বিয়ে পর্ব-২৫

0
667

#বিয়ে
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব-২৫

অদ্রি চরম বাকরুদ্ধ হলো। কথার মর্মার্থ ধরতে না পেরে পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়লো,
— মানে?
— সুস্থ, সুন্দর একটি মন; তোমার কেন সেটা নেই? যেখানে মায়া, প্রেম-ভালোবাসা লুকানো থাকে?
শেষ কথাটা ধ্রুব এমনভাবে বললো যে অদ্রির মুখে অন্ধকার নেমে এলো। মিইয়ে যাওয়া কন্ঠে বলল,
— আছে তো!
ওর ধীরস্বরে বলা কথা শুনে ধ্রুব বক্র চোখে তাকালো।
মেয়েটা কি বুঝতে পারে না ওর এই আচরণগুলো অহেতুক? এই রাগ, জেদ ওকে ওর জীবনের কিছু সুন্দর মুহূর্ত থেকে দূরে সরিয়ে রাখছে? যেগুলো আর কখনো ফিরে পাবে না! ধ্রুব রাশভারী চেহারা নিয়ে তাকায়। কাঠ সুরে চোয়াল শক্ত করে বলে,
— নেই অদ্রি। যদি থাকতো তাহলে তুমি এতদিনে সবটা ঠিক করে নেওয়ার চেষ্টা করতে। আমি নিজের রাগ, ইগো দূরে সরিয়ে তোমাকে বুঝার চেষ্টা করছি, দায়িত্ব পালনের চেষ্টা করছি। কিন্তু তুমি নিজের ইগো দূর করতে পারছো না। কিন্তু সেজন্য আমি তোমাকে সময় দিয়েছি। বাট তুমি সেই সময়টা কাজেই লাগাতে নারাজ। এভাবে সম্পর্ক গড়ে ওঠে না অদ্রি। ভালোবাসার বিনিময়েই ভালোবাসা আশা করতে হয়…
অপ্রত্যাশিত কিছু কথা শুনে অদ্রি ভ্রুকুটি কুঞ্চন করে ফেললো,
— আমি এসব কিছুই আশা করি না। সবাই নিজের মতো বাঁচতে চায়।
ধ্রুব গাম্ভীর্যতা নিয়ে জবাব দেয়,
— নিজের মতো বাঁচতে কেউ মানা করে নি তোমাকে। কিন্তু তুমি যেভাবে ব্যাপারটা নিচ্ছো এটাকে নিজের মতো বাঁচা বলে না। যখন থেকে তুমি বিয়ে নামক বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছো তখন থেকেই তোমার সাথে আরও অনেকের জীবন জড়িয়ে গেছে৷ সেজন্য একা নিজের কথা ভাবলে চলবে না অদ্রি। আমি বিয়ে করতে চাইনি কারণ ঝামেলাহীন জীবন পছন্দ করি। কিন্তু দিনদিন সবকিছু জটিল হয়ে ওঠছে!
অদ্রি চকিতে তাকালো। বলল,
— আমি জটিলতা পছন্দ করি না।
ধ্রুব প্রশস্ত ঠোঁটে হাসে। বলে,
— তুমি জীবনে তোমার প্রিয়জনদের হারিয়েছো। যারা তোমার জীবনের সবকিছু ছিলো। আমি জানিনা এই অনুভূতিটা ঠিক কেমন, তবে একটু হলেও বুঝতে পারি এটা খুবই মর্মান্তিক। সেজন্যই তুমি কারো কথায় আশ্বস্ত হতে পারছো না। কিন্তু মনে মনে যত্ন,
ভালোবাসা আশা করো। অথচ স্বীকার করতে চাও না নিজের জেদ বা ভয়ের কারণে। তবে তুমি চাও আর না চাও, আমি কখনোই তোমাকে ছাড়বো না।

সত্য কথাগুলো বলে দেওয়ায় অদ্রিকে অপ্রতিভ দেখালো। কিয়ৎক্ষণ ঠোঁট কামড়ে বসে রইলো। ধ্রুব আর কথা বাড়ালো না। কাবার্ড থেকে কাপড় নিয়ে বেরিয়ে গেলো সে। অদ্রি একরাশ কুন্ঠা নিয়ে হতবিহ্বল ভাবে ওর যাওয়া দেখলো। ওর অনেক কিছু বলার ছিলো কিন্তু সেটা আর বলা হয়ে ওঠলো না। মনটা বেশ খুঁতখুঁত করতে লাগলো। ধ্রুব’র কথাগুলো তিতে হলেও সত্য বটে! সে ঠিকই কারো কাছে যত্ন, মায়া, ভালোবাসার আশা করে। কিন্তু সেই কারোর
জায়গাটায় কাউকে ভাবতে পারে না। বহুদিন পর অদ্রি চোখ বন্ধ করে নিজের মনের গভীরে খোঁজ চালায়, দেখতে চায় ও; কে অজান্তেই জায়গা দখল করে আছে ওই বদ্ধ কুঠুরিতে। হঠাৎই ও চমকে ওঠে চোখ খুলে তাকায়; যাকে নিয়েই তার এতো সমস্যা
সেই ধ্রুব’র চেহারাটাই কেন ভেসে ওঠলো?
অদ্রিকে ক্রমেই বিষন্নতা গ্রাস করলো। ওর নিজেকে একজন স্বার্থপর মেয়ে মনে হলো। ব্যলকনিতে গিয়ে ধ্রুব’কে নিয়ে ভাবতে বসলো। শুধুমাত্র বৃষ্টি ভেজা এক দুপুর সেই মুহূর্তটার সাক্ষী হয়ে রইলো। এরপর! হাজারো ভাবনাচিন্তা, রাগ, ইগোকে দূরে সরিয়ে অদ্রি ঠিক করলো নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা একবার অন্তত করে দেখবে! বহু কষ্টে এই ভাবনাটা নিজের মনের মধ্যে গেঁথেই সে ক্ষান্ত হলো।

শায়লা লিভিংরুমে বসে ফোনে কথা বলছিলেন বড়ভাই আইঁয়ুব আলীর সাথে। তখনই অদ্রিকে নিচে নামতে দেখলো। ওর চোখমুখ গম্ভীর। যেন মেঘহীন আকাশে হঠাৎই কালো মেঘ জমাট বেঁধেছে। শায়লা ভাইকে বিদায় জানিয়ে ফোনটা কেটে দিলেন। অদ্রিকে চুপচাপ দেখে নিজের কাছে ডাকলেন। অদ্রি এসে বসলো তার পাশে। শায়লা চিন্তিত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
— কি হয়েছে? চোখমুখ এমন শুকনো লাগছে কেন?
অদ্রি ভড়কে গেলো। আমতা-আমতা করে বলল,
— কিছু হয়নি তো…
শায়লা কড়া সুরে বলল,
— মিথ্যে বলিস না। তোর চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা হয়েছে।
— বললাম তো আন্টি কিছু হয়নি।
শায়লা চোখ ছোট ছোট করে বলল,
— ধ্রুব কিছু বলেছে? আমাকে বল…
অদ্রি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই মাথা নাড়িয়ে বলল,
— না না। ওনি কি বলবেন? কিছুই বলেন নি। আমার কিছুই হয়নি। তুমি অহেতুক ব্যস্ত হচ্ছো!
শায়লা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন,
— আমি তোকে যতটুকু চিনেছি খুব ভালোভাবেই বলতে পারি, তুই আমাকে কিছুই বলবি না। তাই জোর করবো না। যাইহোক, কাল সকালেই আমরা বেরিয়ে পড়বো। তোরা দু’জন সবকিছু নিয়েছিস কি-না দেখে নিস মা। আমার গুণধর পুত্রের আবার গ্রামীণ পরিবেশ এলার্জি।
অদ্রি অবাক হয়ে বলল,
— এলার্জি মানে?
শায়লা আলতো হাসলেন,
— গেলেই দেখবি। সবকিছু নিয়ে চেঁচামেচি করে
আমার মাথা খারাপ করে দেবে। তবে এবার মনে হয়
আমি একটু নিস্তার পাবো।
অদ্রি জিজ্ঞেস করল,
— কেন?
— তুই আছিস তো!
অদ্রি হাসার চেষ্টা করলো। ধ্রুব’র গোছগাছ এখনো হয়নি; সেটা আর জানালো না শায়লাকে। কিন্তু বিষয়টা নিজের মাথায় রাখলো।

অদ্রি প্রচন্ড দোটানা নিয়ে হাত দিলো ধ্রুবর কাবার্ডে। সেদিন তো ধ্রুব ওকে অনুমতি দিয়েছিলোই। আর তার চেয়ে বড় কথা অদ্রি ধ্রুবকে ওর কাজে সাহায্য করছে।
এরপর প্রায় সব জামাকাপড় বের করলো। সাথে ওর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বের করে বিছানায় সাজিয়ে রাখলো। কিন্তু কোনটা নেবে বা কি কি নেওয়া উচিৎ সেটা বুঝতে পারলো না। অদ্রি মনে করার চেষ্টা করলো ধ্রুবকে সে কি কি ব্যবহার করতে দেখেছে। কিন্তু ঠিকঠাক কিছুই মনে পড়লো না। অদ্রি অবাক হয়ে ভাবলো সে কোনোদিনই ধ্রুব’র এরকম ছোটখাটো ব্যাপার গুরুত্ব দিয়ে দেখে নি৷ অদ্রি সামনে যা পেলো তা-ই লাগেজে গুছিয়ে নিলো সুন্দর করে। ও হার মানতে নারাজ। সে ধ্রুব’কে দেখিয়ে দেবে, অদ্রি শুধু আশা করে না, দিতেও জানে।

ধ্রুব যখন জানলো অদ্রি ওর সমস্ত গোছগাছ করে রেখেছে বিস্ময়ের চূড়ান্ত সীমানায় পৌঁছে গেলো।
এই প্রথম, অদ্রি ওর জন্য কিছু করেছে। ভাবতেই ধ্রুব’র মন এতটাই শান্ত হয়ে গেলো যে ও নিজে আর চেক করে দেখার প্রয়োজন অনুভব করলো না অদ্রি ওর জন্য কি কি নিয়েছে। ধ্রুব অন্যরকম দৃষ্টিতে অদ্রিকে পরখ করছিলো। ওর চাহনির ধরন দেখে অদ্রির এবার খানিকটা লজ্জায় পড়ে যায়। ব্যলকনি থেকে শুকনো জামাকাপড় ভাঁজ করছিলো ও। কিন্তু ধ্রুব’র অর্ন্তভেদী দৃষ্টির জন্য কোনোকিছুই ঠিকমতো হচ্ছিলো না। একপর্যায়ে ধ্রুব জিজ্ঞেস করেই ফেললো,
— থ্যাংকস। বাট কেন করলে আমার কাজ?
অদ্রি যেন জানতো এমন একটি প্রশ্নের সম্মুখীন সে হবে। আগে থেকেই এ প্রশ্নের উত্তর তৈরি করে রেখেছিলো। ও বিরস মুখে বলল,
— আন্টি বলেছিলো।
ধ্রুব ভ্রুকুটি করলো,
— আ’র ইউ টেলিং দ্যা ট্রুথ? মা বললো আর তুমি করে ফেললে? বিবাহিত জীবনে তুমি কফি এনে দেওয়া ছাড়া আমার জন্য আর কিছুই করোনি। আর আজ মায়ের কথায় সোজা কাবার্ড খুলে জামাকাপড় গুছিয়ে ফেললে?
অদ্রি ভড়কে যাওয়া গলায় বলল,
— কেন? আপনি কি বিশ্বাস করতে পারছেন না?
ধ্রুব তীক্ষ্ণ বলল,
— অভিয়েসলি নট। তুমি মিথ্যে বলতে পারো না বাট চেষ্টা করো কেন?
অদ্রি বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো। লোকটা বুঝে গেলো নাকি? ওর প্রচন্ড লজ্জা অনুভূত হলো। কান রক্তিম হয়ে ওঠল। ধ্রুব এক পা, দু-পা করে ওর সামনে এসে দাঁড়ায়। অদ্রি হতবিহ্বল হয়ে সরে দাঁড়ায়। ধ্রুব খানিকটা নিচু হয়ে ওর এলোমেলো চুল কানের পাশে গুঁজে দেয়। অদ্রি খানিকটা কেঁপে ওঠে চোখ তুলে তাকায়। ধ্রুব’র ঠোঁটে বাঁকা হাসি। খুব ধীর স্বরে অদ্রির কানের কাছে এসে দরাজ কন্ঠে বলে,
— অদ্রি, তুমি ধরা পড়ে গেছো।

অদ্রির গলা শুকিয়ে গেলো। ইচ্ছে করলো কোথাও গিয়ে লুকিয়ে পড়তে। মানুষটা এভাবে ওর মিথ্যেটা বুঝে গেলো? অদ্রির হৃদয়ে বেসামাল এক অনুভূতির জাগরণ ঘটে। চোখদুটো বুজে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা চালায়। ধ্বংসাত্মক অনুভূতি ওর হৃদয়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে। ধ্রুব অনিমেষ চেয়ে থেকে চুপচাপ ওর কপালে একটি চুমু খেয়ে দ্রুত সরে যায়। অদ্রি কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো বাক্যব্যয় করতে পারে না। তবে অন্য সময় রিয়েক্ট করে ফেলা অদ্রির কিছুতেই আজ ধ্রুব’র চোখে চোখ রাখার সাহস হয় না! সে তো ধ্রুব’র কাছে ধরা পড়তে চায় নি এতো শ্রীঘ্রই!

[ আমি একটু ব্যস্ত, সে সেজন্য আগেই বলে
দিয়েছিলাম আজ ছোট পর্ব হবে। ১২০০+ শব্দ। আপনাদের পড়তে সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিট, আমার লিখতে কয়েক ঘন্টা!]
[মতামত জানাবেন সুন্দরভাবে, পার্সোনাল অ্যাটাক না।]

চলবে….