ফাগুন ছোঁয়া পর্ব-০৯

0
112

#ফাগুন_ছোঁয়া
#পর্ব_৯
#লেখিকা_সারা মেহেক

রাতে বাইরে থেকে খাওয়াদাওয়া শেষ করে আদ্রিশ মিমকে হোস্টেলে পৌঁছে দিয়ে গেলো। হোস্টেলে প্রবেশের পূর্বে মিমকে জিজ্ঞেস করলো,
” বাসাটা কি পছন্দ হয়েছে?”

মিমের বাসাটা পছন্দ হলেও ভাড়ার ব্যাপারে চিন্তা করে ভাবলো জবাবে ‘না’ বলবে। কিন্তু তার জবাব দেওয়ার পূর্বেই আদ্রিশ বললো,
” ভাড়ার ব্যাপারটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। এতো আহামরিও কিছু না ওটা। শুধু বলো বাসা পছন্দ হয়েছে কি না।”

মিম খানিক রয়েসয়ে অনিশ্চিত কণ্ঠে বললো,
” পছন্দ তো হয়েছে। কিন্তু……”

আদ্রিশ তৎক্ষনাৎ তাকে মাঝপথে থামিয়ে বললো,
” কোনো কিন্তু নয়। তোমার পছন্দ হয়েছে,এটাই চলবে আমার জন্য। আমি ভাইকে বলে রাখবো উনি যেনো উনার চাচার সাথে কথা বলে রাখে এ ব্যাপারে।”

” উনি সেই সিনিয়র ভাইয়ের চাচা ছিলো?”

” হ্যাঁ। এজন্য একটু সুবিধা হয়েছে কি….তিন মাস পরেও বাসায় উঠলে সমস্যা করবে না। সাধারণত কেউ তিন মাসের জন্য বাসা খালি রাখে না। কিন্তু ভাই আমাকে খুব ভালো চিনে। অনেক স্নেহ করে। উনাকে বললে উনি দেখে নিবে। ”

মিমের দুশ্চিন্তা কমলো কিছুটা। খুশি হলো সে। আদ্রিশ পুনরায় বললো,
” প্রথম প্রথম খরচাপাতি আমি একাই টানতে পারবো। এরপর তো তুমিও কিছুটা কন্ট্রিবিউট করবে।”

” হ্যাঁ। ইন্টার্নির যে টাকা পাবো তাতে বাসায় কিছু পাঠাবো আর নিজেদের জন্য কিছু রাখবো। আর তার এক বছর পরেই ইন শা আল্লাহ আমিও চাকরি করবো। তখন দুজনে সমানতালে সংসার চালাতে পারবো। আমাদের দুজনের সংসারে কিছু আপনি দিলেন, কিছু আমি দিলাম। এভাবে করেই এগোবে আমাদের নতুন সংসার।”

মিমের প্রস্তাবিত কথাগুলো ভীষণ ভালো লাগলো আদ্রিশের। সে আদুরে গলায় বললো,
” তোমার মুখে ‘আমাদের সংসার’ শব্দটা শুনে ভীষণ ভালো লাগছে মিশমিশ। অপেক্ষায় আছি সে দিনটার জন্য যে দিন আমরা আমাদের ঐ ব্যালকনিতে বসে একে অপরের হাতে হাত রেখে গল্প করবো। শেষ বিকেলের রোদে তৃপ্তি সহকারে চা খাবো। দ্রুত পরীক্ষাটা শেষ করো মিশমিশ। আমার আর তর সইছে না। তোমায় নিয়ে সংসার বাঁধার প্রবল ইচ্ছা আমায় রোজ কুরে কুরে খাচ্ছে।”

আদ্রিশের কণ্ঠে অধৈর্য্যের ছোঁয়া পেলো মিম। আদ্রিশের এরূপ ব্যাকুলতা তাকে ভীষণ আনন্দ দিলো। এর কারণ কি সে নিজেও জানে। তবে আদ্রিশকে এভাবে তীব্র ইচ্ছা পোষণ করতে দেখে সে মনে মনে বললো,
” পছন্দের জিনিস পেতে একটু ধৈর্য্য ধরতে হবে। বলে না, সবুরে মেওয়া মিলে!”

মিম মুচকি হেসে চলে এলো হোস্টেলের ভেতরে। পিছে আদ্রিশের ভীষণ ইচ্ছে হলো মিমকে এখনই তুলে নিয়ে চলে যেতে। কিন্তু পরিস্থিতির চাপে পারলো না সে। শেষমেশ একরাশ দুঃখে ভারাক্রান্ত মন নিয়ে চলে এলো সে।

আদ্রিশ ও মিমের বিয়ের প্রায় এক সপ্তাহ শেষ। ইতোমধ্যে দুজনে একে অপরের সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে শুরু করেছে। বিশেষত মিম। তার পক্ষে আদ্রিশকে মেনে নেওয়া খানিক কষ্টসাধ্য ছিলো বটে। তবে আদ্রিশের বেলায় এমনটা হয়নি। যদিও তারা একে অপরের থেকে দূরে আছে তবুও তাদের মাঝে ধীরেধীরে সামান্য বোঝাপড়া, ভালোলাগা তৈরী হচ্ছে। আর এ ভালোলাগাই তাদের মাঝে ভালোবাসার সম্পর্কের সূত্রপাত ঘটাচ্ছে। মাঝে মাঝে মিমের বোধ হচ্ছে সে বুঝি প্রেম করছে। বোধ হচ্ছে সে সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া এক কিশোরী যে নব্য প্রেমের স্বাদ নিচ্ছে। কিন্তু এ প্রেমের স্বাদ সে নিজেকে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রেখে একটু একটু করে নিচ্ছে। যেনো পুরোপুরি প্রেম ছোঁয়ার চেষ্টা করলেই তা হারিয়ে যাবে! এই প্রেম ভালোবাসায় নিজেকে জড়িয়ে নিতে নিতে তারা সংসারে মনোযোগী হচ্ছে। সন্দেহ নেই দুজনারই দুজনার প্রতি অনুভূতি তৈরী হচ্ছে। সে অনুভূতি দায়িত্বের, সে অনুভূতি প্রথম প্রেমের। আদ্রিশের মনে এ অনুভূতির স্ফূলিঙ্গ ঘটেছিলো সর্বপ্রথম, যখন সে মিমকে সরাসরি দেখেছিলো। তবে সে এ অনুভূতিকে এখনই সম্পূর্ণরূপে জাহির করতে নারাজ। তার ইচ্ছে মিমের পক্ষ হতে যখনই তার প্রতি কোনো আকর্ষণের সূচনা ঘটতে দেখবে সে তখনই সে আগ বাড়িয়ে ধীরেধীরে মিমের প্রতি নিজের অনুভূতির জানান দিবে। এখন অবশ্য সে সদ্য বিবাহিত দম্পতির আচরণ কেমন হয় সেটাই মিমের সম্মুখে প্রকাশ করছে।

মিম রুমে এসে দেখলে ফারহা নেই। সম্ভবত বাসায় চলে গিয়েছে সে। মেয়েটা আজকাল হোস্টেলে থাকতেই চায় না। পরীক্ষার আগে এসে বাসায় বেশি থাকে সে। মিম ভেবেছিলো আজ ফারহাকে সব কাহিনি বলবে। কিন্তু ফারহা-ই তো রুমে নেই।

মিম ফ্রেশ হয়ে ডায়েরি নিয়ে বসলো। লিখতে আরম্ভ করলো,
” সংসার। শব্দটা চারটা অক্ষরের। কিন্তু এর ভারত্ব বিশাল। সংসার মানেই প্রথমত যা মাথায় আসে তা হলো দায়িত্ব। আমি সবসময় বড় রকমের দায়িত্ব নিতে ভয় পাই। আর এখন সেই আমিই সংসারের দায়িত্ব নিবো! সেটাও আবার নিজের! আমার নিজেকে বিশ্বাস করাতে কষ্ট হচ্ছে।
কখনো এভাবে সংসার নিয়ে স্বপ্ন দেখিনি। কখনো নিজের সংসার গোছানোর কথা ভাবিনি। অথচ আজ আচমকা আদ্রিশ আমায় বললেন চলো বাসা দেখি। ওখানে যাওয়ার পর আমার অনুভূতিগুলো কেমন যেনো জট পাকিয়ে আসছিলো। অদ্ভুত লাগছিলো সবকিছু। আদ্রিশের সাথে যে প্ল্যান করেছিলাম তাতেও আমার মাঝে অদ্ভুত এক সুখের অনুভূতি অনুভব করেছিলাম। তখন মনে হচ্ছিলো, হ্যাঁ, এসব একান্তই আমার নিজের। আমার পাশাপাশি হাঁটতে থাকা মানুষটাও আমার। তার সাথে গড়ে উঠা সম্পর্কের বাসস্থানটাও আমার।
আজ আদ্রিশ যখন আমার হাতে হাত মিলিয়েছিলো তখন অদ্ভুত এক শিহরণ বয়ে গিয়েছিলো সমস্ত শরীরে। কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গিয়েছিলাম আমি। স্বামীর নিকট হতে প্রেমের ছোঁয়া বুঝি এমনই হয়!”

———

সকালের ওয়ার্ড শেষ হতে না হতেই আদ্রিশ মিমকে কল করলো,
” তুমি কোথায় এখন?”

” ওয়ার্ডে।”

” একটু কার্ডিওলজিতে আসো তো। একজনের সাথে দেখা করাবো।”

মিম ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
” কার সাথে দেখা করাবেন?”

” আহহা, আসো তো। আছে একজন যে তোমার সাথে দেখা করার জন্য বসে আছে।”

মিম আর কথা বাড়ালো না। ফারহাকে চলে যেতে বলে সে কার্ডিওলজি মেইল ওয়ার্ডে চলে গেলো। গিয়ে দেখলো আদ্রিশ বসে আছে। তাকে দেখে আদ্রিশ উঠে এলো। মিম জিজ্ঞেস করলো,
” কার সাথে দেখা করাবেন?”

আদ্রিশ ইশারায় মাঝের দিকে এক বয়োবৃদ্ধকে দেখালো। বললো,
” ঐ যে দেখছো না ঐ চাচাকে তোমার সাথে দেখা করাবো।”

এ কথা শুনে মিমের দৃষ্টিতে প্রশ্ন খেলা করলো। তবুও সে আদ্রিশের সাথে এগিয়ে গেলো মাঝের দিকের বেডে। সেখানে যাওয়া মাত্রই বুড়ো বৃদ্ধা আদ্রিশকে দেখে সৌজন্যমূলক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
” কেমন আছো বাজান?”

আদ্রিশ একগাল হেসে বললো,
” আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি চাচি। চাচার কি খবর?”

” তোমার চাচার খবর তো ভালাই। কাইল রাতে একটু বুক ব্যাথা করতেছিলো। পরে অবশ্য ওষুধ খাওয়াইয়া ঠিক হয়ে গেছে।”
এই বলে বৃদ্ধা মিমের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলো,
” এইডা কে?”

আদ্রিশ মিমের দিকে কয়েক সেকেন্ড চেয়ে পরে নিজের দিকে মিমকে খানিক টেনে নিয়ে এলো। বললো,
” আমার বউয়ের সাথে দেখা করতে চেয়েছিলেন আপনারা। এই যে আমার বউ।”

বৃদ্ধার মুখখানা খুশিতে চকচক করে উঠলো। ঈষৎ বিস্ময়ের সুরে বললো,
” ওমা! তোমার বউও ডাক্তার!”

” এখনও ডাক্তার হয়নি চাচি। আর কয়েক মাসের মধ্যেই ডাক্তার হয়ে যাবে।”

ইতোমধ্যে মিম সেই বৃদ্ধাকে সালাম দিলো। বৃদ্ধা সালামের জবাব দিয়ে মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে বললো,
” কি সুন্দর মাইয়াডা! চোখখানা কি সুন্দর!”

ইতোমধ্যে বয়োবৃদ্ধ লোকটিও উঠে গিয়েছে। দৃষ্টি মেলেই আদ্রিশকে দেখে তাঁর ঠোঁটের কোনে বিস্তৃত হাসির রেখা ফুটে উঠলো। স্নেহমাখা কণ্ঠে আদ্রিশকে বললেন,
” আইছো বাজান! সকাল থেইকে তোমাক দেখবার জন্য বইসা ছিলাম। তারপর ঘুমায় গেছি।”

আদ্রিশ একগাল হেসে বললো,
” আমিও এসে দেখলাম আপনি ঘুমিয়ে পড়েছেন। তাই আর ডাকিনি। তো ওষুধ খাচ্ছেন ঠিকমতো?”

” হ্যাঁ বাজান। তোমার কথামতো সব ওষুধ একদম ঠিকঠাক খাইতেছি। এখন আমি একদম সুস্থ। ”

” কিন্তু চাচি যে বললো আপনার বুকে ব্যাথা?”

” ঐসব একটু-মিকটু থাকেই। তা এইডা কে?”
বলে বয়োবৃদ্ধ মিমের দিকে ইশারা করলো। আদ্রিশ বললো,
” আমার বউ। আপনারা ওকে দেখার জন্য পাগল হয়ে গিয়েছিলেন না সেজন্য নিয়ে এলাম। ”

আদ্রিশের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি যে তার বউ জানার পর বয়োবৃদ্ধ ভীষণ খুশি হলেন। উতলা হয়ে বললেন,
” মা বসো বসো। এই যে আমার সামনে বসো।”

মিম বসলো। বয়োবৃদ্ধ তখন মিমের মাথায় স্নেহমাখা হাত বুলিয়ে বললো,
” তোমারে দেখার জন্য ডাক্তার বাজানরে বলছিলাম। বুঝলা, তোমার জামাইডা এক্কেরে ফাশ্ট কেলাস। এত্ত খেয়াল রাখছে আমার! মনে হইছিলো প্রথম দিনেই আমার বুকের ব্যাথা শেষ।”

এবার বৃদ্ধাও যোগ দিলেন তার স্বামীর সাথে। বললেন,
” তোমার জামাইডা এত্ত ভালা কি যে বলমু! মন চাইতেছিলো আমার মাইয়ার জামাই কইরা নিয়া যাই। তুমি অনেক ভাগ্যবতী মা। দোয়া করি, সারাজীবন তোমার সুখে থাকো।”

মিম দুজনের কথা শুনে নিকাবের আড়ালে লাজুক হাসলো। ওদিকে আদ্রিশ নিজের এতো প্রশংসার জোয়ারে যেনো ভেসেই গেলো।

বৃদ্ধ আর বৃদ্ধা মিমের সাথে আরোও বেশ কিছুক্ষণ কথা বললো। নিজেদের জন্য আনা কিছু খাবার সস্নেহে তাকে দিলো। তাদের দুজনের স্নেহে মিম ভীষণ অভিভূত হলো। এভাবে কোনো রোগী রোগ সেরে যাওয়ার পর মন থেকে যখন দোয়া করে তখনকার অনুভূতিটা সত্যিই অতুলনীয়।

মিম বেরিয়ে গেলো ওয়ার্ড হতে। আদ্রিশও এলো তার সাথে৷ মিম জিজ্ঞেস করলো,
” রোগীদের সাথে বেশ ভালোই ভাব জমাতে পারেন দেখছি! ”

আদ্রিশ সগর্বে বললো,
” এটা একটা গুণ বুঝলে। সবার মাঝে থাকে না। এজন্য অনেক রোগীই আমাকে খুব ভালোবাসে।”

মিম শেষোক্ত কথাটি শুনে সন্দেহের সুরে জিজ্ঞেস করলো,
” মেয়ে রোগীরাও!”

আদ্রিশ এ প্রত্যুত্তরের জন্য প্রস্তুত ছিলো না। মিমকে একবার আড়চোখে দেখে তাকে খানিক বাজিয়ে নেওয়ার জন্য বললো,
” হ্যাঁ, মেয়ে রোগীরাও।”

মিম তৎক্ষনাৎ মাঝ পথে দাঁড়িয়ে গেলো। পাশ হতে আদ্রিশের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে ঈষৎ রাগত স্বরে বললো,
” আপনি তো মানুষটা ভীষণ খারাপ। আপনাকে তো ভালো ভাবতাম আমি।”

মিমের এ রূপ দেখে আদ্রিশ ভ্রু উঁচিয়ে খানিক সময় তার দিকে চেয়ে রইলো। অতঃপর ফিক করে হেসে ভ্রুজোড়ায় ঢেউ তুলে বললো,
” পোঁড়া পোঁড়া গন্ধ পাচ্ছি বোধহয় কোথাও থেকে।”

মিম কিছু বলতে চাইছিলো। কিন্তু পরক্ষণেই আদ্রিশের টিপ্পনি কাটা দেখে চুপ করে রইলো সে। দৃষ্টি এদিক ওদিক দিয়ে এলোমেলো তাকালো। আদ্রিশের হাসি যেনো থামছেই না। সে হাসতে হাসতেই বললো,
” বুড়ো চাচিদের দেখেও যদি এতো জেলাস হও,উফ কি আর বলবো।
তোমার কি মনে হয় কার্ডিওলজিতে ইয়ং ফিমেল পেশেন্ট আসে? আসে, তবে হাতেগোনা কিছু। মোস্ট অফ দা পেশেন্ট মিডেল এজড বা ওল্ড এজের হয়।”

আদ্রিশের এ কথা শুনে মিমের নিজের মাথায় নিজেরই বারি মারতে মন চাইলো। আরে সে তো ভেবে দেখেনি, কার্ডিওলজিতে অল্প বয়সী মেয়েরা আসে না বললেই চলে। অথচ সে কি ভেবে বসেছিলো। ইশ, শুধু শুধু আদ্রিশের সামনে তার মান সম্মান ডুবলো। মাঝে মাঝে সে কিছু পরিস্থিতিতে নিজেকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেই ভুলে যায়। না জানি, ভবিষ্যতে কোনো এ কান্ড ঘটিয়ে ফেলবে সে!
#চলবে

®সারা মেহেক