অলীকডোরে চন্দ্রকথা পর্ব-০১

0
454

#অলীকডোরে চন্দ্রকথা। (পর্ব-১)
#আফিয়া খোন্দকার আপ্পিতা

শেখ বাড়িতে পা রাখবার কালে নতুন বরের মতো অনুভূতি হলো সৈকতের। নতুন বরের মতো অস্বস্তি, লাজুকলতা হানা দিল তার চোখে মুখে। অথচ এ বাড়ির কোন মেয়ের বাস না তার ঘরে, আর না তার মনে। তবুও এই অদ্ভুত অনুভূতি কেন! প্রশ্নবিদ্ধ অদ্ভুত অনুভূতির উত্তরটা অবশ্য জানা সৈকতের। কাল রাতে এ বাড়ির বড়ো কন্যাকে বিয়ে করেছে সৈকত। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো তার ঘরে কিংবা মনে নয় তার নববধূর বাস তার অলীকে। । মনে, ঘরে না থাকা মানুষের বাস অলীকে? এ বড়ই আশ্চর্যজনক ব্যাপার।

ঘটনার সুত্রপাত গেলরাতে। ঘুমের ঘোরে স্বপ্ন এসেছে, প্রেম হাতে চন্দ্রকথা। বন্ধ চোখে অলীক ডোরেই সেরেছে পরিণয়। নীল কাগজের বুকে গট গট করে লিখেছিল নিজের নামটা। স্বপ্নডোরেই সৈকত অনুভব করেছিল, সাক্ষর করবার পর তার প্রসন্নতা। তারপর লাল টুকটুক বউকে এনে বসাল তার কাছেপাশে। দুজনার মাথা এক করে নেটের ওড়নায় ডাকা হলো। দুজনার সামনে নকশি আয়না ধরতেই ভেসে উঠল মেরুন শেরওয়ানির সুদর্শন যুবক এবং লাল বেনারসি পরিধেয় লাল টুকটুকে বউয়ের মুখখানা।

বধূবেশী কন্যার পানে এই প্রথম চোখ পড়ল সৈকতের। আয়নায় চোখ রাখতেই দৃষ্টি আটকে গেল। গোলাকার মায়া মায়া মুখখানা কী মিষ্টি দেখাচ্ছে! মুখে প্রসাধনীর বাহার, তা ভেদ করে উঁকি দিচ্ছে লাজুকতা। ভারি আস্তরের পল্লব বারবার উঠানাম করছে, লাজুক টানা চোখের দৃষ্টি নিজের কোলেতেই নিবদ্ধ। সৈকতের চোখে চোখ রাখবার সাহসটি হচ্ছে না তার। লজ্জাবধূকে দেখে চোখে ঘোর লাগল সৈকতের। ওদিকে পাশ থেকে কেউ একজন যে প্রশ্ন করল , ‘আয়নায় কী দেখতে পারছো, সৈকত?’
সেই প্রশ্নখানার উত্তর দেবার খেয়ালটি নেই। সে তো বিভোর হয়ে আছে তার নারীতে। লোকলজ্জা ভুলে আয়না থেকে চোখ উঠিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে চাইল সে। যেন আয়নায় দেখে চক্ষুতৃষ্ণা মিটছে না তার। সেই চাওয়া ক্ষণ পেরিয়ে দীর্ঘ হলো, সৈকত চেয়ে রইল অনিমেষ । তার দৃষ্টিতে মুগ্ধতা ঝরে পড়ছে। ভরা মজলিসে তার ওমন চাহনি দেখে হাসির রোল পড়ল। ঠাট্টা আর হৈহৈ এ পরিবেশ ভারি হলো। এক ভাবি টিপ্পনী কাটল,
‘সব দেখা এখনই দেখে ফেলবে না কি দেবরজি! কিছু দেখা রাখো বাসর ঘরের জন্য!’

বরমশাইয়ের সেসবে খেয়াল নেই। সে মত্তমনে দেখছে তার হৃদহরণীকে। বধূবেশি কন্যা এমনিতেই লজ্জায় লাল হয়েছিল উপরন্ত আশপাশ থেকে ভেসে আসা হাসি ঠাট্টা আর বরের ওমন চাহনিতে
তার চাহনিতে লজ্জাবতী লতার মতো নুয়ে পড়ছিল যেন। ক্ষণ কাটল অনেক। তারপর ধ্যান ভাঙাতে এগিয়ে এলো বন্ধু অন্তর। কাধ চাপড়ে বলল,
‘ কিছুক্ষণ পর ডিনার করে বাসায় পাঠিয়ে দিব তোদের। তখন বউকে পাশে না কোলে বসিয়ে দেখিস সারারাত। এখন ঘোর ছ্যাইড়া উত্তর দে, মামা।’

এতেই ধ্যান ভাঙল সৈকতের। চারপাশে তখন হেসে গড়াগড়ি খাওয়ার দৃশ্য চলছে। বেশ বিব্রতবোধ করল সৈকত। নড়েচড়ে বসল সে। সে কী অস্বস্তি তার! আয়নায় চাইল এক পলক। মেয়েটার অস্বস্তির পরিমাণ তার থেকে বেশিই ঠেকল। সৈকত বোকা হাসল। টিপ্পনী কাটা ভাবি আবার টিপন্নী কাটল,
‘ তোমার দেখার পর্ব শেষ হলে বলো, আয়নায় কী দেখতে পারছো?’

সৈকত আবার চাইল আয়নায়। লাবণ্যময়ীর পানে এক নজর দিতেই উত্তরটা আপনাআপনি বেরিয়ে এলো, ‘আমার চন্দ্রকথা।’

হৈহৈ পড়ল। প্রগাঢ় প্রেম নিয়ে বলা কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছতেই প্রথমবারের মতো আয়নায় বরের মুখ পানে চাইল সৈকতের চন্দ্রকথা। দৃষ্টিতে দৃষ্টি পড়ল দুজনার। তড়িৎ চোখ সরাল লাজুকলতা। এবার তার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করা হলো, ‘আয়নায় কী দেখতে পারছেন, ভাবি?’

লাজুকবধূ নামানো দৃষ্টি আবার তুলল, চাইল সৈকতের পানে। তার ঠোঁটের কোণে লজ্জার সাথে হাসির রেখা ফুটে উঠল। চোখের ভাষা ভিন্ন। স্থির, প্রগাঢ়, অর্থবহ। যেন সে কথায় নয় চাহনিতেই উত্তর দিচ্ছিল। সেই দৃষ্টির গভীরতা এতখানি ছিল যে সৈকতের হৃদপিণ্ড ছলকে উঠেছিল। সেই ঝলকানিতে ঘুম ছেড়েছে চোখ থেকে।

চোখ খুলে স্বপ্ন বাস্তবের দ্বিধায় পড়ে লজ্জা নিয়ে পাশে চাইল সৈকত। পাশে লাল টুকটুকে বধূবেশী নারী নয় বরং একটা লাল কভারের একটা কোলবালিশ নজরে এলো। দেয়ালে ঘুরে বেড়ানো একটা টিকটিকি ছাড়া পুরো রুমে তৃতীয় কোন প্রাণের অস্তিত্ব খুঁজে পেল না। অথচ প্রগাঢ় প্রেমে তখনো তার বুক কাঁপছে, বিয়ে বিয়ে সুখে নাচছে মন। তার মনের এক সত্তা হতাশ হয়ে বলল, ‘ইশ! এটা স্বপ্ন না হলেই পারতো। ‘

স্বপ্নের দ্বিধা কেটে বাস্তবে পদার্পণ করতেই সেই হতাশা অস্বস্তিতে রূপ নিল। পরিচিত ওমন মুখটাকে নিজের বউবেশে কখনো কল্পনা করা হয়নি তার। ভাবতেই মুখ কুঁচকে আসছে। এমনটা হয় না কি! হুট করে এমন আজগুবি স্বপ্ন আসল কেন! এহেন অদ্ভুত, প্রেম মাখা স্বপ্ন কখনোই আসেনি ওর। এই প্রথম এলো, তাও এমন একজনের সাথে যাকে সে স্নেহের চোখে দেখে! মেয়েটা এই বেশে এলো কেন স্বপ্নে! তাকে তো কখনো স্নেহ ছাড়া প্রেম চোখে দেখা হয়নি।

ঘড়ির কাটায় তখন রাত ৩টা ৩২মিনিট। পানি খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করল সৈকত। কিন্তু ঘুম ধরা দিল না, চোখ বন্ধ করলেই স্বপ্নটা এসে ভাসছে। সেই নারী, সেই ডাক, সেই চাহনি এখনো ভাসছে চোখে। বাজছে কানে। বুক কাঁপছে, অস্থিরতা মনস্তাপ জুড়িয়ে যাচ্ছে। বাকি রাত ঘুম হলো না, ছটপট করতে করতেই কাটল।

সকাল বেলা ডাক পড়ল শেখ বাড়িতে। বধুবেশী কন্যার সামনে যেতে তার অস্বস্তি হচ্ছিল ভীষণ! যাবার ইচ্ছে হলো না কিঞ্চিৎ । কিন্তু শেখ বাড়ির একমাত্র ছেলের অসুস্থতার কথা শুনে আর থাকা গেল না। অস্বস্তি চেপে পথ ধরতে হলো।

___

শেখ বাড়ির উঠোন পেরুবার সময় অস্বস্তি মাত্রা বাড়ল সৈকতের। কাল স্বপ্নে এই উঠোনেই বিয়ে সারা হয়েছিল তাদের। স্বপ্নের বরবেশী ভাবটা বাস্তবে হানা দিল। নিজেকে বরের মতোই মনে হলো। এ পর্যায়ে নিজের উপর নিজেই বিরক্ত হলো। ঘুমের ঘোরে দেখা স্বপ্ন কখনোই মনে থাকে না ওর। চোখ খুলতেই ভুলে যায়। আজ এত করে চেয়ে ও ভুলতে পারছে না কেন! আশ্চর্য!
উঠোন পেরিয়ে দোতলা দালানের দিকে এগুতে এগুতে সৈকত দোয়া করল, যাতে স্বপ্ন ভুলে যায় আর মেয়েটার সামনে না পড়ে। ভীষণ অস্বস্তি লাগবে ওর।

প্রার্থনা অগোচরে থাকার, অথচ অবচেতন মনের চাওয়া যেন সেই নারীর গোচর হওয়াতেই নিবদ্ধ। তাইতো চোখ জোড়ার দৃষ্টি কখনো এঁকে, কখনো বেঁকে আশপাশেই ঘুরছিল। যেন আজ মনচক্ষু দিয়ে পরখ করতে চাইছিল স্বপ্নে দেখা রমনীর মুখখানা কি আসোলেই ওমন মায়ায়মাখা! দৃষ্টির খোঁজ নিতে নিতে একতলা পেরিয়ে দোতলায় উঠল। নাহ্! বন্ধু অন্তর ছাড়া দ্বিতীয় কাউকে চোখে পড়ল না। প্রার্থনার জয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে দক্ষিণার রুমে ডুকল সৈকত।

সাধারণত, রোগী দেখতে এলে রোগীকে ব্যাথাতুর চেহারায় বিছানায় পড়তে থাকতে দেখা যায়। আজ সেই চিরচেনা নীতি ভাঙতে দেখল সৈকত। হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে বিছানার পরিবর্তে মেঝেতে পাতানো বিনব্যাগে বসে আছে রোগী। ব্যান্ডেজ করা পা অবহেলায় ফেলে রেখেছে মেঝেতে। ব্যান্ডেজে প্যাঁচানো এক হাত, অন্য হাতে কোকের ক্যান ধরা। চেহারায় ব্যাথার লেশমাত্র নেই, ঠোঁটের কোণে হাসির রেশ। তার পাশে বসা দুই যুবক। রোগী প্রফুল্ল চিত্তে তাদের সাথে গল্প করছে। সৈকতকে দেখে হেয়ালি করে বলল,
‘ কী অবস্থা মামা?’

ওর কথার ভঙ্গি দেখে সৈকত সন্দেহী চোখে চেয়ে বলল,
‘ রুবাব! তোর ব্যান্ডেজের ভেতরে ভাঙাচুরা আছে না কি হুদাই প্যাঁচাইয়্যা রাখছোস!’

রুবাব নামের ছেলেটা হাসতে হাসতে বলল, ‘
এক্কেবারে পিওর কা/ টা। হাতে চার সেলাই লাগছে। পায়ে সেই ব্যাথা। প্রেমের জ্বালা বড়ই করুণ, বন্ধু!’

রুবাবের কথা শুনে মনে হলো সে এই ব্যাথা নিয়ে ব্যাপক খুশি। সৈকত ভ্রু কুঁচকাল,
‘তাও চিল করছিস কিভাবে!’

‘ প্রেমিকদের অল্পতে ভেঙে পড়তে হয়না। প্রেমিকদের সহিষ্ণু হতে হয়। সহিষ্ণুরা সবকিছুতে চিল করে। প্রেমিকার কান্না ছাড়া কোন কিছু তাদের আহত করতে পারে না। ‘ বলে বিজয়ী হাসল রুবাব। ভাব খানা এমন যেন খানিক আগে কেউ ওর দিকে মেডেল ছুঁড়ে মেরেছে, আর সে সেটা ক্যাচ করতে পেরেছে।

রুবাবের পাশের বিন ব্যাগে বসতে বসতে সৈকত প্রশ্ন করল, ‘ কাহিনি কী!’

রোগীর পাশে আগ থেকে বসে ছিল দুই যুবক। নাম, অন্তর আর নাহিদ। উত্তরটা দিল অন্তর, হাসতে হাসতে
‘ শা/লার তাড়ানি খাইছে।’

ঘটনা হলো, রুবাব একটা মেয়েকে ভালোবাসে। নাম, সেঁজুতি। প্রেমের বয়স দুই বছর ছুঁইছুঁই। রুবাব স্বাধীন, প্রফুল্ল যুবক। গা ভাসিয়ে প্রেম করছে, কোন বাঁধা নেই। সেঁজুতি রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে। প্রেম ভালোবাসা পারিবারিকভাবে নিষিদ্ধ। বলা হয়ে থাকে, নিষিদ্ধ কাজে আসক্তি বেশি। এই আসক্তিটাই ঘিরে ধরেছে সেঁজুতিকে। ভার্সিটির বড়ো ভাইয়ের সাথে কিভাবে যেন প্রেম হয়ে গেল। মনের লেনাদেনা হলো। রাত জেগে কথা বলা, সময় পেলে মুক্ত পাখির মতো বাইকে ঘুরা, সিনেমা দেখা, ক্যাম্পাসে ঘন্টার পর ঘন্টা একসাথে বসে থাকা। পরিবারের অগোচরে লুকিয়ে চুবিয়ে বেশ চলছিল সেঁজুতির প্রেম। বিপত্তি বাধল মাসখানেক আগে। কোন একভাবে বোনের প্রেমকথা জেনে যায় সেঁজুতির ভাই সাদাত, পেশায় পুলিশ। তারপর সেঁজুতিকে শাসিয়ে ঘর বন্দী করে ফেলে। বের টের হওয়া নিষেধ। মুক্ত বিহঙ্গ যেন ডানা কে/ টে মাটিতে আছড়ে পড়ল। বিরহে চোখে সর্ষে ফুল দেখল যুগলের। সমাধান স্বরূপ রাত বিরাতের ছাদদর্শনে নামল তারা। লুকিয়ে চুবিয়ে মধ্যরাতে সেঁজুতির বাসার ছাদে গিয়ে দাঁড়ায়। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কখনো আকাশের চাঁদ দেখা, কখনো আবার একে অপরের চাঁদমাখা মুখ দর্শন আর দুটো আলাপ সেরেই বাড়ি ফিরে। গতকাল রাতে ও গিয়েছিল। বিধিবাম টের পেয়ে বসল সাদাত। হাতে নাতে ধরে ফেলল। তোপের মুখে পড়ে প্রাণ নিয়ে বাঁচতে চারতলার পাইপ বেয়ে নামতে ধরল। তাড়াহুড়ায় অসাবধানতা বসত নিচে পড়ে গেল। ভাগ্য ভালো নিচে বালির স্তুপ ছিল। বেশি একটা লাগে না। বালির স্তুপে বেলছা ছিল। সেটা হাতে লেগেছে। ততক্ষণে নিচে নেমে গেছে সাদাত। এক হাতে রিভলবার, অন্যহাতে লাঠি। ধাওয়া করল আবার। কাটা হাত নিয়ে নিয়ে নিয়ে প্রাণপণে দৌড় দিল রুবাব। নিজের কাধে খু……নের দায় না নিতে রিভলবার কোমরে গুজে লাঠি তাক করে পেছনে রীতিমতো দৌঁড়াচ্ছে সাদিত। এই দৃশ্যখানা কল্পনা করে না চাইতে ও হেসে ফেলল সৈকত। হাসি থামিয়ে বলল,
‘ প্রেমের জ্বালায় হাত কা/টছে বুঝলাম। কিন্তু পা? পা কি প্রেমিকার বিরহে শহীদ হয়েছে?’

নাহিদের হাসি চেপে বলল, ‘ পালাবার সময় উষ্ঠা খেয়ে গুষ্টি ভুলে নখ উলটে ফেলছে। ‘

সৈকতের হাসি নিভল এবার। চেহারায় চিন্তার রেখা টেনে বলল, ‘এই শরীর নিয়া ক্যামনে ফিরলি? একটা ফোন দিবি না? দৌড় প্রতিযোগিতার পর কাধে কইরা নিয়া আসতাম।’

সৈকতের কথায় সাহায্যের ইঙ্গিত থাকলেও রুবাব সেটাকে কৌতুক হিসেবেই নিল। হতাশ স্বরে বলল,
‘ মজা লস ? আমার মতো অবস্থা হলে বুঝবি কত ধানে কত চাল।’

অন্তর প্রতিবাদী সুরে বলল, ‘আমি হইলে ধান চাল এক কইরা শালারে ডুবাইতাম। তোর মতো আহত হইলে পালাবার সময় শালার বইনেরে লোইয়্যা আইতাম।’

সৈকত বলল, ‘ লক্ষণ সেনের মতো পালাতে গেলি ক্যান! ধরা যখন পড়েই গিয়েছিলি তখন কনফেস করে ফেলতি! প্রেমিকদের শুধু সহিষ্ণু না, সাহসী ও হতে হয়। ‘

‘রিভলভার দেখলে বিয়ার আগে নিজের জানের খেয়াল আসে। শালা ভয়ংকর লোক। কনফেস করার সময় নিলে শ্যু/ ট করে দিত। জান নিয়ে ফিরেছি, এই অনেক। ‘ হাফ ছেড়ে বলল রুবাব।

থেমে প্রতিজ্ঞার সুরে বলল, ‘খালি একবার বিসিএসটা হইতে দে। তারপর শালারে দেইখ্যা নিমু।’

কথার ভঙ্গি দেখে মনে হলো খু……ন টু……ন করবে। বন্ধুরা ভয় পেল। আতঙ্ক নিয়ে বলল, ‘কী করবি?’

রুবাব ফোঁসফোঁস করে বলল, ‘ তখন আমারে সেঁজুতির সাথে দেখা করতে দিতাছে না, তখন আমি ও দিমু। পোস্টিং নিয়া বাংলাদেশের শেষ প্রান্তে চইল্যা যামু। বাসায় গেলে ও না চেনার ভান করে বলল, হু আর ইউ!’

ওর শিশুসুলভ প্রতিশোধের কথা শুনে বন্ধুদের স্বস্তি মিল, মিলল হাসি ও। হাসির পর্ব শেষে নাহিদ বলল, ‘আন্টি আংকেলরে ক্যামনে ম্যানেজ করলি?’

রুবাব বলল, ‘বাবা মা বাসায় নেই। কাল বিকেলে গ্রামের বাড়ি গেছে। মুন আছে শুধু। ‘

‘মুন!’ নামটা কানে যেতেই এতক্ষণ ভুলে বসা স্বপ্নের কথা মনে পড়ল সৈকতের। চোখে ভাসল হৃদয় নিংড়ানো দৃষ্টি। মন আওড়াল, ‘আমার চন্দ্রকথা’ শব্দ দুটো। কানে প্রতিধ্বনি তুলল সৈকতের। অস্বস্তি ভেসে উঠল মুখে। রুবাব সুখ সুখ ভাব নিয়ে বোনের গল্প করছে।
‘ মুন তো আমারে দেইখ্যা কেঁদেই বেহুশ। সারারাত জেগে বসেছিল। কত করে বললাম, ঘুমাতে। যায় নাই। জেগে জেগে সেবা করছে। আজ ভার্সিটিতে ও যায় নাই। যাইতে বলায় মায়ের মতো চোখ রাঙাল। পাগলী!’

বোনের কথা বলবার সময় রুবাবের মুখখানা উৎফুল্ল হয়ে গেল। বোনের প্রতি তীব্র স্নেহ আর ভালোবাসা, সন্তুষ্টি প্রকাশ পাচ্ছিল। অন্তর বলল, ‘মেয়েটাকে কষ্ট দিলি ক্যান। আমাদের ফোন দিতি। আমরা আসতাম।’

বন্ধুর বোনকে বোনের চোখেই দেখে ওরা। ‘তোর বোন মানেই আমার বোন’ ধরনের চিন্তা ধারা সবার। স্নেহ ছাড়া ভিন্ন কোন অর্থে ইতঃপূর্বে দেখেনি কেউ। সেই স্নেহ থেকেই নাহিদ আর অন্তর এটা ওটা বলছে। কিন্তু সৈকত কিছু বলছে না। মুখে অস্বস্তির রেখা টেনে নিশ্চুপ স্বপ্নে বিয়ে করা বউয়ের গল্প শুনছে। এলোমেলো স্বপ্নের উপর বিরক্ত হচ্ছে, এমন অদ্ভুত স্বপ্ন আসার মানে কী!
আজ রুবাবের গল্পের ট্রেন চলছে বোনকে ঘিরে। এতে সৈকতের বিরক্তি বাড়ছে। এমনিতেই এলোমেলো ভাবনা আসছে মাথায়, তার উপর রুবাবের বোনের গল্প শেষই হচ্ছে না। আজ কি রুবাব একটু বেশিই বোনের গল্প করছে না! ভ্রু কুঁচকাল সৈকত। প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে বলল,
‘ পড়াশোনা কদ্দুর তোদের? ‘

একসাথে গ্রাজুয়েশন শেষ করে বিসিএসের প্রস্তুতি নিচ্ছে ওরা। মাস কয়েক বাদেই পরীক্ষা। পড়ার বেশ চাপ। ক্যারিয়ার গড়ার লক্ষ্যে রাতদিন এক করে পড়ছে সবাই। এই সবাই এর দলে ছিটকে পড়া মানুষ, রুবাব। পড়াশোনার ব্যাপারে কিছুটা হেয়ালিপনা আছে তার মাঝে। সেঁজুতিকে বিয়ে করতে হবে বলে ইদানীং সিরিয়াস হয়েছে।

মুনের টপিক বদলে পড়াশোনার দিকে ঘুরল। কে কোন বই পড়ছে সে নিয়ে চলল আলোচনা। সৈকতের অস্বস্তি কাটল। কিন্তু সেটা কেবলই ক্ষণিকের তরে। কথার মাঝে আকস্মিক ডেকে উঠল রুবাব,
‘মুন? মুন? শুনে যা!’

কথা বলছিল সৈকত। দৈবাৎ থেমে গেল। সেইক্ষণে কানে এলো একটা মিষ্টি স্বর,
‘আসছি, ভাইয়া।’

ওই স্বর শুনে কথার খেই হারিয়ে ফেলল সৈকত। নুপুরের ঝনঝন শব্দ তুলে কেউ একজন এগিয়ে আসছে। কাল রাতের ওমন স্বপ্নের রেশ ধরে সৈকতের মাথায় তখনো চলছে আলোড়ন। কিছুতেই মুছতে পারছে না, ভুলতে পারছে না। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। অস্বস্তি হচ্ছে। বুক কেঁপে উঠছে। প্রশ্নবিদ্ধ হবার ভয়ে সৈকত দু’হাতের তালুতে মুখ চেপে অস্বস্তি ঢাকল।
নুপুরের ছন্দ তোলা পদযুগল এসে রুমের দরজায় দাঁড়াল। ধীরে বলল, ‘ ডেকেছিলে, ভাইয়া?’

অন্তর স্নেহের সুরে বলল, ‘মুন! ভালো আছো? পড়াশোনা কেমন চলছে?’
মুন হেসে বলল, ‘ আলহামদুলিল্লাহ। আপনারা ভালো আছেন?’
নাহিদ উত্তর দিল , ‘ আমরাও ভালো আছি। পিচ্চি, তোমাকে একটা দায়িত্ব দিচ্ছি। রুবাবের দিকে নজর রাখবে। রাত বারোটার পর কোনভাবেই বাসা থেকে বের হতে না পারে। বের হলেই আমাদের ইনফর্ম করবে। প্রেম ত্রেম ব্যান করা হয়েছে ওর জন্য। পারবে?’

মুন সায় জানাল। রুবাব প্রসঙ্গ ঘুরাল, ‘ রান্নাঘরে কী করছিস? রাতে ঘুমাস নি। এখন গিয়ে ঘুমাবি। লাঞ্চ বাইরে থেকে আনব।’

বুকের তোলপাড় নিয়েও অনড় ছিল সৈকত, স্বপ্ন যেমনই আসুক বন্ধুর বোনকে স্নেহ ছাড়া ভিন্ন নজরে দেখবে না। কিন্তু মন সে কি আর প্রতিজ্ঞা মানে? সে তো অবাধ্য। অনড়তা ভেঙে চোখকে বাধ্য করল স্বপ্নে দেখা মেয়েটার মুখে বাস্তবে মায়া কতখানি পরখ করতে। চোখ থেকে হাত সরিয়ে তাকাল সম্মুখে। চোখ আটকাল শ্যামবর্ণের গোলগাল মুখখানায়। ডাগর চোখ আর পেশিবহুল গাল দুটোয় এক সমুদ্র মায়া। । চাঁদের মতো কোমল মুখ খানা। একবার দেখলে দেখতেই ইচ্ছে করে। এই জন্যই বোধহয় স্বপ্নে চন্দ্রকথা বলে ডেকেছিল।,
স্বপ্নের মতো তার চোয়ালে লজ্জা না থাকলেও মায়াটা ঠিকই আছে। একটা লাল থ্রি-পিস পরনে, এলোচুলে পনিটেইল বাধা। কটা চুল বেরিয়ে এসেছে কপালের দুই ধারে। সাধারণ বেশভূষা। অথচ সৈকতের মনে হলো তার সামনে লাল বেনারসিতে বধূবেশি মুন দাঁড়িয়ে আছে। আগে কখনো খেয়াল করা হয়নি, মেয়েটার মুখে ভাসা এতখানি মায়া। আজ খেয়াল করল, আটকাল ও বোধহয়। হৃদস্পন্দন বাড়ল। কানে বাজল, ‘আমার চন্দ্রকথা’

মুন তখন শাসনের সুরে চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘ এই শরীর নিয়ে বাইরে যাবার নাম নিবে না। আমি কিন্তু বাবাকে বলে দিব। চুপচাপ ঘরে বসো, আমি রান্না করব।’

থেমে ভাইয়ের বন্ধুদের দিকে চোখ ঘুরিয়ে স্মিত হেসে শ্রদ্ধার সাথে বলল, ‘আপনারা লাঞ্চ করে যাবেন।’

এই ক্ষণে দ্বিতীয়বার স্বপ্নবধূর দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলল সৈকতের। মেয়েটার ওই ডাগর চোখ জোড়ার দৃষ্টি হৃদস্পন্দন বাড়াল সৈকতের। ঠোঁটের কোণের হাসিটা বুক কেঁপে উঠাল। মেয়েটা সাধারণ চোখেই তাকিয়েছে অথচ সৈকতের মতো হলো এরচেয়ে গভীর দৃষ্টি দুটি নেই। মেয়েটা জানে ও না সে কতটা গভীরভাবে কারো স্বপ্নে এসেছে। কারো বুকে তোলপাড় তুলছে। আজ মেয়েটাকে দেখে ওর স্নেহ আসছে না। অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। প্রশ্নবিদ্ধ অনুভূতি আর অস্বস্তিতে বুঁদ হয়ে যাচ্ছিল সৈকত।

এ পর্যায়ে প্রসন্ন হাসল রুবাব। ভীষণ কোমল স্বরে বলল, ‘আচ্ছা যাব না। অনলাইন থেকে অর্ডার দিব। তাও তুই কিচেন থেকে বের হ।’

মুন চলে গেল। একটা দমবন্ধ অনুভূতি নিয়ে বসে রইল সৈকত। বাকিরা গল্প করছে। মুন মিনিট পাঁচেক বাদে আবার ফিরে এলো। হাতে চা নাস্তার ট্রে। সবাই বিনব্যাগে বসা। ট্রে রাখতে হলে নিচেই রাখতে হবে। মুন চারদিকে চোখ বুলাল। অন্তর আর নাহিদ বেশ আপত্তিই জানাল চা আনাতে। রুবাব ট্রে হাতে নিয়ে আদেশ দিল, ‘ কিছু লাগলে আমরা নিবে। তোকে যেন লাঞ্চের আগে তোর রুমের বাইরে না দেখি।’

মুন যাওয়া ধরল। ট্রে রেখে সবাইকে চা নেয়ার ইশারা করল রুবাব। সবাই নিল, সৈকত ছাড়া। সে তখনো অসাড়, গম্ভীর, নিশ্চুপ অনুভূতির আলোড়ন নিয়ে বসে আছে। দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ। রুবাব ওকে পরখ করে কিছুটা হেয়ালি করেই বলে উঠল,
‘ সৈকত, তুই কি নতুন জামাই? চা না নিয়া নতুন জামাইর মতো বইস্যা আছোস ক্যান? চা নে!’

সহসা হকচকিয়ে উঠল সৈকত! বিস্ময় আর অস্বস্তি নিয়ে চাইল। মুনা ভাইয়ের কথা শুনে কৌতুহল নিয়ে পিছু চাইল। দৈবাৎ দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলল। সৈকতকে ভীষণ বিচলিত দেখাল। হাঁসফাঁস করে উঠল। রুবাব ভ্রু কুঁচকাল,
‘তোরে এমন লাগতাছে ক্যান? কিছু হইছে?’

সৈকত মনে মনে বলল, ‘স্বপ্নে তোর বোন আমার চন্দ্রকথা হয়ে গেছে। ‘
কথাটা বলতে পারল না সে। আনমনে কেবল একটা শব্দ উচ্চারণ করল, ‘শা/ লা।’

কেউ জানল না তার স্বপ্নের কথা। বুঝল না শা/লা বলার কারণ।

_______

হোম ডেলিভারিতে লাঞ্চ অর্ডার দিয়েছে রুবাব। ডেলিভারিম্যান খানিক আগে ফোন দিয়েছে, গলির মোড়ে রাস্তার কাজ চলায় ভেতরে আসা যাচ্ছে না। যেন গিয়ে রিসিভ করে। রুবাব মুনকে ডেকে বলল, রিসিভ করতে। মুন বের হবার পর মনে পড়ল, এত পার্সেল মুন একা আনতে পারবে না। এদিকে সে নিজেও যেতে পারছে না। অগত্যা বন্ধুদের সাহায্য নেবার চিন্তা করল। নাহিদ ওয়াশরুমে, অন্তর ফোনে কথা বলছে। সৈকত বসে ফোন দেখছে। রুবাব সৈকতকে বলল,
‘ মুন একা পারবে না, তুই একটু ওর সাথে যা না সৈকত?’

সৈকত বিস্ফোরিত চোখে চাইল। সেই তখন থেকে মুন থেকে পালাতে চাইছে, অথচ ক্ষেত্রবিশেষ মুনের সামনেই পড়তে হচ্ছে । চাপা শ্বাস ফেলে মনে মনে বলল,
‘কাল রাতে তোর বোন আমাকে হালাল করেছে, আজ তুই হালাল করছিস। ‘

‘যাচ্ছি।’ বলে পা বাড়াল। কদম বাড়ার সাথে সাথে ক্রমশ বাড়ল অস্থিরতা, অস্বস্তি। বুকে তোলপাড় নিয়ে মুখোমুখি হলো স্বপ্নে বিয়ে করা বউয়ের সাথে।

______

চলবে……