শঙ্খতেও ফাটল ধরে পর্ব-০১

0
173

#শঙ্খতেও_ফাটল_ধরে
পর্ব-১
লেখনীতে-সঞ্চিতা

প্রথম বারের প্রেগনেন্সিতে বৃক্কে পাথর ধরা পড়লো লিখির।জানা মাত্রই থমকে গেছে লিখি, এক হাতে প্রেগনেন্সির রিপোর্ট নিয়ে স্থির ভাবে বসে আছে লিখি। পাশেই তার স্বামী শুভম নিশ্চুপ ভাবে বসে আছে। লিখির পুরো পৃথিবী ঘুরছে, বিয়ের আজ আট বছর পর সে মা হতে যাচ্ছে। আর এইসময় তার বৃক্কে পাথর হতে হলো। লিখির মনে হচ্ছে এই পৃথিবীতে তার মতো অভাগী আর কেউ নেই। বুকটা ফেটে যাচ্ছে তার, ইচ্ছে হচ্ছে চিৎকার করে কাঁদতে। চেতনা হারানোর কারণে সে কাঁদতেও পারছেনা। পাশেই শুভম স্থির ভাবে ডক্টর অভির দিকে তাকিয়ে আছে। এভাবেই কিছুক্ষন সময় অতিবাহিত হওয়ার পর শুভম ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলে উঠলো,,,

-” এর কি কোনো সমাধান নেই ডক্টর অভি!আমাদের বিয়ের আট বছর পর আমি বাবা হতে যাচ্ছি! (ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে)

ডক্টর অভি কিছুক্ষন চুপ করে রইলো শুভমের দিকে, এরপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললে উঠলেন,,

-“এটার একটাই উপায় সার্জারি!আর যদি সার্জারিটা হয় তাহলে আপনাদের বাচ্চাটাকে বাঁচানো যাবেনা! আর আপনার স্ত্রী যদি সার্জারি না করাতে চান, বাচ্চাটাকে জন্ম দিতে চান তাহলে এতে করে আপনার স্ত্রী এবং বাচ্চা দুইজনেরই ক্ষতি হবে। আর আপনার স্ত্রী খুবই সিরিয়াস অবস্থায় আছে।

এবার আর নিজেকে আটকে রাখতে পারলোনা লিখি অঝোরে কান্না করতে লাগলো। তার বিয়ের আজ এতগুলা বছর পর সে প্রথম মাতৃত্ব এর স্বাদ গ্রহণ করতে যাচ্ছে। কিন্তু তার ভাগ্য তার হ্যা তে হ্যা মিলাতে পারছেনা।
শুভম ভাঙা গলায় লিখিকে বললো বাইরে গিয়ে বসতে, শুভম ডক্টর অভির সাথে কথা বলবে।
লিখি আঁচল দিয়ে চোখ মুখ চেপে কান্না করতে করতে বাহিরে চলে গেলো।

-” আপনি কি আসলেই যা করছেন ঠিক করছেন? একবার বিবেক দিয়ে ভেবে দেখুন!(চিন্তিত কণ্ঠস্বরে)

শুভম কাঠ কাঠ গলায় বলল,,

-“আমি যেটা করছি সেটা ঠিকই করছি। আপনি শুধু সব সামলে লিখির এবোর্শন করতে পারলেই হলো। টাকার দিকে তাকাবেন নাহ, শুভম রায়ের টাকার অভাব নেই। একটা কথার দিকে খেয়াল রাখবেন, লিখি যাতে কোনোমতেই জানতে না পারে যে ওর বৃক্কে কোনো পাথর টাথর হয়নি, বরংচ ওর এবোর্শন করা হচ্ছে।আর কালকেই কাজটা সেরে ফেলতে হবে।(কাঠখোট্টা কণ্ঠস্বরে)

ডক্টর অভি নিরাশার দৃষ্টিতে শুভমের দিকে তাকিয়ে আছে,, মানুষটা সবাইকে বাহিরের মিষ্টি দিকটাই দেখায়। কিন্তু তার ভেতরে যে একটা পশুত্ব আছে তা এখনো পর্যন্ত কেউ টের করতে পারেনি। ডক্টরের খারাপ লাগছে কিন্তু তার কিছুই করার নেই।তিনি গলার স্বর ছোট করে বলে উঠলেন,,

-“আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবেই হবে সবকিছু। উনি জানতে পারবেন নাহ যে ওনার এবোর্শন করানো হচ্ছে। আপনি কালকে ওনাকে যথা সময়ে নিয়ে আসবেন।

শুভম বাঁকা হাসলো। ডক্টর অভিকে ধন্যবাদ জানিয়ে সে উঠে দাঁড়ালো। বাহিরে এসে গম্ভীর মুখ করে লিখিকে বলে উঠলো,,

-” চলো বাড়িতে চলো। কালকে তোমার সার্জারি করা হবে। ডক্টর অভি আশা দিয়েছেন আমাদের বাচ্চাকে তিনি বাঁচাবার সম্পূর্ণ চেষ্টা করবেন। (গম্ভীর মুখে)

লিখি নিঃশব্দে কান্না করছে, অতি কষ্টে সে পাথরে পরিণত হয়েছে। লিখির বলার মতো ভাষা নেই মুখে। বহু কষ্টে উঠে দাঁড়ালো সে। শুভমের দিকে এক নজর তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করতে লাগলো লিখি।

-“আমি এতটাই অভাগী যে বিয়ের আট বছর পর মা হতে গিয়েও মা না হওয়ার পরিস্থিতিতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। শুভম যেভাবেই হোক না কেন আমাদের বাচ্চাটাকে বাঁচান!(ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে)

শুভম মন খারাপের ভান ধরলো। এক হাত দিয়ে লিখিকে বুকে চেপে ভাঙা কণ্ঠে বলে উঠলো,,
-” আমাদের সন্তানের কিছুই হবেনা দেখো। আমাদের পরিবার পূর্ণ করার জন্য সে আমাদের কাছে আসবেই। তুমি শুধু নিজের মনোবল বজায় রাখো। কালকের সার্জারির পরেই সে আমাদের কাছে চলে আসার আস্থা দিবে আমাদের ।(ভাঙা গলায়)

লিখি পারছেনা কিছুতেই নিজেকে সামলাতে। এতো গুলো বছর পর সে মা হতে যাচ্ছে কিন্তু এই সময়ই তার সাথে এটা হতে হলো। নিজেকে বর্তমানে পৃথিবীর সবচেয়ে ভাগ্যহীনা মনে হচ্ছে তার।
____________________________

গাড়িতে চুপচাপ বসে আছে লিখি। শুভম ড্রাইভ করছে। হসপিটাল থেকে তারা সোজা ঢাকেশ্বরী মন্দিরে চলে গিয়েছিলো দূর্গা প্রতিমা দর্শন করতে। সেখানে গিয়ে লিখি তার প্রতিটা মুহূর্তে দূর্গা মায়ের কাছে তার মাতৃত্ব টিকিয়ে রাখার প্রার্থনা করেছে। অনেকটা সময় সেখানে থাকার পর তারা বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা হচ্ছে।
লিখি চুপচাপ জানালার দিকে মুখ করে বাহিরের দিকে তাকিয়ে আছে। সময়টা বিকেলের শেষাংশ এখন। আকাশ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে, সেই রক্তিম আকাশে পাখিরা মুক্ত হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। লিখি চুপচাপ আকাশের দিকেই তাকিয়ে আছে। সব কিছু উপভোগনিও হলেও বর্তমানে সবকিছু তার কাছে বিষাদ মাখা লাগছে। খানিকক্ষণ পর পর বুক চিরে বেরিয়ে আসছে দীর্ঘশ্বাস।

-“লিখি চলে এসেছি। নামো আমি গাড়ি সাইড করে রেখে আসি। (নিচু স্বরে)

শুভমের আচমকা ডাকে ধ্যান ভাঙলো লিখির। মৃত ব্যাক্তির মতো চুপচাপ গাড়ি থেকে বেশ সময় নিয়ে নামলো লিখি।
শুভম গাড়ি সাইডে রেখে এসে দেখে তখনো লিখি সেভাবেই দাঁড়িয়ে আছে।
ব্রু কুঁচকে বিরক্তি ভাব অনুভব করলেও লিখিকে তার বিরক্তি ভাবটা দেখালোনা সে।
সোজা হেটে লিখির হাত ধরে বাড়িতে ঢুকলো সে।
বাড়িতে ঢুকতেই লিখির শাশুড়ির সম্মুখীন হতে হলো,,

-“কিরে শুভম! তোদের দুজনের মুখ শুকিয়ে আছে কেন এরকম? ডক্টর কি বলেছে শুভম? এভাবে চুপ করে আছিস কেন!(চিন্তিত কণ্ঠস্বরে)

শুভম নিচু স্বরে বলে উঠলো,,
-” মা লিখির বৃক্কে পাথর ধরা পড়েছে, সিরিয়াস অবস্থা!ডক্টর বললো কালকে সার্জারি করা হবে ওর, উনি আমাদের আশা দিয়েছেন আমাদের সন্তানের কিছু হতে দিবেন নাহ!(নিচু স্বরে)
শুভমের কথা শেষ হতে না হতেই লিখির শাশুড়ি তেলে বেগুনে জ্বলা কণ্ঠস্বরে বলে উঠলেন,,

-“বিয়ের আজ আট বছর পর মা হতে যাচ্ছে। কিন্তু সন্তান জন্ম দিতে পারবে কিনা সেটার নিশ্চয়তা নেই বাহ্! তোমার মতো একটা মেয়ের সাথে আমার ছেলেটাকে বিয়ে দিয়েই আমি ভুল করেছি। তোমার জায়গায় অন্যকেউ থাকলে আজ পর্যন্ত আমার নাতি নাতনি আমাকে ঠাম্মা ঠাম্মা বলে ডাকতো। (কড়া গলায়)

শাশুড়ি মায়ের এহেন কথায় লিখির ভেতরটা পুরে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বলার মতো লিখির কাছে শব্দ নেই। এর প্রতি উত্তরে সে কি বলবে, তার জানা নেই। লিখি আর না দাঁড়িয়ে আস্তে আস্তে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো,,
রুমে ঢোকার আগে মুহূর্তে শাশুড়ি মায়ের কোথায় সে থমকে গেলো,,

-“তুমি হয়তো কারো পাপের ফল ছিলে তাই ভাগ্য তোমার সাথে নেই। নেহাৎ সমরেস বাবু তোমাকে দয়া দেখিয়ে নিজের মেয়ের পরিচয় দিয়েছেন নয়তো আজ যে কোথায় থাকতে। শুনো তোমার মতো পাপের ফলকে আমি আর নিজের ছেলের বউ হিসাবে মানবোনা!যদি এই সন্তানকে জন্ম না দিতে পারো তাহলে তুমি নিজ থেকে আমার ছেলেকে ডিভোর্স দিবে। (কঠোর কণ্ঠস্বরে)

মিসেস রাহেলা সেই বিয়ের ছয় মাসে পর থেকে লিখিকে আজ পর্যন্ত অনেক কথাই শুনিয়েছেন,কিন্তু এইরকম কথা কোনোদিন বলেননি। আজকে ওনার মুখ থেকে এইরকম কথা শুনে লিখি নিজেকে হারিয়ে ফেললো। হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হতে লাগলো তার। তার মাথায় বারবার ঘুরপাক খেতে লাগলো একটা কথায় “খারাপ সময়ে বুঝি এভাবেই আপনজনেরা ব্যক্তিত্বকে আঘাত করে”
লিখি আর পারলোনা সহ্য করতে। সেখানেই জ্ঞান হারিয়ে পরে গেলো লিখি।
_____________________________

-“ম্যাম!ম্যাম শুনতে পাচ্ছেন আমার কথা?

কারো ফিসফিসিয়ে বলা কথা শুনে চোখ মেলে তাকালো লিখি। চোখ মেলার সাথে সাথে লিখির প্রচন্ড মাথায় ব্যথা হতে লাগলো।
লিখি পিটপিট করে তাকালো, সামনেই একজন নার্স দাঁড়িয়ে আছে। লিখি চারিদিকে একটু দৃষ্টি প্রগাঢ় করে তাকাতেই বুঝলো সে হসপিটালের বেডে শুয়ে আছে। পাশেই নার্স তাকে তারা দিচ্ছে একটা রেকর্ড শোনার জন্য, লিখি আশ্চর্য হলো।

-“আপনি কিসের কথা বলছেন!(অবাকের স্বরে)

-“দেখুন ম্যাম আমার এতো কথা বলার সময় নাই, আপনাকে আমার এই রেকর্ড তা শোনাতেই হবে। আপনার এখন সার্জারির নামে এবোর্শন করানো হবে, আপনি যদি এখান থেকে এখন না পালান তাহলে আপনার সন্তানের বিপদ হবে। (তারা দিয়ে)

লিখি বিস্মিত হলো। কি বলছে উনি!সব লিখির মাথার উপর দিয়ে গেলো, লিখির তো এখন সার্জারি করা হবে বৃক্কের পাথর অপসারণের জন্য তাহলে উনি কেন এবোর্শনের কথা বলছেন!
লিখি নার্সের হাত থেকে ফোন টা নিয়ে রেকর্ড টা শুনতে লাগলো। সম্পূর্ণ রেকর্ড টা শুনে গায়ে শিহরণ বয়ে গেলো লিখির। লিখির মস্তিষ্ক শুধু এটাই আওড়াচ্ছে মানুষ এতটা বিশ্বাসঘাতক কিভাবে হতে পারে!!নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেনা লিখি।

-“এটা মিথ্যা আমি জানি,, শুভম এরকম কিছুই করতে পারেনা আমার সাথে!(অস্ফুষ্ট স্বরে)

-“হয়তো আপনি এটা বিশ্বাস করবেন নাহ! কিন্তু এটাই সত্যি। ডক্টর অভি নিজে এইটা রেকর্ড করে আমাকে দিয়ে বলেছেন এটা যত তাড়াতাড়ি পারি আপনার কাছে পৌঁছে দিতে। আপনি এখান থেকে পালিয়ে যান ম্যাম। আপনি যাকে ভরসা করে এই অবধি এসেছেন সে আসলে ভরসার যোগ্য নাহ!(দ্রুততা মিশ্রিত কণ্ঠে)

নার্স আর কিছু বলতে পারলোনা তার আগেই তিনি জোরে চিৎকার দিয়ে মাটিতে পরে গেলেন। হঠাৎ এইরকম হওয়ায় চমকে উঠলো লিখি, সামনের দিকে তাকাতেই সে ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলো।

চলবে,,