বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে পর্ব-২১+২২

0
574

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_২১
#Esrat_Ety

ডাক্তার রাসেল কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে থাকে সামিনের দিকে। তারপর হাসিহাসি মুখ করে বলে ওঠে,”এই শহরের মেয়র সামিন ইয়াসার! আমাকে চিনতে পেরেছো?”

সামিন রাসেলের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়,”রাসেল। ফার্স্ট বেঞ্চার। রোল নাম্বার ৩!”

রাসেল হেসে ফেলে, অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সামিনের সাথে কোলাকুলি করে। সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি ব্যাক বেঞ্চার হলেও তোমার স্মৃতিশক্তি প্র’খ’র সামিন। এত বছর পরেও মনে রেখেছো আমাকে!”

সামিন মৃদু হাসে। রাসেল আলোর দিকে তাকিয়ে সামিনকে বলে,”ওয়াইফ?”

সামিন মাথা নাড়ায়।

_হু বুঝলাম। রোগী কে হয়? শশুর?
_হ্যা রাসেল।

রাসেল একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”আই সি!

সামিন বলে,”ওনার এখন কি অবস্থা?”

_দেখো সামিন। ওনার আগে থেকেই ডা’য়া’বে’টি’স এবং হার্টের অসুখ ছিলো। অতএব ঝুঁ’কি’টা একটু বেশিই। আর তাছাড়া ওনারা এখানে আনতে অনেকটাই দেরী করে ফেলেছে। এটা মাইল্ড স্ট্রো’ক না, মস্তিষ্কে র’ক্ত’ক্ষ’র’ণ হয়েছে। সা’র্জা’রি ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

সামিন আলোর মুখের দিকে তাকায়। আলো বোকার মতো ডাক্তার রাসেলের দিকে তাকিয়ে আছে। এগিয়ে এসে কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”তাহলে! করছেন না কেনো অ’পা’রে’শ’ন! করুন।”

_ভাবী সার্জারি তো মুখের কথা নয়। আর তাছাড়া….

_এ দেশে হবে না? বলো!

রাসেল সামিনের দিকে তাকায়,
_হবে! কিন্তু অনেক রি’স্কি। অন্যদিকে বেশি দেরী করাও যাবে না। আমাদের কিছু একটা করতে হবে। যদি তোমরা রাজি থাকো।

_আপনি অ’পা’রে’শ’ন করুন।‌ প্লিজ।
আলো হা’ত’জো’ড় করে বলে ওঠে।
_আপনাদের সৌভাগ্য নাকি জানি না তবে আজকেই ডাক্তার আদনান রুহানি এসেছে। যদি ব’ন্ডে সই করে দেন তাহলে আমরা এগোতে পারি!

আলো কেঁ’পে ওঠে কথাটা শুনে। ভীত কন্ঠে বলে,”বন্ডে কেন সই করতে হবে!”

রাসেল নিচু স্বরে বলে,”বললাম না অনেক রি’স্কি! কিছু একটা হয়ে গেলে!”

রেহেনা আ’র্ত’না’দ করে ওঠে। আজান মাকে আগলে নেয়। আলো গলায় জমে থাকা কান্নাটা গিলে ফেলে একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”ঠিকাছে। কোনো অসুবিধা নেই।”

_আর একটা বিষয়। অপারেশনটা খুবই ব্যয়বহুল …..

_তুমি এসব নিয়ে ভেবো না রাসেল…..আমি আছি!

সামিন কথাটি বলার সাথে সাথে আলো চেঁচিয়ে ওঠে,”নাহ!”

সামিন এবং রাসেল তার মুখের দিকে তাকায়। আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,”প্রয়োজন নেই। একেবারেই প্রয়োজন নেই ইয়াসার মির্জা!”

_শা’ট আ’প আলো। হাজার টাকার বিষয় না এটা।

আলো সামিনের দিকে এগিয়ে যায়,তেজী কন্ঠে বলে ,”আপনি ভাবলেন কি করে আমি আপনার টাকায় আমার আব্বুর অ’পা’রে’শ’ন করাবো!”

রাসেল একবার সামিন একবার আলোর দিকে তাকায়। সামিন আলোকে বলে,”কি করবে তুমি?”

_আমাদের যেটুকু আছে সেটাই যথেষ্ট। আপনার মতো ক্রি’মি’না’লে’র টাকায় আমার আব্বুর জীবন বাঁচলে অমন জীবনের দরকার নেই!
চোখের পানি মুছে রেহেনার দিকে তাকিয়ে বলে,”আমি আব্বুর সেভিংস থেকে টাকা তুলতে চাই আম্মু। নমিনি তো তুমি! কিন্তু মনে হচ্ছে বেশ দেরী হবে তাতে, তুমি আমার বিয়ের জন্য যে গয়না গুলো গ’ড়ে’ছি’লে ওগুলো বিক্রি করতে চাচ্ছি। আজ রাতের মধ্যে!”

সামিন কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে আলোর হাত ধরে টানতে টানতে ওয়েটিং রুমের পেছনের দিকটায় নিয়ে যায়। দেয়ালের সাথে ঠে’সে ধরে ধ’ম’কে’র সুরে বলে ওঠে,”বেশি বুঝবে না আলো। তুমি ঠিক নেই। আমাকে সামলাতে দাও সবটা।”

আলো সামিনকে ধাক্কা দিয়ে বলে,”কেনো? কে হন আপনি আমাদের?”

_কেউ না। একজন অ’প’রা’ধী আমি। একজন দোষী। ধরে নাও এই সবটা আমার ভুলের মা’শু’ল।

আলো তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে,”ভুলের মা’শু’ল চাইনা আমি। আপনার অন্যায়ের শা’স্তি ছাড়া আমি কিছুই চাই না! দরকার নেই এসবের! যান এখান থেকে!”

এমন সময় হন্তদন্ত হয়ে ইশমাম এসে দাড়িয়ে পরে সেখানে। তার পিছনে ইশিতা। ইশমাম আলো আর সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,”ভাইয়া!”

সামিন ওদের দিকে তাকায়। ইশিতাকে দেখতে পেয়ে বলে,”ইশু এই অর্ধ উ’ন্মা’দ মেয়েটিকে ধরে রাখ। আমার কিছু কাজ আছে। আতাউর আলমের সা’র্জা’রি হবে।”

আলো চেঁচাতে থাকে,”সব যায়গায় নিজের ক্ষমতার জো’র, গায়ের জো’র,অর্থের জো’র দেখাবেন না ইয়াসার মির্জা।”

ইশমাম বলে ওঠে,”অদ্রি……..”

তারপর কথাটা ফিরিয়ে নিয়ে নিজেকে সামলে নিয়ে বলে,”ভাবী, আপনি শান্ত হোন! এখন মাথা ঠান্ডা রাখার সময়!”

আলো এক পলক ইশমামের দিকে তাকিয়ে ছুটে চলে যায় রেহেনার কাছে। সামিন কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে ডাক্তার রাসেলের কাছে চলে যায়।

***
“ভাবী!”
ইশিতা হুট করে কি মনে করে আলোকে ভাবী ডেকে ফেলে। আলো রেহেনাকে আগলে ধরে বসে ছিলো। মাথা তুলে ইশিতার দিকে তাকায়। আজান আয়াত দূরের একটা বেঞ্চিতে মাথা নিচু করে বসে আছে।
ইশিতা আলোর পাশে বসে রেহেনার দিকে তাকিয়ে বলে,”আন্টির শরীরটা খুব খা’রা’প সম্ভবত। হসপিটালের পাশেই আমার এক ফ্রেন্ডের বাসা। তুমি চাইলে আমি আন্টিকে সেখানে নিয়ে যেতে পারি, আন্টি একটু রেস্ট নিতো। অপারেশন সকাল সাতটায়।”

_দরকার নেই।
নিচু স্বরে কিন্তু দৃঢ় কন্ঠে বলে ওঠে রেহেনা। তারপর আজানের দিকে তাকিয়ে বলে,”তোর দাদীর খোজ নিয়েছিস?”

“হু। পপি খালা এসেছে বাসায়।”

রেহেনা দু’চোখ বন্ধ করে ফেলে। ইশিতা উঠে দাঁড়ায়। তখনি একজন নার্স এসে বলে,”এখানে আলো কে?”

_আমি।
নিস্তেজ কন্ঠে জবাব দেয় আলো‌।

_আপনি একটু আমার সাথে আসুন। ব’ন্ডে সই করতে হবে।

আলো একটা ধাক্কার মতো খায়। কিন্তু নিজেকে দ্রুতই সামলে নিয়ে সে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়। দুই কদম হেটে সামনে এগোতেই মাথা ঘুরে পরে যেতে নিলে ইশিতা ধরে ফেলে। ইশিতা নরম গলায় বলে,”আমি তোমাকে ধরে রাখছি ভাবী। তুমি চলো।”

ডাক্তার রাসেলের কেবিনে সামিন এবং ইশমাম। দুজনে দুটো চেয়ারে বসে আছে। আলো গিয়ে কেবিনের দরজার কাছে দাড়ায়। ইশমাম আলোকে দেখতে পেয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। আলো গিয়ে চেয়ার টাতে বসে পরে। তার দৃষ্টি ডাক্তার রাসেলের দিকে। রাসেল আলোর দিকে একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলে,”এটাতে সই করতে হবে ভাবী।”

কাঁপা কাঁপা হাতে আলো কাগজটা নেয়। কিছুক্ষণ কাগজটার দিকে তাকিয়ে থেকে মুখ তুলে একে একে সবার দিকে তাকায়। ইশিতা আলোর কাঁধে হাত রেখে নরম গলায় বলে,”সব ঠিক হবে। কিছু হবে না তোমার বাবার!”

‌সামিন চুপ করে বসে আছে। আলো ধীরে ধীরে কাগজটায় সই করে ডাক্তার রাসেলের দিকে এগিয়ে দেয়। রাসেল বলে,”এখন তোমরা অপেক্ষা করো। আমরা ডাক্তাররা আগে একটা মিটিং করবো। তোমরা ধৈর্য্য ধরো। আল্লাহ্ কে ডাকো।”

আলো উঠে চলে যায়। সামিন ইশিতার দিকে তাকিয়ে বলে,”কিছু খাওয়া ওদেরকে।”
_কাজ হবে না ভাইয়া। সবাই ক’ঠি’ন পাথরের মূর্তি। যার কারিগর তুমি নিজেই।

সামিন বোনের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইশিতা উঠে আলোর পিছু পিছু চলে যায়।

***
“কোথায় যাচ্ছো!”
নরম গলায় বলে সামিন।
আলো আজানের হাত ধরে দাঁড়িয়ে পরে। সামিন এসে আলোর সামনে দাঁড়ায়। আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে বলে,”রাত তিনটার সময় কোথায় যাচ্ছো তুমি?”

আলো অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলে,”টাকা আনতে। আব্বুর অ’পা’রে’শ’নে’র।”
সামিন আলোকে শক্ত করে ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে রেগে গিয়ে বলে,”বাড়াবাড়ি করছো কিন্তু আলো।”

আলো নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়না সামিনের থেকে। চুপচাপ অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। আলোর নীরবতা সামিনকে আরো রা’গি’য়ে দেয়। কিন্তু মুহুর্তেই নিজেকে শান্ত করে। আলোকে ছেড়ে দিয়ে নরম গলায় বলে,”ঠিকাছে। কিন্তু এই মুহূর্তে তুমি টাকা কোথায় পাবে? না ব্যাংক খোলা না স্বর্নের দোকান। কে দেবে তোমাকে টাকা? আর এই শহরে আমার জানামতে তোমাদের কোনো পরমাত্মীয় নেই যে এই মুহূর্তে তুমি চাইলেই তোমাকে এতগুলো টাকা দিয়ে দেবে।”

আলো সামিনের দিকে তাকায়। সামিন বলে,”আমি টাকার ব্যাবস্থা করছি। তুমি বরং ধার হিসেবে নাও। পরে না হয় শো’ধ করে দিও। তোমার গয়না গুলো আমাকে দিও। তবু এতো রাতে অযথা পণ্ডশ্রম করো না আলো। তোমার মায়ের কাছে যাও।”

_আমি আপনার কাছ থেকে ধারও নেবো না।

সামিন এইবার প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে রে’গে গিয়ে দেয়ালে একটা ঘু’ষি মে’রে দেয়। ইশিতা এসে ভাইয়ের হাত ধরে। ইশমাম এসে দাঁড়ায়। ইশিতা আলোকে একপলক দেখে কিছু কঠিন কথা বলতে যাবে অমনি ইশমাম চোখ দিয়ে ইশারা করে তাকে কিছু বলে নিষেধ করে। নিজেকে সামলে নিয়ে ইশিতা আলোকে বলে,”ঠিকাছে ভাবী। ভাইয়ার থেকে নিতে হবে না। তুমি আমার থেকে ধার নাও‌। তোমার গয়না গুলো আমাকে দিও। প্লিজ!”

আলো ইশিতার দিকে তাকিয়ে থাকে। ইশিতা এসে আলোর গালে একটা হাত রেখে বলে,”আপু বলো তো তুমি আমায়। তাই না? তাহলে আমার এই কথাটা ফেলো না প্লিজ। প্লিজ ভাবী! প্লিজ আলো!”

আলো কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে নিজের গাল থেকে ইশিতার হাত টা ছাড়িয়ে দিয়ে ধীরপায়ে হেটে রেহেনার কাছে চলে যায়।

***
অপেক্ষার প্রহর গুনতে গুনতে সকাল ছয়টা বেজে গিয়েছে। আর একঘন্টা পরে অ’পা’রে’শ’ন। এর মাঝে কেউ কিছু মুখে দেয়নি। ডাক্তার আদনান রুহানি এবং রাসেল ছাড়াও আরো দুজন ডাক্তার অপারেশন রুমে ঢুকে প্রস্তুতি নিচ্ছে সবকিছুর।
রেহেনা বিধ্বস্ত মুখটা নিয়ে বসে আছে স্বামীর কেবিনের সামনে। আলো এসে মাকে একটু পানি খাইয়ে দেয়। আজান ভোর চারটার দিকে একবার বাড়িতে গিয়েছিলো। সে এইমাত্র এসে মায়ের পাশে বসে পরে। আয়াত বাইরে থেকে কিছু শুকনো খাবার কিনে এনে আলোর পাশে বসে।

সামিন ধীর পায়ে হেঁটে তাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। আলো সামিনকে দেখে উঠে চলে যায়। আজান আয়াতও বোনের পিছু পিছু চলে যায়। রেহেনা বসে আছে। সামিন রেহেনার পাশে বসে। কিছুক্ষণ দু’জনেই চুপচাপ। সামিন রেহেনার দিকে একপলক তাকিয়ে তার হাত দুটো মুঠি করে ধরে। রেহেনা সামিনের দিকে তাকায়। সামিন নরম গলায় বলতে থাকে,”আন্টি। এই পৃথিবীতে আমি সবথেকে বেশি অন্যায় আপনার সাথে করেছি। একজন স্ত্রী এবং একজন মা হয়ে আপনি দ্বিগুণ ভু’গে’ছে’ন। আমি নিজের দোষ স্বীকার করে নিলাম আন্টি,আমি লজ্জিত, অনুতপ্ত..আপনি আমাকে পারলে মাফ…”

সামিনকে আর কিছু বলতে না দিয়ে রেহেনা নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। নিজের মায়ের বয়সী এই মহিলার চোখে সামিন তার প্রতি তী’ব্র ঘৃ’ণা দেখতে পেয়ে আর কথা বলার সাহস পায় না। কয়েক মুহূর্ত বসে থেকে সেও উঠে চলে যায়।

***
আতাউর আলমকে অ’পা’রে’শ’ন থিয়েটারে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ওয়েটিং রুমে সবাই অপেক্ষা করছে একটা ভালো খবর শোনার! একজন মেয়ে অপেক্ষা করছে তার বাবার জন্য, দুজন ছেলে অপেক্ষা করছে তার বাবার জন্য, একজন স্ত্রী অপেক্ষা করছে তার স্বামীর জন্য, একজন অ’প’রা’ধী অপেক্ষা করছে একটা স্বস্তির সংবাদের যাতে তাকে আর কোনো দোষের ভাগীদার না হতে হয় তাই।

ইলহামের নাম্বার থেকে অনবরত ফোন আসছে। সামিন প্রথমে ফোনটা রিসিভ করতে চায়নি। পরে রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ইলহাম বলে,”ভাইয়া! আজকের অনুষ্ঠানের কি হবে কিছু বলছো না যে। এখানে সবকিছু আয়োজন করা হয়ে গিয়েছে!”

সামিন কিছু মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে,”অনুষ্ঠান হবে। লোকজনকে খাইয়ে, সবটা বুঝিয়ে বলবি। এখানে সা’র্জা’রি চলছে।”

ইমতিয়াজ মির্জা ইলহামের হাত থেকে ফোন নিয়ে সামিনকে বলে,”কি ধরনের রসিকতা শুরু করেছো তুমি! এতো বড় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এখন বলছো আসতে পারবে না! বর বৌ ছাড়া রিসিপশন হবে?”
_হ্যা হবে। লোকজন যেন পেট ভরে খেয়ে চলে যায়। রিতুকে বলো সবটা দেখতে।

_সামিন তুমি কি শুরু করেছো একটু বলবে। ওখানে কি করছো তুমি!
_এখানে আমার একজন আত্মীয় মৃ’ত্যু’র সাথে পাঞ্জা ল’ড়’ছে। সম্পর্কে তিনি আমার শশুর। এখানে আমার থাকাটা জরুরি বাবা। লোকজনকে তুমি আর ইলহাম ম্যানেজ করো। কোনো সাংবাদিক এলে বলবে যা কথা জানার ইয়াসার মির্জার কাছ থেকে জানতে। রাখছি।

ফোনটা কেটে দিয়ে সামিন আলোর দিকে তাকায়। বেঞ্চির উপরে পা উঠিয়ে হাঁটুতে মাথা রেখে গুটিয়ে বসে আছে। একে একে আতাউর আলমের পরিবারের প্রত্যেকের মুখের দিকে তাকিয়ে সামিন সেখান থেকে চলে যায়। তারপর সোজা তিনতলায় নামে সে। এই হসপিটালেই জামিল এডমিট। তিনশো চার নাম্বার কেবিনের পর্দা সরাতেই দেখে জামিলের মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে হেনা। সামিনকে দেখে হেনা উঠে দাঁড়ায়। সামিন নিচুস্বরে বলে,”উঠতে হবে না। তুমি বসো!”

হেনা বসে পরে। সামিন জামিলের কাছে এগিয়ে যায়। জামিল তার ইয়াসার ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে। ক্ষীণ কন্ঠে বলে,”সা’র্জা’রি শেষ হয়েছে?”
_না চলছে।

জামিল ম্লান হাসে,”কি অদ্ভুত তাই না ভাই। একসময় এই আতাউর আলমকে দুই বেলা তুলোধুনো করতেন আর এখন!”

সামিন জামিলের বেডের একপাশে বসে। জামিল হেনার দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি একটু বাইরে যাবে হেনা? ভাইয়ের সাথে আমার কথা আছে।”

হেনা উঠে চলে যায়। সামিন জামিলের দিকে তাকিয়ে আছে। জামিল বলতে থাকে,”সেদিন ওদের সামনে আমি আপনাকে লজ্জা দিতে চাইনি ভাই, তাই বলিনি যে আপনি ঘোর অন্যায় করেছেন। আতাউর আলম যদি দোষী থাকতো তবুও তার শা’স্তি তার মেয়ে কেন পাবে? খুব আ’হ’ত হয়েছি ভাই আমি। আপনাকে আমি এই দুনিয়ার কারো সামনে ছোট করতে পারবো না, কিন্তু সত্যিই ভাই আপনি মহা অন্যায় করে ফেলেছেন।”

সামিন জামিলের দিকে তাকিয়ে থাকে তার কথা শুনে।

***
টানা চারঘন্টা অ’পা’রে’শ’নে’র ইতি টেনে ডক্টর রাসেল অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়। সামিন তার কাছে যাওয়ার আগেই আলো ছুটে যায়। সামিন দাঁড়িয়ে পরে। আলো কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,”কি হয়েছে ডক্টর!”

মুখের উপর থেকে মাস্ক খুলে নিয়ে ডক্টর রাসেল একটা ম্লান হাসি হেসে বলে,”অপারেশন ঠিক ঠাক ভাবে হয়েছে ভাবী।”

আলো শান্ত হতে পারে না। একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেলে বলে,”বাঁচবে তো আব্বু!”

_ভাবী দেখুন আগেই বলেছি এটা রিস্কি। আপনার বাবাকে আইসিইউতে শিফট করা হবে। এখনো কিছু বলা যাচ্ছে না।

আলো দুই পা পিছিয়ে গিয়ে একটা বেঞ্চিতে ধপ করে বসে পরে। ইশমাম গিয়ে ডাক্তার রাসেলকে বলে,”ওনার কন্ডিশন কিরকম মানে ধরুন আনুমানিক কখন জ্ঞান ফিরবে বলে আশা করা যায়।”

_জ্ঞান তো এতো তাড়াতাড়ি ফিরবেই না তবে হ্যা ৭০ পার্সেন্ট চান্স আছে আগামী বাহাত্তর ঘন্টার মধ্যে রোগী রেসপন্স করবে বাকি টা তো সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছা।

রেহেনা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কাঁদছে আজান এবং আয়াত। সামিন কিছুক্ষণ তাদের দেখে ইশিতাকে বলে,”ওনাদের বাড়িতে নিয়ে চল ইশু। এখানে ওনার মেয়ে থাকবে সম্ভবত। ওনারা চলে যাক। হসপিটালে থেকে তো কোনো লাভ নেই সবার।”

তারপর আজান আয়াতের দিকে তাকিয়ে ধ’ম’কে’র সুরে বলে,”মেয়েদের মতো ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদছো কেনো? তোমার আপুকে দেখে কিছু শিখতে পারো না? সে সহজে কাঁদে?”

রেহেনা কান্না থামিয়ে ক’ঠি’ন গলায় বলে ওঠে,”আমি আমার স্বামীর কাছে থাকবো। তুমি কে ঠিক করার সবটা?”

সামিন রেহেনার দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠে,”আপনার জামাই আমি। আপনার মেয়ের স্বামী। এখন যেটা বলছি সেটা চুপচাপ করুন নয়তো ধরে বেঁ’ধে বাড়িতে রেখে আসবো।”

সবাই চুপ করে শোনে সামিনের কথা। কিছুক্ষণ পরে সামিন বলে ওঠে,”হসপিটালে থেকে আপনি করবেন কি? আপনি নিজে হাই ব্লা’ড প্রে’শা’রে’র রো’গী। এখন যদি একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলেন ভো’গা’ন্তি তো আপনার ছেলে মেয়েদের হবে। ”

ইশিতা রেহেনার পাশে বসে নরম গলায় বলে,”আন্টি দোহাই আপনার। আজান আয়াতকে নিয়ে চলে যান। এখানে থাকার কোনো মানে নেই। আলো তো আছে। ও সবটা দেখবে!”

রেহেনা মাথা তুলে একপলক ইশিতাকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। ধীর পায়ে হেঁটে আইসিইউর কাছে গিয়ে আতাউর আলমের নিথর শরীরটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে।

****
পাশে বসে আড়চোখে আলোর দিকে একপলক তাকায় সে। মাথা নিচু করে বসে আছে আলো। সামিনের হাতে টিস্যু পেপারে মোড়ানো একটা স্যান্ডউইচ । কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থেকে অনেকটা সাহস নিয়ে সে স্যান্ডউইচ টা আলোর দিকে এগিয়ে দেয়। নরম গলায় বলে ওঠে,”রাত থেকে কিছু খাওনি। এখন দুপুর দেড়টা বেজে গিয়েছে। এটা অন্তত মুখে দাও।”

আলো একপলক স্যান্ডউইচটার দিকে তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিয়ে ঠান্ডা গলায় বলে,”এসব এখন বন্ধ করুন। আমি কথা দিচ্ছি আমি আপনার নামে কোনো মা’ম’লা করবো না, কোনো স্টেপ নেবো না আপনার বিরুদ্ধে। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন। আপনি শুধু এখান থেকে চলে যান। আমার আপনাকে দেখলে য’ন্ত্র’না হচ্ছে খুব।”

_এসব কথার সাথে তোমার এটা খাওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই আলো। তুমি এটা খাও।

কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থেকে আলো হাত বাড়িয়ে স্যান্ডউইচ টা নিয়ে নেয়। স্যান্ডউইচটার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটা কা’ম’ড় বসায় তাতে। সামিন আলোকে দেখে কিছুটা স্বস্তি পায়। পানির বোতলটা এগিয়ে দেয় আলোর দিকে।

আলো নিস্তেজ কন্ঠে বলে ওঠে,”কি কপাল আমার , যে লোকটার জন্য আব্বু আজ মরতে বসেছে আমি তার হাতে খাবার খাচ্ছি।”

কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে সামিন বলে ওঠে,”শুধু খাবার না, তার কিনে দেওয়া শাড়ি তোমার গায়ে। তার কেনা গয়না পরে আছো, তার মায়ের হাতের বালা তোমার হাতে, তার নামের সাথে তোমার নাম জুড়ে গিয়েছে। অদ্রিতা আলো, অভিভাবক: স্বামী , স্বামীর নাম: সামিন ইয়াসার মির্জা।”

সামিনের এমন উত্তরে আলো ম্লান হাসে। সে হাসিতে সামিনের প্রতি ছিলো বিদ্রুপ।

সামিন হঠাৎ করে একটা হাত ধরে ফেলে আলোর। আলো হাত সরিয়ে নেয় না। সামিন আলতো করে সেই হাতটাকে নিজের দুহাতে আগলে নিয়ে নরম গলায় বলে,”একটা মাস নষ্ট করে দিয়েছি তোমার জীবনের। আমাকে আরো একটা মাস সময় দাও। সবটা না পারি,কিছুটা হলেও ঠিক করে দেবো আমি।”

আলো নিজের হাত ছাড়িয়ে নেয় না। সামিনের চোখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলে,”আপনি আমার জীবন থেকে গোটা জীবনটাই নিয়ে নিন ইয়াসার মির্জা। তবুও আপনার প্রতি আমার অনূভুতি বদলাবে না কিংবা এই সম্পর্ককে শ্রদ্ধা আমি করবো না। আপনাকে আমি সহস্র বছর সময় দিলাম। আপনাকে স্বামীর অধিকার খাটানোর অনুমতি দিলাম,আমি নিজেকে সমর্পণ করলাম। কিন্তু আপনি আমাকে পাবেন না, এই ভেতরের আমি টাকে পাবেন না আপনি। আমি আপনাকে ঘৃণা করি।”

কথাটা বলে আলো চোখ বন্ধ করে নেয়। দুই ফোঁটা তরল গড়িয়ে পরে তার দু’চোখ থেকে। সামিন আলোর হাত ছেড়ে দিয়ে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে।

***
অতিথিরা এসে সবাই হতভম্ব হয়ে গিয়েছে। ইতিহাসে এই প্রথম কোনো বিয়ের রিসিপশন হচ্ছে যেখানে বর বৌ নেই। সাংবাদিকরা এসে বিভিন্ন প্রশ্ন করছে। ইলহাম এবং ইমতিয়াজ মির্জা সবাইকে সবটা বুঝিয়ে বলে কোনোভাবে ম্যানেজ করে নিয়েছে বিষয় টা।

অনুষ্ঠানে জুঁই কে দেখে ইলহাম কিছু টা বিরক্ত হয়ে তার দিকে এগিয়ে যায়। এদিক ওদিক তাকিয়ে এগিয়ে গিয়ে ধ’ম’কে’র সুরে বলে,”তুমি এখানে এসেছো কেনো? পাগল হয়ে গিয়েছো নাকি তুমি!”

জুঁই চাপা স্বরে চেঁ’চি’য়ে বলে ওঠে,”ফোন ধরছিলে না কেনো আমার। জবাব দাও। বৌ কি আঁচলে বেঁ’ধে নিয়েছে নাকি!”

ইলহাম প্রচন্ড রে’গে গেলেও নিজেকে শান্ত করে বলে,”দেখো জুঁই , তুমি এভাবে হুট করে চলে আসলে সমস্যা টা তো আমার হবে তাই না? এটা কি তুমি চাও!”

_আমার ফোন লাগাতার কে’টে দেওয়ার আগে এটা মাথায় রাখা উচিত ছিলো।
_আচ্ছা ঠিকাছে। আর কাটবো না। এবার তুমি যাও। ঘর ভর্তি অতিথি। বাড়িতে বাবা আছে, সমস্যা হবে আমার। প্লিজ যাও।

জুঁই বলে,”ঠিকাছে। আগে কিছু টাকা দাও। আমি শপিং এ যাবো।”

ইলহাম জুঁই এর দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে তার পকেট থেকে ওয়ালেট বের করে জুঁই এর হাতে একটা কার্ড দেয়।

জুঁই আহ্লাদী গলায় বলে,”বলো। কাল দেখা করবে সকালে। বলো!”

_কাল হবে না জুঁই,ইহানের মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যাবো।

জুঁই কপাল কুঁচকে বলে,”কি হয়েছে ওর? পে’ট বা’ধি’য়ে’ছে নাকি আবার! দেখো ইলহাম, যদি এমন কিছু হয় তাহলে ওর এ’ব’র’শ’ন করাবে তুমি। মাইন্ড ইট!”

ইলহাম রেগে গিয়ে বলে,”স্টপ জুঁই। এখন যাও। প্লিজ।”

জুঁই চলে যায়। ইলহাম কিছুক্ষণ ওখানে কিছুক্ষণ থেকে ঘুরে দাড়াতেই দেখে রিতু তার দিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখ দুটো ভেজা। ইলহাম কিছু বলার আগেই রিতু চলে যায় সেখান থেকে।
***
বিকেল তিনটার দিকে রেহেনা আজান আয়াতকে নিয়ে আবারো এসেছিলো হসপিটালে। সন্ধ্যার দিকে তাদেরকে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে আলো। বলেছে সে একাই থাকতে পারবে।

সামিন এসে পেছন থেকে আলোকে ডেকে ওঠে,”আলো।”

আলো ঘুরে তাকায়। সামিন নরম গলায় বলে,”অনেক রাত হয়েছে। কাল রাত থেকে ঘুমাওনি। বাড়ি চলো, একটু ঘুমিয়ে নেবে। এখানে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই। নার্স ঠিক করে রেখেছি আমি। কোনো অসুবিধা হবে না।”

_আমার আব্বুর কাছ থেকে আমাকে কোথাও নিয়ে যেতে পারবেন না।
নিচু স্বরে কিন্তু তেজী কন্ঠে বলে ওঠে আলো।

সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বলে,”ঠিকাছে। থাকো। আমি আশেপাশে আছি। প্রয়োজন হলে ডেকে নিও।”

ইশমাম এসে সামিনের পিছনে দাঁড়িয়ে বলে,”তুমিও তো ঘুমাওনি ভাইয়া। তুমি বাড়িতে যাও। আমি আছি। ”

_না, তুই যা। তোদের কষ্ট করার কোনো মানে হয়না ছোট। যা।

জোরাজুরি করে ভাইয়ার সাথে পারা যাবে না। ইশমাম হাল ছেড়ে দিয়ে আলোর দিকে একপলক তাকায়। তারপর চলে যায় সে।

ঘুরেফিরে ওয়েটিং রুমে এসে দেখে আলো বসে আছে চুপচাপ। ঘুমে তার চোখ বুজে আসছে। ওয়েটিং রুমে তারা দুজন এখন ‌। পুরো হসপিটাল নি’স্ত’ব্ধ। সামিন এগিয়ে গিয়ে আলোর পাশে বসে। আলো বসে বসে ঢুলছে। সামিনের উপস্থিতি সে টেরই পায়নি। কয়েক পলক আলোকে দেখে সামিন বলে ওঠে,”ভেতরে কেবিন রয়েছে। অন্তত সেখানে গিয়ে ঘুমাও। ”

আলো লাফিয়ে ওঠে। সামিন বলে,”সরি! ভ’য় পেয়ে যাবে বুঝিনি। বলেছি ভেতরে কেবিন আছে সেখানে গিয়ে ঘুমাও। এভাবে বসে বসে তো ঘুমানো যায়না।”

আলো কপাল কুঁ’চ’কে বলে,”চোখটা একটু লেগে গিয়েছিল। ঘুমাইনি। এখানেই ঠিক আছি আমি।”

সামিন কিছুক্ষণ শীতল চোখে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে শার্টের হাতা ফোল্ড করতে থাকে। আলো তার দিকে তাকিয়ে আছে। সামিন আলোর চোখের দিকে এক পলক তাকিয়ে আলোকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়। নিজেকে ছাড়ানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে আলো ব্যর্থ হয়। সোজা হেটে একটা কেবিনে ঢুকে একটা বেডের ওপর আলোকে বসিয়ে দেয় সামিন‌ । আলো তার দিকে রা’গী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সামিন আলোর চোখের দিকে তাকিয়ে খুবই ঠাণ্ডা ভাবে বলে,”এখন এখানে চুপচাপ শুয়ে না পরলে এক চ’ড় মে’রে সামনের পাটির দাঁত সবগুলো ফেলে দেবো আছিয়া।”

চলমান……..

#বধূ_কোন_আলো_লাগলো_চোখে
#পর্বসংখ্যা_২২
#Esrat_Ety

“তোকে দেবদাস মুভিতে কাস্ট করা যেতে পারে। লুকটা একেবারে পারফেক্ট।”
ফুয়াদ সামিনের দিকে তাকিয়ে কথাটি বলে সামনের দিকে তাকায়। সামিন একমনে ড্রাইভ করছে। ফুয়াদ বলে,”সেদিন রাতে তোর সাথে খুব খা’রা’প ব্যাবহার করেছি। আসলে রাইসার সাথে ঝ’গ’ড়া হয়েছিলো। তুই কি এখনো রে’গে?”
_নাহ।
একশব্দে জবাব দেয় সামিন।
_দুই রাত না ঘুমিয়েই ছিলি?
_না। গতকাল শেষ রাতের দিকে একটু ঘুমিয়েছিলাম। তাও বসে বসে। এখন পুরো শরীর ভেঙে ঘুম আসছে। বাড়িতে গিয়ে একটু ঘুমাবো।

_আলো কি করছে? কাঁ’দ’ছে খুব?
_না প্রথমে খুব কেঁ’দে’ছি’লো। এখন স্বাভাবিক। শুধু আমাকে দেখে ক্ষে’পে যায়।

_তো যাচ্ছিস কেনো সামনে, হেল্প করলে আড়ালে থেকেও তো করা যায়।
_আমার বৌ, আমি সামনে যাবো না?

ফুয়াদ সামিনের দিকে তাকায়। পরপর বলে ওঠে,”আমার দাদী তোর কপালের তিলটা দেখে সবসময় বলতো তুই নাকি বৌ পা’গ’লা হবি। দাদীর কথা মিলে যাচ্ছে।”

সামিন ম্লান হাসে। ফুয়াদের অফিসের সামনে ফুয়াদকে নামিয়ে দিয়ে সোজা শান্তিনীড়ে ছুটে যায় তার গাড়ি। ধীরপায়ে বাড়িতে ঢুকে দেখে কেটারিং সার্ভিসের লোকেরা সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে চলে যাচ্ছে। ইমতিয়াজ মির্জা লিভিং রুমে ইহানকে কোলে নিয়ে বসে ছিলো,সামিনকে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। গম্ভীর কন্ঠে বলে,”দাঁড়াও।”

সামিন দাঁড়ায় না। একটা হাই তুলে বলে,”ঘুমাবো বাবা। দাঁড়ানোর সময় নেই।”

সিঁড়ি বেয়ে ইশমাম নামে। সামিনকে দেখে বলে,”তুমি এসে গিয়েছো। আমি হসপিটালেই যাচ্ছিলাম ভাইয়া।”

_হ্যা এসেছি। বিকেলের দিকে গিয়ে তোর ভাবীকে নিয়ে আসবো। এখন আমার একটু ঘুম প্রয়োজন। তুই যেতে চাইলে যা,তবে ওরা তোর সাথে যে খুব একটা ভালো ব্যাবহার করবে তার গ্যারান্টি দিতে পারছি না।

ইমতিয়াজ মির্জা বলে ওঠে,”এতো গুলো টাকা দিয়ে তুমি আতাউর আলমের অ’পা’রে’শ’ন করিয়েছো! তুমি!”

_হু। কেনো বাবা,এর থেকে বেশী টাকা আমি প্রত্যেক মাসে এতিম খানা গুলোতে দেই। তোমার কি কোনো অসুবিধা হয়েছে? লোকটা আতাউর আলম বলে?

_না,সেসব পুরনো কথা। তার জে’র ধরে আমি কিছু বলছি না।

_আমি ভুলের মাশুল গুনেছি বাবা।
ঠান্ডা গলায় বলে সামিন।

ইমতিয়াজ মির্জা বিদ্রুপ করে বলে ওঠে,”তোমার মেজো ভাই ভুল করে এক মেয়ের ওরনা ধরে টা’ন দিলো,সেখানে মাশুল গুনলে। এখন তুমি ভুল করে এক মেয়েকে তুলে এনে বিয়ে করে তার মাশুল গুনছো। আর তোমার এই ছোটো ভাই ভুল করে কি করবে? জানতে পারি?”
কথাটি বলে ইমতিয়াজ মির্জা ইশমামের দিকে তাকায়। ইশমাম কিছু না বলে বেড়িয়ে যায় বাড়ি থেকে। সামিন বাবার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে সিড়ি বেয়ে উপরে উঠে যায়।

***
ঘরে ঢুকে অনেকটা সময় নিয়ে শাওয়ার নিয়ে ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে আসে। ফোনের রিংটোন বেজে যাচ্ছে। তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরে।

_কি রে সামিন ইয়াসার। শেষমেশ আতাউর আলমের মেয়েকে!

সাগরের কন্ঠ পেয়ে সামিন ফোন কেটে দিতে যাবে তখনি সাগর বলে ওঠে,”খবরদার ফোন কাটবি না সামিন। আগে বল তুই আমাকে লিজ টা পেতে দিস নি কেনো শা’লা!”

_জামিলের গায়ে হা’ত তুলেছে তোর বাপের লোক। আমার দুর্বল যায়গায় আ’ঘা’ত করতে আসলে আমিও তার ঠিক আসল যায়গায় আ’ঘা’ত করি। তোকে আর তোর বাপকে সিটি কলেজের ছেলেপুলে দিয়ে পি’টি’য়ে মা’রা’র থেকে ভাবলাম প্রানে না মে’রে ধনে মা’রি। কেমন লাগছে এখন?
কথাটি বলে সামিন কু’ৎ’সি’ত একটা গা’লি দেয় সাগরকে। সাগর গা’লি’টা গায়ে না মেখে ঠান্ডা গলায় বলে,”তোর খুব খারাপ অবস্থা করে ছাড়বো সামিন। আমাকে তুই খুব ভালো করে চিনিস। এতো বড় ক্ষ’তি আমি হজম করবো না কিন্তু।”

সামিন একটা বাকা হাসি দিয়ে ফোন কেটে দেয়।

তোয়ালে দিয়ে মাথাটা ভালো করে মুছে তোয়ালেটা দূরে ছু’ড়ে মেরে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। ঘুমে দু’চোখ তলিয়ে আসছে। ফ্লাইওভারের সাইট থেকে ফোন আসছে। সেখানে গিয়ে একটাবার দেখে আসা দরকার। বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে চোখ বুজে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর ফোনটা আবারো হাতে নিয়ে তৌফকে ফোন দেয়। তৌফ ফোনটা রিসিভ করতেই সামিন বলে ওঠে,”তোর ভাবী কি করছে?”

_ভাবী তার মাকে খাইয়ে দিচ্ছে ভাই।
_আর সে খেয়েছে?
_তা জানি না। গিয়ে জিজ্ঞেস করে আসবো?
_জিজ্ঞেস করতে গেলে চ’ড় খাবি। যাস না। ইশমাম যাচ্ছে হসপিটালে। কোনো সমস্যা হলে আমাকে ফোন করবি। আমি এখন ঘুমাবো। বিকেলে আসছি।
_জ্বি আচ্ছা ভাই।

সামিন ফোন কেটে দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেলে। কিছু সময় যেতেই ঘুমিয়ে যায় সে।

***
“অদ্রিতা!”
ইশমামের কন্ঠ পেয়ে মাথা তুলে তাকায় আলো। ইশমাম আলোর পাশে কিছুটা দূরত্ব নিয়ে বসে। আলো স্বাভাবিক গলায় বলে,”এলে কেনো! ভাই স্পাই হিসেবে পাঠিয়েছে বুঝি! আমি পু’লি’শ ডাকলাম কিনা! মুখ খুললাম কি না। এসব দেখতে পাঠিয়েছে তোমাকে?”

_নাহ, তোমার খেয়াল রাখতে পাঠিয়েছে।

আলো চুপ করে থাকে। ইশমাম বলে,”ভাইয়া প্রচণ্ড অনুতপ্ত।”

_তো? সে অনুতপ্ত,তাই তার বুকে ঝা’প দেবো? ভুলে যাবো সেই বি’ভী’ষি’কা’ময় রাত টা?

ইশমাম চুপ করে আলোকে দেখছে। সেই রাতটা তো তার জীবনেরও সবথেকে বি’ভী’ষি’কা’ময় রাত।
খুবই ক্লান্ত দেখাচ্ছে আলোকে। নরম গলায় ইশমাম বলে,”বিকেলে বাড়িতে চলে যেও প্লিজ। এখানে নার্স রা সবটা দেখবে। তোমার এমন ভোগান্তি আমাদের কারো কাম্য নয়।”
_ভোগান্তি তোমাদের কাছে। ঐ মানুষটা আমার আব্বু, আমার কোনো কষ্ট হচ্ছে না। ভাইয়ের হনুমানগিরি করা শেষ হলে তুমি এখান থেকে যাও। প্লিজ যাও।

***
“তুমি যাবে না?”
_না।
সামিনের মুখের উপর বলে দেয় আলো। সামিন রা’গ’টা নিয়ন্ত্রণ করে বলে,”দু দুজন নার্স ঠিক করা। যেখানে থাকার প্রয়োজন নেই সেখানে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছো কেনো? হসপিটাল কি একটা থাকার যায়গা? এখানে কেউ শখ করে থাকে?”

আলো অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সামিন একটা নিঃশ্বাস নিয়ে নরম গলায় বলে,”দেখো! তোমার বাবা ঠিক আছে। রেসপন্স করছে উনি। সম্ভবত খুব শিগগিরই জ্ঞান ফিরবে তার। তুমি বাড়িতে চলো, প্রতিদিন এসে এসে সকাল-সন্ধ্যা দেখবে। এভাবে একটানা হসপিটালে পরে থাকলে তুমি নিজেও অ’সু’স্থ হয়ে পরবে আলো। কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ থাকতে পারে এতদিন এভাবে? ঘুম নেই, গোসল নেই, খাবার খাচ্ছো না ঠিক ভাবে! ”

আলোকে চুপ থাকতে দেখে সামিন আলোর হাত ধরে। খুবই নিচু স্বরে বলে,”মাত্র একমাস নিয়েছি তোমার থেকে। আজ সেই একমাসের প্রথম দিন। চলো বাড়িতে।”

আলোকে কিছু বলতে না দিয়ে সামিন আলোর হাত ধরে বের করে নিয়ে আসে হসপিটাল থেকে। আলো নিশ্চুপ হয়ে থাকে। রাত তখন সাড়ে দশটা। আলোকে গাড়িতে বসিয়ে নিজে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট করে। একপলক আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”সিট বেল্ট টা বাধো প্লিজ।”
আলো রোবটের মতো সামিনের বলার সাথে সাথে সিটবেল্ট বেঁধে নেয়। পুরো রাস্তা দু’জনে চুপচাপ। শান্তিনীড়ের গেইট থেকে গাড়ি ঢোকে। গাড়ি থামিয়ে সামিন নেমে দরজা খুলে আলোকে নামতে বলে। আলো নেমে পরে।

লিভিং রুমে ইশিতা এবং পরী বসেছিলো। আজ বিকেলে পরী এসেছে। আলো আর সামিনকে দেখে দু’জনে উঠে দাঁড়ায়। ইশিতা নরম গলায় বলে,”তুমি ঠিক আছো ভাবী?”
আলো মাথা নাড়িয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে থাকে। সামিন আলোর পিছু পিছু যায়।

ঘরে ঢুকে আলো এক মিনিট চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে আলমারির কাছটায় যায়। তারপর একটা আকাশী রঙের সুতির শাড়ি বের করে ওয়াশ-রুমে ঢোকে।
সামিন দরজা বন্ধ করে গায়ের শার্টটা পাল্টে নিয়ে একটা বালিশ এনে ডিভানে রেখে বসে পরে। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়। আলো ওয়াশ রুম থেকে বের হয় না। সামিন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে আলো প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট ধরে গোসল করছে।
কিছু সময় যেতেই খট করে ওয়াশ রুমের দরজা খোলার আওয়াজ হয়। ধীর পায়ে আলো বের হয়ে আসে। মাথায় তোয়ালে জড়িয়ে রেখেছে। শাড়ির আঁচল টেনে ডান কাঁধে তুলে রেখেছে। মাথা ঘুরিয়ে আলোর মুখের দিকে তাকাতেই সামিন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আলোর দিকে। আকাশী কোনো আহামরি সুন্দর রঙ নয়। অথচ এই শ্যামলা বর্ণের মেয়েটিকে কী ভীষণ মানিয়েছে! সামিন খেয়াল করেছে, সামিনের যত অপছন্দের সব রং। এই মেয়েটির গায়ে জরালেই সামিনের চোখে সুন্দর হয়ে ওঠে রং টা।

হঠাৎ করে আলো একটা হা’চি দিতেই সামিনের ঘোর কেটে যায়। আলো বিছানায় বসে মাথা থেকে তোয়ালে টেনে সরিয়ে দেয়। ভেজা চুলগুলো পিঠে ছড়িয়ে পরে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সামিন চোখ সরিয়ে নেয়। আলো নিজের গায়ে একটা চাদর টেনে নিয়ে ওদিকে ফিরে শুয়ে পরে। সামিন মাথা ঘুরিয়ে আবারো আলোর দিকে তাকায়। একবার ভাবলো আলোকে বলবে মাথাটা ভালো করে মুছে নিতে। কিন্তু সে সাহস পেলো না। তর্কাতর্কি শুরু হয়ে যাবে তাহলে, আলো শেষ পর্যায়ে বলবে,”আমি আপনাকে ঘৃ’ণা করি ইয়াসার মির্জা!”
এতো রাতে সেই বাক্যটা শুনতে ইচ্ছে করছে না সামিনের।

***
প্রচন্ড শব্দে “আহ” বলে আ’র্ত’না’দ করে ইশমাম পেটে হাত চেপে ধরে। তিনটা বই হাতে পরী পেছনের দিকে তাকাতে তাকাতে ছুটে আসছিল। যে গতি নিয়ে পরী ছুটছিল,তাতে ধাক্কা লেগে হাতের বই গুলো ইশমামের পেটে লাগে। পেটে হাত চেপে ইশমাম তিন পা পিছিয়ে যায়। মনে হচ্ছে রাতের খাবার সবটা এখনি বেরিয়ে যাবে। নিজেকে ধাতস্থ করে ইশমাম চেঁচিয়ে বলে ওঠে,”চোখ কোথায় নিয়ে ছোটো? আর এভাবে ছুটছিলে কেনো? অদ্ভুত!”

যে ভ’য়ে পরী ছুটছিলো,ইশমামের ধ’ম’ক খেয়ে সেই ভ’য়ে’র কথা পরী ভুলে গিয়েছে। এখন তার ভ’য় একটাই, আগামী পাঁচ মিনিট এই লোকটার থেকে কঠিন কঠিন কিছু কথা শুনতে হবে।

ইশমাম তার দিকে চোখ রা’ঙি’য়ে তাকিয়ে আছে। পরী একটা ঢোক গিলে ফেলে। ইশমাম গম্ভীর কন্ঠে বলে,”ষাঁড় তা’ড়া করেছিলো নাকি তোমায়? অদ্ভুত মেয়ে!”

_আসলে ভ’য় পেয়েছিলাম। তাই ছুটছিলাম।
আমতা আমতা করে জবাব দেয় পরী।

_ভ’য় পেয়েছিলে মানে? কিসের ভ’য়?
_ভুতের।

পরীর মুখে ভুতের কথা শুনে ইশমাম প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে যায়। চাপা স্বরে চেঁচিয়ে বলে,”ডিসগাস্টিং! তুমি একটা মেডিক্যাল স্টুডেন্ট হয়ে এসব কথা বলছো!”

পরী নিচু স্বরে বলে,”লাইব্রেরীর পাশের ঘর থেকে কেমন শব্দ আসছিলো।”

_শব্দ আসতেই পারে। তাই বলে ভুত ভেবে নিলে?

পরী একটা ঢোক গিলে বলে,”ঐ ঘরে কে থাকতো জানেন?”

_কে?
ইশমাম ধমকের সুরে বলে।

_আপনার দুই নাম্বার চাচী!

_দুই নাম্বার চাচী মানে?
_ইসতিয়াক মির্জার দ্বিতীয় স্ত্রী মারুফা। যাকে আপনার চাচা তুলে এনে বিয়ে করেছিলো। অনেক অ’ত্যা’চা’র করতো তাকে। এক পর্যায়ে সে বি’ষ খেয়ে ম’রে গিয়েছিলো। এসব আপনার আমার জন্মেরও আগের কাহিনী।
_তো এতদিনে তো মারুফা চাচীর ভুতও ম’রে ভুত হয়ে গিয়েছে। সেসব কথা এখন বলছো কেনো? কোন ধরনের ফাজলামি এগুলো!

ইশমাম পরীর দিকে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। পরী বলতে থাকে,”সত্যি বলছি। কেমন শব্দ আসছিলো।”

ইশমাম দাঁতে দাঁত চেপে বলে,”চলো আমার সাথে। যদি ভুত না বের করতে পেরেছো তাহলে ঐ ঘরে বন্ধ করে দিয়ে আসবো তোমাকে।”

_না যাবো না‌।

_চলো।

পরী মুখটা একটুখানি করে ইশমামের পিছু পিছু যায়।
ঘরের দরজা খোলা ছিলো। ইশমাম পরীর দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি এখানে দাঁড়াও। আমি ভুত নিয়ে বাইরে আসছি। নড়বে না এখান থেকে।”

ভেতরে ঢুকে লাইটের সুইচ টিপে দিতেই বিছানার ওপরে ইশিতার বিড়াল টাকে লেজ নাড়াতে দেখা যায়। ইশমাম এগিয়ে গিয়ে বিড়ালটাকে কোলে তুলে বেড়িয়ে আসে। পরীর সামনে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,”এই যে তোমার ভুত। স্টু’পি’ড মেয়ে।”

তখনি ইশিতা এসে দাড়িয়ে ওদের দিকে তাকিয়ে বলে,”কি হয়েছে ইশমাম!”

ইশমাম ইশিতার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে,”যেমন স্টু’পি’ড তোর এই বিড়াল টা,তেমন স্টু’পি’ড তোর এই সখী। দুটোকে আমার সামনে থেকে নিয়ে বিদেয় হ।”

***
রিতুর শরীরটা সকাল থেকেই খুব খারাপ। বেশ কয়েকবার ব’মি হয়েছে। এখন বিছানায় ওদিক ফিরে শুয়ে আছে। ইলহাম কিছুক্ষণ রিতুর দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,”ডাক্তারের কাছে চলো। নাকি ডাক্তার বাড়িতে ডাকবো?”

রিতু ঘুরে ইলহামের দিকে তাকিয়ে বলে,”প্রয়োজন নেই। আমি ঠিক আছি। আপনি অফিসে যান।”

ইলহাম বিছানায় একপাশে বসে পরে, কিছুক্ষণ পরে বলে ওঠে,” এই মাসে পি’রি’য়’ড হয়েছিলো তোমার?”

রিতু কিছুক্ষণ নিজের স্বামীর দিকে তাকিয়ে থেকে মাথা নাড়ায়। ইলহাম বলে,”চলো টে’স্ট করাবে। রেডি হও!”

_কেন? এ’ব’র’শ’ন করানোর খুবই তা’ড়া বুঝি?
কাঁপা কাঁপা গলায় বলে ওঠে রিতু। ইলহাম কিছুক্ষণ রিতুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। হঠাৎ করে খুব খারাপ লাগছে রিতুর কথাটা শুনে। আগে হলে অনেক ব’কা’ঝ’কা করে দিতো মুখের ওপর কথা বলার অ’প’রা’ধে। আজ পারছে না।

রিতু অ’সু’স্থ শরীর নিয়ে উঠে বসে। নিচু স্বরে বলে,”ইহান কে জন্ম দিয়ে আপনার ভালোবাসা পাইনি, দ্বিতীয় বাচ্চা পৃথিবীতে এলেই আপনি হঠাৎ আমায় ভালোবাসবেন এমনটা আমি ভাবি না। আমি নিয়মিত ও’ষু’ধ খাই। কোনো বাচ্চা আসেনি পেটে। প্রতি মাসেই পি’রি’য়’ড হতে একটু দেরী হয় আমার।”

ইলহাম উঠে দাঁড়ায়। পেছন থেকে রিতু বলে ওঠে,”ঐ মেয়েটার মধ্যে কি এমন ছিলো যেটা আপনার স্ত্রীর মধ্যে আপনি পান নি। আমাকে এক বছর পরে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার আগে এই প্রশ্নের উত্তরটা কি একটু দেবেন?”

ইলহাম কয়েক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে সেখান থেকে চলে যায়।

***
“তুমি রেডি হয়ে নিচে এসো। আমি অপেক্ষা করছি। তোমাকে হসপিটালে পৌঁছে দেবো।”

সামিনের কথা শুনে আলো কপাল কুঁচকে ফেলে। গম্ভীর কন্ঠে বলে,”প্রয়োজন নেই। আমি রিকশা নিয়ে চলে যাবো ‌।”

_রিকশা ভাড়া আছে তোমার কাছে? আমার ধারণা নেই, রিকশাওয়ালা তোমার চেহারা দেখে তোমাকে রিকশায় ওঠাবে না। অতটাও সুন্দরী নও তুমি।

সামিন কথাটি বলে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে ঠোঁট টিপে হাসে। আলো সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চোখ মুখ ফ্যা’কা’শে।

সামিন আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”নিচে অপেক্ষা করছি। তাড়াতাড়ি এসো। যদি হসপিটালে যেতে চাও তো।”

সামিন চলে যায়। আলো মলিন মুখে খোলা চুল গুলো খোঁপা বেঁধে নিয়ে ডান কাঁধে শাড়ির আঁচল উঠিয়ে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়।

করিডোরে সিঁড়ির কাছে ইহান বল নিয়ে খেলছে। এমাথা থেকে ওমাথা ছোটাছুটি করছে। আলো বের হতেই ইহানের বলটা এসে তার গায়ে লাগে। আলো গম্ভীর কন্ঠে বলে,”এখানে এভাবে বাঁ’দ’রা’মি করছো কেনো ছেলে? সিঁড়ি থেকে পরতে চাও?”

ইহান আলোকে দেখে চোখ মুখ কুঁ’চ’কে সিঁড়ি বেয়ে নামতে থাকে। আলো তার পিছু পিছু নামছে। ইহান আলোকে দেখিয়ে দেখিয়ে ইচ্ছে করে লাফিয়ে লাফিয়ে নামছে। পেছন থেকে আলো গম্ভীর কন্ঠে বলে,”ঠিক ভাবে হাটো। পরে যাবে।”

ইহান বেশি করে লাফাতে থাকে। হুট করে পা পি’ছ’লে দুই ধাপ নিচে পরে যেতেই আলো দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে ইহানকে ধরতে গেলে সেও পা পিছলে পরে যায়।

বি’ক’ট একটা শব্দ হয়।
ঘটনার আকস্মিকতায় সামিন উঠে দাঁড়িয়ে যায়। ইহান নিজের যায়গায় দাঁড়িয়ে চোখ বড় বড় করে আলোকে দেখছে। আলো হাত দিয়ে নিজের পা চেপে ধরে চাঁপা স্বরে কো’কি’য়ে যাচ্ছে। য’ন্ত্র’না’য় তার পুরো মুখমণ্ডল নীল রঙ ধারণ করেছে।

লিভিং রুমের থাকা সবাই ছুটে আসে। সামিন এসে নিচু হয়ে ঝুঁকে বসে, উ’ৎ’ক’ণ্ঠা নিয়ে বলে,”কোথায় লেগেছে?”

আলো কোনো উত্তর দিতে পারে না, উত্তর দেওয়ার মতো পরিস্থিতিতে সে নেই। য’ন্ত্র’না’র তীব্রতা বাড়ছে। ইশমাম দাঁড়িয়ে আছে, সামিনের দিকে তাকিয়ে বলে,”সম্ভবত পায়ে ভাইয়া।”

সামিন আলোর পায়ে হাত দিলে সে উচ্চশব্দে আ’র্ত’না’দ করে ওঠে। পেছন থেকে ফুলির মা বলে,”ভে’ঙে গেছে নাকি ভাইজান!”

সামিন ইশমামের দিকে গাড়ির চাবি এগিয়ে দিয়ে বলে,”গাড়ি স্টার্ট কর। শিগগিরই।”

তারপর আলোর দিকে তাকিয়ে বলে, উঠতে পারবে? নাকি আমি উঠাবো?
আলো দু’চোখ বন্ধ করে নিশ্চুপ হয়ে কেঁ’দে যাচ্ছে। তার কাছে মনে হচ্ছে পায়ের কোনো হা’ড় ভেঙে গিয়েছে।

সামিন আলোর দিকে একপলক তাকিয়ে তাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়। ইশমাম গিয়ে গাড়ি স্টার্ট করে। পোনা চাচা পেছনের সিটের দরজা খুলে দেয়,সামিন আলোকে বসিয়ে নিজেও বসে পরে।

পোর্চের নিচে দাঁড়িয়ে ফুলির মা দাঁত বের করে সিতারাকে বলে,”মানুষ একটা আমাদের বড় ভাইজান। কথায় কথায় ভাবীরে কোলে উঠায়‌। এতো মোহাব্বত আজকালকার পুরুষের মধ্যে থাকে? এই বে’টি যদি একটু বুঝতো। ভাইজানরে পাত্তাই দিতে চায় না। যদি এই বংশের পূর্বপুরুষদের হাতে পরতো তাহলে বুঝতো কত ধানে কত চাল। স্বামীর হাতে মার খেতে খেতে জীবন শেষ হয়ে যেতো!”

***
“অদ্রিতা।”

ইশমাম দরজার কাছে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে ভেতরে ঢোকে। আলোর বেডের পাশে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে একটা চেয়ার টেনে বসে। আলোর ডান পায়ের গোড়ালিতে প্লাস্টার করে দিয়েছে ডাক্তার। খুব বেশি মা’রা’ত্ম’ক না হলেও বেশ কিছুদিন ভোগাবে আলোকে।
ইশমাম নিচু স্বরে বলে,”হাটো কিভাবে তুমি! সিঁড়ি থেকে যখন পরছিলে মনে হচ্ছিলো একটা পিংপং বল গড়িয়ে পরছে।”

আলো কোনো উত্তর না দিয়ে ইশমামের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইশমাম ম্লান হেসে বলে,”ভাইয়া তোমার খুব কেয়ার করে। অবশ্য ভাইয়া এমনই। যাদের সে আপন মনে করে তাদের সবার খুব কেয়ার করে। আমি আর ইশু যখন জন্মাই,তখন থেকেই মায়ের শরীর টা হঠাৎ খুব খারাপ হতে শুরু করে। বছরের আটমাস অসুস্থ থাকতো। ভাইয়াই আমাকে আর ইশুকে দেখভাল করতো বলতে গেলে। সেজন্য মায়ের পরে ভাইয়ার সাথে আমার সখ্যতা বেশি।”

_এসব কথা আমাকে বলছো কেনো?
ঠান্ডা গলায় বলে আলো।

ইশমাম আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”দেখো, ভাইয়া তোমাকে খুব ভালো রাখবে। বোঝাই যাচ্ছে।”

_আমাকে শান্তনা দিচ্ছো?

_নাহ। নিজেকে দিচ্ছি।

আলো ইশমামের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ইশমাম কিছু সময় চুপ থেকে বলে ওঠে,”আমার একটা প্রিয় মানুষ আমার আরেকটা প্রিয় মানুষের কাছে ভালো থাকবে,যত্নে থাকবে,নিরাপদে থাকবে, এটা আমার কাছে অনেক বড় একটা শান্তনা অদ্রিতা।”

আলো ইশমামের কথায় কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে,”বিয়ে করে নাও ইশমাম। একটা ভালো মেয়ে দেখে বিয়ে করে নাও।”

ইশমাম হেসে ফেলে। আলোর দিকে তাকিয়ে বলে,”ভাবীগিরি দেখাচ্ছো?”
_তুমিও তো ভাইয়ের হনুমানগিরি করো, ভাইয়ের দালালি করো।

ইশমাম চুপ হয়ে যায়। আলো বলে,”তোমার প্রিয়, আদর্শবান ভাইয়া আমাকে একটা রাতেই গোটা এক জন্মের বি’ভী’ষি’কা দেখিয়ে দিয়েছিলো। এখন আবার আমার সাথে নতুন গেইম খেলার চেষ্টা করছে। গত একটা মাস আমাকে ভয় দেখিয়ে ব’ন্দি’নী করে রেখেছিলো,এখন আবার আমাকে মুগ্ধ করতে আমার কাছ থেকে আরো একটা মাস সময় চাচ্ছে। আমার অনূভুতি নাকি পাল্টে দেবে!…”

আলোর কথা বলার মাঝে সামিন এসে ভেতরে ঢোকে। ইশমাম উঠে দাঁড়ায়। সামিন বলে,”উঠলি কেনো। বস।‌”

ইশমাম নিচু স্বরে বলে,”ভাবীর বাবার এখন কি অবস্থা?”

_সব ঠিক ঠাক। কোনো কম্লিকেসি নেই। এখন শুধু জ্ঞা’ন ফেরার অপেক্ষায়।

ইশমাম ভাইয়ের দিকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বলে,”বসো ভাইয়া,আমি আসছি।”

কথাটি বলে ইশমাম চলে যায়। সামিন মাথা ঘুরিয়ে আলোর দিকে তাকায়। তারপর চেয়ারে বসতে বসতে বলে,”হসপিটাল টা পুরো আমার পারিবারিক হসপিটাল হয়ে গিয়েছে। আমার ছোটো ভাই, আমার শশুর,আমার বৌ, সবাই রোগী।”

আলো মাথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন বলে,”কি করছিলে তখন? সিঁড়িতে দৌড় ঝাঁ’প দিচ্ছিলে কেন? ইহানকে তা’ড়া করছিলে মা’রা’র জন্য?”

আলো মাথা ঘুরিয়ে তাকায়,অবাক হওয়া কন্ঠে বলে,”আমি একটা ছোট বাচ্চাকে মা’রা’র জন্য তা’ড়া করবো?”

_তুমি যে ধরনের মেয়ে। করতেই পারো। তোমাকে বিশ্বাস কি?

ঠাণ্ডা গলায় বলে সামিন। আলো কপাল কুঁচকে সামিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। সামিন আলোর চোখে চোখ রেখে বলে,”তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে চাইলে আর সৃষ্টিকর্তা তোমার ঠ্যাং ভে’ঙে দিলো। এই ফে’রা’উ’ন’টার প্রতি সৃষ্টিকর্তার কত মায়া দেখেছো আছিয়া?”

চলমান…..