বাসন্তী প্রেম পর্ব-১৯+২০

0
485

#বাসন্তী_প্রেম 🌼🌼
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#উনবিংশ_পর্ব

দেখতে দেখতে বিকেল পেরিয়ে রাত হয়ে এসেছে। চারপাশের কালচে আঁধারের মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকার তীব্র আওয়াজ দূর থেকে জানালা ভেদ করে শোনা যাচ্ছে। সিরাতও একমনে বারান্দায় বসে সেই আওয়াজ একমনে শুনে যাচ্ছে।
– ” সিরাত আপু?”
হঠাৎ করে নিশাতের কন্ঠস্বর কান অবধি পৌঁছাতেই চমকে উঠে সিরাত। ভাবনা খেয়ালের জগৎ থেকে বেরিয়ে তড়িঘড়ি করে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় সে।
সিরাতের দিকে দৃষ্টি যেতেই দ্রুত গতিতে এগিয়ে যায় নিশাত‌। পিছন পিছন যথারীতি ফাইয়াজ ও প্রবেশ করে ভেতরে। নিশাত গিয়ে প্রথমেই সিরাতকে ঝাপটে ধরে; যেন এতদিন বড় বোনকে না দেখার বিতৃষ্ণা আরো কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সিরাত ও জড়িয়ে ধরে নিশাতকে।
– ” আপু তুই ঠিক আছিস? তোর কিছু হয়নি তো?”
বিচলিত কন্ঠে নিশাতের প্রশ্ন।
– ” হ্যাঁ আমি একদম ঠিক আছি। কিছু হয়নি আমার। হয়নি বললে ভুল হবে; মিস্টার ফাইয়াজ কিছু হতে দেন নি আমার।”
কৃতজ্ঞতার ভঙ্গিমা অনুসরণ করে প্রত্যুত্তরে বলে উঠে সিরাত। ফাইয়াজ বিনিময়ে শুধু মুচকি হাসি দেয়।
– ” উহুম, উহুম‌! সারারাত কি এভাবে গল্প করে কাটিয়ে দিলেই হবে নাকি কিছু খেতেও হবে?”
সদর দরজার সামনে ট্রে হাতে উপস্থিত হতেই বলে উঠে ফারিহা।
– ” আরে বাইরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন, ভেতরে আয়!”
ফাইয়াজের কথামতো ভেতরে প্রবেশ করে টেবিলের উপর ট্রে রাখে ফারিহা।

– ” আচ্ছা, তোমরা না কথা বলো আমার একটা জরুরী কল এসেছে! আমি একটু বাহিরে যাচ্ছি।”
বলতে বলতে ফোন হাতে রুম থেকে প্রস্থান করে ফাইয়াজ।
রাতের খাবারের আয়োজনের পর্ব চুকিয়ে তিন জন যথাক্রমে সিরাত, নিশাত আর ফারিহা মেতে ওঠে নানারকম গল্পে। হাস্যরসাত্মক গল্প করার মাঝেই ঘরের মধ্যে হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ে রিয়া। রিয়াকে এভাবে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে হাসি থামিয়ে দেয় ফারিহা আর নিশাত‌। দুজনেই ভ্রু কুঁচকে তাকায় রিয়ার দিকে।
– ” রিয়া আপু তুমি এখানে? ভালোই করেছো এসে; এখানে এসে আমাদের সাথে জয়েন হও!”
– ” গল্প মাই ফুট! আমি এখানে তোমাদের সাথে কোনো ইউজলেস গল্প করতে আসি নি! আমি এখানে সিরাতকে ওয়ার্ন করতে এসেছি।”
খানিকটা রাগমিশ্রিত‌ কন্ঠে বলে উঠে রিয়া। সিরাতকে ওয়ার্ন করার কথা কানে আসতেই ফারিহা, নিশাত সহ সিরাতও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বসে।
-” ম,ম,মানে কিসের ওয়ার্ন?”
অস্ফুট স্বরে জিজ্ঞেস করে সিরাত।

– ” কি মনে করো নিজেকে? কেউ তোমার আসল চেহারা চিনবে না? আমি চিনে ফেলেছি তোমার আসল চেহারা!
আমার মুগ্ধকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেয়ার জন্য এত নাটক সাজিয়েছ তাই তো? নিজেকে মুগ্ধের সামনে অসহায় অবলা সাজিয়ে নিজের মায়ায় ফেলতে চাও যাতে করে এ সব সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে পারো; লিসেন মুগ্ধ ইজ মাইন!
ওর দিকে হাত বাড়ালেও সেটা তোমার পক্ষে ভালো হবে না সিরাত!”
রিয়ার মুখের এমন হুমকিস্বরূপ কথাবার্তা সিরাতকে অবাক না করে পারে না। রিয়ার কথায় সবার মুখেই বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট।
– ” এগুলো আপনি কি বলছেন রিয়া আপু? কিসের নাটক আর কিসেরই বা মুখোশ উন্মোচন?
আর মিস্টার ফাইয়াজের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কখনোই সম্পত্তির বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল না। আর না আমিই তার সামনে অসহায়ত্বের নাটক করেছি! তিনি তো শুধু আমার বিপদে আমাকে সাহায্য করেছেন! এখানে তাকে নিজের মায়ায় জড়ানোর সাদৃশ্য কোথায়?”
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে সিরাত।
– ” আমার সামনে এসব নাটক করার প্রয়োজন নেই। আমি সব ভালো করে জানি! আই জাস্ট ওয়ার্ন ইউ! এর পর থেকে যেন তোমাকে মুগ্ধের আশেপাশে না দেখি! হি ইজ অনলি মাইন!
একটু পরিমাণেও যদি লাজ লজ্জা থেকে থাকে তাহলে এ বাড়ি থেকে আগামীকালই চলে যাবে তুমি।”

– ” রিয়া আপু!!
ব্যস অনেক হয়েছে। তুমি সেই কখন থেকেই সিরাত আপুকে যা তা শোনাচ্ছো, তোমার প্রবলেম কোথায়? আমার ভাই যাকে খুশি ভালোবাসবে আর এটা একান্তই তার ব্যাপার। আর তুমি খুব ভালো করেই জানো ভাইয়া তোমাকে পছন্দ করে না; তুমি যেগুলো সারাদিন ভাইয়ার সামনে করো সেগুলো ন্যাকামি, নাটক ছাড়া কিছুই না!”
রিয়ার প্রশ্নোত্তরে হুংকার দিয়ে বলে উঠে ফারিহা।
এদিকে চিল্লাচিল্লি করার শব্দ কর্ণপাত হতেই রুমে দ্রুত পায়ে চলে আসে ফাইয়াজ। রুমের মধ্যে রিয়াকে আর ফারিহাকে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা কাটাকাটি করতে দেখে ভ্রু কুঁচকে নেয় সে। আর এক পর্যায়ে সিরাতের দিকে চোখ যেতেই আতকে উঠে সে। চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া অশ্রু গুলো চিবুকে এসে জমা হয়েছে নির্লিপ্ত ভাবে। ফর্সা ত্বকে লালচে আভা স্পষ্ট।
– ” কি ব্যাপার ফারিহা; কি হয়েছে এখানে? এত চেঁচামেচি কিসের?”
ফাইয়াজের বলা কথার মাঝেই রুম থেকে গটগট করে বেরিয়ে পড়ে রিয়া। রিয়ার যাওয়ার পানে কিছুক্ষণ দৃষ্টি স্থির করে ফারিহা বলে উঠে,
– ” তুই আয় আমার সাথে; তোর সাথে আমার জরুরী কথা আছে।”
কোনোকিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফাইয়াজকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো ফারিহা‌।
এদিকে একে একে সবাই চলে যাওয়ার পর খাটের উপর ধীরে ধীরে বসে পড়ে সিরাত‌। চোখ মুখ লাল রঙ ধারণ করেছে অনেক আগেই।

————
পরদিন সকালে,,
ডাইনিং টেবিলে উপস্থিত সবাই নাস্তা খাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে এমন সময় ফাইয়াজের গম্ভীর কন্ঠস্বর ভেসে আসে সকলের কানে। ফাইয়াজের আওয়াজ অনুসরণ করে পাশে তাকাতেই খেয়াল করে সিরাতের হাত মুঠোয় নিয়ে ডাইনিং রুমের দিকেই অগ্রসর হচ্ছে দুজন। জাফর সাহেব কপাল কুচকালেন‌। চোখে মুখে বিরক্তির উদ্রেক।
– ” আমি সবাইকে কিছু বলতে চাই।”
বেশ শান্ত গলায় বলে উঠে ফাইয়াজ। সিরাত ভয়ে জড়সড় হয়ে কোনোমতে দাঁড়িয়ে আছে। ফাইয়াজের হঠাৎ এমন কথার ভাবভঙ্গি যথেষ্ট পরিমাণে সন্দেহ জনক মনে হচ্ছে।

– ” কি হয়েছে বাবা, কি বলবি?”
বলে উঠেন মিসেস সাবিনা ওরফে ফাইয়াজের মা।

– ” আমি সিরাতকে ভালোবাসি; আর আমি সিরাতকেই বিয়ে করব! ”
ফাইয়াজের বলা কথা শুনতে পেয়ে হালকা নড়েচড়ে উঠেন জাফর সাহেব। সিরাতও ভড়কে যায় এমন কথা শুনে।
– ” কি সব বলছো তুমি মুগ্ধ? আর ইউ লস্ট ইউর মাইন্ড?
আমি রিয়ার সাথে তোমার বিয়ে ঠিক করেছি; সেখানে এই মেয়ের কথা আসে কি করে? ”
গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন জাফর সাহেব।

– ” আমি ঠিকই বলছি বাবা। আমি সিরাতকে ভালোবাসি। আর যদি বিয়ে করতে হয় তাহলে আমি সিরাতকেই করব বিয়ে; রিয়াকে না!”
ফাইয়াজের কথা শুনে রাগে ক্ষোভে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় রিয়া।
– ” হোয়াট হ্যাপেন্ড টু ইউ মুগ্ধ? তুমি এই একটা চিপ, থার্ড ক্লাস মেয়ের জন্য আমাকে রিফিউজ করে দিচ্ছ! আমি শুধুমাত্র তোমার জন্য ইউকে থেকে ব্যাক করেছি! আই লাভ ইউ‌ মুগ্ধ, হোয়াই ডোন্ট ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড?”
বলার পরক্ষণেই নাকি কান্না জুড়ে দেয় রিয়া‌।

– ” কি শুরু করেছো কি মুগ্ধ?
কি যোগ্যতা আছে এই মেয়েটার এই আহমেদ বাড়ির বউ হওয়ার? ”
অত্যন্ত ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলেন জাফর সাহেব।
– ” বাবা!!
এই আহমেদ বাড়ির বউ হবার কোনো যোগ্যতা থাকে সেটা সিরাতের আছে! আর সবচেয়ে বড় কথা আই লাভ হার; সেখানে অন্য কাউকে বিয়ে করার প্রশ্নই আসে না।”

– ” তাহলে আমার এ বাড়িতে থাকার কী মানে? আমি থাকব না এখানে; চলে যাব আবারো ইউকে তে!”
বলেই চেয়ার ছেড়ে উঠে রুমের দিকে পা বাড়ায় রিয়া‌।
– ” তবে আমার জিনিস আমি নিয়েই যাব! আর যদি না পাই তাহলে তোর মতো একটা চিপ ক্লাস মেয়েরও হতে দিব না; মুগ্ধ ইজ অনলি মাইন!
মাইন্ড ইট!”
সিরাতের পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলে উঠে রিয়া‌। অতঃপর পা বাড়ায় ঘরের দিকে।
রিয়া চলে যাওয়ার পর পরই জাফর সাহেব ও নাস্তার টেবিলে খাবার রেখেই উঠে পড়লেন।
– ” সাবিনা আমি বের হচ্ছি অফিসের জন্য!”
বলেই একটা ব্যাগ নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে পড়েন জাফর সাহেব। আর সেদিকেই অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে ফাইয়াজ। সিরাতের মনের অবস্থাও বিদ্রুপ। সামনের দিনগুলো যে খুব একটা সহজ হবে না তা বেশ ভালোই টের পাচ্ছে সে।

এক আকাশ পরিমাণ রাগ নিয়ে পাত্রপক্ষের সামনে মাথা নিচু করে বসে আছে চন্দ্রিকা। সামনে বসে থাকা মাঝবয়সী মহিলা এবং পাত্রের দিকে এখন পর্যন্ত তাকিয়ে দেখে নি সে। গানের ক্লাস শেষে বাড়িতে এসে তার বিয়ের কথাবার্তা শুনতেই মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। ইয়াসিন সাহেবের কথার অমান্য করতে না পেরে এক প্রকার বাধ্য হয়ে ড্রয়িং রুমে গিয়ে চুপচাপ বসে পড়ে চন্দ্রিকা।
– ” মাশাআল্লাহ, মেয়ে তো ভারী মিষ্টি! আমার তো বেশ পছন্দ হয়েছে মেয়েকে। তাহলে বিয়ের কথা সামনে বাড়াই; কি বলেন ভাইসাহেব? তাছাড়া আমার ছেলে রূপের কথাও তো রাখতে হবে!”
রূপ নামটা শুনতেই নিমিষেই সব রাগ ক্ষোভ মিইয়ে যায় চন্দ্রিকার। একরাশ বিস্ময় নিয়ে মাথা তুলে তাকাতেই চোখ দুটো কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। অস্ফুট স্বরে শুধু উচ্চারণ করে,
– ” ড,ড্,ডক্টর রূপ!!”……………

#চলবে 🍂

#বাসন্তী_প্রেম 🌼🌼
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান ( ছদ্মনাম)
#বিংশ_পর্ব

– ” ড,ড্,ডক্টর রূপ!”
বিস্ফোরিত নয়নে রূপের দিকে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করে চন্দ্রিকা।
দুজনের চোখাচোখি হতেই রূপ বিনিময়ে একটা মুচকি হাসি দেয়। চন্দ্রিকার কাছে সবকিছু যেন এখনো ঘোরের মতো লাগছে। তার সুক্ষ্ম ভাবনায় ছেদ পড়ে রূপের মায়ের কথায়।
– ” আচ্ছা এখন তো অনেক কথা হলো; রূপ আর চন্দ্রিকাকেও না হয় এবার আলাদা করে কথা বলতে দেয়া যাক!”
রূপের মায়ের কথায় হালকা নড়েচড়ে উঠে চন্দ্রিকা। হুট করেই যেন নার্ভাসনেস কয়েক গুণ পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে যেখানে সে আর রূপ আগে থেকেই পরিচিত।
– ” জী আপা অবশ্যই! পূরবী, তুমি রূপকে নিয়ে যাও। ”
না চাইতেও জোরপূর্বক দাঁড়িয়ে হাঁটা দিল চন্দ্রিকা। আর তাকেই অনুসরণ করে পিছু পিছু চলে রূপ।

বিকেলের আকাশে সূর্য অস্তায়মান‌। রোদের প্রখরতা নেই বললেই চলে। প্রবাহমান বাতাসের শীতল স্পর্শ কিছুক্ষণ পর পর ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে চন্দ্রিকাকে‌। যার ফলস্বরূপ কোমর অবধি লম্বা খোলা চুলগুলো তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে। আর তার ঠিক সামনেই কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে রূপ। দুজনের মাঝেই পিনপতন নীরবতা। মিনিট পাঁচেক বাদে নীরবতার সমাপ্তি ঘটিয়ে চন্দ্রিকা খানিকটা শান্ত গলায় বলে ওঠে,
– ” এসবের মানে কি ডক্টর রূপ?”
চন্দ্রিকার প্রশ্নে সোজা হয়ে দাঁড়ায় রূপ। গলা হালকা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠে,
– ” কোন সব? কিছু কি হয়েছে?”
না জানার ভান করে এদিক সেদিক তাকিয়ে বলে রূপ। এতে করে খানিকটা রেগে যায় চন্দ্রিকা। তবুও নিজেকে যথাসম্ভব সামলে আড়চোখে তাকিয়ে বলে উঠে,
– ” আমি মজা করছি না ডক্টর রূপ। আমি সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করছি; এসবের মানে কি? আপনি ভালো করেই জানতেন যে আমার এসব বিয়ে, ভালোবাসা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই আর না এগুলোর সাথে কখনো জড়াতে চাই!
আপনি সবটা জানার পরেও কেন বিয়ে নিয়ে বাড়াবাড়ি করছেন?”
চন্দ্রিকার রুক্ষ কন্ঠস্বর শুনে রূপের মুখের হাসি উবে গেল। নিজের মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণে গাম্ভীর্য ভাব এনে বলা শুরু করে,
– ” হ্যাঁ আমি জানি আমি কি করেছি!
তবে চন্দ্রিকা এখানে নিশ্চয়ই কোনো ভুল নেই। আর যদি আমি তোমার আঙ্কেলের কাছে বিয়ের প্রস্তাব না আনতাম তাহলে ইয়াসিন আঙ্কেল তোমার বিয়ে অন্য আরেকটা ছেলের সাথে দিয়ে দিত।”
– ” মানেহ্?”
– ” হ্যাঁ ইয়াসিন আঙ্কেল তোমার অজান্তেই তোমার বিয়ের প্ল্যানিং করছিল এন্ড ফরচুনেটলি এই ব্যাপার নিয়ে তিনি আমাকেও বলেছিলেন!
আর এটা আমি কখনোই হতে দিব না যে নিজের চোখের সামনে প্রিয় মানুষটিকে অন্য কারো হাতে তুলে দিতে।”
রূপের কথাবার্তা শুনে অবাক হয় চন্দ্রিকা। বিস্ফোরিত চোখে রূপের দিকে তাকায় সে।
– ” কি বলছেন আপনি ডক্টর রূপ? প্রিয় মানুষ মানে?”
– ” কাম অন চন্দ্রিকা। তুমি এতটাও ইম্যাচিউর নও যে আমার কথা বুঝতে পারো নি!
আমি জানি তুমি ভালো করেই জানো যে আমি তোমাকে ভালোবাসি; আর তুমি জেনে শুনে ইচ্ছে করেই সবটা জেনেও এড়িয়ে গিয়েছ আমায়।”
রূপের কথায় কিঞ্চিৎ কেঁপে ওঠে চন্দ্রিকা। কপাল বেয়ে বিন্দু বিন্দু দুশ্চিন্তার ঘাম ঝড়ছে। রূপ সবটা জানত তাহলে ভাবতেই মাথা ঝিমঝিম করা শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে।
– ” আপনি তো তাহলে সবটা জানতেন ই! তাহলে শুধু শুধু কেন যেচে আবারো আমার কাছে এসেছেন? আমি তো বলেছিই যে আমি কাউকে বিয়ে করতে পারব না।”
– ” ট্রাই টু আন্ডারস্ট্যান্ড চন্দ্রিকা। আমার ইনটেনশন‌ খারাপ না; আমি তোমাকে ভালোবাসি বলেই বিয়ের প্রপোজাল টা দিয়েছি! আমি তোমাকে হারাতে চাই নি। আমাকে প্লিজ ফিরিয়ে দিও না!”
– ” আমি জানি আপনার ইনটেনশন খারাপ না ডক্টর রূপ! আর আমি এটাও বলছিনা যে আপনি খারাপ। তবে ঐ যে একটা জিনিস বিশ্বাস! সেটাই দ্বিতীয় বারের মত করা কখনোই সম্ভব না।”
– ” আমি কথা দিচ্ছি আমি আমার বেস্ট তোমাকে দিব! সবসময় আগলে রাখব, ভালোবাসব! তবুও এই বিয়েতে রাজি হয়ে যাও। তোমাকে আমার ভালোবাসতে হবে না ; বরং শুধু দিনশেষে আমার সাথে থাকলেই চলবে! প্লিজ চন্দ্রিকা, আই রিকোয়েস্ট ইউ‌।”

– ” আর আমি যদি এ বিয়েতে রাজী না হই তাহলে? ”
স্থির দৃষ্টিতে রূপের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে উঠে চন্দ্রিকা। রূপের দৃষ্টিও স্থির‌। তবে সে দৃষ্টিতে আছে একরাশ অভিযোগ, অসহায়ত্ব আর একরাশ ভয়।

পুরোটা বিকেল এক অজানা আতংকের মধ্য দিয়ে কেটেছে সিরাতের‌। সকালে রিয়ার বলে যাওয়া কথাই শুধু মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে। তাছাড়া দিনকে দিন তাকে নিয়ে ফাইয়াজ আর জাফর সাহেবের মাঝে বেড়ে যাওয়া দ্বিধাদ্বন্দ্ব তাকে বেশ ভাবিয়ে তুলেছে। রুমের মধ্যে বসে এতক্ষণ এগুলোই ভাবছিল সিরাত‌। তার সুক্ষ্ম ভাবনায় ছেদ পড়ে রুমের দরজা খোলার খটখট শব্দে।
– ” আসতে পারি? ”
হঠাৎ করে সাবিনা বেগমের কথায় একটু নড়েচড়ে উঠে সিরাত‌।
– ” আন্টি আপনি? ভেতরে আসুন।”
সিরাতের কথা শুনে গুটি গুটি পায়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন সাবিনা বেগম। মুখশ্রী জুড়ে হাসি হাসি ভাব তার।
– ” জি বলুন আন্টি; কিছু হয়েছে? ”
– ” না তেমন কিছুই হয় নি! একটু দেখা করতে আসলাম তোমার সাথে। আসলে এ বাড়িতে আসার পর তোমার সাথে তেমন করে কোনো কথাই হয়নি। তাই ভাবলাম আজ কিছুক্ষণ সময় কাটানো যাক!”
সাবিনা বেগমের কথার বিনিময়ে একটা মুচকি হাসি দেয় সিরাত‌।
– ” তুমি কি ফাইয়াজকে ভালোবাসো সিরাত ঠিক যেমন ফাইয়াজ তোমাকে ভালোবাসে? ”
মিসেস সাবিনার প্রশ্নে মুহূর্তেই থমকে যায় সিরাত‌। মুখে লেগে থাকা হাসির রেখাটুকু ও নিমিষেই মিলিয়ে যায়। সিরাতকে এভাবে চুপচাপ হয়ে যেতে দেখে মিসেস সাবিনা ধীর গতিতে নিজের হাতটা সিরাতের কাঁধের উপর রাখলেন।
– ” আমি জানি তোমার মনের ভেতর কি চলছে সিরাত। হ্যাঁ ও না এই দুইয়ের মাঝে দ্বন্দ্বে পেরে ওঠা খুবই কঠিন। তবে হ্যাঁ একটা কথা ফাইয়াজের তোমার প্রতি ভালোবাসাটা কিন্তু সত্যি। একজন মা হয়ে নিজের সন্তানের ভালোমন্দ বোঝার ক্ষমতা অন্তত আমার আছে। আর সেটা থেকেই তোমাকে বলছি, ফাইয়াজ তোমাকে সত্যিই ভালোবাসে! তুমি ও ঠিক তাকে ভালোবাসো কি না সেটা আমার জানা নেই তবে তুমি যে ফাইয়াজকে ভালোবাসলে ঠকবে না এটা অন্তত ভরসা করতে পার।”
সাবিনা বেগমের প্রশ্নোত্তর অনেকাংশেই দূর করে দেয় সিরাতের মনে থাকা দ্বিধাদ্বন্দ্বকে‌। নিজের প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যেতেই মুচকি হেসে ধীর গতিতে গিয়ে মিসেস সাবিনাকে জড়িয়ে ধরে। মিসেস সাবিনা ও নিজের উত্তর পেয়ে সিরাতের মাথায় হাত বুলাতে শুরু করেন।
– ” উহুম উহুম! নতুন মেয়েকে পেয়ে সব আদর নতুন মেয়েকেই দেয়া হচ্ছে। বাড়িতে যে আমার মতো একটা কিউট, সুইট মেয়ে আছে তা তো সবাই ভুলতেই বসেছে। ”
সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মুখ ফুলিয়ে কথাগুলো বলে উঠে ফারিহা। আর সে কথা শুনতেই উচ্চশব্দে হেসে উঠে সিরাত এবং মিসেস সাবিনা দুজনেই।

ঘড়িতে রাত আটটা বাজে,,
এখনো ফাইয়াজের বাড়িতে ফেরার কোনো নাম গন্ধ নেই। সকাল সকাল একটা কনসার্টের উদ্দেশ্যে যে বেরিয়েছে এখনো ফেরার কোনো নাম গন্ধ নেই। বেডরুমে বসে আনমনে পছন্দের লিস্ট থেকে কিছু গান শুনছিল সিরাত‌।
” তুমি যাকে ভালোবাসো,
স্নানের ঘরে বাষ্পে ভাসো;
তার জীবনে ঝড়!
তোমার কথার শব্দদূষণ; তোমার গলার স্বর
আমার দরজায় খিল দিয়েছি,
আমার দারুণ জ্বর!
তুমি অন্য কারোর সঙ্গে বেঁধো ঘর!”
আচমকা দরজার অপর প্রান্ত থেকে কড়া নাড়ার আওয়াজ পেয়ে সজাগ হয়ে ওঠে সিরাত। ধীর পায়ে এগিয়ে দরজা খুললেও অপর পাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ এলো না। মনের ভ্রান্তি মনে করে পেছন দিকে পা বাড়াবে এমন সময় আবারো সিঁড়ির কাছে কিছু পড়ার শব্দ হয়। এবার খানিকটা সন্দেহের সৃষ্টি হয় সিরাতের মনে। গুটি গুটি পায়ে সিঁড়ির দিকটায় এসে আরেক পা দিতেই পায়ে তেল জাতীয় পদার্থের সংস্পর্শে পা পিছলে পড়ে যেতে নিলেই এক জোড়া শীতল পুরুষালী হাত তার কোমরের সংলগ্ন জড়িয়ে ধরে। এতে করে চিৎকার দিতে গিয়েও থেমে যায় সিরাত‌। মুখ দিয়ে টু শব্দ ও বের হয় না।…………..

#চলবে 🍂