#বাদামি_চোখ [১৪]
দুজন মানুষ একসাথে থাকতে না চেয়ে একসাথে কি করে থাকতে পারে? আর থাকলেই বা তারা কেমন করে ভালো থাকবে?
আমি লিয়নের বউয়ের দিকে তাকিয়ে এসবই ভাবছিলাম।
আর লিয়ন তাহলে কয়েকদিন আগে ওই লেখাটায় তার এমন অস্বস্তিকর জীবনকেই বুঝাতে চেয়েছিল। আসলেই সে তার জীবনসঙ্গীর সাথে ভালো নেই। তারা দুজনেই এই সম্পর্কে খুশি না। তবুও কোনো এক অদ্ভুত শিকলের বাঁধায় পড়ে দুজন একসাথে আছে!
আর আমি আমার ভাবনার মধ্যেই লিয়নের বউয়ের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বসলাম,
‘ তাহলে আপনারা একে অপরকে বিয়ে করলেন কি বুঝে?
লিয়নের বউ হেসে আমার কাঁধ চাপড়ে বললো,
‘ কিছু না বুঝে বিয়ে করার ফলই হলো এটা। অতঃপর বুঝার পর অমিল! আমাদের চিন্তা, ভাবনা, স্বভাব, চরিত্র, ইচ্ছে, অনিচ্ছে, সবকিছুই আলাদা। আর আমাদের কারো মধ্যে ধৈর্য্য ধরে মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতাও নেই। তাই একসাথে থাকার ইচ্ছে ফুরিয়েছে সেই কবে! আমাদের সম্পর্কটা এখন শুধুই লোক দেখানো!
লিয়নের বউ আরো কিছু বলতে যাচ্ছিলো, তখনি সে দেখলো আমি পেছনে তাকিয়ে তনয়ের ছোট ফুফির সাথে কুশলাদি বিনিময় করছি। সে আমাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে এরপর ঘুরে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো।
তনয়ের ফুফু বেশ মজার মানুষ। আর আমিও উনার সাথে কথা বলায় এতটাই মগ্ন হয়ে গেলাম যে লিয়নের বউকে আটকানোর কথাটুকু পর্যন্ত ভুলে গেলাম।
পরবর্তীতে আমার মনে হলো সে কি রাগ করে এখান থেকে চলে গেছে নাকি? কথার মাঝে হঠাৎ অন্যদিকে ফিরে গেলাম রাগ না করলেও অপমানবোধ তো নিশ্চয়ই অনূভব করেছে।
তারপর আমি রান্নাঘরে একবার উঁকি দিলাম, কিন্তু রান্নাঘরে এই মূহুর্তে কেউ নেই। সবাই এখান থেকে বেড়িয়ে গেছে। অথচ পাশে দাঁড়িয়েও আমি খেয়ালই করতে পারিনি সবাই কোনদিকে বেড়িয়ে চলে গেলো।
আমি একা একা এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে আমার শাশুড়ীর রুমের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম। তখনি আমার পথের মধ্যে লিয়ন এসে দাঁড়ালো। আর দাঁড়িয়েই বললো,
‘ নিবিতা তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল!
আমি বেশ অবাক হলাম। বিয়ের কথা থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত অসংখ্যবার দেখা হলেও একবারও সে সাহস করে কোনো কথা বলতে আসেনি। আজকে খুব সাহস নিয়ে একদম সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
কিন্তু আমি অবাক হওয়ার ভাবখানা লুকিয়ে রাগান্বিত চেহারায় বললাম,
‘ দুঃখিত! আপনার কথা থাকতে পারে তবে আমার শোনার মতো কোনো ইচ্ছে নেই।
বলেই আমি শাড়ির কুঁচিটা বা হাতে ধরে ওকে পেরিয়ে চলে আসলাম। সে অসহায় দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু ওর এই দৃষ্টি আমার মায়াতে একটুও বাঁধেনি । এমনকি ওর কথা শুনতেও আমার কোনো রকম ইচ্ছে হয়নি ৷ আর কিই বা বলবে সে? আবেগময় কথা ছাড়া দরকারী কথা তো আর নয় ৷ আর এসব আমি কেন শুনবো? যখন একটু প্রায়োরিটি পাওয়ার জন্য ছটপট করে মরেছি তখনি তো দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলো। আমার স্পষ্ট মনে আছে ওর গায়ে হলুদের রাতে আমি ওকে ২০০ বারেরও বেশি ফোন দিয়েছিলাম, কিন্তু সে আমার ফোন দেখে মোবাইলটা সাইলেন্ট করে রেখে দিয়েছিলো। কেননা রিসিভ করলেও কোনো অভিযোগে ধমকাতে পারবেনা, কারণ সে তখন পরিবারের লোকজনের দোষ দিয়েছিলো, তারা নাকি আমার বাদামি চোখের জন্য আমাকে মেনে নিবেনা, আর সেসময় যদি সে ফোন রিসিভ করতো এবং আমি নিশ্চয়ই কান্নাকাটি করতাম এতে তো সে বিরক্ত হলেও তা প্রকাশ করতে পারতোনা, আর বিষয়টা তখন কেমন দেখাতো? তাইই হয়তো রিসিভই করেনি।
তবে আমি সেসবের কিছুই ভুলিনি,প্রতিটি সেকেন্ড আমার মনে গাঁথা আছে। বেশ হয়েছে ওর কাছাকাছি আমার স্থান হয়েছে, কাছ থেকে ওর অতিরিক্ত ভালো থাকাকে তো এখন দেখতে পাবো!
আর সেও দেখবে একজনকে ছাড়াও কেউ খুব ভালো থাকে।
এদিকে আমার শাশুড়ির রুমে যেতে কেবল আর একটা দরজা পেরুনো বাকি। লিয়ন এখনো আমাকে দেখছে। আমি খুব দ্রুত গতিতে হেঁটে এই অচেনা রুমটা পার করতে যাবো তখনি হাতে শক্ত করে ধরে কে জানি একটানে এই দরজাটার ভেতরে নিয়ে গেলো। বাহির থেকে আমি শুধু ঝাপসা তার হাতটাই দেখলাম। ভয়ে কেঁপে ওঠতে গিয়েও পারলাম না, তার আগেই দেখলাম এটা আর অন্য কেউ নয়, আমার সে,আমার পৃথিবী!
আমি ভয়ার্ত চেহারাখানাকে হাসিতে রূপান্তর করে বললাম,
‘ কি হ্যাঁ? এত মানুষের মধ্যে এভাবে টেনে নেওয়ার মানে কি?
তনয় গম্ভীর হয়ে বললো,
‘ এখানে শুধু লিয়ন ভাই ছাড়া এখানে আর কেউ দেখেনি৷ উনি তোমাকে কিছু বলছিলো মনে হচ্ছে?
আমি চোখ বাঁকিয়ে বললাম,
‘ বউয়ের উপর খুব নজরদারি তাইনা? এটা শুনতেই টেনে আনলেন?
তনয় আমার নাক টেনে বললো,
‘ এই যে এতো নাক ঘামছে কারণ কি জানো? বর বেশি ভালোবাসবে! সবসময় ছায়ার মতো থাকবে৷ না মানে আমি ছোট বেলায় বয়স্কদের কাছে এসব শুনতাম আরকি, তবে সত্য মিথ্যে যাই হোক আমার ক্ষেত্রে এখন বাস্তবায়ন করতে দোষ কি বলো? তাই সবসময় নজর রাখি! আচ্ছা এসব বাদ দিয়ে বলো , লিয়ন ভাই কিছু বলতে চাচ্ছিলো মনে হলো, তুমি চোখ রাঙিয়ে বিরবির করে কিছু বলে চলে এলে! কি বলছিলে?
আমি তনয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘ সে বললো, আমাকে কিছু কথা বলার আছে। আর আমি বললাম, আমার শোনার ইচ্ছে নেই৷ এইটুকুই। আর আমি কেন শুনবো বলেন তো? এই মূহুর্তে আমার কাছে আপনার পরিবার ছাড়া দুনিয়ার কাউকেই দরকারী বলে মনে হচ্ছেনা। সেখানে ওর মতো একটা মানুষ তো একদমই না!
তনয় কিছু বলতে গিয়েও আমাকে ছেড়ে দিয়ে বললো,
‘ আচ্ছা যাও কোথায় যেন যেতে চাচ্ছিলে৷
আমি কিছু না বুঝে চোখ ঘুরিয়ে দেখি এই রুমের খোলা জানালা দিকে তাকাতে তাকাতে লিয়নের বউ দরজা পেরিয়ে যাচ্ছে। বুঝলাম তনয় এইজন্যই সরে গেছে। আমিও তনয়ের দিকে মিটমিট চোখে তাকিয়ে দরজা খুলে লিয়নের বউকে উদ্দেশ্য করে বললাম,
‘ এই ভাবি, সরি! হঠাৎ এভাবে অন্যদিকে মনোযোগী হয়ে আপনার কথা শেষ করতে দিলাম না। এখন আপনার কাছেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু এখানে!
লিয়নের বউ চাপা হাসি দিয়ে বললো,
‘ আহা! কত্তো রোমান্টিক দেবর আমার! আমার কাছে যাওয়ার আগেই আটকে নিলো ? আচ্ছা থাকো তুমি! পরে একসময় বলবো সব।
এটা বলে উনি লিয়নের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন আর আমি পেছনে তনয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘ এখানে কি করছিলেন আপনি?
তনয় একটু কি ভেবে যেন বললো,
‘ কিছুই না, এমনি আসছিলাম। আচ্ছা মাকে বলে দুটো পান সাজিয়ে আনো । আমি এখন রুমে যাচ্ছি!
আমি ভ্রু ভাঁজ করে বিরক্তি প্রকাশ করার আগেই তনয় হনহন করে চলে গেলো। উফফ, পান? খুবই ভয়ানক জিনিস, মূহুর্তেই সাদা চকচকা দাঁতগুলোকে লাল করে দিবে। সাথে জর্দ্দা দিলে মাথায় চক্কর দেওয়া তো আছেই !
ছোট বেলায় একবার দাদীর সাথে শখের বশে পান খেয়ে মাথা ঘুরে পড়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম, সেখান থেকেই অজ্ঞান হওয়া শুরু আমার। অল্পতেই এখন এই সমস্যার সম্মুখীন হই।
তবুও আমি এসবকিছু না ভেবে মা’র রুমে প্রবেশ করলাম। গিয়ে দেখি তিনি আলমারিতে কিছু দেখছিলেন। আমাকে দেখেই বললেন,
‘ আরে তোমাকেই ডাকতাম! দেখোতো এই শাড়ীটা। এইটা আমার বিয়ের শাড়ী বুঝেছো? যত্ন করে আলমারিতে তুলে রেখেছিলাম। তোমার বাবার বড়চাচা এটা বিলেত থেকে এনেছিলো। তুমি এটা আজ পরো কেমন? আর যেটা আজকের জন্য আমরা কিনেছিলাম, সেটা কালকে তোমাদের এখানে পরো। জানো তোমাকে দেখার পরেই আমি এই শাড়ীতে তোমাকে বারবার কল্পনা করছি, এটা কতো সুন্দর না? ছুঁয়ে দেখো!
আমি উনার চোখের দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি! আমার জন্য কতো ভালোবাসা উনার চোখেমুখে! নিজের সব পছন্দের জিনিসগুলোই আমাকে সপে দিতে চাচ্ছেন। উনি যেন পারছেন না আমাকে উনার কলিজাটা খুলে দিয়ে দেন!
আমি হাত বাড়িয়ে শাড়ীটা নিলাম। বেশ পুরনো ডিজাইন, কিন্তু এগুলো আবার এই যুগে নতুন করে ফিরে আসছে! আমিও দেখেই কেন জানি ধারণা করতে পারলাম এটা সেজেগুজে পরলে আমাকে অবশ্যই খুব মানাবে! রঙটার পরিচয় সোজা বাংলায় দিতে গেলে গাঢ় ইটের রঙ বলতে হবে। শাড়ীর প্রতিটা সুতোর বুনন একদম নজরকাড়া,মিহি এবং বেশ পরিপাটি।
আমি এটা হাতে নিয়ে বললাম,
‘ এখনি একটু পরে দেখাই! এটা এতো সুন্দর! আচ্ছা মা এটা আপনার বিয়ের দিন পরেছিলেন? বাবা নিশ্চয়ই আপনাকে দেখে পাগল হয়ে গিয়েছিলো!
তিনি লজ্জা মাখিয়ে বললেন,
‘ হাহাহা! এখনো যদি পরে সামনে যাই, হা করে তাকিয়ে থাকবে! কিন্তু আমি শাড়ী সামলাতে পারিনা, বিয়ের পরে কয়েক জায়গায় অনুষ্ঠানে কেবল শাড়ী পরেছি, আর এমনিতে তো অলওয়েজ থ্রিপিস!
আমি শাড়ীটা কাঁধের উপর থেকে ঝুলিয়ে ধরে হাসতে হাসতে বললাম,
‘ কেমন লাগে?
উনার খুশির পরিমাণ যেন আরো তীব্র হলো। খুশির সাথে আমার কথায় সায় দিয়ে বলতে লাগলেন,
‘ অনেক সুন্দর !
আমি তারপর এটাকে পাশে রেখে বসলাম, আর বললাম,
‘ মেহমানদের জন্য কি পানের আয়োজন আছে? মানে একজন আমার কাছে দুইটা পান চাইলো!
আমার শাশুড়ী মা আরো হেসে কুটিকুটি হয়ে বললেন,
‘ একজন আর কে! তনয়? ওর জন্য নিবে? জানো সে পান খেয়ে রঙিন দাঁত বের করে খাওয়ার আগ পর্যন্ত ঘুরে বেড়াবে!? আবার বারবার জিজ্ঞাসা করবে দেখো তো লাল হলো কিনা? এসব কান্ডে তুমি নিশ্চিত রেগে যাবে, তাই বুঝেশুনে নিয়ে যাও।
আমি মাথা ঝাকিয়ে বললাম,
‘ প্রথমবার চেয়েছে তো, নিয়ে দেখি একবার।
তিনি পাশ থেকে পানের বাটা বের করে আমার হাতে ধরিয়ে বললেন,
‘ পুরো বাটাটাই নিয়ে যাও। যা যা লাগে দেখো!
আমি শাড়ী এবং পানের বাটা দুটো একসাথে নিয়ে বের হয়ে গেলাম। চারদিকে তাকিয়ে ধিরে ধিরে রুমে চলে গেলাম। রুমে গিয়ে দরজার কপাট লাগাতেই তনয় শোয়া থেকে আমার ফোনটা নিয়ে বসে বললো,
‘ এদিকে আসো তাড়াতাড়ি।
আমি ভাবলাম ওই মেয়ে বুঝি আবার ফোন দিয়েছিলো,তাই রাগান্বিত হয়ে ফোনটা কেড়ে নেওয়ার জন্য এগুতেই তনয় পুরনো একটা কথোপকথনের কল রেকর্ড অন করে বললো,
‘ এই মূহুর্তে আমি এগুলো চেক করতেই সম্পূর্ণ মনে করতে পেরে গেছি এই মানুষটা আসলে কে? আর কেনই বা বলছিলো আমার উপর প্রতিশোধ নিতে চায়!
আমি হাতের জিনিসগুলো বিছানায় রেখে বসে পড়লাম আর ফোনের রেকর্ডটা প্রথম থেকে শুনতে গিয়ে অল্পক্ষণেই চোখ বড় বড় করে বললাম,
‘ স্বাভাবিক কথার মধ্যেও মাঝে মাঝে কান্নার হেঁচকির মতো নিঃশ্বাস? হ্যাঁ আমিও তাকে চিনি!
তনয় এবার অবাকের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলো।
হঠাৎ করে আবার দুজনেরই একসাথে মনে পড়ে গেলো! এই মূহুর্তে আমিও জানিনা মেয়েটার সাথে তনয়ের পরিচয় কিভাবে, আর তনয়ও জানেনা মেয়েটার সাথে আমার সম্পর্ক কিভাবে! শুধু দুজনেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছি!
চলবে…..
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার