বিবর্ণ বসন্ত পর্ব-০১

0
448

#বিবর্ণ_বসন্ত
সূচনা_পর্ব
~মিহি

‘বিয়ের এক সপ্তাহ না হতেই নতুন বৌ বাজার করতে গেল! এ কেমন কথা ছোট ভাবী। আমাদের ছেলে কি অপদার্থ নাকি? যাই বলো এ বউয়ের চরিত্রে দোষ আছে বলে দিলাম।’ রান্নাঘরে বাজারের ব্যাগটা রেখে শাড়ির আঁচলে ঘাম মুছতে মুছতে শাশুড়ির ঘরে পা রাখতেই ফুফু শাশুড়ির কথা কানে এলো অনামিকার। চোখের কোণে জল জমতে সময় নিলো না তার। শাশুড়ির নিশ্চুপ থাকাটা যেন আরো ক্ষত করলো তাকে। নিশ্চুপ ভঙ্গিতেই স্থান ত্যাগ করলো সে।

-‘ছোটো, সবসময় মানুষকে অপমান করার মধ্যে শান্তি খুঁজিস না। ছোট বউ দায়িত্ব থেকে বাজার করতে গেছে। আজ যদি সোহরাব অসুস্থ হতো তবে কি সে বাজার করতে যেত না? এতটুকু বিষয়কে বাড়িয়ে-চাড়িয়ে এলাহি কাণ্ড বাঁধিয়ো না।’

-‘তুমিও আমার দোষ দেখলা ভাবী! ভালো করতে নাই কারো। হুহ!’ গজগজ করতে করতে ভাবীর ঘর ত্যাগ করলে রাহেলা বানু। সাজিয়া শেখ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তার ছোটো ননদ বরাবরই এমন। মানুষের দোষ ত্রুটিকে বড়সড় আকারে উপস্থাপন করে মানুষকে হীন করতে তার ভালো লাগে। অনামিকা তো ভুল কিছু করেনি। অনামিকা বাজারে যাওয়ার আগে সাজিয়া শেখের অনুমতি নিয়েই সম্পূর্ণ পর্দার মধ্যেই বাজারে গেছে। তাছাড়া মেয়ে বলে কি বাইরে গিয়ে ঠাড়ির দায়িত্ব পালনের অধিকার তার নেই নাকি! রাহেলাকে হাজার বুঝিয়েও যেন তার স্বভাব এতদিনেও পরিবর্তন করতে পারেননি তা দিব্যি বুঝলেন তিনি। আলনার কাপড়গুলো ভাঁজ করে উদাসীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন স্বামীর ছবির ফ্রেমটাতে।

এ বাড়িতে আসার পর নেহাতই কম অত্যাচারিত হননি সাজিয়া। তখন রাহেলাই সবচেয়ে বেশি মানসিক কষ্ট দিত সাজিয়াকে। কারণে অকারণে অপমান করে ত্যাক্ত বিরক্ত করে ফেলতো তাকে। সাজিয়া অনাথ পরিবারের মেয়ে। শাশুড়ি খুব যত্ন করে তাকে এ বাড়িতে আনলেও স্বামীর ভালোবাসা তার কস্মিনকালেও পাওয়া হয়নি। তার একটা কারণ ছিল রাহেলা, সবসময় আজমীরকে সাজিয়ার বিরুদ্ধে যা তা বলে ক্ষেপিয়ে রাখতো। শ্বশুর শাশুড়ির হাজার ভালোবাসা পেলেও দিনশেষে স্বামীর কাছেই ফিরতে হয়। সেখানে যদি একটুকু ভালোবাসা কিংবা শান্তির পরশ না পাওয়া যায় তবে কষ্ট কি কমে? সাজিয়া শেখ জানেন রাহেলা এখন সোহরাবের কাছে গিয়ে উল্টোপাল্টা বলবে নিশ্চিত আর সোহরাবও বাবার স্বভাব পাওয়া ছেলে। রেগে গেলে বুদ্ধিবৃত্তি লোপ পায় তার। সাজিয়া কাপড় রেখে দ্রুত সোহরাবের ঘরের দিকে গেলেন।

সোহরাব ঘরে নেই। একটু আগেও সে বিছানায় পড়ে পড়ে ঘুমোচ্ছিল। অনামিকা বেশ কয়েকবার বাজার যাওয়ার কথা বললিও কানে তোলেনি। সে ছেলে হঠাৎ গেল কোথায়? আশেপাশে খুঁজে রাহেলা বানুকেও দেখতে পেলেন না সাজিয়া। অদ্ভুত একটা ভয় মনে দানা বাঁধতে থাকলো। না জানি এবার অনামিকার সংসারে কোন আগুন লাগাতে এসেছে রাহেলা।

-‘মা, ছোট মাছ এনেছিলাম। চচ্চড়ি করবো নাকি ভর্তা?’

-‘ভর্তাই করো। একা একা সব রেঁধে মাকে ডাকতে এসেছো?’

-‘না মা। ভাত রেঁধেছি আর মাছের ঝোল শুধু। আর কী কী করবো আজ্ঞা করুন।’

সাজিয়া হাসলেন। বড়োই ভাগ্য করে এমন বৌমা পেয়েছিলেন। অনামিকাকে যখন তিনি দেখতে গেলেন তখন বাবা হারানো মেয়েটা তিনটে টিউশনি করে ক্লান্ত বিরস মুখে সাজিয়া শেখের সামনে বসলেও ক্ষণিকেই হাস্যোজ্জ্বল চোখে সাজিয়ার সকল প্রশ্নের জবাব দিয়েছিল। সেদিন সাথে করে রাহেলাকে নিয়ে যাওয়ার ভুল তিনি করেননি। করলে বোধহয় অনামিকাকে পেতেন না।

-‘মা, আমার বাজারে যাওয়া নিয়ে আপনি কি অসন্তুষ্ট?’

-‘অসন্তুষ্ট হলে তখন অনুমতি দিতাম না মা।’

-‘ফুফু বোধহয় পছন্দ করেননি।’

-‘আঁড়ি পেতে কথা শোনা হচ্ছিল?’

-‘না মা, আপনাকে ডাকতে যাচ্ছিলাম।যে কী কী রাঁধবো তখন কানে এসেছে।’

-‘দেখ মা, তোর ফুফু এ বাড়ির মেয়ে। সে এখানে আছেই কিছুদিন। তার আচরণ খারাপ লাগলেও মুখের উপর কিছু বলবি না, আমাকে এসে বলিস। আমি দেখবো।’

-‘আমি ফুফুর কথায় কষ্ট পেয়েছি মা তবে তার জন্য তর্ক করতে যাবো এমন শিক্ষা আমি পাইনি।’

সাজিয়া শেখ নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। আসলে মেয়েদের এ শিক্ষাটা প্রয়োজন ছিল। গুরুতুল্য বলে মাথায় তুলতে তুলতে মেয়েরা প্রতিবাদ করতে ভুলে যায় আর ঠিক সে কারণেই শারীরিক মানসিক অত্যাচারগুলোর সাক্ষী হতে হয় তাদের।

‘আম্মা! আম্মা বাইরে আসো তো।’ সোহরাবের চেঁচামেচিতে বাইরে এলেন সাজিয়া। পেছন পেছন অনামিকাও এলো। সোহরাবের চেঁচামেচি শুনে রাহেলাকেও উপস্থিত হতে দেখা গেল অথচ এতক্ষণ তিনি যেন অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিলেন।

তিনটে বাজারের ব্যাগ ধপ করে মাটিতে ফেলে খানিকটা দাম্ভিক দৃষ্টিতে অনামিকার দিকে তাকালো সোহরাব।

-‘আম্মা, আগামী একমাসের বাজার আমি এনে রাখলাম। তাও যেন বাড়ির বউ দুশ্চরিত্রা মেয়েলোকের মতো বাজারে না ঘুরে বেড়ায়।’

-‘বাজারে গেলেই বুঝি মানুষ দুশ্চরিত্র হয়ে যায়?’

-‘আমি আমার মায়ের সাথে কথা বলছি অনামিকা। আর তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি। বেশি কথা বলা আমার পছন্দ না।’

হনহন করে উঠোন ছেড়ে ঘরের দিকে এগোলো সে। রাহেলা বানুর চোখেমুখে হতাশার ছাপ স্পষ্ট দেখতে পেলেন সাজিয়া। বোধহয় আরেকটু গণ্ডগোল আশা করেছিল সে। সাজিয়া চুপচাপ বাজারের ব্যাগগুলো তুলে রান্নাঘরে যেতেই অনামিকার ডাক পড়লো। সোহরাব ডাকছে তাকে। রাহেলা বানু উৎসুক দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছেন। সোহরাবের কানে অনামিকার নামে আগুনটা ভালোই লাগিয়েছেন তিনি। এ পরিবারের ছেলেগুলো তো আজন্ম রগচটা মাথামোটা। রাহেলা যা বলেছে দিব্যি বিশ্বাস করে এবার অনামিকাকে ঠিকই ঝাড়বে সোহরাব।

___________________

-‘দেখো অনামিকা, এরপর থেকে যা প্রয়োজন আমাকেই বলবে তবে শুক্রবার সকাল সকাল না। সারা সপ্তাহ অফিস করে এ দিনটাতে আমি প্রচণ্ড ক্লান্ত হয়ে ঘুমাই। সহজে ডাকলে উঠিনা। তাই বলে যে তোমাকে বাজার সদাই করতে হবে সেরকম না। বাড়ির বউ, বাড়িতে থাকো, সংসার সামলাও।’

-‘কিন্তু আমার পড়াশোনা? আপনি তো বলেছিলেন…’

-‘বাজারে যেতে নিষেধ করেছি, কলেজ নিশ্চয়ই বাজার না? তাছাড়া তুমি তো মহিলা কলেজে পড়ো। সেখানে অনিরাপত্তার তেমন কিছু নেই। সামনেই তো এইচএসসি, সংসার সামলিয়ে পড়াশোনায়ও মন দিও।’

অনামিকার একবার বলতে ইচ্ছে হলো,’আপনি কি এতটাই অবিশ্বাস করেন আমায়?’ কিন্তু বলতে পারলো না। না ভেবে চট করে বলা কথা সংসারে অশান্তি বাড়ায়।

সোহরাবরা দুই ভাই, দুই বোন। বড় ভাই বিয়ে করে বিদেশে সেটেল্ড, এদিককার খবর রাখে না। এক বোন বিবাহিত, অন্যজন মাত্র এসএসসি দিয়েছে। ছোট ননদ সুমি বেশ মিশুক স্বভাবের তবে এখন বাড়িতে নেই। গত পরশুই সে এক বান্ধবীর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছে নাহলে সেও ছিল অনামিকার পাশে থাকার জন্য।

-‘কী হলো কথা বলছোনা কেন? মুখ কি সেলাই করা?’

-‘না কিছুনা। ভাত বাড়বো?’

-‘বেশি মাতব্বরি করলে যা হয়। শুক্রবার সকালবেলা আমি পরোটা ছাড়া কিছু খাই না। বাড়িতে তো পাবো না, বাইরে থেকেই খেয়ে আসি।’

আবারো ঝটপট বেরিয়ে যায় সোহরাব। অনামিকা নিজের উপর বিরক্ত হয়। লোকটা তার জন্য না খেয়ে বেরিয়ে গেল! বিরসমুখে সে রান্নাঘরে গিয়ে ভর্তা করার প্রস্তুতি নিল।

-‘অনু মা, মন খারাপ?’

-‘সোহরাব সকালে পরোটা খায় মা। আমি তো জানতাম না। আমার জন্য লোকটা না খেয়ে বেরিয়ে গেল।’

-‘সোহরাব পরোটা খায়?’

সাজিয়ার বলতে ইচ্ছে হলো সোহরাব কখনো শুক্রবার সকালে পরোটা খায় না। অনামিকাকে হীন করার এ একটা প্রচেষ্টা মাত্র! কিন্তু অনামিকাকে এ সত্যি বললে মেয়েটা আরো কষ্ট পাবে।

-‘এ বাড়ির পুরুষ মানুষগুলো সব বদমেজাজি ভেড়া! এদের মাথায় রাগ ব্যতীত বুদ্ধিসুদ্ধি নাই। এদের রাগ সামলাতে পারলেই সব পারবা।’

অনামিকা ঠোঁট টিপে হাসলো।

-‘হেসো না মেয়ে। তোমার শ্বশুরকে তো দেখোনি! কী রাগ যে তার! বিয়ের রাতে বেল্ট দিয়ে আমাকে মারতে এসেছিলেন।’

অনামিকা অবাক না হয়ে পারলো না, ‘বাবা বিয়ের রাতে আপনাকে বেল্ট দিয়ে মেরেছেন?’

চলবে…