বিদায় বেলা পর্ব-০২

0
160

#বিদায়_বেলা
#পর্ব_২
#ইশরাত_জাহান

ওইদিনের পর থেকে কুসুম বেগমের মনে একটাই আশা জেগেছিলো তার সন্তানেরা তাকে ভালোবাসবে।তাকে মা বলে মর্যাদা দিবে,সম্মান দিবে।সন্তানদের আশায় কুসুম বেগমের অপেক্ষা।শরীফ আহসান একটি বারের জন্যেও জিজ্ঞাসা করেনা তার কি লাগবে।একটি বারের জন্য বলেনা,কুসুম তুমি তো আমার সন্তানের মা হতে চলেছো।আমার সন্তান আর তুমি দুজনে কেমন আছো।নাহহ সে তো কাজে ব্যাস্ত।তার কাছে এসবের সময় নেই।

~~~~~~
দেখতে দেখতে অপেক্ষার বেলা বিদায় নিলো।কুসুম বেগম ছেলে সন্তানের জন্ম দিলেন।শরীফ সাহেব এই প্রথম যেনো খুব খুশি।ছেলেকে কোলে নিয়ে খেলাধুলা ঘুরাঘুরি করছে।কিন্তু কুসুম তার খোঁজ নিলো ন।ছেলে সন্তান জন্ম দেওয়ার কুসুম বেগমের বড় জা যেনো আরো ক্ষেপে গেলো।তার দুইটা সন্তান।দুজনই মেয়ে।তারমানে তো এই বাড়ির চাবিকাঠি কুসুম বেগমের হাতে।রাগে দুঃখে তিনি কুসুম বেগমের সাথে আরো বেশি বেশি অন্যায় করা শুরু করলেন।

খাবারে ঝাল দেওয়া,বাচ্চার ঘুমের ভিতর চিমটি দিয়ে ডেকে তোলা,নিজের ভালো ভালো শাড়ি পুড়িয়ে অপবাদ দেওয়া,মেয়েদের যত্নের অভাব বলে কাজ করানো,যেখানে সেখানে তেল বা সোডার পানি রেখে দেওয়া। যাতে করে কুসুম বেগম পড়ে যায়।

হলোও তাই,একদিন সিড়িতে তেল রেখে দিয়েছিলো।এর ফলে কুসুম বেগম পড়ে যান।কোমরে খুব জোড়ে ব্যাথা পান।জ্বর আসে তার ওই রাতে।কিন্তু শরীফ আহসান কুসুমকে ওষুধ দেওয়া ছাড়া আর কিছুই করলেন না।কুসুম বেগম ভেবেছিলেন আজ সন্তান আছে বলে মনে হয় একটু তাকে আদর সোহাগ দিবে।না তার চিন্তা ভাবনা একটু বেশি হয়ে গেছে।শরীর আহসান তো তাকে কোনোদিনই গ্রহণ করবেন না।

দেখতে দেখতে ছেলের বয়স যখন চার কুসুম বেগম জানতে পারেন তিনি আবার মা হবেন। সেইবারও তেমন কারো হেলদোল নেই।শুধুমাত্র কুসুম বেগম আর তার ছেলে জিয়ান ছাড়া।ছোট্ট জিয়ান তখন কুসুম বেগমের সাথে অনেক খুশি হয়।সে বড় ভাই হবে এটা যেনো তার আনন্দের বিষয়।কুসুম বেগমের প্রথম প্রেগনেন্সিতে তার ননদ বিলেত ছিলো স্বামীর সাথে।এবার সে আসছে।ননদ বরাবরই কুসুম বেগমের ভক্ত।এই ক্ষুদ্র মানুষগুলোর ভালোবাসা কুসুম বেগমের জন্য অনেক ছিলো। বড় সন্তানের বেলায় যতটা কষ্ট হয়েছিলো,ছোট সন্তানের বেলায় ততটা কষ্ট হয়নি।ননদ ছিলো বলে বড় জা তেমন কিছুই করতে পারেনি।

এবার কুসুম বেগমের মেয়ে সন্তান হলো।শরীফ আহসান মেয়েকে কোলে নিলেন।নাম রাখলেন মেয়ের।কিন্তু এবার কুসুম প্রতিবাদ করেছে।বলেছে,
_আমার ছেলের নাম তো আপনি রেখেছেন। এবার আমার মেয়ের নাম আমি রাখবো।
_আমার মুখের উপর কথা বলা আমি পছন্দ করি না মেয়ে।
_আমি আমার সন্তানের জন্য অধিকার ফলাচ্ছি।এতে আশা করি আপনার আপত্তি নেই।আমি তো সংসারে কোনো অধিকার দেখাই না।

ভাইয়ের রাগ সম্পর্কে খুব ভালোভাবে অবগত শরীফ আহসানের বোন।তাই সে তাদের থামাতে বললেন,
_আচ্ছা ভাবী রাখবে নাম।মায়ের তো একটা চাওয়া পাওয়া থাকে।ভাই তুমি এভাবেও ভাবীকে বলতে পারো না।তোমার দুই দুইটা সন্তানের মা সে।
বোনের সন্তনাতে চুপ হয়ে গেলো সবাই।দমে জন শরীফ আহসান।কুসুম বেগম তার মেয়ের নাম রাখেন,
_জার্ণবি।(ছেলের সাথে মিল রেখে)
সবাই তাতে খুশি হলো।এর ভিতর কুসুম বেগমের ননাশের আবদার,
_ভাই ভাবী আমাদের ছেলের তো বয়স এখন আট। জার্ণবির বিয়ের বয়স হতে হতে ওর একটা চাকরি হয়েই যাবে।আমি চাই আমার ছেলের সাথেই আপনাদের মেয়ের বিয়ে হোক।
রাজি হলেন শরীফ আহসান।

চোখের পলখে ছেলে মেয়েরা কিভাবে যেনো বড় হয়ে যায়।সময়টা যেনো ধরে রাখা যায় না।কুসুম বেগমের ছেলের বয়স এখন পঁচিশ আর মেয়ের বয়স বিশ।ছেলে দেশের বাইরে পড়াশোনা করেছে।মেয়ে তার কাছেই ছিলো।ছেলেকে বিদেশে পড়ানো এটা নাকি ওই পরিবারের ঐতিহ্য।ছেলেকে বিদেশে যেতে দিতে চায়নি কুসুম বেগম।শরীফ আহসানের চোখ রাঙানিতে যেতে দিতে হলো।ছেলে মেয়ে মাশাআল্লাহ মা ভক্ত হয়েছে।কিন্তু তারা বাবাকে মেনে চলে।এছাড়া কি আর উপায় আছে।তবে সন্তান হবার পর কুসুম বেগমের কষ্ট অনেকটাই কমে যায়।মেয়ে তার পড়াশোনার ফাকে ফাকে মাকে অনেক সাহায্য করতো।বাবাকে খুব ভয় পায়।মাকে সারাদিন বকাবকি,চোখ রাঙানি করতে দেখে সেও বাবার কাছে যেতো না। তবে শরীফ আহসান মেয়েকে আদর করতেন।মেয়েকে কাছে ডাকতেন।জার্ণবি চুপ করে ভয়তে বসে থাকতো।যদি তার বাবা কিছু বলে।এর ভিতরে কুসুম বেগমের বাবা মাও মারা যান।

বিদেশ থেকে পাশ করে ওখানেই চাকরি পায় জিয়ান। ওখানের এক মেয়েকে ভালোবেসে ফেলে সে। প্রেমও করে তারা।মাকে সবকিছু জানায়।বিদেশি কালচার হলেও জিয়ানের মা হিসেবে কুসুম বেগমকে অনেক সম্মান করে জিয়ানের গার্লফ্রেন্ড।যেহেতু বিদেশি মেয়ে আর ছেলে বিয়ের মত হয়ে গেছে তাই আর কোনো দ্বিমত জানান নি শরীফ আহসান ও কুসুম বেগম।দেশে এনে বিয়ে দিয়ে দেয়।ছিলো মাস চারেক এখানে।তারপর আবার চলে যায় বিদেশে।

ছেলের বিয়ের দের বছরের মাথায় জার্ণবির বিয়ে ঠিক হয়।শরীফ আহসানের বোনের ছেলের সাথেই।বিয়ের আয়োজন শুরু করা হয়ল। জার্ণবিরজন্মের সময় শরীফ আহসানের ওয়াদা করা ছিলো বলে এবার জার্ণবির অনুমতি নেয় নি।বিয়ের দিন কুসুম বেগম জানতে পারেন।ফোনের যুগ এটা।মেয়েকে ফোন কিনে দেন শরীফ আহসান।সেই ফোনেই মেয়েকে কথা বলতে শুনেন।কথার ধরণেই বুঝে যান সবকিছু।যেদিন জেনে যান সেদিন সকালেই তার মেয়ের বিয়ে।কুসুম বেগম কি করবেন বুঝতে না পেরে খুঁজতে থাকে শরীফ আহসানকে।অনেকক্ষণ খোঁজার পর পেয়ে যায়।শরীফ আহসানকে বলে দেয় সবকিছু।কিন্তু তিনি কথাগুলো গায়ে মাখলেন না।ওই যে কালচার,কুসুম বেগম তো কোনো কালচার জানেন না।ফোনে কথা বলার জন্য স্মার্ট হওয়া লাগে।কুসুম বেগম তো তা নয়।কথাগুলো খেতভাবে বলে। আর তার মেয়ে প্রেম করতেই পারে না।মেয়ে তো জানে বাবা ওয়াদা করে আছেন।কুসুম বেগম যেনো আজ ভেঙেই পড়লো।লোকটা এতগুলো বছর তাকে অবহেলাই করলো।কখনও বুঝলো না তাকে।লোকটাকে ভালোবেসে সংসারকে আগলে রাখলো।কিন্তু স্বামী সে তো তার একটা কথার দু পয়সারও দাম দেয় না।
চলবে,