বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব-৮+৯

0
280

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৮
জাওয়াদ জামী

” আহ্ শিউলি, তুই এসব কি শুরু করেছিস? এ আহাজারির কি হয়েছে! তোর কি মিনিমাম সম্মানটুকুও নেই? একে-তো অন্যায় করেছিস, তার উপর এভাবে গলা চড়াচ্ছিস! ধন্যি মেয়ে তুই। একটুতো লজ্জা কর। ” শাহনাজ সুলতানার গলায় ব্যঙ্গ স্পষ্ট।
এবার যেন জোঁকের শরীরে লবন পরল। থেমে
গেল শিউলির আহাজারি।

নাজমা পারভিনের মেয়ে মাইশা আর শাহনাজ সুলতানার ছেলে-মেয়ে আনান, আরোশী তিনজন অনেকদিন পর নানুর বাড়িতে এসেছে। তাই ওরা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কুহু আর শিহাবকেও ওদের সাথে নিয়েছে। দৃষ্টিকেও ওরা বলেছিল, কিছু দৃষ্টি ওর মায়ের সাথে কাজ করছিল তাই যেতে পারেনি।
আনান এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিবে। আর আরোশি আগামী বছর এসএসসি দিবে। আনান দৃষ্টির থেকেও কুহুকে বেশি পছন্দ করে। দৃষ্টির কিছু কিছু জিনিস ওর পছন্দ হয়না। তার মধ্যে আছে কুহুকে খোঁ’চা মেরে কথা বলা আর সব জায়গায় নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করা। যদিওবা আনান কুহু আর আরোশিকে আলাদা দৃষ্টিতে দেখেনা তবুও দৃষ্টি বারবার কুহু আর আনানকে নিয়ে টিটকারি মারে। এসব কারনে আনান চুড়ান্ত পর্যায়ের অপছন্দ করে।

রাতে কায়েস বাড়ি ফিরে বোনদের দেখে অবাক হয়ে যায়।
” আপা তোমরা কখন এসেছ? আমাকে জানাওনি যে! তোমরা সবাই কেমন আছো? ” ভাগ্নে-ভাগ্নীদের আদর করতে করতে কায়েস বিস্মিত হয়ে জানতে চায়।
” আমরা সেই দুপুরে এসেছি। বাবার বাড়িতে এসেছি এখন তোকে জানানোর দ্বায়িত্ব তোর আদরের বউয়ের। সে যদি ননদদের দেখে ভয় পেয়ে তোকে না জানায় এই দোষ কি আমাদের? ” নাজমা চোখের সামনে অন্যায় দেখলে কিছুতেই নিজের মুখকে সামাল দিতে পারেনা।
কায়েস মেজো বোনের কথা শুনে মুখ কালো করে। সত্যিই তো আপারা সেই দুপুরে এসেছে কিন্তু শিউলি এ কথা তাকে জানায়নি!
” এসব কথা বাদ দাওতো আপা। আমি মুখহাত ধুয়ে এসে সবাই একসাথে খাব। কতদিন আমরা ভাই-বোনেরা একসাথে খাইনা। ” কায়েস কলপাড়ে যায় মুখহাত ধুতে।
ততক্ষণে শিউলি ভাত-তরকারি সাজিয়ে দিয়েছে বারান্দার মেঝেতে। বিছিয়ে দিয়েছে মাদুর।
ছেলে-মেয়েরা একে একে সবাই হাত ধুয়ে এসে বসেছে মাদুরে।
কায়েস বোনদের মাদুরে বসতে বলে নিজেও বসে।
” শিউলি, তুই ও বস আমাদের সাথে। আজ সবাই একসাথে খাই৷ ” আফরোজা নাজনীন স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললেন।
” না আপা, আপ্নেরা ভাই-বোন মিল্লা একসাথে খান। আমি পরে খামুনে। ”
” আরে বস, আজ একসাথে খাই। এতদিন তো একাই খেয়েছিস আজ আমাদের সাথে খা। ” নাজমা পারভিন বাচ্চাদের প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বলেন।
মায়ের কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠে মাইশা।
” ও আম্মু, তুমি মামিমাকে একেক সময় একেক ভাবে সম্মোধন কর কেন? একবার তুই বলো তো আরেকবার তুমি। এটা কেমন ডাক বলতো? দিনদিন তোমার স্মৃতি বোধহয় কমে যাচ্ছে! ”
” চুপ থাক৷ এত কথা বলিস কেন? বড়দের মাঝে কথা বলার বদঅভ্যাস রপ্ত করলি কবে থেকে? এই শিক্ষা দিয়েছি তোকে। ” মায়ের হুং’কা’র শুনে চুপসে যায় মাইশা।
” শিউলি আমার ভাগ্নে-ভাগ্নীদের ঠিকমত খাওয়াও। ভালো দেখে মাংস দাও। দেখি বাটি আমার কাছে দাও। আমিই তুলে দিচ্ছি আমার আব্বা-আম্মাদের। ” কায়েস মাংসের বাটি নিয়ে বেছে বেছে মাংস তুলে দেয়। তাই দেখে শিউলি আক্তার ভেতরে ভেতরে ফুঁ’স’তে থাকে।
ছেলে-মেয়েদের পাতে মাংস তুলে দেয়ার পর দেখা যায় বাটিতে দু-চারটা হাড় রয়েছে। অথচ বড়দের পাতে এখনও মাংস উঠেনি। ওরা তিন বোন মাছ ভাজা আর বেগুন ভাজা দিয়েই খেতে থাকে। কায়েস শিউলির কাছে আরও মাংস চাইলে শিউলি জানায় মাংসের তরকারি বাটিতে যা আছে তাই। এতে কায়েস বেশ অবাক হয়। বাচ্চাদের পাতে দিতেই মাংস শেষ! অথচ এখনও তার বোনদের খাওয়া হয়নি।
” তুই চুপ করে খা। ছেলে-মেয়েরা মাংস খাচ্ছে এতেই হবে। আমাদের খাওয়া লাগবেনা। শিউলি, কায়েসের প্লেটে মাংসের তরকারির যা আছে তাই দে। ” আফরোজা নাজনীন মুখে খাবার তুলতে তুলতে কথা বলেন।
কায়েসের আজ শিউলির উপর ভিষণ রা’গ হচ্ছে। এই বেয়াক্কেল মহিলা বোধহয় একটা হাঁস জবাই করেছে৷ এর কি কাণ্ডজ্ঞান লোপ পেয়েছে!
কোন ঝামেলা ছাড়াই খাওয়া শেষ করে সবাই।
উত্তরের ঘরের বারান্দায় বসেছে ভাই-বোন মিলে। বাচ্চারা কুহুর ঘরে আড্ডায় মেতেছে।
শিউলি নিজ ঘরে প্লেটে খাবার নিয়ে এসেছে। ভাতের প্লেট টেবিলের উপর রেখে আলমারির ভেতর থেকে ঢাকনা আঁটা বক্স বের করে। খাটে এসে বসে বক্সের ঢাকনা খুলে ভাতের উপর ঢেলে নেয় তিন টুকরা মাংস আর ঝোল। সে রান্নার পরপরই একটুকু তরকারি তুলে রেখেছিল। এত কষ্ট করে হাঁস কেটে, বেছে শেষ পর্যন্ত কিনা খেতে পারবেনা এটা হতে পারেনা।

আগামীকাল থেকে তাহমিদের পরিক্ষা শুরু। ও মনযোগ দিয়ে পড়ছে। তাহমিনা আক্তার বেশ কয়েকবার এসে খেতে ডেকেছে কিন্তু ও এখন খাবেনা। একবারে শোয়ার আগে খাবে। তাহমিনা আক্তার টেবিলে খাবার ঢেকে রেখে তাহমিদের রুমে এসে ওর বিছানায় শুয়ে পরে।
” মা, তুমি এখানে শুচ্ছ কেন! আমার পড়া শেষ করতে রাত তিনটা বাজবে। এতক্ষণ রুমের লাইট অন থাকবে। তোমার ঘুম হবেনা৷ তুমি তোমার রুমে যাও। ”
” আমার সমস্যা নেই। তুই পড়। আমি রুমে গেলে তুই তো আর পড়া শেষ করে ডাকবিনা। তাই তোর পড়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি এখানেই আছি। তোর শোয়ার আগে খাবার গরম করে, তোকে খাইয়ে তারপর আমার রুমে যাব। ”
তাহমিদ বুঝল ওর মা এখন এখানেই থাকবে। তাই কোন প্রত্যুত্তর না করে পড়ায় মনযোগ দেয়।

সকালে ঘুম থেকে উঠে আবার বই নিয়ে বসে তাহমিদ। একটু বইয়ের পাতায় চোখ বুলিয়ে নেয়। কিছুক্ষণ পর ওর মা এসে খাইয়ে দেয়। এরপর তৈরি হয় সে। তবে পরিক্ষা দিতে যাওয়ার আগে বড়মার সাথে কথা বলতে হবে৷ ফোন হাতে নিয়ে বড়মার নম্বর বের করে তার উপর আঙুল ছোঁয়ায়। আজ ও নতুন একটা নম্বর থেকে ফোন করেছে বড়মার কাছে। যেটা বড়মার ফোনে সেইভ করা নেই। আননোন নম্বর দিয়ে বড়মার সাথে একটু দুষ্টুমি করবে ও।
আফরোজা নাজনীনের ফোন বেজেই চলেছে। পরপর দুইবার ফোন বেজে আবার কেটেও যায়।
কুহু একটা কাজে নিজের ঘরে এসে ফুপুর ফোনের রিংটন শুনতে পায়। টেবিলের উপর থাকা ফোন হাতে নিয়ে দেখে আননোন নম্বর। এবারেও কেটে গেছে। কুহু দেখল এর আগেও তিনবার ফোন এসেছে একই নম্বর থেকে। ফোন কুহুর হাতে থাকা অবস্থায়ই আবার বেজে ওঠে।
কুহু একটু চমকায়। এদিকে ফুপুও বাড়িতে নেই৷
যদি গুরুত্বপূর্ণ কিছু হয় এই ভেবে রিসিভ করে কুহু।
” আসসালামু আলাইকুম। ফুপুতো বাড়িতে নেই। একটু বাইরে গেছে। ”
অতি পরিচিত গলার আওয়াজ শুনে তাহমিদের বুকের ভিতর ধুকপুক করছে। উত্তেজনায় হাত-পা কাঁপছে। এই মুহূর্তে প্রচন্ড পিপাসা পেয়েছে ওর। সে কি প্রত্যুত্তর দেবে এই মেয়ের কথার!
এদিকে কুহু কথা বলে চুপ করে থাকে অপরদিকের উত্তর শোনার আশায়।
” ওয়ালাইকুমুসসালাম। বড়মা, আসলে বলো আমি পরিক্ষা দিতে যাচ্ছি। ” এক নিশ্বাসে বলে তাহমিদ।
কুহুর শরীর অবশ হয়ে আসছে তাহমিদের গলা শুনে। ও কোন কারন ছাড়াই এই ছেলেটাকে ভয় পায়। হঠাৎই মনে হয় সেদিনের কথা। সাথে সাথে চোখের কোনে পানি এসে জমে। অনেক কষ্টে উত্তর দেয়,
” আ..আচ্ছা আমি ফু..ফুপুকে বলব। রাখছি। ” কুহু ফোন কাটতে নিলেই পুনরায় কথা বলে তাহমিদ।
” কংগ্রেচুলেশন। খুব ভালো থেকো। ” বলেই ফোন কেটে দেয়।
এদিকে কুহু হতভম্ব হয়ে গেছে। তাহমিদ ভাইয়া কেন ওকে কংগ্রেচুলেশন জানাল!

চলবে….

#বিন্দু_থেকে_বৃত্ত
#পার্ট_৯
জাওয়াদ জামী

আফরোজা নাজনীন ভেতর বাড়িতে আসলে কুহু জানায় তাহমিদ ফোন দিয়েছিল। আফরোজা নাজনীন ঘরে এস ফোন হাতে নিয়ে দেখলেন আননোন নম্বর থেকে ফোন এসেছিল । আফরোজা নাজনীন কল ব্যাক করলেন৷
” আসসালামু আলাইকুম বড়মা। বাবার বাড়িতে যেয়ে আমাকে ভুলে গেছ। ফোন করেও তোমাকে পাওয়া যায়না। ” মন খারাপের ভান ধরে তাহমিদ।
” ওয়ালাইকুমুসসালাম। আমি কাউকেই ভুলিনি বাপ। একটু ব্যস্ত ছিলাম। ফোন সাথে ছিলনা তাই রিসিভ করতে পারিনি। নাস্তা করেছিস? তুই কখন বেরোবি? মনযোগ দিয়ে পরিক্ষা দিবি। পরিক্ষার পর আমাকে ফোন করে জানাবি কেমন হয়েছে। ” একনাগারে কথাগুলো বলে থামলেন আফরোজা নাজনীন।
” আমি রাস্তায় আছি বড়মা। মা খাইয়ে দিয়েছে। তুমি চিন্তা করোনা। বেশি করে দোয়া করো। পরিক্ষা শেষ করে বেরিয়েই তোমাকে জানাব। ”
” সাবধানে থাকবি বাপ। একদম টেনশন করবিনা। ”
আরও কিছু উপদেশ দিয়ে ফোন রাখেন আফরোজা নাজনীন।

সকালে খাবার পর আফরোজা নাজনীন দুই বোনকে নিয়ে শিউলি আক্তারকে কাজে সাহায্য করছেন। কায়েস বাজার থেকে খাসির মাংস, বড় তিনটা কাতলা মাছ, গলদা চিংড়ি কিনে পাঠিয়েছে। ওরা সবাই মিলে সেগুলোই কাটছে। একে একে সব কেটে, বেছে রান্নাঘরে নিয়ে যায়। কয়েক পদ রান্না হবে আজকে।
ছেলে-মেয়েরা এদিক-সেদিক ঘুরছে। কিন্তু কুহুর মন পরে আছে বাড়িতে ফুপুদের কাছে। তাই।মাইশাকে বলে ও বাড়িতে চলে আসে। উঠানে পা রেখেই বুঝতে পারল ফুপুরা রান্নাঘরে আছেন। কুহু এসে রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ায়।
” কি রে কুহুতান, তুই একা কেন? আরগুলো কই? ” নাজমা পারভিন মাছ ভাজতে ভাজতে কুহুকে জিজ্ঞেস করলেন।
” ওরা সবাই মাঠে আছে। আমার ভালো লাগছিলনা তাই চলে আসলাম। ” কুহু একটা পিড়িতে বসে জবাব দেয়।
আরেকটা চুলায় আফরোজা নাজনীন মাংস কষাচ্ছেন। শিউলি আক্তার তাদের পাশে বসে এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে।
শাহনাজ সুলতানা বসে বসে তাদের কাজ দেখছে। কুহু ছোট ফুপুর পাশে বসে তাদের কাজকর্ম দেখতে থাকে।
” কুহুতান, তুই তো বললিনা তোর গালে কি হয়েছে? এভাবে ফুলে, কালচে হয়েছে কেন গালগুলো? ” নাজমা পারভিনের প্রশ্ন শুনে শিউলির মুখ শুকিয়ে যায়। যদি কুহু সত্যি বলে দেয় তবে ওকে ননদরা আস্ত রাখবেনা।
” এ্যালার্জির জন্য এমন হয়েছে ফুপু। তুমি তো জানোই আমার এ্যালার্জি আছে। ” আমতা আমতা করে জবাব দেয় ফুপু।
” এ্যালার্জি থাকলে কেমন হতে পারে সে সম্পর্কে ভালোই ধারনা আছে আমার। তাই আমি চাইবনা আমার সাথে তুই মিথ্যা বলিস। সে হিসেবে এখন ধরে নিলাম তুই মিথ্যা বলছিসনা। কিন্তু পরে যদি এই মিথ্যার আড়ালের সত্য আমার কানে আসে তবে আমি যে কি করতে পারি সেটা ভুলে যাসনা। ” নাজমা পারভিনের হু’ম’কি শুনে কুহু মাথা নিচু করে থাকে।
আর শিউলিতো রীতিমত ঘামছে। তবে কি ওর ননদেরা জানতে পেরেছে!
একে একে রান্না শেষ করে ওরা গোসল সেরে নেয়। ছেলে-মেয়েরাও গোসল সেরে বারান্দায় বিছানো মাদুরে গিয়ে বসে। আজ সবকিছু রান্না করে সেগুলো নিজ তত্বাবধানে রেখেছেন নাজমা পারভিন। কারন তিনি গতরাতেই বুঝেছেন শিউলি মাংসের তরকারি সরিয়ে রেখেছিল। তাই আজ তিনি শিউলিকে সেই সুযোগ দেননি। নিজের হাতে সবকিছু সাজিয়ে-গুছিয়ে রেখেছেন।
নাজমা পারভিন নিজ হাতে সবাইকে খেতে দেন। সুন্দরমত একে একে মাছ, মাংস দিয়ে খাওয়ান। তবে ওদেরকে খেতে দেয়ার আগে কায়েসের জন্য সব আইটেম তুলে রেখেছেন।
আফরোজা নাজনীন কুহুকে নিজের পাশে বসিয়ে খাওয়াচ্ছেন। তা দেখে শিউলি ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে।

তাহমিদ পরিক্ষা শেষ করে বাসায় এসেছে। খুবই ভালো হয়েছে ওর পরিক্ষা। রুমে ঢুকেই বিছানায় সটান হয়ে শুয়ে পরে। পকেট হাতড়ে ফোন বের করে বড়মার নম্বরে সংযোগ করে। মনে মনে চাইছে সকালের এবারও কুহু রিসিভ করুক। কিন্তু ওর মন খারাপ করে দিয়ে আফরোজা নাজনীন কথা বলেন। তাহমিদ জানায় ওর পরিক্ষা খুব ভালো হয়েছে। এতে ওর বড়মা খুব খুশি হন। তাহমিদ ক্ষুধার্ত থাকায় বেশিক্ষণ কথা বলা হয়না। ফোন রেখে ফ্রেশ হয়ে নিচে আসে খেতে। খাওয়া শেষ করে রুমে এসে একটা লম্বা ঘুম দেয়। একঘুমে সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। তাহমিদ কিছুক্ষণ ঝিম মেরে শুয়ে থাকে। এরপর উঠে ফ্রেশ হয়ে সোজা ছাদে আসে। আজও সেই হাসনাহেনা গাছ ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। তাহমিদ মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় এগিয়ে যায় গাছের দিকে। আঙ্গুল দিয়ে আলতোভাবে ছুঁয়ে দেয় ফুলগুলো। আজকাল এই ফুলগুলোর মাঝেই কুহুকে খুঁজে পায় তাহমিদ। শুধু কুহু এই গাছটা লাগিয়েছে বলেই এক অজানা আকর্ষনে বারবার ছুটে আসে ছাদের এই গাছের নিকট। যে মেয়েকে একটা সময় বিরক্ত লাগতো অথচ আজ সেই মেয়েকে নিয়েই ভাবতে ভিষণ ভালো লাগে। সেই ভীরু চাহনি, অকারণেই ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া, লম্বা চুলের বেনী এমনকি তার সবকিছুই এখন মনে পরলে তাহমিদের বুকে শিহরণ জাগায়। এগুলো কি প্রেমে পরার লক্ষণ? তাহমিদ মনে মনে ভাবে, তবে কি ও প্রেমে পরেছে! এভাবেও কি প্রেম হয়! না-কি কুহুর সাথে হওয়া অ’ত্যা’চা’রে’র কথা শুনে ওর প্রতি সহানুভূতি জন্মেছে? কিন্তু যদি এটা শুধু সহানুভূতিই হবে, তবে কেন তাকে নিয়ে ভাবতে এত ভালো লাগে? কিংবা তাকে দেখার জন্য, তার গলার আওয়াজ শোনার জন্য মনটা এত আকুলিবিকুলি করে? আজ সকালেই যেমন ওর গলার আওয়াজ পেয়ে তাহমিদের ধরনী আনন্দে দুলে উঠেছিল। পিপাসায় ওর বুক শুকিয়ে গিয়েছিল যেন সাতসমুদ্রের পানিতেও সেই পিপাসা মিটবেনা। এগুলোও কি সহানুভূতি? তাহমিদ ধপ করে বসে পরে ছাদে। নিজের সাথে কঠিন বোঝাপড়া করা প্রয়োজন। ওর প্রথমে বুঝতে হবে কুহুর প্রতি ওর আকর্ষনটা কিসের। সহানুভূতি নাকি প্রেম।

তাহমিনা আক্তার ছেলের রুমে এসে ওকে না দেখতে পেয়ে সারা বাড়ি তন্নতন্ন করে খুঁজে ও পাননা। একসময় ছাদে এসে দেখলেন তার ছেলে ছাদে টানটান হয়ে শুয়ে একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। দু-হাত বালিশের ন্যায় মাথার নিচে দিয়ে রেখেছে। ছেলেকে এভাবে শুয়ে থাকতে দেখে প্রায় ছুটে আসেন তিনি৷
” তাহমিদ, তোর কি হয়েছে বাবা? এখানে, এভাবে শুয়ে আছিস কেন? তুই উঠতো বাবা, আমার সাথে নিচে চল। ” তাহমিনা আক্তারের গলায় উদ্বেগ।
মায়ের আওয়াজ পেয়ে ঘুরে তাকায় তাহমিদ।
মায়ের হাত ধরে টান দিয়ে তাকেও নিচে বসায়। তাহমিনা আক্তার বসলে তার কোলে মাথা রাখে তাহমিদ৷
” একটা প্রশ্ন করি, উত্তর দিবে মা? ”
” মাকে প্রশ্ন করবি তাতে জিজ্ঞেস করার কি হলো পাগল ছেলে। ”
মায়ের সম্মতি পেয়ে মুচকি হাসে তাহমিদ৷
” আচ্ছা মা, সহানুভূতি আর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য কি? ”
ছেলের আচমকা এমন প্রশ্নে হকচকিয়ে যান তাহমিনা আক্তার। ছেলেকে দেয়ার জন্য যুৎসই উত্তর খুঁজতে থাকেন। তাহমিদও মাকে গুছিয়ে নেয়ার সময় দিয়ে নীলচে তারা দেখতে থাকে।
প্রায় অনেকক্ষণ পর মুখ খোলেন তাহমিনা আক্তার।
” ভালোবাসা আর সহানুভূতি দুজনের অবস্থান সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে। কারো প্রতি ভালোবাসা জন্মালে তার সবকিছুই বড্ড আপন লাগে। তার ছোট ছোট দোষ-ত্রুটি সত্ত্বেও তাকে জয় করতে জীবন বাজি রাখতেও দুবার ভাবতে হয়না। তার হাসি, তার কথা বলা, তার প্রতিটা খুটিনাটি বিষয়ও ভাবতে ভালো লাগে। তাকে প্রতিক্ষণেই দেখতে ইচ্ছে করে, তাকে আলতোকরে ছোঁয়ার সাধ জাগে। তার গলার আওয়াজ শুনলে বুকে হাঁসফাঁস করে। সে সর্বক্ষণ বাস করে বুকের ঘরে। যে জায়গাটা একান্তই তার। সেখানে আর কারো অস্তিত্ব থাকবেনা। যে রাজত্বে একমাত্র সেই রানী।
আর সহানুভূতি হলো কেউ দুঃখী বা কষ্টে আছে তা জানার পর তার বিপদেআপদে ঝাঁপিয়ে পড়া। তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া। তার উন্নতির পথে নিজেকে সামিল করা।
তবে মনে রাখিস যার প্রতি তোর সহানুভূতি জন্মাবে তাকে সারাজীবন বন্ধু হিসেবেই ভালোবাসবি, জীবন সঙ্গী হিসেবে নয়।
আর যেখানে ভালোবাসা জন্মায় সেখানে সহানুভূতির কোন স্থান থাকেনা। ভালোবাসা এবং একমাত্র ভালোবাসা দিয়েই তাকে জয় করতে হয়। সহানুভূতি ভালোবাসার ভেতর ঢুকে পরলে সেটাকে ভালোবাসা বলেনা সেটা স্রেফ দ্বায়িত্বে রুপান্তরিত হয়। ”
তাহমিদ মায়ের ব্যাখ্যা শুনে তাকে জড়িয়ে ধরে।
” থ্যাঙ্কস মা। আমার সকল সংশয় দূর হল ”
” আমি বাবা তোদের মত এত গাদাগাদা বই পড়িনি তাই তোদের মত এত ভাবুক কথাও জানিনা। তোর প্রশ্ন শুনে মনে যা আসল তাই বলে দিলাম। ”
” তুমি যা বলেছ তাতেই আমার সকল সংশয়ের দ্বার খুলে গেছে। এখন নিচে চল আমার ক্ষুধা লেগেছে। ” তাহমিনা আক্তারকে কিছু বলতে না দিয়ে টেনে নিচে নিয়ে আসে তাহমিদ।

চলবে…