বাড়ির নাম বৃষ্টিলেখা পর্ব-২২

0
488

#বাড়ির_নাম_বৃষ্টিলেখা
#পর্ব-২২
পুরো ঘটনায় বৃষ্টি খুব মজা পাচ্ছে। মুখে হাসি লেগেই আছে। একজনের চিঠি আরেকজনের কাছে পৌছে দিয়ে জবাবের জন্য অপেক্ষাও করছে। আবির বৃষ্টিকে বলল,

“তোকে তো দেখে তো মনে হচ্ছে আনন্দে ভাসছিস!”

“হ্যাঁ। খুউউব। ”

“খুউউব আনন্দের কারণ টা কী? আমার আর পলিনের কথা চালাচালি বন্ধ হয়েছে তাই?”

“হ্যাঁ। ”

“এতে তোর লাভ কী?”

“লাভ এই যে, তোমার ডিটেক্টিভ গিরি বন্ধ হয়ে যাবে। সারাক্ষণ আমার পিছনে লেগে থাকাও বন্ধ হবে।”

“ওহ আচ্ছা! এই ব্যাপার! তোর কী মনে হয় আমি আর ডিটেক্টিভ গিরি করতে পারব না? আমাকে এখনো চিনিস নি? সোজা বাড়িতে চলে যাব। ”

বৃষ্টি হেসে বলল, সে যেতেই পারো, আমরা তো আর আটকাবো না। কিন্তু পলিনকে ঘুষ দিয়ে কথা কেনা তো বন্ধ হলো।

“এসব আসলে তোর বুদ্ধি! পলিনের এতো প্যাচ নেই মনে। কথা না বলতে দেয়ার বুদ্ধি তোর।”

“তোমার যা ভাবার ভেবে নাও। আমার কোনো সমস্যা নেই। এবার আতিফ কে ডাকো। ”

“আমার ছোট ভাইটার কাছে আবার তোর কী কাজ?”

“পলু আতিফ কে চিঠি লিখেছে। আতিফ এখনো জবাব দেয় নি।”

আবিরের খেয়াল হলো যে বৃষ্টি প্রথমবার যখন এসেছিলো তখন আতিফ কেও একটা চিঠি দিয়েছিলো।

আবির আতিফ কে নাম ধরে ডাকাডাকি শুরু করলো। বেচারা পলিনের চিঠি পেয়ে একদম মুষড়ে পড়েছে। আতিফ এসে বলল,

“আবার আমায় ডাকছো কেন?”

আবির কিছু বলার আগেই বৃষ্টি ভালো মানুষের মতো মুখ বানিয়ে বলল,

“এই তোকে পলু চিঠি লিখেছে। জবাব লিখেছিস?”

আতিফ একবার বৃষ্টির দিকে তাকালো আরেকবার আবিরের দিকে তাকালো। আবির বলল,

“কী লিখেছে রে? প্রেমপত্র? প্রেমপত্র হলে এতো ভেঙে পড়ার কিছু নেই। ছোট্ট মেয়ে লিখতেই পারে। ”

বৃষ্টি অবাক হবার ভান করে বলল,

“প্রেমপত্র লিখেছে? কী বলিস!”

আবির বৃষ্টির দিকে কঠিন দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

“ভং ধরবি না। সব চিঠি তুই আগে পড়েছিস। তোর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে।”

“কিন্তু আতিফের চিঠি পড়তে পারিনি। পলু যে কী লিখেছে বুঝতেই পারিনি। ”

আতিফ বেচারা বৃষ্টির দিকে অসহায় চোখে তাকালো।

আবির বুঝলো একটা কিছু গন্ডগোল আছে। আবির আতিফ কে বলল,

“যা চিঠি নিয়ে আয়। ”

আতিফ বলল, চিঠি নেই। ফেলে দিয়েছি।

“যেখানে ফেলেছিস সেখান থেকে নিয়ে আয়। ”

আতিফ গেল না। এতক্ষন দাঁড়িয়ে ছিলো। এবার বসে পড়লো। বৃষ্টি শব্দ করে হেসে ফেলল। আবির আতিফ কে কিছু না বলে চিঠি খুঁজতে গেল। আবির যেতেই আতিফ বৃষ্টিকে বলল,

“বুবু তুমি শুধু শুধু আমাকে কেস খাওয়াচ্ছো কেন!”

“তোকে কেস খাওয়াতে ভালোই লাগছে রে। ”

আবির চিঠি খুঁজে পেয়ে আর্তনাদ করে উঠলো৷ ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বলল,

“এটা কী?”

আতিফ কপালে হাত দিয়ে বসে রইলো। বৃষ্টি হাসছে। আবিরের মা রান্নাঘরে ছিলো। ছুটে এসে বলল,

“দেখো দেখো এটা নাকি তোমার ছেলে!”

আবিরের মা কাগজ হাতে নিয়ে হাসতে লাগলো। বৃষ্টিও হাসছে। আতিফ চুপচাপ বসে আছে। আবিরের মা বলল,

“মাথার উপর চারটা পাখি দিছে, চারটা ডিম কেন দিলো না!”

আতিফ উঠে ঘরে চলে গেল। বৃষ্টি তখনও হাসছে।

আবির বৃষ্টিকে বলল,

“তোর বড়লোক বোন কে বল চিঠির জবাব পরে পাঠাবে। আগে নিজের নতুন চেহারা আমার ভাইটাকে হজম করতে দে। ”

বৃষ্টি আবির দের ঘর থেকে বেরিয়ে যাবে এমন সময় আবির ডেকে বলল,

“এই শোন, পলিনের সঙ্গে থেকে তোর কিন্তু ভালোই উন্নতি হয়েছে। ”

“কী উন্নতি?”

“আজ দেখতে পেলাম যে তোর বত্রিশ টা দাঁত আছে। আমি এতোদিন ভেবেছি তোর দাঁত নাই তাই হাসিস না। ”

বৃষ্টি জবাব না দিয়ে হাটা শুরু করলো। আবির আবারও বলল,

“এই দাঁড়া, আমার কথা এখনো শেষ হয় নি। তুই কী লক্ষ্য করেছিস যে তোর কাঠখোট্টা ভাব অনেক টা কমে গেছে। ”

“আমি আগেও যেমন ছিলাম এখনো তেমন আছি। নিজের চরকায় তেল দাও।”

“আচ্ছা সে দেব। এখন বিশ টাকা নিয়ে যা।”

“কিসের টাকা? ”

“পিওনের কাজ করছিস আর টাকা নিবি না? এবার বিশ টাকা নে। পরে আরও বাড়িয়ে দেব। ”

বৃষ্টি আর কোনো কথা না বলে হনহন করে চলে গেল।

****
পলিনের আঁকা আতিফের ছবি পলিনদের বাড়ির সবাই দেখলো। আবিরের মা নিজেই এনে সবাই কে দেখিয়েছে। পলিনের করিতকর্মা দেখে সবাই হেসেছে। আর এদিকে আতিফ কিছু না করেই হাসির পাত্র হয়েছে। বেচারা আপাতত চুপচাপ আছে। ও বুঝতেই পারছে না যে ওর দোষ টা ঠিক কোন জায়গায়। চিঠি দেয়ার কাজ টা প্রথম তো পলিন নিজেই শুরু করেছে। আগ বাড়িয়ে ও তো কিছু বলতে যায় নি। এখন ও’কে যে দেখছে সেই হাসছে। পিকু, পিয়াস আবার ও’কে দেখতেও এসেছিলো, সত্যিই ওর চেহারা আঁকা ছবির মতো হয়েছে কী না! মাথার উপর যে পাখিগুলো ছিলো সেগুলো আছে কী না!

আতিফের মাঝেমধ্যে আবিরের মতো হতে ইচ্ছে করে। ওর জায়গায় আবির থাকলে কঠিন কিছু কথা শুনিয়ে আসতো। কিন্তু ও এসব পারবে না। ভালো ছেলের তকমা গায়ে লাগানো যে! তাই হজম করা ছাড়া উপায় নেই।

আজ আর পলিন কে পড়াতেও যায় নি। কে জানে সেখানে কী অপেক্ষা করছে ওর জন্য!

রাতে দুই ভাই খেতে বসেছে। আবিরের মা আতিফ কে জিজ্ঞেস করলো,

“ডিম দিয়ে বেগুন রান্না করেছি। তুই কী খাবি? মুরগির ডিম কিন্তু পাখির ডিম না। ”

আতিফ দীর্ঘ শ্বাস ফেলে ভাইয়ের দিকে তাকালো। আবির গম্ভীর গলায় বলল,

“এসব কী মা? পরের বাড়ির মেয়ের সঙ্গে তুমিও তাল দিচ্ছো!”

আবিরের মা হাসতে লাগলো। আতিফ চুপচাপ খেয়ে নিলো। খাওয়া শেষে আবিরের কাছে গিয়ে বলল,

“ভাইয়া, এই মেয়েটার কী ব্যবস্থা করা যায় বলোতো?”

“কোনো ব্যবস্থা নিতে হবে না। ব্যবস্থা নিতে গেলেই জ্বালাবে।”

“তাহলে কী বসে বসে এসব সহ্য করব!”

“কী আর করবি? তোর ছাত্রী, একটু তো সহ্য করবিই। ”

বুবু যদি তোমার সঙ্গে এমন করতো তাহলে তুমি চুপচাপ বসে থাকতে?”

“মোটেও না। খুশিতে সকাল, বিকাল তিনবার লাফাতাম। ”

আতিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

“তাহলে আমাকে কেন চুপ করে থাকতে বলছো?”

“পলিন আর বৃষ্টি কী এক? এই তুই আগে বল পলিন কে তুই কী চোখে দেখিস?”

আতিফ থতমত খেল। বলল, কোনো চোখে দেখি না। তাকালেই তো ভেংচি কাটে।

এই প্রথম আবির শব্দ করে হেসে ফেলল। আবির বলল,

“আচ্ছা কী করতে চাইছিস বল। ”

“ওর চিঠির জবাব পাঠাব। তুমি লিখে দাও। কী কী লিখতে হবে আমি বলছি। ”

***
পরের দুদিন আবির পলিনের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও পারলো না। পলিন ফিরেও তাকাচ্ছে না। মুখে আঠা লাগিয়ে রেখেছে এমন ভাব। আবির অবশ্য অনেক চেষ্টা করেছে। বিভিন্ন ধরনের লোভ দেখাতে শুরু করেছে কিন্তু কাজ হচ্ছে না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে সমানে পলিন বেগম, পলিন বেগম করে চেচাচ্ছে তাও জবাব দিচ্ছে না। শেষমেস বৃষ্টি এসে বলল,

“পলিন কথা বলবে না। ”

আবির বলল,

“পলিন তোর চামচামি করে খুব ভুল করছে। ”

“ভাষা ঠিক করো, ও আমার ছোট বোন। ”

“আচ্ছা এখন থেকে ব্যকরনের ভাষায় বলিব কথা আপনার সঙ্গে। ”

বৃষ্টি চলে গেল। আবির আরও কিছুক্ষন খাবারের লোভ দেখিয়ে হাল ছেড়ে দিলো।

***
পলিনের স্কুল শুরু হয়েছে আরও দুদিন আগে। ও যায় নি। আজ থেকে স্কুলে যেতে শুরু করেছে। স্কুল থেকে ফেরার পর বৃষ্টি বলল,

“তোর চিঠি আছে৷ ”

পলিন বুঝতে পারলো কে পাঠিয়েছে। জিজ্ঞেস করলো,

“কী লিখেছে?”

“পড়ে দেখ। ”

পলিন দুটো চিঠি পেল।

প্রথম টা আতিফ দিয়েছে। ওর মতোই অভিনব পদ্ধতিতে জবাব পাঠিয়েছে। কাগজে একটা মেয়ের অবয়ব। মেয়েটা শাড়ি পরা। কোলে একটা বাচ্চা। পাশে আরও তিনটা দাঁড়ানো। ছোট থেকে বড় পর্যায় ক্রমে দাঁড়ানো। মেয়েটা দেখতে খবিশ টাইপ। নাক টা অনেক বড়। চোয়ালও বড়। মাথার চুলগুলো শাকচুন্নীদের মতো। চুলে সবুজ রং করা। কানের সাইজও বড়। পাশেই ছোট করে লেখা, বাংলা সিনেমার হারিয়ে যাওয়া ভিলেন পলিন বেগম।

পলিন চিঠি দেখে বজ্রাহত হলো। আতিফ এটা কিছুতেই পাঠায় নি। এটা নিশ্চয়ই আবিরের কাজ।

এবার আবিরের চিঠি খুলল৷ চিঠিতে লেখা,

শ্রদ্ধেয়া পয়সাওয়ালা মহিলা, (ওরফে অতি প্রিয় পলিন)

পত্রের শুরুতে এক বিঘা জমিতে চাষ হওয়া গোলাপ বাগানের সমস্ত গোলাপের শুভেচ্ছা। তুই যে তোর বোনের পথে হাটছিস ব্যপার টা সুবিধার না। তোর বোন মৌনবাসে(বনবাসের সঙ্গে মিলিয়ে মৌনবাস) গিয়ে যে খুব কষ্ট পেয়েছে সেটা কিন্তু স্বীকার করেছে। তাই তুই এই ভুল করিস না। তাছাড়া তোর মতো ভালো মেয়েকে এসব মানায় না। তুই অসম্ভব ভালো একটা মেয়ে। তোর মতো ভালো মেয়ে পাওয়া মুশকিল। কিন্তু তুই আমার বোকাসোকা ভাইয়ের এসব কী ছবি এঁকেছিস! আমরা যে গরীব সেটা এভাবে প্রমাণ করার কী দরকার ছিলো! আমরা তো এমনিতেই কুঁড়েঘরে থাকি। তোদের বাড়ির দিকে হা হয়ে তাকিয়ে থাকি যে কবে একটু ভালো, মন্দ খাবার পাঠাবি।

এবার আসল কথা শোন, তোর কাছে আমি অপরাধী। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করব। তোর নামে আমি পল মহল বানাবো। সম্রাট শাহজাহান তার স্ত্রী মমতাজের জন্য তাজ মহল বানিয়েছে আর আমি তোর জন্য বানাবো পল মহল। সেখানে তুই রানীর মতো থাকবি। তোর দাসী থাকবে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির কিছু নায়িকা। শাবানাকে রাখব না। ওঁ সারাদিন ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদবে। তাছাড়া ওঁকে রাখতে গেলে জসিমকেও রাখতে হবে। বিরাট কেলেঙ্কারির ব্যাপার স্যাপার। যাইহোক পল মহলে সিনেমা দেখারও ব্যবস্থা থাকবে। চিন্তা করিস না। আমি কিন্তু পল মহলের জন্য সিরিয়াস। আজই দুটো টাকা জমিয়েছি। এভাবে জমালে খুব বেশী সময় লাগবে না।

আর শোন, আতিফের হয়ে তোর একটা ছবি আমি এঁকে দিয়েছি। ভালোই হয়েছে তাই না?

ইতি
ভবিষ্যৎ পল মহলের প্রতিষ্ঠাতা আবির।

পুনশ্চঃ তোর বোন যে দিন দিন তোর ফর্মে চলে যাচ্ছে জানিস? এই জন্য হলেও তোর জন্য একটা সমুদ্র কেনা দরকার। মাঝেমধ্যে সেখানে হাত, পা ধুতে পারবি।

চলবে…..