ফিরে আসা পর্ব-১৩+১৪

0
425

#ফিরে_আসা
১৩
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

মোবাইল স্ক্রিনের ওপর ভেসে উঠেছে অপরিচিত একটি নম্বর। এ আর নতুন কিছু নয়। আরশাদের ম্যানেজার হওয়ার সুবাদে দিনে হাজারটা অপরিচিত ফোন রিসিভ করতে হয় অরাকে। ইন্ডাস্ট্রিতে সেলিব্রিটিদের ফোন নম্বর যেন হওয়ার ভেসে বেড়ায়। কোনো পরিচালক বা অ্যাসিস্ট্যান্টের কাছে চাইলেই পাওয়া যায় পছন্দের সেলিব্রিটির নম্বর। আরশাদ সে দিক থেকে একেবারেই ব্যতিক্রম। তার ব্যক্তিগত নম্বর খুব বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে নেই। তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে, যোগাযোগ করতে হবে অরার সঙ্গে।

আজ না জানি কোন নতুন পরিচালক ফোন করেছে। কিংবা হয়তো প্রযোজক। একটা সময় ছিল, অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা বলতে গেলে অরার বুক কাঁপতো। মনে মনে সাজানো কথাগুলোও এলোমেলো হয়ে যেত। অথচ সেই অরাকে আজ দিনে কতশত অপরিচিত মানুষের সঙ্গে কথা বলতে হয়। আমরা যে জিনিসটাকে সবথেকে বেশি ভয় করি, সে জিনিসটাকেই এক সময় আপন করে নিতে হয়। অদ্ভুত ব্যাপার!

বিরক্ত ভঙ্গিতে ফোন রিসিভ করলো অরা। অপরপ্রান্ত থেকে শোনা গেল ভারী পুরুষ কণ্ঠস্বর।

“হ্যালো? কেডা?”

বিরক্তিতে দাঁতে দাঁত চেপে অরা বলল, “আপনিই তো ফোন করলেন। জানেন না কাকে ফোন করেছেন?”

“এইডা কী আখির নাম্বার?”

অরার গা বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। আখি। এই নামে তাকে এখন আর কেউ ডাকে না। অরা তো প্রায় ভুলতেই বসেছে একটা সময় তার নাম ছিল অন্য কিছু। নিজের ভেতরে বাস করতে থাকা ওই মেয়েটাকে তো সে কবে মেরে ফেলেছে নিজ হাতে।

অরা কম্পিত স্বরে বলল, “না, এখানে ওই নামে কেউ থাকে না। আপনি আর এই নম্বরে ফোন করবেন না।”

অরা কলটা কাটতে যাবে ঠিক তখনই লোকটা বলে উঠলো, “শুনেন, শুনেন। আমি আখির চাচা। ওরে বইলেন, ওর বাপে গত বৎসরে মারা গেছে। এই এক বৎসর আখিরে মেলা খোঁজাখুঁজি করছি। শেষে এই নাম্বারটা পাইলাম। ওরে বইলেন একবার গেরামে আইসা বাপের কবর জিয়ারত কইরা যাইতে। মাইয়া হইয়া বাপের কবর জিয়ারত করবো না, এইটা কেমন কথা?”

অপরপ্রান্ত থেকে কলটা কেটে গেল। থ হয়ে বসে রইল অরা। তার হৃদস্পন্দনের গতি ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছে। মাথাটা কেমন যেন ভনভন করছে। অরা বুঝতে পারছে না তার কেমন অনুভব করা উচিত। তার কি কষ্ট পাওয়া উচিত? না-কি এত বড় একটা খবর গায়ে না মেখে ফিরে যাওয়া উচিত নিজ জীবনে?

বাবা নামক মানুষটাকে প্রায় ভুলতে বসেছিল অরা। বাবা তাকে কোনোদিন সন্তান হিসেবে ভালোবাসেনি। দায়িত্ব পালনের জন্যে নিজের কাছে রেখেছেন ঠিকই, তবে একটা সময় পর স্বার্থের বশীভূত হয়ে নিজের মেয়েকেই পর করে দিতে চেয়েছেন। এতগুলো বছর ধরে ওই মানুষটার ওপর প্রচুর ক্ষোভ জমা পড়েছে। বাবা চাইলেই পারতেন অরার জীবনে শান্তির আঁচ এনে দিতে। চাইলেই পারতেন নতুন মায়ের অত্যাচার থেকে তাকে রক্ষা করতে। কিন্তু তিনি সেসব কিছুই করেননি। নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করে গেছেন সারা জীবন।

এত বছরের এত এত জমে থাকা ক্ষোভ, সব যেন নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। ভেতর থেকে কিছু একটা যেন এসে বারবার অরাকে বলছে, একটাবার গিয়ে বাবার কবরের সামনে দাঁড়াতে। মানুষটা সেই কবে চলে গেছে, শেষবার দেখার সুযোগ তো হলো না।

পুকুরঘেরা অপরূপ সুন্দর এক রিসোর্টে আজ শুটিং হচ্ছে। এই মুহূর্তে শট চলছে রিসোর্টে মূল দরজার সামনে। অরা এতক্ষণ আরশাদের গ্রীন রুমে বসে জরুরি ফোন কলগুলো সারছিল। আচমকা চাচার এই কলটা এসে তার স্বাভাবিক চিন্তা-ভাবনাগুলোকে স্থবির করে গিয়েছে।

শট ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে। ক্যামেরাম্যান ব্যস্ত ভঙ্গিতে ক্যামেরা নিয়ে ছুটে গেল আরশাদের কাছে। শটটা যদি আরশাদের পছন্দ হয় তবেই সিনেমার জন্যে চূড়ান্ত করা হবে। পছন্দ না হলে আবার নতুন করে শট নেওয়া হবে। সুপারস্টারদের নিয়ে সিনেমা বানানোর এই এক জ্বালা! পরিচালকদের কথার কোনো মূল্যই থাকে না সেটে।

আরশাদ তার চেয়ারে বসে ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে। ডান হাতের আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেট জ্বালিয়ে রেখেছে কিন্তু মুখে দিচ্ছে না। তার চোখদুটো সানগ্লাসের আড়ালে ঢেকে যাওয়ার কারণে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না তার মুখভঙ্গি।

অরা এসে দাঁড়ালো আরশাদের পাশে। অরার চোখেমুখে কেমন উদ্ভ্রান্ত ভাব। আরশাদ ইশারায় ক্যামেরাম্যানকে যেতে বলল। যার অর্থ, শট তার পছন্দ হয়েছে।

অরা ইতস্তত করে বলল, “স্যার… একটা কথা।”

আরশাদ মোবাইলের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “বলো।”

“আমার ছুটি লাগবে।”

“কবে?”

“আজকে।”

আরশাদ বিরক্ত গলায় বলল, “ওয়াট ননসেন্স! তুমি জানো একদিনের নোটিশে আমি ছুটি দিতে পারবো না। জানো না?”

অরা অস্পষ্ট গলায় বলল, “একটা ইমারজেন্সি হয়ে গেছে স্যার।”

“সব তোমার ফাঁকিবাজি। ইমারজেন্সি আবার কী?”

অরা ক্লান্ত গলায় বলল, “আমার বাবা মারা গেছে স্যার। যদিও এক বছর আগে, কিন্তু আমি আজ জানতে পারলাম।”

আরশাদের মুখভঙ্গি নিমিষেই বদলে গেল। সকল কাঠিন্য ও গাম্ভীর্য উবে গিয়ে জায়গা করে নিল করুণা।

আরশাদ কিছু একটা বলতে যাবে তার আগেই অরা ব্যস্ত গলায় বলল, “থাক স্যার, আমি অন্য আরেক দিন চলে যাবো।”

আরশাদকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে অরা সরে এলো। মূলত তার চোখভর্তি জল চলে এসেছে। যেকোনো সময় তা বেয়ে পড়বে তার নরম গাল বেয়ে। গোটা পৃথিবীর কাছে অরা নিজেকে উপস্থাপন করে একজন সাহসী মেয়ে হিসেবে। সাহসী মেয়েদের চোখে জল মানায় না।

অরা এসে বসলো পুকুরের পাড়ে। পুকুরে টকটকে গোলাপী পদ্ম ভেসে বেড়াচ্ছে। এগুলো আসল ফুল না প্লাস্টিকের কে জানে? ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে চোখ জুড়িয়ে যায় এটাই আসল কথা।

দীর্ঘক্ষণ জলের দিকে তাকিয়ে রইল অরা। অশান্ত হৃদয় ক্রমেই শান্ত হতে শুরু করেছে। তবে মনের মাঝে সেই অদ্ভুত অনুভূতি এখনো রয়ে গেছে। অরা এখনো বুঝতে পারছে না বাবার মৃত্যুতে তার কেমন অনুভব করা উচিত। চোখের জল সাবধানে মুছে নিয়েছে বহু আগেই। তবুও কান্না পাচ্ছে, তবে কাঁদতে ইচ্ছা করছে না। এই অদ্ভুত অনুভূতিকে কী নামে প্রকাশ করা যায় কে জানে?

হঠাৎ আরশাদ এসে বসলো অরার পাশে। বস এসে বসায় স্বভাবতই সম্মান জানানোর জন্যে উঠে দাড়াঁতে যাবে অরা, ঠিক তখনই আরশাদ ইশারায় বসে থাকতে বলল তাকে। অরা বসে ঠিকই রইল কিন্তু তার মনের মাঝে একরাশ অস্থিরতা। নীরবতা ক্রমেই অস্থিরতা বাড়িয়ে দেয়।

নীরবতা ভঙ্গ করে আরশাদ হঠাৎ বলল, “আমার সঙ্গে তোমার অনেক মিল জানো অরা।”

কথাটার অর্থ বুঝতে না পেরে অরা বলল, “জি স্যার?”

আরশাদ শান্ত গলায় বলল, “আমার বাবা, ছোটবেলায় আমাদেরকে ফেলে চলে যায়। গল্পটা কি তুমি জানো?”

অরা হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।

আরশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “তুমি যেমন তোমার বাবা সহ্য করতে পারো না, আমিও ঠিক তাই। ঘৃণা করতাম আমি আমার বাবাকে। হয়তো এখনো করি। তখন আমার প্রহর সিনেমাটার শুটিং চলছে। হঠাৎ একটা ফোন আসলো। বাবা না-কি মারা গেছে। এক সেকেন্ডের মধ্যে আমার সব রাগ-ঘৃণা উবে গেল। চোখের সামনে বারবার তার মুখটা ভেসে উঠছিল। আমার কিন্তু তখন বাবার চেহারাটাও মনে নেই। আবছা আবছা মনে আছে। আমি যেখানে আমার বাবাকে সবথেকে বেশি ঘৃণা করতাম, সেই আমি বাবার মৃত্যুর পর সবকিছু ফেলে রেখে ছুটে যাই অস্ট্রেলিয়াতে।”

ফেলে আসা স্মৃতিগুলো যেন স্পষ্ট ভেসে উঠেছে আরশাদের চোখে। ওই চোখদুটোর দিকে তাকালেই দেখা মিলবে তার ফেলে আসা দিনগুলোর।

অরা সাবধানে চোখের জল মুছে বলল “আমার বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার পর আমি কখনো বাবার মুখোমুখি হতে চাইনি।তার কারণেই তো আমার জীবনটা এত এলোমেলো হয়ে যায়। সে চাইলেই আমার ছোটবেলাটা আরও সুন্দর হতে পারতো। কিন্তু সে চায়নি।”

আরশাদ অবাক হয়ে লক্ষ্য করলো অরা কাঁদছে। নিঃশব্দে কান্না। আরশাদ জানে তার ম্যানেজার নিতান্তই বাচ্চা একটা মেয়ে। বাচ্চা মেয়ে হওয়া সত্বেও বাচ্চামির লেশমাত্র কোনোদিন দেখেনি তার মাঝে। আজ দেখছে।

অরা এবার চোখের জল মোছার কোনপ্রকার চেষ্টা না করে বলল, “আমিও তো আমার বাবাকে ঘৃণা করি স্যার। তবুও কেন তার কাছে যেতে ইচ্ছা করছে?”

আরশাদ দৃঢ় গলায় বলল, “তুমি যাও অরা।”

“কিন্তু স্যার…”

“যাও তুমি। রক্তের সম্পর্কগুলো এমনই হয়। তুমি সবকিছু ছেড়ে আসতে পারলেও, এই বন্ধন কখনো ছিঁড়তে পারবে না। একটা কাপড়ের টুকরা হাত দিয়ে ছিঁড়তে চাইলে কী হবে জানো? কাপড়টা ছিঁড়বে ঠিকই, কিন্তু সমানভাবে না। সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সুতা কাপড়ের শেষ ভাগে ঠিকই রয়ে যাবে। মানুষও ঠিক তেমন।কেউই রক্তের সম্পর্ক একেবারে ভেঙে ফেলতে পারে না।”

চোখের জল মুছে আরশাদের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে রইল অরা। যেন কথাগুলো বেশ কঠিন হয়ে গেছে তার জন্যে। কথার অর্থ উদ্ধারের চেষ্টায় অরা এখনো মগ্ন।

আরশাদ বলল, “তুমি যাও। ফিরে আসার জন্যে তাড়াহুড়ো করতে হবে না।”

বাকি কাজগুলো মেহেদীকে বুঝিয়ে দিয়ে অরা বেরিয়ে গেল। তবে তার এই ঘটনাটা গভীর ছাপ ফেলল আরশাদের মনে। সে অরাকে চেনে নিতান্ত রোবট প্রকৃতির একটি মেয়ে হিসেবে। সকাল থেকে রাত অব্দি কাজ ছাড়া অন্য কোনো ভাবনা নেই। কিন্তু আজ একেবারেই ভিন্ন রূপে ধরা দিলো অরা। যার অনুভূতি আছে, যে কাঁদতে জানে, যার আপনজনের প্রতি রয়েছে এক অদৃশ্য টান।

আপনজন নিয়ে অরাকে দীর্ঘ লেকচার দিলেও আরশাদের নিজেরই আপনজনদের নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই। আপনজন বলতে তার কে আছে? কথা, আপা আর মা। আর তো কেউ নেই, আছে? কথার সঙ্গে না হয় দিনে বেশ কয়েকবার কথা হয়। কিন্তু বাকি দুজনের সঙ্গে? আপা ফোন করলে হাজার বিরক্তি নিয়ে রিসিভ করলেও মায়ের সঙ্গে কথা হয় না বহুদিন। আরশাদ ইচ্ছে করেই মায়ের সঙ্গে সব ধরনের যোগাযোগ বন্ধ করে রেখেছে।

আপনজনদের ওপর অভিমানের পাহাড় তৈরি করতে নেই। একদিন তারা হুট করে চলে গেলে মনের মাঝে আক্ষেপ জমে যায়। অতঃপর নিজেকেই কষ্ট পেতে হয়। যেমন অরা পাচ্ছে। বহু ভাবনা-চিন্তার পর আরশাদ সিদ্ধান্ত নিলো আজ একবার মাকে ফোন করবে। তবে সমস্যা একটাই, মাকে ফোন করলেই আবারও মনে পড়ে যাবে সেই দিনটার কথা। সেই দিনের প্রতিটি সেকেন্ডের ঘটনা আজও স্পষ্ট মনে আছে। মস্তিষ্কে দৃঢ়ভাবে গেঁথে আছে।

মাকে অবশেষে ফোনটা করেই ফেলল আরশাদ। দুটো রিং বাজার পর অপরপ্রান্ত থেকে রিসিভ হলো। তবে কোনপ্রকার কথা শোনা যাচ্ছে না। মা হয়তো অবিশ্বাসের স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন।

নীরবতা ভঙ্গ করার দায়িত্বটা নিজ কাঁধে নিয়ে আরশাদ স্বাভাবিক গলায় বলল, “কেমন আছ মা?”

সেলিনা হক হতবাক গলায় বললেন, “আরশাদ? বাবা তুই আমাকে ফোন করেছিস? সত্যি, তুই আমাকে ফোন করেছিস?”

“কেন? ফোন করতে পারি না?”

“অবশ্যই পারিস বাবা! আমার যে কী আনন্দ হচ্ছে তোকে বলে বোঝাতে পারবো না।”

“তোমার শরীর ঠিক আছে?”

“এই তো বাবা, শরীর আলহামদুলিল্লাহ ঠিক আছে। তুই ভালো আছিস তো আরশাদ?”

আরশাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “হুঁ, আমি ভালোই থাকি।”

সেলিনা হক তৃপ্ত গলায় বলল, “সেই দোয়াই তো সবসময় করি বাবা। তুই ভালো থাকলেই আমি ভালো থাকি? আমার দিদিভাই কেমন আছে?”

“কথা ভালো আছে মা। কিছুদিন আগে ওকে নিয়ে বেড়িয়ে আসলাম।”

“শুনেছি, অরা বলেছে।”

চুপ করে রইল আরশাদ। দীর্ঘদিন মায়ের সঙ্গে কথা না বলে কেমন বদভ্যাস হয়ে গেছে। কুশল বিনিময়ের পর আর কোনো কথা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

সেলিনা হক ইতস্তত গলায় বললেন, “আরশাদ?”

“হুঁ?”

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে সেলিনা হক কম্পিত স্বরে বললেন, “তুই কি এখনো আমার ওপরে রাগ করে আছিস বাবা?”

আরশাদ ক্লান্ত গলায় বলল, “আমি জানি না মা। আমি কার ওপরে রাগ করে আছি, কার ওপরে নেই – নিজেই বুঝতে পারি না।”

“আমি তো তোকে বলেছি আমার ভুল হয়ে গেছে, মস্ত বড় ভুল। আমি পুরো ঘটনা জানতাম না। জানলে কি আর তোকে এত জোরাজুরি করি?”

“এসব কথা এখন থাক না মা। পুরনো জল ঘোলা করে কোনো লাভ নেই।”

সেলিনা হক উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “আরশাদ? কোনো কিছুই কি আর আগের মতো হবে না?”

আরশাদ কিছুটা আক্ষেপ আর কিছুটা রাগ মিশ্রিত গলায় বলল, “আমার জায়গায় তুমি থাকলে কী করতে? সবকিছু আগের মতো করে ফেলতে?”

সেলিনা হক এই প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেলেন। শুধু শুধু প্রসঙ্গটা টেনে এনে ছেলেকে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে হয় না। তার কৌতুহল চলে গেল আরশাদের কর্মজীবনের দিকে।

পরদিন ভোর ছয়টা আট। বাবার কবরের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরা। হাত-পা ক্রমেই কেঁপে উঠছে। একই সঙ্গে অনেকগুলো অনুভূতি অনুভব করতে পারছে সে। কষ্ট হচ্ছে, বাবার চলে যাওয়াতে। রাগ হচ্ছে, নিজের ওপরে। এত অন্যায়ের পরও বাবাকে নিয়ে কষ্ট পাওয়ার জন্যে। অনুতাপ হচ্ছে, মৃত্যুর এতগুলো দিন পর কবরের কাছে আসায়।

সীমা অরার পাশে এসে দাঁড়ালো। প্রিয় বান্ধবীকে এত লম্বা পথে একা ছাড়েনি মেয়েটা।

সীমা শান্ত ভঙ্গিতে বলল, “ঘরে তালা দেওয়া। খোঁজ নিয়ে আসলাম, তোর সৎ মা এখানে আর থাকে না। ছেলেদের নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেছে।”

অরা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলল, “ভালোই হলো। উনাকে ফেস করার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।”

“তুই ঠিক আছিস তো অরা?”

“হুঁ, ঠিক আছি।”

কথাটা ভুল বলা হলো। এতটা বেঠিক অরা এ জীবনে কোনদিন হয়নি।

অরা থেমে থেমে বলতে লাগলো, “বাবাকে কবর দেওয়া হয়েছে দাদির কবরের পাশে। আগে এখানে একটাই কবর ছিল। মাঝে মাঝে গভীর রাতে আমি হারিকেন নিয়ে ঠিক এই জায়গাটায় এসে পড়াশোনা করতাম। অনেকে কবরের আশেপাশে ভিড়তে ভয় পায়, তাদের গা ছমছম করে। কিন্তু আমি নির্ভয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে পারতাম। মনে হতো দাদী আমার পাশেই আছে। অথচ আমার দাদীকে কিন্তু আমি কোনোদিনও দেখিনি জানিস। আমার জন্মের অনেক আগেই সে মারা যায়। তবুও অদ্ভুত এক টান অনুভব করতাম। কাল স্যার এই টানের কথা বলছিলেন।”

সীমা কোমল গলায় বলল, “বাবার মৃত্যুর খবর তুই না জানলেই ভালো হতো। তাই না রে?”

অরা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, “না, ভালো হয়েছে জেনেছি। আখির গল্পটা আমার কাছে অপূর্ণ হয়ে ছিল। এখন ওর গল্পে একটা ফুলস্টপ বসাতে পারবো।”

“এখানে কয়েকটা দিন থেকে যাবি? তোর ভালো লাগবে।”

“উহুঁ। আমি শুধু আজকের ছুটি নিয়ে এসেছি।”

সীমা আক্ষেপজড়িত গলায় বলল, “তুই এমন কেন অরা? সারাক্ষণ কাজ কাজ করিস কেন?”

“ওই যে বললাম, আখিতারা। কাজে ডুবে থাকলে ওর ওপর হওয়া অন্যায়গুলোর কথা ভুলে থাকতে পারি।”

(চলবে)

#ফিরে_আসা
১৪
লেখা : অতন্দ্রিলা আইচ

“স্যার, একটা কথা ছিল।” ভয়ে ভয়ে বলল অরা।

আরশাদ সবে স্ক্রিপ্টটা নিয়ে বসেছিল। এই ইন্ডাস্ট্রিতে সুপারস্টার হওয়ার জন্যে ভালো অভিনেতা হওয়ার প্রয়োজন নেই। কেউ অতি অখাদ্য অভিনয় করেই হয়ে যেতে পারে সুপারস্টার। ভাগ্যক্রমে আরশাদের নাম সেই তালিকায় নেই। অভিনয়ের ব্যাপারে তার বেশ কড়াকড়ি। শুটিংয়ের আগে যেসব দৃশ্য ধারণ করা হবে সেগুলোর সংলাপ নিয়ে নিজের মস্তিকে গবেষণা চালায় কিছুক্ষণ। সেই কাজে কোনপ্রকার ব্যাঘাত সৃষ্টি হলে বিরক্তির সীমা থাকে না তার। অরা যেমন ব্যাঘাত ঘটলো।

অরা কারণ ছাড়া কাজের সময় ব্যাঘাত ঘটাতে আসবে না জেনেই আরশাদ বিরক্ত গলায় বলল, “বলো।”

অরা ইতস্তত করে বলল, “কথাটা জরুরি।”

আরশাদ গলার স্বরে দ্বিগুণ বিরক্তি নিয়ে বলল, “হ্যাঁ বলো!”

অরা তবুও ইতস্তত করে যাচ্ছে। আরশাদ সকল মনোযোগ তার দিকে দিয়ে কথাটা না শুনলে যেন অনর্থ হয়ে যাবে।

আরশাদ ধাম করে স্ক্রিপ্টের পাতা বন্ধ করে গম্ভীর গলায় বলল, “বসো।”

অরা বসলো। তবে তার অস্থিরতা যেন এখনো থামছে না। দুশ্চিন্তায় কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে।

“কী ব্যাপার?”

অরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ম্যাম ফোন করেছিল স্যার, একটু আগে।”

আরশাদ ধমকের সুরে বলল, “কোন ম্যাম? তোমাকে না কতবার বলেছি তোমার কোনো ম্যাম নেই।”

আরশাদের হাজার বারণ সত্বেও অরা নওশীনকে ‘ম্যাম’ ডাকবেই। তবে এই মুহূর্ত সেটা সম্বোধন না করাই যৌক্তিক হবে। অরা এমন একটা কথা বলতে যাচ্ছে, যা শোনার পর আরশাদের রাগ হবে তুঙ্গস্পর্শী। অযথা সেই রাগের আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার কোনো মানে হয় না।

অরা শুকনো ঢোক গিলে বলল, “স্যার উনি ফোন করে বললেন, উনি না-কি বিদেশে চলে যাবেন।”

“বিদেশে চলে যাবেন মানে?”

“মানে কানাডায়, উনার মায়ের কাছে। গতকালই ভিসা পেয়ে গেছেন। আগামী ছয় মাস সেখানেই থাকবেন।”

আরশাদ বিরস গলায় বলল, “তাতে আমার কী?”

অরা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শুকনো গলায় বলল, “কথাকেও তার সাথে নিয়ে যাবেন স্যার।”

আরও কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল নীরবতা। আরশাদের মুখভঙ্গি দেখে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না সে রেগে গেছে না অবাক হয়েছে। তার হাতদুটো মুঠিবদ্ধ হয়ে গেছে। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে এসেছে। এ যেন প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস।

আরশাদ থমথমে গলায় বলল, “বাহ্! আমার মেয়েকে আমার পারমিশন ছাড়া আমার কাছ থেকেই দূরে নিয়ে যাবে?”

অরা চুপ করে রইল। এমন প্রশ্নের উত্তর তার কাছে না থাকাই তো স্বাভাবিক।

“কথা কোথাও যাচ্ছে না। সে যেখানে ইচ্ছা যেতে পারে কিন্তু কথা আমার কাছেই থাকবে।”

“কথার কানাডার যাওয়ার ব্যাপারে তিনি একেবারে সিউর। মূলত ওর জন্যই কানাডায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।”

“ওর জন্যেই মানে?”

অরা থেমে থেমে বলল, “কথাকে তিনি ওখানকার স্কুলে পড়াতে চান। ছয় মাস ওখানে থেকে দেখবেন কথা ওই স্কুলের সঙ্গে মানিয়ে চলতে পারে কিনা। যদি পারে তাহলে…”

দাঁতে দাঁত চেপে চোখদুটো বন্ধ করলো আরশাদ। তার সমস্ত শরীরের রক্ত টগবগ করে ফুটছে। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে সে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে, তবেই ত্রমেই অস্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে।

আরশাদ তার চিরচেনা রাগী গলায় বলল,‌ “কবে থেকে চলছে এসব প্ল্যানিং?”

“মাস খানেক তো হলো স্যার।”

“আর আমি এখন জানতে পারছি?”

অরার গা বেয়ে শীতল স্রোত বয়ে গেল। ব্যাপারটা আগেই আরশাদকে জানানোর প্রয়োজন ছিল। অরা ভেবেছিল শেষমেশ হয়তো নওশীন মেয়েকে নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমানোর চিন্তাভাবনা বাতিল করবে। শুধু শুধু স্যারকে রাগিয়ে দিয়ে লাভ কী?

আরশাদ ক্রুদ্ধ গলায় বলল, “তুমি আগামীকাল নিজ থেকে রেজিগনেশন লেটার এনে আমাকে দেবে। কোনো ভুল যেন না হয়।”

অরা মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেঝের দিকে তাকিয়ে রইল।

আরশাদ উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, “আমার লয়ারকে ফোন করে আসতে বলো। কথার কাস্টাডির আপিল করবো, ব্যবস্থা নিতে বলো।”

আরশাদ নিজের ঘরে গিয়ে প্রচন্ড ভয়ানক শব্দ করে দরজা বন্ধ করে দিলো। আর এদিকে দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে অরা। যদিও তার অস্থির হবার কোনো কারণ নেই। ঘূর্ণিঝড় এসে আঘাত হানবে আরশাদের জীবনে। তবুও অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। অরা চুপ করে বসে রইলো আরশাদের বসার ঘরে। লয়ারকে ফোন করলো না। কাস্টাডির আপিল করার সিদ্ধান্ত সে রাগের মাথায় নিয়েছে না-কি সুস্থ মস্তিষ্কে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।

অতীতে…

শূন্য দৃষ্টিতে জানালার দিকে তাকিয়ে আছে নওশীন। বসার ঘরের পূর্ব দিকের এই জানালাটা থেকে স্পষ্ট দেখা যায় তাদের বাগানটা। বাগানের ওপারেই মূল দরজা। সেই দরজা পেরিয়েই তো আসার কথা তার। তার অপেক্ষায় সেই কখন থেকে জানালার ধারে বসে আছে নওশীন। অপেক্ষার এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে গেলেও অপেক্ষাটা করেই যাচ্ছে।

নওশীনের চোখেমুখে একরাশ হতাশা। মনে মনে কিঞ্চিৎ ভয়। তবে ভয়ের চাইতে হতাশার পরিমাণই বেশি। আজ কথার দ্বিতীয় জন্মদিন। বিশেষ এই দিনটা উপলক্ষে কাল সন্ধ্যায় বাড়িতে ব্যাপক আয়োজন করা হয়েছে। ইন্ডাস্ট্রির বড় বড় তারকারা আসবে সেই আয়োজনে। তবে প্রথম আয়োজনটা বেশ সাদামাটাভাবেই করতে চেয়েছিল নওশীন।

কথার অনেকদিনের শখ তার ঘরটা বেলুন দিয়ে সাজানো থাকবে। যেদিকে চোখ যাবে সেদিকেই শুধু বেলুনের ছড়াছড়ি! তেমন আহামরি কোনো শখ নয়। নওশীন চাইলেই পারে সারা বাড়িটা বেলুনে মুড়ে দিতে। কিন্তু সে তা করে। শখটাকে জমিয়ে রেখেছিল। বিশেষ দিনে বাচ্চাদের কোনো শখ পূরণ করা হলে সেই স্মৃতি আজীবনের জন্যে তাদের মনে গেঁথে যায়। নওশীন চেয়েছিল সে এবং আরশাদ একসঙ্গে বেলুন দিয়ে ঘরটা সাজাবে। কারো সাহায্য নেবে না। আর ঠিক রাত বারোটার সময় সারপ্রাইজ দেবে তাদের রাজকন্যাকে।

এখন বাজছে রাত একটা সাতচল্লিশ। সারপ্রাইজের অপেক্ষা করে করে রাজকন্যা সেই কখন ঘুমিয়ে গেছে। সে বেচারি না হয় জন্মদিন, সারপ্রাইজ এসবের কিছু বোঝে না। কিন্তু যে বোঝে, ক্রমেই তার অভিমানের পাল্লা হচ্ছে ভারী। আরশাদ কী করে পারলো আজকের মতো এই বিশেষ দিনটায় দেরি করতে? নওশীনের রাগ হচ্ছে না। আরশাদের ওপর রাগ করার ক্ষমতা তার নেই। যা অনুভব হচ্ছে তা হলো নিখাদ কষ্ট।

নওশীনের চোখের সামনে মূল দরজাটা খুলে গেল। গাড়ির হেডলাইট সরাসরি এসে পড়লো তার মুখের ওপরে। অবশেষে তার আসার সময় হয়েছে। অভিমানে একাকার হয়ে বসে রইল নওশীন। দরজা খুলতে উঠলো না। দরজার লকের পিন কোড আরশাদের জানা আছে। বাইরে থেকে দরজা খুলতে তার কোনো অসুবিধা হবে না।

দুয়েকবার কলিংবেল বাজলো। অতঃপর বাইরে থেকে দরজাটা খুলে গেল। পারফিউমের ঝাঁঝালো ঘ্রাণ আর সিগারেটের গন্ধ একসঙ্গে ভেসে এলো ঘরে। নওশীনের চোখ তুলে তাকাচ্ছে না তবে আরশাদের উপস্থিতি অনুভব করতে তার বিন্দুমাত্র অসুবিধা হচ্ছে না।

আরশাদ কিছু বলছে না। চুপ করে এসে বসলো নওশীনের পাশে। তার ডান হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বুকের কাছে ঠেকালো। কোনো একটা ভুল করে ফেললে আরশাদ এমনই করে। নিজের পক্ষে সাফাই না গেয়ে চুপচাপ নওশীনের পাশে বসে থাকে।

এক পর্যায়ে নীরবতা ভঙ্গ করলো নওশীন অভিমানী কণ্ঠে বলল, “আজকেও দেরি?”

আরশাদ সঙ্গে সঙ্গে কোমল গলায় বলল, “নওশীন আই অ্যাম সো সরি!”

“তোমার সরি দিয়ে আমি কী করবো?”

আরশাদ অনুতপ্ত গলায় বলল, “আমি জানি, অনেক বড় ভুল করে ফেলেছি। আমি বুঝতে পারিনি শেষের শটে এতটা সময় লাগবে।”

নওশীনের আরশাদের কাছ থেকে তার হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, “আর আমার মেয়ের বার্থডে? তার কোনো মূল্য নেই তোমার কাছে?”

“অবশ্যই আছে নওশীন। আমি অন টাইমে আসতে চেয়েছিলাম, কিন্তু শটটা শেষ হতে হতে এত দেরি হয়ে গেল!”

নওশীন আক্ষেপের সুরে বলল, “কত শখ করে প্ল্যান করলাম রাত বারোটায় আমরা দুজন মিলে কথাকে সারপ্রাইজ দেবো। কিন্তু তুমি তো আমাকেই সারপ্রাইজড করে দিলে। কী হতো একটা দিন একটু তাড়াতাড়ি বাসায় এলে। অন্য কোনো দিন তো তোমার কাজে বাঁধা দিই না শাদ। সারা দিন তুমি শুটিং করো, রাত করে বাড়ি ফেরো। তোমার সমস্ত সময় কাজের জন্য, আমাদের জন্য তো কোনো সময়ই নেই।”

আরশাদ আহত গলায় বলল, “আই অ্যাম সরি নওশীন। তুমি চাইলেই তো সবকিছু ঠিক করে নিতে পারি আমরা। এখন কথাকে সারপ্রাইজ দিই। কথা কোথায়?”

“কিচ্ছু ঠিক হবে না শাদ। কথা ঘুমিয়ে পড়েছে।”

বেশ অনেকটা সময় চুপ করে থেকে আরশাদ ফিসফিস করে বলল, “আই অ্যাম সরি।”

ছেলেটা এতবার সরি বলায় নওশীনের ভেতরকার অভিমানের বরফ ক্রমেই গলতে শুরু করেছে। তবে মুখভঙ্গি তা প্রকাশ করছে না। ভাবটা এমন করছে যেন আরশাদের ওপর সে প্রচন্ড রেগে আছে।

নওশীন রাগী ভঙ্গিমায় বলল, “সরো তুমি আমার কাছ থেকে।”

আরশাদ নওশীনের গা ঘেসে বসে বলল, “সরবো না।”

নওশীন ব্যর্থ হয় আক্ষেপ নিয়ে বলল, “সরতে তোমাকে হবেই। আমারই ভুল হয়েছে, তোমাকে আশা করা। আর কোনো বিশেষ দিনে তোমার আশায় বসে থাকবো না। আমার বাচ্চাদের নিয়ে আমিই সেলিব্রেট করবো।”

“বাচ্চাদের?”

“তাড়াতাড়ি এলে কথার সাথে সাথে তুমিও একটা সারপ্রাইজ পেতে। যেহেতু আসনি, কোনো সারপ্রাইজও তুমি পাচ্ছ না।”

আরশাদ ধাঁধায় পড়ে গেল। নওশীন কী বলতে চাইছে সে খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে। আবার ঠিক পরমুহূর্তেই মনে হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না।

আরশাদ নওশীনের চোখের দিকে তাকিয়ে কোমল স্বরে বলল, “নওশীন?”

তার চোখেমুখে খেলে বেড়াচ্ছে একরাশ প্রশ্ন। প্রশ্নগুলোর সঠিক উত্তরও সে আঁচ করতে পারছে। তবে মনে হচ্ছে যেন, সেই উত্তর নওশীনের মুখ থেকে না শুনলে সে মরেই যাবে। অভিমানে আবেগে নওশীনের চোখ বেয়ে জল পড়ছে।

সেই জল মোছার কোনপ্রকার চেষ্টা না করে নওশীন বলল, “তুমি আবার বাবা হচ্ছ, আমি আবার মা হচ্ছি। সকাল থেকে অপেক্ষা করে আছি কখন তোমাকে খবরটা জানাবো। আর তুমি…”

নওশীনকে কথাটা আর শেষ করতে দিলো না আরশাদ। তার আগেই তাকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বলল, “I love you! I love you more than my life.”

নওশীনের ঠোঁটে ফুটে উঠলো সুখের প্রচ্ছন্ন হাসি। হাসিটা বজায় রেখে বলল, “Love you too.”

বাবা হওয়ার সংবাদ যে একটা ছেলের জন্যে কতটা আনন্দদায়ক হতে পারে, আরশাদকে না দেখলে বোঝার উপায় নেই। প্রথমবার যখন সংবাদটা পেয়েছিল আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব সবাইকে ফোন করে আনন্দে আত্নহারা হয়ে জানিয়েছিল, “আমি বাবা হবো!” এবারও তাই করলো। আরশাদের চিরচেনা এই পাগলামি তাকে করে তোলে অনন্য। পাগলামির মাঝেই লুকিয়ে আছে তার সরলতা। সরলতা জিনিসটাই ভয়ঙ্কর। এতটাই ভয়ঙ্কর যে তা একটা মানুষকে সম্পূর্ণভাবে শেষ করে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।

বর্তমানে…

আরশাদ আগামীকাল রেজিগনেশন লেটার চাকরিটা ছেড়ে দিতে বলেছে অরাকে। নেহায়েত রাগের মাথায় বলা। এর আগেও বহুবার রাগের মাথায় চাকরি চলে যাওয়ার হুমকি পেয়েছে অরা। এবার সত্যি সত্যি চাকরি চলে গেলে বেঁচে যায়। অপরিচিত কাউকে নিজের চাকরির সমন্ধে বলতে বেশ গর্ববোধ করে অরা। সুপারস্টার আরশাদ হকের ম্যানেজার সে। আর কজনের আছে এত বড় চাকরি?

পরিচিতি, সমাজে মর্যাদা, ভালো বেতন – এই চাকরির যেমন হাজারটা সুবিধা আছে, তেমনি আছে হাজারটা অসুবিধা। কারণ এই চাকরি করতে গেলে ভেতরে ভেতরে প্রচুর যন্ত্রণা সহ্য করতে হবে। আগামীকাল আরশাদের শুটিং আছে। আবার আগামীকালই কথাকে গাজীপুর থেকে আনতে যাওয়ার দিন। সেই যুক্তরাষ্ট্র থেকে একসঙ্গে ঘুড়ে আসার পর বাবার সঙ্গে দেখা হয়নি তার। প্রতিবারের মতো অরাই যাবে তাকে আনতে।

কথার সঙ্গে সময় কাটাতে কখনোই খারাপ লাগে না অরার। তবে সমস্যাটা বাঁধিয়েছে নওশীন। কিছুক্ষণ আগে তার ফোন এলো। খুব স্বাভাবিক ভাবেই বলল, “অরা, তুমি তো কাল কথাকে নিয়ে ঢাকায় যাবে। আমিও তোমাদের সঙ্গে যাবো। শাদের সঙ্গে আমার জরুরি কিছু কথা আছে। কথাগুলো সামনাসামনি বলা দরকার। আমি যে যাচ্ছি, এই কথাটা আবার ওকে বোলো না কিন্তু।”

যত জ্বালা! আরশাদকে যদি জানাতে না চায়, তাহলে অরাকে জানালো কেন? অরা বেচারি এখন আগামীকাল পর্যন্ত ভেতরে ভেতরে অপরাধবোধে ভুগবে। ডিভোর্সের পর মাত্র দুবার দেখা হয়েছে দুজনের। আরশাদ এক মুহূর্তের জন্যেও মুখোমুখি হতে চায় না তার প্রাক্তনের। অথচ আগামীকাল ঠিকই মুখোমুখি হতে হবে। ব্যাপারটা জেনেও অরা তাকে জানাচ্ছে না।

ওদিকে আবার আরশাদের লয়ার শেষমেশ এসে পড়েছে। বসার ঘরে চলছে দীর্ঘ কথোপকথন। কথার কাস্টডি আপিলের সিদ্ধান্তে আরশাদ পুরোপুরি অনড়। কোনোক্রমেই তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের উপায় নেই। এই বিষয়টা নওশীনকে জানানোর দরকার। অরা জানাচ্ছে না। অপরাধবোধ দুদিক থেকেই তাকে শেষ করে দিচ্ছে।

সব দায়িত্ব তার ওপরেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে কেন কে জানে? এই দুজন নিজেরা নিজেদের মধ্যে কথা বললে আজ এই দুর্দশায় পড়তে হতো না। হতাশায় গা জ্বলে যাচ্ছে অরার। মনে মনে কালকের দিনটার জন্যে প্রস্তুতি নিতে হবে। কাল যে তার ওপর দিয়ে কী ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাবে, তা শুধুমাত্র অরাই জানে।

(চলবে)