প্রেয়সী পর্ব-২৮

0
1201

#প্রেয়সী 🤎🥀
#moumita_mehra
#পর্বঃ২৮

৫৪.

রাত ৯টা। রান্নার কাজ সব কমপ্লিট করেই এসে বসলাম আমার ছোট্ট ব্যালকনিতে। নিজের রুম, নিজের বিছানা, নিজের ব্যালকনি সব কিছুতেই যেন অন্যরকম শান্তি। এতোদিন ধরে ঐবাড়িতে পড়ে না থাকলেও আহামরি কিছু ঘটে যেত না। বরং ওমন রগচটা মানুষের থেকে নিজের দূরত্ব ঠিকই বজায় রাখতে পারতাম। উনি অযথা আমার সাথে এমন ব্যবহার করবেন এটা আমি কিছুতেই মেনে নিবোনা। কেননা উনারও এবার বোঝা উচিত নিধির আত্মসম্মান বোধ সদাসর্বদা একটু বেশিই। দুপুরের ব্যাপারটা মনে পড়লে মনের মধ্যে এখনও এক অসহ্য যন্ত্রণায় হচ্ছে। আমারই ভুল! সব কিছুতে নিজেকে এতোটা ছোট করে ফেলা কখনোই উচিৎ নয়। আগে আত্মসম্মান পরে অন্যকিছু।

—-” নিধি আফা আফনের কল আইছে। নিতু আফা কল দিছে?”

নীচতলা থেকে রানির মুখে নিতুর আপুর কলের কথা শুনতেই জলদি করে নীচে নেমে এলাম। কিন্তু আমার ফোনতো অফ! কিসে কল দিলো তবে?

—-” আমার ফোন তো অফ! তবে নিতু আপুর কল কি করে এলো?”

গলা উঁচিয়ে রানিকে এমন প্রশ্ন করতেই রান্নাঘর থেকে ওর জবাব এলো,

—-” সোফার রুমে খালুর ল্যান্ডলাইনে কল দিছে!”

চাচার ল্যান্ডফোনে কল দিয়েছে? অদ্ভুত!! নিতু আপু কি করে জানল আমি এ বাড়িতে আছি? মনের মধ্যে খানিক অস্বস্তি নিয়েই এগিয়ে গেলাম সোফার রুমে। রানিকে অযথা প্রশ্ন করে লাভ নেই। তার থেকে বরং নিজেই দেখে নিই। ধীরগতিতে ধাপ ফেলে প্রথমেই ল্যান্ডফোনের দিকে তাকালাম। ফোনটা স্বাভাবিক ভাবেই রাখা আছে। অন্যসময় কল এলে তো পাশে উঠিয়ে রাখা হয়। তবে কি কল কেটে দিলো?

—-” নীলাদ্রিতা?”

বেশি দূরে নয়। গুনে গুনে আমার থেকে ঠিক পাঁচ হাত দূরেই অপ্রত্যাশিত মানুষটা বসে আছেন। আমি তার দিকে তাকাতে তাকাতে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। হঠাৎ উনাকে আবিষ্কার করব ভাবতে পারিনি। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল দু’তিনবার। বুকে হাত চেপে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে উনার দিকে ভালো করে তাকালাম। শুঁকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। মনে হচ্ছে না দুপুরের পর থেকে এখনও অব্দি অন্য গ্রহণ করেছেন। বাসায় ফিরেছেন তাও মনে হচ্ছে না। দুপুরে যেই ড্রেসে ছিলেন এখনও সেই একই ড্রেসে আছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো উনি এখানে কেন এসেছেন?

—-” আপনি?”

কন্ঠে ভারী বিরক্তির রস ঢেলে জিজ্ঞেস করলাম উনাকে। উনি শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ালেন। শুঁকনো মুখেই চমৎকার হাসলেন। উনার হাসিতে আমারও মনটা শীতল হয়ে উঠল। কিন্তু উনাকে বুঝতে দিলাম না৷ মুখের ভাব একই রাখলাম,বিরক্তিকর! উনি কিছু বলার প্রয়াস চালাচ্ছেন। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারছেন না। আচ্ছা উনি কি কোনো কারনে আমাকে সরি বলতে চাচ্ছেন? নাকি আমার মস্তিষ্ক একটু বেশি বেশি ভাবছে।

—-” রেগে আছো আমার উপর?”

শোনো কথা? একগাদা কথা শুনিয়ে দিয়ে যে কিনা আমাকে একলা রেখে হুড়মুড় করে চলে গেলো তার উপর রেগে থাকবো না তো কি খুশি হয়ে লুঙ্গি ডান্স মারবো। সারা বাড়িতে খুশিতে পিঠেপুলির উৎসব করে বেড়াবো? ফালতু লোক একটা! ঢং করে আবার জিজ্ঞেস করা হচ্ছে!

আমাকে একই ভাবে চুপ থাকতে দেখে উনি ধাপ ফেলে এগিয়ে এলেন কিছুটা। মুখে এখনও সেই চমৎকার হাসি। উনার মেয়েলি ধরনের চোখ জোড়া হঠাৎ চিকচিক করছে। ভারি পল্লব ঝুঁকিয়ে বারবার চোখও ঝাপটাচ্ছেন। হাত জোড়া এবার ঝুলিয়ে দাঁড়ালেন। সরি বলার জন্য খুব আটঘাট বেঁধে দাঁড়ালেন। কিন্তু উনার সরি বলার সুযোগ আর আমিই দিলাম না। গলা উঁচিয়ে রানিকে ডেকে উঠতেই উনি অস্বস্তিতে পড়ে এক পা পিছিয়ে গেলেন। রানি ওড়নার আঁচলে হাত মুছতে মুছতে দৌড়ে এলো। আমার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,

—-” হ আফা কন?”

আমি দাঁতে দাঁত চেপে রানিকে দিলাম এক ধমক। রানি ধমক খেয়ে চমকে উঠে মুখ কালো করে ফেললো। একবার আমার দিকে তাকাচ্ছে তো একবার রাহিয়ানের দিকে। মুখটাকে কালো করেই কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই আমি আবারও ধমকের সুরে বলে উঠলাম,

—-” তুই একজন বাইরের লোকের জন্য আমাকে মিথ্যে বললি? এতে সাহস বেড়ে গিয়েছে তোর হ্যাঁ? হ্যাঁ রে,তুই চিনিস এই লোককে?”

রানি মাথা নীচু করে না সূচক মাথা নাড়ল। আর যা দেখে আমার মেজাজটা আরও খানিক বিগড়ে গেলো। আমি পূর্বের ভঙ্গিমাতেই বলে উঠলাম,

—-” না চিনে বাসায় কেন ঢুকতে দিয়ছিস? এই শিক্ষা পাস এ বাড়ি থেকে?ছোট থেকে বড় হলি এই বাড়িতে, অথচ মিনিমাম নিয়ম রক্ষা করতে পারিস না? যাকে তাকে যখন তখন বাড়ি বয়ে নিয়ে আসছিস? তোকে আমি শেষবার বারন করে দিচ্ছি রানি এর পরের বার যদি এমন আর করেছিস তো আমার চেয়ে বেশি খারাপ আর কেউ হবেনা। আমার তো ভাবতেই অবাক লাগছে রানি, তুই একজন অপরিচিত লোককে বাসায় ঢুকিয়ে আবার আমাকেই মিথ্যে বলছিস? তোর এমন কাজ যদি চাচি ঘুনাক্ষরেও টের পায় ভাবতে পারছিস কতটা রেগে যাবে চাচি?”

রানি ফুপিয়ে কেঁদে উঠল। আমার দিকে টলমল চোখে তাকিয়ে বলল,

—-” আর কুনো দোষ নাই আফা! উনিই কইল আফনে হেতেরে চেনেন! খুব ভালা সম্পর্ক আফনে গো। আফনে নি রাগ কইরা আছেন উনার প্রতি তাই….”

—-” তো? তাই বলে তুই যাকে তাকে বাসায় ঢুকতে দিবি? তুই বিশ্বাস কি করে করতে পারছিস এসব আমিতো সেটাই বুঝতে পারছিনা?”

—-” ছোরি আফা আই আর এমন কাজ জীবনে করুম না! আফনে খালাম্মারে কিছু কইয়েননা আফা!”

—-” কথা কম বল আর যা এখান থেকে।”

রানি চলে যেতে লাগল। আমি ওকে আবারও থামিয়ে দিয়ে বললাম,

—-” শোন, একটা প্লেট নিয়ে অল্প কিছু বিরিয়ানী আর মুরগীর রোস্ট থেকে দুই টুকরো রোস্ট উঠিয়ে রাখ। আর টেবিলের পাশে কিছু টাকা আছে, টাকা গুলো নিয়ে রাকেশ চাচার দোকানে চলে যা। বলবি দুটো কোঁক দিতে।”

রানি চোখের জল মুছে আমার দিকে অবাক চোখে তাকালো বটে। কিন্তু আমি আর তাকালাম না ওর দিকে। রাহিয়ানের দিকে তাকাতেই দেখলাম সে রীতিমতো লোহার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমি তাকাতেই তার চমৎকার হাসি খানাও আর দেখলাম না৷ রানিকে বকতে সময় হয়তো সে হাসিরও অবসান ঘটেছে।

—-” তুমি অযথাই রানিকে বকাঝকা করলে! আসলে আমিই ওকে…. আমি নিজেই বুঝতে পারিনি!! আম সো সরি! আমি চলে যাচ্ছি। এন্ড যাওয়ার আগে তোমাকে কিছু বলতে চাই! আম সরি নীলাদ্রিতা! দুপুরের ব্যাপারটার জন্য আমি সত্যিই খুব দুঃখিত। প্রবলেমটা আসলে আমার নিজেরই। দ্যাট ওয়াজ মাই ফল্ট।”

কথা গুলো বলেই হাঁটা ধরলেন রাহিয়ান। আমি জায়গায় স্থির থেকেই কঠিন স্বরে বলে উঠলাম,

—-” আমি আপনাকে এখানে আসতে বলেছি নাকি এখন এখান থেকে যেতে বলেছি?”

উনি পেছন মুড়ে তাকালেন না। সামনের দিকে তাকিয়েই বললেন,

—-” কোনোটাই বলোনি তবে আমি এটুকু বুঝতে পেরেছি, আমার এখানে আসাটা একদমই ঠিক হয়নি। তাতে আমি তোমাকে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে ফেলে দিয়েছি।”

—-” সত্যি কথা বলতে, আপনি ঠিকই ধরেছেন। প্রবলেম আসলে আপনারই। আর সেটা হলো ওভার থিংকিং এর প্রবলেম।”

পেছন মুড়ে তাকালেন উনি। চোখমুখ থেকে অপরাধ বোধ টা উঠে গিয়ে একরাশ বিষ্ময় ধরা দিচ্ছে। আমি দুই পা হেঁটে তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। তাকে ভালো করে আরেকবার দেখতে দেখতে বললাম,

—-” সিঁড়ি ভেঙে সোজা উপরে উঠে যান। হাতের ডানে গিয়ে দেখবেন পরপর তিনটা রুম। প্রথমটা বাবার আর তার পরের টা রান্নাঘর,আর তার পরেরটা… না জানলেও চলবে। প্রথম ঘরটা তে ঢুকে বামে গেলেই ওয়াসরুম পাবেন। গিয়ে চটপট ফ্রেশ হয়ে দুই মিনিট জিরিয়ে নিবেন ফ্যান ছেড়ে। দুঃখি এর জন্য যে আপনার রুমের মতো স্পেশালিটি এখানে পাবেননা। আমাদের গরীবের বাসায় এসি নেই। মাথার উপর ফ্যান আছে। কষ্ট করে সেখানেই আপনাকে কিছুক্ষণ কাটাতে হবে। ঠিক পাঁচ মিনিট থেকে নীচে নেমে আসবেন। আপনার জন্য খাবার দিচ্ছি টেবিলে। মুখ দেখে তো মনে হচ্ছে না দুপুর থেকে কিছু খাওয়া হয়েছে। এখন এভাবে হা করে তাকিয়ে না থেকে জলদি চলে যান।”

উনি মাথা নীচু করে মুচকি হাসলেন। ডান হাতটা তুলে মাথা চুলকে মৃদুস্বরে বললেন,

—-” ভাবছি মাকে বলব ছোট মনির মেয়েটাকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। যদি নিজে থেকে রাজি হও তো ধুমধাম করে বিয়েটা সেরে ফেলব, অন্যথা বছর দুয়েকের জন্য তাকে নিয়ে দেশান্তর হবো।”

আমার চোয়াল ঝুলে পড়ল তার কথায়। আমি মুখে ভেংচি কেটে বললাম,

—-” এতো শখ ভালো নয় মশাই! আমি আপনাকে বিয়ে করব এটা আপনি ভাবছেন কি করে হ্যাঁ?”

উনি এবার সাদা দাঁতের ঝলক দিয়ে হাসলেন। চমৎকার হাসি তার। চোখ দুটো সরু করে বললেন,

—-” বিয়ে না করতে চাইলে জোর করে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে করব। দেন খুব টর্চার করবো! উঠতে বসতে টর্চার চলবে তখন।”

আমার ভ্রু জুগল কুঁচকে এলো তার কথায়। আমি এক ভ্রু উঁচিয়ে বললাম,

—-” আচ্ছা? তো আপনি কি ভাবছেন শুনি? বিয়ের পর আপনি আমাকে টর্চার করবেন আর আমি অবলা নারীর মতো সয়ে যাবো? আমিও আপনাকে টর্চার করব! আপনাকে আমি না খাইয়ে টর্চার করব। না রেঁধে না খাইয়ে টর্চার করব।”

উনি ফিক করে হেসে দিলেন। একটু এগিয়ে এসে আমার কোমরে হাত চেপে গভীর চোখে তাকালেন। ঠোঁটের কোনে চমৎকার হাসি ঝুলিয়ে মৃদুস্বরে বললেন,

—-” তবে কি স্বীকার করে নিচ্ছ বিয়েটা আমাকেই করবে?”

আমার টনক নড়তেই ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিলাম তাকে। বুঝতে পারছি লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছি আমি। কোনো রকম উনার থেকে পালানোর বাহানায় বললাম,

—-” অসম্ভব! আমি আপনার মতো এমন একটা মানুষকে বিয়ে করব সে প্রশ্নই উঠেনা!”

উনি হেসে উঠলেন শব্দ করে। আমি তার সামনে থেকে দৌড়ে চলে আসতেই সে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,

—-” আমার বড় স্বাধ হয় নীলাদ্রিতা,
একবার তোমার নিঃশ্বাস আটকায়ে দেখি।”

৫৫.

বাবা দাঁড়িয়ে আছে আমার সামনে। আমার টলমল করা চোখ জোড়া এই দৃশ্য যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাচ্ছে না। বাবা সম্পূর্ণ সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে হাত ইশারা করে কাছে ডাকছে। কিন্তু আমি বাবার কাছে যেতে পারছিনা! আমার শরীর শক্ত হয়ে জমে আছে। ছাদের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে বাবা। আর আমি বাবার থেকে সামান্যই দূরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আকাশে চাঁদ আর মেঘেদের লুকোচুরি খেলা চলছে। সাথে মিটমিট করে জ্বলছে শতাধিক তাঁরা। বাবা সবসময় চাঁদের থেকেও তাঁরা বেশি পছন্দ করে। সবসময় বলে তোর মা ঐ তাঁরাদের সাথেই থাকে। তাই চাঁদের চেয়েও আমার তাঁরা বেশি পছন্দ। ঘন্টা খানিক আগে একটা খবর এলো! বড় খালামনি রাহিয়ানকে কল করেছেন। বাবা নাকি আর নেই! হঠাৎ কিভাবে কি হয়ে গেলো কেউ কিছু বলতে পারছেনা। বাবার সুস্থ স্বাভাবিক শরীরটা নাকি হঠাৎই নিথর হয়ে গেল। এই খবরে আমার বিশেষ ভাবাবেগ ঘটাতে পারলাম না। ঠিক ঠাহরেই উঠতে পারলাম না বড় খালামনি হঠাৎ এমন মজা কেন করছেন? বাবা আর নেই মানে? এটা কেমন মজা? তারা কি জানেনা, নিধি আর যাই হোক তার বাবাকে নিয়ে মজা সহ্য করতে পারেনা! আচ্ছা আমি কি এখন নীচে গিয়ে বড় খালামনিকে জিজ্ঞেস করব, তিনি হঠাৎ এমন মজা কেন করলেন? আর বাবা যদি নাই থাকে তবে এই যে বাবা আমার সামনে দাঁড়িয়ে! সেটা কি করে সম্ভব হয়? আমার কি জিজ্ঞেস করা উচিৎ? নাকি উচিৎ না?

—–” বাবা? ও বাবা? কি হয়েছে গো তোমার? ওখানে কেন দাঁড়িয়ে আছো? আমার পাশে এসে দাঁড়াও না! দেখো না আজ আকাশে কত তাঁরাদের মেলা বসেছে? মাও এসেছে আজ! তোমার সাথে বুঝি কথা বলতে চায়? দেখো বাবা, ঐ যে তাঁরা টা? কিরকম করে জ্বলছে দেখো? ঐ টা বুঝি মা তাই না বাবা? আচ্ছা বাবা! আমি যদি এখানে বসেই মাকে ডাকি, মা-কি শুনবে আমার ডাক? বুঝবে তার নিধি তাকে ডাকছে? কথা বলবে আমার সাথে?”

বাবা মুচকি হাসছে আমায় দেখে। আমার বুকের ভেতর টা মোচড় দিয়ে উঠল। বাবার চুপ করে থাকাটা যেন আমাকে দুমড়েমুচড়ে দিচ্ছে! রাগে দুঃখে চিৎকার করে উঠতে ইচ্ছে করছে। বাবা কেন কিছু বলছে না আমাকে? আমিও যে পাথরের মতো জমে আছি জায়গায়। বাবার কাছে এগিয়ে যেতে পারছিনা! আচ্ছা বাবার কি ক্ষিধে পেয়েছে?

—-” বাবা তোমার কি ক্ষিধে পেয়েছে? চলো খাবে চলো? আজ তো সব তোমার পছন্দের খাবার রেঁধেছি। তুমি কাল বললেনা? ক্ষেতে চাইলে যে। আমি তো আজ সব রেঁধেছি বাবা। জানো, আজ কিন্তু চাচির কোন হেল্প নেইনি। সব নিজের হাতে রেঁধেছি। রানি একটু আধটু কুটতে বাটতে সাহায্য করেছে। বাকি সব আমি একাই করেছি। চেখে দেখবেনা স্বাদ কেমন হলো? আমি জানি খারাপ হয়নি! বাবার জন্য রেঁধেছি খারাপ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। কি বলো?”

কথা গুলো বলে নিজে নিজেই হেসে উঠলাম। আমার মনে হচ্ছে আমি পাগল হয়ে গিয়েছি। পাগলের মতো করে হাসছি। এই মুহুর্তে আমার আশেপাশে কেউ থাকলে নিশ্চয়ই আমার দিকে আঙ্গুল তুলে বলত,

—-” এই দেখ তোরা! এই মেয়েটা পাগল হয়ে গিয়েছে। পাগলের মতো হাসছে!”

আমি মনের কথায় পাত্তা দিলাম না। নাকের ডগা লাল করে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। এতক্ষণ হাঁটতে না পারা আমি হঠাৎ কি করে বাবার সামনে এসে দাঁড়াতে পারলাম তা আমায় ভাবালো না। আমি বাবার মুখোমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আমার বাবা দেখতে কিন্তু আমার মতোই। শ্যামা উজ্জ্বল গায়ের রং। কিন্তু এই মুহুর্তে মনে হচ্ছে যেন বাবার চেয়ে সুন্দর দেখতে মানুষ এই পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি নেই। ইচ্ছে করছে বাবাকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু পারছিনা! খুব রাগ হচ্ছে নিজের উপর। বাবা এতদিন পর সুস্থ হয়ে আমার কাছে ফিরল আর আমি কিনা বাবাকে একটা বারের জন্য জড়িয়ে ধরতে পারছিনা? মনে হচ্ছে আমার হাত পা যেন খসে পড়ছে শরীর থেকে। শরীরের মাংস গুলোতে অস্বাভাবিক ভাবে জ্বালাপোড়া করছে। এক বিদঘুটে গন্ধে বারবার গা গুলিয় উঠছে আমার! হঠাৎ বাবার দিকে চোখ পড়ল। বাবা আমার যন্ত্রণা দেখে হাসছে। দাঁত বের করে হাসছে। বাবার হাসি অদ্ভুত! ভয়ংকর লাগছে। খুব ভয়ংকর লাগছে। আচমকাই আমি শূন্যে ভেসে উঠলাম। আশপাশে কিছু ধরার জন্য হাত বাড়াতেই মাথায় খুব শক্ত ভাবে আঘাত লাগল। ব্যাথায় কুঁকড়ে গেলো আমার শরীর। জ্ঞান হারাতে বসেও অবচেতন মনটা বারবার বলে উঠছে, “আমার বাবার কিচ্ছু হয়নি। আমার বাবা ঠিকাছে। আমার বাবার কিচ্ছু হয়নি!

ঘরের আনাচে কানাচে মরা কান্না জুড়েছে মানুষ! আমি ঘুমচ্ছি না! কিন্তু কোনে এক ঘোরের মধ্যে আছি। ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারছিনা! নিজের শরীরের ভারটা মনে হচ্ছে দশজন মানুষের চেয়েও বেশি। শরীর নাড়িয়ে নড়তেও পারছিনা! আশেপাশে মানুষের উপস্থিতি মস্তিষ্ক ধারন করতে পারছে। কিন্তু মন বলছে সব ঠিকাছে। মাথার উপর কারোর শীতল হাতের ছোঁয়া পেয়ে মনে মনে হাসলাম! হাতটাকে জড়িয়ে ধরে চোখ বুজেই বলতে লাগলাম,

—-” বাবা, এই মাঝরাতে আর কত রেডিও শুনবা বলোতো? দেখো কিভাবে মরা কান্না জুড়েছে? শুনতে ভালো লাগছেনা বাবা! প্লিজ বন্ধ করো?”

আমার কথাটা শেষ হতেই কারা যেন হু হু করে কেঁদে উঠল। আমার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে উঠল। রেডিওতে কাঁদলে সবটা এমন বাস্তব কেন মনে হবে? সবটা এতো জীবন্ত কেন লাগছে? আমার ঘোর তখনও কাটল না। চোখ খুলে আশেপাশে তাকালাম। কিন্তু ঘরের কোথাও কাউকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু কান্না গুলো এখনও বাজছে আমার কানে। দু’হাতে ভর দিয়ে উঠে বসলাম। বাবা রুমে নেই! রেডিও নেই! কিন্তু কাঁদছে টা কে?

ডানে বামে চোখ বুলাতেই দেয়ালে টানানো ঘড়িটার দিকে চোখ পড়ল। ঘড়ির কাঁটা চারটার উপর আঁটকে আছে। এখন কি বিকেল না ভোর?

আচমকাই চোখের সামনে এক এক করে সব পরিচিত মুখ গুলো ভেসে উঠছে। রাই,রিম্মি আপু,নিতু আপু, ফাহিম ভাইও আছে দেখছি। ওরা কখন এলো? সবাই আমার পায়ের কাছে বসে কাঁদছে। সবার চোখ মুখ অদ্ভুত ভাবে ফুলে আছে। হঠাৎ মনে হলো রাই আমার হাত ধরে আমার পাশেই বসে আছে। আরে ও না এক্ষনি ওখানে ছিলো?

কোত্থেকে রানি এসে হাজির হলো। আমায় রেখে বাকি সবার সাথে কথা বলছে। আমি ওর কথা শুনছি না! শুধু দেখছি ও বারবার ফুঁপিয়ে উঠছে। মেয়েটা অনেক কালো। আর এখন যেন আরও বেশি কালো লাগছে। রানি কথা শেষ করে একবার আমার দিকে তাকাল। আবার চলেও গেলো। রানি যেতেই রাই আর নিতু আপু আমার হাত ধরে বিছানা থেকে নামিয়ে দিলো। আমাকে নিয়েও কোথায় একটা যাচ্ছে তারা। পেছন পেছন আরও অনেক মানুষজন আসছে। সবাইকে আমি চিনিও না। আজ সবাই কাঁদছে। পরিবেশটা আমার খুব বিরক্ত লাগছে! আমি কেবল সবার কান্নাই দেখছি কিন্তু কারোর কথা শুনছিনা! বড় অদ্ভুত পরিবেশ। সিঁড়ি ভেঙে নীচে নামতেই আরও শতাধিক মুখ আবিস্কার করলাম। সবাই একটা সাদা কাপড়ে মোড়ানো কিছুকে ঘিরে বসে আছে। অনেকে কাঁদছে, অনেক তিলাওয়াত করছে। অনেকে আবার তছবিহ্ পড়ছে।

হাত ইশারা করে কে যেন ডাকছে আমায়! আমি তার দিকে তাকাতেই দেখলাম দেয়ালে টানানো ছবিটির অনুরূপ কেউ বসে আছে সাদা কাপড়ে মোড়ানো জিনিসটির পাশে। মুখজুড়ে রয়েছে তার মায়াবী হাসি৷ আমি তাকে দেখতেই সে আবারও হাত ইশারায় ডাকল আমায়। আমি ধীরপায়ে এগিয়ে গেলাম তার কাছে। সে মিষ্টি হেসে আমার দু’গালে হাত রেখে বলল,

—-” কি রে কষ্ট হচ্ছে?”

—-” কে তুমি? আর হঠাৎ কষ্ট হওয়ার কথা কেন জিজ্ঞেস করছো?”

উনি হাসল। আমার কপালে আদর মাখানো ছোট্ট একটা চুমু খেয়ে বলল,

—-” আমি তোর মা! আজ তোর বাবাকে নিয়ে যাচ্ছি আমার সাথে করে। অভিমান রাখিস না মা। তোর বাবাই বড্ড জেদ করেছিলো যাওয়ার জন্য! আমায় ছাড়া নাকি সে জীবন্ত লাশের মতো হয়ে যাচ্ছে। তাই নিয়ে যাচ্ছি। তুইও তৈরি থাকিস! একদিন সময় করে তোকেও নিয়ে যাবো।”

বুকের ভেতর টা খা খা করে উঠল। আমি শক্ত করে সাদা কাফনের কাপড় টা চেপে ধরলাম। শরীরে যত শক্তি ছিলো সব মিলিয়েই চিৎকার করে বলে উঠলাম,

—-” আমি আমার বাবাকে কিছুতেই তোমার সাথে যেতে দিবো না। চলে যাও তুমি৷ দূর হও আমার চোখের সামনে থেকে। তুমি একজন স্বার্থপর মহিলা। তুমি কখনোই আমাকে ভালোবাসোনি আর আজও ভালোবাসতে পারোনি! তুমি আজ আমার বাবাকেও আমার থেকে কেঁড়ে নিতে এসেছো! আমি যেতে দিবো না আমার বাবাকে! ছাড়ো, ছাড়ো আমাদের! আমার বাবাকে ধরবেনা তুমি! একদম ধরবেনা! আ..আমার বাবাকে প্লিজ ছেড়ে দাও! প্লিজ ছেড়ে দাও আমার বাবাকে! দেখো না মা, আমার যে বাবা ছাড়া আর কেউ নেই! আ..আআমার বাবা আমার থেকে হারিয়ে গেলে আমি কি করে বাঁচব? আমি যে একেবারে নিঃস্ব হয়ে যাবো মা। আমার যে যাওয়ার মতো আর কেউ রইল না। ও মা, মা? শুনোনা, আমি ত..তোমার পায়ে পড়ি মা! প্লিজ আমার বাবাকে আমার থেকে আলাদা করে দিওনা! আমি বাবাকে ছাড়া এক দন্ডও বাঁচতে পারবো না মা! ও বাবা? বাবা? বাবা উঠো, উঠো তুমি? এভাবে কেন শুইয়ে আছো? কেন শুইয়ে আছো? দেখো তোমার
নিধি কিন্তু কাঁদছে বাবা! তোমার নিধির খুব কষ্ট হচ্ছে!! বাবা? ও বাবা? উঠছো না কেন? তুমি উঠে এই মহিলাকে বলে দাও তো, তুমি কিছুতেই উনার সাথে যাবেনা? তুমি আমার কাছে থাকবে? আমার সাথে থাকবে! অলওয়েজ আমার সঙ্গে থাকবে। আমায় আগলে রাখবে! বাবা তুমিও যদি চলে যাও তবে আমার কি হবে? তোমার নিধি কি করে বাঁচবে! ও বাবা!! বাবা উঠো! উঠো বাবা উঠো, তোমার মিসেস খানকে জবাব দাও বাবা! কড়া জবাব দিয়ে বলো তুমি শুধু আমার কাছে থাকবে, তুমি উনার সাথে যাবে না! একদম যাবে না! বাবা উঠোওওও (চিৎকার করে)

আমার গলার স্বর আমি আর নিজেই শুনতে পেলাম না! গলা ভেঙে এখন শুধু ফ্যাসফ্যাস আওয়াজ আসছে। নিজের কথা নিজেই শুনতে পাচ্ছি না। আশপাশের সবাই দেখছে আমায়। হয়তো খুব আফসোসও করছে,

—-” হায় রে এই অভাগীর কপালে তো বাপটাও আর রইল না!”

#চলবে____________________