বর্ণচোরা পর্ব-০১

0
429

#বর্ণচোরা
#সূচনা_পর্ব
#স্নিগ্ধতা_প্রিয়তা

সকাল থেকেই গুড়িগুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। থামার নাম নেই। অরুনিতা বিছানা থেকে দুইবার উঠে আবার শুয়ে পড়েছে বৃষ্টি দেখে। আজ আর ভার্সিটি যাওয়ার ইচ্ছে নেই। ওকে দ্বিতীয়বারের মতো বিছানায় আসতে দেখে ওর মা ওর রুমে এসে বলল,

–“কিরে আবার শুয়ে পড়ছিস যে। ভার্সিটি যাবি না?”

মায়ের কথা শুনে অরুনিতা কাথাটা গায়ে টেনে নিতে-নিতে অলসতায় জড়ানো কন্ঠে বলল,

–“এই বৃষ্টির মধ্যে কে ক্লাসে আসবে! বাদ দাওতো মা। আজ আর যাবো না। একটু শান্তি মতো ঘুমাতে দাও।”

বেলা ৮টার সময় মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে অরুনিতার মা কিছুটা রাগান্বিত স্বরে বলল,

–“এই মেয়েকে নিয়ে হয়েছে যত জ্বালা! একটা কাজে কখনো হাত লাগায় না! একা-একা সব করি এটা ভেবে যে, পড়াশোনা করে মানুষ হোক! সেটাতেও ডাব্বা! মেট্রিক আর ইন্টার দুইটাতেই টেনেটুনে পাস! সরকারি কোনো ভার্সিটিতেতো চান্স দূরে থাক! পরীক্ষা দেওয়ার যোগ্যতাই ছিলো না! ভাইদের টাকা পাইছে আর বেসরকারিতে ভর্তি হলো! তাও যদি ঠিকমতো ক্লাস করে! কত করে বললাম মেয়েকে আর পড়াতে হবেনা! বিয়ে দিয়ে দাও! কে শোনে কার কথা! ভাই দুইটাও বোনকেই সাপোর্ট করবে! নিজেরা সংসার করা বাদ দিয়ে সব টাকা বোনের পেছনেই নষ্ট করছে! বিয়ে করলে বউরা যখন কথা শুনাবে তখন বুঝবে যে, টাকা জমাতে হয় কিনা! ”

মায়ের চেঁচামেচি শুনে অরুনিতার বড় ভাই নেহাল এগিয়ে এসে মাকে উদ্দেশ্য করে বলল,

–“মা তুমি সকাল বেলাই ওর কান-মাথা খাচ্ছো কেন! নাস্তা দাও তাড়াতাড়ি। অফিসে দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

ওর মা কিছু বলার আগেই অরুনিতার আরেক ভাই নিবিড় এসে বলল,

–“মা তুমি আমাদের নাস্তা দেওয়া বাদ দিয়ে এখানে কি করছো! আমার ভার্সিটির দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর অরু কি এখনো তৈরি হয়নি?….অরু! এই অরু! তাড়াতাড়ি উঠে রেডি হয়ে নে।”

অরু যে প্রাইভেট ভার্সিটিতে পড়ে নিবিড় সেই ভার্সিটির টিচার৷ ও আছে বলেই বোনকে ওখানে ভর্তি করিয়েছে। অরু এইবার থার্ড ইয়ারে। অরুর অনার্স শেষ হলেই দুইভাই বিয়ে করবে বলে পণ করেছে। যা ওর মায়ের একদম পছন্দ নয়! বিয়ের বয়স পার হয়ে যাচ্ছে! অথচ বোনের জন্য দুইভাই পাগল!

অরুর মা নিবিড়কে লক্ষ্য করে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,

–“তোমাদের বোন নাকি আজ ভার্সিটি যাবে না! এই বৃষ্টিতে তার নাকি সমস্যা হচ্ছে!”

বলেই রুম থেকে বের হয়ে গেলো ছেলেদের নাস্তা তৈরি করার জন্য। নেহালও অরুকে ডেকে বের হয়ে গেলো। অরুর বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত আর্মি অফিসার। তিনি বাজারে গিয়েছেন।

নিবিড় অরুর রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলো যে, বৃষ্টি হচ্ছে না বললেই চলে৷ তাই অরুকে আস্তে করে ডেকে বলল,

–“আজ ভার্সিটি গেলে লাঞ্চে কাচ্চি খাওয়াবো!”

কথাটা বলতে দেরি অরুর বিছানা থেকে উঠতে দেরি হলো না। উঠেই নিবিড়কে লক্ষ্য করে ন্যাকামি গলায় বলল,

–“আমার ভাইয়া পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাইয়া! আমি এক্ষুনি রেডি হয়ে আসছি!”

বলেই বাথরুমে চলে গেলো অরু। নিবিড় নিজের বোনের ছেলেমানুষী দেখে হেসে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। ওর মা তখন ওর নাস্তা দিতে-দিতে বলল,

–“এই তোরা দুইভাই মিলেই মেয়েটাকে আরো ব*দমায়েশ বানাচ্ছিস! এর ফলাফল কিন্তু ভালো হবে না বলে দিলাম! কোনো কাজ করতে দিবে না! কোনো কিছুর অভাব বুঝতে দিবে না! বিয়ের পর সংসার করতে হবে না! বোনকে কি সারাজীবন শোকেজে সাজিয়ে রাখবি নাকি!”

নেহালও মায়ের একথা গুলো শুনে ফেলল। তারপর চেয়ার টেনে বসতে-বসতে বলল,

–“মা তুমি এতো চিন্তা কেন করো বলোতো! ওর কি এখনি বিয়ে হচ্ছে নাকি! ও না চাইলে কখনো জোর করে ওর বিয়ে দেব না! ও যখন চাইবে তখনি ওর বিয়ে দেবো!”

বড় ছেলের মুখে এমন কথা শুনে অরুর মা রেগে ওখান থেকে যেতে-যেতে বলল,

–“বিয়ে করো না তোমরাও ততদিন! এই বুড়ীটাকে খাটাতেতো তোমাদের ভালো লাগে! ”

মায়ের কথায় নেহাল আর নিবিড় একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল। তারপর নিবিড় বিড়বিড় করে বলল,

–“দেখেছো ভাইয়া মা নাকি বুড়ী হয়ে গেছে!”

এমন সময় অরুও এসে নিবিড়কে বলল,

–“ভাইয়া আমি রেডি! তুমি আসো। আমি নিচে অপেক্ষা করছি!”

নেহাল বোনকে ডেকে বলতে লাগলো,

–“আরে পাগলী নাস্তাতো করে যা!”

অরু দরজার বাইরে যেতে-যেতে বলল,

–“আমি এখন নাস্তা করবো না! তোমরাতো জানো সকালে আমার কিছু খেতে ভালো লাগে না! আর ভাইয়া আজ আমাকে স্পেশাল ট্রিট দিবে!”

বলেই দুই ভাইয়ের থেকে আড়াল হয়ে গেলো অরু।

দুইভাই নাস্তা শেষে মাকে বিদায় জানিয়ে বেড়িয়ে পড়লো যার যার গন্তব্যের দিকে। ততক্ষণে ওর বাবাও চলে এসেছে বাজার নিয়ে।

নিবিড় বাইক স্টার্ট দিলে অরু উঠে বসলো। তারপর দুই ভাইবোন ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। গুড়িগুড়ি বৃষ্টিতে দুজনেই হাল্কা ভিজে গেলো।

অরুকে ওর ডিপার্টমেন্টের সামনে নামিয়ে দিয়ে বাইক পার্ক করে নিবিড় চলে গেলো।

অরু ক্লাসে ঢুকতেই ওর বান্ধবী তন্বী ওর দিকে টিস্যু এগিয়ে দিয়ে বলল,

–“আমার প্রাণের ননদিনীটা যে ভিজে একদম কাক হয়ে গেছে! আসো আমি মুছে দিচ্ছি! আমার ননদিনীর ভাইটাও বুঝি ভিজে গেছে!”

এই বলে ও অরুর দিকে এগিয়ে গেলে অরু একটু পিছিয়ে গিয়ে বলল,

–“থাক ভাই তোমার টিস্যু লাগবে না! তোমার মতো রাক্ষুসির ননদিনী আমি হতে চাই না!”

ওর কথা শুনে পাশ থেকে অরুর আর সব বান্ধবীরাও উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। তন্বী তখন অরু আর সবার উপরে রাগ করে মুখ গোমড়া করে নিজের সিটে বসে পড়লো। এটা যেন এখন ওদের ক্লাসের নিত্যদিনের রুটিন হয়ে গেছে। তন্বী নিবিড়কে পছন্দ করে এটা অরুদের ক্লাসের সবাই জানে। তাই সব সময় অরুসহ সবাই তন্বীকে নিয়ে মজা করে। তবুও তন্বী থামবে না!

তন্বীর গোমড়া মুখ দেখে অরুও মুখটায় একটু দুখী ভাব নিয়ে তন্বীর পাশে বসে বলল,

–“আমার ভাবিটা বুঝি রাগ করেছে! কইগো তোমার টিস্যু! দাও, আমাকে একটু মুছিয়ে দাও! দেখো তোমার ননদিনীকে ওই বৃষ্টির পানিগুলো কেমন ভিজিয়ে দিয়েছে!”

তন্বী তখনো মুখটা ওর থেকে ঘুরিয়ে রেখেছে। তারপর আস্তে-আস্তে অরুর দিকে তাকিয়ে বলল,

–“আমি রাক্ষসী তাই না! আর তোমার ভাই তাহলে একটা খোক্ষস! আর তুই হচ্ছিস একটা…! ”

অরু ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

–“না ভাই আমি অরুই থাকতে চাই! আরকিছু হওয়ার দরকার নেই! তোমাদের রাক্ষসী আর খোক্ষসের সংসার নিয়েই তোমরা থাকো!”

একথা শেষ হতে না হতেই ক্লাসে স্যার চলে আসলো। তন্বী তখন অরুকে উদ্দেশ্য করে ফিসফিসিয়ে বলল,

–“নেহাল ভাইয়া বিয়ে করবে কবেরে?”

অরুও তন্বীর মতো ফিসফিস করে বলল,

–“লাভ নেই! আমার দুইভাই চিরকুমার থাকবে বলে পণ করেছে!”

অরুর এই কথা শুনে তন্বী জোরে করে বলে উঠলো,

–“কি!”

স্যার তখন ক্লাস নেওয়া শুরু করে দিয়েছে। তন্বীর এমন চিল্লাতে দেখে তিনি ওকে দাঁড় করিয়ে বললেন,

–“কি ব্যাপার তন্বী তুমি এমন চিলাচ্ছো কেন? আমি ক্লাস নিচ্ছি তা তোমার পছন্দ হচ্ছে না? আমার ক্লাস ভালো না লাগলে ক্লাস থেকে বের হয়ে যাও। ”

তন্বী কিছু বলতে যাচ্ছিলো তার আগেই স্যার আবার ওকে একটা ধমক দিয়ে বলল,

–“আমি কি বলেছি কানে যায়নি! এক্ষুনি আমার ক্লাস থেকে বের হয়ে যাও! আর ভালো না লাগলে আমার ক্লাসে আসবে না!”

তন্বী অরুর প্রতি রাগে ফুসতে-ফুসতে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেলো। আর বিড়বিড় করে বলতে লাগলো,

–“তোকে আমি দেখে নেবো অরু! আমার সাথে টক্কর! ”

অরুও তন্বীর চলে যাওয়া দেখে মিটিমিটি হাসতে লাগলো।

ক্লাসের পর তন্বী আর অরুর সাথে কথা বলল না। অরুর ওকে সরি বলার পরেও না। মাঝেমধ্যেই ওরা এমন ফাইজলামি করে থাকে। কিন্তু অরু আজ একটু বেশিই করে ফেলেছে৷ পুরো ক্লাস তন্বীকে ক্লাসের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছে।

অরু নিবিড়ের জন্য ক্যান্টিনে অপেক্ষা করছিলো। একটা ফাঁকা টেবিল পেয়ে ওখানে বসে পড়ে অরু৷ তারপর নিবিড় এসে বলল,

–“আমি অর্ডার দিয়ে যাচ্ছি, তুই খাওয়া শেষ করে চলে যাস। আর আজকে তুই রিকশা করে চলে যাস। আমার একটা মিটিং আছে।”

অরু “হুম” বলে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছিলো। তখন ওর পাশে অন্য একটা ছেলে এসে বসলো। অরুর মনোযোগ ফোনের দিকে থাকায় ছেলেটিকে খেয়াল করেনি৷ একটু পরেই ক্যান্টিনের ছেলেটা এক প্লেট কাচ্চি টেবিলের উপরে রাখতেই অরু প্লেটটা নিজের দিকে নিয়ে খাওয়া শুরু করলো।

অরু হঠাৎ খেয়াল করল যে, ওর সামনে থাকা ছেলেটা ওর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অরু আড়চোখে একবার দেখে নিলো যে, সত্যিই ছেলেটা ওর দিকে চেয়ে আছে কিনা। তারপর যখন সিওর হলো যে ছেলেটা ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। তখন একটু রাগী সুরে বলল,

–“এই যে মিস্টার! এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন কেন? আপনি কি আমাকে চিনেন?”

ছেলেটা তখন হাসিমুখে বলল,

–“আপনি আমার জন্য দেওয়া খাবারটা খাচ্ছেন ম্যাডাম!”

–“এই খাবারে কি আপনার নাম লেখা আছে নাকি! আর আমার ভাইয়াও খাবার অর্ডার করে গেছে বলেই আমি খাচ্ছি!”

অরু একথা বলতেই ক্যান্টিনের ছেলেটা আরেক প্লেট কাচ্চি এনে ওই টেবিলে দিয়ে অরুকে লক্ষ্য করে বলল,

–“এই টেবিলে উনি আগে এসে খাবারটা অর্ডার করেছিলেন আপা! আপনার অর্ডারটা এখন আনলাম….. আচ্ছা ভাই আপনেই এইটা নেন! একিতো! ”

অরু তখন নিজের ব্যাবহারে লজ্জিত হয়ে বলল,

–“সরি! আমি ভেবেছিলাম…”

ছেলেটি নরম সুরে হাসিমুখে বলল,

–“ইটস ওকে! কোনো সমস্যা নেই!”

অরু কোনোমতে খাওয়া শেষ করে ক্যান্টিন থেকে বাইরে চলে আসলো। আজ আর ক্লাস নেই ওর।তাই ভার্সিটির গেইটের সামনে এসে রিকশার জন্য অপেক্ষা করছিলো। হঠাৎ ওই ছেলেটাও ওর পাশে এসে দাঁড়ালো। ছেলেটার তাকানো দেখে ওর কেমন যেন লাগছিলো৷ ও একটু সরে দাঁড়াতেই ছেলেটি ওর সামনে গিয়ে বলল,

–“আপনি কি অরুনিতা?”

অরু ওই ছেলেটির মুখে নিজের নাম শুনে চমকে গিয়ে বলল,

–“আপনি আমাকে চিনেন?”

চলবে…?