#বাড়ির_নাম_বৃষ্টিলেখা
#পর্ব-১৩
টুকুর অবস্থা দেখে আবির সহ বাড়ির লোক হতভম্ব। আবির ঘুমে ছিলো। আতিফ গিয়ে উঠিয়ে বলল,
“টুকু ভাই এসেছে।”
আবির ঘুমঘুম চোখে বলল, আচ্ছা।
“একা আসেনি। বাক্স প্যাটরা সহ বউ নিয়ে এসেছে।”
আবির লাফ দিয়ে উঠে বসলো। নিজেকে ধাতস্থ করতে খানিকটা সময় নিলো। বসার ঘরে টুকু আর ওর বউ বসে আছে। টুকুর হাতে একটা মিষ্টির প্যাকেট। আর বউটা জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। আবিরের মা খাওয়ার ঘরে শরবত গুলছে। চামচের টুংটাং আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। দুলু আবিরের দিকে তাকিয়ে আছে। আবির কী বলবে বুঝতে পারলো না। টুকু বেচারা ভয়ে মাথাই তুলছে না। আতিফ আবিরের পাশে এসে ফিসফিস করে বলল,
“তোমার কী মনে হয় এই বুদ্ধি টুকু ভাইয়ের মাথা থেকে বেরিয়েছে?”
আবির অবাক গলায় বলল, বৃষ্টি!
“ঠিক বলতে পারছি না। পলিনও হতে পারে।”
“পলিনের কথায় এরকম টুকু আসবে বলে মনে হয় না। এই বুদ্ধি বৃষ্টির। মিচকে শয়তান। ”
আতিফ হাসলো। ওর খুব বলতে ইচ্ছে করলো, রতনে রতন চিনে। কিন্তু চেপে গেল। বেচারা এমনিতেই একের পর এক ধাক্কা নিতে পারছে না। বৃষ্টির চিঠি হাতে পেয়ে যা কান্ড করেছে!
আতিফ যখন এসে চিঠি দিলো তখন আবির দুলুর মেয়েকে কোলে নিয়ে বসেছিল। আতিফ এসে বলল,
“এই নাও তোমার চিঠি।”
আবির বলল, কে দিয়েছে?
“একটা মেয়ে।”
আবির বুঝতে পারে নি যে চিঠি বৃষ্টি দিয়েছে। তাই বলল,
“কোন মেয়ে দিয়েছে? আর মেয়ে দিলেই বা তুই চিঠি আনবি কেন!”
“কী আশ্চর্য! তুমি ওই মেয়েকে চিঠি দিয়েছো তাই সেও দিয়েছে।”
আবির তখন বুঝলো যে চিঠি বৃষ্টি দিয়েছে। বড় বড় চোখ করে চিঠির দিকে তাকিয়ে রইলো। দুলু এসে দেখলো আবির চিঠি নিয়ে বসে আছে। আতিফের কাছে শুনলো বৃষ্টি চিঠি লিখেছে। টেনে নিয়ে সেই চিঠি পড়ে আতিফ আর দুলু হাসতে লাগলো। আবিরের অবশ্য সেই চিঠির কথাগুলো গায়ে লাগলো না। বৃষ্টি চিঠি লিখেছে সেই তো অনেক! এতো বছরে যে বরফ গলাতে পারলো না, সেই বরফ একবারে গলছে! এরচেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে!
****
পলিন উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে। বৃষ্টি নিজেও উত্তেজিত তবে পলিনের মতো টগবগিয়ে ফুটছে না। পলিন এসে বলল,
“বুবুরে কাজ হয়েছে।”
“ওই বাড়ি ডুকেছে টুকু ভাই?”
“হ্যাঁ। এই মাত্র শুনে এলাম। চম্পা কাকি খবর পেয়ে মা’কে এসে বলল।”
উল্লেখ্য, চম্পা কাকি হলো বৃষ্টিদের এলাকায় রেডিও নামে পরিচিত। সব বাড়ির সব খবর পৌছে দেয়া তার কাজ।
বৃষ্টি বলল, চল নিচে যাই। এই শোন, আমরা কিন্তু কিছু জানি না।
“না না আমরা তো টুকু ভাই কে চিনিই না।”
পলিনের কথার ধরন দেখে বৃষ্টি শব্দ করে হেসে ফেলল। তাল মিলিয়ে পলিনও হাসলো।
***
নিচে নামতেই টুকুর মা হুংকার দিয়ে বললেন,
“পলু খবরদার ওই বাড়িতে যাবি না।”
পলিন অসহায় মুখ করে বলল, ওদের সাথে ঝগড়ার পর আমি তো ওই বাড়ির দিকে চোখ তুলে তাকাই না।
ফুপু বৃষ্টিকে কিছু বলল না। বৃষ্টি জিজ্ঞেস করলো,
“কী হইছে ওই বাড়ি।”
বৃষ্টির মা চাপা গলায় বলল, আরে টুকু বউ নিয়ে আসছে।
ফুপু রক্তচক্ষু নিয়ে বৃষ্টির মা’কে বলল,
“যারে তারে বউ ডাকবা না। তুমি জানো আদৌ বিয়া হইছে কী না!”
“বিয়ে হবে না ক্যান! আবির তো ছিলো। ”
ফুপু আরও কিছু কঠিন কঠিন কথা বলতে গিয়েও থেমে গেল। দাদী এসে বললেন,
“সবাই চুপ থাকো। যে যার কাজ করো। ওই বাড়ি যা হয় হোক মাথা ঘামাবা না।”
ব্যাপার টা কিছুসময়ের জন্য মূলতবি হলো।
***
পলিন আজ স্কুলে যায় নি। অবশ্য আজ ক্লাস নেই বলে যায় নি। স্কুলের ছেলেরা অন্য স্কুলে ফুটবল খেলতে যাবে বলে স্কুল বন্ধ। পলিনের এখন খুব ইচ্ছে করছে ওই বাড়িতে যেতে। টুকু ভাইয়ের বউ বলে কথা! কিন্তু বলতে পারছে না। পলিন কে ছটফট করতে দেখে বৃষ্টি বলল,
“তোরও ওই বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে?”
পলিন লাফ দিয়ে উঠে বলল,
“তার মানে তোমারও?”
“হ্যাঁ। ”
“চলো বুবু আমরা লুকিয়ে যাই। আরেকটু পর সবাই রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকবে। তখন আমরা লুকিয়ে যাব।”
“না। মাকে বলে যাব।”
“ধূর! বড় মা রাজী হবে না।”
বৃষ্টি বলল, রাজী না হলেও যাব। আজ আমিও বৃষ্টিলেখা থেকে পলিন হয়ে যাব।
পলিন হেসে ফেলল।
***
রান্নাঘরে দুই বোন কে ঘোরাঘুরি করতে দেখে বৃষ্টির মা বলল,
“তোরা দুই বোন একটু হাতে হাতে কাজ করে দে। তোর ফুপু কাঁদছে বসে বসে। সে আজ আর এদিকে আসবে না। ”
পলিন বৃষ্টির দিকে তাকালো। বৃষ্টি পলিন কে আশ্বস্ত করে মা’কে বলল,
“মা আমরা ওই বাড়ি যাচ্ছি। টুকু ভাইয়ের বউ দেখতে।”
মা আঁতকে উঠলো। বলল, না না খবরদার। তোর বাবা, ফুপু এরা রাগ করবে।
পলিন বলল, তোমাদের রাগ তোমাদের কাছে রাখো বড় মা। টুকু ভাই তো আমাদেরই ভাই নাকি! এই বুবু চলো।
মা’কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই পলিন বৃষ্টির হাত ধরে টানলো। মায়ের ডাক শুনলোও না।
***
টুকুকে বসার ঘরেই পাওয়া গেল। ওদের দেখে টুকু হাসলো। পলিন জিজ্ঞেস করলো,
“কী টুকু ভাই কেমন আছ?”
টুকু জবাব না দিয়ে হাসলো। বৃষ্টি দুলুর ঘরের দিকে গেল। পলিনও পেছন পেছন গেল। দুলুর খাটের উপর বউ বসে আছে। ওদের দেখে দুলু বলল,
“ননদ দের শেষমেস আসা হলো তবে!”
টুকুর বউ মাথার কাপড় আরও একটু টেনে নড়েচড়ে বসলো। পলিন গিয়ে পাশে বসে বলল,
“ওমা! এতো ভারী সুন্দর দেখতে!”
মেয়েটা লজ্জা পেল। বৃষ্টি বলল,
“ভাবী আমার নাম বৃষ্টিলেখা। আর ও পলিন। টুকু ভাই আমাদের কথা হয়তো কিছু বলে নি।”
মেয়েটা এবার মুখ খুলল। বলল,
“উনি আপনাদের সবার কথাই বলছেন। আপনার কথা বেশী বলছেন। ”
পলিন মুখভার করে বলল, টুকু ভাই তো শয়তান লোক। আমার কথা বললো না!
নিলুফার একটু হেসে বলল, সবার কথাই বলছেন।
***
আবির বৃষ্টিকে দেখে বলল,
“আপদ আমার ঘাড়ে উঠিয়ে মজা দেখতে এসেছিস?”
বৃষ্টি ওর কথার জবাব না দিয়ে আবিরের মা’কে বলল,
“কাকি কী রান্না করতেছো? একটু পোলাও কোরো। নতুন বউ প্রথম খাবে।”
আবিরের মা হেসে বললেন, সব হবে। আপ্যায়নে কোনো ত্রুটি হবে না।
আবির অবাক গলায় বলল,
“তোদের বাড়ির বউ সত্যি সত্যি আমাদের ঘাড়ে চাপাচ্ছিস।”
বৃষ্টি এবারও আবিরের মা’কে বলল,
“কাকি তোমার ছেলেকে বলো যে আজ ঝগড়া করার ইচ্ছে আমার নেই। ”
আবিরের মা বললেন, তুই বললেই পারিস। তাছাড়া শুনলাম তোদের নাকি ভাব হয়ে গেছে।
দুজনেই প্রশ্ন এড়াতে দুদিকে চলে গেল।
****
বৃষ্টি আর পলিন বাড়ি ফিরলো না। পিকু, পিয়াস স্কুল থেকে ফিরলে ওদের পাঠালো ডাকার জন্য। ওরাও ফিরলো না। ওদিকে ফুপু শুরু করে দিয়েছে তার দুঃখের সাতকাহন। এই সংসারে তার কোনো গুরুত্ব নাই। আপন ভাইজিরা পর্যন্ত তাকে মানেনা। বৃষ্টির মা পড়লো বিপদে। চেঁচিয়ে নিজে কিছুক্ষন ছেলেমেয়েদের ডাকলো তাও কোনো সাড়া শব্দ নেই।
দুপুর বেলা বৃষ্টির বাবা কাকা দুজনেই সব শুনে রাগ করলেন। পলিনের বাবা বললেন,
“এক্ষুনি মেয়ে দুটোর কান ধরে নিয়ে আসো। দুটোকেই কঠিন মাইর দেয়া লাগবে। ”
বৃষ্টির মা চারদিক থেকেই বিপদে পড়লো। অগত্যা নিজেই গেল ছেলেমেয়েদের ডাকতে।
***
আবিরদের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির মা মেয়েদের ডাকলো। পলিন দরজা খুলে বলল,
“মা, বুবু দেখো বড় মা এসে গেছে।”
ঘরের মধ্যে রেনুও বসে আছে। বৃষ্টির মা রেনুকে দেখে বলল,
“রেনু তুই এখানে! ”
রেনু হেসে বলল, তোমার দস্যি মেয়ে পলিন আমাকে স্কুল থেকে ধরে নিয়ে এসেছে।
নিলুফার বৃষ্টির মা’কে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো। বৃষ্টির মা আর রেগে থাকতে পারলেন না। বললেন,
“সবাই মিলে ফন্দি করে এই বাড়ি উঠেছিস!”
আবিরের মা বলল, চিন্তা নাই। সবার রান্নাই হচ্ছে। আজ সবাই এখানেই খাবে।
“তারপর ওই বাড়ি থেকে আমাকে সহ সবাই কে বের করে দিবে।”
পলিন বলল, বড় মা আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা এখানেই থাকব। ভাবীকে যদি ওই বাড়ি না ঢুকতে দেয়া হয় তাহলে আমি আর বুবুও থেকে যাব। কী বুবু ঠিক তো!
সবার আচরণ দেখে আবির বিস্মিত না হয়ে পারছে না। সকাল থেকে ওর বুকের ভেতর ধড়াম ধড়াম আওয়াজ হচ্ছে। আগাম যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু এখানে তো চাঁদের হাট বসেছে। সবাই আনন্দ করছে।
***
বৃষ্টির মা বাড়ি ফিরে জানালো বউ এই বাড়িতেই থাকবে। বিয়ে যেমনই হোক, হয়েছে। ওই মেয়ে এখন টুকুর বউ। তাই সে এই বাড়িই থাকবে। তাছাড়া বউ আরেক বাড়ি থাকলে পাড়া প্রতিবেশী ছিঃ ছিঃ করবে। বাড়িতে ওদের নিজেদের মেয়েও আছে। তাই অন্যের মেয়ের উপর এমন অবিচার সে দেখতে পারবে না। বৃষ্টির দাদী এই কথায় সহমত হলেন। বললেন,
“বড় বউয়ের কথা ঠিক। তাছাড়া বাড়ির মেয়েদের বিয়েশাদির ব্যাপারে কেউ এলে তখন তো লোকে বলবে আমরা পিশাচ।”
বৃষ্টির বাবা কাকার হম্বিতম্বি কমলো। মায়ের কথার উপর তারা খুব একটা কথা বলেন না। তবে টুকুর মা কিছুক্ষন বিলাপ করে কেঁদে কেটে ব্যাগপত্র গুছিয়ে রওনা হলেন। তাকে আটকানোর চেষ্টা করলেও লাভ হলো না। এই প্রথম সত্যিই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলেন।
***
বউ যখন ঘরে প্রবেশ করলেন তখন বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। বৃষ্টির দাদী বললেন,
“ছোট বউ, এই মেয়ে তো সুলক্ষনা। দেখছ কেমন বৃষ্টি শুরু হইছে!”
সমস্ত ব্যাপার টায় আবির ভারী অবাক হলো। দুলুকে বলল,
“আপা তোমরা আগে থেকেই জানতে যে এরকম কিছু হবে।”
“হ্যাঁ। বৃষ্টি আর পলু আগেই জানিয়েছিল। ছোট কাকিকে নিয়ে তো চিন্তা নেই। বড় কাকিকে ম্যানেজ করা নিয়ে একটু চিন্তা ছিলো।”
আবির মুগ্ধ গলায় বলল, কাঠখোট্টা মেয়েটাও এতো কিছু ভাবতে পারে।
দুলু হেসে বলল,
“দেখলি তো ওরা কতো ভালো। তুই তো কোনোদিন কদর করলি না। শুধু দেখলেই আজেবাজে কথা বলে ক্ষেপিয়ে দিস। ”
আবির মিষ্টি করে হাসলো।
চলবে…..