#বিয়ে
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-৯
অদ্রি বললো ভাবলেশহীনভাবে। কিন্তু ধ্রুব’র মন মুহূর্তেই ভালো হয়ে গেলো। মেয়েটা ওর ঘুম-স্বাস্থ্য নিয়ে ভাবছে! ও চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে ওঠে এলো। দু’জনেই ঘরের দিকে পা বাড়ালো। ধ্রুব শুধু রুক্ষ স্বরে বলল,
— থ্যাংকস।
— আমি মানবতার খাতিরেই বলেছি। অন্যকিছু ভাবার বেশি প্রয়োজন নেই।
ধ্রুব আচমকা মাথা চুলকে অদ্রিকে জিজ্ঞেস করলো,
— তোমার নামটা যেন কি?
অদ্রি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। একরাশ বিস্ময় নিয়ে সে প্রশ্ন করলো,
— আপনি আমার নাম জানেন না?
অদ্রি এমনভাবে কথাটা বললো যেন ও অষ্টম আশ্চর্য দেখে ফেলেছে। যে লোকটা দেখলেই ওকে খোঁচা দিয়ে কথা বলে সেই লোকটা নাকি ওর নাম-ই জানে না। অদ্রি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ততক্ষণে ওরা রুমে এসে পড়েছে। ধ্রুব বিছানা থেকে কাগজপত্র সরাতে সরাতে বলল,
— আমার আসলেই খেয়াল নেই।
অদ্রি দাঁড়িয়ে দেখছিলো ওকে। কথাটা শুনে ও অবাক গলায় বলল,
— সিরিয়াসলি? আমি ভেবেছি আপনি এটা মজা করে বলেছেন।
— আমি সত্যিই মজা করছি না।
অদ্রি কপাল কুঁচকে চেয়ে থাকে। খানিকটা কাঠিন্য নিয়ে বলে,
— জানেনই না যখন, আর জানার কোনো প্রয়োজনও নেই। এমনিতেও আমাকে আপনার তেমন দরকার পড়বে না যাতে করে নাম জানা আবশ্যক।
ধ্রুব দরাজ কন্ঠে বলল,
— তোমাকে দেখে সহজসরল মনে হলেও তুমি আসলে একটা কঠিন মেয়ে।
— এটা কি দোষের কিছু?
— না। তবে সবক্ষেত্রেই কি কঠিন হওয়া ঠিক?
অদ্রি আগের মতোই ভাবলেশহীন হয়ে গেলো। ওর এখন কোনো কথা বলতে ইচ্ছে করলো না। আচমকাই যেন সারা শরীরে নেমে এসেছে ক্লান্তি। ছোট্ট করে বলল,
— জানি না। আপনার সাথে আমার সেরকম ভাব হওয়ার সম্ভাবনা নেই, সেজন্য হয়তো আমাকে আপনার কঠিন মনের মেয়ে মনে হয়।
ধ্রুব আরকিছুই জিজ্ঞেস করলো না। অদ্রি নতুন করে আবারও মেঝে ঝাড়ু দিলো, সুন্দর করে বিছানা করলো, তারপর শুয়ে পড়লো। ধ্রুব বিছানার হেডবোর্ডে পিঠ ঠেকিয়ে সবকিছু দেখতে লাগলো। হঠাৎ অদ্রি মাথা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
— আপনার সমস্যা না হলে আলোটা নিভিয়ে দিই? নাকি কাজ করবেন? বেশি আলো আমার ভালো লাগে না।
ধ্রুব কাঠ কাঠ গলায় বলল,
— দাও।
অদ্রি ওঠে গিয়ে সুইচ অফ করে দিলো। তার বদলে জ্বালিয়ে দিলো বেগুনি রঙের ছোট্ট একটা ল্যাম্পশেড। পুরো ঘরে ছড়িয়ে পড়লো এক ধরণের নরম মায়াবী আলো। অদ্রি ধ্রুবকে বলল,
— থ্যাংকস।
ধ্রুব মনে মনে বলল,
— তোমার থ্যাংকস কি আমার চোখে ঘুম এনে দেবে?
কিন্তু মুখ ফুটে সেটা বললো না। অন্ধকারে গাল ফুলিয়ে বসে রইলো আগের মতোই। কাল সারারাত ঘুমাতে পারেনি অদ্রির কারণে। বিড়ালছানার মতো ঘুমুয় মেয়েটা। তখন ওকে এতো আদুরে লাগে যে ধ্রুব এক মুহূর্তের জন্যেও নিজের চোখ সরাতে পারে না। ইচ্ছে
করে অদ্রির কপালে চুমু খেতে, বুকের ভেতর জড়িয়ে নিয়ে ঘুমাতে। কিন্তু ধ্রুব সেই ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিতে পারে না। কোথায় যেন বাঁধে তার। হয়তো ইগোতে!গতরাতে এই অনুভূতির তৃষ্ণা ওকে ঘুমাতে দেয়নি। প্রথম দিনের মতো বিছানায় ধ্রুব’র পাশে ঘুমালে না হয় মেয়েটাকে একটু ছোঁয়া যেতো, চুলে হাত বুলিয়ে দিতো কিন্তু না! অদ্রি মেঝেতেই নিজের বিছানা করে নেয়। এই মহাযন্ত্রণা ধ্রুব আর নিতে পারছে না। মায়ের ওপর রাগ হচ্ছে। ধ্রুবকে এমন উলটপালট করে দিতে কেন এমন একটা পুতুল মেয়ের সাথে ওকে বিয়ে দিলো? এই যে টান, মায়া, অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে! এটাই কি তাহলে বিয়ে নামক সম্পর্কের মূল জিনিস? যেখানে প্রতিনিয়তই একে-অপরের মায়ায় জড়িয়ে পড়ে? সঙ্গীর ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে? অন্ধকারে ধ্রুব নিজের চুল খামচে ধরে। ও তো কখনোই চায় নি এসব!
সকালবেলা শায়লা হাসান আর আশফাক সাহেব লিভিংরুমে বসে আলোচনা করছেন অদ্রির পড়াশোনার বিষয়ে। কিছুদিন পরই অদ্রির এডমিশন এক্সাম। এখন কোথায়, কিভাবে ভর্তি করালে অদ্রির সুবিধা হবে সেটা নিয়েই তারা দু’জন চিন্তিত।
কাজটাজ শেষ করে জরিনা আর অদ্রি টিভি দেখছে আর গল্পও করছিলো। ধ্রুব সোফায় বসে ফোন স্ক্রল করছে। একসময় শায়লা হাসান ওর পাশে এসে বসলেন। ছেলেকে উদ্দেশ্যে করে বললেন,
— কিছু কথা ছিলো তোমার সাথে।
ধ্রুব’র মনোযোগ ফোনের স্ক্রিনে। মায়ের কথার শুনে ছোট্ট করে বলল,
— হুঁ, শুনছি।
শায়লা ধীর গলায় বললেন,
— তোমার বাবা খোঁজ নিয়েছিলেন তার বন্ধুর সাথে, অদ্রির এডমিশন প্রিপারেশনের ব্যাপারে।
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকালো,
— কে অদ্রি?
শায়লা হতভম্ব হয়ে ছেলের দিকে তাকালেন। জরিনা হা হা গেলো। অদ্রি একপলক সবাইকে পর্যবেক্ষণ করে নিজের মতো টিভিতে মনোযোগ দিলো। জরিনা
চোখ বড় বড় করে বলল,
— ভাইজান আফনে নিজের বউয়ের নাম জানেন না?
এ কি কথা!
ধ্রুব হকচকিয়ে গেলো। মেয়েটার নাম অদ্রি, হ্যাঁ মনে পড়েছে ওর। প্রথমদিন বাবা ওকে এই নামেই ডেকেছিলো। ইশ, মায়ের সামনে কি একটা লজ্জাজনক পরিস্থিতি তৈরি হলো! মেয়েটা ওকে নাজেহাল বানিয়ে ফেললো একদম। এদিকে শায়লা রেগে গেলেন,
— এসব কি ধ্রুব? তুমি তো ছোট বাচ্চা নও। আমার সাথে মজা করছো?
ধ্রুব বিব্রতবোধ করলো প্রচন্ড। হাসার চেষ্টা করে বলল,
— ট্রাস্ট মি, আ’ম জোকিং।
— রিয়েলি?
ধ্রুব মাথা নাড়তে নাড়তে বলল,
— অফকোর্স, অফকোর্স।
জরিনা মুখ বাঁকা করে বলল,
— ভাইজানে আবার মজাও করে, হুহ!
শায়লা কড়া চোখে তাকালো ধ্রুবের দিকে। তারপর বলল,
— সে যাইহোক, আমি অদ্রির ব্যাপারে বলছিলাম। ওর সামনে এডমিশন। তোমার বাবা তার পরিচিত বন্ধুর সাথে কথা বলেছেন। তার একটা কোচিং সেন্টার আছে। বেশ ভালোই নাম-ডাক। তুমি একটু অদ্রিকে নিয়ে যেও সেখানে।
ধ্রুব জিজ্ঞেস করলো,
— কখন যেতে হবে?
শায়লা উত্তরে বলল,
— বিকেলে। টাকা-পয়সার ব্যাপারটাও দেখে নিও।
ধ্রুব ওঠে যেতে যেতে বলল,
— রেডি হয়ে থাকতে বলো তোমার মেয়েকে। অহেতুক
লেইট করলে আমি কিন্তু খুব রেগে যাবো।
বলেই অদ্রির দিকে তাকালো। ওর কথা শুনে অদ্রি রেগে তাকালো। ওর রাগী চেহারা দেখে যেন খুব মজা
পেলো ধ্রুব। শায়লা দু’জনকে দেখে কেবল হাসলেন। যাইহোক, দুজনের মধ্যে তাহলে মিলমিশ হচ্ছে। তিনি নিশ্চিন্ত মনে ঘরের দিকে পা বাড়ালেন।
রোদে চকচক করছে ধরণী। পড়ন্ত বিকেলের এই রোদ্দুরে তেমন তাপ নেই। আকাশ ঘন নীল। সাদা মেঘের দল একসাথে পাড়ি দিচ্ছে অনেকটা পথ। বাড়ির লনে ওড়াওড়ি করছে কবুতরের দল।
অফিসে তেমন কাজের চাপ না থাকায় একটু আগেই ফিরেছে ধ্রুব, যাতে অদ্রিকে নিয়ে বেরুতে পারে। কিন্তু বাড়ি ফিরে দেখে অদ্রি ভীষণ ব্যস্ত। ঘর্মাক্ত চেহারা নিয়ে
ঘর গোছাচ্ছে। ধ্রুব’র ঘরের যে অংশটুকুতে স্পেস আছে সেখানে নিজের একটা পড়ার টেবিল রেখেছে। পাশেই মাঝারি আকারের একটা ওয়্যারড্রোব। সেখানে লাগেজ থেকে খুলে নিজের জামা-কাপড় রাখছে। জরিনা ওর বইগুলো সাজিয়ে রাখছে। ধ্রুবকে দেখে অদ্রি ধীর গলায় বলল,
— কাল রাতে বলে রেখেছিলাম আপনাকে। আমি কিন্তু আপনার ঘরের বেশি জায়গা দখল করি নি।
ধ্রুব রুক্ষ স্বরে বলল,
— এগুলো কোথা থেকে এনেছো? তোমার বাসা থেকে?
অদ্রি ব্যস্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,
— না। নতুন নিয়েছি, অনলাইনে অর্ডার করে।
ধ্রুব নিজের ফোন বের করতে করতে বলল,
— বিল পে করে দিচ্ছি আমি।
অদ্রি ওকে অবাক করে বলল,
— পেমেন্ট করে দিয়েছি। আর আপনি কেন আমার বিল পে করবেন? সেরকম কোনো কথা ছিলো নাকি?
ধ্রুব কপাল কুঁচকে ফেললো। এই মেয়ে তো তার চিন্তাধারার বাইরের জগতের। অদ্রি আবারও বলল,
— তবে আমি আন্টিকে মিথ্যে বলেছি।
ধ্রুব বলল,
— মিথ্যে?
অদ্রি গলায় স্বর নিচু করে বলল,
— হ্যাঁ। আন্টি বারবার জিজ্ঞেস করছিলো এগুলোর ব্যাপারে। তাই বলেছি আপনি ব্যাপারটা জানেন। বিলও পেমেন্ট করেছেন। যদিও স্যরি, তবে আমার কিছু করার ছিলো না। আন্টি হয়তো মাইন্ড করতেন।
ধ্রুব কি বলবে ভেবে পেলো না। ওর মনের ভেতর অস্থিরতা শুরু হয়েছে। নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছে। অদ্রি সত্যিই ওর থেকে কিছু নেবে না? বিয়ে না মানলেও বউ হয় ওর, এখন থেকে অদ্রির ছোটবড় সব দায়িত্ব ওর। কিন্তু সেদিন ধ্রুব নিজেই তো বলেছে ওর ঘরের কোনো জিনিসে যাতে অদ্রি হাত না দেয়। অদ্রিও তাই করেছে। তাহলে এই ব্যাপারগুলো ধ্রুব’র গলায় কেন কাঁটা হয়ে বিঁধছে? ধ্রুব ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,
— পাঁচ মিনিটে রেডি হও। তোমাকে নিয়ে বেরুনোর কথা ছিলো।
অদ্রি জবাবে বলল,
— ও তাইতো। শুনুন, কোচিংয়ের টাকাটা আমি আলাদা করে রেখে দিয়েছি, আপনার এতো কিছু চিন্তা করতে হবে না। বাই দ্যা ওয়ে, এই ব্যাপারগুলো আন্টিকে বলবেন না। এটা আমার রিকুয়েষ্ট।
ধ্রুব এবার রেগে গেলো। জরিনাকে ধমকে ঘর থেকে বের করে দিয়ে অদ্রির কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
— তোমার কি মনে হয় আমার কাছে টাকা নেই? এত বাড়াবাড়ি করছো কেন?
অদ্রি হয়ে বলল,
— আমি নিজের খরচ নিজে চালাতে চাইছি। আমি আপনার থেকে এক টাকাও নিতে চাই না।
ধ্রুব চেঁচিয়ে ওঠলো,
— আই সী। তুমি আমার থেকে এক টাকাও নেবে না। তাহলে এতগুলো টাকা কে দিচ্ছে তোমাকে? তোমার বাবা নাকি কোনো রিচ বয়ফ্রেন্ড?
অদ্রি কড়া স্বরে বলল,
— এসব আমার মায়ের টাকা। কিছুদিন পর চাকুরী করলে মায়ের টাকারও প্রয়োজন পড়বে না।
এটুকু বলে থামলো। তারপর খুব শান্ত গলায় পলক না ফেলে ধ্রুব’র চোখে চোখ রেখে বলল,
— আমার আসলে কেউ নেই।
ধ্রুব’র দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে এলো। অদ্রি কি বলছে এসব?
ওর শান্ত গলা আর দু’চোখে টলমল করা জল ধ্রুব’র বুকে তোলপাড় তৈরি করে দিয়েছে। ওর যে কি হলো, আচমকা টেনে অদ্রিকে শক্ত করে নিজের বুকে জড়িয়ে ধরলো!
[ ক্ষমাপ্রার্থী, দেরি হয়েছে আজ বেশ।]
চলবে…