বকুলতলা পর্ব-১০+১১

0
306

বকুলতলা

১০.
বাসস্টেন থেকে অনেক দূর মোটরসাইকেলটা রেখে এসেছিল মাহাদ। একটা বড়সড় গাছের নিচে। তরীকে বাসে উঠিয়ে প্রথমে সেখানেই গেল সে। পরে মনে পরলো, মোটরসাইকেলের তেল শেষ হয়ে গেছে সেই সকালেই! পকেটে টাকা নেই। মানিব্যাগটাও নেই। আনতে ভুলে গিয়েছিল। বাধ্য হয়ে মোটরসাইকেল রেখেই হেঁটে হেঁটে বাসায় পৌঁছাতে হয় তাকে। আধঘণ্টার রাস্তা! কম নয় কিন্তু! কড়া রোদে শরীর তখন ঘেমে একাকার। হাঁপিয়ে গিয়ে নিশ্বাসটাও অস্বাভাবিক প্রায়। কোনোমতে টেনেহিঁচড়ে ফ্যানটা চালালো মাহাদ। বিছানায় বসতে না বসতেই ফোনে কল এলো। মাহাদের বাবা রশিদের কল।
মাহাদ প্রথমে কল ধরতে না চাইলেও পরে কি মনে করে ধরলো, “হুম, বলো।”

রশিদ জবাবে তৎক্ষণাৎ কিছু বলতে পারলেন না। তার শরীর ইদানিং ভালো যায় না। কিছু বলার আগেই খুকখুক করে কাশি চলে আসে। খুবই বিশ্রী ব্যাপার। এবারও জোড়েসোড়ে কেশে উঠে বললেন, “কেমন আছিস বাবা?”
—“আছি। ওখানে সবাই কেমন আছে?”
রশিদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “বেশি ভালো না। দোকানে ঝামেলা চলছে। তুই কবে আসবি?”
মাহাদ উত্তরে কিছু বললো না। ফোনের ওপাশ থেকে তার ছোটো বোনের কণ্ঠ ভেসে আসছে। হইহই করে চেঁচাচ্ছে সে। বারবার বলছে, “আব্বা, আমারে ফোনটা দাও। আমি ভাইয়ার সাথে কথা বলমু। আব্বা, দাও না!”
জবাবে রশিদও বারবার নিচু স্বরে চুপ করতে বলছেন ওকে। সব শুনে মাহাদ বললো, “ফোনটা নূপুরকে দাও আব্বা। কথা বলি।”
রশিদ প্রথমে একটু গাইগুই করলেন। তারপর ফোনটা নূপুরকে দিয়ে দিলেন। আজকের মতো যে ছেলে আর তার সাথে কথা বলবে না, সেটা তিনি ভালো করেই জানেন।
ফোন কানে রেখে নূপুর ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে বললো, “কেমন আছিস ভাইয়া?”
—“ভালো। তুই?”
—“আমিও ভালো আছি। তুই কবে আসবি?”
—“আসবো, তোর বিয়ের সময়।”
নূপুর মুখ বাঁকিয়ে ফেললো। ভীষণ ভাবে নাক কুঁচকে বললো, “আমার বিয়ের এখনো অনেক দেড়ি। তুই বুড়া হয়ে যাচ্ছিস। তোর বিয়ে আগে। বাবা আর চাচা তো তোর জন্যে মেয়েও দেখে ফেলেছে। ওই যে, শবনম চাচীর মেয়ে আছে না? কুহু? সুন্দর করে মেয়েটা যে আমাদের বাসায় আসতো?”
মেয়ের তরতর করে বলা কথাগুলো শুনে মাথায় হাত রশিদের। এ মেয়েটার পেটে কিচ্ছু থাকে না। কতবার বলেছিলেন মাহাদকে যেন আগেই এসব না বলে। কিন্তু এ মেয়ে কি আদৌ সুধরাবার?
মাহাদ কথা বলছে না। নূপুর বার কয়েক হ্যালো, হ্যালো বললো। তবুও ফোনের ওপাশ শব্দহীন, চুপচাপ। পরপরই লাইন কেটে গেল। রশিদ বিরক্ত ভঙ্গিতে মেয়ের থেকে ফোন কেড়ে নিলেন। মাথার একপাশে চড় মেরে বললেন,
—“মাইয়া দেখতে গেছি এ কথা মাহাদরে কইতে গেলি ক্যান? তোরে মানা করছিলাম না?”

চড় মারা জায়গায় হাত বুলিয়ে বোকা হাসলো নূপুর। বললো, “ভুইলা গেছিলাম আব্বা।”
রশিদ সন্তুষ্ট হলেন না। কিচ্ছুক্ষণ রোষপূর্ণ চাহনিতে চেয়ে রইলেন। নূপুরও মুখ লুকিয়ে পালালো যেন। ঠিক পালালো না। সে তো হাঁটতে পারেনা। হুইলচেয়ারের চাকা ঘুরিয়ে কোনোমতে আস্তে আস্তে কেটে পরলো।
বাড়ির খোলা বারান্দায় মাহাদের দাদি নূরুন্নেসা বসে ছিলেন। হাতে সুঁই-সুতা। কোলে সুতীর বড়োসড়ো একটা কাথা। দিনের প্রায় অনেকটা সময় তিনি কাথা সেলাই-ই করেন।
কথায় সুঁই গাথতে গাথতে নুরুন্নেসা রশিদকে বললেন, “আমার দাদুভাই কবে আইবো কিছু কইছে?”
—“কইতে আর পারলো কই? তার আগেই তো নূপুর ঝামেলা পাকাই দিলো।”
—“দাদুভাইরে তাড়াতাড়ি আইতে ক। আর না আইলে শহরের কোনো চাকরি-বাকরি করুক। তুইও একটু শক্ত হইয়া কিছু কইছ রশিদ। আর কতো পোলাটায় বাপের টাকায় খাইবো?”

কথাটা যেন রশিদের পছন্দ হলো না। বিরক্ত কণ্ঠস্বরে বললো, “আমার পোলা আমি বুঝমু আম্মা। তুমি এত বেশি কও ক্যান? আমার এত সম্পদ কি আমি রাইখা দেওনের লাইগা বানাইছি?”
বলতে বলতে উঠান ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন তিনি। নুরুন্নেসা হাঁক ছাড়লো, “কই যাস রশিদ?”
রশিদ ততক্ষণে বাড়ি পেরিয়ে কাঁচামাটির রাস্তায় চলে এসেছে। মায়ের কথাটা শুনতে পেলেও উত্তর দিতে ইচ্ছে করেনি।

প্রণয় তখন মাত্রই বাসায় ফিরেছে। রয়েসয়ে ফ্রেশ হতেও চলে গেছে। যাওয়ার আগে অবশ্য খাবার ঘরে থাকা তরীর সাথেও তার চোখাচোখি হয়েছিল। ক্ষণিকের ঠান্ডা দৃষ্টির বিনিময়। তরীর যেন অস্বস্তিতে শরীর কাঁটা দিয়ে উঠেছিল। সে দ্বিতীয়বার আর এই অস্বস্তিকর দৃষ্টির সম্মুখীন হতে চায় না। তাই যত দ্রুত সম্ভব হাত চালিয়ে কাজগুলো শেষ করতে চাইছে। হঠাৎ প্লেটগুলো সাজিয়ে সাজিয়ে রাখতে রাখতে সালেহা তরীর দিকে তাকালো। পরপরই কেনন আর্তনাদ দিয়ে উঠলো,
—“আপা? তোমার কাঁধে এইডা কিসের দাগ?”

তরীর পরনের জামাটার গলা বেশ বড়। ওড়না দিয়ে কোনোমতে গলার দিকটা পেঁচিয়ে রেখেছিল সে। কখন যে ওড়না সরে গেল!
তরী দ্রুত ওড়না ঠিক করলো। মৃদু স্বরে মিথ্যা বলতে চাইলো, “কি– কিছু না।”
সালেহা ভ্রু কুঁচকালো বাজে ভাবে। সহজেই মিথ্যেটা ধরে ফেলে আবারও জিজ্ঞেস করলো, “সত্যি কইরা কও আপা। কি হইছে? দুক্কু পাইছো কেমনে?”
তরী কৃত্রিম রাগ দেখিয়ে ধমক দিলো, “বললাম তো কিছু না! এত বেশি প্রশ্ন করো কেন সালেহা?”
তরীর ধমকে একটুও মন খারাপ করলো না সালেহা। বরং দাঁত বের করে হাসলো। সে জানে, তরীর হয়তো মন খারাপ। নয়তো সালেহাকে কখনোই বকতো না।

প্রণয় খাবার ঘরে এসেই চেয়ারে বসে পরলো। তরীর দিকে আবারও সেই অস্বস্তিকর দৃষ্টি ফেলে শুধালো, “খাবারে কি কি আছে?”
—“মাংস, ভর্তা, লালশাক।”
—“কিসের ভর্তা?”
—“কাঁঠাল, শুটকি।”
প্রণয় একটু ভেবে বললো, “মাংস খাবো না। ভর্তা আর লালশাক দাও।”

প্রণয় সবসময় নিজেই বেড়ে খায়। অথচ আজ বেড়ে দিতে বলছে কেন কে জানে! সালেহাটাও পাশে নেই। প্রণয়ও খাবার বেড়ে দেওয়ার আশায় বসে আছে। তাই বাধ্য হয়ে তরীই খাবার বেড়ে দিতে লাগলো। সেসময় প্রণয় খুব আস্তে করে প্রশ্ন করলো, “দাগটা কি অর্ণবের দেওয়া তরী?”
তরী চমকালো খুব। চট করে একবার দেখে নিলো গলার কাছটা। নাহ্! সব তো ঠিকই আছে। বিস্মিত নেত্রজোড়া প্রণয়ের দিকে স্থির হতেই সে মুচকি হেসে আবার বললো, “আপনার বাবা-মাকে আমার একটুও পছন্দ না জানেন? এত স্বার্থপর মানুষ হয়?”
নিমিষেই চোখমুখ কঠিন করে তরী বললো, “আমার বাবা মা স্বার্থপর হলে আপনারা কি? ভালো মানুষ তো নিশ্চয়ই নন। আমার খারাপ সময়ে আপনার কখনো আমার ভালো মন্দ জিজ্ঞেস করতে এসেছেন? অথচ সময়ে সময়ে খোঁচা দিতে ঠিকই ভুলেন না!”
প্রণয় লহু হাসির রেশ নিয়েই বললো, “এটা তো আপনার খারাপ সময়ই তরী। আমরা কি আপনাকে আপনার খারাপ সময়ে এখানে থাকতে দিচ্ছি না?”
অপমানটা তীব্রভাবে গায়ে লাগলো। তরীর ফ্যাকাসে মুখশ্রী আরও ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সেখানে আর দাঁড়ালো না সে। হনহনিয়ে ঘরে চলে গেল।

তরীর ঘরে কোনো ধরণের ঘড়ি নেই। সময় দেখতে হলে তাকে মোবাইলের স্ক্রীনের দিকেই তাকাতে হয়। কিন্তু মোবাইলটা বিছানায় পাচ্ছে না। বালিশের নিচে, টেবিলের ওপর, কোথাও নেই। ব্যাগ থেকে কি সে বের করেনি? মেঝের একপাশে রাখা মাঝারি ব্যাগটা হাতে নিলো সে। অনেককিছু ব্যাগটায়। ঘাটাঘাটি করার সময় একটা গোলাপ আর তার সাথে কস্টেপ দিয়ে লাগানো একটা চিরকুট পেল। গোলাপটার অনেকাংশ শুকিয়ে গেছে। গুটিকয়েক পাঁপড়িও ঝড়ে গেছে। তরী চিরকুট-টা কস্টেপ থেকে ছাড়িয়ে নিলো। সাদা রঙের ছোটোখাটো কাগজ। একভাঁজ দেওয়া। ভাঁজের আড়ালে আঁকাবাঁকা কতগুলো লেখা। ১,২,৩ করে অনেকগুলো পয়েন্ট। তরী পরে দেখলো। বোঝা গেল, মাহাদের চিরকুট এটা। সে মিথ্যা বলার অনেকগুলো টিপস দিয়েছে। মিথ্যা বলার সময় এটা করা যাবে না, ওটা করতে হবে। পড়তে পড়তে তরী হেসে ফেললো। ম্লান অথচ অকৃত্রিম হাসি।

চিরকুট আর গোলাপ ফুলটি ব্যাগে রাখতে রাখতে তরী বিড়বিড়ালো, “আপনি আমাকে এত জ্বালান কেন মাহাদ?”

________________

চলবে~

বকুলতলা

১১.
আজকাল প্রণয়ের সঙ্গে তরীর দেখাই হয়না বলা চলে। হাসপাতাল থেকে আসতে আসতে ঘড়িতে তখন প্রায় এক’টা। ততক্ষণে ক্লান্ত তরীও ঘুমে বিভোর। ছোট্ট সালেহা একহাতে খুব সূক্ষ্ণ ভাবে সব সামলে নেয়। খাওয়া দাওয়া শেষে সুন্দর করে গুছিয়েও রাখে আবার। প্রণয় চলে যায় তার লাইব্রেরি ঘরে। বাকিটা সময় তার ওখানেই কাটে। বড়সড় জানালা দিয়ে টিমটিম করা তারাগুলির কথোপকথন যেন তাকে ঘিরেই। বাতাসের শো শো বয়ে চলা শব্দ শক্ত কাচ ভেদ করে আসতে পারে না। তবুও হাতটা আলতো করে কাচের ওপর রেখে তা স্পর্শ করার ক্ষীণ প্রচেষ্টায় নেমে পরে প্রণয়। মাসটা জুলাই। জুলাইয়ের আকাশ, নিস্তব্ধতা, ঠান্ডা হাহাকার।
আচমকা সালেহার হাঁক শোনা গেল, “ভাইজান, ঢুকমু?”

প্রণয়ের মনের আকাশে বিশাল বিষাদের কালো মেঘেরা খেলা করছিল। হতাশ নিশ্বাসগুলো পিছু ছাড়ছিল না। লাইব্রেরির শতশত তাকের একটির সামনে মাত্রই দাঁড়িয়ে ছিল সে। সালেহার হঠাৎ ডাকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো। বললো, “আয়।”
পা দিয়ে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো সালেহা। হাতে তার চায়ের কাপ। খুব সাবধানে কাপটা টেবিলে রেখে সে আবার বললো, “আর কি কিছু দিতে হইবো ভাইজান? আমি ঘুমাইতে যাই?”
বলতে বলতে কেমন দুলে উঠলো সে। তন্দ্রার দাপটে চোখ তুলে তাকানো কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছে। প্রণয় একটু হাসলো। তার ভাইটা যদি আজ বেঁচে থাকতো, তবে হয়তো সালেহার মতোই দেখতে হতো।
পাঁচ নম্বর তাকটা থেকে একটা উপন্যাসের বই হাতে নিলো প্রণয়। বইয়ে নামটা একটু ছুঁয়ে দেখলো। এরপর পৃষ্ঠা উল্টাতে উল্টাতে বললো, “আর কিছু লাগবে না। যাওয়ার সময় দরজা ভিড়িয়ে দিস।”

সালেহা আস্তেধীরে চলে যায়। আড়চোখে একবার দরজাটা পরখ করে নেয় প্রণয়। তারপর ইজি চেয়ারে গিয়ে বসে। হাতে থাকা বইটা খুব পুরনো। একযুগ আগের হয়তো। কিংবা তারও বেশি। উপন্যাসটার জটিল একটা পাতার একপাশে প্রণয় অনভ্যস্ত হাতে একবার বকুলগাছ একেঁছিল। ত্যাড়াব্যাকা ভাবে। এত কাঁটাছেড়ার মাঝে বোঝার উপায় নেই, এটা আদৌ বকুলগাছ। প্রণয় বইটার একটা একটা করে পাতা উল্টালো। ৮১ নম্বর পাতায় হাত থমকালো তার। উপন্যাসের কিছু লাইন চোখে পড়লো,
—“প্রিতম, আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। কিন্তু আমি চাই আমার ভালোবাসাটা অপূর্ণ থাকুক। পাওয়া থেকে তো না পাওয়াতেই সুখ বেশি।”
প্রিতম ছেলেটা হেসে বলে, “অথচ আমি তোমাকে নিঃস্বার্থ ভাবে ভালোবেসে কাছে রাখতে চেয়েছিলাম।”

প্রণয়ের কেন যেন লাইন দুটো খুব পছন্দের। বিড়বিড় করে বেশ কয়েকবার পড়লোও সে। পেন্সিলের দাগে তৈরি পাশের কৃত্রিম বকুলগাছটা আলতো করে ছুঁলো। তরীদের বাসার বকুলগাছটাও এমন। একটুও সুন্দর না। প্রণয়ের মনে পরে, ছোটবেলায় যখন তারা গ্রামে যেত, তরীদের বাসাতেই থাকা হতো ওদের। প্রণয় ছোট থেকেই খুব শান্ত, ভদ্র ছিল। সারাদিন বইয়ে মুখ গুঁজে রাখতো। সে যে ঘরটায় থাকতো, ওখান থেকে স্পষ্ট বকুলগাছটা দেখা যেত। সময়ে অসময়ে গাছ বেয়ে ডালে বসে মনের সুখে গান ধরতো তরী,
“আমারো পরাণও যাহা চায়, বকুলফুল তুমি তাই, ওগো তুমি তাই।”

দশ বছরের তরী কি মিষ্টি করেই না গাইতো! ভেবে ভেবে প্রণয় শব্দ করে হেসে ফেললো। সেই হাসি লাইব্রেরি ঘরে ঝংকার তুললো যেন। অথচ কেউ শোনার নেই। কেউ পাশে নেই।
প্রণয়ের ক্ষণিকের হাসি হঠাৎ থেমে গেল। বইটা বন্ধ করে পাঁচ নম্বর তাকে সেটা আবারও রেখে দিলো সে। বুকে পাথর জমেছে। তরীর হয়তো কিচ্ছু মনে নেই। না থাকারই কথা। তখন তো তার বয়স কম ছিল। প্রণয়ও অত মিশতো না।

বাসে আজ ভীড় নেই তেমন। তবে জ্যাম খুব। বাস একটু এগোতে না এগোতেই জ্যাম লেগে বসে থাকতে হচ্ছে। মাহাদ যেন খুব উপভোগ করছে ব্যাপারটা। তরী সবসময়ের মতো উদাসীন চোখে দেখছে তাকে। মাহাদ সাহেব আজ বায়না ধরেছেন, তিনি বাসে করে যাবেন তরীর সঙ্গে। তরী মানা করেনি। আবার যেতেও বলেনি।
মাহাদের শরীরে গরম বেশি। একটু থেকে একটু হলেই গরমে হাঁপিয়ে যায় সে। এখনও ঘেমে নেয়ে এলাহি কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। শার্টের প্রথম বোতামটা সর্বদা খোলাই রাখে মাহাদ। এবার দ্বিতীয় বোতামটাও খুলে কলার ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে বললো, “কথা বলছো না কেন তরী? ভালো লাগছে না আমার।”
কণ্ঠেই সুস্পষ্ট তেঁতো মেজাজ উপড়ে আসতে চাইছে। তরী একবার মাহাদের দিকে তাকালো। ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে এগিয়ে দিলো।

—“আপনি শুধু শুধু নিজের দেড়ি করছেন। আমরা এখনো বাড়ির অর্ধেক রাস্তায়ও আসিনি।”
মাহাদের বাঁকা কণ্ঠে উত্তর, “একটা ছেলেকে বিকাল বেলা উড়াধুরা মারার কথা ছিল আমার। সেটা না করে আমি তোমার সাথে চুপচাপ বসে আছি। তোমার কি ভালো লাগছে না?”
তরী তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। সরাসরি তাকিয়ে বললো,
—“আপনি এত বাজে কেন মাহাদ?”
—“তুমি এত পাষাণ কেন?”

তরী আর কিছু বললো না। মুখ মলিন করে অন্যপাশে চেয়ে রইলো। পাশে বসে থাকা মাহাদ কিন্তু থেমে নেই। একটুও স্থিরতা নেই লোকটার মাঝে। সরব তার বাহু টেনে নিজের কাঁধে মাথা চেপে ধরলো। তরীর চোখ বড়োসড়ো হয়ে গেল মুহুর্তেই। ভড়কালো খুব। হন্তদন্ত কণ্ঠে বললো, “বাসে মানুষ! মাথা গেছে আপনার?”
—“চুপ থাকো তরী।”
—“কি চুপ থাকো? দেখি, সরুন।”
চোখের চাহনি কঠোর করলো মাহাদ। তরী নড়াচড়া ক্ষীণ থামালো। ম্লান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো, “এমন করছেন কেন?”
—“তুমি ক্লান্ত, তাই।”
তরী তবুও শান্ত হলো না। আশেপাশে নজর ঘুরালো। কলেজ পড়ুয়া দুটো মেয়ে তাদের পাশের সীটে বসে আছে। ওরা কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে ছিল। তরী তাকাতেই মুখ ভরে হাসলো।
লজ্জায় আড়ষ্ট তরী সরতে নিলেই মাহাদ বলে, “চোখ বন্ধ করো তরী।”
—“কেন?”
—“চোখ বন্ধ করো। তারপর বলছি।”

তরী সত্যি সত্যি নেত্রপল্লব একটার সঙ্গে অন্যটা মিলিয়ে নিলো। তার ধীর কণ্ঠে বললো, “করেছি।”
—“এবার চোখ বন্ধ করে রাখো। কথা বলবে না।”
তরী তাই-ই করলো। শরীর যেন আস্তে আস্তে ছেড়ে দিলো। বন্ধ চোখের কালো গভীরতা বাড়লো। একটু একটু করে বেড়েই চললো।

তরীর যখন ঘুম ভেঙ্গেছে তখন আকাশে সন্ধ্যা নেমে এসেছে। মাহাদ স্থির চোখে সামনের দিকে চেয়ে চেয়ে কি যেন দেখছে। তরী একটু নড়েচড়ে উঠলো। প্রশ্ন করলো, “কয়টা বাজে?”
—“৭টা বাজবে একটু পর।”
তরী দীর্ঘশ্বাস ফেলে খুব আস্তে বললো, “আজকেও দেড়ি হয়ে গেছে। মামী বকবেন খুব।”
অথচ মাহাদ কথাটা শুনে ফেললো। শুধালো, “তোমার মামী তোমার সাথে এমন ব্যবহার করে কেন?”
—“মামীর তিন ছেলে ছিল। ছোট ছেলে তৈয়ব আমাদের বাড়ির ছাদে খেলতে গিয়ে নিচে পরে গিয়েছিল। বেঁচে ফিরেনি আর। তখন থেকে মামী আমাদের তেমন পছন্দ করেন না।”

মাহাদ শুনলো, বুঝলো। বিষয়টা এড়িয়ে বললো, “তোমাকে না মিথ্যে বলার কিছু পয়েন্ট দিয়েছিলাম? শিখেছো? দেখি, একবার মিথ্যে বলো তো।”
মাহাদের ভাবভঙ্গি নিমিষেই বুঝে ফেললো তরী। হেসে বললো, “মাহাদকে কেউ পছন্দ করে না।”
মাহাদ নাক কুঁচকে বললো তখন, “মিথ্যেটা আমার পছন্দ হয়নি। বলো, মাহাদকে কেউ ভালোবাসে না।”

______________

চলবে~
ঈশানুর তাসমিয়া মীরা