#বাদামি_চোখ [১৭]
সব যাত্রী এখনো নিজেদের জায়গায় ঠিকঠাক বসেনি। কয়েকজন পেছনে থেকে আসছে,আবার কয়েকজন সামনে দিয়ে যাচ্ছে, আমি খেয়াল করছিলাম তনয় এতে বেশ বিব্রত হচ্ছে।
এদিকে এতো বেশি গরম যে আমিও এখানে বসে থাকার কোনো ধৈর্য্য পাচ্ছিনা। মনে হচ্ছে কষ্ট করার বদলে এসি কেবিনে চলে যাওয়াটাই বোধহয় ভালো হবে। আর কে এই ব্যবস্থা করেছে সেটা নাহয় পরে দেখা যাবে!
ভাবতে ভাবতেই আমি সীট ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম, আর তনয়ের হাত ধরে বললাম,
‘ চলুন যাই!
তনয় মুখের ঘাম মুছতে মুছতে বললো,
‘ যেতে বলছো?
আমি মাথা নেড়ে বললাম,
‘ হ্যাঁ বলছি! এখানে কষ্ট করে লাভ কি? ব্যাগগুলো নামান, আমি আমার হাতে একটা নিচ্ছি।
তনয় আমার দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবলো, তারপর ব্যাগগুলো নামিয়ে ছোটটা আমার হাতে দিলো আর ধিরে ধিরে চলতি ট্রেনে এগুতে লাগলো।
ইতোমধ্যে ট্রেনটা দ্রুতগতিতে চলছে। আর ট্রেনের গতির সাথে আমরা দুলেদুলে হেঁটে সামনে এগুচ্ছি।
আমরা এই বগি ছাড়িয়ে আরো দুই বগি অতিক্রম করলাম। কেননা তনয় আর আমি টিকিট দেখে যাত্রীদের জিজ্ঞাসা করে করেই সামনে যাচ্ছিলাম। আর সবার কথামতো তৃতীয়টাতেই এই টিকিটদুটোর স্থান!
সেই বগিতে প্রবেশ করে সরু রাস্তা দিয়ে আমি আগে আগে এগুচ্ছি। মাঝে মাঝে এক হাত দিয়ে কিছুতে ভর রাখার চেষ্টা করছি।
আমার দৃষ্টি ছিল দুলে আবার নিচে পড়ে যাই কিনা!
কিন্তু তনয় অন্য সময়ের মতো স্বাভাবিক হাঁটছে! ওর হয়তো চলমান ট্রেনে হাঁটার অভ্যাস আছে!
আমরা কেবিনের প্রায় কাছে চলে আসছি, এসময় হঠাৎ তনয় তার হাতের ব্যাগটা নিচে আওয়াজ করে ফেলে আমাকে হাত দিয়ে সরিয়ে সামনে একটু গিয়ে গেলো, আর তাড়ার স্বরে হাত বাড়িয়ে বললো,
‘ এইইইই আপনি অরলি! আমি আপনাকে স্পষ্ট দেখেছি, দাঁড়ান বলছি!
আমি এবার অবাক হয়ে চোখ তুলে সামনে তাকিয়ে দেখি মাথায় পেঁচিয়ে ওড়না পরিহিত কেউ মুখ আড়াল করে পালিয়ে যেতে চাচ্ছে, কিন্তু তনয় কিছু বলার পরেই থেমে দাঁড়িয়ে গেছে৷
আমি পেছনে ব্যাগটার দিকে একবার তাকিয়ে সামনে তাকালাম, এতো বড় ব্যাগটা আরেকহাতে আমি একা নিতে পারবোনা, তাই এটাকে রেখেই আমি সামনে এগিয়ে গেলাম। তনয় ততক্ষণে মেয়েটার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। অল্প কাছে যেতেই আমি শুনলাম তনয় বলছে,
‘ কি সমস্যা আপনার? কেন এসব করছেন? আর কি করে জানেন আমরা আজ বেরুচ্ছি?
অরলি ঘুরে তাকালো! আমিও প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললাম,
‘ এক বছর তোমাকে কাছ থেকে চিনেছিলাম অরলি। কতো পছন্দ করতাম তোমাকে! আর তুমিও না আমাকে কতো ভালোবাসতে? কেন হঠাৎ আমাদের জীবনে অশান্তি করতে চলে এসেছো, বলো?
অরলি তনয়কে পাশ কেটে কেবিনে প্রবেশ করার জন্য অগ্রসর হলো আর আমাদেরকে ভেতরে আসার ইশারা করলো। আমিও তনয়কে পেছনের ব্যাগটা আনতে বললাম। আর আমি অরলির সাথে সাথে ভেতরে প্রবেশ করলাম।
কিছুক্ষণের মধ্যে তনয় ভেতরে এসে দরজা বন্ধ করে সীটে বসে বললো ,
‘ এখন বলুন, এই ট্রেনে আপনি কোথায় যাচ্ছেন ?
অরলি চুপ করে আছে৷ আমি সাথে সাথে বললাম,
‘ বিস্তারিত বলো অরলি! নইলে আমরা তোমাকে পুলিশে ধরিয়ে দিবো৷
অরলি এবার আমার দিকে তাকিয়ে হেসে বললো,
‘ হাহাহা পুলিশের ভয় দেখাচ্ছো, তাও আমাকে? আমি যে কোনো অপরাধ করেছি তার প্রমাণ আছে?
আমি তনয়ের দিকে আড়চোখে তাকালাম। তনয় ইশারা করলো এমন ভয় না দেখাতে৷
তারপর তনয় থুতনিতে হাত রেখে বললো ,
‘ আপনি আমাকে বিয়ে করতে চান,তাইতো?
অরলি চোখ তুলে তনয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ একদমই না।
এটা শুনে তনয় আর আমি অবাকের শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেলাম। আর তনয় ঘাড় তুলে আঙুল বাঁকিয়ে বললো,
‘ তাহলে এসব কি? কি মানে এসবের?
অরলি একটু থেমে বললো,
‘ আমি আপনাকে নয়, আমি লিয়নকে চাই! একটা দুইটা দিন ধরে না, সেই ইউনিভার্সিটিতের শুরু থেকে আমি লিয়নকে পাগলের মতো ভালোবেসে এসেছি। কিন্তু আমি কাছাকাছি যেতে পারিনি নিবিতার জন্য, শুধু নিবিতার জন্য! তাহলে নিবিতাকে কীভাবে ভালো থাকতে দিবো বলেন ?
অরলির কণ্ঠস্বর ক্ষীণ হয়ে এলো, আর এটা শুনতেই আমি চমকে উঠলাম। কি বলছে এসব?
আমি কিছু বলার আগেই তনয় বললো,
‘ বুঝলাম না, তাহলে আপনি লিয়নের পিছে না লেগে আমাদের পেছনে কেন লাগছেন? আর নিবিতারই বা কি দোষ?
মেয়েটা হাসতে হাসতে বললো,
‘ নিবিতার একটাই দোষ সে লিয়নকে ভালোবেসেছিলো। যে আমার হওয়ার কথা ছিল। আর লিয়নের বউ আপনাকে ভালোবাসে, আর সে যেকোনো মূল্যে আপনাকে বিয়ে করতে চায়!এবং আমি চাই লিয়নের বউকে আপনার করে দিয়ে ওর মনের জায়গা খালি করতে।
আমি গলা খাঁকরে বললাম,
‘ কিসব অদ্ভুত কথা? লিয়নের বউ এটা কেন চাইবে? আর তনয়কে উনি বিয়ে করতে চায় মানে? আপনি তাহলে তনয়কে বিয়ে করতে রাজী ছিলেন কেন?
এসবই বা কেন করেছেন বা করে চলেছেন?
মেয়েটা তনয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ তনয় অবিবাহিত হয়ে নিশ্চয়ই কখনো বিবাহিত মেয়েকে বিয়ে করতে চাইবেনা, তাই সে চেয়েছে তনয়ও ডিভোর্স তালিকায় পৌঁছাক, তখন প্রস্তাব দেওয়ার সুযোগ আসবে! আর আমি লিয়নকে চাই এটা শুনে ও নিজেই এই পরিকল্পনা করে আমার জন্য তনয়ের পাত্রীর সন্ধান দিলো ৷ তনয়ের মায়ের কাছে লিয়নের বউই আমার জন্য ঘটক পাঠিয়েছিলো। বিয়ের পরে আমিও ছেড়ে যাবো, সেও ছেড়ে আসবে এমন কিছুই বলছিলাম! কিন্তু মধ্যে আমার সাথে বিয়ে ভেঙে হঠাৎ নিবিতার সাথে বিয়ের আলাপ আলোচনা সবকিছু ভেস্তে দিলো। এটা ভেঙে দেওয়ার অনেক চেষ্টা করা হলেও আমরা করতে পারিনি! শেষ পর্যন্ত যখন শুনলাম বিয়ে করেই ফেলেছে তখন আমাদের আলোচনায় যুক্ত হলো তাহলে আপনিও এখন বিবাহিত তালিকায়, এখন বিচ্ছেদ ঘটাতে পারলেই হলো, আর আমার তনয়কে বিয়ে করার দরকার নেই। কিন্তু এরপরও লিয়নের বউয়ের কথা শুনে আপনাকে আরো অসংখ্যবার ফোন দিয়েছি! বিভিন্ন আজগুবি কথা বলেছি কিন্তু এতে যে এভাবে ধরা পড়ে যাবো ভাবিনি।
তনয় গালে হাত রেখে শুনে চলেছে। আর মাঝে মধ্যে নিজের বামপাশের ভ্রু চুলকাচ্ছে!
অরলি কথা থামানোর পরে আমি অরলির কাঁধে হাত রেখে বললাম,
‘ তুমি জানো তিনি এখন প্রেগন্যান্ট! আর তুমি এতো সুন্দরী একটা মেয়ে কেন লিয়নের জন্য এতো কিছু করবে বলো? তুমি নিঃসন্দেহে আরো ভালো কাউকে ডিজার্ভ করো!
আমি এটা বলার সাথে সাথে অরলি ছিটকে আমার হাতটা ওর কাঁধ থেকে সরিয়ে বললো,
‘ চুপ করো তুমি! তোমার চেয়ে আমি কিসে কম বলো? তোমার চেয়ে হাজারগুণে ভালো আছি, সেখানে এমন বিলাই চোখের জন্য তোমার এতো গুরুত্ব! ভাবতেই অবাক লাগে ছি!
আমি হাত গুটিয়ে তনয়ের দিকে তাকালাম। তনয় অরলির এই কথা শুনে কেন জানি বোকা হাসি হাসছে!
তারপর সে সেটাকে থামিয়ে বললো,
‘ আপনিই কি নিবিতার লেখা কবিতা ম্যাগাজিনে ছাপিয়েছিলেন?
অরলি এটা শুনে এবার তার পার্স থেকে আমার সেই পুরনো ফোনটা খুলে সামনে রাখলো, আর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছলছল চোখে বললো,
‘ লিয়নকে পেতে আমি কতো কিছুইনা করলাম! এমনকি নিবিতাকেও ওর থেকে আলাদা করতে সক্ষম হলাম,কিন্তু ভাগ্যের খেলায় তবুও আমি জয়ী হতে পারলাম না! মধ্যে দিয়ে সে হুট করে বিয়ে করে নিলো!
আমি এবার ভ্রু কুঁচকে বললাম,
‘ ওয়েট ওয়েট কি করেছো তুমি? এসবের পেছনে তাহলে কেউ ছিল? লিয়ন ইচ্ছে করে আমার সাথে এমন করেনি?
অরলি চুপ করে আছে। আমি আবারও হাত বাড়িয়ে ওকে ছুঁলাম। আর ঝাকিয়ে বললাম,
‘ কি বলোনা কেন? তুমিই করেছো এসব?
অরলি এবার মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে বললো,
‘ বললাম না?! আমিই ছিলাম এসবের পেছনে। তোমার ফোন চুরি করার প্রধান উদ্দেশ্য, তোমার দূর্বলতা খুঁজে বের করে তোমাকে লিয়নের মন থেকে শুধু উঠিয়ে দেওয়াই নয়, ঘৃণার শেষ চূড়ায় পৌঁছে দেওয়া! কিন্তু আমি কেবল আলাদাই করতে পেরেছিলাম, কিছু করার আগেই লিয়ন আরেকটা মেয়েকে বিয়ে করে নিলো! তবে আমি হার মেনে নেওয়ার মেয়ে নয়। আমি লিয়নকে চাই মানে চাই। একজনকে ভালোবেসেছি তার তাকেই আমার প্রয়োজন! আমি তোমাদের পেছনও ছেড়ে দিবো, শুধু লিয়নকে তার বউটা ছেড়ে যাওয়ার জন্য উদ্ভুদ্ধ করো!
এটা শুনে তনয় রেগে গেলো। উঠে দাঁড়িয়ে বললো,
‘ আমি আপনাকে পুলিশে দিবো! আপনার স্বভাব চরিত্র ঠিক আছে? আরেকটা মানুষের সংসারে আগুণ ধরাচ্ছেন কোন অধিকারে? একটা নয় আপনি লিয়ন ভাইয়ার বউয়ের সাথে যোগ দিয়ে উনার উদ্দেশ্যকে হাসিল করতে চাচ্ছেন, সাথে চাচ্ছেন নিবিতার জীবনটাকে নরকে রূপান্তর করতে!
অরলি উচ্চশব্দে হাসতে হাসতে বললো,
‘ আমার কাছে দুনিয়ার সবচেয়ে অসহ্যকর মানুষ হলো নিবিতা! সবকিছুর মূলে সে রয়েছে। লিয়নের সাথে তো আমার ভালো সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিলো, এমন একটা জায়গায় চলে গিয়েছিলাম যে আমি প্রপোজ করলে সে নির্দ্বিধায় গ্রহণ করবে। কিন্তু সেসময়ই ওর দেখা নিবিতার সাথে, আমার সব শেষ হয়ে গেলো তখন।
তনয় এবার রাগ নিয়ন্ত্রণ করে সীটে বসলো, আর উল্টো জিজ্ঞাসা করলো,
‘ বলতে চাচ্ছেন আপনাদের ফেইসবুকে পরিচয় হয়েছিল?
অরলি মাথা নেড়ে বললো,
‘ না ইউনিভার্সিটিতে। সেখান থেকেই ফেইসবুকে এড এবং মোটামুটি ভালো বন্ধুত্ব। রোজই কথা হতো আমাদের। অনেকটাই গভীর হয়ে গেছিলাম। কিন্তু আমি ওকে ভালোবাসি এটা সে কখনোই জানেনি।
অরলির এসব কথাবার্তা আমার মাথাটাকে পুরো এলোমেলো করে দিচ্ছিলো৷ কিসব বলছে সে? লিয়নকে পাবার জন্য এতকিছু? একটা মানুষ বিয়ে করে নিয়েছে,তবুও তাকে পেতে চায়? কাউকে পাওয়ার আকাঙ্খা যে এতো তীব্র হয় অরলিকে না দেখলে বুঝতেই পারতাম না। সে মেয়ে হয়ে ভালোবাসাকে পেতে যাচ্ছেতাই করে যাচ্ছে।
তবুও আমি ওর কথাকে অবিশ্বাস করতে পারলাম না। কেননা লিয়নকে সেসময় অনেকেই পছন্দ করতো তা আমি জানতাম৷ সেখানে অরলি বোধহয় অতিরিক্তই ছিল।
তাই এসব দিকে কথা না বাড়িয়ে বললাম,
‘ আমরা এই ট্রেনে যাবো কি করে জানতে? আর দুইটা টিকিট?
অরলি স্বাভাবিক ভাবে বললো,
‘ তোমরা আসার কথা লিয়নের বউ বলছে, আর দুইটা টিকিট যাত্রী থেকে ২০ হাজার টাকা দিয়ে ক্রয় করেছি! টাকাও লিয়নের বউই দিয়েছে। এখানকার যাত্রীদেরকে সেই টাকা দিয়ে বলেছি এসি মাইক্রো নিয়ে চলে যেতে, আর বাকি টাকা দিয়ে শপিং করে নিতে! এর জন্য পুরো স্ট্যাশন টইটই করে ঘুরেছি, কেউই দিতে রাজী হচ্ছিলোনা, অবশেষে অল্প বয়সী দুটো ছেলেকে পেলাম, ওরা যাবে কিনা দ্বিধায় ছিল, তারপর ২০ হাজার টাকা চাইলো!
এটা শুনে তনয় হাহাহা করে হেসে উঠলো। আর আমার হাতের উপর হাত রেখে বললো,
‘ আমাদের কতটা দাম দেখলে?আমাদের এই দুইটা টিকিট নাকি ২০ হাজার টাকা!
এটা বলে পরক্ষণেই সে হাসি থামিয়ে আবার বললো,
‘ আমাদেরকে টিকিট বুক করে দেওয়ার পেছনের কারণ কি?
অরলি তার মুখে একটা হাত রেখে বললো,
‘ কারণ হলো তোমাদের দুজনের এই জুটিকে অক্ষত অবস্থায় না ফিরতে দেওয়া! শারীরিক না হোন অন্তত মানসিকভাবেও! তবে আমি এই সিদ্ধান্তে স্থির হতে পারছিলাম না, এটা করতে আমার হাত পা কাঁপছিলো। আমি এখানে কিছুক্ষণ চুপ বসে ছিলাম, এরপর ভাবলাম নাহ এতটা নিষ্ঠুর হওয়া উচিত হবেনা, যেখানে শুধুই অন্যের স্বার্থ রয়েছে!
কেননা আমি তো লিয়নকে চাই, আমি কেন তোমাদের ক্ষতি করবো?
তনয় আর আমি একে অপরের দিকে তাকিয়ে বললাম,
‘ অথচ আমরা না জেনে এই ফাঁদে পা দিচ্ছিলাম। মরেই যেতাম আজ!
অরলি আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
‘ না মারার উদ্দেশ্য নয়, আলাদা করে দেওয়ার প্লানিং। আর সেটা এই মূহুর্তে আমি বলতে চাইনা। অনেককিছু বলে ফেলেছি, শুধুমাত্র কিছুক্ষণ আগে হওয়া অনুতাপের জন্য! আর আমাকে তো চিনেই গিয়েছো তোমরা, তাই ভাবলাম সবকিছু বলেই দেই, নয়তো ভাব্বে আমি আসলেই তনয়কে চাই! আর ওই দিনের এক্সিডেন্টের সাথেও আমি যুক্ত নয়। এসব তিনি জানেন! এখন লিয়নকে পেতে সাহায্য করলে আমি তোমাদের একসাথে থাকার মধ্যে বিরোধিতা করবোনা।
তনয় আস্তে আস্তে বললো,
‘ সেসব আপনার ব্যপার। আমরা এসবে সাহায্য করবোনা। তবে আপনি আমাদেরকে আলাদা করতে পারবেন না। দুজন যেখানে একমনের সেখানে আপনাদের মানসিক টর্চারে কিছু আসবে যাবেনা। স্বামী স্ত্রী কিংবা সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি দরকার ভেতরের সবকিছু একে অপরের সাথে ভাগ করে নেওয়া। এটা আমাদের মধ্যে আছে আর তাই দুজনকে ভালো করেই জানি চিনি! আপনি যার সাথে ইচ্ছে মিলে পরিকল্পনা করে, লিয়ন ভাইয়ের মতো এমন একটা রুক্ষ মনের মানুষকে বিয়ে করুন, কিন্তু মনে রাখবেন আমাদের মতো ভালো থাকতে পারবেন না।
এটা বলে তনয় থেমে গেলো। আর তনয়ের কথা শুনে অরলি তনয়ের দিকে নিশ্চুপ চোখে তাকালো। তারপর আমার দিকে লক্ষ্য করে কিছু বলতে গিয়েও বললোনা। উঠে দাঁড়িয়ে দরজা খুলে সোজা বের হয়ে গেলো।
আমি আর তনয় একসাথে ওর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে জোরে কয়েকটা নিঃশ্বাস নিলাম। তারপর দুজন একসাথে বললাম,
‘ আসুন দেখে নেই এখানে আমাদের ক্ষতি করার মতো কোনো কিছু রেখে গেলো কিনা।
তনয় উঠে সীটের এপাশ ওপাশ ভালো করে দেখে নিলো। নাহ কিছুই নেই। আর আমরা ভালোমতোই গন্তব্যে পৌঁছালাম। জায়গাটা ততটা জনপ্রিয় কিংবা ভ্রমণপ্রিয় মানুষের খুব একটা চেনাজানা নয়৷ তবে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে, এখানে সবুজে ঢাকা গাছগাছালি, ছোট ছোট পাহাড়, পাশে বয়ে যাওয়া নদী আর ছোট ছোট কুঁড়েঘর। জানিনা হঠাৎ করে এমন একটা জায়গার কথা তনয়ের মাথায় আসলো। তবে এটা নিয়ে আমি কোনো প্রশ্ন করিনি।
দুইদিন এখানকার সবকিছু ঘুরে দেখলাম, টাকা দিয়ে অন্যদের বসতঘরেই অবস্থান করলাম।
তারপর ভালোমতো ট্রেনে করেই বাসায় ফিরে এলাম।
তনয় এবং আমার ভেতরে একটাই চিন্তা, আমরা দুজনেই গিয়ে লিয়নের বউকে এই বিষয়ে প্রশ্নবিদ্ধ করবো। কি করে ঘরের মানুষ হয়ে এমন ছুড়ি মারতে চায়!
কিন্তু গিয়ে দেখি ওরা গতকাল বাসা বদলে অনত্র চলে গেছে।
তাহলে কি অরলি সবকিছু জানিয়ে দিয়েছে?
কিন্তু মা বললো লিয়নের নাকি চাকরির বদল হয়েছে সাথে প্রমোশনও। তাই ওরা চলে গেছে। অথচ গত ৭-৮ বছর ধরে ওরা এখানেই আছে, লিয়ন এখানে থেকেই ইউনিভার্সিটির পড়ালেখা শেষ করেছে এবং তার চাকরিও আশেপাশেই হয়েছে। হঠাৎ চলে যাওয়ার কারণ আমরা কেউই জানতে পারিনি।
কিন্তু তনয় লিয়নের সাথে কথা বলেছে, আর আমার মা লিয়নের মার সাথে যোগাযোগ করে মাঝেমধ্যে। কিন্তু আমি লিয়নের বউয়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারিনি। আর ওদেরকেও করতে বলিনা। উনার ফোন বন্ধ, তার উপর দূরত্ব বজায় রেখে সরে গেছে, তাই আর এসব প্রশ্ন করার ইচ্ছেও বাদ দিয়ে দিলাম।এখন আর আমাদের ক্ষতি না করলেই হয়।
‘
চলে গেলো ২৫০ দিন মানে ৮ মাসেরও বেশি সময়। আমরা দুজন ভীষণ ভালোভাবে কাটাচ্ছিলাম, এর মধ্যে অবশ্য আরো অসংখ্য জায়গায় ঘুরাঘুরি করেছি। কিন্তু কোনো সমস্যার সম্মুখীন হইনি।
কোনো ফোন আসেনি, ভয় আসেনি, শত্রুর দেখাও মিলেনি।
সেদিন রাতে আমি রান্নাঘরে রান্নায় ব্যস্ত। হঠাৎ করে তনয় আমাকে জোরে ডাকতে লাগলো। আমি মাকে রেখে তাড়া করে রুমে গেলাম আর জিজ্ঞাসা করলাম,
‘ ডাকছেন কেন?
তনয় আমাকে ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো,
‘ কথা বলো।
আমি ফোনটা কেন দিতেই শুনলাম পরিচিত কণ্ঠস্বর। একটু নরম হয়ে বলছে,
‘ সরি নিবিতা! আর ধন্যবাদ তোমাকে।
আমি গলা ঝেড়ে বললাম,
‘ ভাবি কেমন আছেন? আপনার বেবি কি কোলে চলে আসছে?
তিনি বেশ উৎসুকভাব নিয়ে বললেন,
‘ হোয়াটসঅ্যাপে আসো দেখাচ্ছি।
আমি হোয়াটসঅ্যাপে যেতেই তিনি ভিডিও কল দিলেন। আমি রিসিভ করতেই দেখি ফুটফুটে একটা বাচ্চা চোখ নিভু নিভু করছে। আমি হেসে বললাম,
‘ মাশাল্লাহ পুরো পুতুল।
তিনি বাচ্চার চোখে হাত দিয়ে হাসতে হাসতে বললেন,
‘ আমার মেয়ের বাদামি চোখ, দেখো! দেখি মা চোখ খুলে দেখাও।
আমি ঠোঁটে হাত রেখে চমকের সাথে বললাম,
‘ ও গড আপনার ইচ্ছে পুরণ হয়েছে তাহলে! আপনার সন্তান বাদামি চোখের অধিকারী। খুব ভালো লাগছে শুনে, আর খুশির কথা হলো আমিও মা হতে যাচ্ছি। তবে আমার সন্তান যে কোনো চোখ নিয়ে সুস্থ স্বাভাবিক আসলেই আমি খুশি!
উনার চোখ খুশিতে চকচক করছে, এরপরই লিয়নের দিকে ক্যামেরা ঘুরিয়ে বললেন,
‘ বাবুর আব্বু তো আরো বেশি খুশি। রাতে আমি ঘুমিয়ে গেলে, বাবু যদি সজাগ থাকে তিনি বাবুর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকেন। জিজ্ঞাসা করলে বলে, উনি ওর চোখে তাকিয়ে রাত পার করে দিতে পারবেন! জানো আমরা এখন সাংসারিক হয়েছি, একে অন্যের জন্য কতো সংগ্রাম করি। আমরা খুব ভালো আছি নিবিতা। খুব ভালো!
আমি তনয়ের দিকে হেসে তাকিয়ে বললাম,
‘ খুব ভালো লাগছেনা বলেন?
তনয় মাথা নেড়ে বললো,
‘ হ্যাঁ ভীষণ ভালো লাগছে!
আর কথা না বাড়িয়ে লাইনটা কেটে দিলাম। ফোনটা রেখে তনয়কে বললাম,
‘ এই মূহুর্তে অতীত নিয়ে কোনো রকম প্রশ্ন করতে ইচ্ছে হয়নি। মানুষকে সুখে থাকতে দেখাটাও কতো শান্তির।
তনয় এটাতে সম্মতি দিতে গিয়েও আবার কি যেন মনে করে বললো,
‘ আরে অরলি বিয়ে করেছে জানো? কয়েকদিন আগেই ওকে স্বামীর সাথে গাড়িতে করে হাসিখুশিতেই যেতে দেখলাম।
আমি আরো স্বস্তির হাসি মুখে টানিয়ে তনয়ের চুলগুলো হাত দিয়ে এলোমেলো করে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালাম।
ঠোঁটে এখনো হাসি লেগে আছে। আসলে ভালোবাসাটাই ব্যপারটাই এমন বৈচিত্রময়। কখন কীভাবে আর কোন উছিলায় হয়ে যায় বোঝার উপায় নেই। মানুষ চাইলেই পারে নিজের সত্যিকার ভালো থাকাকে খুঁজে নিতে। আর যারা এটা চায় তারাই পারে সুখী হতে, সেখানে অতীত তো শুধুই বিরক্তির নাম!
আমি এটা ভেবে আরো হাসছি, যেই ছেলেটা আমাকে বিয়ে করলে সন্তানদের চোখের মনি স্বাভাবিক কালো না হয়ে বাদামি হওয়ার সম্ভবনাকে সমস্যা বলে অজুহাত দিলো, আজ সেই ছেলেটাই ভাগ্য পরিশেষে বাদামি চোখের অধিকারী মেয়ের চোখের দিকে তাকিয়ে অপার মুগ্ধতায় প্রশান্তি খুঁজে চলে, প্রতি রাত প্রতি মূহুর্ত!
(সমাপ্ত)
লেখাঃ #তাজরীন_খন্দকার