বন্য প্রণয় পর্ব-৪৬

0
85

#বন্য_প্রণয়
#পর্ব_৪৬
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

আমেনা ইসলাম হুহু করে কেঁদে উঠলেন। অনিক তৃষাকে ইশারা করে সামলাতে বলছে মা’কে।
” জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে মা। এতবড় শক সহ্য করতে পারেনি। এসে থেকে একটা কথাও বলেনি আর না তো কেঁদেছে। এভাবে চুপচাপ থাকলে ভয়ের বিষয়। ”
” তাহলে কী করবে? ভাইয়াকে কীভাবে কথা বলাবেন? ”
” তৃষা তুমি মা’কে নিয়ে বসো আমি দেখছি।”
তৃষা আমেনা ইসলামকে নিয়ে অনিমার লাশের পাশে গিয়ে বসলো। আমেনা ইসলাম শেষ বারের মতো চঞ্চল মেয়েটাকে দেখতে চাইছেন। কিন্তু এক্সিডেন্টের কারণে চেহারা দেখতে বিশ্রী লাগায় সবাইকে দেখতে বারণ করছে অনেকেই। কিন্তু আমেনা শুনলেন না। তৃষাকে জোরাজোরি করলেন। শেষে তৃষা মুখের উপর থেকে কাফনের কাপড় সরিয়ে দিলো। ছ্যাঁত করে উঠলো আমেনার বুকটা। এই তো সেদিনও বাসায় এসেছিল মেয়েটা! কতো কতো প্ল্যান ছিলো তার। বাড়িতে এসে কোন কোন কাজ সে করবে সবকিছু বলে রেখেছিল আয়ানের মা’কে। আমেনা ইসলামও অনিমার চঞ্চলতার মধ্যে তাহমিকে খুঁজে পেতো। নিজের আরেকটা মেয়ের মতোই ভালোবাসতেন অনিমাকেও। এভাবে মেয়েটা একদিনের মধ্যে নাই হয়ে গেলো? ছেলেটাকে কীভাবে সামলাবেন সে নিয়েও মনটা খচখচ করছে আমেনার। আয়ানের বাবা এরমধ্যে এসে অনিমার বাবার সাথে দেখা করতে গেলেন।

” আয়ান? শক্ত হও জেন্টলম্যান। মা এসেছেন। ”

আয়ানের জ্ঞান ফিরতেই উঠে বসেছে। আশেপাশে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছে সে। অনিকের বুঝতে বাকি নেই আয়ানের চোখজোড়া ভুলবশত এখনও অনিমাকেই খুঁজছে। মেয়েটা খুব ভাগ্যবতী ছিলো। পুরুষ মানুষের চোখের জল যে নারীর জন্য ঝড়ে নিসন্দেহে সে ভাগ্যবতী। আয়ান আমেনা ইসলামকে দেখে উনার পাশে গিয়ে ফ্লোরে বসেছে। অনিমার মুখ ঢেকে দিয়েছে তৃষা।
” বাবা আয়ান, কথা বলছিস না কেনো? কথা বল! অনিমাকে শেষবারের মতো কিছু বলবি না ওকে? ”
মায়ের কথায় শব্দ করে কেঁদে উঠল আয়ান। অনিমার লাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠে কান্নার বেগ আরও বাড়ালো। উপস্থিতি সবাই তাকিয়ে আছে আয়ানের দিকে। আয়ান সবকিছু ভুলে অনিমাকে জড়িয়ে ধরে গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগলো। আয়ানের কান্না দেখে অনিকেরও দু-চোখ ছলছল করছে। আমেনা ইসলাম তো আগে থেকেই কাঁদছেন। তৃষা ওড়নায় মুখ গুঁজে ভাইয়ের আহাজারি দেখছে। কলিজা পুড়ে যাচ্ছে ছেলেটার।
” অনিমা? এই অনিমা? এভাবে পারলে স্বার্থপরের মতো আমাকে ছেড়ে যেতে? তুমি না বলতে আমাকে কখনো একা রেখে কোথাও যাবে না? মরলেও পেত্নী হয়ে ঘাড়ে চাপবে? কই! তোমাকে তো দেখতে পাচ্ছি না আমি। অশরীরী হয়ে আসতে তো পারো? আমি কীভাবে বাঁচব তোমাকে ছাড়া? বাড়িতে বিয়ের জন্য সবকিছু কত সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। আমাদের বিয়েটা হলো না অনিমা! আমাদের এক হওয়া হলোনা, একটা সংসার হলো না। আচ্ছা কে আমাকে জ্বালাতন করবে এখন? কে হুটহাট বিব্রত করবে বলো তো? এই অনিমা আমি আর কখনো তোমাকে বকবো না। এখুনি লাফিয়ে আমার কোলে উঠতে পারো না? ”
তৃষা মা’কে জড়িয়ে ধরে ঠুকরে কেঁদে উঠে। আমেনা ইসলামের নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। চোখের সামনে বসে সন্তানকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখেও মা হয়ে কিছু করতে না পারার যন্ত্রণা মারাত্মক। সবাই আয়ানের কষ্ট দেখে চুপ হয়ে গেছে। পুরুষ মানুষের কান্না কী বিশ্রী রকমের ভয়ংকর তা না দেখলে কেউ বুঝবে না। আয়ানের চিৎকারে শেষমেশ সত্তার শেখও বসার ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছেন। অনিমার জন্য আয়ানের এতো ভালোবাসা দেখে বড্ড আফসোস হচ্ছে উনার। পোড়া কপাল না হলে এই ভালোবাসা উপেক্ষা করে কেউ পৃথিবী ছাড়ে? কপালে ছিলো না মেয়েটার এতো সুখ। এরমধ্যে সহন ও তাহমিও এসে গেছে। তাহমি সাকিনকে নিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। কী বলে যে ভাইকে স্বান্তনা দিবে সে ভাষা তাহমির জানা নেই। ভেবেছিল ভাইয়ের বিয়েতে কতো আনন্দ করবে,খাবে। আর কী হলো? নববধূ সাজে যাকে দেখার কথা ছিলো আজ সে লাশ হয়ে শুয়ে আছে ভাইয়ের কোলে! সহন ও অনিক মিলে আয়ানকে ধরে লাশের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে। বাকিরা অনিমার লাশকে জায়গায় শুইয়ে দেয় আবারও। সত্তার শেখ বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। তাই নিজের ঘরে গিয়ে বসলেন। সৃষ্টিকর্তা যখন তার স্ত্রীকে নিয়ে গেলেন তখনও এতটা কষ্ট হয়নি। পৃথিবীতে হয়তো সন্তানের প্রতি ভালোবাসার চেয়ে আর কারো প্রতি বেশি ভালোবাসা থাকে না।

জীবন কারো জন্য থমকে থাকে না। শুধু জীবনের প্রতিটি দিন সেই মানুষটার অভাবে দূর্বিষহ লাগে। আয়ানেরও হচ্ছে তাই। অনিমা ছাড়া বেঁচে থাকলেও তা জীবন্ত লাশের মতোই বেঁচে থাকা মনে হয় তার কাছে। মেয়ের চলে যাওয়ার ঠিক সপ্তাহ খানেকের মধ্যে সত্তার শেখও ইন্তেকাল করেন। ভদ্রলোকের আগেই জটিল রোগ ছিলো শরীরে। কিন্তু সে কথা কখনো প্রকাশ করেননি তিনি। লিউকেমিয়া হয়েছিল উনার। একেবারে লাস্ট স্টেজে ছিলো বলে ডাক্তার আগেই বলেছিল বেশি দিন নেই তার হাতে। তাই তো মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে নিজের যাবতীয় সম্পত্তির সত্তর ভাগ আয়ানের নামে করে দিয়ে গেছেন সত্তার শেখ। বাকি ত্রিশ ভাগ বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। আয়ান কিছু নিতে চায়নি প্রথমে। কিন্তু পরে অনিমার বাবার চিঠি পড়ে সবকিছু নিজের করে নিয়েছে। অনিমার ভীষণ ইচ্ছে ছিল, একদিন দেশের নামকরা বিজনেসম্যান হবে আয়ান। কিন্তু আয়ানের অত বড়ো হওয়ার ইচ্ছে কখনো ছিল না। কিন্তু এখন আছে সেই ইচ্ছে। প্রেয়সীর সব ইচ্ছে পূর্ণ করার চেষ্টা করছে আয়ান। অনিমার ইচ্ছে মতো একটা কোচিং সেন্টার খুলে সেখানে মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বারো জন টিউটর সেখানে কাজ করে। মূলত যখন আয়ান অনিমাকে পড়াতো তখুনি এই ইচ্ছার কথা বলেছিল অনিমা। টাকাপয়সার তাই কোনো অভাব নেই এখন আয়ানের। কিন্তু মনের শান্তি? সে হয়তো চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে। আগের মতো আর কথা বলে না আয়ান। সব সময় মেপে মেপে কথা বলে। সারাক্ষণ কাজকর্ম দিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখাই যেনো তার একমাত্র করণীয় বিষয়।

বিছানার চাদরটা একপাশ থেকে অন্য পাশে টেনে নিয়ে, বালিশ দুটো নিয়ে টানাটানি করছে সাকিন। কিন্তু বালিশের ওজন বেশি হওয়ায় টেনে কুলচ্ছে না। তাহমি গেছে গোসল করতে তাকে রেখে। ফরিদা খান যোহরের নামাজে ব্যস্ত। সহনের আসার সময় হয়ে গেছে ভেবেই দ্রুত গোসল করতে গেলো তাহমি। কিন্তু ওয়াশরুমে বসে ঘরের মধ্যে জিনিসপত্র ফেলার শব্দ শুনে গলা উঁচিয়ে সাকিনের উদ্দেশ্য বললো,
” সাকিন! কী ফেললে বাবা? কিছু ফেলো না। আমি এখুনি আসছি।”
মায়ের গলার আওয়াজে দুষ্ট হাসি দিলো সাকিন। বয়স তার তিন বছর। এলোমেলো পায়ে হাঁটে সে,কথা বলে আধো আধো। বয়সের তুলনায় সবকিছু স্লো একটু।
” আম্মা থুমি এচো না। আমাল কুব ভালো লাগে চবকিচু পেলতে হিহি।”
এই বলে সাকিন ড্রেসিং টেবিলের উপর থাকা সবকিছু আবারও ফেলতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। তাহমি যা বোঝার বুঝে গেছে। আজকে নিশ্চিত ঘরের দফারফা হয়ে যাবে। উফ ছেলেটাকে নিয়ে আর পারে না। তাহমি তড়িঘড়ি করে গোসল সেড়ে বেরিয়ে এসে দেখে ফ্লোরে দুপাশে লিপস্টিক, চিরুনি, কাজল, বডিস্প্রে ছড়িয়ে বসে আছে সাকিন। চেহারার একপাশে লাল অন্য পাশে কালো। মানে একপাশে লিপস্টিক মেখেছে আর অন্য পাশে হলো কাজল।
” সাকিন! এসব কী? তোমাকে সুন্দর করে গোসল করিয়ে রেখে গেলাম না? এরমধ্যে চেহারার অবস্থা কী করেছো?”
” আমি সাজু কলেচি আম্মা।”
হাতে লিপস্টিক নিয়ে হেসে হেসে বললো সাকিন। তাহমি কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে সবকিছু উঠিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখলো আবারও। এরমধ্যেই কলিংবেলের আওয়াজ ভেসে এলো। তাহমি এক দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো।
” কী ব্যাপার? এমন হাঁপাচ্ছ কেনো তুমি? ”
সহনের প্রশ্নের উত্তর দিলো না তাহমি। শুধু ইশারায় বোঝাল পরে বলবে। মেয়েটা এক দৌড়ে আবারও নিজের ঘরে গেলো সাকিনের কাছে। ঘরে এসে দেখে আবারও সবকিছু ফ্লোরে নামানোর ব্যবস্থা করতেন ব্যস্ত সাকিন সাহেব। তাহমির মেজাজ বিগড়ে গেলো তাতে। সবকিছু জায়গায় রেখে চোখ রাঙিয়ে বললো ছেলেকে,
” এই সাকিন! আর যদি দেখি এসব করতে তাহলে কিন্তু বেঁধে রাখবো তোমাকে। ”
মায়ের শাষণে চোখমুখ কুঁচকে ফেললো সাকিন। এরমধ্যে ঘরে সহন এসে ঢুকল। বাবাকে দেখে ফ্লোরে বসে পড়লো সাকিন। ঠোঁট বেঁকিয়ে কান্না জুড়ে দিলো অনায়াসে। সহন হাতের ব্যাগ রেখে এগিয়ে গেলো ছেলের কাছে। কোলে তুলে নিয়ে শুধালো,
” কী হয়েছে? কাঁদছ কেনো বাবা?”
” আম্মু শুধু চবসময় লিজে সাজুগুচু কলে বাবাই। আমকে সাচায় লা। তাই আমিও একতু সাচতে গেচিলাম ব্লে বকচে ডেকো আ্যা…..”
সাকিনের কথায় ফিক করে হেসে উঠলো সহন। তাহমি রেগে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। সারাদিন জ্বালিয়ে মারে এখন আবার বাবার কাছে নালিশ হচ্ছে!

চলবে,