বিনি সুতোর টান পর্ব – ০৮

0
268

#বিনি সুতোর টান
#লেখিকা জেনিফা চৌধুরী(মেহু)
#পর্ব-আট

একটা মা লোভের বশে এতটা নিচে নামতে পারে জায়ান ভাবতে পারছেনা। রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে দেয়াল ঘেষে দাড়িয়ে আছে জায়ান। ওর শরীর রাগে থরথর করে কাপছে। জায়ান নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ওর ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে এইসব কিছুর জন্য ওর মা দায়ী। জায়ান শক্ত হয়ে দাড়িয়ে আছে। নিজেকে কন্ট্রোল করার মতো শক্তি ওর নেই। ওর মা এতটা নিচে নামতে পারলো। ওর মায়ের কথা শুনে জেমিকে পশুর মতো অত্যাচার করেছে। জায়ান দাড়িয়ে এইসবেই ভাবছিলো তখনি ভেতর থেকে মায়ার কন্ঠ স্বর ভেসে আসলো। ইরা বেগমের কথা শুনে মায়া রেগে গিয়ে তাড়াতাড়ি ইরা বেগমের মুখ চেপে ধরে বলে উঠলো……

—চুপ একদম চুপ মামনি। দেয়ালের ও কান আছে। ভুলে যেও না আমি একা দোষী নয় তুমি ও সমান দোষে দোষী।

মায়ার কথা শেষ হতেই জোরে দরজা খোলার শব্দে মায়া আর ইরা বেগম দুজনেই ভয় পেয়ে হকচকিয়ে উঠলো। চোখের সামনে জায়ান কে অগ্নি মূতি হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে মায়া আর ইরা বেগমের মাথায় যেনো বাজ পড়লো। দুজনেই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে জায়ানের দিকে। জায়ানের চোখ লাল টকটকে হয়ে আছে। জায়ান কে দেখেই মায়ার কপালে ঘাম জমতে শুরু করলো। মায়ার শরীরে শীতল রক্ত বইতে শুরু করলো। ওর হাত-পা মুহূর্তেই ঠান্ডা হয়ে আসতে লাগলো। জায়ান কিছু শুনে ফেলেনি তো ভাবতেই মায়ার গলা শুকিয়ে আসতে লাগলো। জায়ান এক মিনিট ও দেরি না করে ইরা বেগমের সামনে গিয়ে খপ করে ইরা বেগমের হাত চেপে ধরে খাটের থেকে নিচে নামিয়ে ওর সামনে দাড় করিয়ে জোরে চেঁচিয়ে বলে উঠলো……

— এইসব কিছু তুমি করেছো মা? আজ অন্তত চুপ করে থাকবে না মা। উওর দাও।

ইরা বেগম ভয়ের চোটে বার বার ঢোক গিলছে। উনার শরীর কাপছে থরথর করে। ইরা বেগমকে চুপ থাকতে দেখে জায়ান জোরে ধমক দিয়ে বললো……

— কি হলো? চুপ করে আছো কেনো মা? বলো? এন্সার মি মা। এন্সার মি……

জায়ানের চিৎকারে ইরা বেগমের শরীর কাঁপুনি দিয়ে উঠলো। উনি কাঁপা কাঁপা কন্ঠে শক্তি সঞ্চয় করে, আমতা আমতা করে বলে উঠলো….

—তুই কিসের উওর চাইছিস বাবা? আমি কিছু বুঝতে পারছি না তো।

ইরা বেগমের কথা শুনে জায়ান আবারো জোরে চিৎকার করে বলে উঠলো…..

— এতদিন জেমির নামে এইসব কিছু তুমি বানিয়ে বানিয়ে বলেছো? কেনো মা কেনো? উওর দাও প্লিজ…..

জায়ান ওর মায়ের নিচ মানসিকতা দেখে কি বলবে খুঁজে পাচ্ছে না। জায়ান ছলছল চোখে প্রশ্নোওর চোখে ওর মায়ের দিকে চেয়ে আছে। জায়ানের রাগের মাত্রা বুঝতে পেরে মায়া সাইড কাটিয়ে নিঃশব্দে দরজার দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে জায়ান ওর হাতটা খপ করে ধরে ফেললো। মায়ার হাতটা জোরে চেপে ধরে বলে উঠলো…..

— তুই। এইসব কিছুর জন্য তুই দায়ী। তোর কথায় মা এইসব করেছে । আর এখন তুই পালাচ্ছিস।

জায়ানের কথা শুনে মায়া আচমকা কেঁদে দিলো। মায়াকে কাঁদতে দেখে জায়ানের শরীর রাগে গিজগিজ করতে লাগলো। ইরা বেগম হা করে তাকিয়ে আছে মায়ার দিকে। হঠাৎ, মায়ার এমন ন্যাকা কান্নার মানে উনি খুঁজে পাচ্ছে না।

—আমার সামনে এইসব ন্যাকামি দেখাতে আসবি না। তোর ন্যাকা কান্নায় আমি সব ভুলে যাব না। আমার সব প্রশ্নের উওর চাই। এন্সার মি? ড্যাম ইট।

বলেই মায়ার গালে একটা থাপ্পড় মে/রে বসলো জায়ান। জায়ান নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারছে না। এই মুহূর্তে ওর মাকে আর মায়াকে নিজের হাতে খু/ন করতে ইচ্ছে করছে ওর।

মায়া থাপ্পড় খেয়ে গালে হাত দিয়ে আরো জোরে কেঁদে উঠলো। হুট করে কাঁদতে কাঁদতে জায়ানের পায়ের সামনে বসে পড়লো। তারপর কান্নারত অবস্থায় বলতে লাগলো…..

–আমাকে ক্ষমা করে দাও জায়ান। আমি এইসব বাধ্য হয়ে করেছি। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দাও। আমি তোমাক ভালোবাসি জায়ান। আমি সব মামনির কথায় করেছি। মামনি প্রথমে জেমিকে পছন্দ করতো শুধুমাত্র ওদের টাকা পয়সার জন্য। কিন্ত জেমি যখন তোমার সাথে পালিয়ে আসলো আর ওর পরিবার ওকে মেনে নিতে অস্বীকার করলো। সেদিন থেকে জেমি মামনির চোখের বিষ হয়ে গেলো। এই বাড়িটা যে আমার সেটাও মামনি জেনে গিয়েছিলো। তাই লোভে পড়ে আমার বাবার সম্পত্তি দেখে আমার সাথে তোমাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগলো। আর একের পর এক মিথ্যা কথা শুনিয়ে যেতে লাগলো জেমির নামের। কাল রাতে তোমাকে দুধের সাথে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দিয়েছিলো মামনি। তাই রাতে মাথা ব্যাথায় ছটফট করতে করতে ঘুমিয়ে পড়েছিলে আর সুযোগ বুঝে ভোরের দিকে তোমার রুমে আমাকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলো মামনি। বিশ্বাস করো শুধু মাত্র তোমাকে পাওয়ার লোভে মামনির কথায় আমি সব কিছু করেছি। এখন বুঝতে পারছি চাইলে সব আপন করে পাওয়া যায়না। আমাকে ক্ষমা করে দাও জায়ান প্লিজ।

বলেই মায়া কাঁদতে লাগলো। মায়ার কথা শুনে ইরা বেগম আর জায়ান দুজনের মাথাই আকাশ ভেঙে পড়লো। ওরা দুজনেই পাথর হয়ে গেলো মুহূর্তেই। জায়ানের মনে হচ্ছে ওর পায়ের তলার মাটি নেই ও শূন্যে ভেসে আছে। ইরা বেগম ধপ করে খাটের উপর বসে পড়লো। জায়ানের চোখ থেকেও পানি গড়িয়ে পড়ছে। রাগ, ক্ষোভ, আর মায়ের কু-কর্ম দেখে জায়ান নিজেকে সামলতে পারলো না ঘুরে সামনে থাকা ট্রি-টেবিলটায় লা/থি মারতেই টেবিল টা উল্টো পড়ে গেলো। জায়ান রাগে কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। ওর সব কিছু ধ্বংস করে দিতে ইচ্ছে করছে। ইরা বেগম পাথরের মূতি হয়ে আছে। জায়ান টেবিলের উপর দুই হাতে ভর করে ঝুঁকে আছে ওর চোখ থেকে পানি পড়ছে। জায়ান নিজেকে সামলে ওর মায়ের সামনে দাড়িয়ে শান্ত কন্ঠেই বলে উঠলো…..

— আজ তোমাকে নিজের মা বলতে ও আমার ঘৃনা করছে। ছিঃ এতটা নিচে নেমে গেলে তুমি লোভের বশে আর আমিও কত বোকা। জেমি ঠিকি বলে আমি পুরুষ নামে কলঙ্ক। সত্য মিথ্যা যাচাই না করে কত অত্যাচার করেছি ওই নির্দোষ মেয়েটাকে। ভাবতেই নিজের এই হাত এই শরীর টাকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিতে ইচ্ছে করছে। আজ থেকে তুমি আমার কাছে মৃত। ঘৃনা করি তোমাকে ঘৃনা।

বলেই হনহন করে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। জায়ান যেতেই মায়ার ঠোঁটের কোনে হাসি ফুটলো। ইরা বেগম নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে। আজ তিনি ভাষাহীন এক জীব মাত্র। জায়ান চলে যেতেই মায়া দরজা আটকে দিয়ে হাসিতে ফেটে পড়লো। ইরা বেগম অশ্রুসিক্ত চোখে মায়ার হাসি দেখছে। মায়া এসেই ইরা বেগমের সামনে হাটু মুড়ে বসে ইরা বেগমের হাতে হাত রেখে বলে উঠলো….

— সরি মামনি। প্লিজ ফরগিভ মি। বিলিভ মি, মামনি আমি যা করেছি শুধুমাত্র পরিস্থিতি সামলানোর জন্য। জায়ান কে যদি আমি আমার সত্যিটা বলে দিতাম তাহলে জায়ান এই মুহুর্তে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেত। আর তোমার আর আমার ভয়ংকর শাস্তি হতো। কিন্তু এখন দেখো জায়ান শান্ত হয়ে গেছে কারন তুমি ওর মা। তোমাকে ও চাইলেও কোনো শাস্তি দিতে পারবে না। আর জায়ান যদি এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতো তাহলে তোমার জায়গা ও রাস্তায় হতো। এইবার তুমি ভাবো আমি যা করেছি ঠিক নাকি ভুল।

বলেই মায়া একটা পৈশাচিক হাসি দিয়ে বেড়িয়ে গেলো রুম থেকে। ইরা বেগম নিঃশব্দে চোখের পানি ফেলছে।
____________________________________________
জায়ান নিজের রুমের এসেই দরজা বন্ধ করে পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। কতটা অসহায় হলে একটা ছেলে এমন করে কাঁদতে পারে সেটা জায়ান কে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।জায়ান কাঁদতে কাঁদতে নিজের হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে একাধারে দেয়ালে ঘুষি মা/রতে লাগলো। কয়েকবার ঘুষি মা/রতেই হাত ফেটে রক্ত পড়তে লাগলো। হাতের উপরের চামড়া উঠে গেছে অল্প কিছুটা। জায়ান রাগে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ঘু/ষি মা/রলো। সেখান থেকে এক টুকরো কাচ নিয়ে এলোপাথাড়ি হাতে আঘাত করতে লাগলো। নিজেকে পাগল পাগল লাগছে ওর। জায়ানের হাত থেকে রক্ত পড়ছে টপটপ করে। জায়ান জোরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলো……

— আমি তোমার সামনে কোন মুখে দাড়াব জেমি। কি করে গিয়ে দাড়াব? আমি যেই অন্যায় করেছি সেই অন্যায়ের ক্ষমা হয়না কখনো। আমি এতটা খারাপ হতে কি করে পারলাম। কি করে? আমার শাস্তি পাওয়া দরকার। খুব কঠিন শাস্তি। আমাকে শাস্তি দিবে জেমি। প্লিজ শাস্তি দাও। এই যন্ত্রনা নিয়ে আমি কি করে বেঁচে থাকব কি করে?

বলেই আবারো কাঁদতে লাগলে। ছেলেরা নাকি সহজে কান্না করেনা। আজ জায়ান কাঁদছে। অসহায়ের মতো কাঁদছে। কি শাস্তি দিবে নিজেকে ও?
____________________________________________
জেমি নিজের রুমের বেলকনিতে দাড়িয়ে আছে। কিছুক্ষন আগের ঘটনা সবটাই দরজার বাইরে দাড়িয়ে দেখেছেও। আজ জায়ান বুঝবে ও কত বড় অন্যায় করেছে। জায়ান এখন যাই করুক জেমি কখনোই জায়ান কে ক্ষমা করবে না। কাল থেকে জায়ান বুঝবে অবহেলা কাকে বলে? কাল থেকে জায়ান বুঝবে কষ্ট কাকে বলে?

–নারী যেমন মন উজাড় করে ভালোবাসতে পারে, আবার আঘাত পেলে তাকে মন থেকে ছুড়ে ফেলতেও পারে। আজ থেকে তুমি আমার ঘৃনার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকবে জায়ান। তোমাকে যতটা ভালোবেসেছে আজ থেকে ততটাই ঘৃনা আর অবহেলা করব। আর এটাই হবে তোমার শাস্তি। এই ঘৃনা আর অবহেলার কষ্টটা তোমাকে সারাজীবন বইতে হবে।

বলেই জেমি একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। আজ ওর জায়ানের জন্য কষ্ট হচ্ছে না করুনা হচ্ছে। মাকে অন্ধবিশ্বাস করার ফল ভোগ করছে ও। অন্ধবিশ্বাস আর রাগের জন্য সব হারাতে চলেছে। জেমির সকাল থেকেই গা গুলাচ্ছে বার বার। মাথা টাও ঝিম ধরে আছে। শরীরটা ক্রমশঃ নিস্তেজ হয়ে আসচ্ছে। হঠাৎ এমন হওয়ার কারন বুঝতে পারছেনা ও। জেমির মাথাটা হঠাৎ করেই ঘুরাতে লাগলো। জেমি বেলকনির গ্রীলটা শক্ত করে ধরে আছে। এখানে দাড়িয়ে থাকলে ও ঢুলে পড়ে যাবে সেটা খুব ভালো করে বোঝা যাচ্ছে।
কোনো রকম দেয়াল ধরে রুমে এসে খাটে সুয়ে পড়লো।
____________________________________________
জানালা দিয়ে সূর্যের আলো জেমির চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে গেলো ওর। ঘুম ভাংতেই মাথাটা ভার ভার মনে হচ্ছে। জেমি চোখ খুলতেই ওর চারদিক ঘুরতে লাগলো। জেমি পাশ ফিরতেই দেখলো জায়ান নিচে বসে খাটের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে আছে জায়ানের হাতটা জেমির হাতের মুঠোয়। জায়ান কে দেখতে এই মুহূর্তে নিস্পাপ মনে হচ্ছে। জায়ানের মাথায় রাখতেও জেমি হাতটা সরিয়ে নিয়ে নিজের হাতের উপর থেকে জায়ানের হাতটা সরাতেই জায়ান জেগে গেলো। জেমিকে দেখেই জায়ান উঠে দাড়িয়ে মাথা নিচু করে ফেললো। জেমি কিছু না বলে খাট থেমে পা বাড়াতেই জায়ান কাঁপা হাতে জেমির হাতটা ধরতেই জেমি সাথে সাথে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে জায়ানের দিকে ঘুরে শক্ত কন্ঠে বললো……

—এই হাত ধরার অধিকার এখন আর তোমার নেই। নেক্সট টাইম এই সাহস দেখি ও না। ফলাফল বাজে হবে।

জেমি কথাটা বলতেই জায়ান জেমির পায়ের কাছে ধপ করে হাটু ভেঙে বসে পড়ে কেঁদে উঠলো।

#চলবে