বিয়ে পর্ব-০৬

0
506

#বিয়ে
#লেখনীতে- ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব- ৬

অদ্রি বিস্ময় নিয়ে তাকালো ধ্রুব’র দিকে। লোকটা কি ওকে লোভী ভাবছে? সম্পর্ক থেকে মুক্তি পেতে এরকম জঘন্য অফার ধ্রুব করতে পারে অদ্রি ভাবেনি। ও তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলল,
— কিচ্ছু লাগবে না আমার। কিচ্ছু না।
শুধুমাত্র আর কিছুদিন সময় দিন, কোথাও একটা এডমিশন হয়ে গেলে আমি ঠিক আপনার জীবন থেকে চলে যাবো। অদ্রি তার বাবার কাছেই বোঝা হয়ে থাকতে চায় নি, সেখানে আপনি কে? কথিত স্বামীমাত্র! যে নিজের স্ত্রী’কে সম্মান দেয় না। জানেন, আপনাদের মতো মানুষগুলোকে আমি প্রচন্ড ঘৃণা করি, প্রচন্ড।

বলেই অদ্রি বিছানার একপাশে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়লো। আর ধ্রুব ওর কথা শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রেগে বলল,
— হোয়াট ড্যু ইউ মিন? আমার মতো পুরুষ মানে? তোমাকে আমি কি করেছি যে ঘৃণা করবে?
অদ্রি শক্ত গলায় বলল,
— কিছুই করেননি।
— তাহলে এরকম একটা কথা বললে কেন?
অদ্রি অন্যদিকে ফিরে শুয়ে পড়লো। গলা ধরে এলো ওর, কেন তা জানেনা। ওর কান্না পাচ্ছে, ভীষণ কান্না। শুধু বলল,
— আপনার কোনো জিনিসে আমি হাত দেবো না। আমি নিজের জিনিসপত্রই ব্যবহার করবো। আমাকে শুধু নিজের মতো থাকতে দিন।

ধ্রুব উত্তরে কিছু কড়া কথা বলতে যাবে কিন্তু ও থেমে গেলো৷ স্পষ্ট বুঝতে পারলো অদ্রির ভেজা গলা। মেয়েটা কি কান্না করছে? ও কি এমন বললো যে কেঁদে ফেললো? ধ্রুব কিছুই বুঝে ওঠতে পারলো না। মন শান্ত করে ফ্রেশ হয়ে এসে ব্যলকনিতে বসলো নিজের ল্যাপটপটা নিয়ে। বাবার অফিসের কিছু দরকারি কাজ বাকি আছে। এই বিয়ের ঝামেলায় অনেক কাজ জমেছে, সেগুলো শেষ করতে হবে। তাছাড়া অদ্রির সাথে এক বিছানায় শোয়ারও ওর কোনো ইচ্ছে নেই। এরকম করতে করতে একসময় রাতের অন্ধকার কেটে যেতে লাগলো। শীতল বাতাসে কেঁপে ওঠতে লাগলো ধ্রুব। একটানা অনেকক্ষণ কাজ করাতে পিঠ ব্যথা হয়ে গেছে। না ঘুমানোর কারণে চোখদুটো লাল। ফর্সা মুখখানায় ক্লান্তির ছাপ। ঘরে ঢুকে অদ্রিকে দেখে প্রথমে হকচকিয়ে ওঠলেও পরক্ষণেই মনে পড়লো সবকিছু! এক বিছানায় শোয়ার ইচ্ছে নেই একদম। কিন্তু পিঠ-পা এমনভাবে ব্যথা করছে যে কিছুক্ষণ বিশ্রাম না নিলেও চলবে না। ধ্রুব চুপচাপ বিছানায় গিয়ে বসলো। ইতস্তত করে একসময় কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখে শুয়ে পড়লো। অনিচ্ছাকৃত ভাবেই অদ্রির দিকে চোখ পড়লো ওর। আর কি আশ্চর্য! ধ্রুব ঘুমন্ত অদ্রির চেহারায় দীর্ঘক্ষণ তাকিয়ে রইলো, ওর যেন অন্যরকম ভালো লাগছে। খেয়াল করলো অদ্রির ঢোলা শার্ট, পাজামা সব এলোমেলো হয়ে আছে। ফর্সা মুখের ওপর কিছু চুল পড়ে আছে, যেগুলো অন্যরকম সৌন্দর্য তৈরি করেছে। গুটিশুটি ভঙ্গিতে শুয়ে থাকা মেয়েটা যে ধ্রুব’র মুখে মুখে তর্ক করে, বিরক্তি নিয়ে তাকায় সেসব মনে হতেই ধ্রুব’র হাসি পেলো। অদ্রিকে ওর ভীষণ বাচ্চা মেয়ে মনে হলো। অজান্তেই ওর হাত চলে গেলো অদ্রির কপালে। এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে দিয়ে ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো অদ্রির চোখের কোণে জমে থাকা জল। ধ্রুব’র একদম ভালো লাগলো না। অদ্রির চোখের পাপড়িগুলো ভীষণ বড় বড়, ঠোঁট লাল। ধ্রুব অনেকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকার পর চোখ সরিয়ে নিলো। ওর ভীষণ অদ্ভুত একটা ইচ্ছে হচ্ছে। নিষিদ্ধ ইচ্ছে। কিন্তু এটা তো ঠিক নয়! ধ্রুব তো এতোটাও খারাপ নয় যে কারো ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু করবে? ও অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়লো। কিন্তু একফোঁটা ঘুমও এলো না চোখে। আবারও অদ্রির দিকে ফিরে শুলো আর চমকপ্রদভাবে লক্ষ্য করলো নিজের ভেতরের পরিবর্তন। অদ্রির চেহারায় কি জাদু আছে? না হলে ওকে দেখতে এত ভালো লাগছে কেন? ধ্রুব শুধু ভাবছে তার মতো ছেলের ভেতরে এত তাড়াতাড়ি এরকম পরিবর্তন কি করে সম্ভব? কিছু মুহূর্ত আগ পর্যন্ত অদ্রিকে সে সহ্যই করতে পারছিলো না। কিন্তু এখন কেন এত টান অনুভব করছে? না এটা কিছুতেই বাড়তে দেওয়া যাবে না। ভাবনাটা অবশ্য বেশিক্ষণ ওর মনে জায়গা করে নিতে পারলো না। আচ্ছা, মেয়েটা রাতে কি সত্যিই কেঁদেছিলো? কেন? এই বিয়ে বা ওর খারাপ ব্যবহারের জন্য নয় সেটা ধ্রুব নিশ্চিত। কিন্তু ঠিক কি কারণে কাঁদছিলো? ধ্রুব কি সুযোগ পেলে একবার জিজ্ঞেস করবে অদ্রিকে?

ফজরের আযান হচ্ছে চারদিকে। জামিউল সাহেব মসজিদ থেকে নামাজ পড়ে এলেন। বাইরে খানিকক্ষণ ভোরের বাতাস গায়ে লাগিয়ে বাসায় ফিরে দেখলেন সাথী বেগম তখনো ঘুমাচ্ছেন। তিনি একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে অদ্রির ঘরের দিকে পা বাড়ালেন। তার একমাত্র মেয়ে, আদরের মেয়ে আজ তার থেকে অনেক দূরে। এই ক’টা দিনে তিনি প্রতিটা ক্ষণ বুকের ভেতর চাপ অনুভব করেছেন। এতদিন না দেখে ভেতরটা কষ্টে জর্জরিত হয়ে গেছে তার। ইদানীং সাথী বেগমের পিড়াপীড়ি অসহ্য ঠেকছে। মেয়েকে বিদায় দেওয়ার সময় সে একবারও ফিরে তাকায়নি সেদিন তিনি লক্ষ্য করার সাথে সাথে তার বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠেছিলো। কত আদরের মেয়ে তার! সাথী বেগমের অসহ্য যন্ত্রণা আর প্যানপ্যানানির জন্যই অদ্রির জন্য পাত্র খুঁজতে বাধ্য হয়েছিলেন তিনি। সাথী বেগম কোথা থেকে যেন অযোগ্য কিছু পাত্রও জোগাড় করেছিলেন অদ্রিকে গছিয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু তিনি বাবা হয়ে সেটা পারলেন না। এরপর এক আত্মীয়ের মাধ্যমে কি করে যেন আচমকা বান্ধবী রুবিনার খোঁজ করেন
শায়লা। বহুদিন পর দেশে ফিরে খোঁজ নিয়ে দেখেন বান্ধবী স্বামী-মেয়ে রেখে গত হয়েছেন। আরও
ভালো করে খোঁজ নিয়েই তিনি জামিউল সাহেবকে
এই বিয়ের প্রস্তাব দেন যেটা সেসময় তার কাছে
মেঘ না চাইতেই জল ছিলো। এত দ্রুত মেয়েকে
বিয়ে দিতে চাইছিলেন না তিনি। কিন্তু সাথী বেগম ইদানীং অদ্রির পেছনে এমনভাবে ওঠেপড়ে লেগেছিলেন! যার কারণে তিনি অদ্রির বিয়েটা দিতে একপ্রকার বাধ্যই হয়েছেন। মাঝেমধ্যে সাথী বেগমের ওপর প্রচন্ড রাগ ওঠে তার। কিন্তু প্রেগন্যান্ট থাকা অবস্থায় তার আর কিছু করার সাহস হয় না। এসব মিলিয়েই তিনি অনেক প্রেসারের মধ্যে আছেন। জামিউল সাহেব রুবিনার কথা মনে করেন! তার প্রথম ভালোবাসা ও স্ত্রী। তিনি হয়তো জামিউল সাহেবকে কখনোই ক্ষমা করবেন না। সুখের সংসার তিনি নিজেই যে ভেঙ্গে ফেলেছেন!

______

পর্দার ফাঁক দিয়ে এক টুকরো রোদ আর মিষ্টি হাওয়া ছুঁয়ে গেলো অদ্রির মুখখানা। বাগান থেকে ভেসে আসছে ফুলের সুবাস। অদ্রির যখন ঘুম ভাঙলো তখন সকাল সাতটা। বেশ কিছুক্ষণ পর ধাতস্থ হয়ে আড়মোড়া ভেঙে ওঠতে ওঠতে আবিষ্কার করলো ধ্রুব ওর পাশে ঘুমিয়ে আছে। অদ্রি চমকালো ভীষণভাবে, জীবনে প্রথম কোনো ছেলের পাশে ঘুমিয়েছে ও! এই অভিজ্ঞতা খুব একটা ভালো ছিলো না। অদ্রি মনোযোগ দিয়ে দেখলো ধ্রুব’কে। ঘুমন্ত অবস্থায় লোকটাকে যতটা সরল দেখাচ্ছে ততটাও সরল নয় ভাবলো অদ্রি। নিজের দিকে আচমকা নজর পড়তেই কাপড়চোপড়ের বেহাল দশা দেখে প্রচন্ড নার্ভাস হয়ে গেলো। আচ্ছা, লোকটা কি দেখে ফেলেছে ওকে এভাবে? ইশ, অদ্রি কেন যে ঠিকঠাকভাবে ঘুমুতে জানে না! ওর নিজের প্রতি খুব রাগ হলো। বিরক্তি নিয়ে ফ্রেশ হয়ে ডাইনিংয়ে এসে দেখলো নাস্তার টেবিলে খাবার সাজাচ্ছেন শায়লা। জরিনা এসে অদ্রিকে চা দিয়ে গেলো। শায়লা ওকে জিজ্ঞেস করল,
— ধ্রুব কিছু বলেছে রে? আমাকে বল তাহলে।
অদ্রি বলল,
— তেমন কিছু সিরিয়াস না আন্টি।
জরিনা নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করল,
— ভাইজানে রাইতে চুমুটুমু খায় নাই ভাবি?
অদ্রির কান আবারও গরম হয়ে গেলো। লাল হয়ে গেলো গাল। এই জরিনা এত খোলামেলা কথা কিভাবে বলে? সবাইকে তো আর বকা যায় না যে ওই লোকের চুমু নিতে অদ্রির বয়েই গেছে! হুহ…
কিন্তু শায়লা সন্দেহ নিয়ে জিজ্ঞেস করল,
— সত্যি তো?
— মিথ্যে কেন হবে?
শায়লা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,
— আমার ছেলেকে তো চিনি আমি, তাই বলছি। ঝামেলা না করলেই ভালো।
অদ্রি অভয় দিয়ে বলল,
— ট্রাস্ট মি, কোনো ঝামেলা হয়নি।
শায়লা নিশ্চিন্ত হলেন। বললেন,
— তাহলে তুই গিয়ে ওকে ডেকে নিয়ে আয়। সবাই একসাথে নাস্তা করি আজ।
অদ্রি এটা আশা করে নি। মুখচোখ শুকিয়ে গেলো ওর। কোনোমতে বলল,
— আ আমি?
শায়লা ভ্রু কুঁচকালেন,
— হ্যাঁ। তোর বর, এখন থেকে তুই ডেকে তুলবি। অফিস যাবে, কাজ করবে। সবকিছু তো ও তোকেই জানিয়ে করবে, তাই-না?
অদ্রি শুধু মাথা নাড়লো। জরিনা বলল,
— মাইয়া মানুষ হইলো এলার্ম, ওগো সব কাজ সময়ের আগে আগে করতে হয়। আর পোলাপান হইসে আকাইম্মা, ঘুমটা পর্যন্ত নিজে নিজে ভাঙাইতে পারে না। বুঝলেন ভাবিজান!
শায়লা বললেন,
— যা, ডেকে নিয়ে আয়! প্রথম প্রথম এমন নার্ভাস লাগবে, কিন্তু পরে সবকিছুতে অভ্যস্ত হয়ে যাবি!
অদ্রি মনে মনে বলল,
— আমি অভ্যস্ত হতে চাই না।
কিন্তু সরাসরি কথাটি বলতে পারলো না। শায়লা তো আর জানে না তার ছেলে রাতে ওকে কত অপমানজনক কথা বলেছে! অদ্রি সেসব কাউকে বলতে চায় না। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সিঁড়ির দিকে পা বাড়ালো ও। ধ্রুবর ঘরের দরজার সামনে এসে দম নিলো। তারপর ঢুকে পড়লো। ধ্রুব তখন গভীর ঘুমে। অদ্রি ওর থেকে দূরত্ব বজায় রেখে অনেকক্ষণ চেষ্টা করলো ওকে জাগানোর। কিন্তু ব্যর্থ হলো। তারপর বিরক্ত হয়ে যখন এলার্ম ঘড়িটা একদম ওর কানের কাছে নিয়ে বাজিয়ে দিলো, কয়েক সেকেন্ডেই ধ্রুব’র ঘুম ভেঙ্গে গেলো। মুখের ওপর ঝুঁকে থাকা মানবীকে দেখে লাফিয়ে ওঠে বসলো। রেগে বলল,
— এসব কি করছো? মে’রে ফেলতে চাও নাকি আমাকে?
অদ্রি মুচকি হেসে বলল,
— না। আন্টি ব্রেকফাস্টে ডেকেছেন বলেই এসেছি। দয়া করে এসে আমাকে উদ্ধার করুন!
ধ্রুব’র গলার স্বর নমনীয় হলো,
— অনেকক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছে?
— জি, অনেকক্ষণ।

মা অপেক্ষা করছে শুনেই ধ্রুব চট করে ওঠে গেলো। অদ্রি শুধু অবাক হয়ে দেখলো ধ্রুব ওর কথার মাঝে কোনো বাকবিতণ্ডা না করে কি সুন্দর ফ্রেশ হতে চলে গেলো! যতই হোক, অদ্রি দেখেছে লোকটা তার মায়ের ভালোবাসা পেতে অনেকখানিই ডেসপারেট! এমনকি এই নিয়ে ওর মধ্যে হিংসাত্মক মনোভাবটা পর্যন্ত আছে!
অদ্রির নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে!

[ গঠনমূলক মন্তব্য আশা করছি (নেক্সট না)। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। সবকিছুর শুরু, তাই গল্পের রোমান্টিকতা আসতে সময় লাগবে।]

চলবে…