প্রেম থেকে অপ্রেম পর্ব-০১

0
818

প্রেম_থেকে_অপ্রেম
#পর্ব১
#রাউফুন

প্রাক্তন স্বামীর বিয়েতে এসে যে এতটা অবাক হতে হবে ভাবিও নি। যখন বউ দেখলাম আমার সর্বাঙ্গে যেনো বিদ্যুৎ খেলে গেলো। অবাক হয়েছি আমার প্রাক্তন স্বামীর হবু বউ সুজানা আপুকে দেখে।অবাকের মাত্রা তখনও আমার চোখ মুখে ছড়িয়ে আছে।

এর মধ্যে আমার অবাকের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পেলো তখন, যখন সুজানা আপুর এক্স বিএফ মিস্টার প্রিহান হাওলাদার আমায় সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব দিলেন। আমি এক কোণায় দাঁড়িয়ে বিয়ে বাড়ির সবাইকে দেখছিলাম। সবাই কত আনন্দ করছে। শাহনাজ কেও দেখলাম বন্ধুদের সঙ্গে খুশ মেজাজে গল্প করছে। অশ্রুসিক্ত হলো আমার দু-চোখ। সেটা গড়িয়ে পরার আগেই চোখের ভারী পল্লভ ঝাপটে চোখের পানি চোখেই শুকিয়ে নিলাম। সে সময় হঠাৎ প্রিহান হাওলাদার আসলেন আমার কাছে। আমাকে তিনি আগে থেকেই চেনেন। সেদিন হসপিটালে উনার সাথে পরিচয় হয়। এরপর অবশ্য অনেক দিন দেখা হয়েছিলো। অনেক কথাও হয়েছিলো। তবে স্বাভাবিক কথা বার্তা। আমি উনার সাথেই দেখেছিলাম উনার গার্লফ্রেন্ড সুজানা আপুকে। প্রিহান আমার একটু কাছ ঘেঁষে বিস্তীর্ণ গলায় বলেন,

‘ইশ এভাবে জ্বলে পুড়ে খা’ক হওয়ার চেয়ে চলুন আমি আর আপনি বিয়ে করে নিই!’

মনটা বিষিয়ে উঠলো মুহুর্তেই। আমি চোখে খেয়ে ফেলবো সেভাবে তাকালাম।তিরিক্ষি হয়ে আমি মুখ খুলার আগেই তিনি আরও বলেন,

‘উম উম রিলেক্স!এই যে এই তেঁজস্বী রুপ টা আপনি আমাদের বিয়ের পর দেখাবেন না হয়। মোটেও মজা করছি না আমি। সো সিরিয়াস ভাবে কথা টা নেওয়ার অনুরোধ রইলো।’

আমার চক্ষুচড়ক গাছে উনার কথা শুনে। আমার প্রশ্ন হচ্ছে সব টা জেনেও তিনি কেন আমায় বিয়ে করতে চাচ্ছেন? আমি যে বিবাহিত ছিলাম সেটা তো তিনি জানেন তবে? আমি স্তব্ধ হয়ে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে দাঁড়িয়ে রইলাম কোনো রকম কথা না বলে। যারপরনাই অবাকে আমার মুখের রা সরে গেছে। আজকে যেনো শুধুই আমার অবাক হওয়ার দিন। প্রথমে আমি জানতাম না প্রিহানেরই এক্স গার্লফ্রেন্ড কে আমার প্রাক্তন স্বামী বিয়ে করছে। আমি তো এসেছিলো আমার স্বামীর বিয়ে করা বউকে দেখতে। মানতেই হবে সুজানা আপুর মতো এমন বোল্ড বিউটিফুল লেডিকে রেখে আমাকে কেন বউ হিসেবে মানবেন শাহনাজ।

বুকের দহনক্রিয়া বাড়লো। অসহনীয় ব্যথায় মো’চ’ড় দিয়ে উঠলো হৃদস্পন্দনে! বক্ষস্থলে যেনো খেজুর কাটা দিয়ে কেউ খোচাচ্ছে। এতোটা কষ্টের মধ্যে মিষ্টার প্রিহানের এমন প্রস্তাব ই যথেষ্ট ছিলো আমাকে ভ’ঙ্গু’র করে দিতে। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। তিনি আমার আরও কিছুটা গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বললেন,

‘আসলে আমি ভাবছি ধন্যবাদ দিলে আপনাকে ছোট করা হবে আর টাকা দিলে আপনাকে অপমান করা হবে। তার থেকে ভালো আপনি আমাকে বিয়ে করুন। মিস শুকরিয়া তাসমিয়াহ মালা। ও সরি আমার এক্স গার্লফ্রেন্ডের এক্স সতীন।’

যদিও আমি ঐশিকে বাঁচিয়ে খুব খুশি কিন্তু তার বিনিময়ে আমি পুরস্কার চাইবো? তাও আবার এমন? আসলে বড় লোক তো! কারোর টাকা বেশি থাকলে যা হয়। যত্তো সব! তাই বলে এমন কুপ্রস্তাব কিভাবে দিতে পারেন তিনি? টাকা দিলে যদি অপমান করা হয় তবে, এই প্রস্তাব রেখে তিনি আমাকে দয়া দেখাচ্ছেন, ছোট করছেন আরও বেশি করে অপমানিত হচ্ছি আমি এতে, এটা কি উনার এতো বড় মাথায় ঢুকছে না?নাকি অন্য কোনো মতলব আছে উনার?

না, না ব্যাপারটা অন্য দিকে গড়াবার আগে এখানেই সবটা শেষ করতে হবে। আমি নিজেকে শান্ত করে চোখ বন্ধ করে দম নিলাম। কিছু বলার জন্য মুখ টা খুলবো তার আগেই প্রিহানের সাথে থাকা বন্ধু টা বলে উঠলো,

‘প্রিহান আমরা বুঝতে পারছি তুই উনার ঋণ শোধ করতে চাইছিস কিন্তু তার বিনিময়ে বিয়ে? লোকে শুনলে কি ভাববে বলতো? ভাববে তুই হয়তো প্রতিশোধ নিতে তোর এক্স গার্লফ্রেন্ডের স্বামীর ডিভোর্সি বউকে বিয়ে করতে চাচ্ছিস।’

প্রিহান উনার বন্ধু রুপমের কথা শুনে আমার দিকে তাকিয়ে বিরস-বদন ভাব করে বললেন,

‘রুপম তুই হয়তো এটা ভালো ভাবে জানিস আমাদের ফ্যামিলির কেউ কখনো কারোর ঋণ রাখেনি। আমিও রাখতে চাইনা। আমি মিস মালাকেই বিয়ে করবো। তুই এখানে কথা না বললে খুশি হবো!’

উনি সুদীর্ঘ লম্বা দম নিয়ে আমাকে উদ্দেশ্যে করে বললেন,

‘আসলে মিস মালা আপনি আমাদের সব থেকে দামি মানুষটার জীবন বাঁচিয়েছেন। আমি অনুরোধ রাখছি আপনি রাজি হয়ে যান আমাকে বিয়ে করার জন্য। আমি আপনাকে বিয়ে করতে চাই আপনার অনুমতি নিয়েই। যতটা ইচ্ছে সময় নিন আপনি। আমি আপনার অনুমতির অপেক্ষা করবো। উত্তর টা ইয়েস হওয়া চাই অবশ্যই। কারণ না শব্দ টা আমার জীবনের সবচেয়ে অপছন্দের একটি শব্দ।’

‘আমাকে দয়া দেখাচ্ছেন হ্যাঁ? আ’ম নট আ পাপেট গেইম! ওকে? ছিঃ কি ভেবেছেন টা কি যা খুশি করা যাবে আমার সঙ্গে? আমাকে কি এতোটাই অসহায় মনে হয় আপনার? আমি ম’রে যাচ্ছি না আপনাকে বিয়ে না করে!’

‘আপনার যদি মনে হয় আমি আপনাকে দয়া দেখাচ্ছি তবে তাই? কিন্তু বিয়ে তো আমি আপনাকেই করবো।’

‘এই মালা আপনাকে কিছুতেই বিয়ে করবে না।’

‘উঁহু উঁহু আগেই বলেছি আমি “না” শব্দটি শুনতে পছন্দ করি না৷ সো ডোন্ট স্যে নো!’

‘আমার জীবন আমি বুঝবো, কি করবো। আমাকে ডিস্ট্র‍্যাক্ট করবেন না এসব বলে।’

‘আহ্! আ’ম এনজয়িং ইউর অ্যাংগার ফেইস এন আই ওয়ান্ট টু এনজয় ইট ফর দ্যা রেস্ট অফ মাই লাইফ!

আমি কটমট করে তাকালাম প্রিহান হাওলাদার এর দিকে। আমার তাকানো দেখে লোকটা গা জ্বালানো হাসি দিলো। বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার আগেই আমি বেরিয়ে এলাম বিয়ে বাড়ি থেকে।আমার জীবন টা তছনছ হয়ে গেছে এই পুরুষ নামক বিষাক্ত কীটের জন্য! এই জীবনে আর কোনো পুরুষের জায়গা হবে না।

অটো থেকে নেমে ঘরে যাচ্ছিলাম ঠিক সে-সময় ক্লাস এইটে পড়ুয়া ছোট বোন দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো আমাকে। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম ওর দিকে তাকিয়ে। কেঁদে কে’টে যা ইচ্ছে তাই করে ফেলেছে মুখের অবস্থা। কাঁন্নারত অবস্থায় হিচকি তুলে তুলে নালিশ করে বললো,

‘আপু কোচিং থেকে আসার সময় প্রতিদিন একটা ছেলে আমাকে খুব বিচ্ছিরি ভাবে বিরক্ত করে। আমি যেদিকে যায় ঔ লোকটাও সেদিকে যায় আর বা’জে বা’জে কথা বলে। পেছনে পেছনে ঘুরে। রোজ পথ আটকে দাঁড়িয়ে থাকে। খুব খুব খুব খারাপ ছেলে টা৷ আমার দিকে বা’জে ইঙ্গিতে তাকিয়ে থাকে!’

কান্নার কারনে ওর সারা মুখ লাল হয়ে গেছে। রাগে আমার চোয়াল শক্ত হলো। দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে বললাম, ‘আগে কেন বলিস নি এসব কথা? আসতে দেরি হয় বলে আমি তো ভাবতাম বেশি করে পড়ছিস!’

‘ভয়ে বলিনি আপু। যদি আব্বু কোচিং বন্ধ করিয়ে আমাকে তোমার মতো বিয়ে দিয়ে দেই তবে যে আমি শেষ হয়ে যাবো আপু। কিন্তু আজ ওই অ’স’ভ্য লোকটা আমার হাত ধরে টানাটানি করছিলো। তাই না বলে পারলাম না আপু। আমি চিৎকার না করলে ওই লোকটা আমাকে ধরে নিয়ে যেতো!’

ভয়ে আঁতকে উঠলাম আমি। তবু্ও কিছু বললাম না। আমার বোনের দিকে কু-নজরে তাকানো? আমার বোনকে টি’জ করা? ও হইতো জানে না ওর সঙ্গে কি হতে চলেছে। ভেতরের অস্থিরতাকে মনস্তাপ করলাম আপাতত। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বোনের মাথায়, চিবুকে স্নেহের হাত বুলিয়ে চোখ মুছে দিলাম। স্বান্তনা দিয়ে বললাম, ‘ কাল থেকে আমি যাবো তোর সাথে। স্বাভাবিক ভাবে ভেতরে যাবো দুই বোন চল। কারোর সামনে এই অবস্থায় পরার প্রয়োজন নেই। তুই একদম কাঁদবি না আর হাত মুখ ধুয়ে, পড়তে বসবি। আমি তোর জন্য খাবার নিয়ে ঘরে যাবো। বাবা-মা যেনো কিছু বুঝতে না পারে। আমি সামলে নেবো সবটা। একদম চিন্তা করবি না।’

পুতুল চোখ মুখ মুছে স্বাভাবিক হয়ে নিলো। দুই বোন ভেতরে গেলাম এমন ভাবে যেনো কিছুই হয়নি।

পরের দিন আমি পুতুলের সঙ্গে ওর কোচিং এ গেলাম। আমি পুরো টা সময় ওর জন্য দাঁড়িয়ে রইলাম। সন্ধ্যার আগে ওর ছুটি হলো। আমি আর ও হেঁটেই রওনা দিলাম। আধ ঘন্টার পথ হেঁটেই যাওয়া আসা করা যায়৷ যদিও আমরা দুই বোন রিকশা বা অটোতে চলাচল করতে পারতাম কিন্তু আব্বু টাকা পয়সা দিতে চান না। উনি আগেই বলে দিয়েছেন,“পুতুল পড়বে পড়ুক এক কানা কড়িও আমি দেবো না। কি ভাবে পড়াবে তোমরা মা, বোন দেখে নিও। আমার ছেলের জন্য সব করবো আমি। ছেলেই তো আমার সব!” তিনি মনে করেন মেয়েরা হলো এক রকম আপদ! আমরা দুই বোন জন্ম নেওয়াই বাবা খুশি হোন নি একটুও৷ তাই তো আমাকে বিয়ে দিয়ে ঘাড় থেকে নামাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই বিয়েটা তো আর ধোঁপে টিকলো না। ওই লোকটার মতো নর্দমার কীটের সঙ্গে কি সংসার করা যায় আদৌ? হঠাৎ পুতুল ভীতস্বতস্ত্র হয়ে একটা জায়গায় থামলো। ওর চোখে মুখে আমি ভীতি দেখলাম। আমি পুতুল কে জিজ্ঞেস করলাম,

‘কি রে পুতুল কোন ছেলেটা তোকে ডিস্টার্ব করে রোজ দেখালি না তো?’ পুতুল আশেপাশে তাকিয়ে কোথাও পেলো না ওই ছেলেটাকে।আমি রহস্যময় ভাবে হেসে বাড়ি ফিরলাম!

#চলবে