#বিবাহিতার সাতকাহন
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ২২/ শেষ পর্ব (১ম অংশ)
বিরক্ত হয়ে এবার দরজাটা খুললাম। ভাবতে লাগলাম এবার দরজার ওপাশে কেউ না থাকলে ম্যানেজারকে কমপ্লেইন করে আসব। এই ভেবে দরজাটা খুলে লক্ষ্য করলাম নুহাশ দাঁড়িয়ে আছে। বিরক্ত গলায় বলে উঠল
“এতক্ষণ যাবত কলিং বেল চাপলাম তুমি কোথায় ছিলে? আর মোবাইল কোথায়? তোমাকে কল দিয়ে পাচ্ছি না।”
আমি নুহাশকে কী উত্তর দিব বুঝতে পারছি না। আমতা আমতা করতে লাগলাম। এর মধ্যে নুহাশ আবার বলে উঠল
“মুমু আমতা আমতা করছো কেন? কী হয়েছে?”
মুখের জড়তা কাটিয়ে উত্তর দিলাম
“মোবাইলটা ব্যাগ থেকে বের করতে ভুলে গিয়েছি। আর আমি শুদ্ধকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আর তুমি তো বললে আসতে আসতে কাল রাত হবে। আজকে কী কাজ শেষ?”
নুহাশ তাড়া দেখিয়ে বলতে লাগল
“কাজ তো সবে শুরু। ভুল করে অফিসের কিছু ডকুমেন্টস ফেলে গিয়েছি। ঐগুলো নিতে হবে।”
কথাগুলো বলেই হনহনিয়ে রুমে ঢুকলো নুহাশ। তাড়াহুড়ো করে কাগজপত্রগুলো ব্যাগ থেকে বের করে আবারও চলে গেল। আর বলে গেল মোবাইলটা যেন সাথে রাখি। কল দিলে যেন ধরি। আমি মাথা নেড়ে শুধু সম্মতি দিলাম। নুহাশ যাওয়ার পর শুদ্ধর পাশে শুয়ে পড়লাম। শুদ্ধ ক্লান্ত তাই এ হট্টগোলেও ঘুমিয়ে পড়েছে। আমার অবচেতন মন বলে উঠেছিল পিয়াস এসেছে। তবে সেটা মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় বেশ শান্তি লাগছে। যদিও প্রথমদিকে কেন এমন হয়েছে বুঝতে পারিনি। নুহাশ মজা করার মতো মানুষ না। আর সে ডকুমেন্টস নিতে এসে এ ধরণের মজাও করবে না। যাইহোক এসব নিয়ে যত ভাববো ততই মাথায় গ্যান্জাম লাগবে। তাই যত কম ভাবা যাবে ততই মঙ্গল আমার জন্য। রাজ্যের ঘুম এসে ঝেঁকে বসলো চোখে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছি জানি না।
মোবাইলটা অনবরত বাজছে। আমি দ্রূত ঘুম থেকে উঠলাম। মোবাইল স্ক্রিনে নুহাশের নামটা ভেসে উঠল। আমি কলটা ধরতেই সে বলে উঠল
“তৈরী হয়ে থেকো। তোমাদের নিয়ে একজন সমু্দ্র পাড়ে যাবে। আর মুমু শুদ্ধকে নিয়ে হুটহাট সমুদ্রে নেমে পড়ো না। কখন তলিয়ে যাবে বুঝবে না। সাবধানে থেকো।”
আমি মুখে হাই তুলতে তুলতে উত্তর দিলাম
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
কলটা কেটে গেল। আমার মনটা অনেক উদাস আর অশান্ত লাগছে। কেন জানি না যে খুশিটা নিয়ে এসেছিলাম সেটা ম্লান হয়ে গিয়েছে। শুদ্ধ উঠে গিয়েছে। আমাকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল
“মাম্মা আইসক্রিম খাব।”
আমি শুদ্ধকে আমার সামনে এনে হাসি মুখে উত্তর দিলাম
“এখন কোনো আইসক্রিম খাওয়া যাবে না। এখন আমি যা দিব তাই খেতে হবে। তারপর দুজন মিলে সমুদ্র পাড়ে যাব ঘুরতে। অনেক মজা করব শুদ্ধ। মা আর ছেলে মিলে আজকে সারাদিন মাস্তি করব।”
শুদ্ধকে খাইয়ে দিলাম। ততক্ষণে দরজায় নক পড়ল। দরজা খুলতেই একজন মধ্যবয়স্ক লোক হেসে দিয়ে বললেন
“নুহাশ স্যার পাঠিয়েছেন। আপনাদের নিয়ে সমুদ্রপাড়ে যেতে। আপনারা তৈরী তো?”
আমি হেসে উত্তর দিলাম
“আমি অনেক আগেই তৈরী হয়ে আছি। চলুন যাওয়া যাক।”
কখনও হিম শীতল কখনও উষ্ণ বাতাস গায়ে লেপ্টে যাচ্ছে। সমুদ্রের স্রোত পৃষ্ঠতলে আঁচড়ে পড়ছে। নামতে একটু ভয় লাগছে। তবুও মনে হচ্ছে একটু পানির স্পর্শ নেওয়া উচিত। পা টা সমু্দ্রের আধু আধু পানিতে চুবালাম। শুদ্ধকে পানিতে নামতে দেওয়ার সাহস হলো না। যদিও অনেক বায়না করেছিল তবুও তাকে পানিতে নামতে দিই নি। সমুদ্র বিলাশ শেষে ডাবওয়ালার কাছে আসলাম। শুদ্ধ , কাকা আর আমার জন্য ডাব অর্ডার করলাম। ডাবের দিকে মনোযোগ দিলাম। এমন সময় শুদ্ধ চেঁচিয়ে বলে উঠল
“মাম্মা ঐ যে দেখো পিয়াস আংকেল।”
শুদ্ধর কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম। পাশ ফিরে তাকালাম। অদূরে পিয়াস দাঁড়িয়ে হাসছে। এবার বুঝতে পারলাম গতকালকের ঘটনাটা পিয়াসেই ঘটিয়েছে। আমি আমার রাগটা সংবরণ করতে পারলাম না। শুদ্ধকে কাকার কাছে রেখে পিয়াসের কাছে গেলাম। পিয়াস আমাকে দেখে হালকা হেসে বলল
“তোমার পাশের রুমেই আমি উঠেছি। একা সমুদ্র বিলাস কেন করবে? আমিও সাথে থাকব। তোমার প্রতিটা পদক্ষেপে আমি থাকব। মুমু আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি।”
আমি বেশ রেগে গেলাম। নিজেকে সামলাতে পারলাম না। পিয়াসের গাল বরাবর একটা থাপ্পর দিলাম। তারপর কিছুটা চেঁচিয়ে বলে উঠলাম
“আমাকে নিস্তার দাও। শান্তিতে সংসার করতে দাও। বারবার বলেছি তোমার সাথে আমার কিছু সম্ভব না। আমি তোমাকে চাই না। আমি আমার স্বামীকে ভীষণ ভালোবাসি। অন্য সবার মতো আমি নিশ্চয় পরকিয়া করে বেড়াব না। দুনিয়াতে কী মুমু ছাড়া কোনো মেয়ে নেই। তোমার এ মুখটা আমাকে আর দেখিও না। আর এসব শুনে কাপুরুষের মতো সুইসাইড করতে যেও না। কারণ তোমার মরে যাওয়াতে আমি কিছু যায় আসে না। হয়তো খারাপ লাগবে তবে এটা সাময়িক। নিজের ক্যারিয়ার গড়ো। লজ্জা থাকলে আর আমার সামনে এসো না। একটু শান্তিতে দম নিতে দাও।”
বলেই কেঁদে ফেললাম। পিয়াসের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। আমার কথার প্রেক্ষিতে সে বলে উঠল
“আমি বুঝতে পারিনি তুমি আমার উপর এত বিরক্ত। আমি আর তোমার পিছু নিব না। তোমার সামনে যেন আসতে নাহয় সে ব্যবস্থায় করব। ভয় পেও না সুইসাইড করব না। তবে তোমাকে ভুলে যেতে বা ঘৃনা করতেও পারব না। তোমার সব খোঁজ আমি রাখব তবে তোমার আড়ালে থেকে। ভালো থেকো। চিরতরে মুক্তি দিয়ে গেলাম তোমায়। পিয়াসের ছায়াও তোমার আশেপাশে থাকবে না। আমি জানি তোমার আমার প্রতি ভালোবাসা না থাকলেও অদ্ভূত একটা টান আছে। যদি কখনও তোমার আমার কথা মনে পড়ে কোনো প্রয়োজন পড়ে আমাকে কল দিবে আমি সবার আগে তোমাকে সাহায্য করব। ভালো থেকো।”
পিয়াস চলে গেল। আমিও আর বেশিক্ষণ এখানে স্থির থাকতে পারলাম না। নিজেকে সামলে নিলাম। তারপর শুদ্ধকে নিয়ে রিসোর্টে চলে আসলাম। সারাদিন আর কিছু খেতে পারিনি। গলা দিয়ে খাবার নামেনি। এ যন্ত্রণার ভার আর নিতে পারছি না। নুহাশকে সবটা বলার দরকার। ওকেও বুঝাতে হবে আমার চাওয়া কী। আমার ইচ্ছার পূর্ণতা না পেলে মন কীভাবে বিগড়ে যায়।
রাত ১১ টা বাজে। শুদ্ধকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছি। নুহাশ এসেছে সবে। আমি নুহাশকে ডেকে বসতে বললাম আমার কাছে। তারপর তার হাতটা আমার বুকে চেপে ধরে প্রথম থেকে ঘটে যাওয়া পিয়াসের পুরো ঘটনা বললাম। তার সাথে কাঁদতে কাঁদতে বললাম
“আমি এ দায়িত্বের সংসার চাই না। ভালোবাসার সংসার চাই নুহাশ। আমাকে অবহেলা করো না। ছোটো ছোটো অবহেলা আমাকে ভীষণ প্যারা দেয়। টাকা চায় মানুষ সুখের জন্য। সে সুখটায় আমার মাঝে নেই। অথচ বিবাহিত জীবনের সাত বছর পার করলাম। আমি তো চাইলেই তোমাকে ছেড়ে পিয়াসের কাছে চলে যেতাম। তবে কেন যায়নি, জানো? তোমাকে আমি একটু হলেও ভালোবাসি। সংসারের দায়িত্বের আড়ালেও তোমার প্রতি আমার একটা ভালোবাসা কাজ করে। এ ভালোবাসাটা মরে যেতে দিও না। আমি তুমি শুদ্ধ মিলে একটা পরিপূর্ণ সংসার হোক। ভালোবাসায় ঘেরা থাকুক আমাদের এ সংসার।”
আমার কথা শুনে নুহাশ চুপ হয়ে গেল। আমার দিকে কেবল তাকিয়েই আছে। আমার ভেতরের অনুভূতি সে আন্দাজ করতে পারছে কি’না জানি না। তবে সাতটা বছরের ক্ষতটা কতটা গভীর হয়েছে সেটা বলতে পেরে আমি ভীষণ শান্তি পাচ্ছি। নুহাশ কেবল আমাকে জড়িয়ে ধরল। নীরব রইল। টানা ২০ মিনিট সে তার বুকে আমাকে চেপে রাখল।
সময় পার হলো কেটে গেল আরও বছর খানেক। দেখতে দেখতে বিবাহিত জীবনের আরও ৫ টা বছর পার করলাম। নুহাশের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। কথাটা শুনার পর সাময়িক পরিবর্তন হয়েছিল তবে সেটা বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। বুঝতে পেরেছিলাম নুহাশ কোনোদিনও পাল্টাবে না। পিয়াসের খবর জানা নেই। সর্বশেষ জেনেছিলাম সে লন্ডন চলে গিয়েছে পড়াশোনার জন্য।
সব মিলিয়ে ১২ বছরের একটা সংসার। নুহাশের অবহেলা যেন পিয়াসকে মনে করিয়ে দেয়। এত বছর পিয়াসের সাথে যোগাযোগ নেই তবে মাঝে মাঝে ভীষণ মনে পড়ে। কিন্তু যোগাযোগ করার ইচ্ছা জাগলেও করিনি। আমি চাই না নুহাশকে আর ঠকাতে। অপূর্ণতায় থাকুক আমাদের দায়িত্বের সংসার।
আজকে আমার জন্মদিন। নুহাশকে শত ব্যস্ততার মাঝেও আজকে আমার জন্য ফুল পাঠিয়েছে ভেবে ভীষণ খুশি লাগছে। তবে সে খুশিটা মলিন হয়ে গেল অনাকাঙ্ক্ষিত একটা ঘটনায়।
#বিবাহিতার সাতকাহন
#শারমিন আঁচল নিপা
#পর্ব- ২২/ শেষ পর্ব (২য় অংশ)
বুঝতে পারলাম নুহাশ আমার জন্য কোনো ফুল পাঠায়নি। ফুলটা এসেছে অন্য কারও পক্ষ থেকে। ভাবছেন পিয়াসের তরফ থেকে! নাহ, তা না। ফুলটা এসেছে অর্কের কাছ থেকে যে আমাকে পাগলের মতো ভালোবাসে। তার সাথে না.. হয় আমার কোনো কথা, না… হয় কোনো দেখা। তবুও মাঝে মাঝে বিশেষ দিনগুলিতে তার থেকে গিফট গুলো আমার বাসায় চলে আসে। পিয়াসের থেকে বেশি সে আমার জন্য পাগলামি করেছে। তবে তার পাগলামিগুলো আড়ালেই রয়ে যায় সামনে আর আসে না।
তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল ফুলের মেলায়। সময়ের সাথে সাথে জীবনের রঙ চাওয়া বদলায়। আমি হুট করেই বাগান করায় মনোযোগ দেই আর কাঠগোলাপ সংগ্রহ করতে থাকি। কাঠগোলাপ সংগ্রহ করতে করতে আট প্রজাতির কাঠগোলাপ সংগ্রহ করে ফেলি। মেলায় সেটাই প্রদর্শন করতে নিয়ে গিয়েছিলাম। আর সেও এসেছিল তার গাছের কালেকশন নিয়ে। সেখান থেকেই টুকটাক কথা। এরপর আর কথা নেই। তবে তার পাগলামি গুলো কেবল সামনে পড়ে। ফুলের মতো সুবাসিত হয়ে পাগলামি গুলো যেন চারদিকে সুবাস ছড়ায়।
সময়ের ধাবমান স্রোতে জীবনে অনেকের দেখা পেয়েছি। যারা আমাকে পাগলের মতো চেয়েছে তবে আমি চেয়েছি নুহাশকে। তাদের পাগলামিগুলো আশা করেছি নুহাশের মধ্যে। তবে সেটা নুহাশকে ঘিরে কখনও পাইনি। নুহাশ সবসময় বেখেয়ালি। বলতে বলতে একটু কেয়ারিং হলেও সেটা আর বেশিদিন স্থায়িত্ব পায় না। আমার জীবনে অনেকেই আমাকে ভালোবেসেছে পাগলামি করেছে। পাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। তবে তাদের গুরুত্ব আমার জীবনে কখনও ছিল না। যাকে গুরুত্বের আসনে বসিয়েছিলাম সে আমাকে অবহেলার চাদরে মুড়ে দিয়েছে। এটাই হয়তো জীবন। আবার এটাই হয়তো জীবনের কোনো অধ্যায়। জানি না অবহেলার সে অধ্যায় শেষ হয়ে কোনোদিন নতুন রঙে ফুলের মতো জীবন রঙিন হবে কি’না! তবে আশাবাদী আমি আশা ছাড়তে ভীষণ নারাজ। একটা ক্ষীণ আশা আমাকে সবসময় বাঁচতে শেখায়। নতুন করে সামনের দিকে চলতে শেখায়।
কলিংবেলের আওয়াজ বেজে উঠল। আমি দৌঁড়ে গেলাম। নুহাশ এসেছে। দরজাটা খুলে হাসি মুখে বললাম
“আমার জন্মদিন ভুলে গেছো আবার?”
নুহাশের মৃদু আওয়াজ কানে আসলো
“তুমি এখনও বাচ্চাদের মতো। শুদ্ধও তার জন্মদিন নিয়ে এত উচ্ছাসিত না, তুমি যতটা। কাজের প্রেসারে সব ভুলে গিয়েছি। যা আছে দাও। খেয়ে আবার ডিউটিতে যেতে হবে।”
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিলাম। হালকা হেসে বললাম
“শুদ্ধকে কখনও ভালোবাসার অভাব বুঝতে দেইনি। ও কী করে বুঝবে না পাওয়ার গ্লানি। ওর জন্মদিন বা প্রতিটা বিষয় আমি মা হয়ে খেয়াল রাখি। ওর যত্ন নিই। কিসের সাথে কী যে তুলনা করো বুঝি না। আমাকে তুমি পাত্তায় দাও না।”
কথাগুলো বলে বেশ জোরেই হেসে দিলাম। হাসিটা যদিও খুশিতে হাসিনি। হেসেছি না পাওয়ার গ্লানি আড়াল করতে। নুহাশ আমার হাসি দেখে বিরক্ত গলায় বলে উঠল
“মাঝে মাঝে তুমি কারণ ছাড়া শুধু শুধু পাগলের মতো হাসো। মুমু তোমাকে আমি বারো বছরেও বুঝলাম।”
আমি হাসি থামিয়ে পুনরায় হেসে বললাম
“১২ জনমেও বুঝবে না। যে সাতে বুঝে না সে সতেরো ও তে বুঝবে না। সুতরাং আর কথা বাড়িও না। যাও খাবার খেতে বসো। আর আমাকে টাকা দিও নিজের জন্মদিনের গিফট নিজেই কিনে নিব। পড়াশোনা শেষ করার পর চাকুরিও করতে দিলে না। তাই টাকাটা তোমার থেকেই নিতে হয়।”
“আমি কার্ড রেখে যাব নিজের ইচ্ছা মতো খরচ করো। আমার যা আছে তাই তো শেষ করতে পারবে না আবার তোমার চাকুরির কী দরকার?”
“হুম জানি। যাও ফ্রেশ হয়ে খেতে বসো। আমি আসছি।”
নুহাশ ফ্রেশ হতে চলে গেল। আমি আবারও হাসলাম। আমি আর আগের মতো আবেগী না। এখন ভালোবাসা চাই না। নুহাশের থেকে কোনো গিফট চাই না। এখন নিজের শখ নিজে পূরণ করি। নুহাশের আশা করি না। নিজের মতো করে চলি, যা মন চায় কিনি। কোথাও ঘুরতে মন চায়লে একাই শুদ্ধকে নিয়ে চলে যাই। নুহাশ তার কাজে ব্যস্ত থাকুক। দুজনের একটা দায়িত্বের সংসার আছে সেটা মনে করে রোবটের গতিতে এগিয়ে যাচ্ছি। তবে এ রোবটিক জীবনের এক কোণায় নুহাশের প্রতি অপার ভালোবাসা জমা করা সেটা নুহাশ বুঝে না।
পিয়াসকে প্রায়শই মনে পড়ে। পিয়াসের খোঁজ আর মিলে নি। আমার সামনে কখনও আসে নি। জানি না কোথায় আছে। বেনামি নামে মাঝে মাঝে কিছু চিঠি আসে। খালি চিঠি। কোনো কিছু লেখা থাকে না। কোথায় থেকে এসেছে সে ঠিকানাও না। তবে মনে হয় হয়তো পিয়াস পাঠিয়েছে। তবে এটা আমার ভুল ধারণাও হতে পারে। মাঝে মাঝে তার প্রতি তীব্র দুর্বলতা জেগে উঠে। কারণ আমাকে বুঝার মতো একটা মানুষেই ছিল। তবে নুহাশকে আমি প্রচন্ড ভালোবাসি। যার দরুণ এ দুর্বলতা ক্রমশ ম্লান হয়ে যায়। জানি না পিয়াস কেমন আছে। তবে এটাই চাই সে ভালো থাকুক।
শুদ্ধও বেশ বড়ো হয়ে গেছে। আমার একমাত্র বেঁচে থাকার অবলম্বন শুদ্ধ। তাকে নিয়েই আমার সময় পার হয়ে যায়। এইতো সব মিলিয়ে ভালো আছি।
কেটে গেল আরও মাসখানেক। শুদ্ধকে স্কুলে দিয়ে বাসায় আসলাম। আজকাল ভীষণ খারাপ লাগে। মাথাটা খুব ঘুরে। শরীরে আগের মতো শক্তি পাই না। তাই খাটে হেলান দিয়ে শুয়ে আছি। এমন সময় মোবাইলটা টুং করে বেজে উঠল। হাতে নিয়ে লক্ষ্য করলাম ওয়াটস এপে একটা ছবি এসেছে। একটা রিসোর্টের ছবি হবে। নাম মুমু প্যালেস। ঠিক তার পর পর দুইটা মেসেজ।
প্রথম মেসেজে লেখা
“মুমু দেখো হাসপাতালের জানালা দিয়েও তোমাকে দেখা যায়। অনেকদিন তোমার সাথে দেখা নেই, কথা নেই তবে ভালোবাসার জায়গায় তুমিই আছো। আমার পাশে তুমি আছো। এই যে দেখো মুমু প্যালেস।”
দ্বিতীয় মেসেজ
“যাইহোক ভালো থেকো। আমি ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজে। অতিরিক্ত মদ্যপান আর নেশা করে এ অবস্থা আমার। তোমাকে ব্লক করে দিলাম। কোথায় আছি কী করছি কোনো খবর যেন না পাও সে ব্যবস্থা অনেক আগেই করেছিলাম। তবে শেষ বারের মতো তোমাকে বলতে মন চাচ্ছিল মুমু আমি তোমাকে ভালোবাসি। আর সেটা বলতেই মেসেজ দেওয়া। মুমু আমি তোমাকে ভালোবাসি।”
আমি পাল্টা মেসেজ দেওয়ার আগেই আমার নম্বরটা ব্লক লিস্টে চলে গেছে। এবং কল দেওয়ার পর লক্ষ্য করলাম নম্বরটা বন্ধ। পিয়াসের এমন অবস্থা শুনে আমার বুক কেঁপে উঠল। মাথাটা ঘুরে গেল। কখন যে জ্ঞান হারালাম জানি না।
জ্ঞান ফেরার পর খেয়াল করলাম আমি হাসপাতালে। এক পাশে শুদ্ধ আর আরেক পাশে নুহাশ বসে আছে। আমি চোখ মেলতেই সে হাসি মুখে আবারও বলে উঠল।
“মুমু আল্লাহ সহায় হয়েছে। দশ বছর পর আমরা আবার বাবা মা হতে যাচ্ছি।”
আমার চোখ দিয়ে এক পশলা জল গড়িয়ে পড়ল। আমি নিজেকে শান্ত করে নুহাশকে জড়িয়ে ধরে বললাম
“আমার আর তোমার ভালোবাসা আমার পেটে বড়ো হচ্ছে। নুহাশ পুরো দুনিয়া আমাকে ভালোবেসেছিল আর আমি সব ফেলে তোমাকেই ভালোবেসেছি। নুহাশ আমি শুধু চাইব আমাদের দায়িত্বের সংসারটা ভালোবাসার সংসারে রুপান্তরিত হোক।”
নুহাশ কেবল আমাকে আর শুদ্ধকে জড়িয়ে ধরেছিল। তবে আমাদের দায়িত্বের সংসার আর ভালোবাসার সংসারে রুপান্তরিত হয়নি। হয়তো এটাই গন্তব্য। আর এভাবে রচিত হয়েছে বিবাহিতার সাতকাহন।
সমাপ্ত
কপি করা নিষেধ।