#বাড়ির_নাম_বৃষ্টিলেখা
#পর্ব-২৩
আবির আর পলিনের চিঠি চালাচালি আপাতত বন্ধ হলো। বৃষ্টিই পলিন কে বারন করলো। এমনকি আতিফ কে বিরক্ত করতেও বারন করা হলো পলিন কে। পলিন তাই চুপচাপ আছে। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ঘটনা হচ্ছে পলিন এবার অংকে পাশ করেছে। উনচল্লিশ পেয়েছে। তাতে করে আতিফের দাম বাড়িতে আরও বেড়ে গেছে। বৃষ্টির বাবা রেনুকে ডেকে বলেছে, মাত্র ক’দিনেই তোমার মেয়ের এই উন্নতি দেখছো! এভাবে পড়ালে ম্যাট্রিক পাশ করবে। তোমার মেয়েকে শয়তানি করতে মানা করো।
কিন্তু আতিফ সেই চিঠি ঘটনার পর আর পড়াতে আসছে না। বৃষ্টির মা একদিন গিয়ে বলেছিল,
“বাবা রাগ করিস না। মেয়েটা পাগল। উল্টাপাল্টা কাজ করাই ওর স্বভাব। ওর উপর রেগে থাকিস না। ”
আতিফ স্বভাবসুলভ আমতা আমতা করে বলল,
“না আসলে রেগে নেই….
“তাহলে আমাদের উপর রেগে আছিস! আমরা হাসাহাসি করেছি তাই রেগে আছিস। ”
“না কাকি সেরকম কিছু না। ”
“তাহলে পড়াতে যাবি কিন্তু। ”
“আচ্ছা। ”
আচ্ছা বলার পরও আতিফের কোনো খোঁজ নেই। শেষমেস রেনু পলিন কে যেতে বলল। পলিন কে বলল,
“তুমি অন্যায় করেছো। তুমিই যাও। গিয়ে বলবে এমন ভুল আর করবে না। ”
পলিন প্রথমে রাজী হলো না। বলল,
“আমি ব্যাচে পড়ব। তাতেই হবে। ”
“এতকাল ব্যাচে পড়ে কিছু হয় নি পলিন। তুমি আতিফের কাছে ক্ষমা চাও। ভুল করে ক্ষমা চাইলে কেউ ছোট হয় না। ”
অগত্যা পলিন কে যেতে হলো। পলিন কে দেখে আতিফ বলল,
“আবার কী নিয়ে এসেছো?”
পলিন বলল,
“আপনি আর পড়াতে যাবেন না?”
“বোধ হয় না। ”
“আপনি শুনেছেন আমি এবার অংকে পাশ করেছি। ”
“শুনেছি। মাত্র একচল্লিশ মার্কের জন্য তুমি লেটার মার্ক পাও নি। ”
“আপনি আমার সঙ্গে রসিকতা করছেন?”
“তোমার সঙ্গে কী রসিকতা করা যায়?”
পলিন চুপ করে রইলো। কয়েক সেকেন্ড পর বলল,
“ওই চিঠিগুলোর জন্য স্যরি। আর আপনাকে কোনো প্রকার চিঠি লিখব না। ”
আতিফ সরু চোখে তাকালো। বলল,
“কী বলছো! সব চিঠি তুমিই লিখেছো! আমার তো বিশ্বাস ই হয় না। তুমি তো ভালো ঘরের মেয়ে। তাছাড়া তোমার জন্য রাস্তায় শত শত ছেলেরা দাঁড়িয়ে থাকে। ”
পলিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“শত শত বলিনি। বলছি কয়েকজন। ”
“আচ্ছা।”
“শুনুন আপনি যেমন ভাবছেন তেমন কিছু না। ”
“আমি কী ভাবছি?”
পলিন রেগে গিয়ে বলল,
“আপনি আসলে একটা মিচকে শয়তান। আবির ভাইয়ের চেয়েও খারাপ। ”
আতিফ হেসে ফেলল। আতিফ কে হাসতে দেখে পলিন খানিকটা অবাক হলো। আতিফ হাসি থামিয়ে বলল,
“বললে না তো আমি কী ভাবছি?”
পলিন চোখ নামিয়ে নিলো। বলল,
“আমার কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নেই। আমি আসলে আপনাকে ক্ষ্যাপানোর জন্য চিঠি লিখছিলাম। ”
“আমাকে ক্ষ্যাপানোর দরকার টা কী? আমি কী এমন করেছি?”
আতিফের প্রশ্নবাণে জর্জরিত পলিন একবার বলতে চাইলো যে,
তোর পড়াতে যাবার দরকার নেই গাধা।
কিন্তু সেটা বলা সম্ভব না। পলিন কিছু সময় চুপ করে থেকে বলল,
“কী করলে এই বান্দীকে আপনি ক্ষমা করে পড়াতে যাবেন বলেন? আপনার পায়ে ধরতে হবে?”
আতিফ পলিনের দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় বলল,
“তোমার মাথা যে ঠিক হয়েছে সেটা কনফার্ম করলেই পড়াতে যাব। ”
পলিন কোনো কথা না বলে আবিরের ঘর থেকে কাগজ, কলম এনে সেখানে লিখলো,
“আমি পলিন। সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে লিখছি যে আমার মাথা একদম ঠিক হয়েছে। রোজ পড়ার আগে মাথায় এক ছটাক তিব্বত কদুর তেল দিয়ে নেব। আল্লাহর রহমতে কোনো সমস্যা হবে না। ”
কাগজ টা আতিফ কে দিলো। আতিফ একবার চোখ বুলিয়ে বলল,
“এখন বাড়িতে যাও। সন্ধ্যেবেলা যাব পড়াতে। ”
পলিন চলে এলো। রাগ করে আবিরের মায়ের দেয়া আমের আচারও খেল না। বাড়ি এসে নিলুফার কে বলল,
“বিয়ে করে তুমি মহা শান্তিতে আছো। আমার মতো পড়াশোনা নিয়ে এতো ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে না। ভালো ছাত্রদের কথা শুনতে হচ্ছে না। ”
নিলুফার হেসে বলল,
“তোমার জন্য আমি সবসময় একটা দোয়াই করি। তুমি জীবনেও বড় না হও। আর তোমার যেন একটা পাগল ছেলের সঙ্গেই বিয়ে হয়। তা না হলে এই পাগলামী হারিয়ে যাবে। ”
“ফজরের নামাজ পড়ে আমার জন্য দোয়া করবে আমার যেন জীবনেও পাশের বাড়ি বিয়ে না হয়। আর পড়াশোনায় ভালো এমন ছেলের সঙ্গেও বিয়ে না হয়। মেছো, গেছো হলেও চলবে। কারণ আমি তো ফেল্টুস। ”
নিলুফার হাসতে লাগলো।
***
বাড়িতে সব ঠিকঠাক চলছিলো। নিলুফার এখন আর শাশুড়ীর সঙ্গে খাতির জমাতে যায় না। অনেক টা দূরে দূরে থাকে। তবে এতে আবার টুকুর মায়ের সমস্যা দেখা দিয়েছে। সে সুযোগ পেলেই বলে, নাটক শ্যাষ হইছে। আমারে হাত করার চেষ্টা কইরা বুঝছে যে কাজ হইবে না। এখন দূরে গেছে।
তবে বাড়ির অন্যরা নিলুফার কে মাথায় করে রাখে। দাদীর সুপুরি কাটার দায়িত্বটুকু নিলুফার আনন্দ নিয়েই করে। তাছাড়া ঘরের অন্য কাজও হাতে হাতে করে দেয়। বৃষ্টি আর পলিনের সঙ্গেও সম্পর্ক বন্ধুর মতোই। সমস্যা শুধু ওই এক জায়গায়ই।
এই সমস্যা আরও প্রকট হলো যখন টুকু পাকাপাকি ভাবে বাড়িতে থাকার সিদ্ধান্ত নিলো। টুকু জানালো ঢাকায় তার সমস্যা হচ্ছে। তাই বাড়িতে থাকবে। ছোট মামার দোকানে আপাতত কাজ করবে। কর্মচারী একজন কমিয়ে ও’কে যেন রাখা হয়। টুকুর মা সেই ব্যাপার টা ভালো চোখে দেখলো না। কিন্তু টুকুর মামারা সমর্থন করলো। টুকুর মা আর মামার সঙ্গে এক দফা ঝগড়াও হলো।
রেগে গিয়ে বৃষ্টির বাবা টুকুকে বলল, এই তুই দুই মাসের মধ্যে এই বুড়া শয়তান(টুকুর মা) টা’কে নিয়া বের হয়ে যা। রোজ রোজ ঝগড়া, ঝামেলা ভালো লাগে না। এই বাড়িতে ও ছাড়া আর কেউ ঝগড়া করে না। ও গেলেই শান্তি। টুকুর মা এই ব্যাপার নিয়ে খুব কান্নাকাটি করলেন। তবে বিশেষ পাত্তা পেলেন না।
***
বৃষ্টি আজ কলেজে গিয়েছিলো। কলেজ থেকে বেরোতেই দেখলো আবির দাঁড়িয়ে। আবির কে দেখে বলল,
“তুমি এখানে? ”
আবির অবাক হবার ভান করে বলল,
“কী ব্যাপার বিরক্ত হলি না যে আজ?”
বৃষ্টি বলল,
“তুমি এখানে কেন?”
“তোর জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম। বাড়ি ফিরে সোজা এখানে এসেছি। তুই তো দেখছি পড়াশোনায় ভালোই সিরিয়াস। ”
“আমার সঙ্গে তোমার কী কাজ?”
“কথা আছে। চল কোথাও বসি। চা খাবি?”
“না। বাড়ি যাব। ”
“এমন ভাব করছিস যেন চা খাইয়ে তোকে মেরে ফেলব। মারার হলে অনেক আগেই মারতাম। ”
“রাস্তায় দাঁড়িয়ে উল্টাপাল্টা কথা বলবে না। ”
“বাড়িতে বসে বললেও তো রেগে যাস। ”
“তুমি থাকো তাহলে। আমি গেলাম। ”
আবির বৃষ্টির পেছনে পেছনে হাটতে হাটতে বলল,
“এই শোন, তোকে দুটো দুঃসংবাদ দেবার আছে। তাই আগে একটু কথা বলে নিচ্ছি। ”
বৃষ্টি ভীত গলায় বলল,
“কী দুঃসংবাদ? ”
“প্রথম টা হলো। আমার একটা চাকরি হয়েছে। পাশের জেলাতেই। ব্যাংকে। ”
বৃষ্টি মৃদু হেসে বলল, বাহ! এটা তো ভালো খবর!
“তুই খুশি হইছিস?”
“দুঃখ পাবার মতো ঘটনা তো না। ”
“পরের টা দুঃখ পাবার মতো। ”
বৃষ্টি এবার আর সিরিয়াসলি নিলো না। বলল,
“বলে ফেলো। ”
“এবার আমি মা’কে তোদের বাড়ি পাঠাবো। ”
বৃষ্টি বুঝতে পেরেও জিজ্ঞেস করলো,
“কেন?”
“বুঝেও না বোঝার ভান করিস না। ”
বৃষ্টি শান্ত গলায় বলল,
“তুমি এই কাজ করবে না দয়া করে। ”
“সোজা সাপ্টা জবাব দে, এক্ষুনি বিয়ে করতে চাইছিস না নাকি আমাকে বিয়ে করবি না। ”
বৃষ্টি জবাব দিলো না। হাটার গতি কমিয়ে দিয়েছে দুজনই।
আবিরও শান্ত গলায় বলল,
“জবাব দিয়ে যা বৃষ্টি। ”
বৃষ্টি জবাব দিলো না। আবির বলল,
“বেশ! আমি কিন্তু এই টপিকে আর কথা বলব না। তুই তোর সিদ্ধান্ত জানাবি। ”
বৃষ্টি কোনো কথা বলল না। আবির বলল,
“আর হাটতে হবে না। দাঁড়া রিকশা ডেকে দেই। ”
আবির রিকশা ডাকলো। বৃষ্টি রিকশায় উঠে এক পাশে সরে বসলো। আবির হেসে বলল,
“না তুই যা।”
এই পুরো সময়টা বৃষ্টি চুপ করে রইলো। রিকশা চলতে শুরু করলো। আবির দাঁড়িয়ে আছে। বৃষ্টি পেছনে ফিরে তাকালো। কেন যেন মনে হচ্ছে আবির কাঁদছে। এই ছেলেটা এর আগেও ওর জন্য কেঁদেছে। ঢাকায় পড়তে যাবার সময় ওদের বাড়িতে এসেছিলো। মায়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে হঠাৎই কেঁদে ফেলল। বৃষ্টি রিকশাওয়ালাকে বলল,
“চাচা রিকশা থামান। ”
***
আবিরের চোখ ভিজে উঠেছে। কেন যেন মনে হচ্ছিলো এই যাওয়াই বৃষ্টির শেষ যাওয়া। আগেই ভেবে রেখেছিলো আজ যদি বৃষ্টি ও’কে ফিরিয়ে দেয় তাহলে ও আর বৃষ্টির পেছনে ঘুরবে না। হঠাৎ চোখ মুছে তাকাতেই দেখলো বৃষ্টি ওর দিকে হেটে আসছে। কাছাকাছি এসে ওর হাত ধরে বলল,
“চলো একসঙ্গে যাই। পকেটে টাকা আছে। তাহলে ধার দাও তো কিছু টাকা। আজ তোমার এতো আনন্দের দিন। একটা সিনেমা দেখে আসি। ”
বড় হবার পর এই প্রথম হাত ধরা। আবির এখনো বৃষ্টির ধরা হাতের দিকে তাকিয়ে আছে।
চলবে….