প্রেয়সী পর্ব-১২+১৩

0
219

#প্রেয়সী♥️🥀
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্বঃ১২

২৩.

ভোর রাতের অন্ধকার টুকু কুয়াশার মতো আস্তে আস্তে উড়ে যাচ্ছে। বেডের পুর্ব দিকে বিশাল আকারের এক জানালা। আর তার পাশ ঘেঁষেই বিশাল ব্যাকলনি। ব্যালকনির থাই-টা চাপিয়ে ব্যালকনিতে পা রাখতেই বাইরের শীতল বাতাসে মনের বিষন্নতা কেটে গেলো আমার। কয়েক-ঘন্টা যাবত ঘটে চলা ঘটনা গুলো যেন নিস্তব্ধতায় হারিয়ে গেল। আমি মনে খুলে নিঃশ্বাস নিলাম। এই সাইড টা বাড়ির পেছনের দিক। আমার চোখের সামনেই অন্ধকার কেটে আস্তে আস্তে বড় বাগানটা স্পষ্ট হয়ে আসছে। বাতাসের সাথে সাথে ভেসে আসছে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলেদের সুগন্ধ। মনটা আরও ভরে উঠলো সেই সুবাসে। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার হাতের ডান দিকেই একটা বড় কৃষ্ণচূড়া গাছ। আমার ব্যালকনি ছাড়িয়েও আরও একটা ব্যলকনি জুড়ে তার বিচরন। চোখ আঁটকে গেলো আমার পাশের ব্যালকনিটায়। কতটা তাজা আর প্রাণোচ্ছল সম্পূর্ণ জায়গাটা। তার পুরো এক সাইড জুড়েই ফুল গাছ দিয়ে ভরে আছে। আর প্রত্যেকটা গাছের মাথায় তাজা ফুল। তাদের মিহি সুগন্ধে নিশ্চয়ই এর মালিক প্রতিনিয়ত মাতাল হয়। আমিও হচ্ছি। একদম মাঝ বরাবর দুজন মানুষ পাশাপাশি বসার মতো পার্ফেক্ট একটা দোলনা বাতাসের তালেই থেকে থেকে দুলছে। দোলনার উপর কালো গিটারটাও বেশ আয়েস করে বসেই যেন দোল খাচ্ছে। আর তাদের থেকেই যথেষ্ট দূরত্ব রেখে পাশাপাশি অবস্থান করছে একখানা বেতের মোড়া। তার পাশের ছোট্ট টি-টেবিলটার উপর স্থান পেয়েছে এক খানা বই আর ধোঁয়া উড়ানো এক মগ কফি। ভেতরের রুমে আলো জ্বলছে। ভেতরের মানুষটার মুখ দর্শন না হলেও বেশ বুঝতে পারলাম এটা রাফিদ ভাইয়ার বিশিষ্ট রুম। রুমের প্রতিটি জিনিসই তা যেন গর্বের সাথে চিৎকার পেড়ে বলবে, “হ্যাঁ আমি রাহিয়ান রাফিদের সম্পদ।”

কথাটা ভাবতেই মনে মনে হেসে ফেললাম আমি। এসব কি ভাবছি আমি বোকার মতো। হাসতে হাসতেই উনার ব্যালকনি থেকে দৃষ্টি ফেরলাম। উনি খুব গোছালো মানুষ বোঝাই যায়।

—-” কফি খাবে?”

পেছন থেকে করোর কন্ঠ পেতেই চমকে উঠলাম আমি। এটা হলো নিজের খেয়ালে থেকে বেশি বেশি ভাবার ফল। আমার চমকে ওঠার দশা দেখে হয়তো পেছনের মানুষটাও ভড়কে গিয়েছেন। চটপট পেছনে ফিরে রাফিদ ভাইয়ার শুঁকনো মুখটা আবিষ্কার করলাম। মুখে জোরপূর্বক হাসি টানার চেষ্টা করে করে আমতাআমতা করে বললাম,

—-” হ..হাই!”

নিজের এমন আবুল মার্কা রিয়াকশনে নিজেই বোকা বনে গেলাম। উনি বিমল চাহনি দিয়ে বললেন,

—-” হ্যালো।”

—-” ক..কিছু বলবেন?”

—-” কফি।”

—-” জ্বী?”

—-” কফি খাবে?”

উনি আমাকে কফি নিয়ে সাধছিলেন। আমি উনার প্রস্তাবের কোনো জবাব দিতে পারলাম না। হঠাৎ-ই বাবার কথা মনে পড়ে গেলো। কফি নিয়ে বাবার পাগলামি গুলো মনে পড়তে লাগল। এখন বাবা থাকলেও নিশ্চয়ই একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে আসতো, নিধি কফি খাবি মা?” নিঃশ্বাস ভরে আসলো। টেনে নিয়ে নিঃশ্বাস ফেলতে রাফিদ ভাইয়া আবারও জিজ্ঞেস করলেন,

—-” খাবে?”

—-” না। আ..আচ্ছা বড় খালামনিরা কি পৌঁছেছে বাবাকে নিয়ে? ফোন করেছিলো? কিছু জানিয়েছে? বাবার শারীরিক কন্ডিশন এখন কেমন… কিছু…”

—-” রিলাক্স নিধি! এতো হাইপার হতে নেই। রিলাক্স। বসো এখানে, বসো বসো।”

আমি উনার কথায় হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছি। কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বললাম,

—-” বসবো? বসবো কেন?”

উনি পাশ থেকে ছোট্ট মোড়াটা টেনে আমাকে বসতে ইশারা করে বললেন,

—-” সিট। আমি এক্ষনি আসছি।”

এই বলেই বড় বড় ধাপ ফেলে চলে গেলেন উনি। আমি বসতে বসতে উনার যাওয়ার পানে তাকালাম। উনি হঠাৎ আমাকে বসিয়ে এভাবে চলে গেলেন কেন? কাউকে ডাকতে? নাকি কিছু নিতে?

একটা ছোট্ট ট্রে-তে করে এক মগ কফি নিয়ে হাজির হলো রানির মতো দেখতে সেই মেয়েটি। ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণ মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকে আশেপাশে নজর বুলালো। হয়তো আমাকেই খুঁজছে। হঠাৎ আমাকে ব্যালকনিতে দেখতে পেয়ে যেন চমৎকার হাসলো। আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,

—-” আপনি এখানে? আমি তো আরও ভাবলাম ছোটসাহেবের ঘরে।”

মেয়েটার ভয়েস টোনে আমি হকচকিয়ে গেলাম। আর তার কথার ধরন। শুদ্ধ বাংলা। সচারাচর কাজের মেয়েরা কখনো এতো সুন্দর করে কথা বলে না। কারন অনেকেই বলে, কাজের মেয়েদের মুখে শুদ্ধ কথা নাকি শোভা দেয় না। যদিও আমি তা মানিনা। কেননা, সব মানুষই সমান। আর তাদের সব ভাষাতেই কথা বলার অধিকার আছে। হতে পারে তারা গরীব,তাদের যথেষ্ট অর্থ সামর্থ্য নেই যে, ধ্বনিদের মতো তারা চলাফেরা করতে পারে। তাই বলে ধ্বনিদের জু/লু/মে নিজের পরিশুদ্ধ ভাষাটাকেও বিসর্জন দিবে? এটা অ/ন্যা/য়।

মেয়েটা আমার সামনে হাঁটু ভে/ঙে বসলো। হাতে ধরে রাখা ট্রে-টা থেকে কফির মগটা উঠিয়ে আমার হাতে দিতে দিতে বলল,

—-” ছোটসাহেব বলল, আপনাকে কফি দিতে। খেয়ে নিন চটপট। ছোটসাহেবের মতে কফি নাকি শরীরের ক্লান্তি দূর করে। আপনিও তো খুব ক্লান্ত। আর তা আপনাকে দেখলেই বোঝা যায়। আপনি যখন ঘন্টা খানিক আগে আসলেন বাসায় তখনই আমার ইচ্ছে করছিলো আপনাকে সাস্থ্যসম্মত অনেক পদের খাবার বানিয়ে দেই। খেয়ে দেয়ে আপনি একটু বিশ্রাম করবেন। কিন্তু ভাবি বলল,আপনার মন খুব খারাপ। কিছুক্ষন আপনাকে একা ছেড়ে দিতে। আপনি কিছুক্ষণ একা থেকে মনটা ভালো করুন তারপর সবাই মিলে আপনার সাথে থাকবে। আপনাকে সময় দিবে। যেন আপনার আর মন খারাপ না থাকে।”

মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি শুঁকনো হাসি দিলাম। মেয়েটা সত্যিই খুব চমৎকার করে কথা বলে। কিছুক্ষন শুনলে মন ভালো হওয়া সম্ভব।

আমাকে হাসতে দেখে মেয়েটাও হাসলো। হাতে ভর দিয়ে যাওয়ার তাগিদ দেখিয়ে বলল,

—-” আপনি কফি টা খেয়ে এখানেই রেখে দিয়েন। আমি আবার এসে নিয়ে যাবো।”

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তেই মেয়েটা মুচকি হেসে চলে গেলো। প্রকৃতিতে ততক্ষণে দিনের আলো ফুটে উঠেছে। এক্ষনি হয়তো সূর্য মামারও স্নিগ্ধ আলোতে ঝলমলে হয়ে উঠবে প্রকৃতি। এসব ভাবতে ভাবতেই চুমুক বসালাম কফিতে। কফিটাও বেশ ভালো হয়েছে। এই নিরস প্রাণহীন সকালটাতে যেন প্রান ঢেলে দিলো এক মগ কফি।

২৪.

—-” লিয়া এসেছিলো কফি নিয়ে?”

রাফিদ ভাইয়ার কন্ঠ পেয়ে প্রকৃতি থেকে মুখ ফেরালাম। উনার পরনের ধূসর রঙের টি-শার্টটার সাথে হাতে ধরে রাখা ধূসর রঙের ল্যাপটপ টা একদমই মিশে গিয়েছে। একই রঙ। অন্যহাতে কফির মগ। মগের চারপাশ জুড়ে উনার মনকাড়া হাসির চ্যাপ্টা আকারের একটা ছবি। হাঁটু সমান হাফ ট্রাউজার। ফর্সা পা টা কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছে মনে হচ্ছে। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। উনি আরেকটা মোড়া নিয়ে সেটার উপর ল্যাপটপ রাখতে নিলে একহাতে সম্ভব হলো না।

আমি আস্তে করে বললাম,

—-” এদিকে দিন আমি রেখে দিচ্ছি।”

আমার কথায় উনি কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালেন। ল্যাপটপটা এগিয়ে দিতে গিয়েও আবার থেমে গেলেন। অন্য হাতে কফির মগটার দিকে তাকিয়ে করুন সুরে বললেন,

—-” তুমি এটা ধরো।”

আমি ঘাড় কাত করে ছোট্ট করে বললাম,

—-” হু।”

উনি কফির মগটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঘুরে ফিরে ছোট্ট একটা টি-টেবিল নিয়ে এলেন। মোড়ায় বসে ল্যাপটপ টা টেবিলে রেখে ওপেন করে কয়েকটা ফোল্ডার ঘাটাঘাটি করে হঠাৎ আমার দিকে তাকালেন। অপরাধী গলায় বললেন,

—-” সরি সরি! আমি তো ভুলেই গিয়েছি দুটো কফির মগই তোমার হাতে। খাচ্ছো কোন হাতে বলোতো?আমাকে বলবেনা একটা নিতে?”

আমি ছোট্ট করে হাসলাম। কিছু বললাম না। উনি এক মগ উনার হাতে তুলে নিয়েই তৎক্ষনাৎ চুমুক বসালেন। আমিও আর সাত পাঁচ ভাবলাম না। উনার ল্যাপটপে দৃষ্টি রেখে আমিও আবার চুমুক বসালাম। কিন্তু বিপত্তি হলো কফির স্বাদে। একটু আগে যেটা খেয়েছি তাকে হার মানিয়েই নিঃসন্দেহে বলা যায় এটাই হলো বেস্ট কফি। কিছু একটা মনে হতেই ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো আমার। আমি আমার কফি রেখে রাফিদ ভাইয়ার কফির মগটার দিকে তাকাতেই যেন আকাশ থেকে হুমড়ি খেয়ে নীচে পড়লাম। আমার কাশি লেগে গেল তৎক্ষনাৎ। কাশতে কাশতে কফির মগটা টে-টেবিলে রাখলাম। আমার কাশি দেখে রাফিদ ভাইয়া চমকে উঠলেন। উনি ল্যাপটপ ছেড়ে আমাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে গেলেন। দৌড়ে গেলেন ভেতরের রুমে, হয়তো পানি নিতে। আমি উনার অগোচরেই আবারও কফির মগ চেঞ্জ করে দিলাম। মনের অজান্তেই ভীষণ ভ/য় হচ্ছে। বিব্রত লাগছে। আমি উনার কফির মগ থেকে চুমুক দিয়ে খেয়েছি। আল্লাহ, একথা উনি যেন বুঝতে না পারেন! এটা সিক্রেট থাকুক তোমার আর আমার মাঝে। ছ্যা ছ্যা! কি কান্ড গো।

রাফিদ ভাইয়া হাজির হলেন পানির বোতল নিয়ে। আমার পাশে বসতে বসতে অসহায় কন্ঠে বললেন,

—-” পানিটা খেয়ে নাও। বিষম লাগলে কেন হঠাৎ?”

আমি মাথা নীচু করেই পানির বোতল হাতে নিলাম। কেন বিষম লাগলাম সে কথা বলার মতো হলে ঠিকই বলতাম। একদম গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতাম! কিন্তু সে কথা যে বলার মতো নয়!

উনার প্রশ্নবিদ্ধ মুখ চেয়ে আমি কিছুই বলতে পারলাম না। হয়তো উনিও বুঝে নিলেন এর জবাব আমার কাছে নেই। তাই উনিও আর কথা না বাড়িয়ে ল্যাপটপ ঘাঁটতে লাগলেন। ল্যাপটপ ঘাঁটতে ঘাঁটতে হাত ঘড়িতে সময় দেখে বললেন,

—-” আর মাত্র ত্রিশ মিনিট।”

আমি কফিতে চুমুক দিয়ে বললাম,

—-” কিসের ত্রিশ মিনিট?”

—-” মা আর ত্রিশ মিনিট বাদে কল দিবে। আর তার জন্য আমাদের ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে।”

আমি উত্তেজিত কন্ঠে বললাম,

—-” বাবাকে নিয়ে সবাই পৌঁছে গিয়েছে?”

রাফিদ ভাইয়া অসহায় চোখে তাকালেন। বললেন,

—-” পৌঁছে যাবে নিধি। এতো টেনশন করো না।”

আমি মিইয়ে গেলাম। বাবার টেনশনে নিধি ঠিক পাগল হয়ে যাবে। উনি বোধকরি আমার মনের অবস্থা বুঝে নিলেন। কন্ঠে ভারী উৎসাহ নিয়ে বললেন,

—-” একটা জিনিস দেখবে?”

উনার উৎসাহ ঘেরা স্বরের সঠিক কারন খুঁজে পেলাম না। আমি নিজের মুখভঙ্গিমা একই রেখে বললাম,

—-” কি জিনিস?”

উনি মিষ্টি হেসে বললেন,

—-” ওয়েট দেখাচ্ছি।”

উনি ল্যাপটপে মনোযোগ দিলেন আর আমি কফিতে। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটা আরও একবার বারি খেলো মাথার মধ্যে। উনার মগের কফির স্বাদ এই কফির থেকে ভিন্ন। কিন্তু দুটোই ব্ল্যাক কফি। তবে স্বাদ আলাদা হওয়ার কারন কি হতে পারে বুঝতে পারলাম না। ইচ্ছে করছে জিজ্ঞেস করি, কিন্তু সমস্যা হলো মনটা দু’দিকে ছুটছে। একবার মনে হচ্ছে জিজ্ঞেস করি,তো আরেকবার মনে হচ্ছে ভুল করেও নয়!

—-” এই যে দেখো।”

উনি ল্যাপটপটা ঘুরিয়ে ধরলেন আমার দিকে। ল্যাপটপের পুরো স্ক্রিন জুড়ে এক কিশোরীর চাঞ্চল্যকর ছবি ভাসছে। তার মুখ জুড়ে এক মন জুড়ানো হাসি। গাছ থেকে পেয়ারা পারছে। পেয়ারা গাছটা আহামরি বড় না। ছোটই বলা যায়। কিন্তু তার গাছের অগণিত পেয়ারা এক বিশাল গাছের প্রত্যাশিত ফলকেও হার মানিয়ে দিলো। কিশোরির চোখ জোড়া কোনো এক নির্দিষ্ট দিকে নিবদ্ধ। হয়তো গাছের মালিক যে পথ ধরে আসবে সেই পথেই তার ধুরুধুরু মন চোখ জোড়া নিবদ্ধ করেছে।

চোখের পলক পড়তেই ছবিটা পাল্টে গেলো। এবার আসলো আরেক মন জুড়ানো ছবি। এই ছবিতে তিনজন কিশোরী। মাঝে যে দাঁড়িয়ে তার লম্বা দুই বিনুনি টেনে ধরেছে দু’পাশের দুজন। তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে ফুঁসে ওঠা রা/গ। সে গাল ফুলিয়ে কোমরে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। আর দু’পাশের দু’জন কিশোরী একহাতে তার বিনুনি টেনে অন্যহাতে মুখ টিপ হাসছে।

তাদের হাসি দেখে আমার ঠোঁটের কোনেও এক চিলতে হাসির রেখা ফুটলো। আমিও হাসলাম। আবারও ছবি পরিবর্তন হলো। এই হাসিতেও সেই চাঞ্চল্যতা। এবারের ছবিটা বেশ কাছ থেকে। কিশোরীর মুখের গঠন এবার সবটাই স্পষ্ট। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম তাকে। নীল রঙা একখান সালওয়ার কামিজ পড়া। কামিজের হাতা কনুই পর্যন্ত বরাদ্দ। এই ছবিতে কিশোরী বেশ উদাসীন। তার দু-হাত উঠে আছে তার লম্বা বিনুনিতে। এবার তিনি নিজেই নিজের বিনুনি টেনে ধরে আছেন। এই ছবিটা বোধকরি তার আগোচরে তোলা। পাশ থেকে রাফিদ ভাইয়ার শীতল কন্ঠে ভেসে আসল,

—-” এটা ছোটমনির পনেরো বছর বয়সের ছবি নাকি। বড় মামু আর নানাভাই কোন এক অপ্রাসঙ্গিক কারনে ছোটমনিকে নাকি খুব বকা দিয়েছিলেন আর তার জন্যই ছোটমনির মুখটা এমন উদাসীন ছিলো। সারাদিন নাকি কারোর সাথে এক মিনিটের জন্যও দুষ্টুমি করেননি। মা বলে সবসময়, ছোটমনি নাকি খুব বেশিই দুষ্ট ছিলো। পুরো এলাকার মানুষ ছোটমনির নাম শুনতে দৌড়ে পালাতো। এলাকায় নাকি এমন কোনো মানুষ ছিলো না যাদের ছোটমনি জ্বালাতো না। আমরা সব ভাইবোনরা একসাথে হলে মা প্রায়ই এই মানুষটার গল্প করতো! আমি তাকে কখনো না দেখেই ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি জানো। আমার বরাবর খুব আক্ষেপ ছিলো ছোট মনিকে যেন একবার দেখতে পাই। শুধু একবার হলেও হবে, আমি ছোটমনিকে দেখতে চাই… কিন্তু….”

উনি হঠাৎই কথা থামিয়ে দিলেন। আমি উনার দিকে মুখ উঁচিয়ে তাকাতে উনি আমার পায়ের কাছে নেমে এলেন। আমি অবাক নয়নে উনার কার্যকলাপ দেখতে উনি আহতকন্ঠে বলে উঠলেন,

—-” হেই, আর ইউ ক্রায়িং!!”

উনার বাক্যে আমি আশ্চর্যান্বিত হলাম। উনার কথার সত্যতা যাচাই করতে হাত তুলে গালে রাখতেই জলে হাত ভিজে উঠলো আমার। আমি আবারও অবাক হলাম। সত্যিই যে আমার চোখে জল! কিন্তু আমি তো কাঁদছিনা! একটুও কাঁদছি না তবে এই জল?

—-” আ’ইম সরি নিধি! আ’ইম রিয়েলি ভেরি সরি। আমি আসলে বুঝতে পারিনি। সরি!”

আমি দেখছি উনার অসহায়ত্ব ভরা মুখ টা। উনি আমাকে কোনো এক কারনে সরিও বলছেন কিন্তু আমি উনাকে বাঁধা দিতে পারছিনা। বলতে পারছিনা ইট’স ওকে। আমার ভেতরে এক অসহ্য য/ন্ত্র/ণা হচ্ছে। লন্ডভন্ড হচ্ছে মন। গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কেন? ল্যাপটপের স্ক্রিনে যার মুখটা ভাসছে সেই মানুষটা আর আমার জীবনে নেই বলে? আমার মা না থাকার আক্ষেপে আমার এই অসহনীয় য/ন্ত্র/ণা?
.
.
.
.

#চলবে____________________

#প্রেয়সী🥀🖤
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্বঃ১৩

২৪.

বড় খালামনির কল পেয়ে বেশ খানিকক্ষণ কেঁদেছিলাম। বাবা ঠিক আছে, ওখানে উনারা ঠিক ভাবেই পৌঁছেছেন এ সবটাই বড় খালামনি আমাকে বুঝিয়ে বললেন তবুও মন মানছিলো না! হয়তো বাবার সাথে আমি যেতে পারলে বাবা সুস্থ আছে জেনেও এতোটা ক/ষ্ট হতো না। শুয়ে আছি কাঁথার নিচে। রুমের মধ্যে এসি চলছে। এসির গন্ধে থেকে থেকে আমার গা গুলিয়ে উঠছে! মাথাটা ভীষণ ভার ভার হয়ে আছে। ইচ্ছে করছে না উঠে গিয়ে এসি টা বন্ধ করে দিতে। এসির রিমোট টা নিয়ে রিম্মি আপু কতক্ষণ পাওয়ার কমিয়ে বাড়িয়ে কোথায় রাখলো সেটাও দেখা হলো না। এখন এই ঘর দুপুর বেলা কাকেই বা ডেকে বলবো এসি বন্ধ করতে। আর বললে উনারাই বা কি ভাববেন?

পুরো বেডটা ভাইব্রেট করছে। কাঁথার নীচ থেকে ফোন হাতাচ্ছি। কল এসেছে। নিতু আপুর কল নাকি হৃদের কল? ফোনটা হাতে তুলতে তুলতে নামটায় চোখ বুলিয়ে নিঃশ্বাস ফেলে কানে ধরলাম। ওপাশ থেকে নিতু আপু বলে উঠলো,

—-” নিধি, আমি আর রাফিন আজ পাঁচ টার দিকে একবার তোর ওখানে আসছি। তুই কিন্তু রেডি থাকবি.. তোকে নিয়ে আজ বেরোবো।”

—-” কোথায় যাবে?”

—-” ইবনাত গার্ডেন। তোর ফেভারিট প্লেস।”

—-” হঠাৎ?”

—-” তোর মনটা তো একদমই ভালো নেই রে। তাই ভাবলাম ওখানে গিয়ে কিছুক্ষন সময় কাটালে তোর ভাল্লাগবে।”

—-” আপু আজ থাক না প্লিজ। আমরা কাল যাই?”

—-” কাল? কেন রে? আজই চলনা! প্লিজ…”

—-” বলছি কি, শুনো না? আজ কোথাও না যেয়ে তুমি আর রাফিন ভাইয়া বরং এখানেই চলে আসো না।

—-” ওখানে চলে আসবো বলছিস?”

—-” হ্যাঁ গো তোমরা এখানেই চলে এসো। এখানে আরও অনেকে আছে। তোমরা আসলে সবাই মিলে জমপেশ একটা আড্ডা হবে।”

—-” আচ্ছা সোনা আসবো। আচ্ছা তোর শরীর ঠিকাছে তো? গলার স্বর তো ঠিক নেই মনে হচ্ছে! আবার জ্বর আসলো নাকি?” (আতংকিত গলায়)

—-” উঁহু তেমন কিছু নয়! কাল থেকে তো কম ধকল গেলো না সবার উপর থেকে। সারা রাত তো একফোঁটাও ঘুমানোর জো ছিলো না। ভোর রাতে বাসায় ফিরেও আর ঘুম আসলো না। অবশেষে বড় খালামনির সাথে কথা বলে তবেই শান্তি। এখন সব শান্তি শেষে শরীরও আর সঙ্গ দিচ্ছে না। হাত পা সব ভেঙেচূড়ে আসছে। তাই হয়তো ক্লান্তির জন্য ভয়েস এমন লাগছে।

—-” হ্যাঁ রে। সেটাই কথা। আচ্ছা সোনা রেস্ট নে তুই। আমি এখন রাখলাম,আর শোন? যদি বেশি শরীর খারাপ লাগে তবে কল দিস আমায়।”

—-” হু দেবো। আচ্ছা শুনো, তুমি আসার সময় আমার একটা কাজ করে দিতে পারবে?”

—-” হ্যাঁ বলনা?”

—-” আসলে, গত কাল সকালে ভার্সিটির সিনিয়র ভাইয়ারা আমায় তাদের এসাইনমেন্ট গুলো ধরিয়ে দিয়েছিলেন র‍্যাগিংয়ের সূত্রে। তুমি ঐ ফাইল গুলো সঙ্গে করে নিয়ে আসতে পারবে প্লিজ? তাহলে আমি এখানে বসেই সেগুলো কমপ্লিট করে উনাদের দিতে পারতাম।”

—-” এই অবস্থায় তুই কি করে….”

—-” হয়ে যাবে। তুমি চাপ নিও না। তুমি একটু কষ্ট করে নিয়ে এলেই হবে। প্লিজ!”

—-” আরে প্লিজ বলছিস কেন? আমি নিয়ে আসবো তুই টেনশন করিসনা।”

—-” থ্যাংকস আপু”

নিতু আপু আর কথা না বাড়িয়ে কল কাটলো। আমিও ফোনটা পাশে রেখে চিত হয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার খুব ঘুমানোর প্রয়োজন বুঝতে পারছি কিন্তু ঘুম আসছে না একফোঁটাও। চোখ বন্ধ করতেই হঠাৎ হৃদের কথা মাথার মধ্যে বারি খেয়ে উঠলো। ইদানীং তার হালচাল কিছু ঠিক বলে মনে হচ্ছে না। কেমন যেন হঠাৎ পরিবর্তন। এই এক মাস আগেও সে এমন ছিলোনা! সারাক্ষণ তো শুধু কলের উপরই রাখতো। রোজ দুই বেলা মিট করতে আসতো। এই সেই করেই তো আমাদের সম্পর্কের একটা বছর অনায়াসে পার হয়ে গেলো। টেরই পেলাম না কখন একবছর হয়ে গেলো। হৃদ পরিবর্তন হয়েছে! একটু নয় বেশ অনেকখানিই তার পরিবর্তন চোখে পড়ছে। সময় করে ভাবা হয়নি বলেই আগে মনে হয়নি। আমি তো ভেবেছিলাম বাবার এই অবস্থায় ও আমাকে একা ফেলে কখনোই যাবেনা। সারাক্ষণ আমার সাথে থাকবে কিন্তু ও এমন কিছুই করলো না। কেবল আমায় অবাক করে গেলো। একেরপর এক আ/শ/ঙ্কা জাগিয়ে তুলছে আমার মনে। দায়িত্বের খাতিরেও তার একটা কল তো প্রাপ্যই ছিলো তাই না? বাবা এখন কেমন আছেন বা ডক্টররা বাবার শারীরিক কন্ডিশন দেখে কি বললেন? তাছাড়া বাবার কি হয়েছে? এই প্রশ্নটাও সে একটাবারও করলো না! হসপিটাল থেকে বেরিয়ে গিয়ে সে একটা বার কলও করলো না! কি করে? কি হয়েছে তার? তার হঠাৎ এমন আমূল পরিবর্তন কি করে হতে পারে? আর কেনই বা হবে?

এসব প্রশ্ন নিজেই নিজেকে করতে করতে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি জমালাম। যখন ঘুম ভাঙল তখন প্রকৃতি সূর্য মামাকে বিদায় দিতে ডালা সাজাচ্ছিলো। আমি নড়েচড়ে উঠতেই শরীরের ভার সহ্য করতে পারলাম না। মৃদুস্বরে আ/র্ত/না/দ করে আবারও বিছানা আঁকড়ে পড়ে রইলাম। শরীরে এমন ব্যাথা হলো কেন? শরীরের উষ্ণতায় অস্থির হয়ে গা থেকে কাঁথা সরিয়ে ফেললাম। কিন্তু কাঁথা সরাতেই আবার পড়লাম আরেক বিপাকে। শরীর কাঁপিয়ে শীত লাগছে। থরথর করে কেঁপে উঠলাম। মনে মনে ভাবলাম, সারাবছরের শীতেও তো এমন করে কাঁপিনি। বুঝলাম হাড় কাঁপানো জ্বর এসেছে। শরীরের সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলাম। শুয়ে থাকতে থাকতে শরীর যেন আরও বি/ষে/র মতো ব্যাথা করছে। উঠে বসে কাঁথা টা হাত বাড়িয়ে নিতে গেলেই মনে হলো কপাল খুলে পড়বে। জ্বরের ঘোরেই চমকে উঠলাম। ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো।

আসলেই কি আমার কপাল খুলে পড়লো নাকি? কি অদ্ভুত! লোকে দেখলে কি বলবে? ঐ দেখো দেখো মেয়েটার কপাল নেই! আশ্চর্য, সত্যিই কি আমার কপাল নেই? দেখতে হচ্ছে তো। আমার সামনেই বিশাল এক আয়না। আমি সেখান থেকেই নিজের কপালে হাত বুলিয়ে দেখতে লাগলাম। মন যা বলছে মস্তিষ্কও তাই বলছে! সত্যিই আমার কপাল খুলে পড়েছে। সেই দুঃখে আমার ভীষণ কান্না পেয়ে গেলো। আমি হাত পা ছড়িয়ে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদতে লাগলাম। কি সাং/ঘা/তি/ক ব্যাপার হ্যাঁ? নিধির কপাল খুলে পড়েছে! এখন আর খুঁজেও পাচ্ছি না!

কে কোথায় আছো প্লিজ আমার কপাল টা খুঁজে দাও। খুঁজে দাও! আমার কান্নার আওয়াজ ঠিক কতদূর গেলো বুঝতে পারলাম না! কোত্থেকে এক যুবক দৌড়ে এলো। তার সুঠাম দেহে মিষ্টি রঙের শার্টটায় এলোমেলো করে দিলো আমার মন। ঘোর লাগানো চোখে তাকে দেখতে লাগলাম। ভারি পল্লব বিশিষ্ট তার চোখ। সে কি মায়াবী। মাথার চুল গুলো স্পাইক করা। ঠিক একপাশে সবাই চুপটি করে পড়ে আছে। এই মাত্র তাকে দরজার কাছে দেখলেও এখন সে আমার অনেক কাছে চলে এসেছে। তার কাছে আসার ধরন দেখে মনটা হৃদ বলেই ডেকে উঠলো। এটা হৃদ! আঁকড়ে ধরলাম তাকে। বুকের মাঝে মুখ ঢেকে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে বললাম,

—-” দেখো না হৃদ, আমি আমার কপাল খুঁজে পাচ্ছি না। আমার কপাল খুলে পড়েছে! প্লিজ আমাকে আমার কপাল খুঁজে এনে দাও! এনে দাও। খুঁ,,জে এ,,নে দা,,,ও বলছি।(টেনে টেনে)”

নিজের এমন অদ্ভুত কার্যকলাপে মানুষ টার কি অবস্থা হয়েছিলো জানা নেই। কিন্তু আমি একটুও ভাবছিনা! আমার বেশ শান্তি লাগছে তার বুকে। তাকে হৃদ ভাবতে। ভীষণ শান্তি লাগছে।

সে আমাকে তার বুক থেকে টেনে তুলে শান্ত কন্ঠে বলল,

—-” নিধি তোমার শরীর জ্ব/রে পু/ড়ে যাচ্ছে। তুমি প্লিজ এভাবে উঠে বসো না। এখানটাতে শুয়ে পড়ো। আমি বউমনিকে ডেকে আনছি।”

সে চলে যাবে ভেবে আমার আবারও কান্না পেয়ে গেলো ভীষণ। আমি আবারও বাচ্চাদের মতো করে কাঁদতে লাগলাম। ঠোঁট উল্টে নাক ডলে তাকে বললাম,

—-” আ,,মা,,র ক,,পা,,ল খুঁ,,জে না দ,,দিয়ে তুমি কো,,,,থা,,,ওওওও যাবে,,,না হিহি।”

সে অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,

—-” হোয়াট? কপাল খুঁজে না দিয়ে মানে? নিধি সি, তোমার কপাল এই যে তোমার যথাস্থানেই আছে!”

উনি আমার কপাল খুঁজে না দিয়ে বেশি বেশি কথা বলছেন। তা দেখে আমিআবারও ঠোঁট উল্টে তাকালাম। অতঃপর বলতে লাগলাম,

—-” তুমি মিথ্যে ব,,,ল,,ছো! আমার কপাল নেই। নেই। তুমি খুঁজবে এখনই খুঁজবে।”

উনি আমার কথায় বিরক্ত না অবাক ঠিক ঠাহরে উঠতে পারলাম না। উনি আমার কপালে হাত ঠেকিয়ে অসহায় কন্ঠে বললেন,

—-” না জানি কতটা জ্ব/র এসেছে তোমার।”

কথাটা বলেই কিছু একটা খুঁজতে লাগলেন তিনি। আমার পায়ের সাথে পেঁচানো কাঁথা টা টেনে আমার গায়ে পেঁচাতে পেঁচাতে কিছু একটা তুলে নিলেন হাতে। অতঃপর কতক্ষন তার হাতে ধরে রাখা জিনিসটার প্রতি তাকাচ্ছেন তো কতক্ষণ আমার দিকে তাকাচ্ছেন। আমি ঠোঁট উল্টে উনার কান্ড দেখছিলাম। উনি হঠাৎ হেসে ফেললেন। আমি যেন আর লোভ সামলাতে পারলাম না। উনার হাসি মুখটা দেখতেই আমি ঘোর লাগানো কন্ঠে বলে উঠলাম,

—-” আই লাভ ইউর স্মাইল হৃদ, এন্ড আই লাভ ইউ অলসো।”

উনি কিছু বললেন না। আমি “আই লাভ ইউ” বলাতেও উনি ফর্মালিটির খাতিরে “আই লাভ ইউ টু” বললেন না। আমার দিকে শুধু ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ করে বলে উঠলেন,

—-” হেয়ার ইজ ইউর কপাল!”

আমি চোখ দুটো বড় বড় করে উনার হাতের দিকে তাকালেন। সাদা কাপড়ে কিছু একটা ভাজ করা। আমি প্রশ্ন সূচক মুখ করে ঠোঁট উল্টে তাকালাম উনার দিকে। উনি আমার হাত ধরে আমাকে বিছানায় শুইয়ে দিলেন। গায়ে কাঁথা দিয়ে হাতের সাদা কাপড় টা একটা বাটিতে চুবিয়ে আমার কপালে লাগিয়ে দিয়ে বললেন,

—-” এটা তোমার কপাল নয়,এটা জলপট্টির কাপড়। আমিই এটা তোমার মাথায় দিয়ে রেখে গিয়েছিলাম ডক্টর আঙ্কেল কে কল করতে। তোমার জ্ব/রে/র গতিবিধি তেমন সুবিধার নয় তাই ডক্টর আঙ্কেলকে একবার ডাকা খুব জরুরিই মনে হলো। এই যে আবার লাগিয়ে দিলাম এটা। এতে তোমার জ্ব/র/টা একটু হলেও হাল্কা হবে। ডোন্টওয়ারী, ডক্টর আঙ্কেল তোমাকে একবার চেকাপ করে মেডিসিন দিলেই তুমি একদম সুস্থ হয়ে যাবে। এখন একদম গুড গার্লের মতো চুপটি করে শুয়ে থাকো। একদম নড়বে না কিন্তু। তুমি এখন নিজের সেন্সে নেই! তাই এমন করে আবোল তাবোল বকছো। আই আন্ডারস্ট্যান্ড নিধি। তুমি হৃদকে ভীষণ ভালোবাসো। কিন্তু হৃদ… যাক ছাড়ো। তোমার ভালোবাসা নিষ্পাপ সেটা আমি জানি। আর হৃদের ভালোবাসাতেও যে কতটা পা/প মিশ্রিত সেটাও আমি জানি!”

উনি এভাবেই এক নাগাড়ে আরও কতক্ষণ বকে বকে চলে গেলেন। আমি আবারও ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে গিয়েছি। এতক্ষণ ধরে যে কান্ড করেছি তার সবই গুলে খেয়েছি আরও তিনঘন্টা ঘুমিয়ে।

২৫.

রাত ৯ টা বেজে ৩০ মিনিট। ঘরের নিস্তব্ধ পরিবেশে ঘড়ির কাটা সরে যাওয়ার আওয়াজ আমার কানে বিরক্তির ধ্বনি তুলছে। মাথার উপর এখনো জলপট্টির কাপড়টা অবস্থানরত। আমি চোখ খুলতেই পায়ের কাছে নিতু আপুকে দেখতে পেয়ে চমকে উঠলাম। এক লাফে উঠে বসার ইচ্ছে থাকলেও তা মোটেও সম্ভব হলো না। শরীরের সাথে পাল্লা দিয়ে ব্যার্থ হলাম। কাতর কন্ঠে আপুকে ডেকে উঠতেই সামনে থেকে পেছন থেকে আরও অনেকজন উপস্থিত হলো আমার চোখের সামনে। আদ্রিতা আপু আর রিম্মি আপু অসহায় কন্ঠে জানতে চাইলেন, “এখন আমার কেমন লাগছে?”

আমি মিষ্টি হেসে জবাব দিলাম,” ভালো লাগছে।” আমার জবাবে নিশ্চিন্ত হয়েই আদ্রিতা আপু বের হয়ে গেলো। রিম্মি আপু মিষ্টি হেসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে আমার পাশে বসল। অন্য পাশ থেকে নিতু আপু উঠে এলো আমার মাথার কাছে। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু খেয়ে বলল,

—-” তোর এতোটা জ্ব/র এসে যাবে ভাবতে পারিনি। যখন রাফিদ কল করে জানালো তোর এতো জ্ব/র আমার তো যায় যায় অবস্থা! চাচা নেই এখানে। কে সামলাবে তোকে? সবসময় তো তোর জ্ব/রে চাচা কাছে না থাকলে জ্ব/রই সারতো না। কত ডক্টর দেখালেও চাচার সেবা ছাড়া তুই সুস্থ হোসনা। আর তার-উপর থাকতো তোর জ্ব/রের ঘোরে পাগলামি! কিন্তু এবার যে চাচা চাইলেও আর তোর কাছে আসতে পারবেনা। আমার সেই চিন্তাতেই তো…”

নিতু আপুকে থামিয়ে দিলো রিম্মি আপু। ভরসা দিয়ে বলল,

—-” একদম টেনশন নেই। যেখানে আমাদের রাহিয়ান ভাই আছে সেখানে নিধি এক চুটকি বাজাতেই দেখবে ঠিক হয়ে গেছে। আমার ভাইয়ের কাছে জাদু আছে কিন্তু। দেখেছ, বিকেলের জ্ব/র রাতের মধ্যে প্রায় অর্ধেক সেরে গিয়েছে।”

আমি অবাক চোখে রিম্মি আপুর দিকে তাকাতেই নিতু আপু হেসে উঠে বলল,

—-” হ্যাঁ গো রিম্মি। তুমি কিন্তু ভুল বলোনি। ব্যাপার টা নিয়ে কিন্তু আমিও বেশ শকড।”

—-” আরে শকড কি গো? এখনো কত ধামাকা বাকি, বাস দেখতে রাহো।”

কথাটা বলে দুজনেই হেসে উঠলো। আমার অবাক নয়ন কারোরই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারছেনা। কি অদ্ভুত! উনাদের হাসির ইতি টেনে রুমে ঢুকলেন রাফিদ ভাইয়া। সঙ্গে আছেন ফাহিম ভাইয়া আর আর রাফিন ভাইয়াও। রাফিদ ভাইয়ার কাজিন হিমাদ্র ভাই নাকি বড় খালামনিদের সাথে গিয়েছেন। সেকথা জানলাম খালামনির সঙ্গে কথা বলার পর।

রাফিদ ভাইয়া সবাইকে মোটামুটি একচোখে উপেক্ষা করে আমার পাশে এসে দাঁড়ালেন। আমি আঁড়চোখে উনাকে দেখছিলাম। কোনো চিন্তায় বিরক্ত তার কপাল। ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে রিম্মি আপুকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

—-” রিম্মি, বউমনিকে বল নিধিকে খাবার দিতে। ঠিক দশটা নাগাদ এই মেডিসিন গুলো ওকে দিতে হবে। সবটা টাইমলি করতে হবে কিন্তু। গো ফাস্ট।”

রিম্মি আপু উনার আদেশ পালনে মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে ফাহিম ভাইয়াকে উদ্দেশ্য করে বলল,

—-” বাবাকে কল করে বলে দিস রাতের খাবার ফ্রিজে তুলে রাখা আছে।”

রিম্মির আপুর কথায় ফাহিম ভাইয়া মুখ কুঁচকে বললেন,

—-” আমি বাবাকে কল করে কিছুই বলতে পারব না। তুই এসে নিজে থেকে কল দিস।”

রিম্মি আপুর কোনো জবাব এলো না। রাফিদ ভাইয়া রাফিন ভাইয়া আর নিতু আপুর উদ্দেশ্য বললেন,

—-” ডিনার না সেরে কেউ কিন্তু কোথাও যাওয়ার চিন্তা মাথায় আনিস না!”

নিতু আপু অসহায় কন্ঠে বলল,

—-” আমাদের এক্ষনি বের না হলে ঝামেলা হতে পারে।”

রাফিন ভাইয়াও একই সুরে বলল,

—-” হ্যাঁ রে রাহিয়ান। নিতুর প্রবলেম হবে।”

নিতু আপু আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

—-” এখন বরং বাসায় ফিরি রে। কাল সকাল সকাল আবার চলে আসবো তোর কাছে।”

আমি করুন সুরে বললাম,

—-” আজ রাতটা আমার কাছে থেকে গেলেই পারতে!”

—-” ইচ্ছে ছিলো রে। কিন্তু ভাইয়া কল করে একগাদা কথা শোনালো। তাই থাকতে পারছিনা।”

—-” হিমেল ভাই বকলো তোমায়?”

—-” তেমন কিছু না। ওর যেমন ন্যাচার।”

—-” চলে যাবে তাহলে?”

—-” হ্যাঁ রে। কাল আবার চলে আসবো দেখিস। জলদি সুস্থ হয়ে ওঠ সোনা। তোকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে ভালো লাগেনা!”

আমি ছোট্ট করে হাসলাম। নিতু আপু আমার মাথায় হাত বুলিয়ে উঠে গেলো। রাফিন ভাইয়া আর নিতু আপুর সাথে ফাহিম ভাইয়াও কল পেয়ে বেরিয়ে গেলো। এখন এই আবদ্ধ রুমে কেবল আমি আর রাফিদ ভাইয়া। উনি শুঁকনো মুখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমার ঔষধ গুলো চেক করে যাচ্ছেন। আর আমি আঁড়চোখে উনাকে দেখছি। উনি আমার দিকে না দেখেই হঠাৎ মোটা স্বরে প্রশ্ন ছুঁড়লেন,

—-” কিছু বলবে?”

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লাম। উনি এবার নরম গলায় বললেন,

—-” বলো?”

আমি শুঁকনো মুখে বললাম,

—-” বাড়িতে সবাই আপনাকে রাহিয়ান বলে কেন ডাকে?”

আমার প্রশ্নে উনি আঁড়চোখে তাকালেন। কিছু একটা ভেবে বলে উঠলেন,

—-” কেন? নামটা তোমার পছন্দ নয় বুঝি?”

আমি ভাবনায় পড়ে গিয়ে বললাম,

—-” না না! পছন্দ নয় কি বলছেন? আমার তো এই নামটাই বেশি ভালো লেগেছে!”

উনি এবার নিঃশব্দে হাসলেন। আমার দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললেন,

—-” বাড়ির সবারও হয়তো এই নামটা বেশি পছন্দ তাই এই নামে ডাকে। চাইলে তুমিও ডাকতে পারো,আই হ্যাভ নো প্রবলেম।”

উনার সম্মতি পেয়ে মনে হলো আকাশের চাঁদ হামলে নিয়েছি। ঠোঁটের কোনে এক চিলতে হাসি ফুঁটিয়ে বললাম,

—-” আচ্ছা আপনার এই নাম কে রেখেছিলো?”

আমার প্রশ্নে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন তিনি। আমার পানে চেয়ে মিষ্টি করে হাসলেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আস্তে করে বলে উঠলেন,

—-” আমার নাম টা ছোটমনি রেখেছিলো। আর রাহিয়ান নাম টা ছোট মনির বরাবরই ভীষণ প্রিয় ছিলো বলে বাড়ির সবাই আমাকে ভালোবেসে এই নামেই ডাকে।”

মায়ের কথা শুনতেই কয়েক সেকেন্ডের জন্য দম আঁটকে এলো আমার। তার কথার পিঠে কথা তুলে আর জবাব দিতে পারলাম না। উনি ঢোক গিলে আবারও বলে উঠলেন,

—-” আমার মায়ের বিয়ের এক বছরের মাথায় যখন আমি মায়ের গর্ভে আসি তখন ছোটমনি আর ছোট খালুর প্রথম দেখা হয়েছিলো। ছোটমনি যখন মাকে ছোট খালুর কথা বলতে আসে তখন মা আমার আসার কথা সর্বপ্রথম ছোটমনিকেই জানায়। ছোটমনি আমার কথা শুনতেই আনন্দিত হয়ে বলেছিলে,” দেখিস বুবু তোর প্রথম সন্তান ছেলে হবে আর তার নাম তুই রাহিয়ান রাফিদ রাখবি কেমন? রাহিয়ান নামটা কিন্তু আমার ভীষণ পছন্দের। কখনো যদি আমি না থাকি তাহলে আমার কথা মনে করেই ওকে এই নামে ডাকবি!” ছোটমনির কথা অনুযায়ী মায়ের প্রথম সন্তান ছেলেই হলো। মানে আমি আসলাম এই দুনিয়াতে। আমি পৃথিবীর আলো দেখতেই সর্বপ্রথম ছোটমনির কোলে উঠেছিলাম। সবার আগে ছোটমনিই আমাকে কোলে তুলেছিলো। আর স্নেহ ভরা কন্ঠে আমায় রাহিয়ান নামে ডেকেছিলো। এর পর আস্তে আস্তে আমি ছোট মনির কোলেই মানুষ হতে থাকি। আমার যখন তিন বছর তখন ছোটমনি চলে যায় বাড়ি থেকে। তাদের সম্পর্কটা কেউ মেনে নিতে চায়নি। নানা ভাই বা মামুরা কেউই ছোটমনির ভালোবাসাকে গ্রহণ করেননি। তাই ছোটমনি অভিমান করেই বাড়ি ছাড়লো। পরিবারের প্রত্যেক টা মানুষের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে ফেললো। মা সারাটা জীবন ঐ মানুষটা কে ফিরে পাওয়ার আশায় কেঁদেছে। কিন্তু আর কখনো কোনো হদিশ মিলল না তার। আমি বড় হতে লাগলাম। আর আস্তে আস্তে ছোটমনির ভালোবাসা গুলো ভুলে যেতে লাগলাম। কিন্তু তবুও কোথাও না কোথাও এসে কারোর খুব স্নেহ ভরা ডাকটা মিস করতাম। এতো এতো মানুষের মুখে রাহিয়ান নাম টা শুনলেও ছোটমনির ডাকের মতো সেই তৃপ্তিটুকু পেতাম না।”

আমার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো। এই মানুষ টাও মায়ের থেকে তিন তিনটে বছর পেলো। তিনটে বছর ধরে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পেলো! কিন্তু আমি? আমি এই অভাগী দুটো দিনও তো ঐ মানুষ টার থেকে পেলাম না! উনি আমাকে স্রেফ দুটো দিনও কাছে রাখতে পারলো না! তার আগেই সমস্ত বন্ধন ছিঁড়ে পালিয়ে গিয়েছে। স্বার্থপরের মতো হারিয়ে গিয়েছে মা।

#চলবে____________________