বাড়ির নাম বৃষ্টিলেখা পর্ব-১৬

0
432

#বাড়ির_নাম_বৃষ্টিলেখা
#পর্ব-১৬
বৃষ্টির মায়ের সঙ্গে ছোট চাচার সম্পর্ক টা বন্ধুর মতো। সেটা হবার অনেকগুলো কারন আছে। বৃষ্টির মায়ের যখন বিয়ে হয় তখনও ছোট চাচা বেকার। পলিন তখনও ছোট। ছোট চাচা কয়েকদিন ঢাকায় চাকরি শুরু করেও আবার ফিরে এসেছে। সারাক্ষণ মন পড়ে থাকে বাড়িতে। রেনুর পড়াও তখন শেষ হয় নি। বাড়িতে উপার্জন শুধু বৃষ্টির বাবারই। বৃষ্টির মা যখন বাড়িতে এলো তখন প্রায় টানাটানির সংসার। পাতলা ডাল, শাক চচ্চড়ি, সবজি এগুলো ছিলো খাবারের মেন্যু। সংসারের এই হাল দেখে বৃষ্টির মা শ্বশুর কে বললেন,

“আব্বা এইভাবে আর কতদিন? ছোট ভাই যখন দূরে গিয়ে থাকতে পারে না তখন এখানেই কিছু করুক। ”

বাড়ির সবার প্রশ্ন, এখানে কী করবে। এখানে থেকে চাকরি বাকরির চেষ্টা যে করেনি তেমন না। কিন্তু ভাগ্য সহায় হয় নি। শেষমেস প্রস্তাব দিলো যে একটা ছোট দোকান দিয়ে নাহয় শুরু করুক। বাড়ির লোক তাতে রাজি হলেন না। এই বংশের কেউ ব্যবসা বানিজ্য এর আগে করে নি। রক্তে না থাকলে ব্যবসা বানিজ্য হয় না।

বাড়ির লোকের অনেক বারন সত্যেও বৃষ্টির মা ছোট চাচাকে দিয়ে ব্যবসা শুরু করালেন। বৃষ্টির দাদার পৈতৃক সম্পত্তি যা ছিলো তা বিক্রি করে দোকান শুরু হলো। তখনও ওরা ছোট বাড়িতে থাকে। কয়েক বছরে ছোট দোকান বড় হলো। এদিকে পাশ করে বেরোতেই রেনুর চাকরি হলো। বাড়ির কাজ শুরু হলো। সেই থেকে সংসারের কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবার সময় বৃষ্টির মা’য়ের কথাকে বেশী গুরুত্ব দেয়া হয়। ছোট চাচার সঙ্গেও বৃষ্টির মায়ের বন্ধুত্বের শুরু সেই থেকে।

আজ সকালে চা খেতে খেতে ছোট চাচা বলল,

“ভাবী নতুন বউকে গয়নাগাটি কিছু দেয়া দরকার না?”

“কিছু কেন? সবই তো দেয়া লাগবে। একবারে না পারলে আস্তে আস্তে দিতে হবে।”

“সেজন্যই বলছিলাম যে দোকানে বায়না দিয়ে আসবে কী না!”

“রেনুর যেদিন স্কুল থাকবে না সেদিন যাব।”

ছোট চাচা একটু থেমে বলল,

“মেয়েটা বোধহয় ভালো তাই না?”

বৃষ্টির মা হেসে বলল,

“আমাদের ছেলেও তো ভালো।”

“আর ভালো না হলেও হয়ে যাবে তোমাদের সঙ্গে থেকে থেকে। ”

বৃষ্টির মা মৃদু হাসলো। ছোট চাচা চা শেষ করলেন। চা খেয়েই দোকানে যাবেন। দোকানে অবশ্য দুজন কর্মচারী আছে। হাটের দিন আরও দুজন থাকে। বৃষ্টির বাবাও গিয়ে বসেন। সপ্তাহে দুদিন সকাল থেকে রাত অবধি চাপ থাকে। অন্যান্য দিন চাপ কম থাকলেও দোকানে রাত পর্যন্ত লোক আসে।

ছোট চাচা বৃষ্টির মা’কে বলল,

“শুনলাম বৃষ্টির সঙ্গে আবিরের ভাব হয়েছে?”

বৃষ্টির মা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, হ্যাঁ। মেয়েকে আমিই বলেছি যে এক যুগ আগের রাগ ধরে রাখিস না। বিয়ের সময় হাজার টা মন্দ শুনতে হবে।

“লোকে তো ভেবেছিলো বৃষ্টির সঙ্গে আবিরের বিয়ে হবে।”

বৃষ্টির মা মন খারাপ করে বলল,

“আমাদের তো তাতে আপত্তি নেই। মেয়ে না চাইলে কী করার! ”

“সেটাই। ওর উপর জোর করে কিছু চাপিয়ে দেয়ার দরকার নেই। তোমার স্বামী কে এই কথাটা বলে দিও।”

বৃষ্টির মা শব্দ করে হেসে ফেলল৷ বলল,

“সে তুমি তোমার ভাইকে বলে দিলেই তো পারো। আমার কথা যেন কতো শুনে।”

ছোট চাচা আর কথা বাড়ালেন না। বৃষ্টির বাবা যে তার প্রথম স্ত্রীর সঙ্গে মাঝেমধ্যে যোগাযোগ করে এই ব্যাপার টা তার পছন্দের না। এই ব্যাপার বাড়ির লোকও জানে। বৃষ্টির বাবা অবশ্য বলেন মেয়ের খোঁজ নিতে চিঠি লিখে। কিন্তু মেয়ে যখন নিজেই তার মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইছে না সেখানে চিঠির পিঠে চিঠি দেয়ার কী দরকার। তাও ভালো বিয়েটা আপনাআপনি ভেঙে গেছে। নাক উঁচু মহিলার মুখোমুখি তো আর হতে হয় নি।

“কী হলো এতো কী ভাবছো?”

“কিছু না। ভাবছি টিভি টা আরেকবার বাজারের দোকানে দেখাবো কী না!”

“একদম না। টিভি পেলে তোমার মেয়ে আট টা বাজতেই বই গুছিয়ে বসে থাকবে। আবির দের বাড়িতেও কিন্তু দেখছে। আমি বলছি গেলেই তাড়িয়ে দিতে। তারপরও যায়।”

“এই মেয়েটার কী গতি হবে কে জানে! ম্যাট্রিক পাশ করতে পারবে কী না! ”

“আমার যখন গতি হলো তখন ওরও হয়ে যাবে। এতো চিন্তা কোরো না তো।”

ছোট চাচা হেসে ফেললেন। বৃষ্টির মা’ও হেসে ফেলল।

****
পলিন আজ সকালে বই নিয়ে আবির দের বাড়িতে গেল। দুলুকে দেখে বলল,

“দুলু আপা আতিফ ভাই কোথায়?”

“ওর ঘরে। কী রে তুই তো হেব্বি পড়ুয়া হয়ে গেছিস!”

পলিন হাসলো। দুলু বলল,

“তোর দুলাভাই তোর কথা সেদিন জিজ্ঞেস করেছিলো!”

“দুলাভাই আসবে কবে! সেই যে মেয়েকে এক নজর দেখে গেল আর খবর নেই!”

“আসবে ছুটি পেলে। ”

“তোমার কতো কষ্ট হয় না! এইজন্যই বাড়ির আশেপাশে ছেলে দেখে বিয়ে করা উচিত।”

দুলু শব্দ করে হেসে ফেলল। বলল,

“তুই কাকে বিয়ে করবি বলতো? এই এলাকায় তো হাতে গোনা কয়েকটা ছেলে আছে। তারমধ্যে আমাদের বাড়িতে আছে দুটো। একটা অবশ্য বুকড!”

“ধ্যাৎ! আমি কথার কথা বলছি।”

দুলু হাসতে লাগলো। বলল,

“ভালোই হয়। তোরা দুই বোন আমাদের বাড়ি চলে আয়।”

পলিন লজ্জা পেল। লজ্জায় গাল লালও হয়ে গেল। দুলু হাসতে লাগলো।

****
আতিফ পড়ছিল। পলিন কে দেখে বলল,

“তুমি এখানে? স্কুল নেই?”

“আজ যাব না।”

“কেন?”

“বাড়িতে বুবু অসুস্থ। একা একা ওর খারাপ লাগবে।”

“আচ্ছা। তা বই হাতে এখানে? ”

“আপনাকে একটা কথা বলতে এসেছি।”

“আমাকে কিছু বলার জন্য বই হাতে নিয়ে আসতে হবে কেন?”

“এমনি কথা বলতে এলে কী না কী ভাববে!”

আতিফ সরু চোখে তাকালো। বলল,

“কী বলতে এসেছো?”

পলিন চুপ করে রইলো। আমতা আমতা করে বলল,

“সিনেমা দেখার কথাটা আপনি কাউকে বলবেন না। আবির ভাইকেও না।”

“কেন বলব না?”

পলিন জবাব না দিয়ে নখ খুটতে লাগলো। আতিফ বলল,

“আচ্ছা যাও এবার সুযোগ দিলাম। তবে এরপর গেলে কিন্তু বলে দেব।”

“আচ্ছা।”

আচ্ছা বলেও পলিন দাঁড়িয়ে রইলো। আতিফ বলল,

“আর কিছু বলবে?”

“হ্যাঁ। ”

“বলো।”

“আপনাকে সাদা টিশার্টে দারুন লাগে।”

কথাটা বলেই পলিন মিটিমিটি হাসতে লাগলো। আতিফ বুঝতে পারলো যে ও’কে অপ্রস্তুত করার জন্য পলিন কথাটা বলেছে। তাই ও বলল,

“জানি। এর আগেও অনেক মেয়ে বলেছে। ”

পলিনের মুখটা বেলুনের মতো চুপসে গেল। আতিফ বলল,

“এরপর থেকে কথা বলতে এলে আর বই নিয়ে আসবে না। লোকে তোমাকে আর আমাকে নিয়ে এমন ভুল ভাবনা ভাববে না। ”

পলিন মাথা নেড়ে চলে এলো।

****
বৃষ্টির কাজ শুধু শুয়ে বসে থাকা। এর বাইরে আর কিছু করার নেই। শুয়ে বসে গল্পের বই পড়ে। আর সেই সঙ্গে আছে পলিনের বকবকানি। নিলুফারও আসে মাঝেমধ্যে। তবে মেয়েটা কথা বলে কম। পলিনের সঙ্গে অবশ্য কথা বেশী বলে। বৃষ্টিকে নাকি ভয় পায় তাই কথা কম বলে।

সন্ধ্যা থেকে বিদ্যুৎ নেই। পলিন খানিকক্ষণ পড়ে এখন এসে বসে আছে। আবিরদের বারান্দায় হাসাহাসির শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। আর কারও গলার স্বর স্পষ্ট না হলেও আবিরের গলার স্বর স্পষ্ট। পলিনও গিয়ে যোগ দিয়েছে। শুরু হয়ে গেছে আবিরের সঙ্গে খুনশুটি। আবির পলিন কে বলল,

“পলু, এক বাটি মুড়ি বানিয়ে নিয়ে আয়। আমাদের মুড়ি শেষ হয়ে গেছে। ”

“বড় মা যেতে দেবে না। ”

“তাহলে কাউকে দিয়া পাঠা। মুড়ি না খেতে পেলে শুকিয়ে যাব। ”

পলিন গেল না। ওখানে দাঁড়িয়ে আবিরের সঙ্গে তর্কে ব্যস্ত। নিলুফার শুনতে পেয়ে মুড়ি বানিয়ে পিকু কে দিয়ে পাঠিয়েছে। আবির নিলুফারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। বলল,

“নিলুফার ভাবীর জন্য এখন দুই লাইন গান গাইব।”

পলিন বলল, এরপর সব কুত্তাগুলো এসে তোমাদের বাড়ির সামনে জড়ো হবে।

বৃষ্টি এতক্ষন ধরে সব শুনছিলো। না চাইতেও সব মনোযোগ ওদিকে ছিলো। আবির গান গাইতে শুরু করেছে,

“আমি কোন পথে যে চলি!
কোন কথা যে বলি!
তোমায় সামনে পেয়েও খুঁজে বেড়াই মনের চোরাগলি। ”

পলিন এসে বলল, দেখো বুবু তোমাকে শোনাচ্ছে।

বৃষ্টি সেকথায় গুরুত্ব দিলো না। ও অবাক হলো আবিরের গান শুনে। আবির তো ভালোই গায়!

আবির তখনও গাইছে,

“হয়তো মনের দরজা খুলে তুমিও ছিলে বসে।
ভেস্তে গেল সুন্দরী গো সবই কপাল দোষে!
করেছি কী ভুল, নিজেই নিজের দু’কান মলি। তোমায় সামনে পেয়েও খুঁজে বেড়াই মনের চোরাগলি। ”

চলবে….