বকুলতলা পর্ব-০১

0
736

বকুলতলা
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা
সূচনা পর্ব

—“আপনার শার্ট ভিঁজে যাচ্ছে। বৃষ্টিও বেড়ে গেছে। ভেতর করে দাঁড়ান। নয়তো পরে ঠান্ডা লেগে যাবে।”
অল্পসল্প কাঁপা কণ্ঠ শুনে তাকালো মাহাদ। খুব শান্ত দৃষ্টি। বললো, “আমি ভেতর করে দাঁড়ালে তোমার একদম কাছ ঘেঁষে দাঁড়াবো তরী। তুমি সেটা পছন্দ করবে না।”
হকচকিয়ে উঠলো তরী। লোকটা তার সঙ্গে সর্বদা ত্যাড়ামো করেই কথা বলে। সোজা কথা যেন তার স্বভাবেই নেই। আড়চোখে মাহাদের মুখটা একবার পরখ করে নিলো সে। চোখ-মুখ কুঁচকে রেখেছে। কপালে কতশত ভাঁজ! মাহাদ কি কোনো কিছু নিয়ে চিন্তিত? ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে অন্যদিকে তাকাতে গিয়েও তাকাতে পারলোনা তরী। আঁতকে উঠলো মাহাদের হাতের ক্ষতবিক্ষত আঙুলগুলো দেখে। কণ্ঠে ভীড় জমালো দৃঢ় উৎকণ্ঠা,
—“হাত এমন লাল হয়ে আছে কেন আপনার? আবার মারপিট করেছেন? বারবার একই কাজ কেন করেন?”

মাহাদ একবার বিরক্ত দৃষ্টিতে বাম হাতটার দিকে তাকালো। এরপর নির্বিকার ভঙ্গিতে হাতটা ঝাড়তে ঝাড়তে বললো, “আরও করবো। উঠতে, বসতে মারপিট করে জীবন দিয়ে দিবো। তোমার কথা শুনবো না।”

তরী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। একবার আশপাশটায় নজর বুলিয়ে হালকা গলায় বুঝাতে চাইলো, “আমি আপনাকে আগেও বলেছি, আমাদের মাঝে কোনো সম্পর্ক হওয়া সম্ভব না। তবুও কেন আমার পেছনে নিজের সময় নষ্ট করছেন?”
—“কারণ আমি অপেক্ষা করতে জানি।”
শান্ত, স্বাভাবিক, স্থির কণ্ঠের একটি বাক্য। যা তরীর বুক ভারী করে দিলো। আগত নিশ্বাস আটকে দিলো তক্ষুণি। এই উগ্র, মেজাজি ছেলেটা কেন বুঝে না? সে ভালোবাসতে পারবে না, পারে না। সেই অধিকার তার নেই। তবুও কেন পিছু পিছু ঘুরে?

বৃষ্টি কমে এসেছে। তীব্র ভাব কাটিয়ে ঝিরিঝিরি করে একেকটা ফোঁটা গগন থেকে নেমে আসছে। মাহাদ ছাউনি থেকে বেরিয়ে এলো। চারপাশে তাকিয়ে রিকশা খুঁজলো। একটাও খালি রিকশা নেই। সব যাত্রীরা আগেভাগেই দখল করে নিয়েছে। যাও একটা পাওয়া গেল, দাম চাচ্ছে অনেক। মাহাদ রাজী হয়ে গেলেও তরী বেঁকে বসলো। সে কিছুতেই এ রিকশায় উঠবে না। এত দাম দিয়ে রিকশা নিতে হলে তো সে আগেই নিতো। বৃষ্টি কমার অপেক্ষা করতো নাকি?
মাহাদ সূক্ষ্ণ চোখে চেয়ে গাঢ় ধমক লাগালো, “রিকশায় না উঠলে আমি কিন্তু তোমাকে আমার বাইকে উঠাবো তরী! কোনো বাঁধা মানবো না।”

অগত্যা তরীকে সেই রিকশা করেই বাসায় ফিরতে হয়েছে। ফেরার সময় মাহাদ তরীর সাথে সাথেই ছিল। বাইকে করে রিকশার পিছুপিছু আসছিল। তরী খেয়াল করেছিল, আগাম জ্বরে জর্জরিত মাহাদকে। যার মুখশ্রী রক্তিমলাল, দৃষ্টি নিভু নিভু। লোকটার যে বৃষ্টির পানি একদম সহ্য হয় না।

_____

বিশাল দোতলা বাড়িটি তরীর মামার। একমাস আগে উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় এসেছিল সে। হলে সীট খালি না পাওয়ায় এখন এখানেই থাকে।
জুতা খুলে ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতেই সালেহা দৌড়ে এলো তরীর কাছে। উৎকণ্ঠা হয়ে বললো, “এমনে ভিঁজ্জা গেছো কেমনে আপা? সর্দি লাগবো তো! রুমে গিয়া তাত্তাড়ি জামা পাল্টাও। আমি স্যুপ আনতাছি।”

তরী একটু হাসলো। ক্লান্ত শরীরে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বললো, “এত ব্যস্ত হতে হবে না সালেহা। আমি ঠিক আছি। বাড়ির সবাই কোথায়? দেখছি না যে।”
তরীর কথা একটুও মান্য করেনি সালেহা। ভীষণ ব্যস্ত পায়ে রান্নাঘরে চলে যায়। প্রশ্নটাও হয়তো শুনেনি।

দোতলার একদম কোণার ঘরটা তরীর। তার ঘরের বাম পাশেই বিশাল বড় লাইব্রেরী। মামার ছোট ছেলের আবার বই পড়ার অনেক শখ। তাই আস্ত দু, দুটো রুমের জায়গা নিয়ে লাইব্রেরী ঘরটা বানিয়েছে সে।

—“এমন ভেঁজা শরীরে আমার লাইব্রেরীতে ঢুকছেন কেন? পারমিশন কে দিয়েছে আপনাকে?”

গম্ভীর, থমথমে পুরুষ কণ্ঠটি কানে যেতেই তরী চমকে উঠলো। শরীর একটু কাঁপলো যেন। সে তো লাইব্রেরীর দরজাটা বন্ধ করছিল। আর কিছু না। সামনে তাকিয়ে দেখল, মামার ছোট ছেলে। প্রণয়। হাতে গোনা কয়েকবারই ছেলেটার সাথে দেখা হয়েছে তার। তবে কখনো কথা বলা হয়ে উঠেনি।
প্রণয় আবার বললো, “কিছু বলছেন না কেন? কেন ঢুকতে চাচ্ছেন ভেতরে?”
তরী মাথা নুইয়ে আমতা আমতা করলো, “আমি ঢুকছিলাম না ভেতরে। হাত লেগে দরজাটা খুলে গিয়েছিল। তাই দরজা বন্ধ–”

কথা শেষ হলো না। সামনে দাঁড়ানো প্রণয় সন্দিহান কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “আমার জানামতো এ জায়গাটা তো এত ছোট না। একটা ট্রাক যেতে পারবে। এত জায়গা থাকতে আপনি দরজার কাছে গেলেন কিভাবে?”

মাথা নুয়াতে নুয়াতে গলার সাথে থুতনি লেগে গেল তরীর। সে কি উত্তর দেবে? হোচট খেয়ে পরে যাওয়া থেকে বাঁচতে দরজাটা একটু ধরেছিল। ওমনি দরজা খুলে গেছে। এটা বলবে? কথাটা কি আদৌ কারো বিশ্বাসযোগ্য? আগে যদি জানতো, সামান্য দরজায় হাত রাখার জন্য এতকিছু হবে, তাহলে ওই দরজার দিকে মুখ ফিরিয়েও তাকাতো না কোনোদিন।

জবাব না পেয়ে প্রণয় আরও গম্ভীর হয়ে উঠলো। বললো,
—“পরেরবার যেন আমার লাইব্রেরী ঘরে আপনাকে না দেখি। ভেঁজা জামাকাপড় পরে আছেন। চেঞ্জ করুন, যান।”
তরী যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। কিন্তু পরক্ষণেই মিনমিনে স্বরে প্রণয়কে জিজ্ঞেস করলো, “মামীরা কোথাও কি গিয়েছে? ওদের কাউকে দেখছি না।”
—“শপিংয়ে গিয়েছে। এসে যাবে একটুপর।”
তারপর একটু থেমে কেমন করে যেন দেখলো তরীকে। তীব্র পর্যবেক্ষণ দৃষ্টি। বললো, “আনসিজনাল বৃষ্টিতে ভিঁজেছেন। অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা হান্ড্রেড পার্সেন্ট। আপনার রুমে হয়তো ফাস্টএইড বক্স নেই। আমি কিছু ঔষধ সালেহাকে দিয়ে পাঠাচ্ছি। খেয়ে নেবেন।”
এবার প্রণয়কে খানিকটা অদ্ভুদই মনে হলো তরীর। এইতো, একটু আগেও রুক্ষ আচরণ করছিল তার সাথে। এখন আবার এত যত্ন নিচ্ছে কেন?

তরী অতশত ভাবলো না। ঘরে ঢুকে কোনোমতে জামা পালটে কম্বলের নিচে ঢুকে পরলো। ইস! কি ঠান্ডা! এরমধ্যে সালেহাও তার বানানো গরম গরম স্যুপ নিয়ে হাজির হয়ে গেছে। হতাশার সুরে তরীকে জিজ্ঞেস করলো, “বেশি খারাপ লাগতাছে আপা?”

তরী স্যুপ খেতে খেতে জবাব দিলো, “আরে ধুর! এসব বৃষ্টি-টৃষ্টিতে আমার কিচ্ছু হবে না। আজকের দিনটা একটু খারাপ লাগবে। তারপর ঠিক হয়ে যাবে। গ্রামে এমন কত ভিঁজেছি!”
সালেহার চিন্তা তবুও কমলো না। সে তার মতো করেই বললো, “স্যুপ খাইয়া ঔষধটা চোখ বন্ধ কইরা গিল্লা লও আপা। প্রণয় ভাইজান দিছে। ডাক্তার মানুষ! তাত্তাড়ি ঠিক হইয়া যাইবা। তোমারে এভাবে দেখতে আমার একটুও ভাল্লাগতাছে না।”

জবাবে এবার শুধুই হাসলো তরী। আরেক চামচ স্যুপ মুখে দিবে, ওমনি ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো। মাহাদ কল করেছে। সে আড়চোখে দেখলো। তবে ধরলো না। ফোন উলটো করে রেখে দিলো। কিন্তু এতে যেন ভীষণ বিরক্ত সালেহা। সে চোখ-মুখ কুঁচকে শুধালো, “ফোন ধরতাছো না ক্যান আপা? জানো? আমার ফোন এমন কইরা কেউ না ধরলে আমি যে কি বিরক্ত হই! তোমারে যে ফোন দিসে সেও তো বিরক্ত হইবো, তাই না? কল ধরো।”

তরীরও মনে হলো, মাহাদ এখন কেমন আছে, তা জানা উচিত। স্যুপের বাটিটা একপাশে রেখে ফোন হাতে নিলো সে। রিসিভ করে কানে রাখতেই ওপাশ থেকে জোড়ালো, ঢিমে যাওয়া কণ্ঠ শোনা গেল, “তুমি আমাকে ভালোবাসো না কেন তরী?”

তরীর চুপ করে রইলো। লোকটা জ্বরের ঘোরের এই এক প্রশ্নই করছে।

________________

চলবে~