প্রেয়সী পর্ব-৩৫+৩৬

0
1678

#প্রেয়সী ♥️🥀
#moumita_mehra
#পর্বঃ৩৫

৬৮.

গায়ে হলুদের পর্ব সারল রাত ঠিক ১১টা নাগাদ। বাড়ির সবাই আমাদের দুজনকে সারপ্রাইজ দিতে নাচ,গান এবং কবিতা আবৃত্তির অসাধারণ ব্যবস্থা করে রেখেছিলো। আমি এই বিষয়ে কিছুই জানতাম না! হঠাৎ করেই রাই এবং আরফান ভাইয়া একসাথে মিলে গেয়ে উঠলেন অসাধারণ এক গান। আর সেই গানেই তাল মিলিয়ে নাচ ধরল রিম্মি আপু আর নিতু আপু। রাহিয়ানও এই সারপ্রাইজের আংশিক ছিলো। তার বরাবর প্রসংশনীয় কবিতা দিয়েই সবার মন কাড়ল। বিশেষ করে আমার। উনার কবিতার লাইন গুলো এতোটা নেশা ছড়াচ্ছিল যে আমি সেই নেশায় নিজেকে মাতাল না করে পারছিলাম না। বউমনি আর হিমাদ্র ভাইয়াও নাচের অসাধারণ পারফরম্যান্স করেছে। আমি সবচেয়ে বেশি অবাক হলাম যখন বড়-খালামনির এবং বড়-খালু গান গেয়ে একসাথে তালে তাল মিলিয়ে নেচেছেন। নিজেকে তখন বড্ড ভাগ্যবতী বলে মনে হচ্ছিলো। সত্যি বলতে এমন অসাধারণ পরিবার কয়জন মেয়ের ভাগ্য থাকে?

—-” কফি।”

রাহিয়ানের কন্ঠ পেয়ে চমকে উঠলাম! পাশ ফিরে তাকে দেখতে দেখতে সে অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বলল,

—-” কিছু ভাবছিলে? হঠাৎ চমকে উঠলে!”

আমি জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করে উনার হাত থেকে একটা কফির মগটা নিয়ে বললাম,

—-” তেমন কিছু নয়। আপনি হঠাৎ এসে পড়লেন খেয়াল করিনি তাই একটু…”

উনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে। ফিচেল গলায় বললেন,

—-” আর ইউ সিওর?”

আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে দূর আকাশে দৃষ্টিপাত করলাম। তাঁরাদের মাঝে ঝলমলে আকাশ। আজ চাঁদের দেখা নেই! শুধু তাঁরাদের বিচরণ আজ।খন্ড খন্ড ঘন কালো মেঘের পাশ থেকেই উঁকিঝুঁকি দিয়ে যাচ্ছে শতাধিক তাঁরা। উনি আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে শীতল কন্ঠে বললেন,

—-” মন খারাপ?”

আমি দৃষ্টি ফেরালাম না। আকাশের একই ভাবে তাকিয়ে থেকে বললাম,

—-” আজ বাবা থাকলে ভীষণ খুশি হতো বলুন!”

না তাকালেও বেশ বুঝতে পারলাম উনার শান্ত দৃষ্টি এসে ঠেকলে আমার চিকচিক করা চোখের গোড়ায়। শুঁকনো ঠোঁটখানা জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিয়ে জোরপূর্বক হাসতে চেষ্টা করলেন উনি। যদিও চেষ্টা সফল হলো না। তাই আমার হাত ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে স্মিত হেসে এগিয়ে এসে ঠোঁট ছোঁয়ালেন আমার চোখের পাতায়। তার ছোঁয়া পেয়ে অনুভূতির জাতাঁকলে নিজেকে পিষে কেঁপে উঠলাম কিঞ্চিৎ। উনি আবারও পিছিয়ে গেলেন উনার জায়গায়। মুখে চমৎকার হাসি রেখে বললেম,

—-” আজ বাবা নেই কে বলল তোমায়? বাবা তো অলওয়েজ তোমার সাথেই আছে নীলাদ্রিতা। তুমি বাবাকে অনুভব করতে চাইলেই বাবা তোমার সামনে এসে দাঁড়াবে। কথা বলবে, হাসবে,বকবে,মজা করবে। তুমি যা চাও তাই করবে নীলুপাখি!”

আমার ভ্রু জুগল কুঁচকে এলো সঙ্গে সঙ্গেই। “নীলুপাখি”! আবার সেই নীলু! আমি উনার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই উনি হেসে ফেললেন। হাসতে হাসতে বললেন,

—-” আই লাভ দিস নেইম নীলুপাখি!”

আমি ক্ষেপা চোখে তাকিয়ে উনার বুকে কিল ঘুষি বসাতেই উনি “আউচ” বলেই আমার হাতটা চেপে ধরলেন। ব্যাথা হজম করে লোকটা হেসেই চলেছে। তার হাসি দেখে আমার গায়ে জ্বালা ধরে যাচ্ছে যেন। আমি চোখ মুখ কুঁচকে রেখেই উনার দিকে তাকিয়ে রইলাম। খানিকক্ষণ বাদে উনি হাসিটাকে কোনোমতে চেপে বললেন,

—-” কফিটা কিন্তু ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে জান। টেস্ট করে বলো কেমন হয়েছে?”

আমি আর জবাব দিলাম না উনাকে। উনি আমার হাতটা ছাড়তেই আমি মার দেওয়ার ভঙ্গি করে ছোট্ট করে হাসলাম। উনি আমার মার থেকে বাঁচতে কফির মগটা তুলে ধরলেন। অতঃপর সেও হেসে উঠলেন আমার সাথে। দুজনে একসাথেই কফিতে চুমুক বসালাম। উনার তৈরি করা কফি বরাবরই প্রশংসনীয়। সেদিনের ভুলবশত খাওয়া উনার কফির স্বাদটা যেন আজও মুখে লেগে আছে। সেই একই স্বাদ। আমার সম্পূর্ণ মনোযোগ যখন কফিতে উনি আচমকাই আমার হাত থেকে কফিটা টেনে নিলেন উনার দিকে। আমি আচমকা ভড়কে গেলাম এমন কান্ড দেখে। আমার অবাক দৃষ্টি উনার মনোযোগ নষ্ট করতে পারল না। উনি আমার কফিটার সাথে উনার কফিটা পাল্টাপাল্টি করে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। আমি কপাল কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকতেই উনি চোখ টিপে বললেন,

—-” ভালোবাসা বাড়বে।”

আমি বিরস মুখে বললাম,

—-” একপাত্রে খেলে ভালোবাসা বাড়ে এভাবে এক্সচেঞ্জ করে নয়!”

উমি পড়লেন ভারী চিন্তায়। চোখেমুখে চিন্তাগুলো উঁকিঝুঁকি দিয়ে যেতেই উনি আশেপাশে তাকালেন। কিছু খুঁজছেন হয়তো। আমি প্রশ্ন সূচক মুখ করে উনার দিকে তাকাতে তাকাতে উনি একটা ছোট্ট টুলের উপর রেখে দিলেন নিজের কফিটা। আর তারপর দাঁত কেলানো হাসি দিয়ে আমার কফিটা কেড়ে নিয়ে বললেন,

—-” আগে স্বামীর খাওয়া উচিৎ। এম আই রাইট?”

আমি বোবা চোখে তাকিয়ে বললাম,

—-” কফি কি করে একপাত্রে খাওয়া যায়?”

—-” একপাত্রে খেতে অসুবিধা হলে আমার ব্যক্তিগত পাত্র থেকে নিতে পারো। আই মনি টু সে…(উনার ঠোঁটের দিকে ইশারা করে)।”

আমি থতমত খেয়ে উনার থেকে দৃষ্টি নামিয়ে নিলাম। আমতাআমতা করে বলতে লাগলাম,

—-” আ,,পনি তো ভারী অসভ্য লোক!”

উনি ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বললেন,

—-” বউয়ের সাথে অবশ্যই অসভ্য হতে হয় সুইটহার্ট। নয়তো প্রেমটা জমবে কেমন করে?”

—-” ধ্যাৎ!”

লজ্জায় বুকের ভেতরটা ক্রমশই লাফিয়ে লাফিয়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে ছোট্ট হৃদয়খানা। লোকটার সামনে থাকাও যেন পাহাড় সমান লজ্জার মতো ঠেকছে। শাড়ির আঁচলে আঙ্গুল পেঁচাতে পেঁচাতে এখান থেকে যাওয়ারই ফন্দি আঁটছিলাম। হঠাৎই পেছনে থেকে হেঁচকা টান দিয়ে আমায় নিজের সাথে মিশিয়ে নিলেন উনি। আমি কেঁপে উঠে চোখ বন্ধ করে নিলাম সঙ্গেসঙ্গে। উনি উনার ডানহাতে আমার কোমর চেপে ধরলেন। আমি ভয় পেয়ে কাঁপাস্বরে বলে উঠলাম,

—-” ক,,কফিটা কিন্তু গায়ে পড়বে! কি করছেন টা কি বলুনতো।”

উনি জবাব দিলেন না। হাতের বাঁধন শক্ত করেই আমাকে নিজের সাথে আরও শক্ত করে মিশিয়ে নিলেন। বা-হাত দিয়ে আমার পিঠে বিছিয়ে থাকা খোলা চুল গুলো বাম পাশের কাঁধে উঠিয়ে দিয়ে আবারও খানিক মিশিয়ে নিলেন আমায়। উনার তপ্ত শ্বাস আমার ঘাড়ের উপর আচড়ে পড়তেই আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে এলো। উনি আমার ঘাড়ে নাক ঘসে ঘোর লাগানো কন্ঠ বললেন,

—-” আমাদের বিয়েটা আজ নয় কেন বলোতো?”

আমি কেঁপে উঠলাম। ঢোক গিলে জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বললাম,

—-” কফিটা কি করলেন?”

উনি আগের ভঙ্গিতেই বলে উঠলেন,

—-” পাশাপাশি সাজিয়ে রেখেছি। দেখো?”

আমি ঘাড় ফিরিয়ে পাশে তাকাতেই দেখলাম ছোট্ট টুলটার উপরই জায়গা পেয়েছে আমাদের দুজনের কফি। হাতের মগটাও কখন ওখানে রাখলেন টেরই পেলাম না।

—-” আমরা এখানে রোমান্স করবো আর ওরা আলাদা থাকবে তা কি করে হয় বলো তো? তাই ওদেরও রোমান্স করার ব্যাবস্থা করে দিলাম।”

আমি লজ্জায় আরও কুঁকড়ে গেলাম। ইদানীং সব কিছুতেই এতো পরিমানে লজ্জা পাচ্ছি যে তা নিয়েও নিজেকে এখন ডিপ্রেসড লাগছে।

—-” হু বুঝেছি এখন ছাড়ুন আমায়! দেখুন খোলা ছাদে যেকোনো সময় যে কেউ এসে পড়তে পারে! আর এসে যদি আমাদের এভাবে দেখে ফেলে তাহলে কি ভাববে বলুন তো?”

উনি নড়লেন না এক ইঞ্চিও! আমাকে জড়িয়ে একই ভাবে দাঁড়িয়ে রইলেন। উনার তপ্তশ্বাস যে আমার করুন অবস্থা হচ্ছে তা কি করে বোঝাই তাকে। আমার ভাবনার মাঝেই উনি গাঢ় কন্ঠে আবৃত্তি করতে লাগলেন,

—-” তোর জন্য ফুল কুড়িয়ে নিলে,
সঙ্গে খানিক ভুল কুড়িয়ে নিলে,
ভুল করেই বললে ভালোবসি,
তুই কি তবু হাসবি অমন হাসি?
একটুখানি ভুলের ছলে ছুঁলে,
একটুখানি সুবাসমাখা ফুলে,
একটুখানি ডোবাই যদি ঠোঁট!
‘ঢের হয়েছে’,বলবি, ‘এবার ওঠ’!
তোর জন্য খানিক মায়া হলে,
বুকের ভেতর মেঘের ছায়া হলে,
বললে, ‘তোকে আমার ভীষণ চাই,
ভাববি কি তুই, সবটা অযথাই?
তোর জন্য ভীষণ কান্না পেলে,
তোর জন্য আস্ত আকাশ ফেলে,
তোর দুয়ারে দাঁড়িয়ে যদি রই,
বলবি কি তুই, আমি তোর নই?””

কবিতার শেষ লাইন বলেই উনি মুখ ডুবালেন আমার ঘাড়ে। ছোট্ট করে একটা ভালোবাসার পরশ একে মুখ তুলে কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে বললেন,

—-” বলবি কি তুই, আমি তোর নই?”

—-” না ভাই বলবে না! অনেক হয়েছে তোমাদের একান্ত, ব্যক্তিগত সময় কাটানো! এবার নীচে চলো।”

আকস্মিক অপ্রত্যাশিত কারোর গলা ভেসে আসতে ছিটকে পড়লাম দু’জনেই। উনি কয়েক কদম পিছিয়ে গেলেন আর আমি কয়েক কদম সামনে এগিয়ে গেলাম। আমাদের সামনেই দাঁড়িয়ে আছে সবাই। বউমনির পাশেই মুখ টিপে হাসতে থাকা রাই আমার দিকে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরে বউমনিদের পাশে এনে দাঁড় করালো। আর ওদিকে রাহিয়ানকে ঘিরে দাঁড়ালো আরফান ভাইরা। কথাটা অবশ্য বউমনির ছিলো। তাই হঠাৎই হিমাদ্র ভাইয়া নিজের ভাইয়ের পক্ষ নিয়ে বলে উঠলো,

—-” আমি বলেছিলাম এখন ছাদে এসে কাজ নেই। ভাইটা আমার একটু নিরিবিলি সময় কাটাচ্ছিলো কিন্তু তোমরা? মহিলা মানুষ মানেই ঝামেলা বুঝলা!”

রাহিয়ান আঁড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে হঠাৎই চোখ টিপলেন। আমি গোলগোল চোখ করে উনার দিকে তাকাতেই পাশ থেকে বউমনি ক্ষেপা গলায় বলে উঠলো,

—-” কি বললে? মহিলা মানুষ মানেই ঝামেলা? এখন ভইকে পেয়ে দল চেঞ্জ হু? এতক্ষণ যে হাতে পায়ে ধরছিলে ওদের জ্বালানোর জন্য তখন?”

হিমাদ্র ভাইয়া বউমনির কথাগুলো সম্পূর্ণ অস্বীকার করার কায়দায় বলল,

—-” আমি? কখন? কবে? কোথায়? এই আবির, জিয়ান, রাফিন ভাই তোমরা বলোতো? আমি কি এমন কিছু বলেছি?”

হিমাদ্র ভাইয়ার কথাকে সবাই ঠিক প্রমাণ করতেই একসাথে বলে উঠলো,

—-” হ্যাঁ হ্যাঁ হিমাদ্র ভাইয়া ঠিক কথা বলেছে! একদম ঠিক কথা বলেছে!”

বউমনি যেন আকাশ থেকে হোঁচট খেয়ে পড়ল। হিমাদ্র ভাইয়ার দিকে ক্ষেপা দৃষ্টিতে তাকাতে মেয়েদের গ্রুপে বাকিরাও জ্বলে উঠল। নিতু আপু, রাই, হিয়া আপু, রিম্মি আপু সবাই একসাথে জোর গলাতে বলে উঠলো,

—-” হিমাদ্র ভাইয়া মিথ্যে বলছে, মিথ্যে বলছে।”

মেয়েরা সুর দিয়ে উঠতেই এবার ছেলেরাও সুর দিয়ে বলে উঠলো,

—-” হিমাদ্র ভাইয়া সত্যি বলছে, সত্যি বলছে।”

বলা বাহুল্য দু’পক্ষের ছোটখাটো একখানা মিছিল শুরু হলো।

৬৯.

—-” আমি রাইকে বিয়ে করতে চাই!”

বিয়ে বাড়ির সোরগোল থেমে গেলো আরফান ভাইয়ার ছোট্ট কথাটিতে। আমরা সকলেই ভয়াবহ বিস্ময় নিয়ে তার পানে চেয়ে আছি। কাজী সাহেব আমাদের সামনে বসে আছেন। বিয়ে পড়ানো হচ্ছিলো আমাদের। হঠাৎ কোথা থেকে তার উদয় ঘটল টের পেলেননা কেউই! আমাদের ন্যায় কাজী সাহেবও বিস্মিত চোখে তাকালেন। উনার বিভ্রান্ত মনে কেবল একটা কথাই থেকে থেকে প্রশ্ন তুলছে, বিয়ে কি একটা হবে নাকি দুটো?

—-” মানে?”

গম্ভীর মুখে প্রশ্ন ছুঁড়লেন রাহিয়ান। আরফান ভাইয়া নির্বিকার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকে আবারও বললেন,

—-” আমি রাইকে বিয়ে করতে চাই! আজ আর এক্ষনি!”

—-” তোর মাথা ঠিকাছে তো? কি বলছিস এসব?”

—-” হ্যাঁ ভেবে বলছি!”

আরফান ভাইয়ের মুঠোবন্দিতে রাইয়ের হাত খানা খুব শক্ত ভাবে আঁটকে আছে। যেন আলগা হতেই রাই পালাতে না পারে। রাগে, অভিমানে রাইয়ের ফর্সা মুখটা রক্তশূণ্য হয়ে উঠেছে। আমি রাইয়ের দিকে বোবা চোখে তাকাতেই রাই তেতে উঠল আরফান ভাইয়ার উপর। নিজের হাতটা ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টায় লিপ্ত থেকে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,

—-” আমি আপনাকে বিয়ে করবো না! ছাড়ুন আমায়!”

আরফান ভাই নির্লিপ্ত চাহনি দিয়ে বললেন,

—-” তুমি না চাইলেও তোমায় আমাকেই বিয়ে করতে হবে রাই!”

—-” আপনি আমাকে জোর করতে পারেন না!”

—-” আমি তোমাকে ভালোবাসি রাই! আর সারাজীবন আমি তোমার সাথে কাটাতে চাই!”

রাই জ্বলে উঠে বলল,

—-” কিন্তু আমি তো আপনাকে ভালোবাসিনা! তাহলে আমি কেন আপনাকে বিয়ে করবো?”

—-” ভালোবাসো না কিন্তু ভালোবাসবে!”

রাহিয়ান স্টেজ থেকে নেমে গেলেন রাই এবং আরফান ভাইার কান্ড দেখে! আমি অবাক চোখে তাদের দিকেই তাকিয়ে আছি। হচ্ছে কি এখানে?

—-” আবির তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তুই রাইয়ের সাথে জোর করতে পারিসনা!”

—-” আমি রাইয়ের সাথে জোর করছিনা ভাই! আমি ওকে ওর কষ্ট গুলো থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করছি মাত্র! তুই বল, অরিনের কঠিন ষড়যন্ত্রে এই মেয়েটা কেন এতো কষ্ট পাবে? কোনো দোষ না করেও সারাক্ষণ নিজেকে অপরাধী ভেবে যাবে! রূপের মতো একটা কা-পুরুষের কাছে বারবার ফিরতে চাইবে! এগুলা কি অন্যায় হচ্ছে না দোস্ত? আ,,আর ভালোবাসলেই তো সবটা নিজের করে পাওয়া হয়না তাই আমি ওকে বিয়ে করতে চাচ্ছি! আমিও কাউকে ভালোবেসেছি.. কিন্তু কখনও বলার সাহস করতে পারিনি! হয়তো কখনো বলতেও পারবনা!”

শেষ কথাটা বলেই আরফান ভাইয়া আমার দিকে তাকালেন। মনে হলো যেন কথাটা উনি আমাকেই বললেন! আমি উনার দিকে তাকাতেই দৃষ্টি ঘুরিয়ে ফেললেন আরফান ভাই। রাইয়ের হাতটা শক্ত করে ধরে রাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে বললেন,

—-” তাই আমি ওকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি দোস্ত!”

রাহিয়ান রাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,

—-” রাই? তোমার কি মত?”

রাই মুখ তুলে তাকালো। অপরাধী গলায় আমতাআমতা করে কিছু বলতে নিলেই আরফান ভাইয়া বলে উঠলেন,

—-” রাই রাজি।”

—-” কিন্তু আবির…”

—-” আমি ওকে ভালোবাসি এটাই এনাফ রাফিদ! প্লিজ তুই আমাকে বাঁধা দিস না!”

রাহিয়ান আর বাঁধা দিলেন না আরফান ভাইয়াকে। উনি স্টেজে এসে আমার পাশে বসতে বসতে আরফান ভাইয়া আর রাইও উঠে এলো স্টেজে। কাজী সাহেবের পাশে দাঁড়াতেই বড় খালু চেঁচিয়ে বলে উঠলেন,

—-‘ এই কে কোথায় আছিস আরও দুটো চেয়ার এনে দে। আজ আমার দু’টো ছেলের একসাথে বিয়ে হবে।”

বড় খালুর উৎসাহে ঘেরা মুখটা দেখে আরফান ভাইয়া ছোট্ট করে হেসে উঠলো। হাসি মুখেই বড় খালুর উদ্যেশ্যে বলে উঠলো,

—-” থ্যাংক্যু আঙ্কেল।”

বড় খালু ভরসা চোখে তাকালেন। ততক্ষণে দুটো চেয়ার নিয়ে হাজির হলেন ফাহিম ভাইয়া আর জিয়ান ভাইয়া। চেয়ারে পাশাপাশি রাই আর আরফান ভাই বসতেই কাজী সাহেব বিয়ে পড়াতে আরম্ভ করলেন। লেখালেখির পর্ব সেরে রাহিয়ানের উদ্দেশ্য বলে উঠলেন,

—-” বাবা বলো, ‘আলহামদুলিল্লাহ কবুল’?”

কাজী সাহেব বলার প্রায় সাথে সাথে রাহিয়ান বলে উঠলেন,

—-” আলহামদুলিল্লাহ কবুল।

রাহিয়ান তিনবার কবুল বলতেই এনার কাজী সাহেব আমাকে বলে উঠলেন,

—-” বলো মা আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”

আমিও নির্দিধায় বলে উঠলাম,

—-” আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”

আমাদের বিয়ে সম্পন্ন হতেই কাজী সাহেব রাই আর আরফান ভাইয়েরও বিয়ে সম্পন্ন করলেন। একসাথে আমাদের চারজনেই বিয়ে সম্পন্ন হলো। রাইয়ের শুঁকনো মুখটার দিকে তাকিয়ে আমার অবচেতন মনটা বলে উঠলো,

—-” যা হয় ভালোর জন্যই হয়! রাই আর আরফান ভাইয়ের বিয়েটা হয়ে খারাপ হয়নি। মেয়েটার জীবন থেকে আর ভালোবাসা হারিয়ে যাওয়ার ভয় রইলো না। এবার হয়তো রাইকেও কেউ নিজের সবটা দিয়ে ভালোবাসবে।”

#চলবে____________________

#প্রেয়সী ♥️🥀
#moumita_mehra
#পর্বঃ৩৬

৭০.

হুট করে মেয়ে বিয়ে করে ফেলেছে কাউকে কিছু না জানিয়ে ব্যাপারটা প্রত্যেক বাবা-মায়ের কাছেই যেমন অপমানের তেমন কষ্টের! রাইয়ের ক্ষেত্রেও বিপরীত কিছু ঘটেনি! একটা ছেলে বিয়ের জন্য জোর করল বলে তাকেও যে ড্যাংড্যাং করে বিয়ে করে ফেলতে হবে সেই শিক্ষা তো রাই কোনো কালেই পায়নি! তাহলে এমন কাজ সে কি করে করতে পারল? এখানে তো কোনো নাটক সিনেমা হচ্ছে না যে হিরো হিরোইন কে জোর করলো আর হিরোইনও ভয়ে ভড়কে গিয়ে বিয়ে করতে বাধ্য হলো! বিয়ের পর কিছুদিন ঝগড়াঝাটি হবে আর তারপর তারা হবে সেরা কাপল! এমনটা শুধু টিভির পর্দাতেই মানায়! বাস্তব জীবন এর থেকে ভয়াবহ কঠিন! রাইয়ের বাবা-মায়ের এমন কিছু বক্তব্যেই রাই এবং আরফান ভাই অপরাধ বোধে হাসফাস করতে লাগলেন। কিন্তু সেই অপরাধ বোধ আরফান ভাইয়ের মধ্যে ততক্ষণই দেখা গেলো যতক্ষণ অব্ধি রাহিয়ান মুখ খুলেননি।

—-” আন্টি-আঙ্কেল, আপনাদের কাছে আমি প্রথমেই আবির.. আই মিন আরফানের হয়ে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। ও হঠাৎ করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে বিয়েটা তৎক্ষনাৎ করে ফেলাতে আমরাও কম অবাক হইনি! কিন্তু, যা ঘটে গেছে তা-তো আমরা আর চেয়েও বদলাতে পারবনা বলুন? তবে আমি আপনাদের হলফ করে বলতে পারি আরফানের মতো ভালো ছেলে সত্যিই হয়না আর ওর থেকে ভালো ছেলে হয়তো আপনাদের মেয়ের জন্য আপনারা কখনোই পেতেননা!”

আন্টি চেতে উঠলেন রাহিয়ানের প্রতি। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,

—-” তুমি তো একথা এখন বলবেই! কারন ঐ ছেলে যে তোমার বন্ধু। কপাল তো আমাদের পুড়েছে। ভোগান্তিটা তো আমাদেরই ভুগতে হবে তাই না? সমাজে বের হলে পাঁচ কথা শুনে মাথা নীচু করে চলে আসতে হবে আমাদের! লোকজন আমাদের দিকে হাত তুলে বলবে ঐ দেখো মেয়েকে এমন শিক্ষিত করলো যে মেয়ে তাদের না জানিয়ে একটা অপরিচিত ছেলেকে বিয়ে করে ফেলল!! আজকের এই দিনটা দেখার জন্য কি তোকে পেটে ধরেছিলাম মুখপুরি!”

আন্টির কথায় আহত নয়নে তাকালো রাই। মুখ ফুটে দু’চারটে কথা বলারও যে পথ নেই তার। আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে রাইয়ের হাতটা শক্ত করে চেপে ধরলাম। রাই আমার দিকে মুখ তুলে তাকাতে আমি চোখের ইশারায় ওকে চুপ থাকতে বললাম! জানি এই সব কিছুতে ওর কোনো দোষ নেই কিন্তু যা ঘটে গেছে তার জন্য ওকে এমন অনেক মুখঝামটা সহ্য করতেই হবে। এটাই যে সমাজের নিয়ম! ঘরের লোক হোক বা বাইরের, মেয়েদের যে প্রতি পদে পদে খোঁটা দিবেনা সে যে অকল্পনীয়!

রাইয়ের বাবা নরম মানুষ। উনি এক দৃষ্টিতে মেয়ের গতিবিধি নিরীক্ষণ করে চলেছেন। বউয়ের কথায় তার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তার মুখ দেখে মনে হচ্ছে সে মেয়েকে কয়েক মিনিটের জন্য আলাদা করে পেলে মন ভরে দু’চারটে কথা বলে যেতেন। সবার মতো কথা শুনাতেন না! সমাজের এই ঝড় হাওয়া থেকে মেয়েকে রক্ষা করতে হয়তো কিছুটা সাহস জোগাতে সাহায্য করতেন।

আরফান ভাই রাইয়ের মায়ের উদ্দেশ্যে কঠিনস্বরে বললেন,

—-” আপনি যা বলার আমাকে বলুন আন্টি! দয়াকরে রাইকে কিছু বলবেন না। ও আপনাদের একমাত্র মেয়ে হলেও আজ থেকে আমার বউ ও! তাই ওকে কিছু বলতে গেলে অবশ্যই আমাকে আগে বলতে হবে।”

রাইয়ের মা রাগের অতিমাত্রায় পৌঁছে নিজেকে সামলাতে না পেরে দাঁড়িয়ে গেলেন। স্বামীর দিকে তাকিয়ে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বললেন,

—-” তোমার মেয়ে ভালোই প্রেমিক পুরুষ জুটিয়েছিলো! তাই বাবা-মাকে না বলে বিয়েটাও করে ফেলতে পেরেছে! আর এখন তাকে কিছু বলতে গেলে নাকি তার স্বামীর পারমিশন নিতে হবে! আমি তোমায় বলে রাখছি, এই মেয়েকে আমি আর কখনও ঘরে তুলবো না! আমি আজ থেকে জানবো আমাদের কোনো মেয়ে নেই! মরে গেছে আমাদের মেয়ে!”

—-” মা….”

রাইয়ের কন্ঠ ভেঙে এলো। মায়ের পরের শব্দ গুলো নিজের মতো করে আর জুড়তে পারলো না! আন্টি হমহন করে বেরিয়ে গেলেন বাসা থেকে। আঙ্কেল সঙ্গে সঙ্গেই গেলেন না। কিছুক্ষণ মাথা নীচু করে বসে থেকে আস্তেধীরে উঠে দাঁড়ালেন। রাইয়ের চোখ জোড়া ছলছল করে উঠলো। বাবার দিকে একবুক আশা নিয়ে অসহায়ের মতো চেয়ে রইলো! কিন্তু আঙ্কেল আন্টির মতো মেয়েটাকে আশাহত করে হনহনিয়ে বের হয়ে গেলেন না। যদিও চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে আস্তেধীরে হাঁটা ধরলেন! রাই ছুটে গেলো তার দিকে। তার সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই কেঁদে ফেলল মেয়েট। নিজেকে সংযত করা যে আমার পক্ষেও সম্ভব হচ্ছিল না! রাই বাবার সামনে হাত জোর করে দাঁড়াতেই আঙ্কেল ডুকরে উঠে জড়িয়ে ধরল রাইকে। আমি চোখের জল ফেলে হেসে উঠলাম! প্রশান্তি এটাই যে আন্টি রাইকে ভুল বুঝলেও আঙ্কেল ওকে ভুল বুঝেনি।

—-” চিন্তা করিসনা মা সব ঠিক হয়ে যাবে!”

কথাটা আঙ্কেল রাইকে বললেও আমার মনে হচ্ছিলো যেন আমার বাবা এই কথাগুলো আমায় বলছে। মনটা আবারও অসহায়ের মতো কেঁদে উঠতে চাইলে সামলে নিলাম নিজেকে। চোখজোড়া বন্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে রাহিয়ানের কথাটা মনে করলাম। ‘বাবা অলওয়েজ আমার সাথেই আছে!’ সত্যিই যে বাবা আমার সাথে আছে। একেক সময় একেক রূপে বাবা আমার সামনে এসে দাঁড়ায়। আজ যেমন রাইয়ের বাবার রূপ নিয়ে আমার সামনে এলো। আর বলে গেলো,

—-” চিন্তা করিস না মা সব ঠিক হয়ে যাবে।”

আঙ্কেল রাইকে ভালোমন্দ কয়েক কথা বলে সেও চলে গেলেন। রাই বাবার যাওয়ার পানে তাকিয়ে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে রইল। আমি ওর কাছে যেতে নিলে রাহিয়ান হাত ধরে থামিয়ে দিলেন। আরফান ভাইয়ার কাঁধে হাত রেখে বললেন,

—-” ওকে নিয়ে রুমে যা দোস্ত। অনেক ধকল সইলো মেয়েটা।”

আরফান ভাই আমার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে রাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। ধীরপায়ে রাইয়ের দিকে এগিয়ে গিয়ে রাইয়ের হাতটা শক্ত করে ধরতেই চমকে উঠল রাই! আহত নয়নে আরফান ভাইয়ের দিকে তাকাতেই আরফান ভাই আলতো করে রাইকে বুকে আগলে নিলেন। আস্তে করে বললেন,

—-” চিন্তা করো না রাই। আমি আস্তে আস্তে সব ঠিক করে দিবো।”

ঘরের বাকি সদস্যরা নীরব দর্শকের মতো এতক্ষণ কাহিনী দেখলেও এবার সবাই একসাথে হৈচৈ করতে লাগল। বিয়ে বাড়ি এমন নীরব নিস্তেজ থাকলে কি মানায়? রাই আর আরফান ভাইকে আর কেউ জ্বালালো না! বউমনি আর নিতু আপু মিলে রাইকে রুমে দিয়ে এলো। কিছুক্ষন বাদে আরফান ভাইকেও পাঠিয়ে দেওয়া হলো রেস্টের জন্য! আরফান ভাই যেতেই রাহিয়ানের বন্ধুমহল রাহিয়ানকে নিয়ে আড্ডায় বসলেন। তাদের উদ্দেশ্য আজ আড্ডায় আড্ডায় রাহিয়ানকে বাসর ঘরে আর পা রাখতে দিবে না! কিন্তু এদিকে বেচারা উনি তো কিছু বলতেও পারছেন না করতেও পারছেন না!

৭১.

ঘড়ির কাটায় ঠিক ১টা বেজে ৩০ মিনিট। বন্ধুদের ফাজলামো,শয়তানি,ডেয়ার সব শেষ করে মাত্রই রুমে পা রাখলেন রাহিয়ান! আমাকে আরও ঘন্টা খানিক আগেই রুমে পাঠানো হয়েছে। এতক্ষণ আমি একা একাই তার অপেক্ষায় প্রহর গুনছিলাম! অপেক্ষার সময়টা বেশ কঠিন হলেও এই মুহুর্তে সময়টা আমার কাছে বেশ অস্বস্তি লাগছে। কট করে শব্দ হতেই আমি ঘোমটার আড়ালে উনাকে এক পলক দেখে নিলাম। উনি রুমে পা রাখতেই যেন আমার বুকের ভেতরটা ছ্যাঁত করে পুড়লো। আমি শুঁকনো গলায় ঢোক গিললাম। বুকের ভেতর কেউ যেন ঢোল পিটিয়ে যাচ্ছে বারবার। উনি রুমের দরজাটা লক করে পেছন ফিরে তাকাতে আমিও নেমে গেলাম বিছানা ছেড়ে। বউমনিরা শিখিয়ে দিয়েছে, বাসর রাতে নাকি স্বামীর পায়ে হাত রেখে সালাম করতে হয়! এটাই নিয়ম। আজকাল এতো এতো নিয়মের মাঝে নিজেকে যেন হারিয়ে ফেলছি আমি। আমাকে আচমকাই নিজের সামনে আবিস্কার করতে খানিক ভড়কে গেলেন মহাশয়। আমতাআমতা করে কিছু বলতে নিলেই আমি ঝুঁকে গেলাম তার পায়ের কাছে। উনি চমকে উঠে প্রায় জোরেশোরেই বলে উঠলেন,

—-” আরে আরে কি করো?”

আমি থতমত খেয়ে উনার পায়ের কাছে নেমেই থেমে গেলাম। উনার এমন হাইপার রিয়াকশন আমি আশা করিনি। উনি গোলগোল চোখ পাকিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছেন উত্তরের আশায়। আমি বোকা গলায় জবাব দিলাম,

—-” সালাম করছি!”

উনি অবাক হওয়ার চেষ্টা করে বললেন,

—-” সালাম করছো? কিন্তু কিভাবে?”

—-” পায়ে হাত দিয়ে। বউমনি বলেছে এভাবে সালাম করা নাকি নিয়ম!”

—-” হোয়াট?”

—-” হু। দেখি এবার সালাম করতে দিন।”

আমি উনার পা ছোঁয়ার জন্য হাত বাড়াতেই উনিও ঝুঁকে এলেন আমার সামনে। আমি চোখ জোড়া ডিম্বাকৃতির ন্যায় করে উনার দিকে তাকাতেই উনি ঠোঁট বাঁকিয়ে বললেন,

—-” দু’জনে একসাথে সালাম করি?”

আমি হা করে উনার দিকে তাকালাম। উনি স্বাভাবিক কন্ঠেই বললেন,

—-” হা মার্কা রিয়াকশন দেওয়ার কিছু হয়নি! আজ থেকে আমরা যা করব দু’জনে বরাবর করব। তুমি যা করবে আমিও তাই করব। যদি তুমি আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করো তবে আমারও উচিৎ তোমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা।”

উনার কথায় ঠিক কতটা স্বাভাবিক এবং কতটা হাইপার রিয়াকশন দিতে হবে আমি প্রায় ভুলেই গেলাম। বোবা চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে উনার মনের মধ্যে প্যাঁচ লাগানো কথা গুলোর জোট খোলার প্রচেষ্টা চালালাম। আখেরে ফলাফল শূন্য হতেই দাঁড়িয়ে গেলাম আমি। আমার দাঁড়ানো দেখে উনিও দাঁড়িয়ে গেলেন। কি বলব বুঝতে না পেরে হাতের কাছে যা পেলাম ধরিয়ে দিলাম উনাকে। উনি কিছুক্ষন হাতের দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,

—-” ছোট বেলায় বাংলা সিনেমাতে দেখতাম এসব! তুমিও দেখছি সিনেমার নায়িকাদের মতো শুরু করলে।”

উনি হাত থেকে দুধের গ্লাসটা নামিয়ে রেখে আমার হাত ধরে কাছে টেনে নিলেন। বিগলিত হেসে বললেন,

—-” বাকি সব কিছুও কি বাংলা সিনেমার মতোই করতে ইচ্ছুক?”

আমি লজ্জা পেয়ে মুখ লুকিয়ে নিলাম দু’হাতের মাঝে। উনি মৃদু হেসে আমার মুখ থেকে হাত নামিয়ে দিয়ে বললেন,

—-” আর লজ্জা পেতে হবেনা ম্যাডাম! ওখানে একটা শাড়ি রাখা আছে জলদি গিয়ে শাওয়ার নিয়ে এসো। তোমার এই ভারী শাড়িতে যেন আমারই দমবন্ধ হয়ে আসছে। তারউপর এতো ভারী ভারী গয়না! কি করে পারো বলোতো?”

আমি শাড়িটার দিকে একবার দৃষ্টিপাত করে বললাম,

—-” মেয়েরা সব পারে। যেখানে গোটা একটা সংসার সামলাতে পারে সেখানে এই ভারী গয়না পরে ঘুরে বেড়ানো আর কি কষ্ট বলুন?”

উনি মৃদু হাসলেন। আমাকে যাওয়ার তাড়া দিয়ে বললেন,

—-” আই নো। এবার জলদি যাও!”

—-” আপনিও ফ্রেশ হয়ে নিন?”

—-” একসাথে হবো? আসবো তোমার সাথে?”

আমি হোঁচট খেয়ে তাকালাম। মেকি রাগ দেখিয়ে বললাম,

—-” তাই বললাম নাকি?”

—-” তো কি বললে?”(শয়তানি হাসি দিয়ে)

—-” ধ্যাৎ! কিছুনা।”

আমি আর দাঁড়িয়ে না থেকে দ্রুত পায়ে চলে এলাম উনার সামনে থেকে। পেছন থেকে উনার হাসির শব্দ ভেসে আসতে লাগলো। মানুষটা জ্বালিয়ে মারল আমায়।

শাওয়ার নিয়ে শাড়ি পড়ে ভেজা চুল নিয়ে বের হলাম ওয়াসরুম থেকে। সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি এক গোসলেই যেন কেটে গেলো। এখন যে কতটা শান্তি লাগছে উনার কথায় ফ্রেশ না হলে বুঝতামই না। হাতে টাওয়াল নিয়ে উনার বিখ্যাত আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালাম। যতই বলি শান্তি লাগছে, এতো রাতে চুল ভিজিয়ে শাওয়ার নেওয়াটা মোটেই ভালো কথা নয়। জ্বর-টর না এলেই হলো। টাওয়াল হাতে চুল মুছতে মুছতেই উপলব্ধি করলাম ঘরের মধ্যে মাতাল করা ফুলের সুগন্ধ। সারা ঘরময় ফুলোর এমন সুবাসে ‘ম’ ‘ম’ করছে। আমি জোরে টেনে নিঃশ্বাস নিলাম। অদ্ভুত মাতাল করা গন্ধ। ফুলের সুগন্ধ নিতে নিতে মনে হলো উনি ঘরে নেই! ভেতরটা ধক করে উঠলো। ঘড়ির কাটা ২টার উপর স্থীর হয়ে আছে। ঘরের মৃদু আলোয় উনাকে কোথাও আবিস্কার করতে পারলাম না। ফ্রেশ হতে বলে কোথায় গেলেন উনি? আমি হাতের তোয়ালেটা ফেলে ব্যালকনির দিকে এগিয়ে গেলাম। উনি ছোট্ট মোড়াটায় বসে আছেন গিটার হাতে। আজ আকাশে মস্ত বড় একখানা চাঁদ উঠেছে। সেই চাঁদের আলোতেই আকর্ষণীয় হয়ে ফুটে উঠেছে উনার মুখ। ব্যালকনিতে আসার পথে বড় থাইটার কাছে আমার উপস্থিতি টের পেয়েই ঘাড় ফেরালেন উনি। আমার দিকে তাকিয়ে উনি ঠোঁটের কোনের হাসিটুকু দীর্ঘ করলেন। হাত থেকে গিটারটা নামিয়ে রেখে ধীরপায়ে এগিয়ে এলেন আমার দিকে। তার চাহনিতে মাদকতা ভরপুর। গাঢ় চাহনিতে আমার ভেতরটা লন্ডভন্ড করে দিতে লাগলেন। আমি চোখ নামিয়ে নিলাম উনার থেকে। উনি উনার শেরওয়ানি পাল্টে সাদা শার্ট পরেছেন। শার্টের বেশির ভাগ বোতাম লাগানো থাকলেও বুক বরাবর তিনটা বোতামই খোলা! উনার সুঠাম দেহে শার্টটা টাইট হয়ে আঁটকে আছে। শার্টের লম্বা হাতা কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করা। চাঁদের আলোয় উনার ডার্ক রেড ঠোঁট দু’খানা আরও কঠিন রূপ নিয়েছে। মাথার সিল্ক চুলগুলো চিকচিক করছে। সেই সাথে ঝিরিঝিরি বাতাসের তালে মৃদুভাবে ভাসছে। উনার ফেলা প্রতিটি কদমে আমার ভেতরটায় তোলপাড় করা বাড়ছে বৈ কমছেনা! উনি আমার একদম কাছে এসে দাঁড়ালেন। আমি নিঃশ্বাস আঁটকে ধরে উনার চোখে চোখ রাখলাম। উনি উনার শীতল হাত জোড়া তুলে আমার দু’গালে স্পর্শ করতেই কেঁপে উঠলাম আমি। বুকের ভেতরটার ধুমধাম ঢোল পেটানোর আওয়াজে বিচলিত হয়েই আকস্মিক জড়িয়ে ধরলাম উনাকে! উনার বুকে মাথা রাখতেই অস্থিরতা কমার নাম করে আরও বেড়ে গেল উনার হৃৎস্পন্দনের শব্দে। আমার থেকেও যেন পাল্লা দিয়ে দ্রুত ছুটছে উনার হার্টবিট। উনি কিছু না বলেই দু’হাতে আগলে ধরলেন আমায়। আমার ভেজা চুল গুলোর মাঝে হাত চালিয়ে বললেন,

—-” চুল গুলো ভালো করে মুছলেনা কেন? ঠান্ডা লেগে জ্বর বাঁধতে কিন্তু সময় নিবেনা।”

আমি ছোট্ট করে জবাব দিলাম,

—-” আপনাকে হঠাৎ দেখতে না পেয়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম!”

উনি মুচকি হাসলেন বুঝি! আমাকে নিজের সাথে আরেকটু মিশিয়ে নিয়ে বললেন,

—-” তোমার অপেক্ষা করছিলাম!”

—-” এখানে কেন?”

—-” আমাদের মিলনের সাক্ষী চাঁদ থাকবে বলে!”

আমি লজ্জায় কুঁকড়ে গেলাম! জবাবে আর কিছুই বলতে পারলাম না উনাকে। উনি আমাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে আকস্মিক কোলে তুলে নিলেন। আমি অস্থির নয়নে উনার চোখে চোখ রেখে উনার শার্টের কলার্ট আঁকড়ে ধরলাম। উনি মাদক হাসি হেসে রুমের ভেতর পা রাখতে রাখতে বলে উঠলেন,

—-” আমার বড় সাধ হয়,
একবার তোমার নিঃশ্বাস আটকায়ে দেখি,
তুমি মর,না আমি!
ইঁচালি-বিঁচালি শরীরের ভাঁজে ভাঁজে,
আগুন জ্বালায়ে দেখি,
তুমি পোড়,না আমি!”

ফুলে ফুলে সজ্জিত বিছানায় ভালোবাসার নতুন আবির্ভাব ঘটালাম দু’জনে। কিছু সুখ, কিছু বেদনাকে সাক্ষী রেখেই আজ থেকে নতুন করে সূচনা হলো আমাদের অন্যরূপ ভালোবাসার। বুঝি এই সুখই শেষ নয়! সামনে হয়তো আরও অনেক অনেক ভালোবাসার নতুন রূপে বারবার সূচনা রটাতে থাকবে আমাদের এক মন এক প্রান। হাজার ভুল,হাজার ঠিককে একত্র করেই ভালোবাসায় ভরিয়ে তুললাম দুজন দুজনকে।

#চলবে____________________