#বাঁধিব হৃদয়ে তোমায়
#পর্ব-১৯+২০
#সুমাইয়া মনি
বিভা জারার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। জারা ফটোশুটে ব্যস্ত ছিল। বিভা’কে দেখে দশ মিনিটের ব্রেক নেয়। দু’জনে সবার থেকে একটু দূরে অবস্থান করছে।
‘জারা তোমার আপু যখন নিঁখোজ হয়েছিল। তার আগে কি কারো সঙ্গে ফোনে কথা বলেছিল?’
‘আমি সেটা কীভাবে বলবো মেডাম? আমি তো বাড়িতে ছিলাম না। আর আপু ফ্যাক্টরিতে গিয়েছিল। তারপর আর ফেরেনি। কিছু জানতে পারলেন কী?’
‘ইনভেস্টিগেট চালছে। পুলিশের কাছ থেকে তেমন কিছু জানা যায় নি। সেদিন পার্টিতে সবাইকে দেখেছো তুমি। এই ফোনে তাদের ছবি আছে। দেখো তো চিনতে পারো কি-না তাদের।’
জারা একটার পর একটা ছবি পাল্টিয়ে দেখতে লাগলো। সন্দেহজনক তেমন কিছু নজরে পড়ল না তার। বিভা তীক্ষ্ণ নজরে পর্যবেক্ষণ করছে জারা’কে। সব ছবি দেখার পর জারা বলল,
‘আমি এদের কাউকে চিনি না মেডাম।’
বিভা ফোন লক করে পকেটে পুরে নেয়। বলে,
‘আচ্ছা মনে করে বলতে পারবে। তোমার আপু কোনো কাগজ বা ফাইল এমন কোনো জিনিস এনেছিল বাড়িতে?’
‘আপুর রুম চেক করে দেখতে হবে।’
‘তুমি দেখে আমাকে জানাবে।’
‘আমাকেও…’ বলেই আবির অন্য একটি চেয়ার টেনে ধুম করে বসে যায়৷ ওঁকে দেখে বিভা বিরক্ত বোধ করে। জারা বিস্ময় নিয়ে তাকায়। আবির ওদের চাহনি উপেক্ষা করে বলল,
‘আমি ভূত না। এভাবে না তাকালেও চলবে। বাই দ্যা এদিক-সেদিক, কী নিয়ে আলোচনা হচ্ছে?’
‘আপনাকে বলব কেন?’
‘আমাকে বলবে না কেন?’
বিভা রাগী চোখে তাকায়। আবির দুষ্টু হেসে হেলান দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
‘ক’দিন পর তো আমি তোমার বর হয়ে যাব। তখন পার্সোনাল কথাও শেয়ার করবে। আগে থেকে বলতে সমস্যা কি?’
‘আপনার এমন ফালতু কথা শোনার সময় আমার নেই। জারা আমি চললাম।’ বলে হাঁটতে আরম্ভ করল। আবির এক ছুটে বিভার নিকট এগিয়ে এসে হাঁটতে আরম্ভ করল। বিভা রোদের কারণে সানগ্লাস চোখে পড়ে নেয়। আবির বলল,
‘শার্ট – প্যান্টে তোমাকে মোটেও মানাচ্ছে না বিভা। থ্রি-পিসে ভালো মানায় তোমায়।’
‘আপনাকে বলতে হবে না সেটা।’
‘আমি না বললে অন্য কেউ বলবে নাকি।’
‘আমার পিছু পিছু হাঁটবেন না।’
‘কেন? হাঁটলে কি সেদিনের মতো অজ্ঞান করবে ক্লোরোফর্ম শুকিয়ে?’
‘আমায় বাধ্য করবেন না।’
‘এ তো দেখছি দিনে-দুপুরে খুন করে।’
‘খুন কোথায় হলো?’
‘আধমরা’কে তো খুনই বলে।’
‘তর্ক করতে চাইনা আমি। পিছু ছাড়ুন।’
‘নেভার!’
বিভা থেমে গিয়ে আবিরের দিকে ক্রোধ দৃষ্টিতে তাকায়। বলে,
‘সমস্যা কী?’
‘তুমি?’
‘কি করলে পিছু ছাড়বেন?’
‘আমায় বিয়ে করলে।’
বিভা চুপ হয়ে যায়। কিছু একটা ভেবে বলল,
‘কক্ষণো না।’
‘আমিও কক্ষণো না।’ ভাব নিয়ে বলল।
বিভা স্কুটারে উঠে বসে। আবির বসতে চাইলে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। বলে,
‘আমার সঙ্গে আসবেন না।’
‘হাজার বার আসবো।’ বলে আবারও উঠে বসে।
বিভা প্রচণ্ড ক্ষেপে আছে। নিরুত্তর থেকে স্কুটার স্টার্ট দেয়। অনেক দ্রুত চালাচ্ছে। আবির বিভার বাহুতে হাত রাখতে চাইলে বিভা সরিয়ে দেয়। আবির মুচকি হেসে বিভার পেট জড়িয়ে ধরে। সঙ্গে সঙ্গে বিভা জোরে ব্রেক কষে। এতে করে আবির বিভার উপর ঝুঁকে যায়। বিভা ক্ষেপে নেমে গিয়ে আবির’কে টেনে নামায়। দাঁতে দাঁত কিড়মিড় করে বলে,
‘অসভ্যতা করার জায়গা পান না।’
‘তাহলে আড়ালে চলো।’
‘চুপ করুন।’ ধমক দিয়ে বলে বিভা স্কুটার নিয়ে চলে যায়৷ আবির এবার আর বিভাকে থামায় না। তবে কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হয় তার।
বিভা বাড়িতে ফিরে আসে। আগে থেকেই একটি মেয়ে ওর জন্য অপেক্ষা করছিল গেটের সামনে। তাকে নিয়ে বিভা ভেতরে প্রবেশ করে। দু’জনার মাঝে বেশ কিছুক্ষণ কথপোকথন হয়। মেয়েটি কিছু কাগজ বিভা’কে দেখায়। বিভা অনেক আগের কিছু পুরোনো কাগজের সঙ্গে সেগুলো মিলায়।
______
সুমনা সিমার পাশ কাঁটিয়ে যাওয়ার সময় ল্যাং মেরে ফেলে দিয়ে নিজেও পড়ে যাওয়ার অভিনয় করে। উত্তেজিত হয়ে বলে উঠে,
‘স্যরি মেডাম। আমি দেখিনি আপনাকে। আমি দুঃখিত!’
সুমনা মুখ ভার করে কোনোমতে উঠে দাঁড়ায়। সিমার চাল সে একটু হলেও বুঝতে পেরেছে। সিমা উঠে সুমনার শাড়ি ছেড়ে দিতে যাবে বাঁধা দেয় সে। সুমনা লজ্জা বোধ করে। ক্যাম্পাসের ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে পড়ে যাওয়া লজ্জাজনক ব্যাপার।
সিমা’কে কিছু না বলে তিনি ব্যাগ কাঁধে চেপে শিক্ষক কক্ষে এগিয়ে যায়৷ সুমনা এগিয়ে যেতেই ওর বান্ধবী’রা ঘিরে ধরে। সিমা বাঁকা হেসে হাত বগলদাবা করে দাঁড়িয়ে বলল,
‘যা বেশি করে আমার আফিনের সঙ্গে কফি খেতে। যতবার যাবি, ততবার আমি তোর এমন হাল করব দেখিস।’
‘ম্যাম প্রচণ্ড লজ্জা পেয়েছে।’
‘তাতে আমার কি।’
‘তুই অন্ধ হয়ে গেছির স্যারের প্রেমে পড়ে।’
‘হলে ক্ষতি কি? মানুষ ভালোবেসে পাগল হয়। আমি না হয় অন্ধ হলাম।’
‘তোকে বোঝানো সম্ভব না।’
‘বোঝাতে আসিসও না।’
‘এই ক্লাসরুমে চল তোরা। ও থাকুক এখানে।’
‘নাহ! শোন তোরা।’
______________
রাতে…..
দরজায় কলিং বেল বেজে উঠে। বিভা দরজা খুলে সামিম’কে দেখে সেখান থেকে ফিরে আসে। সামিম ভেতরে এসে দরজা লাগিয়ে দেয়। বিভার দিকে ক্ষীণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
‘এটা কিন্তু কথা ছিল না।’
বিভা নিরুত্তর থেকে একটা ফাইলে নজর বুলাচ্ছে। সামিম বিরক্ত হয়ে পুনোরায় বলল,
‘আমি কিছু বলছি তোমাকে।’
‘আপনি কি চাইছেন?’ শান্ত কণ্ঠে বলল বিভা।
‘তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে, ফিরে আসার পর আবির’কে তুমি কষ্ট দিবে না। তাহলে এমন কেন করছো?’
‘ভালোর জন্যই করছি।’
‘এটাকে ভালো বলে না বিভা। আবির তোমার অবহেলা সহ্য করতে পারছে না। ওর কষ্ট গুলো আমি কাছ থেকে দেখছি। তুমি বুঝো না? ছয়’টি বছর আবিবের একাকিত্বের সঙ্গী ছিলাম আমি। যন্ত্রণা গুলো অতি নিকট থেকে দেখেছি। আজ ওর জায়গায় অন্য কেউ হলে তোমাকে ভুলে যেতো। বিয়ে করে নিতো অন্য কাউকে। কিন্তু আবির তোমাকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। প্রতিটা মুহূর্তে তোমার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনেছে। আর কত কষ্ট দিবে তুমি ওঁকে। এত পাষান কেন তুমি বিভা?’
বিভা পুরো কথা শুনে রেগেমেগে দাঁড়িয়ে যায়। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে সামিম’কে বলল,
‘আমি যা করছি আবিরের ভালোর জন্য করছি। চারদিকে শত্রু আমার। কখন কোথায় আমার ওপর আক্রমণ করে সবে, ঠিক নেই। এর মধ্যে আমি আবির’কে আমার জীবনে জড়াতে পারব না। আমি চাই না আমার জন্য আবিরের কোনো ক্ষতি হোক।’ এতটুকু বলে বিভা থামে। সামিম কিছু বলে না। বিভা আবার বলল,
‘সেদিন রাতে আমার জীবনের মোড় পাল্টে দিয়েছেন আপনি। আপুর স্বপ্ন পূরণ করতে সাহায্য করেছেন। এতটা বছর আমি নিজেকে আড়াল করে রেখেছি আবিরের কাছ থেকে। শুধু মাত্র আমার উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্য। আপনি কীভাবে ভাবলেন ভাইয়া আমি আপনার কথা রাখবো না।’
‘তবে কেন আবির’কে কষ্ট দিচ্ছো? ফিরে যাও ওর কাছে একে বারের জন্য। আবির কিন্তু তোমাকে একটি বারও জিজ্ঞেস করেনি এতদিন কোথায় ছিলে, কার সঙ্গে ছিলে। ও তো এটাও জানে না ওর প্রিয় বন্ধুই তার ভালোবাসার মানুষটি’কে আড়াকে রাখার শপথ নিয়েছিল। যদি কখনো জানতে পারে, মাফ করবে না আমায়।’
‘আমি কখনো বলব না আপনার কথা। আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন।’
‘সত্য চাপা রয় না বিভা।’
‘আপ্রাণ চেষ্টা করব রাখার।’
‘আর যাই করো। এবার আর আমার বন্ধুকে কষ্ট দিও না বিভা। ও মরে যাবে তোমাকে না পেলে।’ করুন সুরে কথাটি বলে সামিম স্থান ত্যাগ করেন। বিভা মাথা নিচু রেখে দাঁড়িয়ে থাকে। মন্থর গতিতে এগিয়ে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দেয়। ধীরে পায়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের পানে তাকায়। ছয় বছর আগের কিছু রঙিন স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠে। তিনজন সদস্যের কতই না সুন্দর ছিল তাদের ছোট্ট পরিবারটি। ছিল মা-মেয়ের খুনসুটি, দুষ্টুমি। হঠাৎ এক তান্ডবে হারিয়ে গেল সব। ছায়া হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে ছিল আবির। তাকে স্বাভাবিক করার প্রখর চেষ্টা করেছে। নিজে হারিয়ে যাওয়ার পর আবিরের খবরা-খবর প্রতিটা মুহূর্তে সে পেয়েছে। বার বার চেয়েছিল ফিরে যেতে। কিন্তু কিছু একটা তাকে বাঁধা সৃষ্টি করেছে। চোখের জল মুছে বিভা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলে,
‘আপু! দেখো আমায়। আজ আমি কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি। তোমার স্বপ্ন পূরণ করেছি। দেখো আপু, মা, দেখো। জানো আপু, আমিও আবির’কে ভালোবাসি। হৃদয়ে বেঁধে রাখতে চাই আবির’কে। কিন্তু পারছি না। আমাকে বার বার বাঁধা দিচ্ছে আপু। বাঁধা দিচ্ছে।’ বলে অঝোরে কাঁদতে থাকে বিভা।
কাঁদতে কাঁদতে সেখানে বসে পড়ে। তার এই কান্না এখানেই সীমাবদ্ধ! না কেউ শুনতে পাচ্ছে। না কখনো জানতে পারবে তার মনের অনুভূতি গুলো!
.
.
.
#চলবে?
#বাঁধিব_হৃদয়ে_তোমায়
#পর্ব_২০
#সুমাইয়া মনি
সকাল থেকে একজন ব্যক্তির খুনের নিউস টিভিতে প্রচার হচ্ছে। তার নাম আকবর আলি। তিনি মাহাথির নামের এক গার্মেন্টসের ম্যানেজার ছিলেন। আকবর আলির মৃতদেহটি তারই বাড়ির আম গাছের সঙ্গে ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। পুলিশ অনুমান করছে, গলায় ফাঁশি দেওয়ার ফলে তার মৃত্যু হয়েছে। এক বছর আগে তিনি বিবাহিত একটি মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। তিনমাস হলো মেয়েটিকে তিনি ডিভোর্স দিয়েছেন। আপাতত তিনি এ বাড়িতে একাই থাকতেন।
লাশ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হয়। টিভিতে খবরটি প্রচার হতে দেখে বিভার ঠোঁটে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠে।
রিমোট পাশে রেখে এক মুহূর্তের জন্য ভাবনার জগতে ডুব দেয়। চলে যায় কাল রাতের ঘটনায়৷ একটা কাজের বাহানায় আকবর আলির বাড়িতে আসে রাত এগারোটার দিকে।
প্রথমে আকবর আলির মনে সন্দেহ ঝেঁকে বসলেও পরমুহূর্তে বিভার সৌন্দর্যে সে মুগ্ধ হয়। বিভা আকর্ষণীয় ভাবে সেজেছিল। দু’জনার মাঝে কথপোকথন হয় বেশ কিছুক্ষণ।
কাজের মহিলা না থাকায় তাকেই চা-নাস্তার জোগাড় করতে হয়। রান্না ঘরে পা রাখতেই বিভা তার আসল রূপে দেখায়। কৌশলে অজ্ঞান করে হাত-পে বেঁধে ফেলে। পানির ঝাঁপটা দিয়ে জ্ঞান ফিরানোর পর বিভা জিজ্ঞাসাবাদ চালায়।
তিনি মুখ খুলতে প্রস্তুত ছিলেন না৷ বিভা বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে তার মুখ থেকে গার্মেন্টসের কিছু রহস্য জানতে পারে। বিভার জন্য এতটুকুই যথেষ্ট ছিল। শেষে নিজের পরিচয় দিয়ে বিভা সামিম’কে ফোন করে এখানে আসতে বলে। সামিম আসার পরপরই বিভা এখান থেকে বেরোয়। বাকি কাজ সামিম পূর্ণ করে।
এক ধাপ এগিয়েছে। উদঘাটন হয়েছে কিছু আসল রহস্যের।
কলিং বেল বেজে উঠে। ভাবনায় ছেদ পড়ে। রিমোট হাতে নিয়েই এগিয়ে যায়। ছিটকিনি খুলে আবির’কে গোলাপ ফুল হাতে নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসা অবস্থায় দেখে। বিভা অবাক হয় না। বরঞ্চ স্বাভাবিক ভাবে বলে,
‘হোয়াট?’
‘উইল ইউ ম্যারি মি?’
‘ইয়েস!’ চটপট উত্তর দিয়ে ফুলটি হাতে নেয়।
আবির মুচকি হেসে উঠে বলল,
‘সত্যি?’
‘হ্যাঁ!’
‘অনেক কষ্ট দিয়েছি আপনাকে। পারলে ক্ষমা করে দিবেন।’
আবিরের মুখের হাসি চওড়া হয়। বিভাকে আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরে। দীর্ঘশ্বাস টেনে পরম যত্নে চোখ বন্ধ করে নেয় আবির। বলল,
‘ক্ষমা চাইতে নেই। আমাকে একটু ভালোবাসা দিও। দেখবে পুরোনো অতীত সব ভুলে যাব।’
‘হুম।’ উচ্চারণ করে আবির’কে দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে।
ঠিক তখনই সেখানে মোহনার আগমন ঘটে। ‘এহেম এহেম’ কাঁশি দিতেই দু’জন দু’জনকে ছেড়ে দেয়। কিছুটা ইতস্তত বোধ করে তারা। মোহনা মৃদু হেসে বলল,
‘আমি না হয় পরে আসি।’
‘নাহ! তুমি থাকো। আমি চলে যাচ্ছি। অফিসে জরুরী মিটিং আছে।’
‘হাহ! সেটা তো দেখেই বুঝতে পারছি।’
আবির দ্রুত প্রস্থান করে। মোহনা হেসে ফেলে। বিভা ওঁকে ভেতরে আসতে বলে। দু’জনে পাশাপাশি বসে।
‘আজ এত প্রেম কেন জাগল তোর মনে? ঘটনা কি?’
‘আর কষ্ট দিতে চাই না ওঁকে। আমরা শীঘ্রই বিয়ে করব।’
‘বাহ! ভালো কথা। আমার আগে তোদের বিয়ে হবে নাকি?’
‘হতে পারে।’
‘এত তাড়াতাড়ি কেন?’
‘সেটা আবির জানে।’
‘যাক এক দিক থেকে ভালো হবে। অন্তত ভাইয়ার কষ্টটা একটু হলেও কমবে। এমনেতেই অনেক দুঃক্ষে ভুগেছে সে।’
বিভা উত্তর দেয় না। মোহনা বের বলে,
‘কিছু জানতে পারলি?’
‘হ্যাঁ।’
‘কি জানলি?’
বিভা রহস্যময় হাসি দেয়। এ হাসি বলে দিচ্ছে লুকানো কোনো রহস্যের বার্তা।
______
দুপুরের দিকে আবির অফিস থেকে দ্রুত বাড়িতে ফিরে। আজ আফিনও বাড়িতেই ছিল। খাওয়ার টেবিলে বলে আবির তাদের উদ্দেশ্যে বিভা’কে বিয়ে করার প্রস্তাব জানায়।
‘ও সত্যিই কি বিভা? নাকি অন্য কেউ?’
‘বিভাই আম্মু।’
‘তাহলে প্রথম দিন এমন অভিনয় করল কেন?’
‘সেটা বিভাই ভালো জানে।’
‘এতদিন কোথায় ছিল জিজ্ঞেস করেছিলি?’ আফিন প্রশ্ন করে।
‘নাহ! করিনি।’
‘কেন?’
‘এক সময় ও নিজ থেকেই সব বলবে এই আশায়।’
‘বিভা কি বিয়েতে রাজি আছে?’
‘হ্যাঁ! আছে। আমি দ্রুত বিয়ে করতে চাই ওঁকে ভাইয়া।’
‘এটা কীভাবে হয়? আফিনের আগে তুই বিয়ে করবি।’
‘তো মেয়ে দেখো। আমি ভাইয়া এক সঙ্গে বিয়ে করব।’
‘আমি বিয়ে করব না। আর কি হবে আবির আগে বিয়ে করলে? এমন অনেক আছে আম্মু, বড়ো ভাইকে ডিঙিয়ে ছোট ভাই পালিয়ে বিয়ে করে।’
‘জানি। এটা ভালো দেখায় না। বিয়ে যদি করতে হয় আগে তুই বিয়ে করবি। তারপর আবিরের বিয়ে হবে। এটা আমার শেষ কথা।’
‘তাহলে আমার আর বিভার কাবিন সেরে ফেলি?’
‘নাহ! আফিনের বিয়ে পর তোর বিয়ে হবে।’
‘দু ভাইয়ের এক সঙ্গেই বিয়ে দিয়ে দেও আম্মু?’ হেসে বলে আবির।
‘এটাও করা যায়। আফিন, এবার আমি তোমার নিষেধাজ্ঞা শুনবো না।’
‘যা ভালো মনে হয় করো।’ বলেই আফিন হাত ধুয়ে উঠে যায়।
আবির, আইরিন বেগম কিছুটা খুশি হয়। এবার আফিনের জন্য মেয়ে দেখার পালা।
__
আজ সিমা সুমনা’কে ধাক্কা মেরে সিঁড়ির ওপর থেকে ফেলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু লাস্ট পর্যায় আফিন এসে তাকে ধরে ফেলে। এবং সবার অগোচরে নিয়ে কষিয়ে চড় দেয় সিমার গালে।
‘অনেক পাগলামি করেছো। আর দেখতে চাই না তোমার পাগলামি। তৃতীয় বার এমন কর্মকান্ড করলে কলেজ থেকে বের করে দিতে বাধ্য হবো।’ এতটুকু বলে সুমনা’কে নিয়ে সেখান থেকে চলে যায়। সিমা গালে হাত রেখে আফিনের যাওয়ার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে রয়। তার আদল দেখে মনে হচ্ছে সে ভীষণ হতবিহ্বল হয়ে আছে। বান্ধবী’রা তার কাছে এসে দাঁড়ায়। জুঁই দুঃখপ্রকাশ করে বলল,
‘এবার তো পাগলামি ছেড়ে দে। চড় পর্যন্ত খেতে হলো স্যারের হাতে।’
‘আমরাও তাই বলি সিমা।’
‘এ্যাহ! তোরা কি ভেবেছিস একটা চড় খেয়ে আমি ঠিক হয়ে যাব। মোটেও না। আমি স্যার’কে ভালোবাসি। এবং সারাজীবন ভালোবাসবো হুহ্!’
‘আজাইরা মাইয়া।’ বিড়বিড় করে বলল জুঁই।
.
‘সিমা মেবি আপনাকে ভালোবাসে। ওঁকে পাত্তা দিচ্ছেন না কেন?’
‘আমি ওঁকে পছন্দ করি না সুমনা।’ আফিন বলল।
‘ও খুব ভালো মেয়ে। হয়তো একটু পাগলি টাইপের তবুও মনটা ভালো। আপনি চাইলে রিলেশন করতে পারেন।’
‘সিমার এমন পাগলামি ভবিষ্যতে খারাপ ইফেক্ট পড়তে পারে। আর আমি যদি সায় দেই, ও আরো বিগড়ে যাবে। আমি চাই না ওর উজ্জ্বল ভবিষ্যত নষ্ট হোক আমার জন্য।’
‘আপনার কথা ঠিক আছে। তবে একটু বুঝিয়ে বলবেন। আপনার সঙ্গে আমাকে দেখে সিমা সহ্য করতে পারছে না। তাই আমার ওপর ক্ষেপে আছে।’
‘জানি! তাই তো চড় দিলাম।’
‘এনিওয়ে, ক্লাস শুরু হয়ে যাবে, আমি চললাম।’
‘আচ্ছা।’
___
আবির বিভার বাড়ি থেকে রাত এগারোটা নাগাদ চলে যায়। আজ এক সঙ্গে অনেকক্ষণ সময় কাটিয়েছে দু’জনে।
বিভা কিছু লোকদের সঙ্গে ফোনালাপ চালায়। তারপর তৈরী হয় দ্বিতীয় মিশনের জন্য। আজ সে একাই যাবে। সামিম’কে প্রয়োজন পড়বে না। বারোটার দিকে বিভা তৈরী হয়ে বের হয়। সুনসান রাস্তা ধরে এগোচ্ছে। চাঁদের আলোয় ঝকমক করছে রাস্তাঘাট। বিভার পরনে কালো প্যান্ট ও হুডিওয়ালা জ্যাকেট। নিজেকে লুকানোর জন্য পরিধান করেছে। মুখে ছিল মাস্ক। অনেকটা পথ পাড়ি দেবার পর চলে আসে মাহাথির গার্মেন্টসের সামনে। গার্মেন্টসের অপজিট রাস্তায় ফার্মেসীর একটি দোকান এখনো খোলা ছিল। দোকানে একজন মধ্যবয়স্ক লোকছিলেন। নাম মকবুল কালাম। সম্ভবত তিনি দোকান বন্ধ করার তোড়জোড় করছেন। তার কর্মচারী অনেক আগেই চলে গেছে।
শাটার লাগাতে যাবে তখনই বিভা তার নিকট এসে দাঁড়িয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘ইয়াবা, ড্রাগস হবে?’
লোকটি শাটারে হাত রাখা অবস্থায বিভার পানে তাকায়। চোখেমুখে তার বিস্ময়কর ভাব। গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলল,
‘আমি এগুলো বিক্রি করি না।’
‘আকবর আঙ্কেল আপনার এড্রেস দিয়েছিল কাল সকালে।’
‘তুমি তার কাস্টোমার?’
‘ছিলাম। আজ তো তিনি মারা গেছেন। তাই আপনার কাছে এসেছি।’
‘ব্যাগে আছে। আমার সঙ্গে চলো, পথিমধ্যে দিয়ে দিবো।’
‘হুম।’ মকবুল একটি কালো রঙের ব্যাগ বের করে শাটার লাগিয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয়। তিনি আগে আগে হাঁটছেন, বিভা তার পিছনে পিছনে হাঁটছে। প্রায় আধাঘন্টা হাঁটার পর তিনি একটি নির্জন এড়িয়ায় এসে থেমে যায়৷ জায়গাটা একটু জঙ্গলের মাঝপথে বলা যায়। এটা একটি পার্ক। বাড়িঘর তেমন একটা নেই এদিকটায়। ভোর বেলায় অনেকেই পার্কে হাঁটতে আসে। ল্যাম্পপোস্টের সোনালী আলোয় চারদিক ফকফকা।
লোকটি ঘুরে তাকায়। হাতে তার কালো রঙের Walther P99 পিস্তলটি চকচক করছে। পিস্তলের ওপরের অংশে সাইলেন্সসার লাগান। মকবুল নামের লোকটি গম্ভীর কণ্ঠে বিভার উদ্দেশ্যে বলল,
‘আকবরের এমন কোনো কাস্টোমার নেই, যার কথা আমি জানি না। আমার বন্ধু ছিল আকবর। আমি নিশ্চিত ওর খুনের পিছনে তোর হাত রয়েছে। কে তুই? পরিচয় কি তোর?’
বিভা মাথা নিচের দিকে নামিয়ে তাচ্ছিল্য হাসে। পকেটে এক হাত গুঁজে বলল,
‘ববির কথা মনে আছে?’
‘ওও! তুই ববির ছোট বোন বিভা। এই বার পরিষ্কার হলো আসল ঘটনা। তাহলে তুই মেরেছিস আকবর’কে।’
বিভা তার কথায় পাত্তা না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে,
‘আমার বোনের খুনের পিছনে তোরও হাত রয়েছে।’
‘হ্যাঁ! আমিও জড়িত। মরার ক’দিন আগে তোর বোন এসেছিল আমার কাছে। সঙ্গে করে কিছু কাগজ নিয়ে।’
‘মাহাথির গার্মেন্টসের মেডিকেল রিপোর্ট ছিল সেগুলো। আর তুই তাকে ভুলভাল বুঝিয়ে দিয়েছিলি সেদিন।’
‘হ্যাঁ! আমরা চাইছিলাম না গার্মেন্টসের গোপন রহস্য কেউ জানুক। তোর বোন উঠেপড়ে লেগেছিল সত্য জানার জন্য। এই জন্য মরতে হলো।’
‘আমার বোন চলে যাওয়ার পর খবরটা নিশ্চয় মাহাথির’কে দিয়েছিলি তুই?’
‘দিয়েছিলাম। যাতে তোর বোন’কে রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়।’
বিভা চোখ বন্ধ রেখে রাগ নিয়ন্ত্রণ করে। পরপরই চোখ খুলে বলল,
‘পড়ালেখা না জানা অশিক্ষিত ছিল আমার আপু। সরল, উদার মনের মানুষ ছিল। তার স্বপ্ন পূরণ হবার আগেই তোরা তাকে মেরে ফেলেছিস। ভালো করিস নি।’ কথাটা বলার পর পরই চোখের পলকের মধ্যেই পাশ কেঁটে লাফিরে মকবুলের সামনে চলে আসে বিভা। হাত থেকে ছোঁ মেরে পিস্তলটি নিজের আয়ত্তে করে নেয়। ঘুরেই বুকের মাঝখান বরাবর গুলি করে দেয়। এক, দু বার ঝাঁকুনি দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মাহবুব। অনবরত শরীর কাঁপছে তার। বুক থেকে অঝোরে রক্ত ঝড়ছে। হাঁটু গেড়ে তাম মাথার সামনে বসে। পকেট থেকে রুমাল বের করে পিস্তলটি সযত্নে মুছতে থাকে। গাম্ভীর্য স্বরে বলল,
‘তোদের মতো চার-পাঁচটে জা*নো*য়া*র’কে মেরে ফেললে সমাজের কোনো ক্ষতি হবে না। বরং আরো লাভ হবে।’ কথাটা পুরো শেষ করার পূর্বেই মকবুল মারা যায়। বিভা তার হাতের মধ্যে পিস্তলটি গুঁজে দেয়। পকেট থেকে ফোনটি বের করে নিয়ে ‘আলবিদা’ শব্দটি উচ্চারণ করে এগিয়ে যায় তার গন্তব্যের দিকে। মনের উপর থেকে সরু পাথরটি সরে গেছে। এখন বড়ো পাথরটি সরানোর পালা। সেটাও একদিন সরবে, গাছের মূল শিকড় উপ্রে ফেললে।
______
সকালে টিভিতে মকবুলের মৃত্যুর নিউস দেখাচ্ছে। তার ব্যাগের মধ্যে নেশা জাতীয় দ্রব্য পাওয়া গেছে। তার ফোনটি গায়েব ছিল। পুলিশ’রা সরাসরি এটাকে সুইসাইড বলতে পারছে না। বিভা আরাম করে কফি খাচ্ছে আর নিউস দেখছে। ফোনে সামিমের একটি ম্যাসেজ আসে। সেখানে লিখা ছিল ‘গুড জব বিভা’। সেটি দেখে বিভা স্মিত হাসে।
.
নয়টার দিকে বিভার সঙ্গে কথা বলতে বলতে অফিসে পৌঁছায় আবির। একটি মিটিং সেরে আবির মারুফের সঙ্গে কথা বলতে বলতে কেবিনে উপস্থিত হয়। গায়ের কোটটি খুলে সোফার উপর রাখে। হেলান দিয়ে ল্যাপটপ অন করে।
‘মারুফ এই প্রজেক্টটি লাভবান হবে আমাদের জন্য। তুই শুধু…’
‘শুনুন।’ বিভার কণ্ঠের স্বর শুনে আবির অবশিষ্ট কথা থামিয়ে চোখ তুলে তাকায়। সে চমকিত! মুখ হা হয়ে গেছে বিভা’কে দেখে। এক নজরে পরিদর্শন করতে ব্যস্ত তাকে। মারুফ হ্যালো, হ্যালো করছে। আবির উঠে দাঁড়িয়ে ‘পরে কথা বলছি’ বলে ফোন কেঁটে দেয়। স্লো গতিতে একবার চোখের পলক ফেলে মোহময় দৃষ্টি নিক্ষেপ রাখে। একি বাস্তবে দেখছে? নাকি স্বপ্ন?
লাল কাতান শাড়ি, লাল চুড়ি, ম্যাচিং গহনা সঙ্গে গর্জিয়াছ সাজ। নতুন বউয়ের মতো লাগছে বিভা’কে। যে কেউ তাকে দেখে ভাববে আজ তার বিয়ে। আবিরের মোহজনিত ভ্রান্তি কিছুতেই কাটছে না। বিভা এগিয়ে আসে আবিরের নিকট। মৃদু হেসে দু’কাঁধের উপর হাত রেখে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
‘চলেন বিয়ে করি। হৃদয়ের বাঁধন মজবুত করি দু’জনার। মিস থেকে মিসেস.আবির হতে চাই আমি।’ পুরো কথা বলে আবিরের চোখে চোখ রাখে বিভা। এই মুহূর্তে আবির নিজেকে ভাগ্যবান বলে দাবী করছে। এতদিনের কষ্ট আজ অবসান হলো। এক চিতলে হাসি ফুটে উঠে তার ওষ্ঠদ্বয়। আবির আলতো স্পর্শে পেটের ওপর হাত রেখে বিভা’কে আরো একটু কাছে টেনে নেয়। নাকে নাক ঘষে নরম স্বরে বলল,
‘অবশ্যই! আজ আর কারো বাঁধা মানছি না। নিজের করে নেবো তোমায়।’ বাক্যটি শেষ করে আবির তার ওষ্ঠদ্বয় এগিয়ে নেয়। দু’জন কপোত-কপোতীর ওষ্ঠদ্বয় মিলিত হয়।
.
.
.
#চলবে?