বিদায় বেলা পর্ব-০৩ এবং শেষ পর্ব

0
159

#বিদায়_বেলা
#ইশরাত_জাহান
#সমাপ্তি_পর্ব

বিয়ের দিন জার্ণবি সত্যি সত্যি পালিয়ে যায়।এটা লোক জানাজানি হয়।অনেকে অনেক কথা বলছে।কেউ কেউ বলছে,”একই পরিবারের মধ্যে বিয়ে ঠিক করে আবার তামাশা দেখলাম।এমন সুযোগ কমই পাওয়া যায়”।আবার অনেকে বলছে,”মেয়েটা বাসায় একবার বললেই পারতো”।কেউ কেউ তো আবার কুসুম বেগমকে দায়ী করছেন।মা নাকি সঠিক শিক্ষা দিতে পারেনি।

অনেক খোঁজার পর জার্ণবি আর তার প্রেমিককে পাওয়া যায।প্রায় এক বছর পর খোঁজ পেলো মেয়ের।জার্ণবি যার সাথে বিয়ে করেছে সে ব্যাংকে জব করে।এটা সত্যি যে শরীফ আহসানের পছন্দ হতো।কিন্তু সে তো ওয়াদা বদ্ধ ছিলো। আর শরীফ আহসানকে খুব ভয় পেতো জার্ণবি।তাই কিছু বলেনি।

সবকিছু মিটমাট করে আজ আবার বিয়ে হলো জার্ণবির।প্রেমিক পুরুষের সাথে বিদায় নেয় সে।কিন্তু বিদায় নেওয়ার আগে ঘটে বিপত্তি।বিয়েতে অনেকে অনেক কিছুই করে।এই যেমন ফিতে ধরা,জুতা চুরি করা। জার্ণবির বিয়েতেও তাই হলো।জুতা চুরি করে জা বন্ধু মহল।সবাই মজা করছিলেন।কিন্তু শরীফ আহসান এর ভিতর একটু তেতে উঠলেন।এগুলো কোন ধরনের কাজ?বারবার টাকা চাওয়া হেনতেন।কুসুম বেগম দেখলো সবাই কষ্ট পেয়েছে।সন্তানের বয়সী বাচ্চাদের কষ্ট সহ্য হলো না।তাই সে আজ দ্বিতীয়বারের মত প্রতিবাদ করেছিলো।বললো,
_এগুলো বিয়েতে হয়েও থাকে।কোনো ব্যাপার না।বাচ্চারা ওদের মত আনন্দ করুক।
কুসুম বেগমের কথায় যেনো আরো দ্বিগুণ রাগ বেড়ে গেলো।মেয়ের বিদায় দিয়ে ওইদিনই রাগ মেটালেন তিনি।সাথে করে দুই গালে দুইটা চর।বিয়েতে প্রতিবেশীরা চলে গেলেও ছিলেন কিছু আত্মীয় স্বজন।তারা এগুলো দেখে অবাক।কুসুম বেগম আজও মুখে কুলু পেতে ছিলো।মুখ ফুটে কিছু বলেনি।আজ সবাই গেছে জার্ণবির বৌভাত অনুষ্ঠানে।শুধু কুসুম বেগম জাননি।তার শরীর অসুস্থ বাহানা দিলো।

কি জীবন তার?কি পেলো সে?বিয়ের দের বছরের মাথায় শাশুড়ি মারা গেলো।তার আড়াই বছর পর ছেলে হলো।ছেলের চার বছর বয়সে মা হওয়ার খবর আবার পেলো।টানা একুশ বছর সন্তান মানুষ করলো।এখন তারা সংসার পেতেছে। বড় ছেলের তো যমজ দুই বাচ্চা হয়েছে।এক ছেলে এক মেয়ে।সবাই সুখে আছে।কর্ম জীবনে শরীফ আহসানও সুখ পেয়েছে।সে কি পেলো?অবহেলা আর শাসন।কিন্তু এগুলো কি তার প্রাপ্য?এগুলো ভাবতে ভাবতে ব্যাগ গোছানো শেষ করলো কুসুম বেগম।শরীফ আহসান বৌভাত শেষ করেই মেয়ে জামাইকে নিয়ে আসবেন আজ।সন্ধায় আসবে তারা।তাই কুসুম বেগম এই দুপুরেই চলে যাবে।যাওয়ার আগে মেয়ের ঘরে চিঠি লিখে গেলো। ছেলে তো বিদেশ,তাকে আর লিখে কি হবে।তার স্বামী তো তার চাওয়া পাওয়া গুলোই শুনলো না।চিঠি পড়লে বলেও মনে হয় না।তাই লিখলো না চিঠি।

সবকিছু শেষ করে আজ চলে যাচ্ছে বাড়ি ছেড়ে।ভালো করে পরখ করে নিলো তার ত্রিশ বছরের সংসার।বিদায় বেলা হয়ে এসেছে তার।বেশি দেরি করা যাবে না।বেরিয়ে পড়লো যশোরের উদ্দেশ্যে।

~~~~~~
সন্ধার দিকে বাসায় ফিরে সবাই। জার্ণবি এখনও জানে না সেদিন কি হয়েছিলো।বৌভাতে মাকে অনেক খুঁজেছে,কিন্তু পায়নি।বাড়ি এসে মাকে অনেক ডাকলো।মা তার সাড়া দিলো না।আজ অনেক ধকল গেছে জার্ণবির।তাই বেশি না ঘেটে ফ্রেশ হতে যায় নিজের ঘরে।ঘরে ঢুকে কাপড় নিয়ে যেই ওয়াশরুমে যাবে চোখ যায় টেবিলের উপর।চিঠি দেখলো সে একটি। চিঠিটি খুলে পড়তে শুরু করলো।
মা জার্ণবি,
ভালো থেকো তুমি তোমার স্বামীকে নিয়ে।আমি চলে যাচ্ছি তোমার বাবাকে ছেড়ে।অনেক আগেই ছেড়ে যেতে চেয়েছিলাম।কিন্তু তখন তোমার নানু নানী আমার গার্জিয়ান ছিলেন।তারা চাইতেন না তোমার বাবাকে আমি ছাড়ি।তারপর তোমার ভাই এলো আমার গর্ভে।তাকে ছেড়ে যাওয়া আমার সম্ভব না।তারপর তুমি এলে।কিছু আসে তো কিছু যায়।তোমরা আসার পর আমার মা বাবা বিদায় নিলো দুনিয়া ছেড়ে।আমাকে দেখতে ইচ্ছে হলে যশোরে এসো।ঠিকানা তোমার বাবা জানে।তার থেকে চেয়ে নিও।আমি পারছি না এই বিদায় বেলা তোমার বাবার অবহেলা নিতে।আমার নাতি নাতনী হয়ে যাবে কয়দিন পর।দাদী তো হলাম এবার নানিও হবো।তারপর আস্তে আস্তে দুনিয়া ত্যাগ করবো।কিন্তু এই শেষে সময়টুকু একটু সম্মান আর শান্তি চাই।তাই আমি চলে যাচ্ছি।ভালো থেকো মা।পারলে তোমার বাবাকে একজন কালচারাল কাউকে দেখে বিয়ে দিও।
ইতি তোমার মা।
চিঠি পড়ে জার্ণবি বুঝলো কিছু একটা হয়েছে।সাথে সাথে সে চলে গেলো তার কাকাতো বোনের কাছে।শুনলো সবকিছু।আজ যেনো জার্ণবি বাড়ি মাথায় তুলবে।এমন তার অবস্থা।চিৎকার করে বাবাকে ডাক দিলো।বললো,
_এবার খুশিতো আপনি? আমার মা আনকালচারাল,অশিক্ষিত,মূর্খ,ক্ষেত আরো কি কি উপাধি দিতেন না আপনি।আজ সে আপনাকে ছেড়ে চলে গেছে।আপনার অশিক্ষিত অযোগ্য বউ বিদায় নিয়ে নিয়েছে।এবার খুশী তো আপনি?আমিও যাচ্ছি আপনাকে ছেড়ে।থাকতে চাই না আপনার কাছে।অন্তত নিজের সন্তানের মা হিসেবে সম্মান পেতো আমার মা।আপনি তাও দেননি।এমন বাবা চাই না আমার।ভালো থাকবেন আপনি।বলেই বিদায় নিতে চায় জার্ণবি।

মেয়ের এতগুলো কথা একসাথে হজম করতে পারলেন না শরীফ আহসান।সাথে সাথে বুকে হাত দিয়ে ঢলে পড়লেন ফ্লোরে।বাবার এই অবস্থা দেখে চলে যেতে পারলো না জার্ণবি।বাবাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি হসপিটালে গেলো।সাথে সাথে কল দিল জিয়ানকে।সবকিছু খুলে বললো তাকে।এগুলো শুনে জিয়ান বললো,
_আমি বাংলাদেশে আসতেছি।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চেষ্টা করবো।

~~~~~দেখতে দেখতে কেটে গেলো তিনটি মাস।এই তিন মাসে শরীফ আহসান বুঝতে করলেন কুসুম বেগমের কমতি।না চাইতেই সব কিছু রেডি থাকতো তার।আজ কিছুই রেডি নেই।ত্রিশ বছরের কুসুম বেগমকে অবহেলা করলেও,কুসুম বেগম তার সমস্ত কাজ ঠিক সময়ে করে দিতেন।

আজ জিয়ান এসেছে বিদেশ থেকে ছেলে ও বউকে নিয়ে।কিন্তু বাসায় আসেনি।হোটেল ভাড়া নিয়েছে।দুই মাসের ছুটিতে আসছে তারা।যশোরে যাবে মাকে নিয়ে আসবে।তারপর মাকেও বিদেশে নিয়ে যাবে নিজেদের কাছে।দরকার হয় মা পাসপোর্ট ভিসা না হওয়া অব্দি এই হোটেলেই থাকবে। জার্ণবি আসবে মাঝে মাঝে দেখতে।

ছেলে এসেছে কিন্তু নিজের বাড়িতে না।এই খবর পেয়েই কষ্টে বুক ছিঁড়ে যাচ্ছে শরীফ আহসানের।সে যেনো বুঝতে পারছে কি কি হারালো সে।

জিয়ান বাংলাদেশে আসার দুইদিন পরই যশোরে যাচ্ছে। জার্ণবিও যাচ্ছে তাদের সাথে। জার্ণবি এর আগেও দুইবার গিয়েছিলো কুসুম বেগমের কাছে ।কিন্তু ফিরিয়ে আনতে পারেনি তাকে।যতই হোক মেয়ের সংসারে তো থাকা যায় না। জার্ণবির শশুর শাশুড়ি স্বামী এরাও বলেছিলো এদের আপত্তি নেই।কিন্তু বিবেক বলতেও ব্যাপার আছে।সম্মানের সাথে পূরণ টিনের বাড়ি শ্রেয়।অসম্মানের সাথে অট্টালিকা না।

যশোরে এসে মাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে দিলো দুই ভাইবোন।অনেকক্ষণ মায়ের কোলে শুয়ে ছিলো জিয়ান।তারপর অনেকক্ষণ রিকোয়েস্ট করলো তাদের সাথে যেতে।ছেলের জেদের কাছে হার মেনে রাজি হলো কুসুম বেগম।

আজ তারা যশোরে যাবেন।সবকিছু রেডি করে জুতা পায়ে দিবে।এমন সময় অনুভব করলো একজোড়া হাত কুসুম বেগমের পায়ে জুতা পরিয়ে দিচ্ছে।কুসুম বেগম তাকালেন সেদিকে।দেখলেন তার স্বামী শরীফ আহসান।কিছু টা অবাক হলো কুসুম বেগম।সে কি জেগে থেকেও সপ্ন দেখছে।সাথে সাথে অবাক তার সন্তানেরা।সবাইকে পরখ করে শরীফ আহসান বললেন,
_আমি কুসুমের সাথে কিছু কথা বলতে চাই।
সবাই কিছু বললো না।সবার একটাই কথা তাদের মায়ের যা ইচ্ছা তাই করবে।তারা তাদের মায়ের পাশে আছে।স্বামীর মায়া এখনও ত্যাগ করতে পারেনি কুসুম বেগম।বিদায় বেলা কি বলতে চান তিনি।শুনতে রাজি হলো সে।তাই এক ছোট ঘরে ঢুকলো শরীফ আহসানকে সাথে নিয়ে।চুপ থাকলো কুসুম বেগম।বলতে শুরু করলো শরীফ আহসান,
_আমি জানি আমি কত বড় পাপ করেছি।এই পাপের শাস্তি অনেক কঠিন।স্ত্রীকে সম্মান দেওয়া স্বামীর কর্তব্য।আমি সে কর্তব্য পালন করিনি।বরং করেছি তাচ্ছিল্য।তুমি কি আমাকে দিবে সেই শাস্তি?আমি মাথা মেনে নিবো সকল শাস্তি।এবার থেকে নাহয় আমাদের উল্টোভাবে পথ চলা শুরু হোক।তুমি নাহয় এবার আমাকে তোমার ইশারায় চলতে দিবে।কিন্তু আমাদের এই বিদায় বেলায় বিচ্ছেদ না হোক।আমি তোমার কাছে এই অনুরোধ করছি।(কুসুম বেগমের দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে)।আজ শরীফ আহসানের চোখেও পানি এসেছে।তিনি আরও বলতে লাগলেন,
_জানো এই তিন মাসে আমি বুঝতে পেরেছি,
অবহেলার কিছু সারাক্ষণ থাকলে তার মূল্য বোঝা যায় না।দূরে গেলেই বোঝা যায়।তুমি এতদিন দূরে থেকে এই শিক্ষাটা দিয়েছো আমাকে।সুযোগ দিবে আমাকে শেষবারের মত।বিশ্বাস করো একটিবারের জন্যেও অবহেলা করবো না।বরং এবার রানির আসনে বসিয়ে রাখবো তোমাকে(নিজের বুকের বাম পাশটা দেখিয়ে)।
দুঃখের ভিতরেও লজ্জা পেলেন কুসুম বেগম।হালকা মুস্কি হাসলেন তিনি।বললেন,
_এটাই কিন্তু শেষ সুযোগ?
_মাথা পেতে গ্রহণ করলাম বিবিজান।
বিবিজান? আহ্ কি মিষ্টি লাগলো এটা শুনতে।সাথে লজ্জাও পেলেন।সমস্ত লজ্জা যেনো এই বুড়ো বয়সে দিলো।

ছেলে মেয়েরা বাবার এই অনুতপ্ত দেখে খুব খুশি।মা যখন মেনে নিয়েছে তারা আর কি রাগ করবে।একসাথে সবাই সবাইকে জড়িয়ে ধরলো।সুখ দুঃখ যেনো মুছে গেলো তার।আজ দ্বিতীয়বারের মত কুসুম বেগম স্বামীর সাথে করে বিদায় নিচ্ছে বাবার বাড়ি।এবারও একটি লাল টুকটুকে শাড়ি পড়লো সে।শরীফ আহসান কিনে দিয়েছে তাকে।জীবনে প্রথম নিজে থেকে দিলো।কুসুম বেগম খুব খুশি এই শাড়ি পেয়ে।বুকে নিয়ে কিছুক্ষণ শাড়ির ঘ্রাণ নিচ্ছিলেন।সব শেষে যখন ওরা গাড়িতে উঠবে,দেখতে পেলো গাড়িতে ফুল দিয়ে সাজানো।ছেলে মেয়েদের সামনে লজ্জা পেলো কুসুম বেগম।শরীফ আহসান সবার সামনে তার বিবিজানকে বুকে জড়িয়ে নিলেন এক হাত দিয়ে। গাড়িতে উঠে সবাই আনন্দ করতে করতে বাড়ি ফিরলো।বাড়িতে এসে দেখে সবাই ওয়েলকাম পার্টি করছে।কুসুম বেগমকে নতুনভাবে স্বাগতম জানালেন সবাই।
এই সবকিছু নাকি শরীফ আহসানের প্ল্যান।তার ইন্সট্রাকশন অনুযায়ী হয়েছে সবকিছু।

অনুষ্ঠান শেষ করে ঘরে এলেন কুসুম বেগম ও শরীফ আহসান।ঘুমানোর সময় কুসুম বেগম বিসানার কোনায় গুটি মেরে শুয়েছিলেন।শরীফ আহসান তাকে বাহু ধরে হেসকা টান দিয়ে নিজের বক্ষে আনেন।বলেন,
_আজ থেকে আমার বিবিজানের জায়গা আমার বক্ষে।কোনো খাটের কোনায় না।বলেই মাথায় চুম্বন একে দিলেন।
কুসুম বেগম যেনো আজ অবাকের ওপর অবাক।সাথে শুকরিয়া আদায় করলো মনে মনে।শুরুতে না হোক বিদায় বেলায় তো পেলো তার আত্মসম্মান।তার ভালোবাসা,ভরসা,মর্যাদা।

সমাপ্ত