#ফেরার_কোন_পথ_নেই ( ১১)
কলমে #রেহানা_পুতুল
ভোর হতেই টের পেলাম আজ হেমন্তের প্রথম প্রহর। ভোরের হিমবায়ুর পালকি চড়ে হালকা কুয়াশার আঁচল টেনে আগমনী বার্তা জানিয়েছে হেমন্ত। প্রকৃতিতে ফুটে ওঠেছে সুন্দর রূপবিভা। হরিদ্রাভ সাজবরণ করেছে পত্রপল্লব। জলজ বাতাসে গায়ে মাখা হিমঝুরির পাগল করা ঘ্রাণ। শব্দহীন উল্লাসে ঝরেপড়া শিশিরধৌত সকাল যেন অমৃত।
জানালায় দাঁড়িয়ে আছি মৌন হয়ে। দৃষ্টিগোচর হলো পাশের বাসার পুষ্পবৃক্ষে সজ্জিত বারান্দাটা। হেমন্তের নবজাগরণে সেই কাননে ফোটে আছে কামিনী, হাসনাহেনা, হিমঝুরিসহ নানা রং ও সুবাসের অসংখ্য জাতের ফুল। সেসব ফুলের পাপড়ি ও গাছের পাতায় পাতায় ভোরের মৃদু শিশিরের স্পর্শ লেপ্টে আছে ঘুমন্ত শিশুর ন্যায়।
ভাবছি অনাগত ভবিষ্যত ও তিন সন্তানের কথা। টিকে থাকার লড়াইয়ে আমি কি শেষ অবধি হেরে যাব? নিজের পশ্নের জবাব নিজেই দিলাম। আমাকে পারতেই হবে। আমার তিন সন্তান আমার শক্তি। আমার পথ চলার ধারালো অস্র। নিজেই তার পতন করব বলে থানার জিডিটাও তুলে নিলাম। কারণ সেটা হলে আত্মীয়স্বজন পাড়াপ্রতিবেশীর মাঝে জানাজানি হয়ে যাবে। এর বিরূপ প্রভাব আমার ছেলেমেয়ের জীবনে পড়তে পারে। শহরে বাস করার দরুন বিষয়টা এখনো অনেকটা ধামাচাপা রয়েছে। প্লিজ #রেহানা_পুতুল লাইক ও ফলো দিবেন গল্প সবার আগে পেতে।
বাচ্চাদের জীবন জীবনের নিয়মেই চলছে। আমি একা হাতে টেনে নিচ্ছি ঘানি টানার মতই। এহসানকে হস্তক্ষেপ করারও সুযোগ দিচ্ছিনা।
রোজ রাতে ঘুমের ট্যাবলেট মিশাতেও ভুল করিনা। এর বেঁচে থাকা হচ্ছে তিন সন্তানের জন্যই। নয়তো কবেই ওর বারোটা বাজিয়ে দিতাম। আমাদের পুরুষ শাসিত সমাজে পিতৃপরিচয়টাকে আজো খুব বড় করে দেখা হয় গুরুত্বের সাথে। এমনিতেই ব্রোকেন ফ্যামিলির বাচ্চাগুলোর যাপিতজীবন ভঙুর হয়ে যায়। চলতে ফিরতে দুচারজন কথা শোনাবেই। নইলে তাদের পেটের ভাত হজম হয়না।
কয়েকদিন পর এক সকালে এহসান আমার কাছে এসে শান্ত গলায় বলল,
আমি গ্রামে যাচ্ছি মিতাকে নিয়ে আসতে। তার ছেলেরা নাকি তাকে বাড়ি থেকে একবারে চলে যেতে বলছে। গ্রামের ভাড়া রুমটা ছেড়ে দিয়েছি। এভাবে রোজ সপ্তাহে গ্রামে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। দুদিন যাবৎ আমার শরীরটা খারাপ যাচ্ছে। আর বছর শেষান্তে তার মেয়েকে মাদ্রাসা থেকে ঢাকায় নিয়ে আসব। পরে এখানে কোন একটা মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দিব। আমি তার কাছেই বেশী থাকব। না থেকেও উপায় কি বল। তুমি আলাদা ঘুমাও। আমার সাথে চলাফেরা করো অচেনার মতন। একটা সহজ বিষয়কে জটিল করে ফেললে তুমি। তোমাদের খরচ আমি সামর্থনুযায়ী অবশ্যই দিব। নতুন দোকান সেখানেই নিয়েছি। বিজনেস আগেরটাই কন্টিনিউ করব।
এসব ফিরিস্তি আমাকে শোনানো হচ্ছে কেন?
শোনাচ্ছি দায়বদ্ধতা থেকেই।
আমি হই হই করে উঠলাম। ক্রুর হাসি দিয়ে বললাম,
তোমার বিবেককে একবার জিজ্ঞেস করতো,
আমাদের ইসলামে দ্বিতীয় বিয়েকে যে কারণগুলোর জন্য জায়েজ করেছে। সেই কারণগুলোর প্রেক্ষাপট কি আদৌ বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছে? বা তুমিও যাকে করেছ, সেই কি তেমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে? তার বড় দুজন ছেলে রয়েছে। সকল আত্মীয়স্বজন সবই রয়েছে। অনেক ভূসম্পত্তিও আছে সেখানে। সবকিছুই ঠিকঠাক ছিল তার। সেজো খালা সব বলেছে আমাকে। নিজের চরিত্রগত দোষে বিয়ে করেছ। সেটা স্বীকার করো। সুতরাং অযথা কথায় কথায় ওই ছবক আর বলনা। শুনতে বিচ্ছিরি লাগে। ঘেন্না হয়।
তোমার সাত জনমের ভাগ্য জেলখানার চৌদ্দশিকের ভিতরে আটকা পড়নি। রেহাই পেলে আমার তিন সন্তানের জন্যই।
অতিরিক্ত বলছ তুমি। আমি অবৈধ কিছুই করিনি জেলখানায় যাওয়ার মত। নিয়ম মেনে একটা বৈধ সম্পর্কে জড়িয়েছি।
আমি ঠাট্টার হাসি হাসলাম। একটা দেশ,রাস্ট্র,সমাজ,পরিবার কেবল ধর্মীয় বিধান মেনেই চলেনা। দেশের আইন মেনেও তাকে চলতে হয়। নয়তো সমাজ তাকে একঘরে করে দেয়। নিজের সুবিধা যতটুকুতে শুধু ততটুকুই জানলে? আমাদের দেশের আইন হলো,
দ্বিতীয় বিয়ে করতে প্রথম স্ত্রীর অনুমতি লাগবে। নইলে সেই বিয়ে হবেনা। এটা জানলে কই? মানলে কই? চলে যাও আমার চোখের সামনে থেকে তুমি। আমি ঘৃণা করি তোমার মত স্বামীরূপী মানুষ নামের অমানুষকে। দূর হ বলছি।
এহসান আর কোন কথা বাড়ালনা। তর্কে জড়ালনা। নিরবে প্রস্থান করল আমার সম্মুখ হতে।
ওকে দেখলাম কেমন ঝিমিয়ে হাঁটছে। কথা বলার ভঙ্গিও ছিল ক্লান্ত শ্রমিকের মতন।
তাতে আমার হৃদয়খানি এতটুকু বিচলিত হলনা। বরং খানিক সুখবোধ হলো তার শারীরিক পতনের নমুনা দেখে। আমার ভেতরের হিংস্র সাহসী সত্তাটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।
কিছু মানুষ কেন যে ভুলে যায়,
” সব দুর্বলেরা যেমন ভীতু নয়,তেমনি সব শক্তিশালীরাও সাহসী নয়।”
” অবলা নারী একবার ক্ষেপে গেলে ভয়ংকর রূপ ধারণ করে। দাবানলের মত সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছঁাই করে দেয়। অবশিষ্ট বলে কিছুই থাকেনা। ”
বাচ্চাদের স্কুলে পৌঁছে দিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে থানায় চলে গেলাম। আবার মামলা করলাম তার নামে। থানার ওসি আমাকে রাগ দেখাল আগের মামলা তুলে নিলাম বলে। আমি মাথা পেতে তা মেনে নিলাম।
চলে এলাম বাসায়। রাতে আয়রা তার বাবার কথা জিজ্ঞেস করল। নয়ছয় করে বুঝিয়ে নিলাম তাকে। এশা ও মাহিনকে জানিয়েছি সব।
গহীন রাতের নির্জনতায় ওরা দুই ভাইবোন গলাগলি করে কেবল অস্রু ঝরাল শ্রাবণ ঢলের মতো। সাক্ষী রইলাম আমি। মাহিন ফ্যাসফ্যাসে গলায় শুধু একটা প্রশ্ন করেছিল আমাকে,
আচ্ছা আম্মু পৃথিবীর সব বাবারাই কি এমন বাজে? পঁচা? অন্য কাউকে বিয়ে করে ফেলে?
বেদনার দীর্ঘশ্বাস ফেলে সত্য শান্তনার বুলি শুনিয়েছিলাম আমার একমাত্র পুত্রধনকে।
বাবা পৃথিবীর সব বাবারা বাজে হয়না। আবার বিয়েও করেনা স্ত্রী বর্তমান থাকা স্বত্তেও। কেউ কেউ করে মাত্র। যারা তোমার বাবার মতো মন্দলোক। ঘুমিয়ে যাও। রাত বেড়ে গিয়েছে। ভোর হলেই যেতে হবে তোমাদের গড়ে উঠার গন্তব্যে।
” নারীই নারীর শত্রু।” বহুল প্রচলিত ও আলোচিত স্বীকৃত হওয়া নিরেট সত্য কথাটি কেবল একবার মনে হলো। একজন পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া চেনা নারী কিভাবে আরেজন চেনা মেয়ের ঘর ভাঙ্গল। উড়িয়ে দিল তাসের ঘরের মতন। তা আমি কেবল চেয়ে চেয়ে দেখলাম নয়নভরে।
আমি একরাম ভাই ও বাদল ভাইয়ের অকৃত্রিম সহযোগিতায় দোকানে সেলাইয়ের মেশিন উঠালাম। কাপড় কাটার টেবিল থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় সব সরঞ্জামাদি ক্রয় করে ফেললাম। দোকানের নেইম প্লেট বসালাম ‘ সুই সুতার ফোঁড় ‘। প্রথম এক সপ্তাহ কর্মী দুজন সারাদিন বসে থাকতো। কেউই সেলাইয়ের জন্য জামাকাপড় নিয়ে আসতনা। আমি হাল ছাড়িনি। মন্ত্র জানি।
“শুরুটা কষ্টের। শেষটা আনন্দের।”
পাহাডের চূড়ায় উঠতে হলে আরোহীকে যেমন একটু একটু করে প্রতিটি ধাপ এগোতে হয়। তদরূপ জীবনে সফলতা আনতে গেলে খাটতে হবে অক্লান্তভাবে। ধৈর্য ধরতে হবে নিজের উপর আত্মবিশ্বাস রেখে। বড় ভাবি মানে জা কে প্রসঙ্গত বললাম বিষয়টি। এর দুদিন বাদেই তিনি দুজন কাষ্টমার নিয়ে এলেন দোকানে। তারা ছয়টি ড্রেস দিলেন সেলাই করতে। ভাবিও দুটো ড্রেস দিলেন। মনের আনন্দ নিয়ে সেগুলো সেলাই সম্পন্ন করি নারী কর্মীদের সাহায্যে।
দোকান চালু করার সপ্তাহ খানেক পরে এহসান এসে দোকান দেখে গেল। তার চোখেমুখে কোন অভিব্যক্তি পরিলক্ষিত হলনা। কিন্তু আমি তার নতুন দোকান দেখতে গেলাম না। দেখার নূন্যতম অভিলাষটুকু আমার নেই।
একদিন দুপুরে হঠাৎ করে মিতা আমার বাসায় এসে ঢুকরে কেঁদে উঠল। পারেতো আমার পা ধরে ফেল। ক্রন্দনরত কন্ঠে বলল,
শিলা ওকে পুলিশ ধরে নিয়েছে একটু আগে। দয়া করে ওকে ছাড়িয়ে আন। তুই গিয়ে বল এখন মেনে নিয়েছিস আমাকে। ও তো শুধু আমার একার স্বামী নয়। তোর ও স্বামী। তোর কি মায়া হয়না এহসানের জন্য?
আপনার মত নিলজ্জ, বেহায়া নারীর কোন আরজি, আর্তি আমার কর্ণে প্রবেশ করবেনা। চলে যান বলছি ঘাড় ধাক্কা খেয়ে অপমানিত হওয়ার আগেই।
মিতা চলে গেল অসহায়ের মত মুখ করে। আমি নিমিষেই আরেকটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম কালক্ষেপণ না করেই।
এহসান থানায়। তার নতুন দোকানে তালা ঝুলছে। একটা স্টাফ রেখেছে। সে ভয়ে পালিয়েছে না জানি কোন বিপদে পড়ে এই দুর্ভাবনায়। একটা গ্রাম্য মহিলা চাইলেও শহরের দোকান হ্যান্ডেল করতে পারবেনা।
এদিকে ভাগ্য সহায় হলো আমার। আর পিছনে ফিরে তাকাতে হলনা। সেন্টার মতে দোকান ও সেলাই ভালো হওয়ায় অল্পদিনেই অনেক কাস্টমার জুটে গেল। ক্রমশ পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা লাভ করতে লাগল আমার পরিশ্রমের ফসল ‘ সুঁই সুতার ফোঁড়।’ একরাম ভাইয়ের পূর্ণ তদারকির কল্যাণে নারী উদ্দোক্তা হয়েও বাইরে সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছেনা এখন পর্যন্ত।
মনে হলো সত্যিই,
এক দরজা বন্ধ হলে অন্য কোন দরজা উন্মুক্ত হয়ে যায় ভিখারির জন্য। সবই স্রস্টার অশেষ করুণা।
কয়েকদিন হয় বাদল ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ নেই। তিনি তার ব্যবসা নিয়ে ব্যস্ত। আমিও ইচ্ছে করে দূরত্ব বজায় রাখি। উনার ভিতরে ঘুমিয়ে থাকা সুপ্ত অনুভূতিগুলো যেন কোনভাবেই না জাগতে পারে। মায়ের কাছে শুনলাম উনার জন্য কনে খোঁজা হচ্ছে বাসা থেকে। ফোন দিয়ে বাদল ভাইকে সব খবরাখবর জানালাম।
পরে বললাম বাদল ভাই থানা থেকে ছাড়া পেলে, ও আমাকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে নিশ্চিত। তার আগে আমিই ওকে বিদায় ঘন্টা শোনাতে চাই। আপনি প্রসিডিওরের বিষয়ে একটু খোঁজখবর নেন।
বাদল ভাই সাথে সাথেই বললেন,
অবশ্যই নিব শিলা। আমি স্যাটিসফাইড় তোর এমন সাহসী অটুটু সিদ্ধান্তে। একদম রাইট ডিসিশন নিয়েছিস।
“যেই হাত নিষ্ঠুরের মতো প্রিয়জনের হাতকে মাঝপথে ছেড়ে দেয়। সেই হাতের উপর আর কখনো ভরসা করা যায়না।”
আপনাকেও অভিনন্দন, নতুন জীবনের সূচনা করতে যাচ্ছেন বলে।
হ্যাঁ ঠিক শুনেছিস। কিন্তু আমি করছিনা বিয়ে।
কেন বাদল ভাই?
ভাবিসনা তোর জন্য।
” তুই আমার মিছে আশা, মিছে স্বপন, রইবি জনমভর।
তোকে নিয়ে বাঁধবনা আমি বালুচরে ঘর।”
আমি ফিক করে হেসে ফেললাম। উনি পট করেই মোবাইল সুইচড অফ করে দিলেন।
এরপর একদিন সকালে ওদের স্কুলে দিয়ে আমি দোকানে চলে আসলাম। কাজের চাপ অধিক তাই। আগের মতো হেলায়ফেলায় সময় খরচ করার সময় নেই। আবার যথাসময়ে আয়রাকে স্কুলে আনতে গেলাম। সব বাচ্চারা চলে যাচ্ছে অভিভাবকের হাত ধরে। কিন্তু আয়রা নেই। নেই। স্কুলের ত্রিসীমানার কোথাও আমার ছোট্ট সোনামণি আয়রা নেই। আমার গগন কাঁপানো বিলাপে সবাই জড়ো হলো। স্যাররা আমার সামনেই গেইটে দায়িত্বরত গার্ডকে জিজ্ঞেস করলো,
প্রতিটি শিক্ষার্থী অভিভাবকের সাথে যাচ্ছে কিনা এটা কিন্তু তোমার দায়িত্ব জলিল।
স্যার বিশ্বাস করেন একটা শিক্ষার্থীও একা বের হয়নি। আমি এই টুলেই বসা ছিলাম। প্রতিটি বাচ্চার সাথেই অভিভাবক ছিল।
স্যাররা আমার দিকে চেয়ে বলল,
দ্রুত থানায় যান। পুলিশে ইনফর্ম করুন। আপনার মেয়েকে কেউ চুরি করে নিয়ে গিয়েছে। সন্দেহভাজন ব্যক্তির নাম জানান।
আমি উম্মাদ হয়ে গেলাম। একরাম ভাইকে ফোন দিয়ে জানালাম। বুঝতে বাকী রইলনা কে সেই জালিম। পাষন্ড৷
গল্প #ফেরার_কোন_পথ_নেই
কলমে #রেহানা_পুতুল
ক্রমশ ঃ ১১