বাড়ির নাম বৃষ্টিলেখা পর্ব-১৪

0
410

#বাড়ির_নাম_বৃষ্টিলেখা
#পর্ব-১৪
টুকুর মা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার পর তাকে খুঁজতে কেউ গেল না। বৃষ্টির দাদি বলেছিল যেতে। কিন্তু রেনু বারন করেছে। বলেছে, খুঁজতে যাবার দরকার নাই। দেখুন আমাদের কোনো আত্মীয়ের বাড়িতেই হয়তো আছে। ক’দিন থেকে নিজেই আসবে। খুঁজতে না গেলে একটা শিক্ষা হবে। রোজ রোজ বাড়ি ছাড়ার হুমকি তখন আর দিবে না।

রেনুর যুক্তি সবারই পছন্দ হলো। তারচেয়ে বড় কথা হচ্ছে ক’টা দিন বাড়ির বাইরে থেকে যদি মন টাও হালকা হয়।

টুকুর মা বাড়ি থেকে বেরিয়ে রিকশা নিয়ে এক আত্মীয়ের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছিল। বাড়ি অবধি রিকশা পৌছানোর পর আবার ফিরে এলো। তবে সে আর নিজের বাড়ি ফিরে যায় নি। সে উঠেছে আবিরদের বাড়িতে। এই খবর পাওয়ার পর বৃষ্টি মা’কে বলল,

“দেখো মা, ফুপু মনে মনে আমাদের বুদ্ধি পছন্দ করেছে। তাই আবার ফিরে এসেছে।”

বৃষ্টির মা বলল, আসল কথা হচ্ছে সে ভেবেছিল তাকে আটকাতে যাবে। কিন্তু কেউ যায় নি। এখন সাধতে গেলে ঠিকই আসবে।

“থাক আজকের রাত টা বাদ দাও। কাল সাধাসাধি কোরো।”

***
আতিফ সন্ধ্যেবেলা পড়াতে এসে অনেকক্ষন বসে রইলো। পলিনের কোনো খবর নেই। অনেকক্ষন পরে এসে বলল,

“আজকে আর পড়ব না। ”

“কেন?”

“আজ বাড়িতে নতুন বউ এসেছে!”

“তাতে না পড়ার সম্পর্ক কী?”

“আমার পড়ায় মন বসবে না।”

আতিফ একটু ভেবে বলল,

“তোমার না সামনে পরীক্ষা আছে।”

পলিন মুখ বাঁকিয়ে বলল, একদিন না পড়লে তাতে ক্ষতি কিছু হবে না।

“আচ্ছা।”

“আপনাকে কালও আসতে হবে না। আমি মা’কে বলছি যে কালও পড়ব না। মা রাজী হয়েছে। ”

“কাল আবার কোন বাহানায় পড়া বন্ধ করবে!”

” কাল সিনেমা দেখতে যাব। টুকু ভাই আমাদের কাল নিয়ে যাবে। ”

“আচ্ছা।”

আতিফ চলে এলো। পলিন কে পড়ানোর ব্যাপার টা শুরুতে ওর কাছে ভীষণ ই অসহ্যের লাগতো। কারণ পড়ার চেয়ে কথা বেশী বলে। তার উপর মনোযোগ দেই। ভাব করে সব বুঝে ফেলছে। কিন্তু যখন পড়া ধরা হয় তখন এক সেকেন্ড সময় না নিয়েই বলে ফেলে পারি না।

এখন পড়াতে যে ভালো লাগে ব্যাপার টা তেমন না, তবুও আজ কেমন খালি খালি লাগছে। অন্যরকম একটা অনুভূতি।

***
যদিও এখন বর্ষাকাল না তবুও বৃষ্টির সিজন শুরু হয়ে গেছে। এবার শীতের পর পর ই বৃষ্টির আমেজ পাওয়া গেল। গরমের অনুভূতি টের পাওয়ার আগেই ঢাক ঢোল বাজিয়ে বর্ষার আগমন ঘটে গেছে।

বৃষ্টির আজ কলেজে যাবার ইচ্ছে ছিলো না। তবুও যেতে হচ্ছে। সামনে পরীক্ষা আছে। দুই একটা ক্লাস না করলেই নয়। গতকাল সন্ধ্যায় বৃষ্টি দেখে ব্যাগে ছাতা নিয়ে বেরিয়েছিল৷ খানিক দূর যেতেই বৃষ্টি শুরু হলো। তাই রিকশা না নিয়ে একটা বন্ধ দোকানের আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালো। দুই এক মিনিট পর ভিজতে ভিজতে আবির এসে হাজির হলো। দৌড়ে এসেছে বলে বৃষ্টির পানি খুব একটা গায়ে লাগেনি। এসেই চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে বলল,

“মরার বৃষ্টিটা আসার আর সময় পেল না! ধুর!”

বৃষ্টি কঠিন চোখে তাকালো। আবির ওর দিকে তাকিয়ে হেসে বলল,

“তোকে বলিনি। আকাশের বৃষ্টিকে বলেছি। তুই তো আমাদের বৃষ্টি।”

বৃষ্টি বলল, আমি কী কিছু বলছি?

“তুই কিছু বলিস না এটাই তো সমস্যা।”

বৃষ্টি প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, তুমি এখানে কেন?”

“কেন এখানে থাকলে সমস্যা? তোর বিয়ে হবে না?”

বৃষ্টি চুপ করে রইলো। সিদ্ধান্ত নিলো আর কথাই বলবে না।

আবির বলল,

“বৃষ্টি শোন, তুই আসলে সূচিত্রা সেনের মতোই।”

বৃষ্টি একবার তাকালো। আবির হাসলো। বলল,

“এই কথাটা সিরিয়াসলি বলছি। সূচিত্রা সেন কেন বলেছিস জানিস? কারণ তার সঙ্গে তোর আচরনের ভালোই মিল আছে। সেও তোর মতো অভিমানী। ”

বৃষ্টি বাইরের দিকে তাকালো। কলেজে যাওয়া বাদ দিয়ে বাড়ি চলে যাবে কী না ভাবলো।

আবির আবারও বলল,

“কিরে আবারও মুখ বন্ধ করলি! তা এবার কতো বছরের জন্য? ”

বৃষ্টি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তুমি আর পলিন একই গোছের। অহেতুক কথা বলো।

“তাও ভালো। তোর মতো বোবা হবার ভান তো করি না। তোর তো কথা বলতে খুব কষ্ট। ”

“তোমার সঙ্গে আসলে কথা না বলাই ভালো ছিলো বুঝলে।”

“তা কী মনে করে হঠাৎ কথা বলতে শুরু করলি?”

বৃষ্টি থেমে গেল। আবিরের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে টা তখন থেকে এসেছে যখন থেকে বিয়ের কথা শুরু হয়েছে। তার উপর একদিন মা ডেকে বলল,

“তোকে একটা কথা বললে শুনবি! আবিরের সঙ্গে কথা টথা এবার বলিস। বয়স হয়েছে, বিয়ের কথাবার্তা চলছে। কেউ যদি শোনে যে তোরা কথা বলিস না তাহলে অন্যকিছু ভাববে।”

বৃষ্টি হেসে বলেছিল, মা শোনো তোমার সাদামাটা মেয়েকে এমনভাবে মেনে নিয়ে যে বিয়ে করবে তার কাছে মেয়ের বিয়ে দিও৷ নাহলে দিও না।

মা হেসে বলেছিল, আমার বলা আমি বললাম। তোর ইচ্ছে হলে শুনবি নাহলে না।

বৃষ্টি এরপর অনেক ভেবেছে। ভেবে শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে দূর্বলতা আসলে কাউকে বুঝতে দেয়া ঠিক না। অল্প বয়সে জেদ, অভিমানে কথা বলা বন্ধ করে ও আসলে দূর্বলতা প্রকাশ করেছে। তখনই ভেবেছিল এরপর আবির বাড়ি এলে ওর সঙ্গে কথা বলবে।

আবির বৃষ্টিকে চুপ করে থাকতে দেখে বলল,

“তুই এতো কী ভাবিস বল তো।”

“কিছু না। জিজ্ঞেস করছিলে না, কেন কথা বলা শুরু করেছি! আসলে ভাবলাম কদিন পর আমার বিয়ে হবে। যার সঙ্গে বিয়ে হবে সে যখন জানবে তোমার সঙ্গে কথা বলি না তখন হাজার টা প্রশ্ন করবে। সেই প্রশ্ন এড়াতে আর কী!”

আবির শব্দ করে হেসে ফেলল। বলল,

“তোর সঙ্গে বহুবছর কথা হয় নি তো তাই জানতাম না যে তুই এতো গুছিয়ে কথা বলিস। ”

বৃষ্টি চুপ করে রইলো। বাইরে বৃষ্টি কমেছে তবুও দুজন দাঁড়িয়ে আছে। আবির বলল,

“তোর ওই বিদেশি বিয়েটা নাকি ভেঙে গেছে?”

“হু।”

“ইশ!”

“আফসোসের কী হলো! আমি কী সেই দুঃখে মরে যাচ্ছি নাকি!”

“না তোর জন্য ওই বিয়ে একদিক থেকে ভালো হতো। আমাদের ছেড়ে অনেক দূর চলে যেতে পারতি।”

“ওহ আচ্ছা।”

আবির চুপ করে রইলো। একটু অন্যরকম গলায় বলল,

“তোর কাছে আমার একটা প্রশ্ন আছে বৃষ্টি। এই টপিকে এটাই আমার প্রথম ও শেষ প্রশ্ন। ”

“কী?”

“ধর, তোর খুব ভালো একটা ছেলের সঙ্গে বিয়ে হলো। সে তোকে খুব ভালোও বাসবে। সেই ভালোবাসাময় জীবনে আমার কথা কী তোর মনে পড়বে?”

বৃষ্টি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো। চোখ নামিয়ে নিলো সঙ্গে সঙ্গে। আবির আবারও বলল,

“পড়ন্ত বিকেলে যে সময় টা একলা থাকবি তখনও কী একবার আমাকে মনে পড়বে না!”

বৃষ্টি এখনো চুপ। আবির বলল,

“তুই কী জানিস আমার রোজকার রুটিনে সবসময় তুই থাকিস?”

বৃষ্টি জিজ্ঞাসু চোখে তাকালো। আবির বলল,

“খাওয়া, গোসল, পড়াশোনা, আড্ডাবাজি এসবের মাঝেও একটা নির্দিষ্ট সময় আমি শুধু তোর কথাই ভাবি। যত কাজ থাকুক ওই সময় টা শুধু তোর জন্য। এসব শুনে তোর কোনো রিয়াকশন হবে না জানি। তবে একটা কথা শুনে রাখ, তোর বিয়ে হয়ে গেলেও আমি শুধু তোকেই ভালোবাসব। সেটা তুই আটকাতে পারবি না।”

আবির কথাগুলো বলা শেষ করে বেরিয়ে গেল। সোজা হাটতে শুরু করলো। একবার পিছনে ফিরে তাকালোও না।

বৃষ্টি আরও কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে রিকশা নিলো। রিকশা নিতেই ফোটায় ফোটায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ওর মাথার মধ্যে কেবল আবিরের বলা কথাগুলো বাজছে। আবিরের জন্য ওর মনে কী এখনো কোনো অনুভূতি আছে! হয়তো আছে। জীবনের প্রথম ভালোলাগা৷ কারনে অকারণে সেজেগুজে আবিরের সামনে যাওয়া। মায়ের শাড়ি জড়িয়ে হাস্যকর কান্ডকারখানা করা। আরও কতো কী!

বৃষ্টি কাঁদছে। না অনুভূতি বদলায় নি। পুরোনো হয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু বদলাই। আজও সেই আগের মতো আবির সামনে এলে অন্যরকম অনুভব হয়। কিন্তু সমস্যা টা হলো পাহাড় সমান অভিমান ডিঙিয়ে ভালোবাসার খোঁজ করা কষ্টকর।

চলবে…..