বাঁধিব হৃদয়ে তোমায় পর্ব-১৭+১৮

0
280

#বাঁধিব হৃদয়ে তোমায়
#পর্ব-১৭+১৮
#সুমাইয়া মনি

রতন বোস সকলের সঙ্গে বিভার পরিচয় করিয়ে, পরিশেষে আবিরের সঙ্গে পরিচয় করাতে এগিয়ে আসে।
‘ওনি হচ্ছেন আমাদের কোম্পানির মালিকের ছোট ছেলে আবির আহমেদ। বর্তমানে তিনিই এখন আমাদের কোম্পানির মালিক।’
বিভা ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,
‘হ্যালো! মি.আবির আহমেদ।’ বলে হাত বাড়িয়ে দেয়।
আবির কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে বাঁকা হেসে হাত এগিয়ে বলল,
‘হাই!’
‘তো? কেমন আছেন?’
‘যেমন রেখে গিয়েছিলে?’
‘হোয়াট?’ ভ্রু কিঞ্চিৎ ভাজ ফেলে বলল।
‘নাথিং।’ মৃদু হেসে বলল আবির।
বিভা কিছুটা বিরক্ত বোধ করে অন্য পাশে এগিয়ে যায়। একজন গার্ড চেয়ার এগিয়ে দেয় বসতে। বিভা বসে। ওর পাশে জিনি নামের মেয়েটিও বসেছে। আবির এক দৃষ্টিতে বিভাকে দেখছে। চোখের পলক ফেলার কোনো চান্স নেই।
এত বছর পর প্রিয়তমা’কে দেখে চোখ জুরিয়ে নিচ্ছে। তবে বিভার অদ্ভুত আচরণে তার মনে সন্দেহর বীজ তৈরী হয়েছে। জামিলা আশ্চর্যজনক কণ্ঠে বলে উঠে,
‘এ আমি কাকে দেখছি। এটা কি সেই বিভা…!’
‘যার ছিল না কোনো সাজসজ্জা, ড্রেসআপ..।’ মারুফ জামিলার সঙ্গে তাল মিলায়।
আবির পকেটে হাত পুরে বলল,
‘সময় যদি বদলাতে পারে। মানুষ কেন বদলাবে না?’
‘নিজেকে জারা বলে কেন পরিচয় দিচ্ছে। ওর নাম তো বিভা।’ জামিলা কুর্নিশ করে বলল।
‘নিজের সঙ্গে, পরিচয়ও পাল্টে নিয়েছে হয়তো।’ আবির স্বাভাবিক কণ্ঠে বলে।
জামিলা রাগ নিয়ে আবির’কে বলল,
‘তুই এত স্বাভাবিক আছিস কিভাবে? তোর রাগ হচ্ছে না বিভার ওপর? এই মেয়েটার জন্য তুই এত বছর কত যন্ত্রণায় ছিলি।’
ফিক করে হেসে দেয় আবির। নেতিবাচক মাথা দুলিয়ে বলল,
‘কিছু অভিমান উড়িয়ে দিতে হয়। মনে রাখতে নেই। আমি জানি এটাই আমার বিভা।’
‘এক দেখাতেই চিনে নিলি?’ সামিম এতক্ষণ পর মুখ খুলল।
আবির সামিম’কে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরে পিঠে চাপড় মেরে বলল,
‘তোকে ধন্যবাদ সামিম। তোর জন্যই বিভা’কে আমি পুনোরায় পেয়েছি।’
সামিম সহ সকলে বিস্মিত চোখে তাকায়। আবির পুনোরায় বলল,
‘রতন বোসের স্যালারি বাড়িয়ে দিবি।’
আবিরের এমন উদ্ভট কথা শুনে কেউ অবাক না হয়ে পারছে না। আইরিন বেগম, আফিন দূর থেকে আবিরের পাগলামি দেখছে। তারা এখনো কনফিউজড! এটা সত্যি কি বিভা নাকি জারা জেরিন? আইরিন বেগম বিভার নিকট এগিয়ে যায়। বিভা আইরিন বেগম’কে দেখে সালাম দিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
‘কেমন আছেন আন্টি?’
‘ভালো। আমাকে চিনতে পেরেছো বিভা?’
‘নিশ্চয়, আবির আহমেদের মাম্মি আপনি।’
‘হুম।’
‘এতদিন কোথায় ছিল তুমি?’
‘নিজের বাড়িতে ছিলাম।’ হেসে হেসে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে বিভা।
‘আমার ছেলে….’
পুরো কথা বলার আগেই বিভার ফোন বেজে উঠে। বিভা শাহাদাত আঙুল তুলে ‘জাস্ট এ মিনিট’ বলে সেখান থেকে জনশূন্য স্থানে চলে আসে। সেখানে আসার পর পরই বিভার কন্ঠ চেঞ্জ হয়ে যায়। হাতের পার্সটি পাশের টেবিলের উপর রেখে গম্ভীর কণ্ঠে কাউকে বলল,
‘বলো, কোনো খবর পেলে?’
‘হ্যাঁ! একবার আসতে হবে।’
‘আসবো।’ বলে বিভা ফোন রেখে ঘুরে তাকায়। তখনই আবিরের সম্মুখীন হয় সে। হাত পকেটে পুরে ক্ষোভিত চোখে বিভা’কে দেখছে। বিভা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। বুকের মধ্যে মোচড় দিয়ে উঠে। এত দিন যেই মানুষটার কাছ থেকে আড়াল ছিল। আজ তার সামনে নিজেকে অপরাধী বলে মনে করছে বিভা। আবির ভাবছে, প্রচুর ভাবছে! এই মেয়েটির জন্য কত বছর অপেক্ষার প্রহর সে গুনেছে। কতোই না পাগলামি করেছে। এখনো হাতের মধ্যখানে সেই কাঁটা দাগটি রয়েছে। কিছু দাগ সহজে মুছে না। রয়ে যায় অনন্তকাল!
আবিরের চোখের মাঝে ঝেকে দেখার সাধ্য তার নেই। না মুখোমুখি দাঁড়ানোর কোনো অধিকার আছে! পাশ কাঁটিয়ে চলে যেতে নিলে আবির বিভার বাহু ধরে টেনে একই স্থানে এনে দাঁড় করায়। হাত সরিয়ে একটু কাছে এসে বলল,
‘এতদিন কোথায় ছিলে? প্রশ্ন করব না। শুধু বলব, তোমার বিরহে প্রতিটা ক্লেদাক্ত দিন গুলো ফিরিয়ে দেও। ফিরিয়ে দেও আমার চোখের অশ্রু! পারবে না তুমি। কেননা তুমি একজন হৃদয়হীন, পাষানী মেয়ে। যার মধ্যে ভালোবাসার ছিটেফোঁটাও নেই।’
অনাড়ম্বর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বিভা। বলার মতো কোনো বাক্য নেই। আবির এবার ক্রোধ নিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেসে ধরে বলল,
‘আমার কাছ থেকে তুমি এত সহজে মুক্তি পাবে না বিভা। নিজের পরিচয় অন্যের কাছে গোপন করলেও, আমি জানি তুমি আমার বিভা। তোমাকে আমার হৃদয়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার প্রতিজ্ঞা নিয়েছি। এবার আর হারাতে দেবো না।’
‘পাগলামি করবেন না মি.আবির। আমি এখন আপনার বিভা নই।’ আবির’কে সরিয়ে বলল।
‘কে তুমি জারা?’ তাচ্ছিল্য হেসে বলল আবির।
বিভা উত্তর না দিয়ে ভ্রু কুঁচকে ফেলে। আবির আবার বলে,
‘তুমি আমার বিভা ছিলে, আছো, থাকবে সারাজীবন। আর রইলো পাগলামি! এখন থেকে তুমি আমার পাগলামি দেখবে। ভয়াবহ পাগলামি!’ পুরো কথা শেষ করে বিভা’কে শক্ত করে বাহুডোরে আবদ্ধ করে নেয় আবির। বিভা দম নিতে পারছে না। আবির বুঝতে পেরে ছেড়ে দেয়। তেজী দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রস্থান করে। বিভা চোখমুখ ঘুচে তাকায়। এটা কোন ধরনের পাগলামি দেখিয়ে গেল বুঝতে পারছে না বিভা। ফোনে আবার একটি মেসেজ আসে। ওপেন করে বুঝতে পারে তাকে এখনই যেতে হবে। ফিরে যায় হল রুমে। দশ মিনিট সময় ব্যয় করে বিভা চলে যাওয়ার জন্য বিদায় নেয় সবার কাছে। প্রথমে তো সকলে ভেবেছিল বিভা’কে আবির যেতে দিবে না। কিন্তু সবার ধারণা পাল্টে যায়৷ আবির কোনো প্রকার পাগলামি করে না। বরং হাসিমুখে বিভাকে বিদায় দেয়। এতে বিভাও কিছুটা বিস্মিত! আপাতত সে এসব নিয়ে কিছু ভাবে না। তাকে যেতে হবে।
‘আবির, তুই ঠিক আছিস?’
আবির ভাবলেশহীন হয়ে বলল,
‘আমার কি হবে?’
সামিম তৎক্ষনাৎ বিভার কথা উল্লেখ করে না ৷ সে কিছুটা কনফিউজড হয়ে পড়ে। আবির হেসে অন্য পাশে এগিয়ে যায়। আফিন এগিয়ে আসে আবিরের নিকট।
.
‘থ্যাংক’স জারা! একদিনের জন্য আমাকে তোমার পদবি দিয়েছো।’ বিভা হাসিমুখে জিনি মানের মেয়েটিকে বলল। মেয়েটির আসল নাম জারা জেরিন। একজন নতুন মডেল। যার কারণে সে সবার কাছে এতটা পরিচিত নয়। তার পদবিটা বিভা একদিনের জন্য নিয়েছিল। সবাইকে চমকে দেওয়ার জন্য। এখানেও বড়ো রহস্য লুকিয়ে আছে।
‘না মেডাম! আপনার উপকার করতে পেরে আমি খুশি।’
‘আমি কিন্তু তোমাকে মাঝেমধ্যে জ্বালাব।’
‘সমস্যা নেই মেডাম। আমি আপনার সাহায্য করতে প্রস্তুত আছি।’
বিভা মৃদু হাসে। ড্রাইভারের উদ্দেশ্যে বলে,
‘সামনের গলিতে নামিয়ে দেও আমাকে।’
ড্রাইভার বিভার কথা অনুযায়ী সামনের নিরব গলিটির মুখে বিভাকে মানিয়ে দেয়। বিভা গাড়ি থেকে নেমে জারার কাছে বিদায় নিয়ে হাঁটতে আরম্ভ করে। হাতের সিল্কের ওড়নাটি গায়ে পেঁচিয়ে নেয়। বিভা এমন একটি গলি ধরে হাঁটছে সেখানে মানুষজনের আনাগোনা একদমই নেই। পাশে বাড়িঘর আছে। কিন্তু কেউ বসবাস করে না। দু পাশে বড়ো বড়ো গাছপালা রয়েছে। এড়িয়াটা ভূতুড়ে পরিবেশের মতো। কিছু ল্যাম্পপোস্টের বাতি নিভু নিভু করে জ্বরছে।
বিভা নির্ভয়ে হেঁটে চলেছে। হঠাৎ ফিল করে তার পিছনে কেউ আছে। ঘুরে তাকায়। তীক্ষ্ণ নজর বুলিয়ে আগে ন্যায় হাঁটতে নিলে কারো সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে দু কদম পিছনে সরে যায়। কঁপাল কুঁচকে ফেলে। আবির’কে দেখে বিভা ভড়কে যায়। আবিরের নজর গম্ভীর! পরনে এখন আর কোট নেই কালো শার্ট রয়েছে। দু’হাতা কনুই পর্যন্ত ফোল্ড করা। গলায় কালো রঙের টাইটি ঢিলা করে রাখা। যেটা মৃদু বাতাসে উড়ছে। আরাম করে পকেটে হাত গুঁজে বিভাকে ক্ষীণ নজরে দেখছে।
বিভা আবির’কে এখানে দেখে বিস্মিত! তবে স্বাভাবিক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে,
‘আপনি এখানে?’
প্রশ্নটি শুনে আবির কিঞ্চিৎ বিরক্ত বোধ করল। বলল,
‘এরূপ প্রশ্ন আমার করা উচিত।’
‘মোটেও না। আপনি আমার পিছু নিচ্ছেন? এখানে কিভাবে পৌঁছালেন?’
আবির বিভার হাতের পার্সটি নিয়ে নেয়ে। দু’টি সাদা পাথরের বোতাম চাপ দিতেই খুলে যায়। তার ভেতর থেকে নিজের ফোনটি বের করে নেয়। বিভার দিকে ব্যাগ এগিয়ে দিয়ে বলল,
‘এবার নিশ্চয় বুঝেছো।’
বিভা চোয়াল জোড়া রাগে শক্ত করে ফেলে। এবার সে বুঝতে পেরেছে বিদায় নেওয়ার পরও আবির তাকে কেন আটকায় নি। আর তখন শক্ত করে জড়িয়ে কেন ধরেছিল। এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে অন্য হাত দিয়ে তার পার্সের মধ্যে ওর ফোনটি রেখে দিয়েছিল। ফোন সর্বক্ষণ হাতে থাকার ধরুন পার্সটি খোলা হয়নি। এবং সে বুঝতেও পারে তা তার পার্সটিয়ে আবিরের ফোন রয়েছে। যেটা তার অগোচরে রাখা হয়েছিল। আবির ফোনের লোকেশন অন করে রেখেছিল। তাই খুব সহজেই জানতে পারে বিভা এখন কোথায় রয়েছে। এবং চুপিচুপি বাইক নিয়ে এখানে পৌঁছাতে সক্ষম হয়।
‘অবশেষে বুঝতে পেরেছো তাহলে।’ এক ভ্রু উঁচু করে বলল আবির।
বিভা কিছুটা রাগী কণ্ঠে শুধালো,
‘পিছু কেন করছেন?’
‘তুমি এদিকে কোথায় যাচ্ছো?’
‘বাড়িতে।’
‘আজকাল ভূতুড়ে এড়িয়ায় থাকছো নাকি?’
‘থাকছি, তাতে আপনার কি।’ বলেই বিভা হাঁটতে আরম্ভ করে। আবির ফোন পকেটে রেখে ওর পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছে। বিভা সেটি দেখে রেগে বলে,
‘আমার পিছু কেন আসছেন। চলে যান।’
‘উঁহু! তোমাকে বাড়িতে যাব।’
‘আমি অচেনা কাউকে বাড়িতে নিবো না।’
‘কে নিতে বলল তোমাকে।’
‘তাহলে আমার পিছু হাঁটছেন কেন?’ ক্রোধ নিয়ে বলল।
‘বাড়িতে যাওয়ার জন্য।’
‘মেজাজ খারাপ করবেন না। চলে যান বলছি।’
‘নাহ!’
বিভা রাগ নিয়ন্ত্রণ করে থেমে যায়। আবির বিভার থেমে যাওয়া দেখে সামনে এসে দাঁড়ায়। বিভা ওর পার্স থেকে একটি রুমাল বের করে। আবির বলল,
‘আমাকে দিবে নাকি?’
‘নিন।’ বলে আবিরের নাকমুখের উপর চেপে ধরে রুমালটি। আবির এক ঝটকায় বিভার হাত সরিয়ে ফেলে। ওর হাত থেকে রুমালটি মাটিয়ে পড়ে যায়। হঠাৎ আবির বিভার দিকে তাকিয়ে থাকাকালীন অনুভব করে তার মাথা ঘুরছে। চোখ জোড়া ক্রমশে বন্ধ হয়ে আসছে। এক বার মাথা ঝাকিয়ে হাতের তর্জনী উঁচু করে মুখ ফুটে কিছু বলার আগেই বিভার গায়ে এলিয়ে পড়ে। বিভা আবির’কে ধরে মাটিতে চিৎ করে শুইয়ে দেয়। আবির জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। মুখের উপর একবার হাত দিয়ে চেক করে। পুরোপুরি কনফার্ম হবার পর মুচকি হাসে। তার কাজ হয়েছে। ক্লোরোফর্ম মাখা রুমালটি পরিশেষে কাজে দিয়েছে। ল্যাম্পপোস্টের ঘোলাটে বাতিতে আবিবের স্নিগ্ধ মাখা আদল দেখে বিভার মায়া হয়। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে চট করে উঠে দাঁড়িয়ে কাউকে কল দেয়। এক মিনিট কথা বলে আবির’কে সেভাবে রেখেই বিভা তার গন্তব্যের দিকে এগিয়ে চলে।
.
.
.
#চলবে?

#বাঁধিব_হৃদয়ে_তোমায়
#পর্ব_১৮
#সুমাইয়া মনি

সকাল থেকে সূর্যের দেখা নেই। আকাশে মেঘ ভেসে বেড়াচ্ছে। যে কোনো মুহূর্তে ঝুপঝাপ বৃষ্টি বর্ষিত হবার চান্স রয়েছে। শাঁ শাঁ শব্দ তুলে জানালার পর্দা উড়ছে। আবিরের চুল গুলো এলোমেলো করে দিচ্ছে। এক মনে সে মারুফ ও সামিমের কথা শুনছে এবং রাতের কথা ভাবছে। জ্ঞান হারিয়ে ফেলার পর বিভা মারুফ’কে ফোন দিয়ে লোকেশন বলেছে। মারুফ, সামিম’কে সঙ্গে নিয়ে আবির’কে আনতে বিভার বলা লোকেশনে আসে। সেখান থেকে আবির’কে সঙ্গে নিয়ে বাড়িতে ফিরে তারা। বাড়িতে আনার পর মারুফ পানির ঝাঁপটা দিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে আনে আবিরের। চেতনা ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে হন্নতন্ন হয়ে বিভা’কে খুঁজতে আরম্ভ করে।
কিন্তু মারুফ তাকে জ্ঞান হারিয়ে ফেলার কথা জানিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। তাদের কথপোকথন শুনে আইরিন বেগম হল রুমে উপস্থিত হলে ‘কি হয়েছে’ জানতে চাইলে সামিম তাকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে রুমে পাঠিয়ে দেয়। রাতে এই বিষয় নিয়ে তারা আর কথা বাড়ায় না। দু’জনে রাতে থেকে যায়।
আবির সারারাত চোখের পাতা এক করেনি। তার মনে হাজারো প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। কেন ক্লোরোফর্ম মাখান রুমাল তার নাকেমুখে ধরা হলো? তাকে অচেতন অবস্থায় রেখে বিভা এত রাতে কোথায় গিয়েছে? কি উদ্দেশ্য তার? ভেবে এপাশ, ওপাশ করতে করতে উঠে বসে। আপাতত যেভাবে বসে আছে এখন, সেভাবেই বসে রয়েছে। সকাল হয়। মারুফ, সামিম আবির’কে ডাকতে রুমের কাছে এসে দেখে দরজা খোলা। ভেতরে প্রবেশ করে বন্ধু’কে স্থির হয়ে বসে থাকতে দেখতে পায়। চোখমুখ দেখে বুঝে যায় রাতে ঘুমাতে পারেনি।
তার নিকট এসে কথা বলতে আরম্ভ করে।
‘কাল রাতে বিভা বলল তুই নাকি অজ্ঞান হয়ে গেছিস। কীভাবে সেন্স হারালি?’ মারুফ প্রশ্ন করে।
‘মাথায় আঘাতের চিহ্ন নজরে এলো না। তাহলে অজ্ঞান হয়েছিলি কীভাবে?’ এবার সামিম প্রশ্ন করে।
‘আর এই বিভা আমার নাম্বার কোথায় পেলো? না এত বছরে কখনো দেখা হয়েছে। না কাল আমার নাম্বার নিয়েছে পার্টিতে থাকাকালীন। কেমন রহস্যময় হয়ে উঠেছে বিভা।’
‘হাজারো প্রশ্ন লুকিয়ে আছে ওর মাঝে। কিন্তু এর উত্তর পাব কি-না জানা নেই!’
আবির এবার মুখ খুলে,
‘কাল রাতে কৌশলে ক্লোরোর্ফম মাখা রুমাল বিভা আমার নাকেমুখে চেপে ধরেছিল। যার ফলে আমি জ্ঞান হারাই।’
‘কিন্তু কেন?’ বিস্ময় নিয়ে প্রশ্ন করে মারুফ।
‘যদি তোকে সেন্সলেসই করতে হতো, তবে আমাকে ফোন দিয়ে কেন ডাকলো।’
‘কারণ বিভা চাইছিল না আমি এত রাতে সেখানে পড়ে থাকি।’
‘বিবেক, বুদ্ধি প্রখর বিভার।’ সামিম বলে।
‘প্রচুর!’
‘বিভার নাম্বারটা দে মারুফ।’
‘ফোনে উঠা..’ বলে ফোন আনলক করল মারুফ।
আবির নাম্বার উঠিয়ে খাট থেকে নেমে গেলো। সামিম উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘অফিসে যাবি? দেখে তো মনে হচ্ছে সারারাত ঘুমাস নি। এখন ঘুমাবি নাকি?’
‘নাহ! অফিসে যাব না। তুই গিয়ে বাকি কাজ গুলো সামলে নিস।’ আবির গুরুগম্ভীর কণ্ঠে শুধালো।
‘তুই কি করবি?’
‘কাজ আছে আমার।’
‘কি কাজ?’
‘লিভ!’
সামিম আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারে না। দু’জনে বেরিয়ে যায়। আবির লম্বা শাওয়ার নেয়।
__________
ক্যাম্পাসের মাঠের মাঝখানে একা কান ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখেছে সিমা’কে আফিন। স্টুডেন্ট’রা দূর থেকে ওঁকে দেখে হাসাহাসি করছে। এতে না আছে সিমার ভ্রূক্ষেপ, না বোধ করছে রাগ, অপমান। আফিনের জন্য শুধু কান ধরা কেন? ক্যাম্পাসের সকল স্টুডেন্টদেরও কান টানতে রাজি আছে।
মনে মনে এসব ভেবে মৃদু মুচকি হাসছে। আফিন দূর থেকে সেটা লক্ষ্য করে। রৌদ্দ নেই দেখে সিমার তেমন গরম লাগছে না। দেখে তো মনে হচ্ছে সে ইনজয় করছে খুব! দশ মিনিট হলো সে এভাবে দাঁড়িয়ে আছে। বাকি স্টুডেন্টদের হাসাহাসি তার নজরে এসেছে। সে এগিয়ে আসে সিমার নিকট।
সিমা আফিন’কে দেখে মুচকি হেসে নজর সরিয়ে নেয়।
আফিন বিরক্ত নিয়ে বলল,
‘আর কখনো বলবে?’
‘কোনটা?’
‘ভালোবাসি…’
‘ভালোবাসি টু।’ বাকি অবশিষ্ট কথা বলার পূর্বেই সিমা তড়িঘড়ি বলে হেসে দেয়।
রাগে চোখ জোড়া বন্ধ করে নেয় আফিন। কঁপালে দুই আঙুল দিয়ে স্লাইড করতে করতে স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
‘তোমার মতো অসভ্য মেয়ে আমি জিন্দেগীতে কক্ষণো দেখিনি।’
‘এখন দেখে নেন।’
‘সেটআপ! ক্লাসে যাও।’ ধমক দিয়ে বলল।
আফিনের ধমক শুনে সিমা ঈষৎ কেঁপে উঠে এক প্রকার দৌঁড়ে ক্লাসরুমে আসে। আফিন রাগী নিশ্বাস ত্যাগ করে ক্লাসরুমের নিকট এগিয়ে যায়। পথরোধ হয় তার সুমনা ম্যামের ডাকে। তিনি এই কলেজের নতুন টিচার। কাল জয়েন্ট হয়েছে। দেখতে বেশ সুন্দরী।
‘আসলে আপনাকে ডেকেছিলাম এটা জিজ্ঞেস করতে, প্রিন্সিপাল স্যার আপনাকে এই লেটারটি দিতে বলল।’
‘দিন।’ বলতে বলতে আফিন হাতে নেয়। একবার নজর বুলিয়ে আফিন তাকে ‘ধন্যবাদ’ জানায়। সুমনা আবার বলে,
‘ওয়েলকাম! আমরা কি এক সঙ্গে কফি খেতে পারি?’
‘শিওর!’ বিনয়ী কন্ঠে বলল আফিন।
‘নেক্সট ক্লাসে যাব তাহলে।’
‘ওকে!’
‘বাই।’ বলেই সুমনা চলে যায়। আফিনও তার বাকি ক্লাস নিতে চলে যায়।
____
বিভা বিরক্ত! বার বার আবিরের ফোন কেঁটে দিচ্ছে। এ নিয়ে দশ বার হতে চলল। শেষমেশ ফোন সাইলেন্ট মুডে ফেলে রাখে। এই মুহূর্তে সে আবির’কে ভুলে থাকতে চায়। কিছুতেই চায় না তাকে জীবনে জড়াতে। কফির মগ নিয়ে চেয়ারে হেলান দেয়। এক চুমুক দিতেই সাইলেন্ট ফোনে আলো জ্বলে উঠে। বুঝতে পারে আবারও কল দিয়েছে আবির। এবার রিসিভ না করে পারে না। চট করে কানে তুলে বলল,
‘সমস্যা কী? কল কেন দিচ্ছেন বার বার?’
‘দরজা খোলো তারপর বলছি।’ শান্ত কণ্ঠে বলল আবির।
বিভা অবাক হয়ে দরজার পানে তাকায়। তার মানে কি আবির দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে? নাম্বার না হয় মারুফের কাছ থেকে নিয়েছে। কিন্তু এড্রেস কোথায় পেলো? পরক্ষণে বুঝতে পারে নিশ্চয় ট্র্যাক করেছে। ফোন রেখে দরজা খুলে দিয়ে ক্ষোভ নিয়ে তাকায় আবিরের ওপর। আবির চট করে বিভার দু বাহু শক্ত করে চেপে ধরে দেয়ালের সঙ্গে চেপে ধরে ক্রোধ নিয়ে তাকায়। বিভার রাগ-ক্ষোভ উবে যায়। আবির মুখ একটু কাছে এনে মৃদুস্বরে বলল,
‘পঁচা মেয়ে…’ বলেই আবির সেই চেয়ারে বসে পড়ে, যেখানে বিভা একটু আগে বসেছিল। হাতে বিভার কফির মগটি উঠিয়ে এক চুমুক দিতে যাবে বিভা বাঁধা দেয়। আবির বাঁধা শুনে না। এক চুমুক দিয়ে নাক-মুখ কুঁচকে বলল,
‘চিনি ছাড়া কফি। এই জন্যই তো বলি মুখে রসকষ নেই কেন?’
‘কফির মগ দেন।’ রাগ নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল বিভা।
‘তোমার বাড়িতে এসেছি কফি খাওয়ার কথা তো বললেই না, উল্টো রেডিমেড কফিটাও খেতে দিচ্ছো না। আচ্ছা নিবে যখন, ঢেলে দেই হাতে।’
‘একদম ফাজলামো করবেন না।’
‘ভালো কথা বললেও দোষ, ফাজলামো করলেও দোষ। বিচারা আবির যাবে কোথায় বলো?’ বলে আরেক চুমুক বসায়৷
বিভা রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যস্ত। বলল,
‘আপাতত এখান থেকে চলে যান।’
‘কেন? তুমি কি ভয় পাচ্ছো?’ বলেই কফির মগ রেখে আবির বিভার মুখোমুখি দাঁড়াল। ফের বলল,
‘একটি ফ্ল্যাটে তুমি-আমি একই রুমে, যদি কিছু হয়ে যায় এই ভয়ে তাড়িয়ে দিচ্ছো?’ ভূতুড়ে কণ্ঠ বানিয়ে বলল আবির।
‘সরেন!’ বলেই আলতো ধাক্কা দেয় আবির’কে।
আবির হেসে ফেলে। বলল,
‘উঁহু!’
‘আচ্ছা, মেয়ের কি অভাব পড়েছে? আমার পিছনেই কেন পড়ে আছেন আপনি?’
‘বাঁধিব হৃদয়ে তোমায় বলে….’ কথাটা বলে বিভার দিকে নেশাতুর দৃষ্টি ফেলে। বিভা নিরুত্তর হয়ে চেয়ে রয়। আবির’কে যত দেখছে ততই অবাক হচ্ছে। এতদিন পর ফিরে আসার ফলে আবির তাকে মোটেও উৎখাত করেনি। বরঞ্চ চাচ্ছে যেন তার হয়ে যাক। বিভা নজর সরিয়ে ফেলে। বিস্বাদ কণ্ঠে বলল,
‘চলে যান এখান থেকে…’
‘ওকে!’ স্বাভাবিক ভাবে বলে উঠে দাঁড়ায় আবির। বিভা ভ্রু কুঁচকে ঘুরে তাকায়। কফি টুকু এক ঢোকে পান করে রুম ত্যাগ করে। যাওয়ার আগে দরজা লাগিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেয়। বিভা এবারও অবাক না হয়ে পারছে না। সে বিস্ময় নিয়ে খোলা দরজার পানে তাকিয়ে আছে। আসলে সে আবিরের মন পড়তে অক্ষম। কিছুতেই আবির’কে বুঝে উঠতে পারছে না। কখন কি করে বসে, বোঝা মুশকিল। কাল রাতের ঘটনার কথা একটি বারও জিজ্ঞেস করল না। না কোনো অভিযোগ করেছে তার বিরুদ্ধে! ভাবতে ভাবতে দরজা লাগিয়ে মৌন হয়ে রয় সে।

গাড়ি ড্রাইভ করতে করতে আবির মৃদু হাসে। সে বিভার কথা মনে করে হাসছে। বিভা যে কনফিউজড হয়েছে। সেটা সে ঢের বুঝতে পেরেছে। রহস্যময় হয়ে গেছে বিভা। এই রহস্যের বেড়াজাল থেকে আবির তাকে বের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। শুধু কিছু সময়ের প্রয়োজন মাত্র!
.
.
.
#চলবে?