বাদামি চোখ পর্ব-১৬

0
456

#বাদামি_চোখ [১৬]

এভাবে অরলি কলটা কেটে দেওয়ায় তনয় আমার দিকে অল্পসময় স্থির হয়ে তাকিয়ে হুহুহু করে হেসে উঠলো। তারপর আমার সিটের কাছাকাছি ঘেঁষে বললো,
‘ অরলির এখন কি অবস্থা বলোতো? ওইখানে জোরে একটা আওয়াজ হয়েছে, আর তার সাথে সাথে কলটা কেটে গেছে, মনে হচ্ছে তার ফোনটার আর অস্তিত্ব নেই! আর এখন হয়তো মাথায় দুইহাত ভর করে বারবার বলছে, ওরা কীভাবে চিনে গেলো আমায়? কীভাবে? !

আমিও হাসতে হাসতে বললাম,
‘ আমাদেরকে তো খুব নাচালো, চাচ্ছিলো নাকে দড়ি বেঁধে ওর ইশারায় ঘুরাবে, হাহাহা এখন টের পাবে ডুবে ডুবে বারংবার শালুক মিলেনা।

তনয় হাসতে হাসতে তার ফোন পকেটে রেখে আমার কাঁধ জড়িয়ে বসলো।
আর অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই আমরা আমাদের বাড়িতে পৌঁছে গেলাম। বিয়ের পরে জামাই প্রথম শ্বশুরবাড়ি আগমন করেছে, তাই চারদিকে হৈহল্লা বেশ!
ভাবি আম্মু,আব্বু, ভাইয়াকে একসাথে একদিন পরে মাত্র দেখেছি, মনে হচ্ছে যেন বহুবছর দেখিনা।
সবাই সানন্দে আমাদের বরণ করে নিলো!


শাশুড়ীর মা’র কথামতো তনয় এখানে একদিন মাত্র অবস্থান করলো। আমরা পরেরদিন যথারীতি বিকেল বেলাতেই ফিরার জন্য রওয়ানা দিয়ে দিলাম।
বাড়িতে কাটানো একদিন হুট করেই চলে গেলো, মানুষের সমাগম, আলাপ পরিচয় আর খাবারদাবারের উপরেই একদিন শেষ। এমনকি ভাবির সাথেও এক জায়গায় বসে ভালো করে কথা হয়নি, হবে কি করে? একমাত্র ননদ জামাইকে ভালোমতো সমাদরে রাখাটাই যে শুধু উনার মাথায় ছিল।

এর মধ্যে অরলি আর ফোন দেয়নি, এমনকি তনয় ইচ্ছে করে নিজে থেকে তাকে ফোন করার চেষ্টা করেছিলো কিন্তু সে পরবর্তীতে নিজের মোবাইলই বন্ধ করে ফেলে।
বাড়িতে ফিরে পরিবারের সাথে তনয়ের একা শ্বশুরবাড়িতে থাকার মজার অবিজ্ঞতা বলতে বলতেই সেদিনের সন্ধ্যা পেরিয়ে গেলো।
এর মধ্যে আমি প্রথমবার রান্নার পাতিল হাতে তুলে নিলাম, কথার মাঝে মধ্যে শাশুড়ী মা আমাকে সবকিছু দেখিয়ে দিলো আর আমি রান্নাবান্না শেষ করে ফেললাম।

আমি গতকাল যাওয়ার পর পরেই এখানকার মেহমান সবাই যার যার গন্তব্যে চলে গেছে। এমনকি আজকে এখনো পাশের বাসার, মানে লিয়নের পরিবারের কাউকেও দেখা যায়নি। আমি ভেবেছিলাম এসেই বুঝি আবার দেখতে পাবো।
আর উনি আমার অপেক্ষা করবেন, আমারও উনার প্রতি অনেকটা আগ্রহ জন্মেছে। কেননা লিয়নের বউয়ের কথাগুলো শেষ পর্যন্ত শুনতে হবে তো। তারা বাচ্চা হওয়ার পরবর্তী সময়ে কি করবে তার জন্য কিছু ভেবে রেখেছে হয়তো। এটাই আসলে শোনার ইচ্ছে খুব। মনে হয়না থাকবে বলে!

সেদিন রাতটাও কেটে গেলো ঝামেলাবিহীন, এখানে বাড়তি চাপ আর সৃষ্টি হলোনা। তবে লিয়নের বউ এবং তাদের পরিবারের কেউই কালকে না আসার পেছনের কারণ আঁচ করতে পারিনি৷ এমনকি আজকের সকাল পেরিয়ে দুপুর প্রায়
ওদের কাউকেই এখানে আসতে দেখা যায়নি৷
তনয় বলে ওদের নাকি এই বাসায় না আসলে পেটের ভাত হজম হয়না, অথচ এমন সময়ে তারা না এসে থাকছে, বিষয়টা অসম্ভাব্য!

এদিকে বিকেলে আমার শাশুড়ি আমাদের দুজনকে একসাথে ডেকে বললেন,
‘ তোমরা এক দুইদিন কোথা থেকে ঘুরে আসতে পারো। প্রথম যেহেতু কাছাকাছিই কোথাও যাও, এরপর সিদ্ধান্ত নিয়ে দূরে কোনো জায়গায় যেও।

এটা শুনে তনয় হেসে বললো,
‘ মা বলো তুমি আর বাবা বিয়ের পরে প্রথম কোথায় ঘুরতে গিয়েছিলে? আমরাও বরং প্রথম সেখানেই যাই!

তিনি হেসে বললেন,
‘ আমরা শ্বশুরবাড়ি বাবারবাড়ি যাতায়াত ছাড়া বিয়ের তিন বছরে কোথাও যাইনি। এরপর তো শহরে এলাম তুই আমার কোল আলো করে পৃথিবীতে আসলি, তারপর অবশ্য তোকে নিয়ে শহরের অনেক প্রান্তে ঘুরাঘুরি হয়েছে।

তনয় কিছুক্ষণ চুপ করে শুনে বললো,
‘ তাহলে আমরাও তিন বছর অপেক্ষা করি, তিনজন হওয়ার জন্য?

মা তনয়ের কথা শুনে রাগী চোখে তাকিয়ে সোফা থেকে ছোট বালিশটা তনয়ের দিকে ছুড়ে বললো,
‘ কবে বড় হবি তুই? বাচ্চামো কথাবার্তা গেলোনা তোর!যাহ তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নে কোথায় যাচ্ছিস। তোর ছুটি কিন্তু বেশি বাকি নেই।

তনয় ফিকফিক করে হেসে উঠে রুমে চলে গেলো। এর পেছন পেছন আমিও গেলাম। রুমে গিয়ে সেই আবার চিৎপটাং হয়ে শুয়ে গেলো । কোথায় যাবে এ নিয়ে আমার সাথে কিছুই আলোচনা করলোনা। আমার আবার বেশি জার্নি ভালো লাগেনা, অসুস্থ হয়ে যাওয়ার চান্স আছে।
তবে এটা তনয়কে জানানোর ইচ্ছে নেই এখন, নইলে আগেই এ নিয়ে দ্বিধায় পড়ে যাবে! আর তার যেখানে ইচ্ছে সেখানেই যাক!


রাত ৯ টা। তনয় আর আমি বারান্দায় বসে কথা বলছি। আমাদের বারান্দাটা অন্ধকারে আচ্ছন্ন। লাইট অফ করে দুজন বসেছি। কিন্তু এখান থেকে উপরে লিয়নদের ফ্ল্যাটের সেই বারান্দাটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। ভেতরে আলো জ্বলছে বলে এই মূহুর্তে গাছের ভীড়েও ছোট ফাঁকফোকরে কি আছে তা অল্প অল্প দেখা যাচ্ছে, লিয়নের বউ গ্রীলে হাত রেখে বাইরে মনোযোগ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তনয়ের সাথে কথা বলার সময় অনেক্ষণ থেকে এটা আমি খেয়াল করছিলাম। ঠায় দাঁড়িয়েই আছে, বসছে না কিংবা ভেতরেও যাচ্ছে না। তার জামার কিছু অংশ এবং হাতটা অল্প দেখা যাচ্ছে কিন্তু মুখ দেখা যাচ্ছেনা।
আমি এবার তনয়কে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে ফিসফিস করে বললাম,
‘ আপনি উনাকে খেয়াল করছেন? আর কালকে আমরা আসার পরেও একবার আসলোনা। আজও আসলোনা, গড়বড় লাগছেনা? ওই অরলিও ফোন ধরছেনা উনারাও এমন চুপচাপ, এমনকি ওই বাসার আন্টিও আসছেনা, কি ব্যপার বলুন তো?

তনয় বারান্দার দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে বললো,
‘ হুউউম আসলেই কেমন যেন লাগছে! অরলিরও কোনো খবর নেই আর তাদেরও। ওরা এমনিতেই আমাদের বাসায় আসা যাওয়া মিস করেনা, সেখানে কিনা এই বাসায় নতুন মানুষের আমেজ শেষ হওয়ার আগেই ভালোমতো আসছেনা? কিছু তো হয়েছে নিশ্চয়ই!

আমি চুপ করে রইলাম। তনয়ও আর কথা বলছেনা।
আকাশে অর্ধ চাঁদটা এতক্ষণ দেখা যাচ্ছিলো, কিন্তু এখন মাথার উপরে চলে গেছে, এখান থেকে বসা অবস্থায় আর দেখা যাচ্ছেনা। তবে আমি আমার মাথার খুব নিকটে ঠিকি একটা পূর্ণিমার চাঁদ দেখতে পাচ্ছি, যেটার আলোয় আমি আলোকিত থাকতে চাই প্রতি দিন, প্রতি মূহুর্ত, আর আজীবন!


পরেরদিন,
মঙ্গলবার!
আজ সূর্যের উত্তাপ প্রবল! খাওয়াদাওয়ার পরে আজ কেউ কারো রুম থেকে বের হচ্ছেনা। নিজেদের রুমে এসি চালু করে বসে আছে।
তনয় টিভিতে কার্টুন দেখছে, আর আমি বসে বসে ফোন ঘাঁটছিলাম। এর মধ্যে হঠাৎই তনয় বলে উঠলো,
‘ ইয়েস! যাওয়ার জায়গা পেয়ে গেছি। চলো চলো আজ বিকেলেই আমরা বেড়িয়ে পড়বো।

আমি ফোনটা পাশে সরিয়ে বললাম,
‘ কিসের জায়গা?

তনয় টিভি বন্ধ করে তোয়ালে হাতে নিয়ে বললো,
‘ তাড়াতাড়ি কাপড় গুছাও! আমরা বেড়াতে যাবো, মা বলছিলোনা?

আমি এবার ঠোঁট বাঁকিয়ে বললাম,
‘ আচ্ছাহ এই কথা! ঠিকাছে যান গোসল করেন, আমি সব গুছাচ্ছি।

আমি আমার কিছু কাপড় আর তনয়ের ব্যবহৃত পোশাক জিনিসপত্র ব্যাগে রাখতে রাখতেই তনয় মাথা মুছতে মুছতে বেড়িয়ে বললো,
‘ মা বাবাকে বলে আসছি আমি!

আমি ওর দিকে একবার তাকিয়ে আবার গুছানোতে মনোযোগ দিলাম। আমার গুছানো শেষ, ঠিক সেসময়ই তনয় ভেতরে প্রবেশ করে আবার বললো,
‘ তাড়াতাড়ি গোসলে যাও, রেডি হও! বিকেলের ট্রেনে যাচ্ছি আমরা! এখন দেখি অনলাইনে টিকিট পাওয়া যায় কিনা!

আমি আবারও নিঃশব্দে তনয়ের দিকে তাকিয়ে একটা শাড়ী হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকলাম।
খুব দ্রুত ফ্রেশ হয়ে বের হয়ে দেখি তনয় এক হাতে গায়ে পারফিউম মাখছে, আরেক হাতে চুল ঠিকঠাক করছে।

আমি বেরুতেই সে আমার দিকে ফিরে তাকালো। চুল ঠিক করতে থাকা হাতটা সেখানেই স্থির হয়ে গেছে আর সাথে উরাধুরা পারফিউম মাখাটাও!
আমি ভেজা কাপড় সাথে বারান্দার দিকে অগ্রসর হবো তখনি তনয় দ্রুত এগিয়ে এসে আমার টেনে ধরে বললো,
‘ আজকে আর কোথাও ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করছেনা।

আমি অবাক হয়ে বললাম,
‘ কেন সিদ্ধান্ত কি বদল?

তনয় ধীরে বললো,
‘ প্রকৃতি তো আমার ঘরেই রয়েছে, বাইরে গিয়ে আর কিসের সৌন্দর্য দেখবো বলো?

আমি লজ্জাময় হাসি মেখে হাতটা ছাড়িয়ে ওর কাছ থেকে চলে গেলাম। ওর যতো ন্যাকা কথাবার্তা!


বেলা তিনটার দিকে আমরা বিদায় নিয়ে বের হলাম। এভাবে হুট করে আজ বের হবো কল্পনাও করিনি।
স্ট্যাশন পৌঁছে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়নি, তবে সমস্যা একটাই আমরা একটা সীট পেয়েছি মাত্র।
তনয় বারবার বলছিলো, চিন্তা করো না ব্যবস্থা হয়ে যাবে, নয়তো তুমি সীটে বসো আমি দাঁড়িয়ে থাকবো।
কষ্ট করে যাবে তাও আজকেই তার মাথায় ঘুরতে বের হওয়ার ভূত চেপেছে। গরমে ভুরভুর ঘামছে তনয়!

এদিকে উঠেই আমরা দুজন সেই একটা সীট খুঁজতে লাগলাম। অবশেষে পেলাম তবে জানালার পাশে একটা মহিলা বসা! আমার সীটটা ভেতরেদিকে, এটা দেখেই আমার মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। তনয় পাশে থাকলে অবশ্য এসব মেনে নিতাম, কিন্তু এভাবে আমিও অস্বস্তিকর জায়গায় বসবো আবার তনয়ও দাঁড়িয়ে থাকবে, কেমন লাগে? এদিকে সিদ্ধ হয়ে যাওয়া গরম পড়েছে!
তবুও কিছু করার নেই আমি সীটে বসলাম।
ভেতরটা শুধু রাগে কিটকিট করছে। কে বলছে এভাবে এরকম পরিস্থিতিতে বেড়াতে যেতে?
ট্রেন ধীরে ধীরে ছেড়ে দিয়েছে, তনয় এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু দেখছে শুধু।

কিছু মূহুর্ত পেরুতেই একজন টিকেট কাউন্টার এসে বললো,
‘ স্যার একজন মেয়ে পাশের কেবিনে আপনাদের জন্য দুইটা সীট বুকিং করেছেন, এই নিন টিকিট!

তনয় টিকিট দুইটা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো!
আমরা অতি তাড়ার জন্য সাধারণ টিকিটই দুইটা পাইনি সেখানে আমাদের জন্য কেবিন বুক করে দিয়েছে কে?

চলবে…….ইনশাআল্লাহ!

লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার