#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_২৩
#Esrat_Ety
ক্রাচে ভর দিয়ে ধীরপায়ে হেটে কেবিন থেকে বের হয় আলো। একজন নার্স এসে বলে,”ঘুম ভেঙেছে আপনার? আপনাকে ব্যাথা নাশক ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিলো, তার প্রভাবেই ঘুম হচ্ছে এতো।”
আলো ম্লান হেসে বলে,”কেউ এসেছিলো? আমার মা কিংবা ভাইয়েরা?”
_হ্যা,ওনারা তো এতক্ষন এখানেই ছিলো। একটু আগে আপনার বাবার কাছে গেলো।
নার্স একটু থেমে আবার বলতে শুরু করে,”মেয়র সাহেব বার বার এসে আপনাকে দেখে গিয়েছে।”
আলো নার্সের কথায় পাত্তা না দিয়ে কেবিনে ঢুকতে গেলে নার্স বলে ওঠে,”আপনার হাজবেন্ড খুব কেয়ারিং। স্ত্রীর জন্য চোখে মুখে কী ভীষণ উৎকণ্ঠার ছাপ! লাভ ম্যারেজ নাকি?”
আলো দাঁড়িয়ে পরে। নার্স বলতে থাকে,”খুবই ভালো লেগেছে দেখতে ব্যাপারটা। এখানে তো সবাই সবটা নার্সদের উপর ছেড়ে দিয়ে চলে যায়। উনি এতো ব্যস্ত মানুষ হয়েও…..”
_আপনার ভালো লেগেছে তাকে?
নার্স কে থামিয়ে দিয়ে আলো প্রশ্নটি করে নার্সের দিকে তাকিয়ে থাকে। নার্স আলোর দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলে,”মানে?”
_মেয়র সামিন ইয়াসার মির্জাকে আপনার ভালো লেগেছে? তাহলে আপনি নিয়ে নিন।
ঠান্ডা গলায় বলে আলো। নার্স হতভম্ব হয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন এসে নার্সের পেছনে দাঁড়িয়ে বলে ওঠে,”আমার বৌয়ের মাথায় একটু সমস্যা আছে নার্স আপা। কিছু মনে করবেন না।”
নার্স ঘুরে তাকায় সামিনের দিকে। সামিন হাসি দিয়ে বলে,”ওর মাথায় একটু সমস্যা আপা। আপনি যান । আমি দেখছি। অসুবিধা হলে ডাকবো আপনাকে।”
হতভম্ব ভাব নিয়েই নার্স সেখান থেকে চলে যায়। সামিন আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমার দ্বিতীয় বিয়ের প্রয়োজন হলে আমি নিজে এসে তোমার কাছে বলবো। তুমি কেনো আগ বাড়িয়ে নিজের সতীন ঠিক করছো।”
আলো ঘুরে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে নিজের কেবিনে ঢোকে। সামিন আলোর পিছু পিছু ঢুকে একটা চেয়ার টেনে বসে। আলো গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”আচ্ছা আপনার আর কোনো কাজ নেই? আপনাকে যারা মেয়র বানিয়েছে তাদের সেবা করুন গিয়ে।”
বেডের পাশে ক্রাচ টাকে রেখে আলো বসে পরে। সাইড-টেবিল থেকে গ্লাসের ঢাকনা উঠিয়ে পানি খেয়ে গ্লাস টা রেখে দিয়ে আবারো ক্রাচ হাতে তুলে নেয়। সামিন বলে,”কোথায় যাবে? ওয়াশ রুমে? নার্স ডাকবো?”
_আব্বুর কাছে যাবো আমি।
কপাল কুঁ’চ’কে জবাব দিয়ে আলো হাঁটতে থাকে। সামিন বলে,”চলো আমি নিয়ে যাচ্ছি।”
আলো কোনো বিরোধীতা করে না। সে জানে সে নিষেধ করলেও সামিন পেছন পেছন আসবে। শুধু শুধু কথা অপচয় করে লাভ নেই।
আইসিইউর সামনে এসে আলো দাঁড়িয়ে পরে। রেহেনা উঠে দাঁড়িয়ে বলে,”তুই আসতে গেলি কেনো মা। তুই বিশ্রাম নিতি!”
আলো বলে,”আব্বুর কি অবস্থা?”
_সব ঠিক আছে। ধৈর্য ধর।
আজান এসে আলোকে ধরে বসিয়ে দেয়। আলো আজানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”আয়াত কোথায়?”
_দাদীর কাছে। বাড়িতে।
সামিন দূরে দাঁড়িয়ে আলোকে দেখতে থাকে। খোঁপা আলগা হয়ে গিয়েছে আলোর। কপালের কাছে কিছু চুল এসে বড্ড বিরক্ত করছে মেয়েটিকে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পরে আলোর চোখে চোখ পরতেই সে চোখ সরিয়ে নেয়। আলো শীতল চোখে সামিনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে রেহেনাকে ডাকে,”আম্মু।”
রেহেনা মেয়ের দিকে তাকায়। আলো বলতে থাকে,”গয়না গুলো আনতে বলেছিলাম,এনেছিলে?”
রেহেনা মাথা নাড়ায়।
_ওনাকে দিয়ে দাও।
সামিন আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো তার দিকে তাকিয়ে বলে,”ইশিতা আপু চেয়েছিলো গয়না গুলো। আপনার দেওয়া অর্থের সমপরিমাণ গয়না আছে ওখানে। আপুকে দিয়ে দেবেন।”
রেহেনা ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে রোবটের মতো সামিনের দিকে এগিয়ে দেয়। সামিন ম্লান হেসে প্যাকেটটা হাতে তুলে নেয়। আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনার ঋন শো’ধ হয়ে গিয়েছে। এর বিনিময়ে আর কোনো কৃতজ্ঞতা বোধ দেখাতে পারবো না।”
***
“তোর হাতে ওটা কিসের প্যাকেট?”
ফুয়াদ সামিনের হাতের প্যাকেট টার দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন বলে,”এটা? এটা তো শশুর বাড়ি থেকে যৌ’তু’ক পেলাম।”
ফুয়াদ হা হয়ে তাকিয়ে থাকে। বলে,”মানে?”
_মানে তোর ভাবীর মা মানে আমার শ্রদ্ধেয় শাশুড়ি এগুলো গড়েছিলেন তার মেয়েকে দেবেন বলে। আমার আত্মসম্মানে পরিপূর্ণ বৌ এগুলো দিয়ে আমার ঋন শো’ধ করেছে।
ফুয়াদ শুকনো হাসি হেসে বলে,”তোর জন্য এমন একটা মেয়েই ঠিক আছে। নরম কোমল টাইপ বৌ পোষাতো না।”
_এ কথা বলছিস কেনো?
_এমনিই। তুই কি যেনো বলতি? স্ত্রী হচ্ছে বি’ছা’না’র সৌন্দর্য, শুধুমাত্র শ’য্যা’স’ঙ্গী । এখন তো দেখছি তুই এই শ’য্যা’স’ঙ্গী ছাড়া একেবারেই অচল। মাত্র ক’দিনেই এই অবস্থা?
সামিন চুপ করে থাকে। ফুয়াদ বলে,”বারবার বলেছি, এমন কিছু করিস না যার জন্য আজীবন তোকে অ’নু’তা’প করতে হয়।”
_ওকে তী’ব্র ভাবে অনুভব করতে শুরু করেছি আমি। আটকে গিয়েছি, ফেরার পথ নেই।
ফুয়াদ সামিনের কাঁধে হাত রেখে বলে,”এটাই সম্ভবত তোর শা’স্তি। ওকে পাওয়ার ব্যাকুলতায় ছ’ট’ফ’ট করবি কিন্তু ও ধরা দেবে না।”
_সত্যিই দেবে না? কখনোই না?
ফুয়াদ সামিনের দিকে তাকায়। সামিন বাচ্চাদের মতো আগ্রহী হয়েছে জানার জন্য।
ফুয়াদ গা ছাড়া ভঙ্গিতে বলে,”কি জানি! নারীর মন,বোঝা বড্ড কঠিন। তবে আমি দুই পার্সেন্ট শিওর ও তোর প্রতি নরম হবে। বাকি আটানব্বই পার্সেন্ট তোর কাজের উপর নির্ভর করছে। দেখ কি হয়!”
_মাত্র দুই পার্সেন্ট?
_অনেক বেশি বলেছি আমি। ভুলে যাস না তুই ওর সাথে কি করেছিস, প্রথমে কোন রূপে আবির্ভূত হয়েছিস ওর মনে। একটা প্রাপ্তবয়স্ক নারীর মন থেকে এসব মুছে ফেলা খুব কঠিন এবং ধৈর্য্যর ব্যাপার সামিন ইয়াসার মির্জা।
_তাহলে দুই পার্সেন্ট কেনো নিশ্চয়তা দিচ্ছিস। একেবারেই দিস না। কোন যুক্তিতে দিলি?
_অবলা জাত কখনো কখনো ঘৃ’ণা করতে করতে পুরুষকে ভালোবেসে ফেলে সেই যুক্তিতে!
***
“হুমায়ূন আহমেদ একটা কথা বলেছিলেন, ধনাঢ্য পরিবারের মেয়েরা গরীব ছেলেদের দেখলে একটা মায়া কাজ করে তাদের মনে, যে মায়া থেকে ভালোবাসা জন্মায়। তবে আমি এই অনূভুতিকে কখনোই ভালোবাসা বলে আখ্যায়িত করবো না,এই অনূভুতির নাম সহানুভূতি। ভালোবাসা নয়।”
ইশিতা কিছুক্ষণ শান্তর মেসেজটার দিকে তাকিয়ে থাকে। উত্তরে কিছু কথা সাজিয়ে লিখেও ফেলে কিন্তু ক্ষন’বাদেই তা মুছে ফেলে অফলাইনে চলে যায়।
দুমিনিট পর শান্তর ফোন আসে তার ফোনে। ইশিতা ফোনটা রিসিভ করবে না করবে না করেও রিসিভ করে কানে ধরে চুপ করে থাকে। শান্ত মৃদু হেসে বলে,”রা’গ করলে?”
_না তো। কেনো রা’গ করবো?
_তোমাকে রা’গি’য়ে দেওয়ার মতো একটা কথা লিখলাম।
_তুমি সহানুভূতি পেতে না চাইলে সাফ সাফ জানিয়ে দেবে। এতো ভনিতা করে কথা বলবে না।
শান্ত কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে ওঠে,”চাই। আমি সহানুভূতি পেতে চাই। অভ্যেস খারাপ করে দিয়েছো তুমি। বড্ড লো’ভী হয়ে উঠেছে মন।”
ইশিতার ঠোঁট প্রশ্বস্ত হয়ে যায় হাসিতে। শান্ত বলতে থাকে,”তবে কি জানো , দরিদ্র সুদর্শন পুরুষ, এটা একটা তরুণীর জন্য মারাত্মক বি’প’দ’জ’ন’ক। আজীবন ভুগতে হয় ঠিক সময়ে এরিয়ে না গেলে।”
_এই আমি ফোন রাখলাম।
ইশিতা রা’গ দেখিয়ে ফোন কেটে দিতে গেলে শান্ত বলে ওঠে,”ইশু। আমি এরকম একটা আদরের দুলালীকে ঠিকঠাক ভাবে ট্রিট করতে পারবো তো?”
_আগে জানো সে কতটা চায়।
_কতটা চায়? তুমি যে সানস্ক্রিন লোশন ব্যবহার করো সেটা আমার প্রত্যেক মাসের মেস ভাড়া ইশু।
ইশিতা চুপ করে থেকে বলে,”চাকরি পেলে মেস ছেড়ে দেবে। একটা বাসা নেবে, আমাকে বিয়ে করবে, মোটামুটি দামের একটা সানস্ক্রিন লোশন কিনে দেবে। এতটুকু আত্মবিশ্বাসী হতে পারছো না?”
_আমার আত্মবিশ্বাস আমি আমার বৌকে পুরো একটা স্যালন কিনে দিতে পারবো। কিন্তু সেটা স্বপ্নে।
শান্ত উচ্চশব্দে হাসতে থাকে কথাটি বলে।
ইশিতা চুপ করে থেকে বলে,”কি করছো?”
_সস্তার সিগারেট পো’ড়া’চ্ছি।
দু’পাশের দুজন নিরব থাকে। শান্ত হুট করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠে,”পারলে এড়িয়ে যাও ইশু। এই সিগারেট টা পু’ড়’তে যতখানি সময় নিচ্ছে, তুমি পু’ড়’তে ততখানি টাইম নেবে না। বাবার রাজকন্যা, ভাইদের আদরের বোন, পারলে এড়িয়ে যাও। বোকামি করো না।”
***
“তুমি যে বলেছিলে জ্ঞান ফিরলে আর কোনো চিন্তার কিছু নেই? তাহলে এখন এসব কি বলছো?”
সামিন রাসেলের দিকে তাকিয়ে থাকে। রাসেল বলে,”আমি বলেছি আশংকা রয়েছে। তবে না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি।”
সামিন বলে,”অ’পা’রে’শ’ন করা হলো কেন তবে?”
_ওনার জীবনটা বাঁচানোর জন্য। বেঁ’চে গিয়েছে উনি প্রানে। এখন বাকিটা পরে বোঝা যাবে।
সামিন মাথা ঘুরিয়ে আলোর দিকে তাকায়। আইসিইউর সামনে ক্রাচে ভর দিয়ে বাবার মুখটা আরো নিকট থেকে দেখার,বাবাকে ছোঁয়ার প্রতিক্ষায় আছে সে। দরজার কাচে চোখ রেখে ভেতরে তাকিয়ে আছে। ভেতরে রেহেনা।
রাসেল বলতে থাকে,”এ ধরনের কেস আমি যেকটা হাতে পেয়েছি তাদের মধ্যে শতকরা বিশ শতাংশ পেশেন্টের সাথে এমনটা হয়েছে তবে বাকি আশি শতাংশ কিন্তু সুস্থ হয়ে উঠেছে সামিন। অযথা দুশ্চিন্তা করো না।”
সামিন রাসেলের কথার জবাব দেয়না। রাসেল যেমনটা বলছে যদি সত্যিই তেমনটা হতে থাকে তাহলে আলো খুব ভেঙে পরবে।
রেহেনা বের হয়। একটু পরেই ডাক্তারের পারমিশন নিয়ে আলো ভেতরে ঢোকে।
আতাউর আলম কারো অস্তিত্ব টের পেয়ে দু’চোখ মেলে তাকায়। আলো ধীর পায়ে বাবার দিকে এগোতে থাকে। আতাউর চোখ পিটপিট করে মেয়েকে দেখতে থাকে। তার সামনে সালোয়ার কামিজ পরিহিতা , চুলে বিনুনি করা, চ’ঞ্চ’ল,দ’স্যি মেয়েটি নয় বরং দাঁড়িয়ে আছে শাড়ি পরিহিতা, চুলে খোঁপা করা, গলায় হালকা পাতলা গয়না পরে বৌ বৌ সাজের একটি মেয়ে। আতাউর কয়েক মুহূর্ত মুগ্ধ হয়ে নিজের কন্যাকে দেখে। অত্যন্ত মিষ্টি একটা চেহারা মেয়েটির। একেবারে মায়ের মতো দেখতে হয়েছে। ক্লাস টেনে থাকাকালীন নানা জায়গা থেকে অসংখ্য বিয়ের প্রস্তাব আসতো মেয়েটির জন্য, আতাউর আলম কখনো তাদের পাত্তা দিতো না। তার ইচ্ছে ছিলো মেয়েটিকে সে নিজের পায়ে দাড় করিয়ে বিয়ে দেবে। আজ সেই মেয়েটি বৌ বৌ সাজে তার সামনে দাঁড়িয়ে। আলো তার দিকে তাকিয়ে আছে। আতাউর আলম অত্যন্ত ক্ষীণ কন্ঠে বলে ওঠে,”পায়ে কি হয়েছে তোর?”
_হো’চ’ট খেয়েছি।
_কিভাবে?
_তুমি পাশে নেই বলে, বারবার খাচ্ছি আব্বু।
আতাউর আলম ম্লান হাসে। আলো বলে,”তোমাকে বুড়ো বুড়ো লাগছে আব্বু।”
_তোকেও মহিলাদের মতো লাগছে। শাড়ি পরে থাকিস কেনো?
_শুধু শাড়িই কিনে দিয়েছে আমাকে।
_তা কেনো?
_আমার অবস্থান বুঝিয়ে দিতে সম্ভবত। আমি এখন কারো বৌ। এটা বারবার মনে করিয়ে দিতে।
আতাউর আলম মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। আলো বলতে থাকে,”সু’স্থ হয়ে ওঠো আব্বু। সবটা গুছিয়ে নিতে হবে। এলোমেলো হয়ে যাওয়া সবটা গুছিয়ে নিতে আমার মাথার উপরে বাবার শ’ক্ত একটা হাত দরকার। দয়া করে সুস্থ হয়ে ওঠো তুমি।”
***
জ্ঞান ফেরার আজ তিন দিন, আতাউর আলমকে জেনারেল কেবিনে শিফট করে দেওয়া হয়েছে। কাল পরশুর মধ্যে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হবে তাকে।
রাত অতটা গভীর নয়। বিকেলের দিকে ভাইদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়ে আলো নিজেও সামিনের সাথে বাড়িতে চলে আসে। তাকে দুদিন আগেই ছাড়পত্র দিয়ে দিয়েছে ডক্টর, কয়েকদিন পরেই তার পায়ের প্লাস্টার খুলে ফেলা হবে। হসপিটালে এখন শুধু রেহেনা আছে।
বিছানায় কিছুক্ষণ শুয়ে থেকে চোখ বন্ধ করে থাকে। তারপর চোখ মেলে ঘড়ির দিকে তাকায়। সময় রাত ১০ টা বেজে বিয়াল্লিশ মিনিট। বিছানায় শুয়ে কিছুক্ষণ উ’শ’খু’শ করে সে উঠে বসে। আব্বুর জন্য মনটা অস্থির হয়ে উঠেছে।
এখন কিভাবে যাবে সে!
সামিন হাতের ল্যাপটপ সরিয়ে আলোকে কিছু সময় ধরে দেখে। আলো চুপচাপ মাথা নিচু করে বিছানায় বসে আছে।
ল্যাপটপ বন্ধ করে মৃদু স্বরে বলে ওঠে,”হসপিটালে যেতে চাও?”
আলো সামিনের দিকে তাকায়। সামিন বলতে থাকে,”যেতে চাও? তাহলে নিয়ে যাবো।”
আলো মাথা নাড়িয়ে না বলে দেয়। সামিন আবারো ল্যাপটপ হাতে নেয়। আলো বলে ওঠে,”আর তেইশ দিন পরে এমনিতেই চলে যাবো, তার আগে এতো ঘনঘন যাওয়া আসা করার কি দরকার!”
সামিন ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। কতটা দৃঢ়তার সাথে বলেছে আলো এই কথাটা। কিছু সময় চুপ থেকে সামিন বলে,”শিওর তুমি? আমাকে ছে’ড়ে তেইশ দিন পরে চলে যাবে? এতোটা আত্মবিশ্বাসের সাথে বলছো?”
_হ্যা।
সামিনের চোখে চোখ রেখে বলে আলো।
***
আতাউর আলম আলোর পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সামিনের দিকে তাকিয়ে আছে। সে তার সামনে তেজী, প্র’তি’হিংসাপরায়ণ, ভ’য়ং’কর ছেলেটাকে দেখে কিছুটা অবাক হচ্ছে। সামিনের চোখে মুখে আগের হিং’স্র’তা সে দেখতে পাচ্ছে না, ক’দিন আগেও যা দেখে সে কেঁ’পে উঠতো। বরং তার সামনে একজন অস্বাভাবিক বিনয়ী একজন লোককে সে দেখছে। এই পরিবর্তিত রূপ হ’জ’ম করাটা কষ্টকর। আতাউর আলম একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ফেলে দু’চোখ বন্ধ করে ফেলে। আলো উৎকণ্ঠা নিয়ে এগিয়ে আসে,”কি হয়েছে আব্বু? শরীর খারাপ লাগছে?”
আতাউর আলম মাথা নাড়ায়। নিজের মেয়েটার পাশে ঐ ছেলেটাকে মেনে নিতে পারছে না সে। বুকের মধ্যে যন্ত্রনা হচ্ছে।
ডাক্তার রাসেল এসে আতাউর আলমকে পরিদর্শন করে। সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”আর দুটো দিন চাইলে রাখতে পারতে। এত দ্রুত বাড়িতে……”
_আমার আব্বু। আমি বুঝে নেবো।
গম্ভীর কন্ঠে বলে আলো, তারপর ডাক্তার রাসেলের দিকে তাকিয়ে বলে,”অসুবিধা নেই তো ডক্টর?”
ডাক্তার রাসেল মাথা নাড়ায়। একটা হাসি দিয়ে বলে,”অসুবিধা নেই তবে, খুব সাবধানে।”
আলো মাথা নাড়ায়। সামিন চুপচাপ আলোকে দেখে। বাবার সুস্থ হবার খুশিতে সে ভুলে গিয়েছে তারও পায়ে চো’ট। ক্রাচে ভর করেও লাফিয়ে লাফিয়ে সবটা দেখছে।
বিকেলে আতাউর আলমকে বাড়ি নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা করা হয়। হসপিটালের সামনে এ্যা’ম্বু’লে’ন্স দাঁড়িয়ে আছে। ওয়ার্ড বয়রা এসে আতাউর আলমকে ধরে ধরে নামিয়ে নেওয়ার জন্য দাড়িয়ে আছে। আলো বাবার পাশে বসে বাবাকে জরিয়ে ধরে রেখেছে। বাপ বেটিতে চোখ বন্ধ করে আছে। সামিন দূরে দাঁড়িয়ে এই অদ্ভুত সুন্দর দৃশ্যটি দেখতে থাকে। মেয়েরা সত্যিই বাবা পাগল হয়। হুট করে তার মনেও বাসনা জাগলো তার প্রথম সন্তান যেনো মেয়ে হয়। ওই পাগল মেয়ে অদ্রিতা আলোর মতো একটা মেয়ে।
কথাটা চিন্তা করে সামিন মনে মনে ভীষণ লজ্জা পেয়ে যায়। মনে মনে নিজেকে নিজে বলে,”বৌ থাকবে কি থাকবে না তারই গ্যারান্টি নেই তুই এদিকে বাচ্চার স্বপ্নও দেখছিস সামিন ইয়াসার!”
ধীরপায়ে হেটে আতাউর আলমের পরিবারের সামনে দাঁড়ায় সামিন । সবাই তার দিকে তাকায়। সবার মুখের দিকে একপলক তাকিয়ে খুবই ঠাণ্ডা গলায় আলোকে বলে,”তুমি চাইলে তোমার বাবা মায়ের সাথে যেতে পারো আলো। ক’দিন ওখানে থাকবে ।”
আলো সামিনের কথায় একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে। রেহেনা নরম গলায় আলোকে বলে ওঠে,”যাবি মা তুই?”
আজান আয়াত বলতে থাকে,”আপু চলো না। আমাদের সাথে চলো।”
আলো সামিনের দিকে একপলক তাকিয়ে তার মাকে বলে,”না আম্মু। আমি এখন যাবো না। আমি ঠিক বাইশ দিন পরে চলে আসবো তোমাদের কাছে । একেবারের জন্য।”
রেহেনা নিজের মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন আলোকে দেখছে। আলো বলতে থাকে,”বাইশ দিন পর তোমাদের কাছে ফেরার আগে এই লোকটাকে বুঝিয়ে দিয়ে আসবো এই লোকটা জীবনসঙ্গী হিসেবে সম্মানের যোগ্য নয়। এই লোকটা একটা অযোগ্য নেতাই নয় বরং অযোগ্য মানুষ। এর চোখে আঙুল দিয়ে আমি বুঝিয়ে দিতে চাই আম্মু। তোমরা যাও। তোমাদের মেয়েও ফিরবে।”
***
গাড়িতে উঠে একপলক আলোর দিকে তাকিয়ে সামিন গাড়ি স্টার্ট করে। হসপিটালের গেইট পেরিয়ে বাড়ির দিকে ফিরতে থাকে। আলো সিটবেল্ট বাঁধে নি। সামিন বলে,”সিট বেল্ট বাঁধতে চাও না কেনো? একটা অ’ঘ’ট’ন ঘটলে তখন বুঝবে!”
_অ’ঘ’ট’নে’র পাশে বসে অ’ঘ’ট’নে’র ভয় পাইনা আমি।
সামিন হেসে ফেলে,”আমি অ’ঘ’ট’ন? বাহ, কখনো পি’শা’চ, কখনো জা’নো’য়া’র , কখনো ফে’রা’উ’ন, কখনো আবার অ’ঘ’ট’ন!”
আলো চুপ করে থাকে। সামিন বলে,”আমি বলেছি একমাস পরে তোমার যদি আমার প্রতি অনূভুতি না বদলায় তাহলে তুমি চলে যেতে পারো। সে কথা শুনে খুব খুশি হয়েছো তাই না? আচ্ছা যদি আর বাইশ দিন পরেও তোমাকে যেতে না দেই, জোর করে আটকে রেখে দেই? যদি জোর জবরদস্তি করি? তখন?”
আলো সামিনের দিকে তাকায়। সামিন ম্লান হেসে বলে,”ভ’য় পেয়ো না। আমি আমার কথা রাখবো। জোর করবো না তোমাকে।”
আলো সামিনের কথার কোনো জবাব দেয়না। দু’জনে দীর্ঘসময় ধরে চুপচাপ। গাড়ি শান্তনীড়ের গেইট থেকে ভেতরে ঢোকে।
গাড়ি থেকে নেমে আলো ক্রাচে ভর দিয়ে বাড়ির ভেতর ঢোকে। লিভিং রুমে বাড়ির মেয়েরা সবাই দাঁড়িয়ে। একজন অচেনা বৃদ্ধ মহিলা বসে আছে লিভিং রুমের সোফাতে। আলোকে দেখে রিতু এগিয়ে এসে আলোর মাথায় ঘোমটা তুলে দিয়ে নিচু স্বরে বলে,”সম্পর্কে আপনার দাদী শাশুড়ি। আমাদের দাদা শশুরের ছোট বোন ।”
আলো এক পলক মহিলাটিকে দেখে। মাথার চুল ধবধবে সাদা, গাঁয়ের রং টাও বেশ চমৎকার। গায়ে একটা সাদা কালো জামদানি শাড়ি। দেখে বয়স কত তা বোঝার উপায় নেই। হতে পারে সত্তরের ওপরে। ভদ্রমহিলা আলোর দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। আলোর পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখছে। সামিন লিভিং রুমে এসে মহিলাটিকে দেখে হাসি মুখে এগিয়ে যায়। তারপর কুশল বিনিময় করে। ভদ্রমহিলার নাম ইলোরা মির্জা। তিনি মাথা ঘুরিয়ে আবারো আলোকে দেখে। তারপর সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”ল্যাংড়া বৌ? কিন্তু কেউ তো কিছু বললো না!”
সামিন থমথমে মুখ নিয়ে আলোর দিকে তাকায়। তারপর তার দাদীর দিকে ফিরে বলে,”পায়ে চো’ট পেয়েছে দাদী।”
ইলোরা আবারো আলোর দিকে তাকায়। ঠাট্টার ছলে বলে,”কেনো? বেশি লাফায় নাকি তোর বৌ?”
আলো কপাল কুঁ’চ’কে সিঁড়ির দিকে যায়। এবাড়ির প্রত্যেকটা লোক এক একটা নমুনা। এই নতুন নমুনাটা আবার কোথা থেকে উদয় হলো কে জানে!
আলোকে যেতে দেখে ইলোরা বলে ওঠে,”কেমন মেয়ে! মুরব্বিদের দেখেও সালাম দেয় না!”
সামিন দাদীর হাত চেপে ধরে চুপ করিয়ে দেয়। আলো ধীরে ধীরে উপরে উঠতে থাকে।
ইলোরা সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”কি? কেমন মেয়ে এটা? বিয়ে করবি না করবি না বলে কেমন মেয়ে বিয়ে করলি!”
তুমি তো জানো সবটা। কিছু মনে করো না দাদী।
নরম গলায় ইলোরাকে বলে সামিন।
***
“ভাবী! আপনার খাবার কি ঘরে পাঠিয়ে দেবো?”
আলো ঘুরে তাকায়। সিতারা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে বলে। ক্রাচ টা হাতে তুলে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,”দরকার নেই। আমি আসছি।”
সিতারা চলে যায়। সামিন ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে আলোর দিকে তাকায়, তারপর বলে ওঠে,”বাড়িতে যিনি এসেছেন তিনি একজন মুরব্বি। রেসপেক্ট ডিজার্ভ করে আলো।”
_রেসপেক্ট আমি মানুষের ব্যাবহার দেখে করি। ওনার কথা বার্তার ধরন দেখে মনে হয়নি তিনি ওসবের যোগ্য।
সামিন বলে,”ঠিকাছে। আর যাই করো ,গালাগাল শুরু করে দিও না অন্তত। দুদিনের জন্য ডাক্তার দেখাতে এসেছে এখানে।”
আলো কিছু না বলে নিচে নেমে আসে। খাবার টেবিলে বসতেই ফুলির মা তার খাবার বেড়ে দেয়। টেবিলে মোটামুটি বাড়ির সবাই খেতে বসেছে। আলো চুপচাপ খেয়ে নিচ্ছে। ইলোরা কিছুক্ষণ আলোকে দেখে রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”সামিন খেয়েছে?”
রিতু মাথা নাড়ায়। ইলোরা সরাসরি আলোর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,”স্বামীর আগে আগে খেয়ে নেওয়ার রীতি চালু হয়েছে এই মির্জা বাড়িতে বুঝি!”
আলো সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে খেতে থাকে। এমন সময় সামিন এসে দাঁড়ায় সেখানে। একে একে প্রায় সবাই খাওয়া শেষ করে উঠে যায়। সামিন একটা খালি চেয়ার টেনে বসে পরে। একপলক আলোর দিকে তাকায় সে। ইলোরা আলোকে বলে,”স্বামীর কি লাগবে না লাগবে সেটা দেখো!”
আলো মাথা তুলে একবার সামিন আর একবার ইলোরার দিকে তাকিয়ে প্লেটে হাত ধুয়ে ক্রাচ তুলে উঠে দাঁড়ায়। তারপর চলে যায় সে সেখান থেকে।
ফুলির মা সামিনের খাবার বেড়ে দিয়ে চলে যায়। খাবার টেবিলে আপাতত সামিন এবং ইলোরা। সামিন খেতে শুরু করে। ইলোরা বলে,”যা শুনেছি তাই তো দেখছি সত্যি। তুই এটা কি বিয়ে করেছিস?”
সামিন চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে। ইলোরা ধ’ম’কে’র সুরে বলে,”এখন আমাকে মির্জা বাড়ির ছেলেদের শিখিয়ে দিতে হবে কিভাবে বৌ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়?”
সামিন খাওয়া রেখে ইলোরার দিকে তাকায়। ঠান্ডা গলায় বলে,”আমি কাউকে নিয়ন্ত্রণে আনতে চাই না দাদী।”
_তো এটাকে দিয়ে কি করবি? সংসারে মন নেই, অহংকারী,দেমাগী মেয়ে, তোকে দামই দেয়না।
_বৌ আমার থাকবে কি থাকবে না সেই নিশ্চয়তা নেই আর তুমি বলছো দাম দেওয়ার কথা!
ইলোরা সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে।
সামিন হেসে ফেলে। ইলোরার দিকে তাকিয়ে বলে,”সংসারে মন লাগানোর টিপস দাও তুমি। এক কাজ করো আবার আসার সময় তোমাদের বাড়ির ওখান থেকে তাবিজ নিয়ে এসো আমার বৌয়ের জন্য, সংসারে মন লাগিয়ে দাও আমার বৌয়ের। যাতে আমাকে ছে’ড়ে না চলে যায়।”
কথাটি বলে সামিন হাসতে থাকে।
ইলোরা গম্ভীর কন্ঠে বলে,”ফা’জ’লা’মি করিস না। তাবিজ লাগবে না। এসব তে’জী মেয়েদের শুরুতেই কোমড় ভে’ঙে দিতে হয়। তাহলেই সংসারে মন লেগে যায় এদের। শুরুতেই পায়ে শিকল পরিয়ে দিলে আর পালাতে পারে না।”
সামিন খেতে খেতে বলে,”তা কিভাবে? এই শিকল টা আবার কি?”
_একটা বাচ্চা দিয়ে দে পেটে। দেখবি সংসারে মন না লেগে কই যায় !
কথাটা শুনে বি’ষ’ম খেয়ে যায় সামিন। কাশতে কাশতে হতভম্ব হয়ে ইলোরার দিকে তাকিয়ে থাকে।
চলমান…….
#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_২৪
#Esrat_Ety
ঘুমন্ত আলোর মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তার গায়ে চাদরটা টেনে দিতে যায় সামিন। হুট করে আলোর ঘুম ভেঙ্গে যায়। সামিনকে দেখে কিছুটা ভয় পেয়ে গিয়ে ধরফরিয়ে উঠে বসে।
সামিন হাত থেকে চাদরটা ফেলে রেখে বলে,”এতো ঘুম পাতলা মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। তুমি নাইট গার্ডের চাকরি নিলে পারো।”
আলো চাদরটার দিকে একপলক তাকিয়ে সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”ওটা দিয়ে কি করতে চাচ্ছিলেন?”
_তোমায় চাদর চা’পা দিয়ে মে’রে ফেলতে চাচ্ছিলাম।
ঠান্ডা গলায় জবাব দেয় সামিন।
আলো শাড়ির আঁচল টে’নে নিজেকে জরিয়ে নিয়ে বলে,”সেটা আপনি করতেই পারেন। আপনার রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্র’তি’হিংসা’প’রা’য়’ণ’তা।”
সামিন শীতল চোখে আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। আলো বলে,”কি? এমন ভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? এই বংশের ছেলেদের কেচ্ছাকাহিনী আমি কিছু জানিনা ভেবেছেন? অধিকাংশ ছেলেই তো দুই তিনটা করে বিয়ে করেছে, কোনো না কোনো বৌকে মে’রে’ছে।”
_এসব কথা কে বলেছে তোমায়? তারা কি খু’ন করার সময় সাথে থাকতো আমাদের বংশের ছেলেদের?
_যা রটে তার কিছু তো ঘটে।
_যে আমলের কথা বলছো সে আমল ঘুনে ধরেছে। এখন তো হাত না তুললেও তোমরা মেয়েরা স্বামীর নামে বানিয়ে মা’ম’লা ঠুকে দাও, নারী হওয়ার সুবিধা নাও।
আলো চুপ করে থাকে। সামিন বলে,”উঠে পরেছো ভালো হয়েছে। দাদী এমনিতেও বেশ কয়েকবার তোমাকে ডেকে গিয়েছে।”
_উনি কেনো ডেকেছে?
_তা তো আমি জানি না। গিয়ে দেখো।
_আমি যাবো না।
_আগামী বিশ দিন তুমি এই বাড়িতে আছো,তো এ বাড়ির বৌয়ের মতো থাকো। বেশি ঘাড় ত্যাড়ামি না করে যাও নয়তো কোলে করে দিয়ে আসবো।
আলো কিছুক্ষণ সামিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,”ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। এবার আমিও আপনাকে একটা কথা মনে করিয়ে দেই ইয়াসার মির্জা, আপনার চেয়ে নেওয়া একমাসের আর বাকি আছে মাত্র বিশ দিন । এবং আপনার প্রতি আমার অনূভুতি একটুও বদলায় নি। একটুও না।”
কথাটি বলে আলো ওয়াশ রুমে ঢোকে। সামিন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে সেখান থেকে চলে যায়।
***
“আজ ইহানকে পড়াতে আসলে না কেন?”
_চাকরীর ইন্টারভিউ ছিলো। একটা বিজ্ঞাপন কোম্পানিতে। রিতু ভাবীকে তো বলেছি।
ইশিতা চুপ করে থাকে। শান্ত ফোনের ওপাশ থেকে বলে ওঠে,”তোমাকে বলিনি বলে মাইন্ড খেয়েছো?”
_নাহ।
একশব্দে জবাব দেয় ইশিতা। তারপর বলে,”ইন্টারভিউ কেমন ছিলো? টিকবে?”
_বুঝতে পারছি না। মনে তো হচ্ছে টিকে যাবো।
ইশিতা চুপ হয়ে শুনতে থাকে শান্তর বিজ্ঞাপন কোম্পানিতে ইন্টারভিউয়ের অভিজ্ঞতা। পেছনে সামিন এসে দাঁড়িয়েছে সে খেয়াল করেনি।
“ইশু”
ভাইয়ার কন্ঠস্বর শুনে চ’ম’কে উঠে হাত থেকে ফোন ফেলে দিয়ে গুটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সে। সামিন বোনের ভী’ত স’ন্ত্র’স্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে অবাক হয়ে বলে,”প্রবলেম কি? ভ’য় পেলি কেনো এভাবে?”
ইশিতা তোতলাতে তোতলাতে বলে,”হুট করে এলে তো। তাই ভাইয়া। বলো কি বলবে।”
সামিন বলে,”একটা অত্যন্ত জরুরি কথা বলতে এসেছি। তোর বিয়ের ব্যাপারে।”
_আমার বিয়ে?
হা করে ভাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে ইশিতা। সামিন বলে,”হ্যা।”
ইশিতা চোখ মুখ কুঁচকে বলে,”ইশমামকে রেখে আবার আমাকে নিয়ে পরলে কেনো ভাইয়া? আমি তো কোন ছেলের জন্য স্লি’পিং পি’ল’স খাইনি!”
সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,”ডাক্তার রাসেল, আমার হাই স্কুলের ক্লাসমেট। সেদিন হসপিটালে তোকে দেখে পছন্দ করেছে। কথায় কথায় আজ বললো। সেও বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজছিলো আর বাবাও তোর বিয়ের কথা বললো। খুব ভালো ছেলে রাসেল। আমাদের গোটা স্কুলে একটা ভদ্র ছেলে থাকলে সেটা ছিলো ও।”
_হসপিটালে ডাক্তারি করা বাদ দিয়ে মেয়ে মানুষ পছন্দ করে বেড়ায় সে ভদ্র? কেনো ভাইয়া আমাকে এই উটকো ঝামেলায় জড়াচ্ছো। বলছি তো বিয়ে করবো না এতো তাড়াতাড়ি। ধূর!
ইশিতা ভাইয়ের ওপর রাগ দেখিয়ে চলে যায় নিজের ঘরে। সামিন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায়। আলো ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।আলোর পায়ের প্লাস্টার খুলে ফেলা হয়েছে গতকাল।
সামিন দাঁড়িয়ে পরে,”ক্রাচ কোথায় তোমার?”
_ওটার আর প্রয়োজন নেই। খুড়িয়ে খুড়িয়ে বেশ হাঁটতে পারি। ওটা একটা বোঝা।
আলো হাঁটতে থাকে। সামিন আলোর পিছু পিছু আসে। আলো গম্ভীর কন্ঠে বলে,”পিছু পিছু আসছেন কেনো?”
_তুমি আগে আগে যাচ্ছো তাই।
আলো চুপ হয়ে যায়। সামিন বলে,”প্লাস্টার খুলে ফেলার সাথে সাথে নিজের আগের রূপ ধারণ করেছো দেখছি। রয়ে সয়ে হাটো। আবার পরে……….”
সামিন কথাটা বলে শেষ করতে পারে না আলো পুনরায় হোঁ’চ’ট খেয়ে পরে যেতে নেয়। সামিন খ’প করে ধরে ফেলে আলোকে। আলো বড় বড় নিশ্বাস নিচ্ছে। এক মিনিট পর নিজেকে ধাতস্থ করে সামিনের দিকে তাকায়। সামিন তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় আলো। সামিন বলে,”এইবার পরে গেলে বেশ হতো, বাম পা-টাও ভেঙে হুইল চেয়ারে বসে থাকতে। আগামী ছয় মাসের জন্য যেতে পারতে না কোথাও স্বামীর বাড়ি ছেড়ে। আমার ধরাটা উচিত হয়নি। আসো তোমাকে ধা’ক্কা মে’রে ফেলে দেই।”
আলো এক মিনিট চুপ করে থেকে অতি সাবধানে সিঁড়ি ভাঙতে থাকে। পায়ের গোড়ালিতে এখনো বেশ য’ন্ত্র’না হয় তার। ধীরে ধীরে নেমে লিভিং রুমে দাঁড়ায়। ইলোরা মির্জার ব্যাগ পত্র গুছিয়ে রাখা লিভিং রুমে,আজ সে চলে যাবে। আলো ধীরপায়ে তার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলে,”আমাকে ডেকেছিলেন।”
ইলোরা মির্জা আলোর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে,”হু। আমি আজ চলে যাচ্ছি। তোমাদের বেশি সময় দিতে পারলাম না।”
আলো মনে মনে বলে,”কে চেয়েছে আপনার সময়? আপনি কে’টে পরুন।”
ইলোরা নিজের পার্স ব্যাগ থেকে একটা স্বর্নের চেইন বের করে। আলো কিছু বুঝতে পারছে না। সামিন গিয়ে আলোর পেছনে দাঁড়ায়। ইলোরা আলোকে চেইনটা পরিয়ে দিতে দিতে বলে,”বৌ দেখা উপহার। যদিও তোমাকে আমার পছন্দ হয়নি খুব একটা। তবুও নাতীর মুখের দিকে তাকিয়ে দিলাম।”
আলো ইলোরার দিকে তাকিয়ে আছে। ইলোরা বাড়ির সবার থেকে বিদায় নিয়ে সামিনের দিকে তাকায়। তারপর বলে,”শি’ক’ল পরানোর বিষয়টা মাথায় রাখিস সামিন। সময় থাকতে শি’ক’ল পরিয়ে দে। ওটাতেই কাজ হবে।”
আলো কিছু না বুঝে একবার সামিন আর একবার ইলোরার দিকে তাকায়। সামিন হেসে ইলোরাকে বলে,”সে দেখা যাবে। তুমি চাপ নিও না দাদী।”
ইলোরা কে বিদায় জানিয়ে ঘুরে দাড়াতেই দেখে আলো তার দিকে তাকিয়ে আছে। গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”কাকে শি’ক’ল পরানোর কথা বলছিলো আপনার দাদী?”
সামিন থতমত খেয়ে যায়,বলে,”সেটা আমার এবং দাদীর কথা তুমি নাক গলাচ্ছো কেন?”
_আপনাদের বংশের মেয়ে গুলোও আপনাদের থেকে কম না কোনো অংশে। কথাবার্তা, চালচলন সব ক্রি’মি’না’ল’দে’র মতো।
_ইশিতাও কি সেরকম?
সামিন আলোকে প্রশ্নটা করে সরাসরি আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। আলো নরম গলায় বলে,”না। ইশিতা আপু ওরকম না। ঐ একজনই ব্যাতিক্রম।”
_আমার ছোটো ভাই ইশমামও ব্যাতিক্রম। এসব পলিটিক্স, মা’র’পি’ট,গু’ণ্ডা’মি থেকে সবসময় দূরে থাকে। ওর সাথে মিশলে বুঝতে কি চমৎকার একটি ছেলে।
আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে থেকে সামিনের কথাটা শোনে। সে আর কোনো কথা বাড়ায় না।
***
দুপুরে সবাই একসাথে খাবার টেবিলে খেতে বসেছে। ইমতিয়াজ মির্জা বাদে টেবিলে বাড়ির সবাই রয়েছে অথচ পুরো ডাইনিং রুম জুড়ে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করছে। কিছুক্ষণ পরপর শুধু চামচের ঠো’কা’ঠু’কি’র শব্দ শোনা যাচ্ছে। কিছু সময় পরে ইলহাম সামিনের সাথে বাড়ির ব্যাবসার আলাপ জুড়ে দেয়। ইশমামকেও সে শুনতে তাগাদা দেয় কিন্তু ইশমাম কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। রিতু কয়েক লোকমা খেয়ে প্লেট সরিয়ে রাখে। তার একেবারেই খেতে ইচ্ছে করছে না,খুব ব’মি পাচ্ছে। আলো একপলক রিতুকে দেখে না চাইতেও নিচু স্বরে বলে ফেলে,”তোমার কি কোনো সমস্যা হচ্ছে?”
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে রিতুর দিকে তাকায়। ইলহাম তাকিয়ে থাকে রিতুর দিকে। রিতু আলোকে বলে,”না ভাবী,মাথা ঘুরছে শুধু।”
কথাটা শেষ করতে পারে না রিতু,ভি’ড়’মি খেয়ে পরে যেতে নিলে আলো খপ করে রিতুকে ধরে।
এমন সময় কলিংবেল বেজে ওঠে। ফুলির মা গিয়ে দরজা খুলে দেয়। পরী হাসি হাসি মুখ করে বলে,”কোথায় বাড়ির সবাই?”
_খাচ্ছে পরী আপা, ডাইনিং রুমে যাও।
পরী হেটে ডাইনিং রুমে গিয়ে দাঁড়ায়। তার হাতে একটা ফাইল। সামিন মাথা ঘুরিয়ে পরীকে দেখে বলে,”ডাক্তার আপা হঠাৎ এলি যে।”
পরী মুচকি হেসে বলে,”আজ মেজো ভাইয়ার কাছে এসেছি। মিষ্টি খেতে।”
ইলহাম অবাক হয়ে বলে,”আমার কাছে? কি হয়েছে?”
_ভাবীর টে’স্টের রিপোর্ট নিয়ে এসেছি। ইহানের ছোটো ভাই-বোন আসতে চলেছে ভাইয়া।
ইলহাম থমথমে মুখ নিয়ে রিতুর দিকে তাকায়। রিতু তার স্বামীর দিকেই তাকিয়ে আছে।
সামিন কিছুক্ষণ পর মৃদু হেসে বলে ওঠে,”ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নাও রিতু।”
ইশিতা এবং ইশমাম ইলহামের দিকে তাকিয়ে বলে,”কংগ্রাচুলেশন ভাইয়া।”
ইলহাম শুকনো একটা হাসি দিয়ে প্লেটে হাত ধুয়ে উঠে পরে। ইশিতা পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,”খাম্বার মতো দাঁড়িয়ে আছিস কেনো? খেতে বস!”
পরী একটা মুচকি হাসি দিয়ে ইশমামের দিকে একপলক তাকিয়ে ইশিতাকে বলে,”না আপু। পরে।”
***
দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ইলহাম রিতুর দিকে তাকায়। রিতু বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসে আছে। মাথাটা নিচু করে রেখেছে সে। ইলহাম এগিয়ে যায়। গিয়ে বিছানার একপাশে বসে। রিতু মাথা তুলে ইলহামের দিকে তাকিয়ে বলে,”আপনার সন্তান। আপনার যেটা ইচ্ছে হয় করতে পারেন। আমার কোনো মতামত নেই।”
ইলহাম রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”ওষুধ ঠিক ঠাক মত খাওনি কেনো?”
অনেকটা চ’ড়া গলায় বলে ইলহাম। রিতু ছলোছলো চোখে ইলহামের দিকে তাকিয়ে বলে,”এক বছর পরে যখন তা’লা’ক দিয়ে দেবেন তখন বৌয়ের কাছে আসার কি দরকার ছিলো? বৌয়ের কাছ থেকে যা পান তা তো আপনার ঐ র’ক্ষি’তা’ই আপনাকে দেয়। গাছেরও খাবেন তলারও কুড়াবেন তাই না!”
_শাট আপ রিতু। একেবারে তেজী গলায় কথা বলবে না। মেয়েদের তেজী গলায় কথা আমি পছন্দ করি না জানো তুমি।
_সেটা বৌয়ের বেলায় শুধু, র’ক্ষি’তা’র বেলায় ঠিকই পছন্দ করেন । ওসবই ভালো লাগে আপনার।
ইলহাম চোখ রাঙিয়ে রিতুর দিকে তাকিয়ে আছে,বলে,”গলায় বেশ জোর এসেছে দেখছি। এসব কে শেখাচ্ছে তোমায়? তোমার বড় জা? ঐ বে’য়া’দ’ব মেয়েটা?”
রিতু তার জবাব না দিয়ে বলে,
_আপনার সন্তানকে আপনি চাইলে মে’রে ফেলতে পারেন । আপনি চাইলে ইহানকেও মে’রে ফেলুন। এমনিতেও ওরা আপনার ভালোবাসায় হয়নি। ওরা আপনার ভো’গ এবং আমার অসহায়ত্বের ফসল। ওদের মে’রে দিন, তারপর আমাকে তা’লা’ক দিয়ে আপনার র’ক্ষি’তা’কে হালাল বানিয়ে সংসার করতে একটুও অসুবিধে হবে না ইলহাম মির্জা!
রিতুর কন্ঠে কিছু একটা ছিলো। ইলহাম রিতুর দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে শার্ট পাল্টে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।
***
“কিহ! রিতু প্রে’গ’ন্যা’ন্ট!”
চেঁচিয়ে ওঠে জুই। ইলহাম বলে,”হু। আজ রিপোর্ট হাতে এসেছে।”
_এটা ওর চাল ইলহাম। এইসব গ্রামের মেয়েদের আমার ভালো করে জানা আছে, যেই বুঝতে পেরেছে তুমি ওকে ছে’ড়ে দিতে পারো অমনি আরেকটা বাচ্চা নিয়ে ফেলেছে। চাল’বাজ মেয়ে কোথাকার!
_শাট আপ জুই। চাল’বাজ বলবে না,রিতু খুবই সহজ সরল একটি মেয়ে।
জুই ইলহামের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে ওঠে,”বৌয়ের নামে আজকাল কিছু বললেই ধ’ম’কে উঠছো দেখছি! ভালোবাসা জন্মে গিয়েছে নাকি?”
ইলহাম কিছু বলে না। জুই ইলহামের কাছে এগিয়ে এসে দাঁতে দাঁত চে’পে বলে,”সাফ সাফ বলো, তুমি আমাকে চাও কি চাওনা।”
_চাই।
একশব্দে বলে ইলহাম। জুই বলে,”ঠিকাছে। তাহলে ওর এ’ব’র’শ’ন করাও। আমি দুইটা বাচ্চা পালতে পারবো না।”
ইলহাম জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”আমার বাচ্চা আমি মে’রে ফেলবো? তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছো?”
_তাহলে কি করতে চাও? শোন ইলহাম,হয় আমায় ছে’ড়ে দেবে নয়তো বাচ্চা এ’ব’র’শ’ন করাবে। তোমার কাছে দুটো অপশন। তিনবছর ধরে আমি অপেক্ষা করছি। বলেছিলে ইহান একটু বড় হলে রিতুকে ছেড়ে দেবে। এখন আরেকটা ঝামেলা তৈরি করে বসে আছো,যত্তসব!
ইলহাম চুপচাপ বসে আছে। সে বুঝতে পারছে না সে কি করবে। ম’রে গেলেও সে নিজের বাচ্চা মে’রে ফেলতে পারবে না, এতটা হৃদয়হীন সে নয়, অন্যদিকে জুঁইকে ছেড়ে দিতে হবে। এখন ইলহাম কি করবে কিছুই বুঝতে পারছে না!
***
রিতু কাঁ’দ’ছে। একটু পর পর শরীরটা কাঁপছে তার। আলো দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছে। এই মেয়েটা এভাবে কাঁ’দ’ছে কেন! এতো বড় সুসংবাদ পেয়েও কাঁ’দ’ছে কেন মেয়েটা!
সামিন নিজের বিছানায় গা এলিয়ে শুয়েছিলো। আলোকে দেখে দ্রুত উঠে বসে, তারপর বলে,”সরি! আমি উঠছি, তুমি বিশ্রাম নাও।”
আলো তার উত্তর না দিয়ে বলে,”আপনার ভাইয়ের বৌ কাঁদছে। আপনার চরিত্রবান ভাই একটা প্রে’গ’ন্যা’ন্ট মেয়েকে কষ্ট দিতে পর্যন্ত ছাড়ছে না। এখন আপনি কি বলবেন ইয়াসার মির্জা?”
সামিন হা হয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,”রিতু কাঁদছে?”
_হু।
_কেন?
_আপনার ভাই তার এ’ব’র’শ’ন করাবে। তাকে একবছর রেখে তালাক দিয়ে পর’কীয়া প্রেমিকাকে বিয়ে করবে আপনার ভাই।
তেজী কন্ঠে আলো বলতে থাকে। সামিন বিছানা থেকে নেমে দ্রুত পায়ে হেঁটে ইলহামের ঘরের দিকে যায়।
রিতুকে ইশিতা ধরে রেখেছে। হুট করে সামিন ঘরে ঢুকে পরতেই রিতু চোখের পানি মুছতে ব্যাস্ত হয়ে পরে।
সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে,”মেয়েটি কে?”
রিতু চুপ করে থাকে। সামিন ধ’ম’ক দিয়ে বলে,”মেয়েটি কে রিতু!”
_এমপির ভাগ্নি। জুই।
কাঁপা কাঁপা গলায় বলে রিতু।
_আমার সাথে শুরুতেই তোমার বলা উচিত ছিলো রিতু।
আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”ভাইকে অ’ন্ধে’র মতো বিশ্বাস করা মানুষ কি করতো? রিতুকেই চুপ করিয়ে রাখতেন।”
সামিন আলোর দিকে একপলক তাকিয়ে ফোন বের করে ইলহামকে ফোন লাগায়। ওপাশ থেকে ইলহাম ফোনটা রিসিভ করতেই সামিন বলে ওঠে,”কোথায় তুই?”
ইলহাম আমতা আমতা করে বলে,”একটা কাজে এসেছি ভাইয়া। কেনো?”
_তুই যেখানেই থাকিস আগামী এক ঘন্টার মধ্যে আমার সামনে আসবি ইলহাম।
ইলহাম অবাক হয়ে বলে,”কেনো ভাইয়া?”
সামিন সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে ফোন কেটে দেয়। তারপর রিতুকে বলে,”এখানে বিশ্রাম করবে তুমি। ওদিকে যাই হয়ে যাক বের হবে না।”
***
ইলহাম চিন্তিত ভঙ্গিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। গাড়ি শান্তিনীড়ের ভেতরে প্রবেশ করলে গাড়ি থামিয়ে সে নেমে পরে। হেটে লিভিং রুম পেরিয়ে সোজা দোতলার সিঁড়ির দিকে যায়। দোতলার লিভিং রুমে সামিন দাঁড়িয়ে আছে। খানিকটা দূরে আলো এবং ইশিতা দাঁড়িয়ে। তাদের পাশেই ইশমাম।
ইলহাম এগিয়ে গিয়ে বলে,”ভাইয়া কি হয়েছে…..”
সামিন কিছু না বলে স্ব-শব্দে ইলহামের গালে এক চ’ড় বসিয়ে দেয়।
সবাই চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ইমতিয়াজ মির্জা নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে আসে।
ইলহাম হতভম্ব ভাব নিয়ে বলে,”তুমি আমাকে মা’র’লে ভাইয়া?”
_জুইয়ের সাথে কি তোর?
ইলহামের মুখ শুকিয়ে যায় জুঁইয়ের নাম শুনে।
সামিন চেঁচাতে থাকে,”বলছিস না কেনো? জুঁইয়ের সাথে কি?”
_কিছু না ভাইয়া।
_কিছু না?
_না।
সামিন পুনরায় একটা চ’ড় বসিয়ে দেয় ইলহামের গালে। ইলহাম চেঁচিয়ে বলতে থাকে,”তুমি আমাকে সন্দেহ করে আমার গায়ে হাত তুলছো? তাও আমার ছোটো ভাই বোনের সামনে? তোমার বৌয়ের সামনে?”
_হ্যা তুলছি। তুই যা করেছিস তাতে এটাই তোর উপযুক্ত শা’স্তি।
ইলহাম আলোর দিকে একপলক তাকিয়ে ভাইকে বলে,”কে দিচ্ছে তোমায় এসব বুদ্ধি? ওই মেয়েটা তাই না? আসার সাথে সাথে ভাইয়ে ভাইয়ে সম্পর্ক ন’ষ্ট করে দেওয়ার ফ’ন্দি এঁটেছে।”
সামিন ইলহামের কলার ধরে বলে,”ও তোর ভাবী। সম্মান দিয়ে কথা বলবি।”
আলো সামিনের দিকে তাকায়। ইশমামও ভাইকে দেখে।
ইলহাম ভাইয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ম্লান হাসে। তারপর নিজের কলার থেকে ভাইয়ের হাত ছাড়িয়ে দিতে দিতে বলে,”জুঁইয়ের সাথে আমার সম্পর্ক আছে। এবং আমি তাকে বিয়ে করবো।”
চেঁচিয়ে বলতে থাকে ইলহাম। নিজের ঘর থেকে ইলহামের সব কথা শুনছে রিতু। তার দু’চোখ বেয়ে অঝোর ধারায় পানি গড়িয়ে পরছে।
সামিন একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে ইলহামকে ধা’ক্কা দিয়ে বলে,”বের হ এবাড়ি থেকে। এক্ষুনি!”
ইলহাম ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”ভাইয়া!”
_আর কখনো যেনো আমি তোকে এই বাড়ির ত্রিসীমানায় না দেখি। এক্ষুনি বের হ।
ধা’ক্কা’তে ধা’ক্কা’তে ইলহামকে দোতলার সিঁড়ির কাছে নিয়ে আসে সামিন।
ইলহাম কন্ঠে তেজ নিয়ে বলে,”তুমি কে বের করার আমাকে?”
সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”আমিই সব। তুই বের হ ইলহাম।”
“তুমি আমার বাবাকে মা’র’ছো কেনো বড় বাবা? বাড়ি থেকে কেনো চলে যেতে বলছো?”
ইহান দূরে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে সামিনের দিকে। সামিন এগিয়ে গিয়ে ইহানকে কোলে তুলে নেয়। তারপর নরম গলায় বলে,”তুমি তোমার ফুপির কাছে যাও বাবা। এখানে বড়রা কথা বলছে।”
সামিন ইশিতার দিকে তাকাতেই ইশিতা এসে ইহানকে নিয়ে চলে যায়।
সামিন অগ্নি’দৃষ্টি দেয় ইলহামের দিকে। ইলহাম একপলক ইমতিয়াজ মির্জার দিকে তাকায় তারপর সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”কি ভেবেছো তোমরা? তোমরা ছাড়া আমি অচল? আমার কোনো মুরোদ নেই? থাকবো না এই বাড়িতে আমি। সবসময় তোমার কথা শুনে চলতে হবে ভাইয়া? আমি কাউকে ভ’য় পাই না। থাকবো না এই বাড়িতে।”
ইলহাম হনহন করে সিঁড়ি ভে’ঙে নিচে নামে। সামিন তার যায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। একটু পরে ইলহামের গাড়ি স্টার্ট হবার শব্দ শোনা যায়। সামিন সোজা নিজের ঘরে চলে যায়। ইমতিয়াজ মির্জা তার ঘরে ঢোকে।
***
শান্তিনীড়ের পরিবেশ এখন থমথমে হয়ে আছে। রিতু নিজের ঘরে শুয়ে আছে চুপচাপ। কাঁদতে কাঁদতে শরীরটা তার নি’স্তে’জ হয়ে গিয়েছে। ইহান তার ফুপির কাছে। সামিন নিজের ঘরে ল্যাপটপে কিছু কাজ করছিলো। মেজাজ যথেষ্ট বি’গ’ড়ে রয়েছে তার। এখন অফিসের একাউন্ট্যান্টসকে মেসেজ করে দিচ্ছে ইলহামকে যাতে কেউ কোন টাকা না দেয়। কিছুক্ষণ পরে ল্যাপটপ বন্ধ করে বারান্দার দিকে তাকায় সে। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পরতে শুরু করেছে বাইরে। বারান্দায় আলোর শাড়িটা মেলে দেয়া ছিলো। শুকনো শাড়িটা এভাবে ভিজে যাবে দেখে সামিন এদিক ওদিক তাকায়। ঘরে আলো নেই। ল্যাপটপ সরিয়ে রেখে সে নিজেই উঠে পরে বারান্দায় যায় শাড়িটা তুলে নিতে। শাড়িটা দ্রুত তুলে নিতে গিয়ে হঠাৎ খেয়াল করলো কিছু একটা নিচে পরে গিয়েছে। সামিন নিচে তাকাতেই তার চোখ মুখ ফ্যা’কা’শে হয়ে যায় লজ্জায়। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পরছে,তার ভেতরেও কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার। বোকার মতো মেয়েদের জিনিসে হাত দেয়া তার উচিত হয়নি এভাবে। কিন্তু সে কিভাবে জানবে মেয়েরা শাড়ির নিচে তাদের ব্যাক্তিগত পোশাক শুকাতে দেয়। নিচে পরে থাকা বস্তুটার দিক থেকে চোখ সরিয়ে শাড়িটা জায়গামতো রেখে দেয়। যার জিনিস সে এসে নিয়ে যাবে। ভিজুক।
সামিন শাড়িটা দড়িতে রেখে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে বারান্দার দরজার কাছে দাড়িয়ে আলো তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখে মুখে ক্ষো’ভ। সামিন একটা ঢোক গিলে ফেলে। তার ৬ষ্ঠ ইন্দ্রীয় বলছে এক্ষুনি যু’দ্ধ লেগে যাবে।
হয়েছেও তাই। খুড়িয়ে খুড়িয়ে আলো এসে তার জিনিসপত্র তুলে নিয়ে সামিনের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে,”অ’স’ভ্য, অ’ভ’দ্র, জ’ঘ’ন্য,ফা’ল’তু লোক। কোন সাহসে আপনি আমার পোশাকে হাত দিয়েছেন। নূন্যতম কমনসেন্স নেই?”
সামিনের লজ্জার সীমা রইলো না। কেন যে সে আগ বাড়িয়ে শাড়িটা তুলতে এলো।
সে আলোকে সরি বলতে যাবে তার আগেই আলো তার দিকে এগিয়ে এসে তার বুকে এলোপাথাড়ি কি’ল ঘু’ষি মে’রে চেঁচাতে থাকে,”অ’স’ভ্য লোক,কোন সাহসে আমার জিনিসে হাত দিয়েছেন। জ’ঘ’ন্য লোক কোথাকার। ফা’ল’তু লোক!”
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে আছে। ভীষণ ক্ষে’পে গিয়েছে মেয়েটা। সে নরম গলায় বলে,”মারছো কেনো আমাকে আলো। আমি বুঝতে পারিনি। দেখছিলাম তোমার শাড়িটা ভিজে যাচ্ছে তাই…..”
আলো সামিনের কোনো কথা শোনে না। একটা ধাক্কা দিয়ে সে নিজের পোশাক নিয়ে ঘরের ভেতর চলে যায়। রা’গে তার গা কাঁপছে।
সামিন বোকার মতো এদিক ওদিক তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠে,”আমার দোষ টা কোথায়?”
আলো তার পোশাক আলমারিতে তুলে রেখে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। সামিন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে,”যুগে যুগে ভদ্রলোকেরাই দোষের ভাগীদার হয়েছে। এটা আবারো প্রমানিত!”
হঠাৎ তার ফোন বেজে ওঠে। ফোনের স্ক্রিনে ফুয়াদের নাম্বার দেখে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে, ফুয়াদ বলে,”একবার বটতলা আসবি? আড্ডা দিতাম। কি করছিস তুই?”
_বৌয়ের হাতে মা’র খেলাম।
_মানে?
_মানে এতদিন সবকিছু গালাগাল পর্যন্ত ছিলো,আজ গায়ে হাত তুললো। উপকার করতে গিয়ে আজ এত্তোবড় একটা বাঁশ খেয়েছি।
চলমান…….
#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_২৫
#Esrat_Ety
ইলহামকে দেখে দরজা থেকে জুঁই সরে দাঁড়ায়। ইলহাম ক্লান্ত ভঙ্গিতে ভেতরে ঢোকে। তার মাথাটা ভীষণ ধরেছে। সোজা গিয়ে জুঁইয়ের বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে পরে সে। জুঁই দরজা বন্ধ করে ইলহামের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলে,”গিয়ে আবার ফিরে এলে যে, কি হয়েছে বাড়িতে, তোমার ভাই কেনো ডেকেছিলো?”
_বাড়ি থেকে লা’থি মে’রে বের করতে ডেকেছিল।
নিচু স্বরে বলে ওঠে ইলহাম।
জুই বিছানার একপাশে বসে চাপা স্বরে চেঁচিয়ে বলে ওঠে,”হোয়াট!”
_বের করে দিয়েছে বাড়ি থেকে।
জুঁইয়ের মুখে হাসি ফোটে। সে নিজের খুশি প্রকাশ না করে বলে,”দিক। যেয়ো না আর ও বাড়িতে! তোমার সম্পত্তি তুমি বুঝে নিয়ে ওদের সাথে সম্পর্ক শেষ করে দাও।”
ইলহাম চিৎ হয়ে শুয়ে জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে বলে,”সম্পত্তি? কিচ্ছু পাবো না আমি,ভাইয়া সাফ সাফ জানিয়ে দিয়েছে।”
জুই যেন আকাশ থেকে পরলো। হতবাক হয়ে বলে,”মানে টা কি?”
ইলহাম জুঁইয়ের কথার উত্তর না দিয়ে কন্ঠে এক রাশ হতাশা নিয়ে বলে ওঠে,”ইহানের জন্য কষ্ট হচ্ছে খুব। ওর কথা মনে পরছে। রাগের মাথায় বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি,এখন যাবো কি যাবো না ভাবছি।”
জুই প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে যায়। সে তার বিরক্তি প্রকাশ না করে বলে,”এখন? তোমাকে বলেছে সম্পত্তি দেবে না আর তুমি মেনে নিলে? অদ্ভুত!”
ইলহাম উঠে বসে, জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে বিরক্ত ভঙ্গিতে বলে,”আমি আমার ছেলেটার জন্য কষ্ট পাচ্ছি আর তুমি সম্পত্তি নিয়ে পরে আছো? আচ্ছা একটা কথা বলো তো জুঁই আমাকে নাকি আমার সম্পত্তিকে,কোনটাকে তুমি বেশি প্রায়োরিটি দাও?”
জুই থতমত খেয়ে বলে,”অবশ্যই তোমাকে। আমি তো তোমার ভালোর জন্য বলছিলাম।”
_আমাকে যদি প্রায়োরিটি দিতেই তাহলে আমার সন্তানকেও প্রায়োরিটি দিতে, তোমার কন্ঠে সবসময় ইহানের জন্য তুচ্ছ তাচ্ছিল্য দেখি। এসব আমি বরদাস্ত করবো না জুঁই।
জুই নরম সুরে বলে,”তুমি ভুল ভাবছো ইলহাম। আই এ্যাম সরি।”
ইলহাম বলে,”ঠিকাছে, আমার মাথাটা বেশ ব্যাথা করছে। চুল গুলো একটু টেনে দাও মাথার। কপাল টা একটু মাসাজ করে দাও।”
জুই একবার নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে ইলহামের দিকে তাকিয়ে আহ্লাদী গলায় বলে,”আমি এই মাত্র নেইলপলিশ লাগিয়েছি ইলহাম। তোমাকে ওষুধ এনে দেই মাথা ব্যাথার?”
ইলহাম জুঁইয়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,”কিছু লাগবে না। তুমি আমার সামনে থেকে যাও!”
***
“বড় বাবা”
ইহানের ডাকে সামিন পিছু ফিরে তাকায়। ইহান তার কাছে এগিয়ে আসে। সামিন ইহানকে কোলে তুলে নিয়ে বলে,”কি হয়েছে বাবা?”
_বাবা কখন আসবে বড় বাবা? বাবাকে কেনো বের করে দিলে বাড়ি থেকে?
সামিন কিছুক্ষণ ইহানের দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর বলে,”তুমি যখন কোনো দুষ্টুমি করো তখন তোমার টিচার তোমাকে কিছু সময়ের জন্য ক্লাসরুমের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখে না ?”
ইহান মাথা নাড়ায়। সামিন বলে,”তোমার বাবাও একটু দুষ্টুমি করেছে তাই তাকে একটু খানি শা’স্তি দিয়েছি।”
_বাবা কি দু’ষ্টু’মি করেছে? কারো পেন নিয়ে নিয়েছে? কাউকে খুঁ’চি’য়ে’ছে?
সামিন মাসুম বাচ্চাটার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কি উত্তর দেবে? ইশিতা এসে দাঁড়ায় সেখানে। ইহানকে বলে,”চলো আমার ঘরে চলো। আমার কাছে ঘুমোবে আজ।”
_আমি মাম্মার কাছে ঘুমাবো।
সামিন ইহানের গালে হাত রেখে বলে,”মাম্মা অ’সু’স্থ সোনা। তুমি ফুপির সাথে যাও প্লিজ।”
ঘরে ঢুকে একটা দৃশ্য দেখে সামিন থ’ম’কে যায়। আলো জায়নামাজে বসে আছে।
সামিন দাঁড়িয়ে থাকে। সামনে যে দৃশ্যটি সে দেখছে এটা সম্ভবত তার দেখা সবচেয়ে সুন্দর এবং চক্ষুশীতল করা একটা দৃশ্য। মাকেও সে এভাবে জায়নামাজে বসে থাকতে দেখতো। মায়ের চুড়ি পরা হাতে যে মেয়েটি মোনাজাত ধরে আছে, তার হাত দুটো অবিকল সামিনের মায়ের মতো, গোলগাল। মনে হচ্ছে সামিনের মা হোসনে আরা শান্তিই মোনাজাত ধরে বসে আছে। মাথায় তার লম্বা একটা ঘোমটা।
দীর্ঘসময় সামিন আলোকে দেখতে থাকে। নামাজ শেষ হলে আলো জায়নামাজ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে জায়নামাজ ভাঁজ করে ঘুরে দাড়াতেই দেখে সামিন তার দিকে তাকিয়ে আছে।
“এতক্ষণ ধরে কি বলছিলে মোনাজাতে আছিয়া? ফে’রা’উ’নে’র মৃ’ত্যু কামনা করছিলে?”
আলো কয়েক মূহুর্ত সামিনের দিকে তাকিয়ে জায়নামাজ তুলে রাখতে যায়,সামিন হাত বাড়িয়ে আলোর পথ আটকে দেয়। আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”বলো না কি বলছিলে মোনাজাতে?”
“ভাইয়া আসবো?”
রিতু দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। সামিন রিতুর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বলে,”এসো।”
রিতু ধীরপায়ে হেটে ভেতরে ঢোকে। সামিন রিতুকে বলে,”ডাক্তার ডাকতে হবে তোমার জন্য?”
রিতু মাথা নাড়ায়। সামিন বলে,”ঠিকাছে। বসো এখানে । বলো কেনো এসেছো?”
রিতু একটা চেয়ারে বসে মাথা নিচু করে রেখেছে। সামিন বলে,”বলো কেনো এসেছো! কি হয়েছে রিতু?”
রিতু কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে,”ওনাকে বাড়িতে আনুন ভাইয়া।”
সামিন রিতুর দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,”না।”
রিতু আমতা আমতা করে বলে,”এভাবে তো ভাইয়া কোনো সমাধান হয় না, তাইনা?”
আলো বলে ওঠে,”এই যে মির্জা বাড়ির লক্ষী মেজো বৌমা। তোমাকে আল্লাহ তায়ালা কি দিয়ে গড়েছে একটু বলবে?”
রিতু আলোর দিকে একপলক তাকিয়ে মাথা নিচু করে বলে,”এভাবে কি আমার প্রতি ওনার ভালোবাসা জন্মে যাবে ভাইয়া? আপনি ওনাকে ডেকে আনুন। আমার ওনার প্রতি কোনো অভিযোগ নেই।”
সামিন রিতুর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। রিতু বলতে থাকে,”বাচ্চাটা জন্মালে আমি আপনাদের বাড়ির বংশধরদের আপনাদের হাতে তুলে দিয়ে চলে যাবো। আপনার ভাই স্বামী হিসেবে যেমন হোক না কেনো,সে বাবা হিসেবে অনন্য। তার প্রতি আমার কোনো রা’গ নেই।”
_বাজে না বকে যাও রিতু। তুমি বিশ্রাম নাও।
_ভাইয়া এতোটা বাধ্য থেকেও তার মনে যায়গা করে নিতে পারিনি,তার মানে আমি সত্যিই অযোগ্য। ওনাকে আপনি বাড়িতে ডাকুন। আমিই বাচ্চা জন্মালে চলে যাবো। তারপর উনি ওনার বাচ্চাদের নিয়ে পছন্দের নারীর সাথে সুখে থাকুক।
সামিন রিতুর দিকে তাকিয়ে বলে,”খুব স্বামীর ঘর ছাড়ার কথা বলছো যে, এসব নিজের বড় জায়ের বুদ্ধিতে করছো নাকি? তোমরা বুদ্ধি করে চলে যাচ্ছো সবাই?”
আলো সামিনের দিকে তাকায়। সামিন আলোকে শুনিয়ে শুনিয়ে রিতুকে বলে,”স্বামীর ঘর ছাড়াও কোনো সমাধান না। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্ক জন্ম জন্মান্তরের সম্পর্ক। স্বামী খা’রা’প হলে তাকে শুধরে নিতে হয়। নয়তো নারী কেনো বলা হয়েছে তোমাদের?”
আলোর ইচ্ছে করছে সামিনকে কঠিন কিছু কথা শুনিয়ে দিতে, কিন্তু সে চুপ থাকে। রিতু সামিনকে বলে,”কিভাবে শোধরাবো ভাইয়া? শোধরানোর হলে তো ইহানের জন্মের পরেই শুধরে যেতো।”
সামিন রিতুর মাথায় হাত রাখে,নরম গলায় বলে,”তুমি এই বাড়িতে আসার পর থেকে আমি জেনেছি আমার একটা বোন না, দুটো বোন। বোনের মতো সবসময় খেয়াল রেখেছো আমার। আমার ওপর ভরসা রাখো। আমি আমার বোনের সংসার এভাবে শেষ হতে দেবো না। ওকে না’কা’নি’চো’বা’নি খাইয়ে তবে এ বাড়িতে আনবো। একটু ভুগতে দাও। তোমার গুরুত্ব বুঝতে দাও। আর ঐ মেয়েরও ব্যাবস্থা করবো আমি। ভরসা করো তো আমায়? করো না?”
রিতু মাথা নাড়ায়। সামিন বলে,”গিয়ে রেস্ট নাও। যাও।”
রিতু চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়ায়। আলো রিতু আর সামিনকে দেখে। রিতুর প্রতি সামিনের অগাধ সহানুভূতিকে সে বিচার করতে পারছে না। কখনো মনে হচ্ছে সামিন হয়তো এমনই, আবার হুট করেই মনে পরে গেলো রিতু তার বংশের বংশোধর জন্ম দিয়েছে, শুধুমাত্র এই একটা কারনেই রিতুর প্রতি এতটা নরম ভাব দেখাচ্ছে সে! নয়তো ঐ লোকটা তো সামিন ইয়াসার, একটা পি’শা’চ।
রিতু চলে যেতেই সামিন ঘুরে আলোর দিকে তাকায়। আলো চোখ সরিয়ে নিয়ে বিছানায় ঘুমানোর প্রস্তুতি নেয়।
বিছানা থেকে একটা বালিশ তুলে নিয়ে ডিভানে রেখে আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”মশারী টাঙিয়ে নাও। খুব মশা পরছে। আশেপাশে সর্বত্র ডেঙ্গু।”
আলো একপলক সামিনের দিকে তাকিয়ে কপাল কুঁ’চ’কে বলে ওঠে,”শহরের মেয়র শহরে মশা নিধনের ওষুধ দেওয়ার ব্যাবস্থা না করে গু’ন্ডা’মি করে বেড়ায়, ওমুককে উচিত শিক্ষা দেয়, তমুকের থেকে প্র’তি’শো’ধ তোলে, ওমুকের মেয়েকে তুলে এনে বিয়ে করে, তমুকের জমি দখল করে বেড়ালে শহরে ডেঙ্গুর প্রকোপ তো বাড়বেই।”
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে কয়েক মূহুর্ত তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”মেয়র তার সব দায়িত্ব পালন করেছে। তারপরও জনগণের সচেতন থাকা জরুরি। মশারী না টাঙিয়ে সবটা মেয়রের ভরসায় ফেলে রাখলে তো চলে না। মেয়র কি বাড়ি বাড়ি গিয়ে জনগণের মশারী টাঙিয়ে দিয়ে আসবে এখন?”
আলো চুপ করে থাকে। সামিন আলমারি থেকে মশারী বের করে সেটা টাঙিয়ে দিতে যায়। আলো সামিনের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,”প্রয়োজন নেই। নিয়ে যান এটা এখান থেকে, আমি মশারীর ভেতরে ঘুমাতে পারি না।”
সামিন আলোর কথা না শুনে মশারী টাঙাতে থাকে। আলো সামিনের হাত থেকে মশারী টেনে নিয়ে নেয়, চেঁচিয়ে বলে,”বললাম না প্রয়োজন নেই?”
সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে মশারী টেনে নেয় । আলোও তেজ দেখিয়ে নিজের দিকে টানতে থাকে। এক পর্যায়ে সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”শক্তি দেখাচ্ছো? একটা তুলে আ’ছা’ড় মারবো অবাধ্য মেয়ে।”
_এসব যত্নবান স্বামী হবার নাটক করে আপনার প্রতি আমার অনুভূতি বদলাতে চান? আমি রিতুর মতো মেয়ে নই ইয়াসার মির্জা। কাজ হবে না।
সামিন কয়েক মুহূর্ত আলোর দিকে তাকিয়ে থেকে টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা কাঁচি নিয়ে এসে মশারীটাকে টুকরো টুকরো করে কে’টে ফেলে। আলো দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ দেখে। তারপর বিছানায় গিয়ে শুয়ে পরে। সামিন উঠে দাঁড়িয়ে গিয়ে ডিভানে উপুড় হয়ে শুয়ে পরে। রাগে তার কপালের দুপাশের রগ দপদপ করছে।
***
মাথাটা ছিঁ’ড়ে যাচ্ছে ইলহামের। জ্বর এসে গিয়েছে। বিকেল থেকে যখন মাথা ব্যথা করছিলো তখনই সে টের পেয়েছে জ্বর আসতে চলেছে। শরীরের সর্বত্র য’ন্ত্র’না করছে। একটু স্বস্তি পাচ্ছেনা সে। ইহানের সাথে কথা বলতে বেশ কয়েকবার ফোন করেছিলো ইশিতার কাছে। ইশিতা ফোন ধরেনি। বাড়ির কেউই ফোন ধরবে না সে জানে। বাধ্য হয়ে পোনা চাচার নাম্বারে ফোন করে জেনে নিয়েছে ইহানের খবর, রিতুর খবরও জানতে চেয়েছিলো। কেনো জানতে চেয়েছিলো তা ইলহাম বুঝতে পারছে না,রিতুর পেটে তার সন্তান শুধুমাত্র সেজন্যই কি?
ইলহাম সেদিনের কথা মনে করতে থাকে। বাবা মা জোর করে একটা গ্রামের সদ্য ক্লাস টেনে পড়ুয়া মেয়ের সাথে বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলো। মা বাবার ধারণা ছিলো সুন্দরী,নামাজী, অল্পবয়সী বৌ পেলে ব’খে যাওয়া ইলহাম শুধরে যাবে। কিন্তু লাভের লাভ কিছু হয়নি বরং একটা প্রানবন্ত ফুটফুটে ফুলে কালসিটে পরেছে তার মতো অ’মা’নু’ষে’র হাতে পরে। বিয়ের প্রথম দিন থেকে মাগনা গৃহপরিচারিকা এবং যৌ’ন’দা’সী হিসেবেই ট্রিট করে এসেছে মেয়েটিকে। কখনো উঁচু গলায় কথা বলে প্রতিবাদ পর্যন্ত করেনি মেয়েটি। পেটে ইলহামের দু- দুটো সন্তান ধরেও ফিরে যেতে হবে খালি হাতে, মাঝখানে স্বামীর ভালোবাসা কি সেটাই কখনো বুঝলো না।
কিছুক্ষণ এসব কথা ভেবে ইলহাম চোখ বন্ধ করে ফেলে। জ্বরের তী’ব্র’তা বাড়ছে। ইলহাম খেয়াল করেছে অসুখ বিসুখ হলেই সে ভীষণ অপরাধ বোধে ভুগতে থাকে। সুস্থ থাকলে অ’মা’নু’ষ হয়ে যায়। ক’ষ্ট দেয় একটা ফুলকে। জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করে বলে ওঠে,”জ্বর থাকুক। আজীবন থাকুক।”
মাথা ঘুরিয়ে সে তার পাশে ঘুমিয়ে থাকা জুঁইকে দেখে। একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে মৃদু স্বরে ডেকে ওঠে,”জুঁই।”
ঘুমের মধ্যে “হু” বলে সাড়া দেয়। ইলহাম বলে,”জ্ব’র টা একটু মেপে দেখবে?”
জুই উঠে বসে, চোখ ডলতে ডলতে উঠে গিয়ে থার্মোমিটার নিয়ে এসে ইলহামের কপালে ধরে। জ্বর একশো দুই।
ইলহাম কিছুক্ষণ জুঁইয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,”আমি বাড়ি যেতে চাই। এক্ষুনি। এই মুহূর্তে।”
***
গাড়ি থামিয়ে ইলহাম নেমে পরে। সে ঠিকমতো দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। মনে হচ্ছে এক্ষুনি পরে যাবে। রিয়াজ গেইট বন্ধ করে ছুটে এসে বলে,”আপনাকে ধরবো ভাইয়া?”
ইলহাম নিষেধ করে। কলিং বেল টিপে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। সিতারা এসে দরজা খুলে দেয়। রাত তিনটার সময় ইলহামকে দেখে সিতারা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। ইলহাম তাকে পাশ কাটিয়ে টলতে টলতে সিঁড়ির দিকে যায়। ফুলির মা এসে সিতারাকে ফিসফিসিয়ে বলে,”নে’শা করছে নাকি!”
_কি জানি!
_তাহলে আজ বড় ভাইজান একে মে’রে’ই ফেলবে।
দরজায় ঠক ঠক আওয়াজ হয়। রিতু ভাবলো ইশিতা হয়তো ইহানকে দিতে এসেছে। অসুস্থ শরীর নিয়ে বিছানা থেকে নেমে গিয়ে দরজার সিটকিনি খুলে দেয়। দরজা খুলে সে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। ইলহাম লাল দুটো চোখ নিয়ে রিতুর দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েক মুহূর্ত রিতু নিজের স্বামীর দিকে তাকিয়ে থেকে তার কপালে হাত ছোঁ’য়া’য়। ইলহাম তার স্ত্রীকে দেখতে থাকে। খুবই নিচু স্বরে রিতু বলে ওঠে,”আপনার গায়ে তো বেশ জ্ব’র।”
ইলহাম “হু” বলে ধীরপায়ে হেটে বিছানার দিকে যায়। তারপর ধপ করে বিছানায় উ’পু’ড় হয়ে শুয়ে পরে। রিতু এগিয়ে গিয়ে বলে,”ওষুধ খেয়েছেন? গা তো জ্ব’রে পু’ড়ে যাচ্ছে।”
ইলহাম কোনো উত্তর দেয়না। থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মেপে দেখে একশো তিনের একটু উপরে। এক্ষুনি জ্বর নামানো প্রয়োজন। রিতু প্রায় ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে দাঁড়িয়ে পরে, সামিনকে ডাকা যাবে না, ভাইয়া যদি ইলহামকে দেখে রেগে যায়! রিতু নিজেই একটা বাটিতে পানি এনে ইলহামের মাথায় জলপট্টি দিতে থাকে। ইলহাম চোখ পিটপিট করে রিতুর দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে বলে ওঠে,”দিও না এসব। প্রয়োজন নেই।”
রিতু ইলহামের কোনো কথার জবাব না দিয়ে চুপচাপ নিজের কাজ করতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে রিতু বলে ওঠে,”আপনার প্রেমিকা কেনো করে না এসব?”
_সে তো আর আমাকে বিয়ে করে,আমার বাচ্চা পেটে ধরে আটকে যায়নি তোমার মতো। তোমার মতো বেহায়া নয়।
রিতু ইলহামের দিকে তাকায়। ইলহাম নিচু স্বরে বলে,”ইহান কোথায়?”
রিতু বিছানা থেকে নামতে নামতে বলে,”আপুর ঘরে,আমি নিয়ে আসছি।”
ইলহাম রিতুর হাত টেনে ধরে। রিতু বসে পরে, ইলহামের দিকে তাকাতেই ইলহাম বলে,”দরকার নেই। তুমি দরজা বন্ধ করে এসো। আমি ঘুমাবো।”
ধীরে ধীরে নেমে রিতু দরজা বন্ধ করে ইলহামের পাশে গিয়ে বসে। ইলহাম কাঁপা কাঁপা একটা হাত রিতুর দিকে এগিয়ে দিয়ে তার পেটে হাত রাখে। রিতু চ’ম’কে উঠে তাকায় তার স্বামীর দিকে। ইলহাম নরম গলায় বলে,”আমি এই বাচ্চাটা চাই।”
_জানি। আপনি শুধু আমাকেই চান না।
ঠান্ডা গলায় বলে রিতু। তার কন্ঠে না ছিলো কোনো ক্ষো’ভ,না ছিল কোনো হতাশা।
ইলহাম কিছু না বলে একটা ম্লান হাসি হেসে দেয়। তারপর দু’চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে চুপচাপ।
***
ফ্রেশ হয়ে নিচে নামতেই ফুলির মায়ের কাছে ইলহামের বাড়িতে আসার খবর পেয়ে ক্ষে’পে যায় সামিন। রে’গে’মে’গে দোতলায় চলে গিয়ে দরজা ধাক্কাতে থাকে। কিছুক্ষণ পরে রিতু দরজা খুলে দিয়ে সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন বিছানায় শুয়ে থাকা ইলহামকে একবার দেখে রিতুকে ধ’ম’ক দিয়ে বলে,”কেনো ঢুকতে দিলে ওকে ঘরে? তোমাকে নিষেধ করেছিলাম না?”
পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকতে ঢুকতে বলে,”নে’শা করেছে নাকি বে’য়া’দ’ব টা।”
রিতু সামিনের হাত টেনে ধরে। সামিন রিতুর দিকে তাকায়। রিতু বলে,”ওনার গায়ে খুব জ্ব’র ভাইয়া। সারারাত ছ’ট’ফ’ট করেছে জ্বরে। এই মাত্র ঘুমিয়েছে। দয়া করে কিছু বলবেন না।”
***
দুপুর নাগাদ ইলহামকে হসপিটালে এডমিট করা হয়। জ্বরে অচেতন হয়ে গিয়েছিলো সে। রিতু এবং ইশিতা তার সাথে হসপিটালে আছে।
বিকেলের দিকে টেস্টে ধরা পরে ইলহাম ডেঙ্গু পজিটিভ। তাকে স্পেশাল কেয়ার ইউনিটে শিফট করা হয়। অবস্থা খুবই গু’রু’ত’র।
বাড়িতে এসে সামিন পুরো বাড়িতে অস্বাভাবিক নিস্তব্ধতা খেয়াল করে। ফুলির মা এবং সিতারাকে ডাকতে থাকে সে। কেউ কোনো সাড়া দেয়না। দোতলা থেকে ইশমাম নেমে আসে। সামিন ইশমামের দিকে তাকিয়ে বলে,”কোথায় যাচ্ছিস?”
_হসপিটালে। আমি গিয়ে ইশিতা আর ভাবীকে পাঠিয়ে দেবো। ভাবীও তো অসুস্থ।
_ফুলির মা আর সিতারা কোথায়?
_ফুলির বাবা অসুস্থ,তাই ফুলির মা চলে গিয়েছে। সিতারা নিজেই অসুস্থ। আমি দু’জনকে ছুটি দিয়েছি।
সামিন চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,”কি একটা মুশকিল হয়ে গেলো! ইহানকে কে সামলাবে! বাড়িতে কোনো মেয়ে মানুষ নেই!”
_কেনো, তোমার বৌ!
ঠান্ডা গলায় বলে ইশমাম। সামিন ম্লান হেসে বলে,”হু, তাহলে তো হতোই।”
ইশমাম বলে,”ইহানকে তোমার থেকে ভালো কেউ সামলাতে পারবে না ভাইয়া। ওকে তুমি দেখো। আমি যাচ্ছি। অসুবিধা হলে ফোন দেবো।”
ইশমাম চলে যায়। সামিন ধীরপায়ে হেটে ইমতিয়াজ মির্জার ঘরের কাছে দাঁড়িয়ে পরে। ঘরের ভেতর ইমতিয়াজ মির্জা ইহানকে বই পড়ে শোনাচ্ছে। সামিন তদের বিরক্ত না করে নিজের ঘরে চলে আসে। দরজার নব ঘোরার শব্দ হতেই আলো নড়েচড়ে বসে। সে একটা বই পড়ছিলো। সামিন ঘরে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে আলোর সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আলোর দিকে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বলে,”এটা নাও।”
আলো কপাল কুঁ’চ’কে প্যাকেটটার দিকে তাকিয়ে বলে,”কি এটা?”
_তোমার জন্য একটা ফোন। বাবা মায়ের সাথে কথা বলবে।
_আর মাত্র উনিশ দিন আছি এই বাড়িতে। উনিশ দিনের জন্য কোনো ফোনের দরকার নেই আমার।
সামিন আলোর দিকে শীতল দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে আছে। হঠাৎ করে প্রচন্ড রা’গ হচ্ছে আলোর উপরে। ঔদ্ধত্যের একটা সীমা থাকে! এই মেয়েটা দিনকে দিন সেটা ক্রস করে ফেলেছে। এত ক্ষমা চাইবার পরেও একটু নরম হবার নাম নেই।
সামিন ফোনটা বিছানার ওপর ফেলে রেখে আলোকে হতবাক করে দিয়ে আলোর হাত ধরে বলে,”চলো।”
আলো বলে,”কোথায়?”
_আগামী উনিশ দিন তো তুমি আমার বৌ? তো আগামী উনিশ দিন তুমি আমার সংসার সামলাবে।
_মানে?
হ’ত’ভ’ম্ব হয়ে যায় আলো। সামিন দাঁতে দাঁত চেপে বলে,”রান্না করবে। চলো রান্না ঘরে।”
আলো অবাক চোখে সামিনকে দেখছে। সামিন আলোকে টানতে টানতে নিচতলার রান্নাঘরে নিয়ে আসে। আলো অবাক চোখে শুধু সামিনকেই দেখছে। সামিন গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,”ফ্রিজে মাছ,মাংস, সবজি সব আছে। এমন কোনো রন্ধন সামগ্রী নেই যেটা এই রান্নাঘরে পাবে না। তুমি খুজে খুজে বের করে রান্না করবে। ইহানের জন্য সবজি দিয়ে খিচুড়ি, মুরগির মাংস, আমার বাবার জন্য অল্প মশলা পাতি দিয়ে একটা সবজি, তোমার এবং আমার দুজনের জন্য সাদা ভাত এবং যেকোনো একটা মাছ।”
আলো সামিনের দিকেই তাকিয়ে আছে। সামিন আলোর দিকে খানিকটা ঝুকে বলে,”তোমার হাতে সময় সাড়ে তিন ঘন্টা। প্রচুর সময়। কাজে লেগে পরো। আর হ্যা, যদি আজ এসব করতে না পারো তাহলে উনিশ দিন পর আমাকে ছেড়ে চলে যাওয়ার কথা ভুলে যাও। এমন ভাবে এই বাড়িতে আটকে দেবো কখনো যেতে পারবে না আমাকে ছে’ড়ে।”
সামিনের কন্ঠে কিছু একটা ছিলো। আলো ঘা’ব’ড়ে যায়। সামিন আলোর চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে যায় নিজের ঘরে।
আলো থম মে’রে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে,একবার চুলা, একবার ফ্রিজের দিকে তাকায়। তার মাথা ঘুরছে।
***
ঘরে ঢুকে দেয়ালে হাত দিয়ে চা’প’ড় মেরে বিছানার উপর গিয়ে বসে পরে সে। ধীরে ধীরে নিজের রা’গ’টা’কে নিয়ন্ত্রণ করে চুপচাপ বসে থাকে। দীর্ঘসময় পরে তার আলোর জন্য খারাপ লাগতে শুরু করে। এমন ব্যাবহার করাটা উচিত হয়নি। মেয়েটার এমনিতেই পায়ে চোট। কিন্তু কেন আলো এখনো এমন করছে ! এতটাই ঘৃন্য নাকি সামিন!
একটু নরম কেনো হচ্ছে না!
ফুয়াদের ফোন আসে। রিসিভ করবে না ভেবে আবার রিসিভ করে। ফুয়াদ ওপাশ থেকে বলে ওঠে,”ইলহামের কি অবস্থা?”
_স্পেশাল কেয়ার ইউনিটে শিফট করা হয়েছে।
_আচ্ছা আমি যাচ্ছি। তুই কি করছিস?
সামিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে এই মাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনা বিস্তারিত বলতে থাকে।
ফুয়াদ সবটা শুনে বলে,”আমি জানতাম। তুই সামিন ইয়াসার মির্জা। তোর ধৈর্য হবে না। নারীর মন পেতে সাধনা করবি তুই? তাহলে তো হলোই। তুই এইমাত্র যেটা করলি তাতে ওর মনে তোর জন্য অনূভুতি পরিবর্তন হওয়া তো দূরে থাক তোর প্রতি রা’গ আরো বাড়িয়ে দিয়েছিস। এখন গিয়ে সরি বলে নিয়ে আয়। যা।”
সামিন ফোন কে’টে কিছুক্ষণ থম মে’রে বসে থাকে। তারপর উঠে নিচে চলে যায়।
আলো বিরস মুখে খুন্তি নে’ড়ে পাতিলে মশলা কষাতে থাকে। মনে মনে যত ধরনের গা’লা’গা’ল রয়েছে সব সামিনকে দিয়েছে সে। মশলা কষানো হয়ে গেলে একটা প্যাকেট হাতে তুলে নেয়।
“কি মেশাচ্ছো ওটা?”
সামিন পেছন থেকে বলে। তার দৃষ্টি আলোর হাতের দিকে। আলো ঘুরে দাঁড়িয়ে সামিনের দিকে তাকায় তারপর তার হাতের প্যাকেটের দিকে তাকায়। সামিন বলে,”কি মেশাচ্ছিলে? বি’ষ জাতীয় কিছু?”
আলো থমথমে মুখ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন আলোর দিকে এগিয়ে এসে বলে,”মানুষ যদি গরু ছাগলের সাথেও বসবাস করে দীর্ঘদিন তাহলে তাদের প্রতি মায়া জন্মে মানুষের। আমার প্রতি তোমার জন্মালো না। এখন বি’ষ খাইয়ে মারতে চাইছো আমাকে? এ যুগের আছিয়া গুলো এতো নিষ্ঠুর কেনো!”
আলো চোখ তুলে সামিনের চোখে চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় বলে,”টেস্টিং সল্ট। তরকারির স্বাদ বাড়াতে দিচ্ছিলাম। আমার রান্নার হাত বাজে। খেতে পারতেন না কেউ।”
সামিন আলোর দিকে একপলক তাকিয়ে উচ্চশব্দে গা দুলিয়ে হাসতে থাকে। দীর্ঘ সময় পরে হাসি থামিয়ে বলে,”আই নো ওটা কি। তোমাকে ভ’ড়’কে দিতে মজা করছিলাম। তুমি ঘরে যাও, যাও এক্ষুনি। ফ্রিজে সব রান্না করা আছে। গরম করে নিলেই হয়ে যাবে।”
চলমান……