#বাড়ির_নাম_বৃষ্টিলেখা
#পর্ব-২১
আবিরের সকাল শুরু হয়েছে বৃষ্টির লেখা চিঠি পড়ে। চিঠি পড়তে পড়তেই মুখে হাসি চলে এসেছে। একটা সুন্দর সকাল বানাতে এমন একটা চিঠিই যথেষ্ট। চায়ের আর দরকার হয় না। ইশ আরেকবার যদি আগের দিনগুলো ফিরে পাওয়া যেত। তাহলে আর বৃষ্টিকে বকাবকি করতো না। ক্রিকেট খেলার সময় বৃষ্টির এসে দাঁড়িয়ে থাকার জন্য রাগ দেখাতো না। বারবার এই সেই অজুহাতে বাড়ি এসে বসে থাকার জন্যও কিছু বলতো না। আফসোস! সেই দিনগুলো চাইলেও আর ফিরে পাওয়া যাবে না। আবির মনে মনে বলল,
“আগে যা গেছে যাক…. সামনের দিনগুলোতে তোর ওই কঠিন রাগ সহ্য করে নেব। নিজে থেকে হাত বাড়িয়ে আমার হাত না ধরিস, কিন্তু আমি ধরলে সেটাও ছাড়িয়ে নিস না প্লিজ!
***
আতিফ পড়েছে মহাবিপদে। পলিনের চিঠিঘটিত ঝামেলার পর পলিন আর ওর সঙ্গে কথা বলছে না। পড়াতে যেতে শুরু করেছে। কিন্তু ওর সঙ্গে একটাও কথা বলে নি। কিছু জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দেবার বদলে ভেংচি কাটছে। না বই বের করে পড়া শুরু করছে আর না কোনো কথা বলছে। আতিফ কিছুক্ষন বসে থেকে হতাশ হয়ে চলে এলো। আসার সময় পলিনের মায়ের সঙ্গে দেখা হলো। সে জিজ্ঞেস করলো,
“একি চলে যাচ্ছো যে? পলিন পড়বে না?”
আতিফ মিথ্যে বলল। বলল,
“আমার শরীর টা একটু খারাপ লাগছে। তাই…..
“ও তাহলে যাও। আমি ভাবলাম মেয়েটা আবারও বদমায়েশী করছে। ”
আতিফ চলে এলো। মিথ্যে না বলে উপায় কী! এই মেয়ে নিশ্চিত পাগল। ক্লাস টেনে পড়ুয়া মেয়ে যে ওভাবে ভেংচি কাটতে পারে সেটা দেখেই ও হতভম্ব।
***
বৃষ্টি সত্যিই পলিনের সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। পলিন হাজার টা কথা বললেও জবাব দিচ্ছে না। চুপচাপ নিজের কাজ করছে। পলিন খুব কান্নাকাটি করলো তাতেও কোনো কাজ হলো না। রাতে ঘুমানোর সময় মাঝখানে বিশাল বড় কোলবালিশ রাখলো। কোলবালিশ টপকানোর সাহস আর করলো না পলিন। সকাল হতেই দাদীর কাছে ছুটে গেল। দাদীকে বলতেই সে বলল,
“ঠিক হইয়া যাবে ছোট বুবু। রাগ কমলে কথা বলবে। ”
পলিন ভীত গলায় বলল, আবির ভাইয়ের কথা কী ভুলে গেছো! আমার সঙ্গেও যদি অমন করে।
“না করবে না। তুমি আর আবির কী এক! দুদিন পর ঠিক হবে।”
পলিন এরপরও চেষ্টা করলো কথা বলার কিন্তু বৃষ্টি পাত্তাই দিলো না। বাড়িতে মায়েরা ফেরার পর তাদের ধরলো। বড় মা শুনে বলল,
“ওমা এ কেমন কথা! কথা বন্ধ করেছে কেন?”
পলিন চুপসে যায়। কী করে বলবে যে বৃষ্টির চিঠি ও আবিরের কাছে বিক্রি করেছে।
পলিন ঠিকঠাক জবাব দিতে পারে না। পলিনের মা মেয়ের অবস্থা দেখে বলে,
“নিশ্চয়ই দোষ তোমার। সেজন্য কথা বলছে না। তাহলে ঠিকই আছে। আরও করো বদমায়েশী।”
কোথাও কোনো দিশা না পেয়ে পলিন ছুটে যায় নিলুফারের কাছে। নিলুফার অবশ্য পলিনের দুঃখ বুঝতে পারে। ওর হয়ে ওকালতি করতে যায় বৃষ্টির কাছে। বৃষ্টি কঠিন গলায় বলে,
“তুমি যদি ওর কথা আমার কাছে বলতে আসো তাহলে তোমার সঙ্গেও কথা বন্ধ। ”
পলিন সারাদিন না খেয়ে থাকে। অনেক সাধাসাধি করেও কিছু খাওয়ানো গেল না। তা দেখে বৃষ্টির মা বলল,
“ছোট বোন টা না খেয়ে আছে দেখেও কথা বলবি না। ওর সঙ্গেও এতো রাগ দেখাতে হবে! জানিস তো ওর একটু তাড় ছেড়া।”
বৃষ্টি স্বাভাবিক গলায় বলে, ক্ষিদে পেলে খেয়ে নিবে। এতো চিন্তার কিছু নেই।
মা আরও দুই এক কথা শুনিয়ে চলে যায়। বৃষ্টি জবাব দেয় না। অবেলায় ঘুমিয়ে যায়। ঘুম ভাঙে সন্ধ্যারও অনেক পর। নিলুফারের ডাকে ঘুম ভাঙে। নিলুফার ডেকে বলে,
“বুবু উঠবেন না? বেশী ঘুমালে রাতে ছাড়া ছাড়া ঘুম হইবে।”
বৃষ্টি ওঠে। বেশী সময় ঘুমানোর কারনে মাথা ভার লাগে। নিলুফার কে বলে,
“একটু চা করে দিতে পারবে? মাথাটা ব্যথা করছে।”
“হ্যাঁ দিচ্ছি। বুবু একটা কথা।”
“কী?”
“আপনার বোন কিন্তু এখনো না খাওয়া। বড়মামা, ছোট মামা খুব রাগারাগি করছে।”
বৃষ্টি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে,
“তোমার ঘরে? ”
“হু।”
বৃষ্টি নিলুফারের ঘরে গিয়ে বলল,
“এই ঢং শেষ হয়েছে তোর? তাহলে খেতে চল।”
পলিন শুয়ে ছিলো কাথা মুড়ি দিয়ে। লাফিয়ে উঠে বসলো। বৃষ্টি আবারও বলল,
“চল খেতে।”
পলিন আবারও কেঁদে ফেলল। বলল,
“তুমি আমাকে মারো বুবু। ”
“মারলেও কী তুই শোধরাবি?”
“আমি আর জীবনেও আবির ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলব না। ”
“মিথ্যে প্রমিস করিস না। চল এখন। ”
“না সত্যি। ”
“আচ্ছা চল। ”
পলিন উঠে দাঁড়ালো। বৃষ্টির কাছে এসে ওকে জড়িয়ে ধরলো। বৃষ্টিও ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। পলিন ভেজা গলায় বলল,
“বুবু আমি ভুল করলে আমাকে থাপ্পড়, কিল, ঘুষি যা ইচ্ছা হয় দিও। কিন্তু কথা বলা বন্ধ কোরো না। তুমি ছাড়া তো আমার আর কেউ নাইও যার সঙ্গে আমি বেহিসাবি কথাবার্তা বলব। ”
বৃষ্টি মৃদু হেসে বলল, আচ্ছা যা। এরপর ভুল করলে তোকে কঠিন মার দেব।
পলিন হেসে বলল,
“থ্যাংক ইউ।”
***
পলিন খেতে বসলো। বৃষ্টি পুরোটা সময় পাশে বসে রইলো। বৃষ্টির মা বলল,
“দেখলি তো। সারাটা দিন শুধু শুধু না খেয়ে ছিলি। ”
পলিন হাসলো।
****
রাতে ঘুমানোর সময় পলিন বলল,
“বুবু আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি ওদের দুই ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলব না। তাই ওদের দুটো চিঠি লিখব। ”
“আবার?”
“এটাই শেষবার। খুব খুব খারাপ কিছু কথা শোনাতে ইচ্ছে করছিল। এখন লিখে পাঠাব। ”
“বাদ দে।”
“নাহ! বাদ দিলে সারাক্ষণ ক্ষ্যাপাবে। তাই কিছু বলা দরকার। ”
“আচ্ছা ঠিক আছে লিখিস। ”
“তুমি একটু পৌছে দিবে। আমি ওদের সামনে যাব না।”
“আমি? আচ্ছা।”
****
পরদিন সকালে বৃষ্টি আবির দের বাড়িতে গেল। দুই ভাই ই বাড়িতে ছিলো। আবির বলল,
“সকাল সকাল গরীবের আখরায় সূচিত্রা সেনের আগমন! ”
বৃষ্টি কথা না বলে দুজনের হাতে দুটো চিঠি দিয়ে বলল,
“পলিন দিয়েছে। পড়ে জবাব লিখে দিতে বলেছে।”
***
আতিফ কে যেটা দিয়েছে সেটা ঠিক চিঠি না। একটা কাগজের এক দিকে একটা গরুর ছবি আকাঁ। গোলাপি রঙ ব্যবহার করেছে। পাশে বড় করে লেখা আতিফ। অপরদিকে একটা মানুষের ছবি আকাঁ। মানুষ না বলে অদ্ভুত জীব বলা ভালো। একটা ছেলের অবয়ব। ছেলেটার কোকড়া চুল। চুলের উপর চারটে পাখি। গায়ে কোনো জামা কাপড় নেই। মুখটা বাকাঁ। নাকটা থ্যাবড়ানো। দাঁতে কালো রঙ দেয়া। পেট টা বড়। পেটের মাঝখানে লেখা ‘আতিফ’। সবচেয়ে লজ্জার ব্যাপার হলো পেটে যে নাভি একেঁছে তার মাঝখানে আতিফ লেখা।
এছাড়া আর কিছু লেখা নেই। আতিফ কাগজ টা হাতে নিয়ে হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। বৃষ্টি অন্যদিকে তাকিয়ে আছে হাসি আড়াল করার জন্য। আতিফ নিজে দেখে সঙ্গে সঙ্গে আড়াল করে ফেলল। আবির নিজের চিঠি পড়তে ব্যস্ত তাই খেয়াল করলো না। আতিফ ঘরের দিকে গেল দ্রুত।
***
আবির কে লিখেছে,
আবির ভাই,
“আমি বুদ্ধিভ্রষ্ট একজন মহিলা। তাই ভুল করে টাকার বিনিময়ে বুবুর চিঠি তোমাকে দিয়েছি। এখন সেই চিঠি ফেরত দাও। আমিও তোমার টাকা ফেরত দিয়ে দেব। আর জীবনেও তোমার কাছ থেকে টাকা তো দূরের কথা একটা সুতাও নেব না। কারণ তোমার সঙ্গে আমি আর সম্পর্ক রাখতে চাই না। আর শোনো আমি তোমার বলদা ভাইকে চিঠি লিখি নি। আমি ফেল্টু পলিন। যদি চিঠি লিখতেই হয় তাহলে ফেল্টু কাউকেই লিখব। তোমার স্কলার ভাইকে না। আমার চিঠি ফেরত দাও। আমি টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
ইতি,
পলিন।
আবির বৃষ্টিকে দিয়ে পলিন কে লিখে পাঠালো,
স্নেহময়ী অতি প্রিয় পলিন,
আজ সকালে আবিষ্কার করলাম যে তুই অতি ভালো মেয়ে। একবার একটা বইয়ে পড়েছিলাম যে ‘প’ দিয়ে যেসব নাম শুরু হয় তারা দুনিয়ার সবচেয়ে ভালো মেয়ে। আজ তোকে দেখে প্রমাণ পেলাম। তুই যে সূচিত্রা সেন কে লুকিয়ে চিঠি দিয়েছিস সেটা বুঝতে পারি নি। মুখ ফসকে বলে ফেলেছি। তুই রাগ করিস না। আমিতো তোর দূরের কেউ না। এভাবে কথা না বলে থাকিস না। আর হ্যাঁ একশ না, তোকে পাঁচশ টাকা পুরস্কার দেয়া উচিত। হাতে টাকা এলে সঙ্গে সঙ্গে দিয়ে দেব। সবশেষে একটা কথাই বলতে চাই, তোর মতো মেয়ে হয় না। এইরকম ভালো মেয়ে কোথাও দেখিনি। আমার সাধ্য থাকলে তোকে নিয়ে একটা জাতীয় সঙ্গীত বানাতাম।
‘এমন মেয়ে কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি!
বিশ্বসেরা মেয়ে সে যে আমাদের পলিন রানী।”
ইতি তোর অতিভক্ত
আবির ভাই।
পুনশ্চ: ফেল করাও একটা আর্ট।
এই চিঠি পড়ে পলিন আবারও একটা চিঠি পাঠালো বৃষ্টির হাতে। সেখানে লিখলো,
“আমাকে টাকার গরম দেখাবে না। তোমাদের বাড়ির পাশে যে বৃষ্টিলেখা বাড়িটা আছে সেটা দেখেই আন্দাজ করা উচিত যে আমাদেরও টাকা আছে। আমরা চৌধুরী না হতে পারি কিন্তু আমাদেরও টাকা আছে। কিন্তু আমরা কাউকে কেনার চেষ্টা করি না। আমার চিঠি ফেরত দাও। তোমার টাকার দরকার নেই আমার।
পুনশ্চঃ আমাদের বাড়িটা তোমাদের থেকে বড়। বাড়িতে মানুষ ও বেশী। এতেই বোঝা উচিত আমাদের কতো টাকা।
আবির এই চিঠির জবাব দিলো,
মাননীয়া পলিন বেগম,
আমরা অতি দরিদ্র। দিন আনি দিন খাই। বৃষ্টি, বাদলে এখন আনতেও পারি না, খাইতেও পারি না। সেজন্য সকালে আপনার চিঠিটা ভর্তা বানিয়ে খেয়ে ফেলছি। এরজন্য মার্জনা করুন। আমরা আসলে খুবই গরীব।
আর হ্যাঁ, এতো ভালো পোস্টমাস্টার কে দিয়ে বারবার চিঠি পাঠানোর জন্য আপনাকে বিয়েতে একখানা রোস্ট বেশী দেয়া হবে মাননীয়া৷ আপনার জন্য আলাদা করে পাকিস্তানি মুরগির রোস্টের ব্যবস্থা করা হবে। আমরা গরীব হতে পারি কিন্তু ঋন শোধ করতে ভুলি না।
ইতি,
অট্টালিকায় থাকা পলিন বেগমের বাড়ির পাশের কুঁড়েঘরে থাকা আবির।
চলবে…..