বাঁধনহীন সেই বাঁধন অকারন পর্ব-০৯

0
344

#বাঁধনহীন_সেই_বাঁধন_অকারন|৯|
#শার্লিন_হাসান

আগামী কালকে মেঘের শেষ পরীক্ষা। পড়া শেষ করে বেলকনিতে বসে চাঁদ দেখছে মেঘ। অনেকগুলো মাস পেড়িয়ে গেলো অনুভূতি গোছানো,সাজানো,পাগলামির মধ্য দিয়ে। আজো ও মনে পড়ে রুদ্রকে নিয়ে নিজের করা পাগলামী গুলো। রুদ্রকে প্রথম যেদিন দেখেছিলো সেদিনই মেঘ অন্যরকম কিছু অনুভব করে। যেটা ভালো লাগা ছিলো তবে কয়েক দিনের মাঝে একটু বেশী প্রগাঢ় হয় অনুভূতি। প্রথম ক্রাশ,ভালো লাগা এবং এক তরফা ভালোবাসা রুদ্র। এই তো রুদ্রকে লুকিয়ে দেখা। রুদ্র একদিন কলেজে না আসলে ব্যকুল হওয়া। রুদ্রকে মিস করা। বাড়ীতে এসেও রুদ্রকে নিয়ে ভাবা। দিনশষে মনের কথা গুলো ডায়েরিতে লিখে রাখা। রুদ্রর হাঁটাচলা, কথাবলা, হাসি সব মস্তিষ্কের প্রতিটা নিউরনে,নিউরনে গেঁথে নিয়েছে মেঘ। রুদ্রর ভালোবাসার একজন মানুষ আছে জানার পর নিজেকে অনেকটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য মনে হয়েছিল। বিশেষ করে নিজের ভাবনাগুলো, কল্পনা। সবই! পাগলামী গুলো বাইরে থেকে গুছিয়ে নিলেও ভেতর থেকে পোড়ায়। হৃদয় পুড়ে দগ্ধ। ঠিক তখনি মেসেজের শব্দে আকাশের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নেয় মেঘ। ফোনে আরিশের পাঠানো একটা মেসেজ জ্বলজ্বল করছে। তাতে লিখা,

-আগামী কালকে দেখা করবো তোমার সাথে। কিছু কথা বলার ছিলো।

মেঘের সন্দেহ হয়। আরিশ কী বলতে চাইছে সেটা মাথায় চলে এসেছে। মাঝেমাঝে কথা হতো ফেবুতে আরিশের সাথে। মেঘ কখনো মেসেজ দেয়নি। আরিশ নিজেই তাকে নক দিতো। বেশী রিপ্লাই দিতো না মেঘ।

রাখি এসেছে মেঘের রুমে। মেঘকে বেলকনিতে বসে থাকতে দেখে সেও গেলো। মেঘ আজকাল মনমরা। কারণটা জানবে,জানবে করে জানা হয়নি রাখির।

-লাস্ট এক্সাম প্রিপারেশন কেমন,?

-আলহামদুলিল্লাহ ভালো।

-কোন কিছু নিয়ে চিন্তিত? এই আমার ননদিনী আবার ব্রোকেন হয়নি তো?

-ঠিকই ধরেছো আপু। আসলেই তোমার ননদিনী ব্রোকেন।

-তা ব্রোকেন বানালো কে?

-তোমার ভাই এছাড়া আর কে? কারোর সাহস আছে নাকী আমাকে ব্রোকেন বানানোর।

-আমার ভাই তো একজনই সামলাতে পারে না। আর তোমাকে প্রশ্নই আসে না। এতোদিন তো পাগ’ল হয়ে যেতো।

-হয়নি না? বুঝে নেও মেঘ ভালো হয়ে গেছে তাই দু’জন সামলাতে হিমশিম খেতে হয়না।

-হুম বুঝেছি জামাই দরকার তোমার?

-সত্যি বুঝেছো? আমি সিরিয়াস জানো আপু আমার দ্বারা এসব পড়াশোনা হবে না। তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে বিদায় করে দাও। একদম দূরে পাঠিয়ে দেবে যাতে এই শহর এই শহরের কোণায়,কোণায় পড়ে থাকা আমার স্মৃতি আমায় জ্বালাতে না পারে। একবারে মুক্তি চাই।

*****

কলেজে এসেছে রুদ্র। আজকাল মনটা একটু বেশী বিষন্নতায় কাটে। একাকিত্ব নেই সঙ্গ দেওয়ার মানুষ।
আলিশার সাথে সম্পর্কটা মলিন হয়ে গেলো। যাচ্ছে! রুদ্র তো আলিশাকে ভালোবাসে। আগলে রাখতে চায়। কিন্তু আলিশা তো রুদ্রর হতে চায় না। রোজ ঝগড়া,কথা কাটাকাটি, মলিনতা,মূল্যহীন,দূরত্ব। রুদ্র ভেবে পায় না কী হলো আলিশার। যেই মেয়ে রুদ্র বলতে পাগ’ল সেও আজ রুদ্রকে অবহেলা করছে। আসলেই নারীদের মন বোঝা বড় দায়। দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে অফিসের দিকে হাঁটা ধরে রুদ্র।

মনটা বড্ড খারাপ। আলিশাকে হারিয়ে ফেলার ভয় মনে জোকে বসেছে।

তার মাকে মেরে ফেলার পর থেকে সব ছেড়ে দিয়ে ছিলো রুদ্র। একা থাকা,কম কথা বলা। সবাইকে এড়িয়ে চলা। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করলো গোপনে সেখানে রাখির সমবয়সী একটা ছেলেও ছিলো। কী কঠিনতম দিন ছিলো সেদিন। যেদিন তার চোখের সামনেই তার বাবা তার মা’কে মেরে ফেললো। দরজার আড়ালে চুপটি করে দাড়িয়ে দেখেছিলো রুদ্র।

আলিশা রুদ্রর জীবনে আসার পর রুদ্র কিছুটা মুভ অন করেছিলো। সেটাও আলিশার কাছে। বাইরের মানুষের কাছে আগের রুদ্রই। না চাইতে আলিশাকে বড্ড বেশী ভালোবাসে রুদ্র।

হল ডিউটি শেষে অফিস কক্ষে আসে রুদ্র। আলিশার ফোনে কল দিতে ব্যস্ত দেখালো। তবে কী তাঁদের সাড়ে তিন বছরের সম্পর্ক শেষের পথে?

********

খোলামেলা একটা জায়গায় এসেছে মেঘ সাথে আছে হৃদ,লিমা। আরিশের জন্য অপেক্ষা করছে তারা। সাড়ি সাড়ি সাজানো গাছ সামনে বিশাল বড় লেক। জোয়ারে পানি ভাসছে। ঠান্ডা বাতাস দিনের অন্তিম প্রহরে খুব বেশী ভালো লাগছে।

-বাঙ্গির ছিলকা ইউর ক্রাশ বয় হোয়াইট মুরগি আওয়ার ফাদারের মুড অফ।

-পটল আর কত বার বলবো তার কথা আমায় বলবি না। লিমা এইডারে কতক্ষণ পানিতে চুবা। হা*লা মানুষ হবে না জীবনেও।

মেঘের কথায় তখন লিমা বলে,

-হৃদ মানুষ হ। পারলে জুনিয়ার কাউকে ইমপ্রেস কর।

-জুনিয়ারটা তো আমায় পাত্তাই দিচ্ছে না রে। তোরা প্লিজ ম্যানেজ করে দে। মাইশাকে আমার ভীষণ ভালো লাগে। ওর সাথে আমায় দারুণ মানাবে। ওটা তো বেশী লম্বা না। আমার হার্টবিট মাপতে পারবে।

হৃদের কথায় লিমা,মেঘ দুজনে হৃদের দিকে তাকায়। ব্রু কুঁচকে হৃদের দিকে তাকিয়ে আছে। তাঁদেরকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হৃদ বলে,

-এভাবে তাকানোর কী আছে? পরপুরুষেকে তো চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছিস। আমার বউ এভাবে আমায় দেখবে তোদের মতো লেসবুরা না।

-তোরে উ’ষ্ঠা না দিলে মানুষ হবি না পটলের বাচ্চা পটল।

-এক্সকিউজ মি?

মেঘের কথার মাঝে আরিশ বললো। আরিশের কথায় মেঘ সহ হৃদ, লিমা দু’জনে হুশে আসে। মেঘ মেকি হাসি টেনে বলে,

-বেয়াই দেখি লেট করে ফেলেছে। টাইম সেন্স কম!

-স্যরি আসলে রাস্তায় জ্যাম ছিলো প্রচুর।

-তা কী বলবেন বলুন তাড়াতাড়ি আমায় বাসায় যেতে হবে।

-সবার সামনে?

-তোহ? কী মনে হয় আপনার?

আরিশ কিছুটা লজ্জা পায়। মেঘ ও ব্যপারটা বুঝতে চাইছে না। এখনই যে ত্যাড়া,ত্যাড়া কথা বলছে সে আবার প্রপোজাল একসেপ্ট করবে?

-কী আর বলবে? প্রেম করার কথাই তো? কী মনে হয় আরিশ চৌধুরী মেঘ প্রেম করবে? উঁহু কক্ষনও না। মেঘ কাউকে ভালোবাসে,বেসেছে এবং দূর থেকে ভালোবেসেই যাবে। এই মনে রুদ্রকে স্থান দিয়েছে মেঘ অন্য কাউকে সে জায়গায় পুনরায় কীভাবে বসাই?

মেঘের ভাবনা বিচ্ছেদ ঘটলো যখন আরিশ বললে,

-দেখো আমি কথা গুছিয়ে বলতে পারি না। চোখের ভাষা অনেক কিছু বুঝায়,বুঝানো যায়। আবার অল্পবাক্যে মনের ভাষাও বুঝা যায়। আমি তোমাকে পছন্দ করি মেঘ এবং তোমার হাত ধরে বাকীটা জীবন কাটাতে চাই। জানি ভালো লাগা আর ভালোবাসা এক না। তবে আমি ভালোবাসতে চাই। ভালোবাসবে তো আমাকে?

-স্যরি আসলে আমি আমার আমিটাকে ছাড়া কাউকে ভালোবাসি না আর না বাসবো। আপনি আমাকে পছন্দ করেন এবং আমাকে ভুলে যেতে সময় ও লাগবে না এবং আমি চাই আমাকে ভুলে যান। আমি সম্পর্কে যাবো না। আর হ্যাঁ ভুলেও আমার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবেন না। যেমন আছেন তেমনই থাকুন।

হতাশ হয় আরিশ। হৃদের দিকে তাকালো। তারা ও নিরব দর্শক। আরিশ শুধালো। পরক্ষণে বললো,

-ভেবে দেখো?

-আসি মিস্টার চৌধুরী।

কথাটা বলে মেঘ উল্টো দিকে হাঁটা ধরে। তার সাথে আছে হৃদ, লিমা। আরিশ দাঁড়িয়ে মেঘের যাওয়া দেখছে। অনুভূতি প্রকাশ করে কী খুব ভুল করে ফেলেছি?

বাড়ীতে এসে ফ্রেশ হয়ে ছাঁদে যায় মেঘ। বিয়েটা যার সাথেই হোক তবে এই চৌধুরী পরিবারে না। চোখের সামনে নিজের ভালোবাসার মানুষ আরেকজনকে নিয়ে ভালো থাকবে না সরে আসা যাবে না সহ্য করা যাবে। তার চেয়ে দূরে সরে থাকাই শ্রেয় যাতে করে এসব কিছুই দেখতে না হয়।

ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে। শুধু রুদ্র!

-এই রুদ্র তো কোনদিন আমার হবে না। তাহলে কেনো তাকে এতো করে মনে স্থান দিচ্ছি? রুদ্রর জায়গায় অন্য কেউ ভাবলে জেনো সব থমকে যায়।

******

বেলকনিতে বসে আছে রুদ্র। সব কিছু শূন্য মনে হচ্ছে। আলিশা! ভাবলে মাথা কাজ করে না। এই মূহুর্তে মন চাইছে আলিশাকে জোর করে নিয়ে আসতে। খুব করে আগলে রাখতে। কিন্তু জোর করে কিছু তো আর হবে না। রুদ্রর ভাবনার মাঝে আলিশার কল আসে। মনটা কিছুটা শান্ত হয় রুদ্রর। কল রিসিভ করতে আলিশা চটজলদি বলে,

-আমি তোমাকে ভালোবাসি রুদ্র। তোমাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবো না। কিন্তু আমি শিকড়ে আটকে গেছি। যেই শিকড় কাটা যাবে না কাটলে আমার মর’ণ নিশ্চিত।

-চুপ করো আলিশা। কিসের শিকড়? তুমি চিন্তা করো না আমি খান বাড়ীতে প্রস্তাব পাঠাবো আমাদের বিয়ের।

-লাভ নেই রুদ্র। বাবা মা রোশানের সাথেই আমার বিয়ে দিবে।

-চলে আসবে আমার কাছে? বিয়ে করে নিবো। পরে সবাই একদিন হলেও মেনে নিবে সব।

রুদ্রর কথায় আলিশা উত্তর দেয় না। নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলে। ইশশ! কী দরকার ছিলো রুদ্রকে রেখে অন্য দিকে মন দেওয়ার? এখন চাইলেও কিছু করতে পারছে না আলিশা। রুদ্রর সাথে যে বেঈমানী করেছে সেটা রুদ্র জানলে তাকে ছেড়ে দিতে দু’বার ও ভাববে না।

-কী হলো আলিশা?

-কিছু না রুদ্র। মনে রেখো আমি যাই ভুল করেছি তোমার অজান্তে আমার অজান্তে তবে আমি শুধু তোমাকেই ভালোবাসি রুদ্র। তুমি আমার মানসীক শান্তি।

-এভাবে বলছো কেন? আমিই তো তোমার রুদ্র।

-হ্যাঁ জানি আমার রুদ্র। আমার রুদ্রকে আমি বেশ ভালো করেই চিনি। জানো না তোমার ডিকশনারিতে চিট শব্দটা নেই। আর চিট জিনিসটা তুমি অপছন্দ করো। আর যে তোমার সাথে চিট করবে তাকে ভুলে যেতে তোমার সময় ও লাগবে না। বলে ছিলে তো তুমি আমায়।

-হ্যাঁ বলেছিলাম। আমি বেঈমানদের পছন্দ করি না। তাঁদের ঘৃণা করি বড্ড বেশী ঘৃণা। সে আমার রক্তের আমার কাছের কেউ হলেও তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি আগলে রেখে মাথায় তুলতে পারি আবার আছাড় দিয়ে মাটিতে ও ফেলতে পারি।

এরই মাঝে রাইহান চৌধুরী এসেছে রুদ্রর ফ্লাটে। কলিং বেল বাজছে। রুদ্র কল রেখে দরজা খুলে দিলো। রাইহান চৌধুরীকে দেখে সালাম দিলো। এতেই বেশ সন্তুষ্ট হয় রাইহান চৌধুরী। তার ছেলে তাকে সন্মান দিচ্ছে।

ভেতরে এসে সোফায় বসলেন রাইহান চৌধুরী। রুদ্রকে দেখে তিনি বললেন,

-একা,একা আর কতদিন বাপ? এবার তো বিয়েটা করে নেও। বউমাকে নিয়ে অন্দরমহলে চলে আসো।

-অন্দরমহলে আমি যাবো না। আর বিয়ে করবো তো! সময় হলেই।

-আমি কিছু জানি না তুমি এই মাসের মধ্যে বিয়ে করে অন্দরমহলে চলে আসবা।

-না আমি যাবো না সেখানে। শুধু, শুধু আপনার সুখের সংসারে আগুন জ্বালানোর মানে হয় না। আমি এখানেই ঠিক আছি। বেশ ভালো আছি।

-বাবাকে পর করে দিচ্ছো জারিফ?

-জারিফ নামটা আমার মায়ের দেওয়া। সেটা উচ্চারণ করার অধিকার আপনি ছাড়া সবার আছে।

-আমার স্ত্রী ও। অবশ্যই আমার অধিকার আছে।

-ওহ আচ্ছা? স্ত্রী হলে সেদিন গলা চেপে মারতে হাত কাপলো না? আমার মায়ের কী দোষ ছিলো বলুন?

-আমি মারিনি ওকে। তুমি বিশ্বাস করো বাপ আমি বাঁচাতে চেয়েছি ওকে। অথচ দোষটা আমার ঘাড়ে পড়লো আর সব লুকাতে নাম দেওয়া হয় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। সব সত্যি সামনে আসবে বাপ। তুমি চিন্তা করো না।

-গলা চেপে মারলেন এখন হৃদরোগ! ভাবুন তো আপনি হেসে খেলে, সিংহের মতো দৌড়ে,গর্জন দিয়ে চলাফেরা করছেন অথচ আপনি একজন খু’নি সেটা হয়ত সবাই জানে না। কিন্তু আপনার নিজের কাছে খারাপ লাগে না?

-জারিফ তুমি ভুল বুঝছো।

-ব্যাস! অনেক হয়েছে আপনার দেওয়ার প্রোপার্টি এটা আপনার অধিকার আছে আসার। যদি আমার নিজের কেনা হতো তাহলে কখনোই আপনাকে এখানে আমি আসার অনুমতি দিতাম না।

-মানুষ মাত্রই তো ভুল বাপ। আর সেদিন যা দেখেছো সবই ধোয়াশা আমি জাফিয়াকে বাঁচাতে গিয়েছিলাম।

-হ্যাঁ ভুল তবে খু’ন করে সেটাকে নিজের ভুল বলে চালানোটা তো আর মানুষ মাত্র ভুল এই সঙ্গায় পড়ে না।

#চলবে