বিনিদ্র রজন পর্ব-০৭

0
275

#বিনিদ্র_রজনী
#পর্ব_৭_অংশবিশেষ
#মুমতাহিনা_তারিন

সকাল গড়িয়ে বিকেল হতে চলেছে শাপলা বেগম আর তুলি ঘর গোছাতে ব্যস্ত। যা যা খুব বেশি প্রয়োজন সেইগুলো শুধু কেনা হয়েছে । ওরা বাড়ি থেকে চলে এসেছে আজকে সকালে,, অবাক করা বিষয় হলো তুলির ভাই ওদের একবারও বলেনি থেকে যেতে । এতটা বছর বাচ্চাদের স্বপ্ন পূরণ করতে ছুটেছে শাপলা বেগম আর তার স্বামী! আর আজকে তার থাকা না থাকায় কিচ্ছু যায় আসে না। এক বুক কষ্ট নিয়ে শাপলা বেগম ঘর ছাড়লেন ।

নিজের স্বামীর কবরের দিকে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে আকাশে পানে চাইলেন মনে মনে একটা কথা উদয় হলো বয়স হলে বুঝি মানুষের মূল্য থাকেনা? মা হয়েছি সন্তানের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার আশা করিনি ইয়া রব,,,,তাই বলে কি ভালোবাসা ও না!! এজন্য হয়তো সবার থেকে আল্লাহকে বেশি ভালবাসতে হয় । শেষ সময়ে সবাই চলে গেলেও আল্লাহ কখনো তার বান্দাকে একা ছাড়ে না । নিজের অশ্রু সংবরণ করে তুলির হাত ধরে বেরিয়ে এসেছিলেন শাপলা ।

” তুলি মা আর তুই কাজ করিস না । এখন কোনো চাপ নেওয়া যাবে না ”

” আম্মা মাত্র তিন মাস হচ্ছে । গর্ভবতী হলেই তো শুয়ে বসে থাকতে নেই একটু কাজ করা ও প্রয়োজন । আর এখন যা মানসিক অবস্থা তাতে ব্যস্ত সময় পার করলেই ভালো লাগবে ”

নিজের মেয়ের এমন কথায় চোখে পানি জমলো শাপলার এইতো কয়দিন আগেও উঠানে কিত কিত খেলে বেড়ানো তুলির কেমন বড় হয়ে গেলো । কিন্তু তার ভাগ্যটাই আল্লাহ্ এমন ভাবে লিখেছে যার বাবা ছাড়া চলতো না তার সন্তান বাবার স্পর্শের বাইরে!

” হুম তবে ভারি কোনো কাজ করতে হবে না । তুই কি আদনানকে কনসিভ করার কথা বলছিস?”

শাপলা বেগমের কথায় তুলি একটু হাসার চেষ্টা করলো । তারপর হাতে থাকা বালিশের কভার লাগাতে লাগাতে উদাসী নয়নে বাইরের মৃদু রোদ্দুরের দিকে তাঁকিয়ে বললো-

” বলার সুযোগ পেলাম কই!আর বললেও হয়তো উনি মানতেন না বাচ্চাকে । কেউ না জানুক সে তো দুটো বছর আমাকে দেখেছে ভালো না বাসুক বুঝেছে তো আমি কেমন তারপরেও কোনো কথা বলেনি । আর এই বাচ্চা তো উনার ভালোবাসার ফল না যে মেনে নেবে । বাদ দাও আম্মা এইসব কথা ”

মেয়ের কথা শুনে আর কিছু বললেন না শাপলা । ঘরের এক পাশে রাখা ঝাড়ু দিয়ে ফ্লোর পরিষ্কার করতে থাকলেন । যত কথা বলবে আদনান কে নিয়ে ততই যে তুলির খারাপ লাগবে বুঝে গিয়েছে শাপলা বেগম।

___________________

আজকেও রান্না ভালো লাগেনি আদনানের । তাও মুখ বুজে কোনোমতে খেয়ে অফিসে চলে এসেছে । কাজের চাপ অনেক এখন আর কোনপ্রকার বেখেয়ালি চলবে না । সমরেশ কে এক কাপ গরম চা দিতে বলে টেবিলে থাকা ফাইল গুলো চেক করতে লাগলো আদনান ।

রোহান অন্য ডিপার্টমেন্টে কাজ করে । শিউলির সাথে রাতে আর কথা বলেনি । নিজের ভালবাসার মানুষের সব কিছুই ভালোবাসতে হয় তার ভুল ত্রুটি সব । কিন্তু অপরাধ? অপরাধের কি ক্ষমা করা যায়? নিশ্চয় এর ও শাস্তি আছে । আল্লাহ্ জানে কেমন শাস্তি হতে পারে। তবে শিউলীর এমন কাজে রোহানের মনটাও ভেঙে গেছে । এতো কিছু হয়েছে কিন্তু একবার ও শিউলী তাকে কিছু বলে নি । নিজের অভিযোগ অভিমানের ঝুড়ি তুলে নয়ন ভাবনায় মগ্ন হলো রোহান।

কাজের ফাঁকে ফাঁকে তুলির সে ভাসা ভাসা অশ্র সজল চোখ গুলো কল্পনার পাতায় ভেসে উঠছে । আহা মানুষ!! কেউ কেউ ভালোবাসার কাঙাল হয় কেউ কেউ ভালোবাসা পেয়েও মূল্য দিতে জানে না আবার কেউ কেউ ভালোবাসা বিলিয়ে বেড়ায় । তুলি ভালবাসা বিলিয়ে বেরিয়েছে কিন্তু দেখ তার সাথে কেমন হলো!আল্লাহর কাছে একটাই চাওয়া তুলি যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক ।

কাজের ব্যস্ততায় হাপিয়ে গেছে আদনান । চোখে ভর করেছে দুনিয়ার ক্লান্তি । আর মনে তো শান্তি নেই তবে যতক্ষণ ব্যাস্ত থাকে ততক্ষণ যেনো একটু রেহাই পায় আদনান। কাচের জানালার নিচ দিয়ে একবার রাস্তার দিকে চাইলো আদনান । রাস্তার অন্যপাশে মাঝে মাঝে তুলি টিফিন নিয়ে আসত । কিন্তু আদনানের ভয়ে রোহানের কাছে খাবার পাঠিয়ে দিত । তখন বিরক্ত লাগলেও এখন মন চাইছে একটু যদি তুলি আসত সেই আগের মত । রাস্তায় অন্যপাশে দাড়িয়ে বার বার জানালার দিকে তাকিয়ে থাকত । কিছু না ভেবেই অনেক ঘেঁটে ঘেঁটে রিনার ফোন নম্বরটা বের করলো আদনান । ক্রিং ক্রিং শব্দ জানান দিচ্ছে অপরপ্রান্তে রিং হচ্ছে । যত সময় অতিবাহিত হচ্ছে ততই নিজের হৃদকম্পন অনুভব করছে আদনান ।

অপর প্রান্ত থেকে ভেসে আসা মেয়েলি কণ্ঠে নিজের গলাকে পরিষ্কার করে নিল আদনান ।

” আসসালমুআলাইকুম তুলি কি আছে?”

” আপনি কে? আর তুলিকে দিয়ে আপনার কি?”

রিনার উপরোক্ত কথা শুনে লজ্জায় পড়ে গেল আদনান । তুলির সাথে বিয়ের পর মাত্র একবার গিয়েছিল তুলিদের বাড়ী । তুলির পুরো পরিবার খুশি হয়ে নিজের সাধ্যমত অ্যাপায়ণ করেছিলো আদনানকে । তুলির অনুরোধ উপেক্ষা করে সকালে গিয়ে বিকেলে চলে এসেছিল আদনান । তুলি যাওয়ার আগে অনেক বড় বলেছিল একটা রাত থেকে যেতে নইলে গ্রামের সবাই শলা বেগম আর সজিবকে কেমন ভাববে কিন্তু তার সেই কথাতে কোনো ধার ধারেনি আদনান।
নিজের বোনের সাথে একটু কথা বলার জন্য আদনানের ফোনে কল দিত সজীব একদিন মুখের উপর অপমান করেছিল সে । অনেক ইতস্তত করে নিজের পরিচয় দিল আদনান ।

” আমি তুলির হাসব্যান্ড বলছি আদনান । তুলির কাছে একটু ফোন টা দিবেন ”

” তুলি নেই এইখানে । জানি না কোথায় গেছে ”

” নেই মানে!!!!”

” ছিল তিনদিন তারপর কোথাও চলে গেছে ”

” আচ্ছা শুনেন…”

আদনানের আর কোনো কথা না শুনেই ফোন কেটে দিলো রিনা । সাথে সাথে ব্লক করে দিলো যাতে আর কল না ঢোকে। “বাড়ি থেকে দূর ছাই করে তাড়িয়ে দিয়ে এখন আবার কল দিচ্ছে কথা বলবে যত্তসব ঢং ” নিজের মনে মনে কথাগুলো আউড়িয়ে বাইরে পড়ে থাকা শুকনো কাঠগুলো উঠাতে চলে গেলো রিনা ।

অন্যদিকে আদনানের ভিতর আবারও সৃষ্টি হলো অস্থিরতা । কেমন নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে ওর । তুলি আবার কোন জায়গায় গেলো! কোথায় খুঁজবে আদনান তুলিকে!

___________________________

লিতুন বেগম ছেলের সব পরিবর্তন নিজের শকুন চোখ দিয়ে এতদিন ভালো ভাবেই পরখ করেছে । নারায়ণগঞ্জে গিয়ে ছেলে জে তুলির উপর অনেকটা দুর্বল হয়ে গিয়েছে তিনি আদনানের চল চলনে বুঝে গিয়েছিলেন । তবে সম্পূর্ণ রূপে দুর্বল হওয়ার আগেই যে আপদ বিদায় হয়েছে তাতে তিনি সন্তুষ্ট । নিজের ছেলের সাথে এখন একটা যোগ্য মেয়ে দরকার যে হবে শিক্ষিতা সুন্দরী আর লিতুনের মনের মত । তবে আর যায় হোক তুলির সাথে আদনানের আগে ডিভোর্স টা বেশি জরুরি তাই আজকেই আদনানের সাথে কথা বলবে বলে মনে মনে ঠিক করলেন লিতুন বেগম ।

রাহেলার এখন খুব একা একা লাগে । আগে তুলি ছিল কথা বলতে পারতো এখন আর সম্ভব না । মাঝে তুলিকে লজ্জা পেতে দেখে মিটমিটিয়ে হাসত রাহেলা । রাহেলার বর মুন্সীর সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তের কথা স্মৃতিপটে রঙিন রং তুলিতে আঁকা ছবির মত প্রতিচ্ছবি তৈরি করতো । তবে থাকা গাছগুলোতে সন্ধ্যার পর ফুল ফোটে ঠিকই কিন্তু সেই গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে সুর তোলে না কেউ । একটা মানুষের এমন বিদায় যে কত যন্ত্রণাদায়ক!

__________________

মুখে বরাবরের মত লেপ্টে আছে এক চিলতে হাসি । সন্ধ্যা হতে না হতেই মালতীর আগমন । এই মহিলাকে দেখে তুলি অবাক হয় মধ্যবয়সী মহিলা নিজেকে কত সুন্দর ফিট রেখেছে আর তার আম্মা আব্বু মারা যাওয়ার পর থেকেই কেমন যেনো বয়স বেড়ে গেছে । সারাক্ষণ পড়ে থাকে হালকা রঙের শাড়ি ।

” বসে বসে খেলে জমানো টাকা আর কয়দিন যাবে আপা । আমার কাছে একটা ছোটখাটো জব অফার আছে তুলির জন্য চাইলে করতে পারে ”

চাকরির কথা শুনে চোখ দুটো চক চক করে উঠলো তুলির ।রান্নাঘর থেকে সামান্য নাস্তা রাখলো মালতীর সামনে ।

” কিসের চাকরি অ্যান্টি? আমি করবো আমার কোনো আপত্তি নেই । এমনি ও চাকরি খুঁজতেই হতো ভালো হলো আপনি একটা ব্যাবস্থা করে দিলেন ”

” ছোটদের পড়াতে হবে ,,তোমার প্রেগন্যান্সির কথা ভেবে তিনমাস পর তোমাদের বাসায় আসতে বলেছি বাচ্চাদের ।আর এই প্রথম তিন মাস স্কুলে গিয়ে প্লে তে বাচ্চাদের পড়াতে হবে ”

” ঠিক আছে অনেক অনেক ধন্যবাদ অ্যান্টি ”

” ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই মেয়ে প্রথম বেতন পেয়ে কিন্তু আমাদের খাওয়াতে হবে । তোমার আম্মা বলেছিল তোমার হাতের রান্না সুন্দর । আমরাও একটু টেস্ট করে দেখবো”

” অবশ্যই অ্যান্টি কেনো নয়”

তুলির ছল ছল চোখ বলে দিচ্ছে কতটা খুশি । বেতন কম হলেও চলবে কিন্তু আপাতত একটা ইনকামের সোর্স থাকাটা অনেক বেশি প্রয়োজন ছিল । নিজের পেটে আলতো হাত রাখল তুলি ।

চলবে,

#বিনিদ্র_রজনী
#পর্ব_৭_পরবর্তী_অংশ
#মুমতাহিনা_তারিন

লিতুন বেগম আজকে আদনানের সাথে ডিভোর্সের বিষয়ে কথা বলেছে । আদনানের কথায় অনিচ্ছা প্রকাশ পেলেও গায়ে লাগায়নি লিতুন বেগম । নিজে থেকেই উকিলের সাথে কথা বলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে । ছেলে ভুল পথে হাঁটলে তাকে সৎপথ দেখানোর দায়িত্ব একজন আদর্শ মায়ের পরিচয় । কিন্তু লিতুন বেগম ভুলে গেছে মায়েরাও অনেক সময় ভুল করে যার ফল সারাজীবন তাদের সন্তানের ভোগ করতে হয় । নিজের ইচ্ছাকে চূড়ান্ত রূপ দিতে উকিলের সাথে ডিভোর্স এর জন্য যত ফর্মালিটি আছে সব কিছু করার কথা বলে দিয়েছে সে ।

রাতের আকাশে আজকে তারার মেলা । নিকষ অন্ধকার তারা গুলোকে যেনো আরো বেশি উজ্জ্বল করে তুলেছে । সেদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তুলি । কালকে থেকে আবার নতুন জীবনে পা রাখতে হবে । লড়াই করতে হবে নিজের জন্য নিজের অনাগত সন্তানের জন্য । ঘরের টিম টিমে আলোয় জ্বলতে থাকা বাতিকে নিভিয়ে বিছানায় নিজের শরীর এলিয়ে দিয়ে গভীর ভাবনার সাগরে গা ভাসিয়ে দিলো । কে জানে কালকে কি অপেক্ষা করছে তার জন্য!

গন্ধরাজ গাছটায় চারটে ফুলে ফুটেছে আর কালকের দুটো ফুল একটু হলদেটে হয়ে গিয়েছে । ঘর জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে ফুলের অসম্ভব সুন্দর ঘ্রাণ । আদনানদের বড় বাড়িটায় নিচতলার কোনার ছোট ঘরটা স্টোর রুম হিসেবে ব্যাবহার করা হয় । এই ছোটো ঘর থেকে বেরিয়ে আসা ফুলের মিষ্টি গন্ধটা ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করছে নির্বিঘ্নে।

রাহেলা রাতের বাসন গুলো রান্নাঘরে গিয়ে পরিষ্কার করছে । এগুলো পরিষ্কার করে রান্নাঘরটা মুছে দিতে হবে । বয়সতো আর কম হয়নি তুলি থাকায় কম কাজ করতে হতো রাহেলার । অন্তত আদনানের কাজগুলো থেকে ছুটিতে ছিল সে । কিন্তু এখন আবার সব কাজ দেখতে হচ্ছে তাকে । আদনান মুখে কিছু না বললেও তার কাজ যে আদনানের ভালো লাগছে না বুঝতে পারছে রাহেলা। কিন্তু তার আর কি করার! আদনান চাইলেই তুলির পাশে দাঁড়াতে পারতো তাকে ভরসা দিতে পারতো কিন্তু সেটা হলো কই! এজন্য বড়লোক বাড়ি মেয়ে দেওয়ার আগে ভাবতে হয় । এতটা দিন তাদের জন্য এতো কিছু করেও কোনো কিছুই পেলো না মেয়েটা ! না সম্মান না ভালোবাসা না পর্যাপ্ত ভরণপোষণ! এসব ভেবেই একটা দীর্ঘনিশ্বাস বেরিয়ে আসলো বুক চিরে ,,,,,

আজকে অর্ডার করে মোমো আনিয়েছে অরোরা । আদনান এর খুব পছন্দের খাবার মোমো । রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার প্যাক করে এনে আদনানের ঘরের ব্যালকনিতে থাকা টি টেবিলের উপর সাজাচ্ছে অরোরা । আদনান অফিস থেকে এসেই ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে । আগামীকালের কিছু ফাইল চেক করতে ।

” চলে আয় আমার সব কিছু গোছানো শেষ । শুধু পেটে চালান করার অপেক্ষা ”

” হুম আসছি ”

ল্যাপটপ বিছানায় রেখে ব্যালকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো আদনান। টি টেবিলের উপর রাখা মোমো গুলো যেনো ওকে ডাকছে । খাওয়ার পাগল আদনান না তবে মোমো অনেক পছন্দের তার । পছন্দের কিছু দেখলেই যেমন মন ভালো হয়ে যায় তেমনটা হয়েছে আদনানের ক্ষেত্রে ও । সাদা টি শার্ট আর ধূসর রঙের ট্রাউজার পরা আদনানের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরোরা । চুলগুলো হালকা ভেজা নিশ্চিত ভাবে বলা যায় আদনান গোসল করে চুল মোছে নি । সুঠাম দেহ আর নাকে আসা সেই চিরচেনা মেনস পারফিউমের গন্ধ প্রতিবার নতুন করে প্রেমে পড়তে বাধ্য করে অরোরা কে । কত ছেলেরা অরোরার পিছনে পিছনে ঘুরেছে কিন্তু অরোরা শুধু আদনানের হতে চেয়েছে । মিষ্টি হেসে ,
অরোরা তিনটে ক্যান্ডেল জ্বালিয়ে টেবিলের উপরে রাখলো । ব্যাগ থেকে কয়েকটা টাটকা গোলাপ সাজিয়ে রাখলো টেবিলের উপরে । নিজের ভালোবাসার মানুষের সাথে কিছু সুন্দর স্মৃতি চায় সে ।

” আজকে কি স্পেশাল কিছু?”

“কেন?”

“এতো আয়োজন তাই ”

” আরে না তুই মন মরা হয়ে পড়ে থাকিস কি করবো বল! এজন্য আমার পক্ষ থেকে ছোট্ট একটা ট্রিট । আর কোনো কথা না আবার চুপ করে বসে খাবো বুঝলি ”

” হুম বুঝলাম ”

ফ্লোরে বাবু হয়ে বসে পড়লো আদনান । অরোরা হাতে রাখা চপস্টিক গুলো এগিয়ে দিল আদনানের দিকে । আদনান চপস্টিক গুলোর দিকে তাকিয়ে থম মেরে গেলো । তুলিকে নিয়ে একবার রেস্টুরেন্ট গিয়েছিল আদনান বিয়ের তখন কেবল ছয়মাস । আদনান এর পছন্দ কে প্রাধান্য দিয়ে সেদিন ও মোমো অর্ডার করেছিল সবাই । খাওয়ার সময় সবাই নিজের মত করে খেলেও তুলির মূখে ফুটে উঠেছিল অস্বস্তি । সেই অস্বস্তি লক্ষ্য করে আদনানের কলেজ ফ্রেন্ড ফারহান তার কাছে সমস্যা হচ্ছে কিনা শুনলে তুলির উত্তর টা ছিল এমন ” আমরা তো গ্রামে থাকি এমন কাঠি দিয়ে খেতে অভ্যস্ত না তাই ….” সবাই তুলিকে সহজ করে হাত দিয়ে খেতে বলেছিল যদিও কিন্তু লজ্জা অপমানে আদনানের মুখটা আষাঢ়ের কালো মেঘের রং ধারণ করেছিল। এই ছোট বিষয়টাকে কেন্দ্র করে প্রথমবার তুলিকে চড় মেরেছিল পুরো পরিবারের সামনে । নিজের ভিতরে দমানো সব রাগ উগড়ে দিয়েছিল তুলির উপর গরীব , লোভী গায়ে পড়া স্বভাবের মেয়ে বলে সবার সামনে অপমান করেছিল আদনান । তুলি কোনো শব্দ করেনি নিচের দিকে তাকিয়ে ছিল । নাক বেয়ে চোখের পানি অবলীলায় গড়িয়ে পড়ছিল সেদিন ।তারপর থেকে তুলি নিজে থেকে কখনো আদনানকে স্পর্শ করতো না ।

অরোরা আদনানকে অন্যমনস্ক দেখে জোরে তুড়ি বাজালো । ভাবনার ঘর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসলো আদনান । অরোরার দিকে তাকিয়ে অপ্রস্তুত হাসলো ।

” কিরে ওমন হা হয়ে তাকিয়ে আছিস কেনো? খ নইলে সব আমি খেয়ে ফেলবো ”

” কি ভাবছিলি?”

” আরে কিছু না তুই খাবি না কি আমি খেয়ে নেব?”

আদনান এর কথায় ভেংচি কাটলো অরোরা । চপস্টিক টা একটু ঘুরিয়ে মোমো নিয়ে সসে ডিপ করে খেতে শুরু করলো ।

________________________

পশ্চিম আকাশটা লালচে বর্ণ ধারণ করেছে যা জানান দিচ্ছে সূর্যি মামা একটু পরেই নিজেকে প্রদর্শন করবেন । জায়নামাজের পাটিতে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছে তুলি । নিজের জীবনের কিছু হিসাব নিকাশ করছে সে । গর্ভবতী হলে অনেক বেশি এবাদত বন্দেগী করতে হয় । শাপলা বেগম তুলিকে প্রতিদিনের নামাজের পাশাপাশি নফল নামাজ আর কোরআন শরীফ পড়তে বলেছেন । তার সাথে বেশী করে তাসবীহ তাহলীল পড়তে হবে । তাই একেবারে ইশরাকের নামাজ পড়েই পাটি ছাড়বে তুলি ।

শাপলা বেগম রান্না ঘরে গিয়ে গ্যাসে তরকারী তুলে দিয়ে অন্যপাশে ভাত বাড়ছেন। গ্রামে সকালে নাস্তা খুব একটা করা হয়না । সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ে রান্না চাপিয়ে সব কাজ করতেন গ্রামে থাকা কালীন । গরু ছাগল, হাস,মুরগি সব কিছু একা হাতে সামলেছে শাপলা । এখন ভাড়া বাসা ওসব কিছুর ঝামেলা নেই । আরো আজকে তুলির প্রথম দিন বাচ্চাদের পড়াতে যেতে হবে । তাই আর দেরি না করে তুলিকে ডাকতে ঘরে আসলেন তখন তুলি ইশরাকের নামাজ পড়ছে ।

” নামাজ শেষ করে গোসল করে খেতে আয় মা নইলে দেরি হয়ে যাবে ”

আজকে প্রথম দিন তুলির ছোট ছোট বাচ্চারা সামনে বসে গোল গোল চোখে তুলির দিকে চেয়ে আছে । তুলির বুকটা ধুক পুক করছে । অফিস থেকে একজন সিনিয়র ম্যাম এসে তুলিকে পরিচয় করিয়ে গেছে । প্রথম দিন তো আর ক্লাস করানো সম্ভব না তাই নিজেকে সামলে নিয়ে সবার সাথে পরিচয় পর্ব সেরে নিলো তুলি ।

____________________

আদনান ডেইলি ওয়াক আউট করে এখন শাওয়ার নিতে ঢুকেছে । ঘেমে যাওয়া শরীর বেয়ে পানি পড়ছে । আদনান একটু শান্তি চায় চোখ বন্ধ করে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে নিলো নিজের মধ্যে । এখন ওর নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে গেছে এই দীর্ঘনিশ্বাস!

চলবে ,,,,,