বাসন্তী প্রেম পর্ব-২৭+২৮

0
567

#বাসন্তী_প্রেম 🌼🌼
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#সপ্তবিংশ_পর্ব

– “ফাইয়াজ আপনি!”
অবাক হয়ে বলে উঠে সিরাত‌। সিরাতের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রিয়ান ও যেন কিছু মুহূর্তের জন্য চমকে যায়। কিন্তু পরমুহূর্তেই দরজার সামনে ফাইয়াজকে দাঁড়ানো অবস্থায় দেখতে পায়। এতে করে বাঁকা হাসে রিয়ান‌। মুখের কোণে বাঁকা হাসি বজায় রেখে হাতে থাকা ছুরিটা‌ ঘোরাতে ঘোরাতে বলে উঠে,
– “আরে রকস্টার ফাইয়াজ যে! যাক অবশেষে আমার খোঁজ পেয়েই গেলে। ইন্টারেস্টিং, ভেরি ইন্টারেস্টিং! সিরাত পাখিকে বাঁচাতে এসেছো আমার হাত থেকে? সো স্যাড, সেটা তো আর হবে না।”
ফাইয়াজের দৃষ্টি তখনও রিয়ানের উপর স্থির। মুখে লেগে আছে রহস্যময়ী হাসি।
– “তাই নাকি! আমার রাজ্যে এসে আমার রানীকে নিয়ে পালিয়ে যাবি আর সেটা আমি হতে দেব? মোটেও না!
আর তুই কী মনে করেছিস সিরাতকে কিডন্যাপ করে নিবি আর আমি খোঁজ ও পাব না!”
বলেই মৃদু হেসে ভেতরে প্রবেশ করল ফাইয়াজ।
ফাইয়াজের কথায় তেমন বিশেষ কোনো ভাবান্তর ঘটে না রিয়ানের মাঝে।
– “কি ভেবেছিস! আমি কোনো প্ল্যান না করেই তোকে এখানে এনেছি? আর তুই নিজ থেকে এখানে আসিস নি ফাইয়াজ, আমি এনেছি তোকে; আমি! আমার বানানো প্ল্যানে তুই নিজে পা দিয়েছিস, আর এই প্ল্যানে আমাকে কে হেল্প করেছে জানিস? তোরই ফ্যামিলির কেউ, তোর কাছের ই কেউ!
আর আমি এতটাও বোকা নই একই ভুল দ্বিতীয় বার করব। আমি আমার গেমকে ঠিক এতটাই নিখুঁত ভাবে সাজিয়েছি যে সেই গেমের এন্ডিং হবে তোর আর তোর প্রাণপ্রিয় প্রেয়সী সিরাত পাখির মৃত্যু দিয়ে। আর সেটাও অবিয়াসলি আমার হাতেই।”
সিরাতের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে বলে উঠে রিয়ান‌। এদিকে রিয়ানের এমন ভয়ঙ্কর কথাবার্তা শুনে সমস্ত শরীর হিমের‌ ন্যায় জমতে শুরু করে দিয়েছে সিরাতের‌। মনের মধ্যে ফাইয়াজকে হারিয়ে ফেলার মতো তীব্র ভয়ঙ্কর ভয় তার মনে বাসা বাঁধা শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে। ফাইয়াজকে স্থির মূর্তির দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফাইয়াজের দিকে এগিয়ে যায় রিয়ান।
– “কি ব্যাপার? ভয় করছে? মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখে ভয় করছে? করা উচিত! আমি বারবার বলেছিলাম আমার রাস্তায় বাধা দিস না! কিন্তু তুই কি করেছিস, আমার জিনিসে হাত বাড়িয়েছিস। আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিস; তাহলে তোকে ছেড়ে দেই কি করে বল!”
বলেই তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় রিয়ান‌। হাসিতে যেন লুকিয়ে রয়েছে বিশাল রকমের পৈশাচিক আনন্দ।
– “শেষ? তোর বলা শেষ? তাহলে এবার আমি শুরু করি?
ফাইয়াজ আহমেদ মুগ্ধ গোটা গেমের অনলি ওয়ান হিরো আর অনলি ওয়ান ই ভিলেন‌। এই রকস্টার মুগ্ধের পেছনে লুকিয়ে থাকা গ্যাংস্টার ফাইয়াজকে আদৌ তুই চিনতে পারিস নি। আর একটু আগে কি যেন বলছিলি সবটাই তোর সাজানো প্ল্যান? লাইক সিরিয়াসলি? খুব হাসি পাচ্ছে জানিস! কিন্তু কোনটার উপর হাসব? তোর করা বোকামি নাকি তোর দুর্ভাগ্যের উপর?”
ফাইয়াজের বলা কথায় বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে যেন পৌঁছে যায় সিরাত। সবকিছু যেন মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। রিয়ান ও যেন একই বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছে।
– “গ্যাংস্টার! কিন্তু তোকে তো সবাই রকস্টার নামেই চিনে। তোর মতো একটা মানুষ গ্যাংস্টার??”
অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে রিয়ান‌। ফাইয়াজ তার ঠোঁট জোড়া কিঞ্চিৎ প্রসারিত করে মৃদু হাসে।
– “ঐ যে বললাম আমার গেমের ভিলেন ও আমি, হিরো ও আমি। হ্যাঁ আমি একজন গ্যাংস্টার। আন্ডার ওয়ার্ল্ড এর হিডেন গ্যাংস্টার। যে গ্যাংস্টারকে আদৌ কেউ চিনে না; আর না কেউ ভবিষ্যতে চিনবে। এই মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট হিডেন সিক্রেট তোর সাথেই আজকে মাটি চাপা পড়ে যাবে।”
– “তুই গ্যাংস্টার নাকি রকস্টার সেটা আমার দেখার কোনো প্রয়োজন নেই ফাইয়াজ। আমি শুধু আজ তোর চোখে তোর মৃত্যুকে দেখতে পারছি। আর সেটা না হয় সিরাত কে দিয়েই শুরু হোক!”
বলেই হুট করে সিরাতকে হ্যাঁচকা টান দিয়ে নিজের কবজায়‌ বন্দী করে নেয় রিয়ান‌। হাতে থাকা ধারালো ছুরি টা সিরাতের গলায় ছুঁয়ে দিতেই নরম চামড়া ভেদ করে রক্তের প্রলেপ দেখা যায়। সাথে করে সিরাতের কন্ঠে ভেসে ওঠে মৃদু আত্ম চিৎকার।
– “নিজের চোখের সামনে নিজের প্রেয়সীকে তিলে তিলে শেষ হয়ে যেতে দেখা খুব কষ্টের তাই না ফাইয়াজ। এখন কেমন হবে যদি তোর সামনে তোর প্রাণ পাখিকে মেরে ফেলি তাহলে? সিরাত আমার একমাত্র আসক্তি, আমার নেশা। এই নেশা শুধুমাত্র আমার। এই নেশা যদি আমার না হয় তাহলে আর কারো হতে পারবে না। আমি নিজেই আমার নেশা কে কাটিয়ে দিব চিরদিনের জন্য।”
বলেই ‌পৈশাচিক হাসি দেয় রিয়ান। সাথে হাতে থাকা ছুরি টা সিরাতের গলার সাইডে চেপে ধরতেই ফাইয়াজ চাপা কন্ঠে বলে উঠে,
– “এই ভুল করার মতো দুঃসাহস করিস না রিয়ান‌। সিরাতের গায়ে আর একটা আঁচড় ও লাগলে তোর লাশটাও কেউ খুঁজে পাবে না রিয়ান। আর আমি জানি তুই এটা কোনোদিনই করতে পারবি না।”
বলেই ধীর পায়ে রিয়ানের দিকে এগোনো শুরু করে ফাইয়াজ।
– “আমি কি করতে পারব তা না হয় নিজেই দেখে নে। আর ওখানেই থেমে যা ফাইয়াজ। আর এক পা ও এগোনো তোর প্রেয়সীর জন্য বিরাট রকমের ক্ষতি বয়ে আনবে।
আর মাই ডিয়ার সিরাত পাখি, তোমার ভালোবাসা, ভরসা, ফাইয়াজকে শেষবারের মতো ‌মন ভরে শুনে নাও। বিদায় জানিয়ে দাও নিজের ভালোবাসাকে।”
চোখ দিয়ে নোনা অশ্রু গড়িয়ে চিবুকে এসে পড়ে সিরাতের। সত্যিই কি আর কোনোদিন ফাইয়াজের কাছে তার ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করা হবে না! কান্নারা যেন দলা পাকিয়ে আসে। তবুও মনের মধ্যে সুপ্ত আশা জমে থাকে এই বুঝি ফাইয়াজ তাকে রিয়ান নামক ভয়ঙ্কর মানুষটির কাছ থেকে বাঁচিয়ে নিবে।

আহমেদ বাড়িতে বিশাল পরিমাণ থমথমে পরিস্থিতি বিরাজমান। বেশ কিছুক্ষণ আগেই জাফর সাহেব উপস্থিত হয়েছেন আহমেদ বাড়িতে। সবার এমন পিনপতন নীরবতা যেন তার চিন্তাকে উগ্র করে তোলে। কিন্তু পরক্ষণেই সিরাতের সাথে সাথে ফাইয়াজের ও নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ কানে পৌঁছাতেই যেন দুশ্চিন্তার পরিমাণ আরো এক ধাপ বেড়ে যায়। রিয়ার মাঝেও অস্থিরতা বিদ্যমান। ফারিহা, রূপ, নিশাত, চন্দ্রিকা কারো চোখের পাতা যেন এক হচ্ছে না। অসুস্থ হওয়ার কারণে সাবিনা বেগমকে কোনো ভাবে একপ্রকার জোর করে ঔষধ পত্র খাইয়ে দিতেই ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যান তিনি।
– “নো নো, এভাবে সবটা হাতছাড়া হতে দেয়া যাবে না। সবার মতো নরমাল না থাকলে সবার সন্দেহ আমার উপরেই হবে। কিছু একটা কর রিয়া, কাম অন!”
মনে মনে বিড়বিড় করে প্রলাপ বকে রিয়া। চোখেমুখে একরাশ আশঙ্কা। সবার চোখের ফাঁকি দিয়ে ছাদে চলে আসে রিয়া। ফোন থেকে রিয়ানের নম্বরে ডায়াল করতেই অপর পাশ থেকে ভেসে আসে,
‘আপনি যেই নম্বর টিতে ডায়াল করছেন তা এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না।’
রাগে ক্ষোভে হাতে থাকা ফোনটা কিছু একটা ভেবে মেঝেতে ছুঁড়তে গিয়েও ছুড়ে না রিয়া।

– “আমি লাস্ট বার বলছি রিয়ান, সিরাতকে ছেড়ে দে। আর সিরাত কোনোদিনই তোর নেশা, তোর আসক্তি ছিল না! তুই শুধু মোহের বশে এসে সিরাতকে পাওয়ার ব্যর্থ প্রচেষ্টা করছিস। সিরাত একমাত্র আমার নেশা, যে নেশা আমার সমস্ত শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে গিয়েছে। তাই ওকে ছেড়ে দে।”
– “যদি না ছাড়ি তাহলে?”
– “তাহলে বেশি কিছু না মিস্টার রিয়ান, ইউ আর আন্ডার এরেস্টেড!”
রিয়ানের মাথায় বন্দুক ঠেকিয়ে বলে উঠে ধ্রুব। ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি।

– “ধ্রুব তুই?”
অবাক হয়ে প্রশ্ন করে রিয়ান।
– “ইয়েস মিস্টার রিয়ান চৌধুরী! আমি ধ্রুব; ওপস্ সরি ধ্রুব দ্যা হিডেন অফিসার অফ সিআইডি ডিপার্টমেন্ট।”
একের পর এক এত বড় বড় রহস্য উন্মোচন হতেই মাথা ঝিমঝিম করছে সিরাতের‌। শরীরটাও অসাড় হয়ে আসছে ক্রমশ। তবুও নিজেকে যথাসম্ভব সামলে নেয় সে।
– “হাতে থাকা ছুরি টা নিচে ফেলে দে রিয়ান। নাহলে আমার বন্দুকের গুলি তোর মস্তিষ্ক ছেদ করে বেরিয়ে যাবে। আর আমি জানি তুই এটা করবি না, তাই ছুরিটা ফেলে দে।”
ধ্রুবের কথায় কিছু একটা ভেবে হাতে থাকা ছুরি টা নিচে ফেলে দেয় রিয়ান‌। এই সুযোগে সাথে সাথেই সিরাতকে নিজের কাছে টেনে নেয় ফাইয়াজ। এতক্ষণে যেন তার হৃদয় শান্ত হয়‌। রিয়ানের দিকে ক্ষোভ ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ধ্রুবকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠে,
– “ওকে এখান থেকে নিয়ে যা ধ্রুব, আমি ও সেখানে আসছি একটু পর।”
বলেই সিরাতকে নিজের বাহুতে আবদ্ধ করে নিয়ে হাঁটা শুরু করে ফাইয়াজ। এদিকে ধ্রুব ও তার হাতের হাতে থাকা বন্দুক দিয়ে রিয়ানকে জব্দ করে সামনের দিকে এগোয়। কিন্তু কয়েক সেকেন্ড পর ই হুট করে ধ্রুবকে ধাক্কা দিতেই টাল সামলাতে না পেরে খানিকটা দূরে ছিটকে পড়ে ধ্রুব। হাতে থাকা পিস্তল টাও পড়ে যায় হাত থেকে। মেঝেতে পড়ে থাকা একটা লম্বা লোহার রডের উপর চোখ পড়তেই শয়তানি হাসি দেয় সে। অপরদিকে ধ্রুব তৎক্ষণাৎ পিস্তল টা খুঁজতে খুঁজতে একসময় চোখ পড়ে রিয়ানের উপর। রিয়ানের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আগাম ধারণা নিতেই আতংক গ্রাস করে তাকে।
তড়িঘড়ি করে উঠে সিরাতের নাম উচ্চারণ করতে যাবে এমন সময় কারো সজোরে আঘাতে সিরাতের চিৎকারে থমকে যায় ফাইয়াজ। মাথার পেছনের অংশে লোহার রডের মতো দৃঢ় বস্তুর আঘাতে পুরো মস্তিষ্ক জুড়ে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হয় সিরাতের‌। পেছনেই রিয়ান দাঁড়িয়ে পৈশাচিক হাসি দিচ্ছে। শেষ মুহূর্তে নিজের প্রেয়সীর এমন করুণ অবস্থা দেখে দপ করে আগুন জ্বলে উঠে ফাইয়াজের মস্তিষ্কে। কিছু না ভেবেই জ্যাকেট থেকে গান বের করে ট্রিগারে আঙুল চালিয়ে দেয় রিয়ানের বুক বরাবর। পরপর তিনটা গুলি বুকের মধ্যে ছেদ করে ঢুকে যেতেই রিয়ানের নিথর দেহ টা মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। এদিকে মাথা চেপে ধরে মৃদু চিৎকার দেয় সিরাত। রক্তের স্রোত ঘাড় বেয়ে জামা স্পর্শ করতেই জামাও লালচে বর্ণ ধারণ করে। সেটা দেখেই আতকে উঠে ফাইয়াজ। দ্রুত পায়ে এগিয়ে যেতেই সিরাতের ক্রমশ নিস্তেজ হওয়া শরীরটা ফাইয়াজের বুকে ঢলে পড়ে।

– “সিরাত, এই সিরাত! লুক এট মি, কিছু হবে না তোমার! চোখ দুটো খোলা রাখো প্লিজ। আমি এক্ষুনি হসপিটালে নিয়ে নিয়ে যাচ্ছি তোমাকে; সিরাত লুক এট মি ড্যাম ইট!”
তবুও সিরাতের মাঝে কোনো ভাবান্তর নেই। মনে হচ্ছে ক্রমশই সে ফাইয়াজের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তবে কি আর কখনোই তার ভালোবাসাকে, ফাইয়াজকে নিজের দৃষ্টি দিয়ে দেখতে পারবে না সিরাত‌?…………….

#চলবে 🍂

#বাসন্তী_প্রেম 🌼🌼
#লেখনীতে: ইনায়াত আহসান (ছদ্মনাম)
#অষ্টবিংশ_পর্ব

ইজি চেয়ারের উপর হেলান দিয়ে বসে ছিল রূপ। হুট করে মেসেজ টোনের আওয়াজ শুনে হালকা নড়েচড়ে উঠে সে। পকেট থেকে ফোনটা বের করতেই ফোনের স্ক্রিনে ফাইয়াজের নাম্বার থেকে আসা একটা মেসেজ দৃশ্যমান হয়। মেসেজ অপশনে ক্লিক করতেই চোখ দুটো ছানাবড়া হয়ে যায় রূপের। দ্রুত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত প্রায় তিনটা বাজে। কপাল বেয়ে দুশ্চিন্তার ঘাম ঝড়তে শুরু করেছে। রুম থেকে শুধু মোবাইল ফোন নিয়ে গটগট করে বাইরে বেরিয়ে পড়ে রূপ।
কিচেনে দাঁড়িয়ে চুলোর সামনে কফির কাপ রেডি করছিল চন্দ্রিকা। ফারিহা, নিশাত কেউই ঘুমায় নি এখনো। শরীরের অবসাদ দূর করার জন্য তিন জনের জন্যেই কফির কাপ রেডি করতে দ্রুত কিচেনে এসে পড়ে সে। কিন্তু পরমুহূর্তেই রূপকে অস্থির ভাবে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে দেখে সেও এগিয়ে যায়।
– “ডক্টর রূপ আপনি এত রাতে নিচে?! কিছু প্রয়োজন ছিল?”
– “আমার হাতে সময় নেই চন্দ্রিকা, আমাকে হসপিটালে যেতে হবে!”
– “হসপিটালে? কিন্তু কেন?”
– “সিরাত এখন হসপিটালে। শরীরের অবস্থা অনেক ক্রিটিক্যাল!”
রূপের কথা শুনে চেহারার রং উড়ে যায় চন্দ্রিকার‌। ঠিক যেন বিশ্বাস করতে পারছে না সে। অবিশ্বাস্য চোখে রূপের মুখশ্রীতে তাকিয়ে অস্ফুট স্বরে বলে উঠে,
– “আ,আম্,আমিও যাবো আপনার সাথে!”
চন্দ্রিকার কথা শুনে রূপ ও মাথা নাড়িয়ে হাঁটা শুরু করে।

হসপিটালের করিডোরের সামনে অস্থির ভাবে পায়চারি করে যাচ্ছে ফাইয়াজ। চোখে মুখে সিরাতকে হারিয়ে ফেলার ভয় স্পষ্ট। হৃদয়ের গহীনে এক চাপা কষ্ট অনুভব হয় তার। তার ঠিক সামনেই চন্দ্রিকা, নিশাত, ধ্রুব বসে আছে। সিরাতের কথা শুনে সবাই দৌড়ে হসপিটালে চলে এসেছে। পাশেই অন্য কেবিনে মিসেস সাবিনা বেগম বেডে অজ্ঞান অবস্থায় শুয়ে আছেন। হাতে স্যালাইনের ক্যানেলা লাগানো। সিরাতের কথা কানে পৌঁছাতেই প্রেশার বেড়ে যায় যার ফলস্বরূপ একসময় অবস্থার অবনতি ঘটলে পাশের কেবিনেই দেয়া হয় তাকে। মিনিট খানেক পর কেবিন থেকে বেরিয়ে আসেন জাফর সাহেব। চোখে মুখে উদ্বিগ্নতা। ছেলেকে অনুভূতিশূন্য ভাবলেশহীন ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন তিনি। তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত বোধ হয় যার ফলে ধীর পায়ে ফাইয়াজের দিকে এগিয়ে যান তিনি।
হঠাৎ কাঁধে কারো স্পর্শ পেতেই কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠে ফাইয়াজ। পেছন ঘুরে তাকাতেই দৃশ্যমান হয় জাফর সাহেবের চিন্তিত মুখ।
– “মা কেমন আছে, বাবা? মায়ের জ্ঞান ফিরেছে?”
– “না এখনো জ্ঞান ফিরেনি, তবে চিন্তা করো না। ডক্টর চেকআপ করেছে, খুব তাড়াতাড়িই জ্ঞান ফিরবে।
কিন্তু সিরাত? ডক্টর কিছু বলেছে এখন অবধি?”
উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করেন জাফর সাহেব।
– “না এখনো কিছু বলে নি! এতক্ষণে তো সিরাতের কোনো আপডেট দেয়ার কথা ডক্টরের‌, কিন্তু কেউ কিছু বলছে না কেন? সিরাত ঠিক হয়ে যাবে তো বাবা? সিরাতের কিছু হবে না তো?”
বিচলিত হয়ে প্রলাপ বকে ফাইয়াজ। নিজের ছেলের এমন করুণ অবস্থা দেখে জাফর সাহেবের মনেও ধীরে ধীরে আশংকা বেড়ে চলেছে। কিছু বলতে যাবেন তার পূর্বেই কেবিন থেকে দুটো নার্স আর ডক্টর রূপ বেরিয়ে আসে। সকলের মুখই বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছে। ডক্টর রূপকে বেরিয়ে আসতে দেখামাত্র ই ফাইয়াজ দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায় তার দিকে।
– “ডক্টর রূপ, কি হয়েছে সিরাতের? ইজ এভরিথিং ওকে? আর এত দেরি হচ্ছে কেন? আমার সিরাত ঠিক আছে তো?”
রূপকে দেখে অস্থির হয়ে বলে উঠে ফাইয়াজ।
– “কাম ডাউন ফাইয়াজ, কাম ডাউন! নিজেকে স্ট্রং করো। কেননা আমি এখন যেটা বলব সেটার জন্য তোমার মেন্টালি ভাবে স্ট্রং থাকতে হবে।”
রূপের কথা শুনে ভেতরে ভেতরে ভয় পেলেও নিজেকে যথেষ্ট স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে ফাইয়াজ।
– “আমি যেটার ভয় পাচ্ছিলাম ঠিক সেটাই হয়েছে ফাইয়াজ। সিরাতের অবস্থা বেশ ক্রিটিক্যাল। মাথায় লাগা আঘাত টা বেশ গভীর। ব্লিডিং ও বন্ধ হচ্ছে না কোনোভাবে। এমন যদি চলতে থাকে তাহলে সিরাত কোমায় চলে যেতে পারে। সেটা হোক অল্প সময়ের জন্য কিংবা দীর্ঘ সময়ের জন্য। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো সিরাতের দৃষ্টিশক্তি আর কোনদিন নাও ফিরতে পারে।”
রূপের কথা শুনে পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাওয়ার মতো অবস্থা। নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করা সবচেয়ে কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। দু কদম পিছিয়ে আসতেই জাফর সাহেব তড়িঘড়ি করে ফাইয়াজকে ধরে ফেলে।
– “নিজেকে সামলাও ফাইয়াজ। আমি বলিনি যে সিরাতের ঠিক হওয়ার চান্স একদমই নেই। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করব। আমি ডক্টর জুনায়েদ এর সাথে কথা বলেছি। তিনি খুব শীঘ্রই চলে আসবেন। কিপ পেইশেন্স ফাইয়াজ।”
কিছুক্ষণ পিনপতন নীরবতা। কয়েক সেকেন্ড পরেই রূপ পুনরায় গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠে,
– “এন্ড ওয়ান মোর থিং! সিরাতের এই কন্ডিশন জেনেও আমরা একটা রিস্ক নিতে চাচ্ছি। আর সেটা হলো সিরাতের চোখের অপারেশন। আই হোপ ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড ফাইয়াজ। ইটস্ এ ভেরি ইম্পর্ট্যান্ট কেস। আর ধরতে গেলে সিরাতের লাইফের সবচেয়ে বড় রিস্ক।”
কি বলবে ফাইয়াজ? সে তো অনুভূতিহীন। তার মাঝে কোনো কথার প্রতিক্রিয়া নেই বললেই চলে। ফাইয়াজকে এমন স্থির কিংকর্তব্যবিমূঢ়‌ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছোট একটা শ্বাস ফেলে রূপ। ফাইয়াজের মনের অবস্থা বেশ ভালোই টের পাচ্ছে সে।

– “ফাইয়াজ? আর ইউ ওকে? লিসেন তুমি এভাবে ভেঙে পড়লে পরিস্থিতি আরো বিগড়ে যাবে। আর আমাদের হাতে খুব বেশি সময় ও নেই। তুমি এই ব্যাপারে সবটাই জানো। আমি জানি অনেকটা রিস্ক আছে বাট উই উইল ট্রাই আওয়ার বেস্ট! এটা সিরাতের ভালোর জন্যই হবে আই থিংক।”
রূপের কথা শুনে ফাইয়াজের ভাবমূর্তির পরিবর্তন এলো। জাফর সাহেব ও চোখের ইশারায় হ্যাঁ বোঝালেন। নিজেকে শক্ত রেখে চোখ বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে বলে উঠে,
– “ঠিক আছে, আমি রাজি! আমি রাজি এই অপারেশন এর জন্য। আমার সিরাতের যেন কিছু না হয় ডক্টর রূপ। ইটস্ এ রিকোয়েস্ট!”
কথা যেন গলায় আটকে যায় ফাইয়াজের। লাইফের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত নিতে যেন দ্বিধান্বিত হয় সে।
– “আই হোপ অলসো! আমাকে এখন যেতে হবে ফাইয়াজ। কিপ প্রে ফর সিরাত।”
বলেই গটগট করে পা বাড়ায় রূপ। ফাইয়াজ ধীর পায়ে গিয়ে কেবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। কাঁচের আবরণ ভেদ করে অস্পষ্ট ভাবে সিরাতের চেহারা বোঝা যাচ্ছে। মুখে অক্সিজেন মাস্ক, হাতে ক্যানেলা; নিস্তেজ শরীরটা বেডে পড়ে আছে। এগুলো চোখে পড়তেই নিমিষেই মন ক্ষত বিক্ষত হতে শুরু করে ফাইয়াজের।
কিছুক্ষণ পড়েই কয়েকজন নার্স আর ওয়ার্ড বয় এসে উপস্থিত হয় কেবিনে। সিরাতকে বেড থেকে স্ট্রেচারে স্থানান্তর করা হয়। ঘন ঘন শ্বাস প্রশ্বাসের দৃশ্য চোখে পড়ে মুহূর্তেই। ফাইয়াজের সামনে দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সিরাতকে অপারেশন থিয়েটারে। পিছু পিছু ফাইয়াজ সহ বাকি সবাই ও পা বাড়ায়।

অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করতেই লালঞ রঙের লাইট জ্বলে ওঠে। সাথে সাথে সবারঞ্জ নৌ দুশ্চিন্তার পরিমাণ ও ক্রমশ তীব্র হতে শুরু করে। পুরো ডক্টর লুকে কেবিন থেকে বেরিয়ে আসে রূপ। সাথে করে ডক্টর জুনায়েদ কবির ও বেরিয়ে আসেন। অপারেশন থিয়েটারে প্রবেশ করার পূর্বে থিয়েটারের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ফাইয়াজকে চোখের ইশারায় ভরসা রাখার জন্য বলে। চন্দ্রিকার দিকে তাকাতেই চন্দ্রিকাও ইশারায় অল দ্যা বেস্ট জানায় রূপকে।
রূপের থিয়েটারে প্রবেশ করার পর পর সবাই যেন ব্যস্ত হয়ে পড়ে সিরাতের সুস্থতা কামনা করার জন্য। ফারিহাও যথাসম্ভব ছুটে আসে সাবিনা বেগমের কেবিন থেকে। দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ফাইয়াজ। চোখে মুখে এক আকাশ সমান গাম্ভীর্যতা‌।
– “ফাইয়াজ?”
ধ্রুবের কন্ঠস্বর শুনে পেছনে ফিরে তাকায় ফাইয়াজ।
– “রিয়াকে পাওয়া গিয়েছে।”
ব্যাস। এটুকু কথাই ফাইয়াজের মেজাজ এবং রাগের পরিমাণকে দ্বিগুণ করার জন্য যথেষ্ট ছিল। ধ্রুবের কথায় চোয়াল শক্ত হয়ে আসে ফাইয়াজের। সাথে করে চেহারাও রক্তিম বর্ণ ধারণ করে। ধ্রুবের কথায় হালকা ভ্রু কুঁচকে নেন জাফর সাহেব।
– “রিয়াকে পাওয়া গিয়েছে মানে? রিয়া কোথায় ছিল? কি হয়েছিল রিয়ার‌?”
সন্দেহবশত জিজ্ঞেস করেন জাফর সাহেব।
– “কি ব্যাপার, কেউ কিছু বলছে না কেন? মুগ্ধ আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি! রিয়া কোথায়?”
জাফর সাহেবের প্রশ্নে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় ফাইয়াজ। চোখে রাগ স্পষ্ট।
– “কিছু হয় নি, তবে এবার হবে! আর ঠিক এমন অবস্থা হবে যাতে করে দ্বিতীয় বার এমন কিছু করার চিন্তাও যাতে মাথায় না জেঁকে বসে!”
ফাইয়াজের কথার কোনো কূলকিনারা খুঁজে পান না জাফর সাহেব।
– “কি সব বলছো মুগ্ধ? কি হবে? আর দ্বিতীয় বার কোন ভুল হবে না?”
– “সিরাতের এই অবস্থার জন্য আর কেউ না বরং রিয়া ই দায়ী। আজ ওর জন্য আমার সিরাত ভেতরে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। রিয়ানের ক্রাইম পার্টনার অন্য কেউ না বরং রিয়া। রিয়ার এমন একটা জঘন্য প্ল্যানের জন্য সিরাতের এমন অবস্থা। আমি রিয়াকে কিছুতেই ছাড়ব না।”
রিয়ার কৃতকর্মের কথা শুনে অবাক না হয়ে পারেন না জাফর সাহেব। আর তিনি তার ছেলেকে খুব ভালো করেই চিনেন যে ফাইয়াজ এমন সিরিয়াস মোমেন্টে মিথ্যে বলবে না। ফাইয়াজ পা বাড়াতে নিলেই ধ্রুব পথ রুখে দাঁড়ায় ফাইয়াজের।
– “এক মিনিট ফাইয়াজ! আমি জানি তোর রাগ করার, রিয়াকে শাস্তি দেয়ার সম্পূর্ণ অধিকার আছে। কিন্তু রিয়াকে শাস্তি দেয়ার চেয়ে তোর এখানে থাকাটা বেশি ইম্পর্ট্যান্ট। আর টেনশন করিস না, আমি সব ব্যবস্থা করেই এসেছি।
টর্চার সেলে যেভাবে রিয়া পড়ে আছে পালানোর অবস্থা রিয়ার নেই। এখন তোর সিরাতের কাছে থাকাটাই শ্রেয়।”
ধ্রুবের কথায় পা বাড়াতে গিয়েও থেমে যায় ফাইয়াজ।

প্রিয়। দু অক্ষরে গঠিত একটা শব্দ। কিন্তু এই শব্দটাই জীবনের সাথে যেন ওতোপ্রত ভাবে জড়িত। প্রিয় রং থেকে শুরু করে প্রিয় মানুষটা অবধি সবকিছুই অতুলনীয়। কিন্তু হুট করেই যদি এই প্রিয় কোনো জিনিস ক্রমশ জীবন থেকে হারিয়ে যাওয়া শুরু করে তাহলে জীবনটাই যেন ফ্যাকাশে হয়ে যেতে থাকে।

ফজরের আযানের ধ্বনি কানে পৌঁছাতেই নড়েচড়ে উঠে ফাইয়াজ। দ্রুত পায়ে বেরিয়ে পড়ে মসজিদের উদ্দেশ্যে। আজ সে তার সর্বস্ব দিয়ে হলেও নিজের প্রেয়সীকে ফিরিয়ে আনার প্রার্থনায় মনোনিবেশ করবে।
দীর্ঘ সাড়ে চার ঘন্টা পর অপারেশন থিয়েটারের লাল লাইট অফ হয়ে যায়। থিয়েটারের দরজা খোলার আওয়াজ পেয়ে তড়িঘড়ি করে উঠে দাঁড়ায় ফাইয়াজ। ডক্টর রূপ সহ বাকি ডক্টর দের মুখেও চিন্তার ছাপ স্পষ্ট।
– “ডক্টর রূপ, সবকিছু ঠিকঠাক আছে তো? সিরাত ঠিক আছে? ওর কিছু হয় নি তো?”
তবুও ডক্টর রূপের চেহারাতে চাপা দুশ্চিন্তার রেখা।
– “কি হলো ডক্টর রূপ? আই আস্ক ইউ সামথিং! ইজ এভরিথিং ওকে?”
– “অপারেশন সাকসেসফুল, ফাইয়াজ! সিরাতের চোখের অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে।”
কিছু সময়ের জন্য থমকে যায় ফাইয়াজ। কিন্তু পরক্ষণেই চোখে মুখে খুশির ঝিলিক ফুটে উঠে তার।
– “থ্যাংক গড! আমি কি একবার সিরাতকে দেখতে পারি?”
– “না ফাইয়াজ! এখনি তুমি দেখা করতে পারবে না সিরাতের সঙ্গে। অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে ঠিকই, কিন্তু,,,,,”
– “কিন্তু কি ডক্টর রূপ?”
– “অপারেশন সাকসেসফুল হলেও সিরাতকে তিনদিন আইসিইউতে অবজারভেশনে রাখা হবে। আর যদি এই ৭২ ঘন্টার মধ্যে সিরাতের জ্ঞান ফিরে আসে তাহলে তো ভালো আর যদি না ফিরে আসে তাহলে সিরাতের কোমায় যাওয়ার চান্স বেড়ে যাবে।”
নিচু কন্ঠস্বরে বলে উঠে রূপ। এদিকে রূপের কথা শুনে ঠোঁটের কোণে লেগে থাকা হাসিটুকু‌ ও উবে যায়।
– “বি স্ট্রং!”
কাঁধে হাত রেখে কোনোমতে বলে উঠে রূপ। অতঃপর সেখান থেকে দ্রুত প্রস্থান করে সে।………….

#চলবে 🍂