বাতাসে তার সৌরভ পর্ব-১৫

0
166

#বাতাসে_তার_সৌরভ–১৫

বাউন্ডরি দেয়াল ধরেই ঝাকড়া আমগাছটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে। নদী আজ এসেছে চন্দ্রমল্লিকার একেবারে পেছনে। এই ইউ শেপের রাস্তাটা কয়েকদিন ধরে খুঁজতে তার সময় বের হচ্ছিলো না। ক্লাসের সময় পেরোলেই সোজা ডিউটিতে চলে আসতে হয় বাধা শিডিউল, কাটায় কাটায় সাড়ে দশটার আগে মুক্তি নেই। গেস্টের চাপে রেস্টুরেন্ট থেকে বেরই হতে পারে না ব্যাকইয়ার্ড তো দূরের কথা।

আজ নদীর ভাইবাটা আগে হওয়ায় তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। গেট পেরিয়েই দেয়াল ধরে চলে গেছে একেবারে বাড়ির পেছনে। সামনের দিকে ঝাঁ-চকচকে গ্যাব্রিয়েলস কিচেনের খোলস রইলেও পেছনটায় এখনো চন্দ্রমল্লিকার আবেশ।ব্যাকইয়ার্ডের একেবারে কোণঘেষা পুরাতন বড় আমগাছটা আরো ছড়িয়ে ঢেকে রেখেছে বাড়িটাকে। এই গাছের জন্যই বাড়ির পেছনের একটা বিশেষ অংশ দেখা যায় না। নদীরা থাকতে থাকতে দেখা যেতো।সেটা হলো সার্ভেন্টস এন্ট্রি। পয়ষট্টি বছর আগের ডিজাইনের বাড়িতে কিছু বিলিতি কেতা ছিলো। সার্ভেন্টরা সামনের গেট দিয়ে নয় পেছনের গেট দিয়ে আনাগোনা করত।

এত দিন পর নদীকে এই পথটা খুঁজে বের করার ইচ্ছে জাগ্রত হয়েছে সেইদিন ফ্রিজার রুমে আবিষ্কৃত মেয়েটিকে দেখে। বড় গেটে কড়া সিকিউরিটি, মূল দরজায় ঢুকতে হলে পার হতে হবে সিসিক্যাম ও আর্মস ডিটেকটর ডোরফ্রেম দিয়ে। কিন্তু তারপরো এই অনাহুত অতিথিরা ঢুকছে তো ঢুকছে কোথা থেকে?

বিষয়টা ভালোমতো চিন্তা করেই এই জায়গাটার কথা মাথায় এলো নদীর। এই বাড়ির সম্পূর্ণ পেছনের ওয়ালে লাগোয়া চিকন একটা লোহার দরজা আছে আজও। নদী দেখলো দরজাটা বাইরে থেকে তালা দেয়া। চিকন রাস্তার ওপারে বিশ তালা বিশাল নির্মাণাধীন এপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স। রাতের দিকে হয়ত খেয়াল করারও কেউ নেই।ধরে নেয়া যাক কেউ বাইরে থেকে তালা খুলে ঢুকছে। অর্থাথ এই বাড়িতে ঢোকার তালা তাদের কাছে আছে।

দেয়াল লাগোয়া লোহার দরজা বরাবর ছোট কড়িডোর ধরে বাড়ির পেছনেই আরেকটা দরজা। বাইরে থেকে জানার উপায় নেই তবে নদী জানে এটা পাকের ঘরের সাথে লাগোয়া বারান্দার সাথে যুক্ত ছিলো। এখন নতুন ডিজাইনের বিশাল কিচেনে বারান্দা ভেঙে ফেলা হয়েছে। এই দরজাটা পড়েছে ফ্রিজার রুমের সাথে ।যার মাধ্যেমে সহজেই রেস্টুরেন্টের মাঝে প্রবেশ করা যায়। সেই দরজারই পাশে বাইরে দিয়ে জিকজ্যাক ভাবে উঠে গেছে খোলা সিড়ি। হ্যাঁ এই বাড়িতে মূলত দুটো সিড়িঘর। একটা সদর দরজার পাশ দিয়ে ওঠে যাওয়া আরেকটা একেবারে পেছন দিয়ে ওঠা এই সিড়িটা ছাদ খোলা।এই সিড়ি কিচেনের দরজা থেকে একই বরাবর দোতালার সাথে আরেকটা লাগোয়া দরজায় গিয়ে থেমেছে, এরপর উঠে থেমেছে তিনতালার একটা দরজায় এবং তার পাশ দিয়ে উঠে গিয়ে থেমেছে ছাদে।

নদী অবাক হয়ে কিচেন সংলগ্ন গেটের দিকে তাকিয়ে আছে। দরজায় তালা ঝোলানো। তালাটা নতুন, দরজা বরাবর একটা সিসি ক্যামেরার ফ্রেম লাগনো আশ্চর্যের ব্যাপার হলো ক্যামেরা নেই, খুলে নেয়া হয়েছে।নদী দারোয়ানের সিকিউরিটিরুমে একবার গিয়েছিল এই এঙ্গেলে কোন মনিটরই দেখেনি। তাহলে ক্যামেরার লাইন কে কাটবে?

সেদিন ফ্রিজার রুমে নদী মেয়েটাকে নিজহাতে স্পর্শ করেছিল।কালো, রোগা, উত্তপ্ত তবে নি:সন্দেহে একটা মানবশিশুর হাত। তারা নিয়মিত আসছে, অথবা কারো নির্দেশে ভূত সেজে একে তাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু কেন? কী স্বার্থ তাদের? সমস্যা হলো যারা করছে তারা এই বাড়ির খুনের সঠিক তথ্যটাও জানে না।নদীকে তো চেনেই না।

মনে আছে সাতক্ষীরায় রানুখালাদের বাড়ির কিছু দূরে একটা পরিত্যাক্ত জমিদার বাড়ি ছিলো। ভূতের উপদ্রপের দারুণ বদনাম ছিলো। হুট করে একবার পুলিশ হানা দিয়ে অনেক চোরাচালানের মাল জব্দ করেছিলো। ভূতের রটনাগুলো স্মাগলারদের ছড়ানো গুজব, যাতে মানুষ না আসে৷ এইখানের ভূতের গুজবে কার স্বার্থ?

গ্যাব্রিয়েলকে এই বিষয়ে কি বলবে? নাকি সোহরাব সাহেবকে? কিছু যেন ছল চাতূরী হচ্ছে অজান্তে। নদীকে এতদিন কোন ছুতো করেও ঢাকায় আসতে দেয়া হয়নি। এর পেছনে রানুখালার স্বার্থ ছাড়াও অন্য কারণ নেই তো? বড় মামা কেন এই বাড়ি থেকে দূরে থাকতে বলেছেন? এত এত প্রশ্ন এসে মাথায় অদ্ভুত জট পাকিয়ে দিচ্ছে।
মাথার ওপর গুড়্গুড় আকাশ নিনাদ, জমাটবাধা কালোমেঘের ছায়া পরিবেশ বদলে দিচ্ছে। কয়েকদিনের ঝাঁঝালো গরম শেষে আজ আবহাওয়ায় ঝড়ের প্রস্তুতি। শো শো বাতাসে যেন ঘূর্ণি খাচ্ছে অতীতের ফিসফিস; চন্দ্রমল্লিকার পুরাতন খোলা সিড়ি ঘর নদীকে ডাকছে। একাই পায়ে পায়ে উঠে যাচ্ছে সিড়ি বেয়ে । দোতালা, তিনতালার দরজা তালা দেয়া। আগেও এই দরজাগুল্ক খোলা হতো না কখনো৷ হুটহাট মাঝেমধ্যে হয়তো।

“স্বাধীনতার দুই তিন বছর আগে এক হিন্দু প্রফেসরের কাছ তোমার দাদাজান খুব সস্তায় কিনেছিলো।একাত্তরে হানাদার বাহিনীর হাত থেকে বাঁচতে ক্রাক প্ল্যাটুন এসে লুকিয়েছিলো এই বাড়িতে।
আমার বয়স তখন চার পাঁচ বছর। হঠাৎ আর্মি চেকিং পড়লো সে সময়, খুব চতুরভাবে এই রাস্তা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পালিয়েছিলো। সেই থেকে এই সিড়িটা খুব আশীর্বাদপুষ্ট। ”

নদীর মনে পড়ছে বাবার মুখের কথা গুলো। খুব আবেগপ্রবণ স্মৃতিকাতর মানুষ ছিলেন। বাড়ি নিয়ে অদ্ভুত নষ্টালজিয়া ছিলো। শো শো বাতাসে নদী সিড়ি ভাঙছে কত দূর উঠবে জানে না। অতীত তাকে অন্য পৃথিবীর স্পষ্ট দৃশ্য দেখাচ্ছে,

” এই সিড়িটা একেবারে অপ্রয়োজনের। এত কি জমিদারী? এটা আবার নাকি সার্ভেন্টস এন্ট্রি” মায়ের বিরক্তি মাখা গলা।

” নদী, বাবলু ওই সিড়ি দিয়ে লাফাবি না গতবারও আছাড় খেয়েছিস” মায়ের কি ধমক।

নদীর ঝাপসা চোখে বাবলু যেন লাফিয়ে লাফিয়ে সিড়ি ভাঙছে।

” রাতে রাতে আসি তোমাদের বিরক্ত কর‍তে ভালো লাগে না, আমার জন্য একটা আলাদা চাবি দিয়ে দিতে সিড়ির চাবিটাই দাও নাহয়। পেছন দরজা দিয়ে ঢুকে সোজা রুমে চলে যাব ”

আচ্ছা এটা কার কথা ছিলো?মনে পড়ছে আরও কেউ তাদের সাথে থাকতো।কোন আত্মিয়ো কিন্তু নাম কিছুতেই মনে পড়ছে না কেন? কেউ তো ছিলো। সেইদিন দুপুরে ওই ডাকাতরা ঘরে কীভাবে এসেছিলো? সামনের গেটে দারোয়ান রুস্তম চাচা ছিলো, সে কাউকে দেখেনি। তাহলে এরা সেদিন ঢুকলো কী করে?পুলিশের ভাষ্যমতে বাড়ির বুয়ারও ছিলো যোগসাজশ৷ কি নাম ছিল যেন, সালেহা বুয়া না?

নদী উঠতে উঠতে দাঁড়িয়ে গেল একটা দরজায়। হ্যাঁচবোল্ড লাগানো হলেও তালা দেয়া নয়। নদী হ্যাঁচবোল্ড টেনে খুলে প্রবেশ করলো খোলা ছাদে। না এটা সেই পুরনো চন্দ্রমল্লিকার সাধারণ ছাদ আর নেই। এখানে থেকে থেকে অর্কিট ফুলের টবের সাজানো বড় টেরেস লন। একপাশে নতুন তোলা কাচের ঝকঝকে দুটো ঘর।

চন্দ্রমল্লিকা পরেছে তার নতুন মালিকের পোশাক। নদীর বুকের মাঝে স্মৃতির ঝড় উঠছে। তার সামনে শৈশবের বৃষ্টিভেজা পাগলামীর ছাদ, পুর্নিমার রাতে সাদা রোধে ভেজা ছাদ,বাবা মা বাবলুর সবার একসাথে পাটি পেতে শুয়ে থাকা চাঁদ দেখা ছাদ।

পশ্চিম পাশের বড় আমগাছটা আর নেই, বৈশাখ মাসে বাগানের গাছের কাচ মিঠা আমগুলো ঝুঁকে থাকতো ছাদেই।টেনে টেনে ছিড়ে খাওয়া যেতো। মা মোরব্বা বানিয়ে রাখতেন। এই ঝড়ো বাতাসে কোথা থেকে ভেসে আসছে মায়ের হাতের আচারের সৌরভ…

সর্ষের তেলে পাঁচফোড়নের গন্ধের মিশে থাকতো কাচা আমের অম্লতা, মৌ মৌ করতো গোটা চত্বর। আর কী অসাধারণ স্বাদ! গন্ধেই নদীর পাগল পাগল লাগতো। মা ততটা খেতে দিতেন না।দাঁত পড়ে যাবে নাকি।

বয়াম বয়াম আচার সর্ষের তেলে চুবিয়ে রোদে দিতেন। এমন ঝড় এলে নদী বাবলু ছুটে চলে আসতো ছাদে। বৃষ্টির হাত থেকে বয়ামগুলো রক্ষা করতে। কিন্তু নদীর তর সইতো না।বয়াম খুলে হাত ঢুকিয়ে দিতো আচারে। বাবলুর আচারে নেশা ছিল না। নতুন রোদে দেওয়া জলপাইয়ের আচারের বয়াম তেলে ভেজা হাত থেকে পিছলে পড়ে ভাঙলো।

” কিরে বয়াম ভাঙলো কীভাবে? ”

“আমি জানিনা মা,বাবলু আমায় ধাক্কা দিলো আর পড়ে গেলাম , ”

মা গিয়ে জোরে একটা চড় মেরেছিলেন বাবলুকে।বাবলু ছাদের মেঝেতে পড়ে গিয়ে ঠোঁট কেটে ফেলেছিল।
বিনা কারণে মার খেলো সেটায় খারাপ লাগেনি কিন্তু ভাইয়ের রক্ত ঝরলে নদী কেঁদে ফেলেছিল।

“মার খেলি কেন বললেই পারতি আমি ভেঙেছি ”

” আম্মু তখন তোমাকে মারতো, তোমার ঠোঁট কেটে যেত, তোমার চেহারা পচা হয়ে যেত তখন তোমাকে কেউ বিয়ে করত না।”

ফোকলা দাঁতে বাবলুর কথা মিশে যাচ্ছে ঝড়ের তান্ডবে। ঝাপসা হয়ে আসছে সব… ঝড়ের প্রকোপ কমে ঝরঝর নামছে বারিধারা। নাকি স্মৃতি নদীর বর্তমানকে অস্পষ্ট করে দিচ্ছে। বুকের মধ্যে বৃষ্টির শব্দের সাথে গুমড়ে ওঠা হাহাকার

” আম্মু, আব্বু, বাবলু তোমরা কই! আমাকে নিয়ে যাও প্লিইইইজ আমি খুব একা… ”

**********

” থ্যাংকস ভাই অনেক কষ্ট করলেন ”
নিশি নোমানের হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা নিতে নিতে বলল।
– না না কষ্ট কী, আপনি এই অবস্থায় যা করছেন সেটাও অনেক সাহসের।

– আমি তো ভালোই আছি।

নিশি অল্প হেসে ওড়না টেনে নিলো গায়ে। নোমান তার স্কুল কলিগ। পুরুষ হিসেবে বেশ সুক্ষ্ম নজর বলতেই হবে।

– আপনি ডাক্তার কোথায় দেখাচ্ছেন?

– এই তো কাছেই !সামনের ব্লকে..

– মাদারস কেয়ার? আমার ওয়াইফ ওখানে ডাক্তার সালমাকে দেখাতো ।

-আচ্ছা ।

নিশির অস্বস্তি বাড়ছে। নোমান হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির গেট পর্যন্ত এলে তাকে চায়ের অফার করতে হবে। নিশির পরিশ্রম কর‍তে মোটেও মন চাইছে না।

– আচ্ছা আপু আসি তাহলে।

-অনেক থ্যাংকস ভাই নেক্সট টাইম ভাবি আর বেবিকে নিয়ে আসবেন।

নোমান অল্প হেসে বিদায় নিলো। নিশি তার ফ্ল্যাটের দিকে অগ্রসর হলো। একরুমের সাবলেটে আগের বাড়ির থেকে প্রাইভেসি কিছু বেশি৷ সাবলেট দাতা দম্পতিদের মধ্যে মহিলা বেশ সতর্ক। কড়া নজর রাখেন স্বামীর। নিশি নদী রান্না করা ছাড়া ঘর থেকে তেমন বের হয় না। চাকরিজীবীদের মাঝে নিশি তাড়াতাড়ি আসে।কিন্তু কারো সাথে তেমন কথা বলা হয় না। আজকাল অচেনা কারো সঙ্গই বেশিক্ষণ সহ্য হয় না।

আজ দুপুর দুটায় ছুটির পর স্কুলে নবনিযুক্ত টিচারদের একটা মিটিং ছিলো। কিন্তু টানা ক্লাস,আজকালকার ভয়ঙ্কর দুষ্টু বাচ্চাদের বাঁদরামো সামলে শরীর ম্যাজম্যাজ করায় চলে এসেছে।কপাল ভালো বৃষ্টি নামার আগেই নোমান গাড়িতে লিফট দিলেন ।

এখন বাসায় ফিরে কেমন খিদে লাগছে৷ এই বিষয়টা হচ্ছে কয়েকদিন হলো। বমি আর দুর্বলতা কমে এলেও হুটহাট খিদে লেগে যায়। যদিও স্কুলে একজন মহিলা কলিগ খাইয়েছে বাসায় ফিরে খিদে লাগার মানে আছে?তাদের ঘরের ছোট্ট ফ্রীজটা খুলে নিশির মন ভালো হয়ে গেলো। একটা বক্সে সেদ্ধ, আলু, ডিম, পাস্তা, শশা, টমেটো মেয়োনিজ গোলমরিচ দিয়ে মাখানো সালাদ, আরেকটা ডিশে ঠান্ডা ডিমের পুডিং, একটা বোতলে ভরা তরমুজের জুস। নদীর কান্ড এসব।বিশেষ করে এই মেয়েটার হাতের পুডং স্বর্গীয় খাবারের তালিকাভুক্ত। এত এনার্জি পায় কোথায় কে জানে। নিশির কোন কাজে হাত দেয়া লাগে না।দীর্ঘদিন রানুখালার বাসায় কাজ করে নদীর মধ্যে কর্মীভাব বেশি।

দিনে দিনে চাকরিও নদীর ধাতে চলে এসেছে। সকাল আটটার মধ্যে ঘরের সব কাজ গুছিয়ে বেরিয়ে যায়। ক্লাস সেরে সোজা কাজে। রেস্টুরেন্টে ঝুটো প্লেট তুলে বাসায় ফেরে সাড়ে দশটায়। গোসল সেরে হোটেল থেকে পাওয়া ওর ডিনারবক্সে থেকে ভাগাভাগি করে দুজন ডিনার করে এরপর পরেরদিনের দুপুরের খাবার রেডি করে ফ্রিজে ওঠায়।
এরপর বারোটার দিকে বই খুলে বসে। নামে হোম ইকোনমিকস কলেজ, কিন্তু নদীর পড়ার বিষয়টা সম্ভবত কিছুটা জটিলই। প্রতি সপ্তাহে প্রেকটিকাল থাকে। সারাদিনে ঘুমানো আগে দুই ঘন্টা পড়ার জন্য বের করে। অথচ নিশির এই সময়টাতেই কথা বলার জন্য মুখ চুলকায়।নদী বিরক্ত হয় তবে উত্তর দেয়। কাল তো ক্ষেপেই গেল,

– নদু রাফিনকে কি ওরা মারবে রে?মানে পেটাবে?

নদী বই থেকে মুখ না তুলেই বললো – না মহৎকর্ম করেছেন মহাপুরুষ, তারা কোলে নিয়ে বসে থাকবে।

নিশি মিনমিন করে বলল-জেলে দিয়ে দিক মারধরের দরকার কি বল। ভায়োলেন্স আই ডোন্ট লাইক।

-তার হাতে মার খাওয়ার আগে তাকেও বুঝিয়ে বলতি ভায়োলেন্স ইউ ডোন্ট লাইক।” নদী তার খাতায় কেমিস্ট্রির একটা ইকুয়েশন তুলতে তুলতে বললো।

নিশি মিনমিন করতে করতে বলল -শুনলাম ড্রাগ কেসে ফাঁসিয়ে নাকি তাকে এরেস্ট করেছে,..

– ফাসায়নি, তার কাছে ড্রাগই পেয়েছে। আমি শুধু তুষার ভাইয়ের কাছে তারা আইডি, আর ঠিকানা দিয়েছিলাম। সে তার র‍্যাব বন্ধুকে কনসার্ণ করেছে বাকিটা তারাই ব্যবস্থা নিয়েছে।

– তোর এই মজনু কিন্তু কাজের বেশ। কিন্তু রাফিনকে কি ছেড়ে দেবে..মানে বেশি হার্ম করবে না তো?

নদী এই সময় মাথা তুলে তাকালো বড় লেকচার দেবার প্রস্তুতি নিয়েও সামলে নিলো

– তোর চারমাসের প্রেগ্ন্যাসি না এসব হাবিজাবি চিন্তা ছেড়ে এখন ডাক্তারের এপয়েন্টমেন্ট নেয়া উচিত।

– আমি তো বলসিই,এটা এবর্ট করব না!

– এবর্টের কথা বলছি না,এটার কেয়ারের জন্যই ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত ? সাতক্ষীরায় কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রেগন্যান্ট মহিলাদের আসতে দেখতাম।
তারা রেগুলার মনিটর করে।কীসব ওষুধ দেয়। প্রেগ্ন্যাসির সময় থেকেই বাচ্চাদের হেলথকেয়ার করা শুরু করতে হয়। তোর সব কিছু এখন রুলস এন্ড রেগুলেশন্স এর মধ্যে আসতে হবে।

নিশি এতক্ষণে মাথা তুললো, –রুলস এন্ড রেগুলেশন্স মানে, দাঁড়া, দাঁড়া , তুই কি আমার ব্যাগ থেকে সিগারেট ফেলে দিয়েছিস? কয়দিন ধরে পাচ্ছি না?

নদী উত্তর দেয়নি পড়ায় মনোযোগ দিয়েছে।

– সাহস তো কম না!

– তোর তো অনেক সাহস কিন্তু দায়িত্ববোধ নাই, কাজেই দায়িত্ব নিতে হইছে। এখন থেকে নো স্মোকিং। তোর ডায়েট প্ল্যান করতেসি সেভাবেই খাবি

-পাকা পাকা কথা বলবি না, তুই ডাক্তার না

-কিন্তু আমি নিউট্রিশানিস্ট, মানে হবো আরকি…

নিশি হেসে মাথা দুলিয়ে বলল – বাবুর্চির বউ, নিউট্রিশানিস্ট; নট ব্যাড

– বাবুর্চির বউ,মানে?

– ও বাবুর্চি না তো শেফ, হট এন্ড হ্যান্ডসাম, তোর জি এস স্যার। ওহো, নাম নিলেও টমেটোর গাল লাল হয়ে যায়,

নদী জবাব দেয়নি বিরক্ত হয়ে পাতা উল্টেছে নিশি স্বগতোক্তি করলো,
আমার ডাউট হচ্ছে বিষয়টা, ইউনো গতরাতে আমাকে এত্ত চেপে ধরে ঘুমাইসিলি , বিজবিজ করে কি যেন বলতেসিলিও, ও ডার্লিং গ্যাব্রিয়েল… হোল্ড মি টাইট ইউ আর ড্রাইভিং মি ক্রেইজি বেইবি.. ওহ বেবি…

নিশি কথা শেষ করতে পারেনি একটা বই উড়ে এসেছিল তার দিকে। আশ্চর্যের বিষয় হলো নদীটার শ্যামলা গাল সত্যি লাল দেখাচ্ছিলো। যেটা বিরল। তার গ্যাব্রিয়েল স্যারের রান্নার প্রশংসা এক দুবার মুখ ফসকে বলে ফেলেছিল এর কারণে নিশি পেয়ে বসে মাঝেমধ্যে।

নিশি নদীর বানানো পাস্তা সালাদ খেতে খেতে ঘর গোছাচ্ছে। মাথায় অন্য একটা চিন্তা। নদী নিশিকে বারবার ডাক্তারের কাছে যেতে বলছে। যেটা যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু নিশির সামনে অন্য একটা লক্ষ্য। যেটার চেষ্টা সে করে যাচ্ছিলো কয়েকদিন থেকেই। আজ সকালেই তার একটা গতি হলো । নিশি তার ব্যাগ থেকে একটা পাসপোর্ট বের করলো। যেথায় একজন চৌদ্দ বছরের ইন্ডিয়ান বংশাদ্ভুত কিশোরী কন্যার ছবি সাঁটানো।

চৌদ্দবছর বয়সে যখন নিশি বাংলাদেশ এলো তখন তার আমেরিকান পাসপোর্টটা জমা ছিলো নিশির এক চাচার কাছে। নিশির মার শানুর কড়া নির্দেশ ছিল কোন অবস্থাতে পাসপোর্ট তাকে দেওয়া না হয়। বাবামায়ের প্রতি বিতৃষ্ণা এখানকার নতুন বন্ধুবান্ধব সব মিলিয়ে নিশির তেমন আগ্রহ হয়নি। এখন এই পাসপোর্টটা সে বেশ কৌশলে আদায় করেছে। চাচার ছেলেকে ক্রমাগত চ্যাট করে পটিয়ে হাত করেছে। বাবার কাছ থেকে আদায় করে কিছু টাকাও তাকে দিতে হয়েছে। ফলস্বরূপ আজ সকালে তার চাচার কবার্ট থেকে পাসপোর্ট চলে এসেছে নিশির হাতে। আমেরিকান এম্বাসির একজন কাউন্সিলর সুজানের কাছে জমা দিলে নিশির নতুন পাসপোর্টে প্রসিজর শুরু হয়ে যাবে।

এরপর যাবার প্রস্তুতি। রাফিনের ফারা কেটে গেছে তার দেয়া আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত মনটাকে শক্ত করতে হয়েছে। ক্রমশ ধাবমান জটিল জীবনটাকে এই দেশে আর টানবে না। নতুন একটা জীবনের দায়িত্ব নেবার আগেই এই জাজমেন্টাল সমাজের সীমার বাইরে তাকে চলে যেতে হবে। এটাই ভালো হবে। কিন্তু বিচিত্র বিষয় হলো আজকাল হঠাৎ একটা চিকন সুতোর তীব্র টান বোধ হচ্ছে৷ নদীটার কী হবে?যদিও নদী ধীরে ধীরে শক্ত হচ্ছে, মফস্বল ছাড়িয়ে মেট্রো সিটির নিয়মে নিজেকে ঢেলে সাজাচ্ছে। কিন্তু অরক্ষিত এই শহরে একা নদী সামলাতে পারবে তো?হোস্টেলে সিট পেতে নাকি এখনো এক বছর লাগবে। এর মাঝে একাই সার্ভাইভ করতে হবে। কোন বিপদে যদি পড়ে? কোন চোট্টা বদমাশ যদি ওর পেছনে লাগে? নদীকে নিশির যাওয়ার ব্যাপারে খুলে কিছু বলাও হয়নি । কেমন যেন অপরাধবোধ হচ্ছে। ভালো হতো যদি নদীটার খেয়াল রাখার মতো কেউ থাকতো,যাকে বিশ্বাস করা যায়। কিন্তু আসলেই কি এই পৃথিবীতে কাউকে বিশ্বাস করা যায়?

নিশি আননোন নাম্বার থেকে কল এসেছে। নিশি চঞ্চল হয়ে রিসিভ করলো সুজানা হবার সম্ভাবনা খুব বেশি৷ সে পাসপোর্টের খোঁজ করছিলো..
-হ্যালো
– নিশি আমি এলা
– ওহ এলা বল ডার্লিং! কী অবস্থা।
এককালীন কলেজমেট এলার কন্ঠ শুনে কিছু হতাশই হলো নিশি৷

– তুই কি অনলাইনে নাই? ম্যাসেজ দিচ্ছি সিন করতেসিস না?

– না আসলে বাইরে ছিলাম খেয়াল করিনি।

– ইনবক্সে যা ভিডিও পাঠিয়েছি কয়েকটা। একটু দেখ। আমাকে আমার কাজিন ট্যাগ করে দেখিয়েছে , তোর সাথে নাকি চেহারায় খুব মিল। আমি কোন মিল পাই নাই।কিন্তু অনেকে বলতেসে…
নিশি কথা বেশী আগাতে পারল না।কোন মতে ফোন রেখে দিল।কাঁপা হাতে ইনবক্সে গেল। চোখের সামনে চলমান কিছু অস্পষ্ট, স্পষ্ট দৃশ্য যা তার অপরিচিত নয়,কিন্তু ঠিক দেখেও দেখা যায় না। রাফিন এরেস্টেড তাহলে এই ভিডিও এখন কীভাবে অনলাইনে?নিশির শরীর হঠাৎ করে কেমন ছেড়ে দিচ্ছে। হাত-পায়ে যেন কোনো শক্তি নেই। বুকের ধ্বনি বেড়ে গেছে প্রায় কয়েকগুণ। নিশির হঠাৎ শরীর খারাপ লাগছে। মাথার চুলের গোড়া ঘামছে ক্রমাগত তল পেটে চিনচিন ব্যথা। নদীর নাম্বারে একবার ফোন দিলো লাইন বিজি।নিশি প্রায় জোর করে পা টেনে বাথরুমে গেলো।
তার জীবনটা স্বাভাবিক হবে না স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে যেতে হবে কারণ নিশি খুব স্ট্রং। বেসিন ছেড়ে জোরে জোরে মুখে পানির ঝাপটা দিচ্ছে । কিন্তু তাতে কোন লাভ হচ্ছে না,কেন মনে হচ্ছে তার পায়ের তলের মেঝে ফাঁক হয়ে সে অতল গহবরে ঢুকে যাচ্ছে। তলপেট থেকে নিম্নাংশ কেমন যেন এক ব্যথার ঢেউ খেলা করে যাচ্ছে।সোজা দাঁড়াতে পারছে না নিশি। নদীকে কি ফোন দেবে? ফোনে নিতেও রুমে যেতে হবে। নিশি ততটা শক্তিও যেন পাচ্ছে না। বাইরে ঝমঝম বৃষ্টির শব্দে চাপা পড়ে যাচ্ছে নিশির আর্তনাদ…।

*****
রম্য ঝিম ধরে বসে আছে থিয়েটার রুমে।
তার সামনে দি কামিউটারের নেট ভার্সন। চলতি বছর অর্থাৎ দুই হাজার আঠেরোর সবরেকর্ড নাকি এই সিনেনা ভেঙে ফেলছে। ভয়ংকর সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার যেখানে কায়দা করে মাইকেল নামক একজন প্রাক্তন পুলিশ অফিসারকে একটা চলন্ত ট্রেনে ফাঁদে ফেলে দেয়া হয়। চিটিং করলে মাইকেলের পরিবার পড়বে ঝামেলায়। লিয়াম নিসেনের অসাধারণ অভিনয়, টানটান স্ক্রিনপ্লে একেবার সিটে বেধে রাখার মতো।।কিন্তু রম্য ঠিক মনোযোগ দিতে পারছে না। অর্ণব কয়েকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছে তার সাথে কথাই বলতে মন চাইছে না।অনিই সব নষ্টের গোড়া। তার পরামর্শেই রম্য শ্রেয়ার বাড়িতে গিয়েছিল গতরাতে।

এই দেশের ক্ষমতাবান আর ধনবান মানুষদের মধ্যে একটা বিচিত্র দেবতা দেবতা ভাব থাকে।সেটা হয়ত সবার মধ্যেই থাকে তবে এইখানে মানুষ নিজেকে জাহির করতে ভালোবাসে। শিষ্টাচারে নিজের ধূর্ততা ঢেকে রাখতে চায় না শ্রেয়ার পরিবারও তার ব্যাতিক্রম নয়। শ্রেয়ার বাবা শিল্পপতি সাবেথ আহমেদ বেশ হাসিমুখেই এগিয়ে এলেন যেন তারই অপেক্ষায় ছিলেন।
মা বিখ্যাত সোশাল ওয়ার্কার তিনিও ব্যস্ত হয়ে আপ্যায়ন করলেন যেন রম্যের জন্যই অপেক্ষা করছিলেন, ইংরেজিতে বললেন,

” কী অবস্থা বল তো ঝগড়া করে কী করেছ। শ্রেয়া তো আজকের দিনে ঘর থেকেই বের হচ্ছে না। সত্যি তোমরা পারোও লাভার‍স কোয়ারেল আর সুইটার দ্যান এপেল।

শ্রেয়ার মায়ের শেষ কথায় রম্য ধন্ধে পড়ে গেল। মহিলা ঠাট্টা করলেন না কি অন্য কিছু বোঝা গেল না আর এতে রম্যের
কিছু যায় আসে না। তবে গাত্রদাহের কারণ হলো তার চাচাতো ভাই ইফতেফার আহমেদ। সদ্য চল্লিশ পেরোনো অল্পবয়সী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী , ব্যস্ততা সত্ত্বেও পারিবারিক অনুষ্ঠানে এসেছেন। তার রাজনৈতিক আচার বিচারে কারো কোন সমস্যা নেই অর্থের ধর্ম সব দলের ক্ষমতার কাছেই সমান। তবে তিনি সদ্য একটা বড় হাউজিং কোম্পানি সানশাইনে বিল্ডারসে শেয়ার কিনেই হয়েছে ঝামেলা। সানশাইনের নতুন এমডি ইফতেখারের খুব শখ ধানমন্ডি লেকের কাছেই একটা ফাইভস্টার হোটেল বানাবেন। যেখানে গ্যাব্রিয়েল কিচেনের পজিশন পড়ে যায়। এত দিন পরোক্ষ ভাবে কথা চালাচালি হয়ে তেমন ফলপ্রসূ কিছু পাওয়া যায়নিম শ্রেয়াদের বাড়িতেই সরাসরি আলাপ হলো। ইফতেখারের আচরণ সব সময়ই খুব নম্র। শুদ্ধ ইংরেজিতে মুগ্ধ করা বয়ান,

” তুমি তাহলে সেই জাদুকর যার চর্চা সব জায়গায়।আমি কিন্তু শিল্পের বিশাল কদরদান,আর রান্নার পেশায় সবাইকে আমার শিল্পীই মনে হয়। তবে শিল্পীদের আসলে ঝামেলায় না জড়ানোই ভালো,তারা থাকবে তাদের ক্রিয়েটিভিটি নিয়ে সেটা সামান্য রেস্টুরেন্টের হোক কি ফাইভস্টার। এই দেশের নিজেস্ব কিছু নিয়ম থাকে গ্যাব্রিয়েল ”

গ্যাব্রিয়েল এর উত্তর দিয়েছিলো ঘুরিয়ে,” ওহ নিয়মের কথায় মনে পড়লো, তোমার দেশের সরকারকে ধন্যবাদ দিতে চাই। জানো তো আমার উত্তরাধিকার সূত্রে নাগরিকত্বের যে এপ্লাই করেছিলাম সেটার অনুমোদন হয়ে গেছে। এখন আমি এখানকারও নাগরিক। আমার এখন দ্বৈত নাগরিকত্ব

“মানে? ”

“মানে তুমি নিয়মের কথা বলছিলে। আমিও নিয়ম মতোই সব কিছু করতে পছন্দ করি এবং করব। তবে আমার উপর কোন অনিয়ম খাটাতে এসো না প্লিজ। ”

ইফতেখার কথা বাড়ায়নি।রম্য জানে প্রচন্ড ধূর্ত এই চরিত্রটাকে কায়দা করতে মাথা ঠান্ডা রাখা প্রয়োজন। ইফতেখারের মাথা বল্কে উঠলেও একজন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকের ওপর মেজাজ খারাপের বোকামো করতে চায়নি। এই বান্দা নি:সন্দেহে গোঁয়ার।পৃথিবীর প্রতিটি দেশে এদের মাতব্বরি। একে সামলাতে হবে ভিন্ন প্রক্রিয়ায়।ইফতেখার আর কথা আগায়নি।

রম্যকে এক পর্যায়ে শ্রেয়ার ভাই ইমরান টেনে নিয়ে গেল বোনের ঘরের দিকে।যেতে যেতে নিচু গলায় কিছু নির্দেশনা,

” শ্রেয়ার কন্ডিশন নিয়ে ডিস্কাস করতেই চাইছিলাম তোমার সাথে। জানো তো ড্যাডের ফ্রিডম চ্যানেলের দায়িত্ব তো আমারই। মিডিয়া নিয়েই ব্যস্ত থাকি ওর সাথে দেখাও কম।হুট করে অকারেন্সটা শুনে ভয় পেয়ে গিয়েছিল। আমি আরো কেয়ারিং বিহেভ আশা করি যেহেতু তুমি ওর খুব ক্লোজ। শ্রেয়ার সমস্যা হলো বাইপোলার ডিজ অর্ডার সাথে অবসেসিভ কমপালসিভ ডিজ-অর্ডার।একটা বিষয়ে মাথায় ঢুকে গেলে সহযে বের হতে না চাওয়া। অচিরেই ট্রিটমেন্টে যাওয়া দরকার আমরা কেউ বুঝতে পারছিনা দিনেদিনে এটা ভয়ঙ্কর হয়ে যাচ্ছে।
ইমরানের কথায় রম্য করিডোরে থেমে গিয়েছিল। ইমরান স্বগোতক্তি করল, আমরা ওকে ভ্যাকেশনের নামে বাইরে সাইকিয়াট্রিক ট্রিটমেন্টে নিতে চাচ্ছি কিন্তু সে যাবে না। বিশেষ করে তোমার সাথে কথা না বলে এখন ওকে বোঝাতে পারো শুধু তুমি। আশা করি তুমি কো-অপারেট করবে।

ইমরান দরজা থেকে বিদায় নিলো। কিছুটা বিভ্রান্ত হয়েই রম্য শ্রেয়ার ঘরে এগোলো। ছাদের সুদৃশ্য ক্রিস্টালের ঝাড়বাতি একপাশে হেলানো, ফ্রেমে বাধা ছবির কাচ ভাঙা , অনেক জায়গা থেকে ফার্নিচার সরানো হয়েছে। প্রবেশ করেই মনে হলো একটা ঝড় বয়ে গেছে৷ বিছানায় অর্ধ শায়িত রম্যকে দেখে কান্নায় ভেঙে পড়লো শ্রেয়া৷ শক্ত করে জড়িয়ে এভাবে ফোঁপাতে রম্য হকচকিয়ে গেল। গোঙাতে গোঙাতে একই কথা ঘুরে ফিরে চারপাঁচ বার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে

” আমি সরি, আমি সরি রম্য। আমি তোমায় আপসেট করতে চাইনি। আমার টেম্পার লুজ হয়ে গেলো। আমি সামলাত্র পারিনি… আমার নিজের লজ্জা লাগছে আমি কতবার তোমায় কল দিতে চেয়েছি লজ্জায় দিতে পারেনি। আমি খুব লজ্জিত রম্য

” ইটস ওকে শ্রেয়া… আমি বুঝতে পারছি “রম্য বলতে বাধ্য হয়েছিলো। “কিন্তু তোমার নিজের খেয়াল রাখা দরকার। হঠাৎ এমন রিএকশন অন্যের নয় তোমার নিজেরও ক্ষতি হচ্ছে। তোমার কি মনে হয় না এটার জন্য চিকিৎসা দরকার? ”

” আমার ভালো হয়ে যেতে ইচ্ছে করে ”

” একজন সাইকিয়াট্রিস্ট তোমাকে সাহায্য করতে পারেন, যাবে”

” তুমি চাইলে যাবো ”

” আমি অবশ্যই চাই ”

” তুমি চাইলে জীবনও দিয়ে দেব, বুঝতে পারছ তুমি কত স্পেশাল?”

আজ শ্রেয়া গলা জড়িয়ে অধরের দখলের সুযোগ নেবার আগে রেস্টুরেন্ট থেকে ফোন বেজে উঠেছিলো।রম্য দ্রুত পাশ কাটিয়ে ওঠে আসতে পেরেছিলো। শত বিতৃষ্ণার মাঝে তৃষ্ণা লুকিয়ে থাকে তাকে সুযোগ না দেয়া যুদ্ধ জয় একই ব্যাপার।

একা থিয়েটার রুমে এখন ভাবছে,আর পুরো ব্যাপারটাকে ঘোলাটে লাগছে। শ্রেয়ার মায়ের এমন রহস্যময় কথা ইমরানের সতর্কবাণী। শ্রেয়ার নিজের এমন অদ্ভুত আচরণ সবকিছু কেমন জট পাকিয়ে দিচ্ছে।

” ইউ শুডনট বি হিয়ার গ্যাব্রিয়েল। ” পার্টির এক পর্যায়ে হাতে ড্রিঙ্ক ধরিয়ে দিতে দিতে শ্রেয়ার বোন রিয়া পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, ” ওকে বেশি প্যাম্পার করে নিজের ঝামেলা বাড়িয়ো না। শি ইজ সিমপ্লি এ ডেভিল লাইফ হেল করে দেবে তোমার।”

“রিয়া আমি বুঝতে পারছিনা কি বলছ ”

“বুদ্ধি খাটাও বুঝতে পারবে, ও তোমাকে নিয়ে ভয়ংকরভাবে অবসেসড। বাইপোলার ডিসঅর্ডার এর রোগীদের এই সমস্যাগুলো হয়। একটা জিনিস বা একটা বিষয়ে কারো কারো জন্য একটা মানুষ হয়ে যায় অবসেশন । তুমি হলে গিয়ে শ্রেয়ার জন্য তেমন ”

রম্যের বিস্ময়ের সীমা রইলো না এই মেয়ে কি বলছে।

” এটা আজকে থেকে না অনেক আগে থেকে। ওর মাথার মধ্যে একটা জিনিস ঢুকে গেলে সেটা আদায় না করে ক্ষান্ত থাকে না।ইদানীং সেটা হলে তুমি ”

রম্য হতভম্ব হয়ে শুনে যাচ্ছে। রিয়া হেসে বলছে,সে তোমার দেশে আসার পর প্রত্যেকটা মুহূর্তের খবর রাখে। রীতিমত স্পাই করে৷ কোথায় যাচ্ছ কার সাথে বন্ধুত্ব হচ্ছে, কার সাথে ইন্টিমেসি হচ্ছে সবই খবর রাখে। কিছুদিন আগে সে জেনেছিল তোমার বাড়ি থেকে মাঝরাতে একটা মেয়ে কি যেন নাম লিলিয়াম,যে ভূতের ভয়ে পালিয়েছে। শ্রেয়া তাকেও খুঁজে বের করেছে। কনফার্ম হয়েছে তোমার সাথে তাঁর ব্রেকআপ হয়েছে কিনা।কথাবার্তার একপর্যায়ে হাতাহাতিতেও চলে যাচ্ছিল। এখন খোঁজ নাও ঠিকই প্রমাণ পাবে। তুমি কি জানো ও যে অনেককেই বলে বেড়ায় তোমার সাথে তার এঙ্গেজমেন্ট হয়ে গেছে?

রিয়ার কথায় রম্যের কন্ঠ খসে পড়েছিল।
” বাবা-মা বলছে এসব ওর পাগলামি, আমি বলব এটা তার শয়তানি ,যদি নিজের ভাল চাও তাহলে একশো হাত দূরে থাকো শ্রেয়ার কাছ থেকে।আরো একটা পরামর্শ শোনো, এই দেশে কোন জিএফ বানিয়ো না। কোন গোপন প্রেয়সীও নয়, শি উইল সিমপ্লি কিল হার ”

গত রাতের এইসব ছেড়া স্মৃতি চোখে ভাসছে আর রম্যের ভেতরটা তিতা হয়ে যাচ্ছে। স্বনির্ভর মানুষের সবচেয়ে বেশি ক্রোধ আসে , যখন সে বোঝে ফেলে অন্যকেউ তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছে।
রম্য বিরক্তিতে মনিটর অফ করলো। সিনেমা বাদ দিয়ে ট্রেড মিলে কিছুটা ঘাম ঝরালে হয়তো বিষণ্ণতা কাটবে।

জিমনেশিয়ামের ছাদমুখি দরজাটা মিরর গ্লাস দিয়ে স্লাইড করে দেওয়া। ছাদের একটা অংশ জিমের থেকেই দেখা যায়।রম্য বাইরের পরিবেশ দেখতে দেখতে মন ঘোরাতে চাইছে।এই দেশে আকাশ সবচেয়ে সুন্দর হয় বৃষ্টির আগে।
আজ আকাশ বেশ গাঢ়ভাবে কাল করছে।থেকে থেকে সাদা বিদ্যুৎ এঁকেবেঁকে চিরে দিচ্ছে আকাশের বুক। বৃষ্টির সাথে শো শো বাতাস সবকিছু ওড়াতে চাইছে তবে টলাতে পারছেনা বেশ কিছু জিনিস। ছাদের মাঝ বরাবর স্থির দাঁড়িয়ে থাকা কোন নারীমূর্তি তেমনই কিছু।।

বেগুনি কামিজ, ওড়না, আর জিন্স পরনে। ঝুমবৃষ্টিতে ভিজে জবজবে সে। সমস্যাটা কি জানতে রম্যের ইচ্ছে করলো ছাদে দিয়ে দেখতে, তখনই মেয়েটা নড়ে উঠলো। ঘুরে এই পাশে ফিরলে চেনা গেল তাকে । মনে হলো মেয়েটা একা বৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলো। কান্না এমন একটা আবেগ যেখানে মানুষকে নিজেরই অবয়বের কাছে দাঁড়াতে হয়। অন্যকারো প্রবেশাধিকার সেই সময় নিষেধ। রম্য ছাদে যাবার থেকে নিজেকে নিবৃত করল। থিয়েটার রুমের ভেড়ানো দরজা থেকেই মনোযোগ দিয়ে দেখছে তাকে। সিক্ত দীর্ঘাঙ্গী জলপরির গড়ন;বিষণ্নতার সাথে নবতারুণ্য জ্বলজ্বল করছে গোটা ব্যক্তিত্বে । রম্যের বুকের স্পন্দন হঠাৎই যেন বিশ্বাসঘাতক হলো, সাথে একটা বিদঘুটে অনুভব। এই মেয়ের কি আসলে বাবার সাথে…?সিরিয়াসলি?বিশ্বাস করা সম্ভব? আচ্ছা যদি না হয়…

” এই দেশে কোন জিএফ বানিয়ো না। কোন গোপন প্রেয়সীও নয়…” অদ্ভুত তো! রিয়ার এমন কথা এখন মনে আসার কি কোন যুক্তি আছে? তবে কিছু যেন আছে মেয়েটার মধ্যে, যা স্নায়ুতে চাপ ফেলে। একদিকে মন বলে সে সামনে থাকুক, অন্যদিকে বলে চলে যাক সে, এখনই যাক..।

ছাদে জবজবে ভিজে নদীরও স্তম্ভিত লাগছে। বৃষ্টি অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তাকে আগা থেকে গোড়া ভিজিয়ে দিয়েছে । এদিকে ডিউটি আওয়ার শুরু হতে দেরি নাই। অতীত চোখের পর্দায় লুকিয়ে নদী কী মনে করে জিমনেশিয়ামের রুপালী মিররের স্লাইড দরজা খুলে ফেলল।ছাদে এই ঘরটা আগে ছিলো না, এক পাশ দিয়ে নতুন তোলা হয়েছে। সবুজ কার্পেটিং করা ঝকঝক করছে কারো ব্যায়ামাগার । ওই পাশে আরেকটা ঘর দরজা ভেড়ানো হলেও অন্ধকার ; বোঝাই যাচ্ছে কেউ নেই ।নদীর ফোনে ম্যাসেজের ঘন্টা ,

“মেহরোজ আর ইউ ইন? ”

” ইয়েস স্যার”

” গ্রাউন্ড ফ্লোর ইজ গেটিং ক্রাউডেড, আই ওয়ান্ট ইউ টু কাম ডাউন শার্প ”

” আই এম কামিং স্যার”

জি এস স্যারের ম্যাসেজে দ্রুত রিপ্লাই দিয়ে ফোন রাখলো। জিমের বড় আয়নায় নিজের কাকভেজা অবস্থা দেখে রাগ লাগছে। এমন ভেজা অবস্থায় ছাদ থেকে রেস্টুরেন্টে ঢোকা মানে কেয়ামত টেনে আনা। এই চাকরি কোন অবস্থাতেই ঝুঁকিতে ফেলতে রাজি নয়। নদী দ্রুত
কলেজ ব্যাগ থেকে ওয়েট্রেস ইউনিফর্ম বের করলো। আয়নায় ছায়া পড়ছে পাশের ঘরের খোলা দরজার,সেখানের আঁধারকে অবজ্ঞা করেই নদী ভেজা কামিজ খুলে ফেলল। তড়িৎগতিতে তৈরি হচ্ছে।এমন ভাবে নিচে যাবে যেন কেউ বুঝতে না পারে কোথায় ছিল।উফ, আবার ফোন বেজে যাচ্ছে, নিশি! তার এলোমেলো বকবকানি শোনার এখন অবসর নেই। নিচে ভিড় বাড়ছে, গ্যাব্রিয়েল খোঁজ করছে তার,ডিউটি কলিং…

(চলবে)
#শারমিন_আঞ্জুম