ফেরার কোন পথ নেই পর্ব-১২

0
218

#ফেরার_কোন_পথ_নেই ( ১২)
কলমে #রেহানা_পুতুল
দিশেহারা আমি কি করব ভেবে পাচ্ছিনা।দিকভ্রান্ত নাবিকের ন্যায় করুণ চোখে এদিক এদিক তাকাচ্ছি। হুঁশ হলো মাহিনের স্কুলে যেতে হবে। মাহিনকে দোকানে রেখে একরাম ভাইসহ থানায় গেলাম। জিডি করলাম মিতাকে সন্দেহ করে। পরে ভাইজান রিকসাযোগে আমাকে দোকানের সামনে নামিয়ে দিল। তিনি উৎকন্ঠা নিয়ে বাসায় ফিরে গেলেন।

আমি মাহিনকে নিয়ে বাসায় চলে গেলাম। এশা একাই চলে আসতে পারবে। আমি বাসার গেটে পা রাখতেই দেখি বাড়ির দারোয়ান চান মিয়া আয়রার সাথে গল্প করছে। আমি অবিশ্বাস্য চোখে আয়রার দিকে চেয়ে রইলাম। আয়রা ভীতসন্ত্রস্ত চোখে আম্মু বলে আমাকে জড়িয়ে ধরল। আমি হুহু করে কেঁদে ফেললাম।

চান মিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম,
চাচা ওকে কে এনে দিল?

আমিতো কাউকেই দেখিনি। ওকেই একা পেলাম গেটের ভিতরে।

আমি আয়রাকে নিয়ে বাসায় চলে গেলাম। আমার রুমে নিয়ে ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
তোকে স্কুল থেকে কে নিয়ে গেল মা?

আমি চিনিনা আম্মু।

আমাদের বাসায় যে একজন মহিলা ছিল কয়দিন আগে সে নাকি?

না আম্মু। পুরুষ মানুষ ছিল উনি।

আমি অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছি আয়রার স্বাভাবিক আচরণে। ওকে জেরা করতে লাগলাম আসামির মতো।

কোন পুরুষ? কি বলল তোমাকে? তুমি আমি ছাড়া অন্য কারো সাথে স্কুল থেকে বের হলে কেন? কতদিন মানা করেছি, অপরিচিত কারো থেকে কিছু খাবেনা। অপরিচিত কারো সাথে কোথাও যাবেনা। চোখ কড়মড়িয়ে বললাম।

সেই মামা আমার হাতে ম্যাংগোবার দিয়ে বলল, আয়রা তোমার আম্মু ব্যস্ত দোকানে। আমি তোমার মামা হই। আমাকে পাঠিয়েছে তোমাকে নিয়ে যেতে বাসায়।

আমি তাজ্জব চোখে আয়রাকে দেখছি আর শুনে যাচ্ছি একাগ্রচিত্তে।
তারপর?

তারপর সে আমাকে রিকসায় করে একটা মার্কেটে নিয়ে গেল। বলল তার নাকি কি কাজ আছে সেখানে। তারপর আমাদের বাসার গেটের সামনে রেখে বলল,যাও বাসার ভিতরে। এরপর সে চলে গেল।

সেকি তখন ফোনে কোথাও কথা বলেছে?

হুম বলেছে।

কি বলেছে মনে আছে?

বলল,কি করব এখন। পরে আমি না ফেঁসে যাই। এসব। আমার আর কিছুই মনে নেই আম্মু।

আর কোনদিন কারো সাথে বের হবেনা। মনে থাকে যেন। আমি কাউকে
পাঠাইনি। তোমাকে চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। পরে বিক্রি করে দিত ছেলেধরার কাছে। আবার তারা অন্য জায়গায় বিক্রি করে দিত। তাদের কথা না শুনলে মারধোর করত। বুঝলে।

আয়রা ভীষণভাবে ঘাবড়ে গেল। সরু চোখে আমার মুখপানে চাইল। ওমাগো! বলে কাঁদো কাঁদো গলায় আমাকে জাপটে ধরল। আমি ইচ্ছে করেই ভয় পাইকে দিলাম। যেন আর কারো সাথেই সে কোথাও না যায়।

আমার বুক ধড়পড় করতে লাগল পানি থেকে ডাঙায় তোলা মাছের মতো। চিন্তায় পড়ে গেলাম। যদি মিতাই না হয়। তাহলে কে হতে পারে এই লোক। নিরুপায় হয়ে হিসাবটা নিজের মত করে মিলিয়ে নিলাম।

হয় এহসান মিতাকে বলছে। মিতা নিজে সেইফ থেকে তার ঘনিষ্ঠ কাউকে দিয়ে আয়রাকে সরিয়ে নিয়েছে। নয়তো শুধু মিতাই একাজ করেছে। যেন আমি মামলা তুলে এহসানকে মুক্ত করে আনি। কিন্তু পারলনা কাজটা কাঁচা হয়ে যায় বলে। এহেন পরিস্থিতিতে একটা পাগলের ও সন্দেহের তীর তাদের দুজনের দিকেই বিদ্ধ করবে। রক্ষা পাবেনা। সাংঘাতিকভাবে তাদের পাতা ফাঁদে তারাই আটকে যাবে।

এহসান ও মিতার প্রতি আমার ঘৃণা ও অবজ্ঞার স্তর আরো কয়েপ ধাপ উঁচুতে উঠে গেল হুড়হুড় করে।

সেদিন আর দোকানে গেলাম না। নিজের জীবনের উপরে একঘেয়েমি হানা দিল। সংসারের নিত্য গৃহকার্য, সন্তানদের দেখভাল , ওদের স্কুলে আনানেওয়া,বাজার করা, দোকানের তদারকি,অর্থের যোগান করা এতসবকিছু দমকা হাওয়ার মতো উড়ে এসে জুড়ে বসল আমার ঘাড়ে। নাভিশ্বাস হওয়ার উপক্রম আমার। তাই আর দেরি করলাম না। সেদিন পড়ন্ত বিকেলেই মাকে ফোন দিলাম। আয়রার বিষয় জানিয়ে মাকে ওদের কাছে চলে আসতে অনুরোধ করলাম।
মা এককথায় রাজী হলো সাতপাঁচ না ভেবে।কিন্তু আমি জানি মায়ের পিছু টান রয়েছে সংসারে অনেকভাবে। উনার নারকেল সুপারির বাগান,অনেকগুলো হাঁসমুরগি, এক ঝাঁক কবুতর,সবজি বাগান,আরো কত কি। তবুও কন্যার কল্যাণের জন্য মা সব বিসর্জন দিতে রাজী। আহারে আমার মা জননী। মিতাও মা। আমিও মা। আমার মাও মা। কিন্তু মা মাতে কত বিস্তর ফারাক। হাহ!

দুদিন বাদেই মা চলে আসল ঢাকায় আমার বাসায়। আসতে গ্রামের অনেক খাবার নিয়ে আসল মা। পারেতো আরো আনে। মলিন কাঁথার মত আমার বিপন্ন মুখশ্রী দেখে মা তব্দা খেয়ে গেল। জীর্ণশীর্ণ আমার দিকে মা হা হয়ে চেয়ে রইলেন। যেন প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কোন ভগ্নস্তূপ দেখছেন মা। মায়ের দেখাটা অমূলক নয়। আগে বেশ পরিপাটি চলতাম। আরশীতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম নিজের মায়াবী উজল মুখখানি। আর এখন আমি যেন রোবট হয়ে গিয়েছি। যন্ত্রের মত দিবানিশি খেটে চলছি। নেই আমার মাঝে প্রাণ। আছে শুধু আকাশসম উদ্বিগ্নতা ও আত্মনির্ভরশীল হওয়ার অদম্য অভিলাষ।

মা আসাতে জানে পানি এলো। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। বাসার ভিতরটা মা দেখাশুনা করছে। আমি বাইরের দিকটা। মা আসার খবর শুনে বাদল ভাই আমার থেকে ঠিকানা নিয়ে এক সন্ধ্যায় বাসায় চলে এলো। বাচ্চাদের জন্য আনল অনেক রকমের ফলমূল ও মিঠাই।

আমাদের সবার সাথে বাদল ভাই কয়েকঘন্টা সময় কাটাল। আমি ডিভোর্স নিয়ে সরাসরি আলাপ করলাম তার সাথে।
বলল, এজ আরলি এজ পসিবল আমি সব ব্যবস্থা করছি।
উনি মায়ের কাছে অনুযোগ করে বলল,
চাচী, শিলা আমাকে কখনোই তার বাসায় আসতে বলেনি। আপনি না এলে কখনোই আসা হতনা আমার। বলেই আড়চোখে আমার দিকে চেয়ে মিটমিটিয়ে হেসে ফেলল।

মা হেসে দিল শুনে। পান চিবুতে চিবুতে বলল, না বলেই এত বিপদ শিলার। আর বললে যে কি হত আল্লাহ মালুম। তুইতো বিয়ে করবি কবে? আমি তোর বিয়ে না খেয়ে গ্রামে যাবনা।

একদিন না একদিন করবই চাচী। পছন্দমতো কোন মেয়েই পাচ্ছিনা। আবার যাদের পছন্দ হয় তারা একলা নেই। দোকলা হয়ে গিয়েছে। বলে একগাল হেসে ফেলল।

মা তুমি চিন্তা করনা। বাদল ভাই বিয়ে করবে খুউব শীঘ্রই।

ঘটক পেশায় নাম দিলি নাকি শিলা?

আপনার জন্য দিব। আলতো হেসে বললাম।

বাদল ভাই রাতে আমাদের সাথে নৈশভোজ করল মায়ের জোরাজুরিতে। বলে গেল,
বাসা চিনে গেলাম। চাচীকে দেখতে আসব আবার। এবং মা সহ তাদের বাসায় যেতে অনুরোধ করে গেল।

তার পরেরদিন উনার আম্মা মাকে ফোন দিয়ে যেতে বলল বারবার। মাও রাজী হলো যেতে।

সময় গড়াচ্ছে। আমার দোকানের অগ্রগতি হচ্ছে। দোকানে সেলাইর মেশিন দুই থেকে চার হয়ে গেল। সাথে কর্মীও যোগ হলো।
‘ পরিশ্রম সৌভাগ্যের প্রসূতি ‘।ব্যাকরণে পড়া ভাব সম্প্রসারণটির কথা মনে পড়ল। বুঝলাম বড় বড় মনিষী,কবি,লেখকরা এমনি এমনি এসব বলেননি।

এই ভিতরে এহসানকে ডিভোর্স দিয়ে দিলাম এশা ও মাহিনকে জানিয়ে। তারা সহমত পোষণ করল। উকিল নোটিশ চলে যাবে তার গ্রামের ঠিকানায়। তিনমাস পর দুজন সামনাসামনি সাইন করলেই আলাদা মেরুর হয়ে যাব দুজন। নিজেকে ভীষণ হালকা লাগছে। বুকের ভিতর থেকে বিশাল এক প্রস্তরখন্ড সরে গেল যেন।

মা সহ একদিন বাদল ভাইদের বাসায় গেলাম মিরপুরে। বাদল ভাই ছিলনা। ভরপুর নাস্তা খাওয়া শেষে মা চাচীর সাথে গল্প করছে পারিবারিক নানান বিষয়ে। এশা,মাহিন,আয়রাকে নিয়ে উনার ছোট বোন ছাদে গেল ঘুরতে। আমি বাদল ভাইয়ের রুমে গেলাম চাচীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে।

খাটে বসে হাত রাখতেই শক্ত কিছু ঠেকল যেন। বাদল ভাইয়ের বালিশ উল্টো করতেই দৃশ্যমান হলো আস্ত একটা ডায়েরি। কৌতুহল বশত হাতে নিলাম। পাতা উল্টিয়ে দ্রুত নজর বুলিয়ে যাচ্ছি।

” তুই বিহনে আমি একা ছিন্ন ঝরাপাতার মতো।
বিষন্ন সন্ধ্যার মতো।

তুই ছাড়া আমার নিঃসঙ্গতা দূর করতে পারবেনা,কোন কাশফুলের মায়া।

রাত্রির নির্জনতা কানে কানে শুধায় মোরে,
তুই কি একবেলা আমার হবি?

আমি স্তব্দ!আমি নির্বাক! সহসা আমার অধরে ফোটেনা কোন বুলি।

কি ভুল করলাম ভালোবেসে তোকে একাকী।
তুই ও কি ভুল করে একবার দেখা দিবি.
নয়তো আমি চিরটাকাল মহাশূন্যতার মতন একা।”

আমি ভ্রুযুগল কুঞ্চিত করলাম। বিড়বিড় করে বললাম,
এত প্রেম বুকে নিয়ে বাদল ভাই কিভাবে একাকী জীবন কাটাচ্ছে। ডায়েরিটা রেখে দিলাম বালিশের তলায়। এ রুমে আর নয়। ভেবেই রুমের দরজায় গিয়ে পা থেমে গেল আমার।

বাদল ভাই বুকের উপর দুহাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে আছে। এক পায়ের উপরে দিয়ে আর পা পেঁচিয়ে আসা।
শাসনের সুরে বললাম,
পথ ছাড়ুন বলছি।

উনি আমার চুলের মাঝে ঘনিষ্ঠভাবে নাক ডুবালেন। দুচোখ বন্ধ করে জোরে নিঃস্বাস নিলেন।
আহ কি স্বর্গীয় ঘ্রাণ। এবার যেতে পারিস বলে সরে দাঁড়ালেন।

আমি রেগে গেলাম। এমন করলেন কেন? এটা অসভ্যতামি হয়ে গেলনা?

প্রেমিক মানেই অসভ্য। জেনে রাখ। তুই আমার বাসায় এসেছিস। তাই একটু অধিকার ছিনিয়ে নিলাম। আকাশী রঙের শাড়ি পড়া তোকে দেখে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললাম। সর‍্যি শিলা।খুউব সর‍্যি।

মেঘমুখে উনার পাশ কাটিয়ে চলে এলাম। আরো কিছুক্ষণ থেকে আমরা চলে এলাম আমাদের বাসায়।

দেখতে দেখতে তিনমাস হয়ে গেল। বাচ্চাদের ফাইনাল পরিক্ষা শেষ হয়ে গেল। তারা প্রত্যেকেই একক্লাস উপরে উঠে গেল। এহসান উকিল নিয়োগ করে জামিন নিয়ে নিল। আমার সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে ডিভোর্স হয়ে গেল কোর্টে সবার উপস্থিতিতেই। তার কিছুদিন পর সে মিতাকেও ডিভোর্স দিয়ে দিল। মিতা গ্রামে চলে গিয়েছে। মিতার সাথে নাকি এহসানের নিত্য কলহ লেগেই থাকত দুজনের নানা শর্ত নিয়ে। আরেকটি অন্যতম কারণ শুনলাম, তার ফিজিক্যালি পাওয়ার অনেকটাই ড্যামেজ হয়ে গিয়েছে।

রুক্ষ শীত বিদায় নিবে নিবে। শীতের এমন এক অলস দুপুরে এহসান আমার বাসায় এসে হাজির হলো। আমার মায়ের পা ধরে ক্ষমা চাইল অনুতাপের সুরে। এবং বলল,

আম্মা আমি শিলাকে আবার বিয়ে করতে চাই। এরজন্য যত যা কিছু করতে হয় আমি রাজী আছি।

আম্মা বেকুবের মতো এহসানের দিকে চাইল। আমি পাশে দাঁড়িয়ে আছি ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে।

মা বলল,
কি পাগলের মত যা তা বলছ? তালাক দেওয়া স্ত্রীকে কিভাবে বিয়ে করে আবার? আগে একটা নিয়ম ছিল। হিল্লা বিয়ে বলে সেটাকে। তিনমাসের জন্য আরেক পুরুষের সাথে ঘর করতে হয় বৈধ ভাবে। তবেই। বর্তমানে এসব নেই।

ও মায়ের হাত ধরে বলল,
আমি সেই নিয়মেও শিলাকে বিয়ে করতে রাজী আছি আম্মা।

আমি দ্রুতপদে রান্নাঘরে ছুটে গেলাম। দা নিয়ে এসে ওকে বললাম,
তিন কোপে তোর কল্লা আলগা করে দিব। যেইনা আমার সুদিন দেখছিস। বাচ্চাদের ভালো রেজাল্ট দেখছিস। অমনি এসবের লোভে এখন বিয়ের বাহানা তুলছিস। লোভী! অমানবিক! জালিম কোথাকার।

ক্রমশঃ১২