#প্রেয়সী♥️🥀
#লেখনীতেঃmoumita_mehra
#পর্বঃ১২
২৩.
ভোর রাতের অন্ধকার টুকু ধোঁয়া উড়ানোর মতো আস্তে আস্তে উড়ে যাচ্ছে। বেডের পুব-কিনারায় বিশাল আকারের এক জানালা। আর তার পাশ ঘেঁষেই বিশাল ব্যাকলনি। ব্যালকনির থাই-টা চাপিয়ে ব্যালকনিতে পা রাখতেই বাইরের শীতল বাতাসে মনের বিষন্নতা কেটে গেলো আমার। কয়েক-ঘন্টা যাবত ঘটে চলা ঘটনা গুলো যেন নিস্তব্ধতায় হারিয়ে গেল। আমি মনে খুলে নিঃশ্বাস নিলাম। এই সাইড টা বাড়ির পেছনের দিক। আমার চোখের সামনেই অন্ধকার কেটে আস্তে আস্তে বড় বাগানটা স্পষ্ট হয়ে আসছে। বাতাসের সাথে সাথে ভেসে আসছে বিভিন্ন প্রজাতির ফুলেদের সুগন্ধ। মনটা আরও ভরে উঠলো সেই সুবাসে। হঠাৎ খেয়াল করলাম আমার হাতের ডান দিকেই একটা কৃষ্ণচূড়া গাছ। আমার ব্যালকনি ছাড়িয়েও আরও একটা ব্যলকনি জুড়ে তার বিচরন। চোখ আঁটকে গেলো আমার পাশের ব্যালকনিটায়। কতটা তাজা আর প্রাণোচ্ছল সম্পূর্ণ জায়গাটা। তার পুরো এক সাইড জুড়েই ফুল গাছ দিয়ে ভরে আছে্। আর প্রত্যেকটা গাছের মাথায় তাজা ফুল। তাদের মিহি সুগন্ধে নিশ্চয়ই এর মালিক প্রতিনিয়ত মাতাল হয়। আমিও হচ্ছি। একদম মাঝ বরাবর দুজন মানুষ পাশাপাশি বসার মতো পার্ফেক্ট একটা দোলনা বাতাসের তালেই থেকে থেকে দুলছে। দোলনার উপর কালো গিটারটাও বেশ আয়েস করে বসেই যেন দোল খাচ্ছে। আর তাদের থেকেই যথেষ্ট দূরত্ব রেখে পাশাপাশি অবস্থান করছে একখানা বেতের মোড়া। তার পাশের ছোট্ট টি-টেবিলটার উপর স্থান পেয়েছে এক খানা বই আর ধোঁয়া উড়ানো এক মগ কফি। ভেতরের রুমে আলো জ্বলছে। ভেতরের মানুষটার মুখ দর্শন না হলেও বেশ বুঝতে পারলাম এটা রাফিদ ভাইয়ার বিশিষ্ট রুম। রুমের প্রতিটি জিনিসই তা যেন গর্বের সাথে চিৎকার পেড়ে বলবে, “হ্যাঁ আমি রাহিয়ান রাফিদের সম্পদ।”
কথাটা ভাবতেই মনে মনে হেসে ফেললাম আমি। এসব কি ভাবছি আমি বোকার মতো। হাসতে হাসতেই উনার ব্যালকনি থেকে দৃষ্টি ফেরলাম। উনি খুব গোছালো পারসন বোঝাই যায়।
—-” কফি খাবে?”
পেছন থেকে করোর কন্ঠ পেতেই চমকে উঠলাম আমি। এটা হলো নিজের খেয়ালে থেকে বেশি বেশি ভাবার ফল। আমার চমকে ওঠার দশা দেখে হয়তো পেছনের মানুষটাও ভড়কে গিয়েছেন। চটপট পেছনে ফিরে রাফিদ ভাইয়ার শুঁকনো মুখটা আবিষ্কার করলাম। মুখে জোরপূর্বক হাসি টানার চেষ্টা করে করে আমতাআমতা করে বললাম,
—-” হ..হাই!”
নিজের এমন আবুল মার্কা রিয়াকশনে নিজেই বোকা বনে গেলাম। উনি বিমল চাহনি দিয়ে বললেন,
—-” হ্যালো।”
—-” ক..কিছু বলবেন?”
—-” কফি।”
—-” জ্বী?”
—-” কফি খাবে?”
উনি আমাকে কফি নিয়ে সাধছিলেন। আমি উনার প্রস্তাবের কোনো জবাব দিতে পারলাম না। হঠাৎ-ই বাবার কথা মনে পড়ে গেলো। কফি নিয়ে বাবার পাগলামি গুলো মনে পড়তে লাগল। এখন বাবা থাকলেও নিশ্চয়ই একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে আসতো, নিধি কফি খাবি মা?” নিঃশ্বাস ভরে আসলো। টেনে নিয়ে নিঃশ্বাস ফেলতে রাফিদ ভাইয়া আবারও জিজ্ঞেস করলেন,
—-” খাবে..?”
—-” নো থ্যাংক্স। আ..আচ্ছা বড় খালামনিরা কি পৌঁছেছে বাবাকে নিয়ে? ফোন করেছিলো? কিছু জানিয়েছে? বাবার এখন শারীরিক কন্ডিশন কেমন… কিছু…”
—-” রিলাক্স নিধি,,,এতো হাইপার হতে নেই। রিলাক্স। বসো এখানে, বসো বসো।”
আমি উনার কথায় হতবিহ্বল হয়ে তাকিয়ে আছি। কিছু বুঝে উঠতে না পেরে বললাম,
—-” বসবো? বসবো কেন?”
উনি পাশ থেকে ছোট্ট মোড়াটা টেনে আমাকে বসতে ইশারা করে বললেন,
—-” সিট। আমি এক্ষনি আসছি।”
এই বলেই বড় বড় ধাপ ফেলে চলে গেলেন উনি। আমি বসতে বসতে উনার যাওয়ার পানে তাকালাম। উনি হঠাৎ আমাকে বসিয়ে এভাবে চলে গেলেন কেন? কাউকে ডাকতে? নাকি কিছু নিতে?
একটা ছোট্ট ট্রে-তে করে এক মগ কফি নিয়ে হাজির হলো রানির মতো দেখতে সেই মেয়েটি। ভেতরে ঢুকে কিছুক্ষণ মূর্তির ন্যায় দাঁড়িয়ে থেকে আশেপাশে নজর বুলালো। হয়তো আমাকেই খুঁজছে। হঠাৎ আমাকে ব্যালকনিতে দেখতে পেয়ে যেন চমৎকার হাসলো। আমার দিকে এগিয়ে আসতে আসতে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলল,
—-” আপনি এখানে? আমি তো আরও ভাবলাম ছোটসাহেবের ঘরে।”
মেয়েটার ভয়েস টোনে আমি হকচকিয়ে গেলাম। আর তার কথার ধরন। শুদ্ধ বাংলা। সচারাচর কাজের মেয়েরা কখনো এতো সুন্দর করে কথা বলে না। কারন অনেকেই বলে, কাজের মেয়েদের মুখে শুদ্ধ কথা নাকি শোভা দেয় না। যদিও আমি তা মানিনা। কেননা, সব মানুষই সমান। আর তাদের সব ভাষাতেই কথা বলার অধিকার আছে। হতে পারে তারা গরীব,তাদের যথেষ্ট অর্থ সামর্থ্য নেই যে, ধ্বনিদের মতো তারা চলাফেরা করতে পারে। তাই বলে ধ্বনিদের জুলুমে নিজের পরিশুদ্ধ ভাষাটাকেও বিসর্জন দিবে? এটা অন্যায়।
মেয়েটা আমার সামনে হাঁটু ভেঙে বসলো। হাতে ধরে রাখা ট্রে-টা থেকে কফির মগটা উঠিয়ে আমার হাতে দিতে দিতে বলল,
—-” ছোটসাহেব বলল, আপনাকে কফি দিতে। খেয়ে নিন চটপট। ছোটসাহেবের মতে কফি নাকি শরীরের ক্লান্তি দূর করে। আপনিও তো খুব ক্লান্ত। আর তা আপনাকে দেখলেই বোঝা যায়। আপনি যখন ঘন্টা খানিক আগে আসলেন বাসায় তখনই আমার ইচ্ছে করছিলো আপনাকে সাস্থ্যসম্মত অনেক পদের খাবার বানিয়ে দেই। খেয়ে দেয়ে আপনি একটু বিশ্রাম করবেন। কিন্তু ভাবি বলল,আপনার মন খুব খারাপ। কিছুক্ষন আপনাকে একা ছেড়ে দিতে। আপনি কিছুক্ষণ একা থেকে মনটা ভালো করুন তারপর সবাই মিলে আপনার সাথে থাকবে। আপনাকে সময় দিবে। যেন আপনার আর মন খারাপ না থাকে।”
মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে আমি শুঁকনো হাসি দিলাম। মেয়েটা সত্যিই খুব চমৎকার করে কথা বলে। কিছুক্ষন শুনলে মন ভালো হওয়া সম্ভব।
আমাকে হাসতে দেখে মেয়েটাও হাসলো। হাতে ভর দিয়ে যাওয়ার তাগিদ দেখিয়ে বলল,
—-” আপনি কফি টা খেয়ে এখানেই রেখে দিয়েন। আমি আবার এসে নিয়ে যাবো।”
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়তেই মেয়েটা মুচকি হেসে চলে গেলো। প্রকৃতিতে ততক্ষণে দিনের আলো ফুটে উঠেছে। এক্ষনি হয়তো সূর্য মামারও স্নিগ্ধ আলোতে ঝলমলে হয়ে উঠবে প্রকৃতি। এসব ভাবতে ভাবতেই চুমুক বসালাম কফিতে। কফিটাও বেশ ভালো হয়েছে। এই নিরস প্রাণহীন সকালটাতে যেন প্রান ঢেলে দিলো এক মগ কফি।
২৪.
—-” লিয়া এসেছিলো কফি নিয়ে?”
রাফিদ ভাইয়ার কন্ঠ পেয়ে প্রকৃতি থেকে মুখ ফেরালাম। উনার পরনের ধূসর রঙের টি-শার্টটার সাথে হাতে ধরে রাখা ধূসর রঙের ল্যাপটপ টা একদমই মিশে গিয়েছে। একই রঙ। অন্যহাতে কফির মগ। মগের চারপাশ জুড়ে উনার মনকাড়া হাসির চ্যাপ্টা আকারের একটা ছবি। হাঁটু সমান হাফ ট্রাউজার। ফর্সা পা টা কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকাচ্ছে মনে হচ্ছে। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম। উনি আরেকটা মোড়া নিয়ে সেটার উপর ল্যাপটপ রাখতে নিলে একহাতে সম্ভব হলো না।
আমি আস্তে করে বললাম,
—-” এদিকে দিন আমি রেখে দিচ্ছি।”
আমার কথায় উনি কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে তাকালেন। ল্যাপটপটা এগিয়ে দিতে গিয়ে আবারও থেমে গেলেন। অন্য হাতে কফির মগটার দিকে তাকিয়ে করুন সুরে বললেন,
—-” তুমি এটা ধরো।”
আমি ঘাড় কাত করে ছোট্ট করে বললাম,
—-” হু।”
উনি কফির মগটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে ঘুরে ফিরে ছোট্ট একটা টি-টেবিল নিয়ে এলেন। মোড়ায় বসে ল্যাপটপ টা টেবিলে রেখে ওপেন করে কয়েকটা ফোল্ডার ঘাটাঘাটি করে হঠাৎ আমার দিকে তাকালেন। অপরাধী গলায় বললেন,
—-” সরি সরি! আমি তো ভুলেই গিয়েছি দুটো কফির মগই তোমার হাতে। খাচ্ছো কোন হাতে বলোতো?আমাকে বলবেনা একটা নিতে?”
আমি ছোট্ট করে হাসলাম। কিছু বললাম না। উনি এক মগ উনার হাতে তুলে নিয়েই তৎক্ষনাৎ চুমুক বসালেন। আমিও আর সাত পাঁচ ভাবলাম না। উনার ল্যাপটপে দৃষ্টি রেখে আমিও আবার চুমুক বসালাম। কিন্তু বিপত্তি হলো কফির স্বাদে। একটু আগে যেটা খেয়েছি তাকে হার মানিয়েই নিঃসন্দেহে বলা যায় এটাই হলো বেস্ট কফি। কিছু একটা মনে হতেই ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠলো আমার। আমি আমার কফি রেখে রাফিদ ভাইয়ার কফির মগটার দিকে তাকাতেই যেন আকাশ থেকে হুমড়ি খেয়ে নীচে পড়লাম। আমার কাশি লেগে গেল তৎক্ষনাৎ। কাশতে কাশতে কফির মগটা টে-টেবিলে রাখলাম। আমার কাশি দেখে রাফিদ ভাইয়া চমকে উঠলেন। উনি ল্যাপটপ ছেড়ে আমাকে নিয়েই ব্যস্ত হয়ে গেলেন। দৌড়ে গেলেন ভেতরের রুমে, হয়তো পানি নিতে। আমি উনার অগোচরেই আবারও কফির মগ চেঞ্জ করে দিলাম। মনের অজান্তেই ভীষণ ভয় হচ্ছে। বিব্রত লাগছে। আমি উনার কফির মগ থেকে চুমুক দিয়ে খেয়েছি। আল্লাহ, একথা উনি যেন বুঝতে না পারেন! এটা সিক্রেট থাকুক তোমার আর আমার মাঝে। ছ্যা ছ্যা! কি কান্ড গো।
রাফিদ ভাইয়া হাজির হলেন পানির বোতল নিয়ে। আমার পাশে বসতে বসতে অসহায় কন্ঠে বললেন,
—-” পানিটা খেয়ে নাও। বিষম লাগলে কেন হঠাৎ?”
আমি মাথা নীচু করেই পানির বোতল হাতে নিলাম। কেন বিষম লাগলাম সে কথা বলার মতো হলে ঠিকই বলতাম। একদম গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতাম! কিন্তু সে কথা যে বলার মতো নয়!
উনার প্রশ্নবিদ্ধ মুখ চেয়ে আমি কিছুই বলতে পারলাম না। হয়তো উনিও বুঝে নিলেন এর জবাব আমার কাছে নেই। তাই উনিও আর কথা না বাড়িয়ে ল্যাপটপ ঘাঁটতে লাগলেন। ল্যাপটপ ঘাঁটতে ঘাঁটতে হাত ঘড়িতে সময় দেখে বললেন,
—-” আর মাত্র ত্রিশ মিনিট।”
আমি কফিতে চুমুক দিয়ে বললাম,
—-” কিসের ত্রিশ মিনিট?”
—-” মা আর ত্রিশ মিনিট বাদে কল দিবে। আর তার জন্য আমাদের ত্রিশ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে।”
আমি উত্তেজিত কন্ঠে বললাম,
—-” বাবাকে নিয়ে সবাই পৌঁছে গিয়েছে?”
রাফিদ ভাইয়া অসহায় চোখে তাকালেন। বললেন,
—-” পৌঁছে যাবে নিধি। এতো টেনশন করো না।”
আমি মিইয়ে গেলাম। বাবার টেনশনে নিধি ঠিক পাগল হয়ে যাবে। উনি বোধকরি আমার মনের অবস্থা বুঝে নিলেন। কন্ঠে ভারী উৎসাহ নিয়ে বললেন,
—-” একটা জিনিস দেখবে?”
উনার উৎসাহ ঘেরা স্বরের সঠিক কারন খুঁজে পেলাম না। আমি নিজের মুখভঙ্গিমা একই রেখে বললাম,
—-” কি জিনিস?”
উনি মিষ্টি হেসে বললেন,
—-” ওয়েট দেখাচ্ছি।”
উনি ল্যাপটপে মনোযোগ দিলেন আর আমি কফিতে। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ব্যাপারটা আরও একবার বারি খেলো মাথার মধ্যে। উনার মগের কফির স্বাদ এই কফির থেকে ভিন্ন। কিন্তু দুটোই ব্ল্যাক কফি। তবে স্বাদ আলাদা হওয়ার কারন কি হতে পারে বুঝতে পারলাম না। ইচ্ছে করছে জিজ্ঞেস করি, কিন্তু সমস্যা হলো মনটা দু’দিকে ছুটছে। একবার মনে হচ্ছে জিজ্ঞেস করি,তো আরেকবার মনে হচ্ছে ভুল করেও নয়!
—-” এই যে দেখো।”
উনি ল্যাপটপটা ঘুরিয়ে ধরলেন আমার দিকে। ল্যাপটপের পুরো স্ক্রিন জুড়ে এক কিশোরীর চাঞ্চল্যকর ছবি ভাসছে। তার মুখ জুড়ে এক মন জুড়ানো হাসি। গাছ থেকে পেয়ারা পাড়ছে। পেয়ারা গাছটা আহামরি বড় না। ছোটই বলা যায় কিন্তু তার গাছের অগণিত পেয়ারা এক বিশাল গাছের প্রত্যাশিত ফলকেও হার মানিয়ে দিলো। কিশোরির চোখ জোড়া কোনো এক নির্দিষ্ট দিকে নিবদ্ধ। হয়তো গাছের মালিক যে পথ ধরে আসবে সেই পথেই তার ধুরুধুরু মন চোখ জোড়া নিবদ্ধ করেছে।
চোখের পলক পড়তেই ছবিটা পাল্টে গেলো। এবার আসল আরেক মন জুড়ানো ছবি। এই ছবিতে তিনজন কিশোরী। মাঝে যে দাঁড়িয়ে তার লম্বা দুই বিনুনি টেনে ধরেছে দু’পাশের দুজন। তার চোখে মুখে ফুটে উঠেছে ফুঁসে ওঠা রাগ। সে গাল ফুলিয়ে কোমরে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে। আর দু’পাশের দু’জন কিশোরী একহাতে তার বিনুনি টেনে অন্যহাতে মুখ টিপ হাসছে। তাদের হাসি দেখে আমার ঠোঁটের কোনেও এক চিলতে হাসির রেখা ফুটলো। আমিও হাসলাম। আবারও ছবি পরিবর্তন হলো। এই হাসিতেও সেই চাঞ্চল্যতা। এবারের ছবিটা বেশ কাছ থেকে। কিশোরীর মুখের গঠন এবার সবটাই স্পষ্ট। আমি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলাম তাকে। নীল রঙা একখান সালওয়ার কামিজ পড়া। কামিজের হাতা কনুই পর্যন্ত বরাদ্দ। এই ছবিতে কিশোরী বেশ উদাসীন। তার দু-হাত উঠে আছে তার লম্বা বিনুনিতে। এবার তিনি নিজেই নিজের বিনুনি টেনে ধরে আছেন। এই ছবিটা বোধকরি তার আগোচরে তোলা। পাশ থেকে রাফিদ ভাইয়া শীতল কন্ঠে ভেসে আসল,
—-” এটা ছোটমনির পনেরো বছর বয়সের ছবি নাকি। বড় মামু আর নানাভাই কোন এক অপ্রাসঙ্গিক কারনে ছোটমনিকে নাকি খুব বকা দিয়েছিলেন আর তার জন্যই ছোটমনির মুখটা এমন উদাসীন ছিলো। সারাদিন নাকি কারোর সাথে এক মিনিটের জন্যও দুষ্টুমি করেননি। মা বলে সবসময়, ছোটমনি নাকি খুব বেশিই দুষ্ট ছিলো। পুরো এলাকার মানুষ ছোটমনির নাম শুনতে দৌড়ে পালাতো। এলাকায় নাকি এমন কোনো মানুষ ছিলো না যাদের ছোটমনি জ্বালাতো না। আমরা সব ভাইবোনরা একসাথে হলে মা প্রায়ই এই মানুষটার গল্প করতো! আমি তাকে কখনো না দেখেই ভীষণ ভালোবেসে ফেলেছি জানো। আমার বরাবর খুব আক্ষেপ ছিলো ছোট মনিকে যেন একবার দেখতে পাই। শুধু একবার হলেও হবে, আমি ছোটমনিকে দেখতে চাই… কিন্তু….”
উনি হঠাৎই কথা থামিয়ে দিলেন। আমি উনার দিকে মুখ উঁচিয়ে তাকাতে উনি আমার পায়ের কাছে নেমে এলেন। আমি অবাক নয়নে উনার কার্যকলাপ দেখতে উনি আহতকন্ঠে বলে উঠলেন,
—-” হেই, আর ইউ ক্রায়িং!!”
উনার বাক্যে আমি আশ্চর্যান্বিত হলাম। উনার কথার সত্যতা যাচাই করতে হাত তুলে গালে লাগাতেই জলে হাত ভিজে উঠলো আমার। আমি আরও অবাক হলাম। সত্যিই যে আমার চোখে জল! কিন্তু আমি তো কাঁদছিনা! একটুও কাঁদছি না তবে এই জল?
—-” আম সরি নিধি! আম রিয়েলি ভেরি সরি। আমি আসলে বুঝতে পারিনি। সরি!”
আমি দেখছি উনার অসহায়ত্ব ভরা মুখ টা। উনি আমাকে কোনো এক কারনে সরিও বলছেন কিন্তু আমি উনাকে বাঁধা দিতে পারছিনা। বলতে পারছিনা ইট’স ওকে। আমার ভেতরে এক অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে। লন্ডভন্ড হচ্ছে মন। গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু কেন? ল্যাপটপের স্ক্রিনে যার মুখটা ভাসছে সেই মানুষটা আর আমার জীবনে নেই বলে? আমার মা না থাকার আক্ষেপে আমার এই অসহনীয় যন্ত্রণা?
.
.
.
.
#চলবে____________________