বাঁধনহীন সেই বাঁধন অকারণ পর্ব-১০

0
535

#বাঁধনহীন_সেই_বাঁধন_অকারণ|১০|
#শার্লিন_হাসান

রাইহান চৌধুরী চলে এসেছে রুদ্রর ফ্লাট থেকে। গাড়ীতে বসে এক ধ্যাণে বাইরে তাকিয়ে আছেন তিনি। জাফিয়ার মুখটা ভেসে আসছে বরাবর চোখের সামনে। ইশশ জাফিয়াকে বাচাতে গিয়ে তার খু’নি হয়ে গেলাম। জারিফ জাফিয়ার মতোই। ফাইজা চৌধুরী নিজের বান্ধুবীর মেয়েকে রাইহান চৌধুরীর বউ করে নিজের ঘরে আনেন। নিজের বিয়ের পর ও কথা দিয়েছিলেন জাফিয়াকে রাইহান চৌধুরীর বউ বানাবেন। অথচ রাইহান চৌধুরী সাদিয়াকে আগে থেকে ভালোবাসতেন। মায়ের পছন্দে বিয়েটা মানতে পারেননি। জাফিয়াকে বিয়ে করার ছয়মাস পরই তিনি দেশের বাইরে চলে যান। সেখানে তিনবছর থেকে দেশে আসেন। মূলত বিজন্যাস এর বাহানা ছিলো। দেশে আসার পর,পরই সাদিয়ার সাথে গোপনে বিয়ে করেন। তার কয়েক মাস পর সাদিয়া প্রেগন্যান্ট হয়। সবই একটা ঘোর লাগা ছিলো। বিয়েটা মনে হলো ফাঁসিয়ে করে নিয়েছে সাদিয়া। আর তাদের ফিজিক্যাল ইনভলব সেটাও একটা পার্টিতে গিয়ে। বিয়ের পর, পরই বুঝতে পারেন রাইহান চৌধুরী অনেক বড় ভুল করেছেন। অন্তত রুদ্রর দিকে তাকিয়ে সাদিয়াকে ডিভোর্স দিতে চেয়েছেন তিনমাসের মধ্যে। যোগাযোগ বন্ধ করে দেয় সাদিয়ার সাথে। একদিন অফিসে বসে কাজ করছিলেন রাইহান চৌধুরী। তার পেছন দিয়ে সাদিয়া যায় অফিসে।

তাকে ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে ক্লাবে নিয়ে যায়। সেখানেই ঘটে যত অঘটন। তার পনেরোদিনের মাথায় সাদিয়া জানায় সে প্রেগন্যান্ট। কী করবে বুঝতে পারছিলেন না রাইহান চৌধুরী। পনেরোদিন আগে জাফিয়ার প্রেগন্যান্সি চেক করে। তখন রাখির বেবিবাম্প। এদিকে সাদিয়া প্রেগন্যান্ট। সাদিয়াকে এভোরশান করিয়ে ফেলার জন্য বলে রাইহান। সাদিয়া সেটা শোনেনি।

এরই মাঝে বছর গড়িয়ে যায়। রাখি আসে দুনিয়ায়। রাইহান চৌধুরীর বেশ ভালো কাটছিলো সময়। দুই সন্তানকে নিয়ে। তবে মনের মাঝে একটা ভয়ই কাজ করতো। সেটা হলো সাদিয়া আর তার সন্তান আয়মান। রাখির বয়স তিনবছর জারিফের বয়স সাতবছর ছিলো।

সেদিন ফাইজা চৌধুরী তার মেঝো ছেলের বাড়ীতে গিয়েছিলো। রাইহান চৌধুরী বেলকনিতে বসে ছিলেন। জাফিয়া রুমে আসে। সেদিন জাফিয়া বেশ রেগে ছিলে।
রাইহান চৌধুরী বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। প্রশ্ন করেন,

-কিছু বলবে জাফিয়া?

-সাদিয়াকে আপনি বিয়ে করেছেন? সাথে আপনার একটা বাচ্চা ও আছে?

-না তুমি ভুল বুঝেছো?

ঘাবড়ে গিয়ে বললেন রাইহান চৌধুরী। জাফিয়া তাচ্ছিল্য হেসে বলে,

-কাগজকলমের সই কখনো মিথ্যে হয়না। আপনাদের বিয়ের কাবিননামা সবই দেখেছি। কী করে পারলেন আপনি? দু’টো বাচ্চার দিকে তো তাকাতে পারতেন?

-হ্যাঁ আমি আমার বাচ্চাদের ভালোবাসি। একটু বেশী ভালোবাসি। সেজন্য সাদিয়াকে ডিভোর্স দিতে চেয়েছি। গোপন রাখতে চেয়েছি বিষয়টা সাদিয়া মানেনি সেদিন আমায় ক্লাবে নিয়ে যায় জোর করে। আমি হুঁশে ছিলাম না। বাকীটা সাদিয়া ভালো জানে। আয়মান আমার সন্তান কী না।

রাইহান চৌধুরীর কথাটা জেনো তীরের মতো আঘাত করলো জাফিয়ার বুকে। এরই মাঝে সাদিয়ার আগমন ঘটে রুমে।সাদিয়াকে দেখে জাফিয়া বলে,

-লজ্জা করলো না বিবাহিত পুরুষের দিকে নজর দিতে? নারী হয়ে নারীর সংসার ভাঙতে বুক কাঁপলো না?

-কিসের সংসার? রাইহান আমার ভালোবাসা। ওকে পেতে সবই করতে রাজী আমি।

-এই মুহুর্তে আমাদের বাড়ী থেকে বেড়িয়ে যাবে তুমি।
আমার স্বামী তোমায় ডিভোর্স দিয়ে দিবে আর তোমার সন্তানের ডিএনএ টেস্ট করাবে।

-তুমি বেড়িয়ে যাও বাড়ী থেকে। আমার স্বামী তোমায় ডিভোর্স দিবে। তোমার মতো আমার ও অধিকার আছে সবকিছুতে।

-রাইহান চৌধুরী আমি কী বলেছি শুনেছেন? আপনার দ্বিতীয় বউকে বলুন চলে যেতে।

-সাদিয়া চলে যাও। ডিভোর্স লেটার পেয়ে যাবে কয়েকদিনের মধ্যে।

রাইহান চৌধুরীর কথায় সাদিয়া হাসে। শব্দ করে হাসে। অতঃপর বলে,

-তোমাকে আর কারোর সংসার ভাঙা জোড়ার হিসাব করতে হবে না। উপরে বসে,বসে নিজের বাচ্চাদের ভালোবাসা আর দো’আ দিও।

কথাটা বলে জাফিয়াকে একটা ধাক্কা দেয় সাদিয়া। যার ফল স্বরুপ সে নিচে পড়তে যাবে রাইহান চৌধুরী তাকে ধরে আগলে নেয়। এরই মাঝে দস্তাদস্তি হয়। রাইহান চৌধুরী সাদিয়াকে আটকাতে যাবে তখন আবার তার মাথায় ভাজ দিয়ে আঘাত করে সাদিয়া। ছিটকে সরে যায় রাইহান চৌধুরী। আবারো জাফিয়ার গলা চেপে ধরে সাদিয়া, তখন জাফিয়ার প্যানিক এ্যাটাক হয়। রাইহান চৌধুরী সাদিয়াকে সরিয়ে দেয়। তখন আবার রুদ্র রুম থেকে কিছুটা দূরে দাড়িয়ে। সাদিয়া অপজিটে থাকে বলে ওকে দেখতে পায় না রুদ্র।

রাইহান চৌধুরী তড়িঘড়ি রুমের দরজা লাগিয়ে দেয়। জাফিয়াকে বার কয়েক ডাকে কোন সেন্স আসে না। শ্বাস প্রক্রিয়া চলছে না। ঘাবড়ে যায় রাইহান চৌধুরী। তখন সাদিয়ার দিকে রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে।

-বেড়িয়ে যা আমার বাড়ী থেকে। ডিভোর্স পেপার্স পেয়ে যাবি কালনাগিনী কোথাকার।

উঠে দাঁড়ায় সাদিয়া। তেজ দেখিয়ে বলে,

-নে এবার এই দিকটা সামলা। এই সাদিয়ার কাছেই তোকে আসতে হবে ঘুরেফিরে।

বেড়িয়ে যায় সাদিয়া। রাইহান চৌধুরী সেখানে বসে রয়। জাফিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কী করবেন কী বলবেন ভেবে পাচ্ছেন না৷ এটা লোক জানাজানি হলে কী হবে? সবাই তাকেই ধরবে। লোকে ছি:ছি: করবে। রাইহান চৌধুরী তার বউকে খু’ন করেছে।

ফাইজা চৌধুরীকে কল দেয় রাইহান চৌধুরী। কী বলবে ভেবে পাচ্ছেনা। কথা আসছে না ভেতর থেকে। তবুও মিথ্যে বানিয়ে বলতে হবে।

নিজের বন্ধুকে কল দিয়ে সবটা বলে রাইহান চৌধুরী। যে তার আর সাদিয়ার বিয়ে থেকে সবই জানে। থানায় টাকা খাইয়ে মুখ বন্ধ করে দিতে বলে। সেদিকটা তার বন্ধু সামলে নেয়। ফাইজা চৌধুরী সহ চৌধুরী পরিবারের সবাই আসে। জাফিয়ার মৃত্যুটা প্যানিক এট্যাক বলেই চালিয়ে দেওয়া হয়। রাতের মধ্যে দাফন করা হয়। জাফিয়ার ভাই জিয়াউল আসে। এসব নিয়ে বেশ খোঁচাখুঁচি করে সে। তবে কিছুই পায়নি। থানায় টাকা দিয়ে মুখ বন্ধ করে রেখেছে।

তার বছর পেরুতে একদিন রুদ্র তার দাদীকে বলে দেয় সবকিছু। সেদিন হয় তুমুল ঝগড়া। সাথে সাদিয়ার সব সত্যি সামনে আসে। ফাইজা চৌধুরী রুদ্র, রাখিকে নিয়ে চলে আসে। রাইহান চৌধুরী ও চলে যায় সাদিয়া আয়মানকে নিয়ে অন্দরমহলে। সেখান থেকে তাঁদের আর যোগাযোগ থাকে না। এই নিয়ে জিয়াউলের সাথে কয়েকবার ঝগড়া, হুমকি-ধমকি হয়েছে রাইহান চৌধুরীর সাথে। এরপর থেকে কারোর সাথেই যোগাযোগ রাখেনি রাইহান চৌধুরী।

সেসব মনে পড়লে আজো ঘোরের মধ্যে আছেন রাইহান চৌধুরী। কী থেকে কী হয়ে গেলো। ছেলে মেয়ে দু’টো মা হারা হলেন। যথাযোগ্য প্রমাণ না থাকায় এগোতে পারেননি ফাইজা চৌধুরী। তাড়িয়ে দিয়েছিলেন রাইহান চৌধুরীকে। রুদ্র,রাখিকে নিজের কাছে রেখেই মানুষ করান। একটা সময় পর রাইহান চৌধুরী রুদ্র রাখির খরচের সব এমাউন্ট ফাইজা চৌধুরীকে হিসাব করে দিয়েছিলেন। মাসে,মাসে টাকাও পাঠাতেন তার দুই সন্তানের খরচের জন্য। নিতে চাননি ফাইজা চৌধুরী। রাইহান চৌধুরীর অধিকার ছিলো তার সন্তানদের উপর সেজন্য বেশী জোর খাটাতে পারেননি ফাইজা চৌধুরী।

বাড়ীতে আসতে মেজাজ আরো বেশী বিগড়ে গেলো রাইহান চৌধুরীর। তার ছেলে আয়মান বসে,বসে ভিডিও কলে কথা বলছে। তাও ঠোঁটকাটা মার্কা কথা। রাইহান চৌধুরী যে এসেছেন সেদিকে তার খেয়াল নেই।

-যাও রুমে যাও।

আয়মানকে উদ্দেশ্য করে বললো রাইহান চৌধুরী। আয়মান ও দেরী করেনি উঠে চলে যায়। সোফায় বসে পড়েন রাইহান চৌধুরী। আজো তার কাছে সব মিছে স্বপ্ন মনে নয়। একটা দুঃস্বপ্ন ছিলো। আসলেই আয়মান তার নিজের ছেলে তো?

*****
আরোহীকে দেখতে এসেছে পাত্রপক্ষ সেটারই তোরজোর চলছে চৌধুরী বাড়ীতে। রাখি যাবে চৌধুরী বাড়ীতে সাথে মেঘকেও নিয়ে যাবে। কিন্তু মেঘ যেতে নারাজ। সে যাবে না আগামী কালকে তার আন্টির বাসায় চলে যাবে।
রাখি জানে আরোহীর বিয়েটা হয়ত বা হয়ে যাবে। মেঘ এখন গেলে কম করে এক সপ্তাহ পর বাড়ী আসবে। মেঘ যেতে চায় না সেখানে রুদ্র আরিশ দু’জনই থাকবে। রুদ্রকে দেখলে তো এমনিতেও তার অনুভূতি, সব জেগে উঠে। মন বিষন্নতায় ডুবে যায়। তার উপর সে বাড়ীতে আরিশ ও আছে। এই সুযোগে মেঘকে জ্বালাবে। সেসব রিস্ক নিতে চায়না মেঘ। মায়া মোহনার কাছে যাবে সেখানে থাকবে।

রাতের ডিনার করে রুমে আসে রাখি মেহরাব। যাওয়া নিয়ে কথা উঠলে রাখি মেঘের কথা বলে মেহরাবকে।

-যেতে না চাইলে জোর করো না।

-আমি একটা কথা বলি মেহরাব?

-পারমিশন নিচ্ছো কেন বলো?

-আমার মনে হয় মেঘ রুদ্র ভাইকে পছন্দ করে। আর তার প্রতি দূর্বল। যখন শুনেছে আলিশার কথা মেঘ অনেক চেন্জ হয়ে যায়। হয়ত আলিশাকে মানতে পারেনি।

-কই আমার তো এমন মনে হলো না?

-সেদিন রুদ্র ভাই এই বাড়ীতে আসাতে মেঘ খুশি হয়েছে অনেক। নিজে নাস্তার ট্রে এগিয়ে দিলো। বেশ হাসিখুশি।

-ভুলে যেওনা রুদ্র ওর টিচার সেই হিসাবে ভক্তি দেখাবেই।

-তোমার কোন স্টুডেন্ট এমন ভক্তি দেখালে ও কী তুমি গলে যাবে?

রাখির কথায় মেহরাব বোকাবনে যায়। পরক্ষণে ভাবে রাখিকে একটু জ্বালানো যায়।

-হ্যাঁ কেনো নয়? স্টুডেন্ট ই তো।

-বিবাহিত তুমি। মাথাটা গেছে?

-তুমি বোকার মতো কথা বলো কেন?

-কী বলেছি?

-এই যে স্টুডেন্ট ভক্তি দেখালে আমি গলে যাবো। তোমার মাথায় আাসলে কী?

-ওই না মানে!!

-উল্টাপাল্টা চিন্তা করতে,করতে পাগ’ল হয়ে গেছো তুমি রাখি।

-হবে হয়ত। তবে মেঘ রুদ্র ভাইকে পছন্দ করে।

-ভুল মেঘ জেনেশুনে এমন করবে না।

-সত্য আমার কথা। তুমি দেখো মেঘ রুদ্র ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করবে।

-তুমি পাগ’ল? রুদ্রর জন্য কেন অপেক্ষা করবে? রুদ্র কয়েকদিন পর বিয়ে করবে আলিশাকে। আর মেঘকে অন্য জায়গায় আমরা বিয়ে দেবো। সেক্ষেত্রে মেঘর যতই পছন্দের হোক রুদ্র।

-মেঘ বিয়ে ভে’ঙে দিবে।

-দেবে না। মেঘ আমায় কথা শুনবে।

-মেঘ রুদ্র ভাইকে পছন্দ করে। আলিশার সাথে বিয়েটা ভাঙলে মেঘ নিজে বিয়ে করতে চাইবে।

-ফালতু কথা ছাড়ো রাখি আমার বোন এমন না। আর ও রুদ্রকে বিয়ে করতে যাবে না? রুদ্রকে আসা লাগবে।
আর আলিশার সাথেই রুদ্রর বিয়ে হবে।

-সেটা জানি।

#চলবে