#বিয়ে
#লেখনীতে -ইসরাত জাহান ফারিয়া
#পর্ব- ৩৯
ধ্রুব ভ্রু কুঁচকালো,
— আজ নয় কেন?
অদ্রির ভাবুক কন্ঠস্বর,
— আজ তো ঝগড়াঝাটির দিন, সেজন্য!
বলে অদ্রি চোখ নামিয়ে নিলো। তবে এক মুহূর্তের জন্য ধ্রুব’র মনে হলো অদ্রি একটা বোকা মেয়ে আর প্রচন্ড ভীতু। চোখে চোখ রাখলে যদি ধ্রুব ওর মন পড়ে ফেলে সেজন্যই অদ্রি নিজেকে লুকিয়ে নিয়েছে। ও একদৃষ্টিতে অদ্রির দিকে তাকিয়ে থাকলো। বহুদিন বুকের ভেতর ঝড় তোলা পাথরটা আচমকাই যেন নেমে গেলো। হাওয়া থেকে টেনে অক্সিজেন নিলো ধ্রুব! এরপর ওঠে দাঁড়ালো,
— চলো যাই।
— কোথায়?
— রাতের শহরে…
শরৎ শেষ হয়ে হেমন্তের শুরু হবে ক’দিন পর। তবে এখনই শীতের রেশ পড়ে গেছে। গুমোট কুয়াশাজড়ানো প্রকৃতি। আবহাওয়া কখনো শান্ত, কখনো অশান্ত। একটু পরপর শীতল হাওয়ায় পথের দু’ধারের ধুলো ওড়ছে। রাস্তার পাশের গাছগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। আর তার আবছা ছায়া পড়ছে মাটিতে। ধীরপায়ে, আলস্য ভঙ্গিতে পা ফেলছে ধ্রুব, তার ঠিক পাশেই হাঁটছে অদ্রি। রাতের শহরে ও এভাবে কখনো ঘুরে বেড়ায়নি। তবে আজ ওর অন্যরকম ভালো লাগছে। ধ্রুব পকেটে হাত রেখে হাঁটছে। মাঝেমাঝে ওর দিকে আড়চোখে তাকাচ্ছে। অদ্রির লজ্জা লাগছে, তবে বুঝতে দিচ্ছে না। আকাশ ঘিরে রাখা থালার মতো গোল চাঁদটা ঠিক যেন ওদের ওপরই আলো ফেলছে। অপার্থিব, রুপকথার রাজ্যে যেন একটুকরো আলো হয়ে জগৎটাকে আলোয় আলোয় ভরিয়ে দিচ্ছে! হঠাৎ করে চারদিকটা এমন আলোকময় মনে হওয়ায় অদ্রির কেমন অদ্ভুত লাগে। এর আগেও তো সে জোৎস্না উপভোগ করেছে। কিন্তু আজকের মতো এমন ভালো লাগেনি তো! অদ্রি কোনা চোখে ওকে দেখে, ভালোবাসার মানুষ পাশে থাকলে কী জগতের সবকিছু আলোকময় মনে হয়?
এই বারোটা দিন অদ্রির কেটেছে চাপা কষ্ট আর যন্ত্রণা নিয়ে। ধ্রুববিহীন সবকিছুই ধোঁয়াশার ন্যায় লাগতো ওর। খেতে গেলে, শুতে গেলে প্রতিটা মুহূর্তে ধ্রুব’র রাগী আর অভিমানী মুখটা মানসপটে ভেসে ওঠতো। যেই চোখে অদ্রি সবসময় ভালোবাসা দেখতে পেতো সে চোখে আত্মগ্লানিটা ঠিক মানাতো না। অদ্রি জানতো, বুঝতে পারতো ধ্রুব ওপর দিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক দেখালেও ভেতরে ভেতরে নিজের কর্মকান্ডের জন্য প্রচন্ড মানসিক অশান্তিতে ভুগছিলো। অদ্রির মন খারাপ হতো ভীষণ৷ অভ্যেসে পরিণত হওয়া একটা মানুষ যদি হুট করে নিজেকে হারিয়ে ফেলে তাহলে সেটা মেনে নেওয়া যায় না। অদ্রিও মানতে পারেনি। কিন্তু নিজের জেদি আর একরোখা স্বভাব ওকে প্রতিনিয়তই দূরে নিয়ে যাচ্ছিলো ধ্রুব’র থেক। তাইতো অতীতের সব ভুল বোঝাবুঝি, রাগারাগিকে পেছনে ফেলে ধ্রুব’র হাত ধরে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে চায় সে। অবশেষে দীর্ঘদিন ধরে চলা মনের সাথে মস্তিষ্কের যুদ্ধে শেষমেশ মনকেই জয়ী হতে হলো। এ জগতের কে চায় ভালোবাসা বিহীন বাঁচতে? এসব হাজারো ভাবনা মন থেকে ঝেড়ে ফেলার জন্য ধ্রুবকে উদ্দেশ্যকরে অদ্রি অস্ফুটস্বরে বলে,
— সরি।
ধ্রুব একমনে হাঁটছিলো। অদ্রির মুখ থেকে “সরি” শুনে
অবাক গলায় বলল,
— কেন?
অদ্রি অস্বস্তি নিয়ে উত্তরে বলল,
— এমনি।
ধ্রুব’র হাসি পেলো। তবুও যথাসম্ভব গাম্ভীর্য নিয়ে বলল,
— গ্রান্টেড। বাট আ’ম অলসো সরি।
অদ্রি ভ্রু কুঁচকে তাকালো,
— আপনি কেন?
— দুঃখ দেওয়ার জন্য।
অদ্রি ছোটছোট চোখ করে ওর দিকে তাকালো। চেহারায় ফুটে ওঠলো অন্যরকম সরলতা। ধ্রুব’র হাসি পেলো। নারী জাতি আসলেই পুরুষকে বিট করার অন্যরকম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। এইযে, তার পাশে সরল মুখ করে হাঁটছে অদ্রি, অথচ এই মেয়েটাই তার জীবনটাকে প্রতিনিয়ত উলটপালট করে দিচ্ছে। যার মায়ায় পড়ে না পারছে দূরে ঠেলতে, না পারছে কাছে যেতে। ওকে আনমনে হাসতে দেখে অদ্রি কুটিল চোখে তাকায়,
— এভাবে হাসছেন কেন?
ধ্রুব হাসি বন্ধ করে বলল,
— নিশ্চয়ই মনে মনে আমাকে নিয়ে রচনা ভাবা শুরু করেছো?
অদ্রি খানিকটা কড়া গলায়ই বলল,
— আপনার মাথা…
— তুমি কিন্তু অনেক কথা জানো!
— মোটেও না।
ধ্রুব কথা বাড়ালো না। ওর সাথে তর্কে যাওয়া বৃথা। শেষমেশ দেখা যাবে কোন কথার রেশ ধরে ওদের এই সুন্দর সময়টা নষ্ট করবে আর ধ্রুবকে রাগিয়ে দেবে। কিন্তু ও অদ্রিকে এই সুযোগ দিবে না। বরংচ জিজ্ঞেস করল,
— কিছু খাবে?
— চা খাবো…
রাত প্রায় দুটো। এতো রাতে কোথায় চা পাবে ভাবলো ধ্রুব। কোনো দোকানপাট বা রেস্তোরাঁ খোলা নেই আশেপাশে। সবগুলো বাড়িঘর কালচে আঁধারে ঢাকা। ব্যস্ত নগরীর মানুষজন আলো নিভিয়ে শান্তির ঘুম দিয়েছে। সোডিয়াম আলোতে অলিগলি ঘুরে একটা দোকানও খোলা পেলো না ধ্রুব। ওর ভীষণ রাগ হলো। এই প্রথম অদ্রির সাথে ডেটে এসে ওকে যদি এককাপ চা-ই না খাওয়াতে পারে তাহলে সে কিসের জীবনসঙ্গী? সবগুলো দোকান বন্ধ দেখে রাগে ওর মুখচোখ লাল হয়ে গেলো। অদ্রি অপ্রস্তুত গলায় বলল,
— আরে বাবা, এত রাগের কি আছে? চলুন বাড়ি ফিরে যাই।
ধ্রুব রেগে গেলো,
— তারমানে তুমি চা খাবে না?
অদ্রি নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল,
— বাড়ি গিয়ে বানিয়ে খাবো।
ধ্রুব’র মেজাজ চরম খারাপ হলো। বাড়ি গিয়ে চা খাওয়ার কি আছে? সেখানে তো স্পেশাল কিছু অনুভূতি থাকবে না, বরাবরের মতোই সাদামাটা। ওর কান্ডে একপর্যায়ে অদ্রি বিরক্ত হয়ে বলল,
— ধুর, আমারই ভুল হয়েছে। আমি তো জানতাম আপনার মাথা ঠিক থাকে না।
অদ্রির আঁধারে ঢাকা মুখ দেখে একসময় ধ্রুব শান্ত হলো। বলল,
— বাড়ি ফিরে আমি তোমাকে বানিয়ে দেবো…
অদ্রি কুটিল চোখে চাইলো। ধ্রুব নির্বিকার কন্ঠে বলল,
— ভয় নেই। অনুভূতিই দেবো, বি’ষ না…
অদ্রি হেসে ফেললো। ধ্রুব একদৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ওর মুখপানে। আগে সে টের পায়নি, এই মেয়েটা আস্ত একটা আদর। যাকে দেখলেই ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে করে। বুকের ভেতর বাজতে থাকে বাতাসের গান, ভালোবাসার শব্দ!
রাস্তাঘাট ফাঁকা। গাড়ি কম৷ বহুকষ্টে একটা রিকশা খুঁজে আনলো ধ্রুব। দু’জনেই বাড়ি ফিরলো ক্লান্তভাবে। তখন প্রায় চারটে বাজে। অদ্রির হাজারো বারণ স্বত্তেও ধ্রুব খুব যত্ন নিয়ে চা বানালো। শুধুমাত্র অদ্রির জন্য। চা খেয়ে অদ্রির মুখটা দেখার মতো হলো। ধ্রুব বুঝতে পারলো না তার ভুলটা কি! কিন্তু পরবর্তীতে সে যখন ট্রাই করলো দেখলো সেখানে চিনির বদলে সে লবণ দিয়েছে। হতাশ ধ্রুব কি দিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দেবে বুঝে পেলো না। এদিকে অদ্রি হাসতে হাসতে শেষ। তবুও যথাসম্ভব প্রশংসা পেয়ে ধ্রুব’র অন্যরকম আনন্দ অনুভব করলো। ওর জীবনের অন্যতম এই রাতটা যেমন অদ্ভুত সুখের, তেমনই কিছুটা হতাশার। তবে সবকিছুর মিশেলে একটা প্রাণবন্ত সম্পর্কের সূচনা বলাই যায়…
দুপুরের খাবার টেবিলে শায়লা আজ বেশ ভালো আয়োজন করেছেন। সব ধ্রুব’র পছন্দের খাবার, এতদিন রাগ করে বাইরে থেকে কি না কি খেয়েছে সেজন্য তিনি ছেলে আর অদ্রির জন্য তাদের পছন্দ অনুসারে খাবার তৈরি করেছেন। জরিনা ফিরেছে আজ সপ্তাহ আগে। ও টেবিলে প্লেট সাজাতে সাজাতে বলল,
— কাইল রাতে দুই জনেই বাইরে গেছিলো। কি জানি মিল হইসে নি? ওদের মিল ডা হইলে আমি যে কি খুশি হমু গো খালাম্মা….
শায়লা হেসে বললেন,
— এইটাই তো আমরা সবাই চাই। দুজন দু’জনকে ছাড়া দূরে থাকতে পারে না, এরপরও মুখফুটে বলবে না।
জরিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— কি আর কমু আমাগো গেরামে কোনো বউ যদি ভাবিজানের মতো হইতো তাইলে পিড্ডা হাড্ডি ভাঙতো, মাইয়া মাইনসেরে কেডা আর দাম দে।
হগলে তো কইলাম আবার আমাগো ভাইজানের মতো ভালা মানুষও না। এইজন্যই চাই ওরা যাতে মিলমিশ কইরা থাহে….
শায়লা ওর কথার জবাবে বললেন,
— হুঁ, তাই যেন হয়!
দু’জনের ঘুম ভাঙলো বেলা করে। ফ্রেশ হয়ে নিচে নেমে এলো অদ্রি। শায়লা খাবার বাড়ছেন। অদ্রিও এসে হাত লাগাতে চাইলো৷ বলল,
— আমাকে দাও, করি…
শায়লা ওর হাতে চামচটা দিলেন। এরপর একপলক লক্ষ্য করে নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,
— ঝগড়া মিটলো?
অদ্রি প্লেটে ভাত তুলতে তুলতে বলল,
— যে রাগ করে বাড়ি ছেড়েছিলো তাকেই জিজ্ঞেস করো…
— সে কোথায়?
— ঘুমায়।
শায়লা আলতো হেসে বললেন,
— ডেকে নিয়ে আয়, ক’টা বাজে খেয়াল আছে? খেতে হবে তো!
অদ্রি গেলো ধ্রুবকে ডাকতে। দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকতেই দেখলো ধ্রুব তোয়ালে পরে ঘরময় আঁধার মুখ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, কিছু একটা খুঁজছে৷ ফর্সা বলিষ্ঠ দেহের ধ্রুবকে দেখেই কেমন লজ্জা লাগলো ওর। এরপরেও ভাবলেশহীন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— কিছু হয়েছে?
ধ্রুব ওকে দেখে বেঁফাসে বলে ফেললো,
— খুঁজে পাচ্ছি না..
অদ্রি ভ্রু কুঁচকালো,
— কি?
ধ্রুব থতমত খেয়ে গেলো। কি খুঁজে পাচ্ছে না সেটা কিছুতেই অদ্রিকে বলা যাবে না। বউ হলেও নিজের তো একটা চক্ষুলজ্জা আছে নাকি? এসব কি বলার জিনিস? সে যে তার কালো রঙের আন্ডার’ওয়্যার খুঁজে পাচ্ছে না এটা অদ্রিকে বললে হয়তো এই মেয়ে ওকে নির্লজ্জ, বেহায়ার তকমা দিয়ে দেবে। ধ্রুব তাই নিজের মুখ বন্ধ রাখার চেষ্টা করলো।
[ আজ দিতাম না, তবুও বসে বসে এতটুকু লিখে ফেলেছি৷ তাই ভাবলাম পোস্ট করে দিই। ভুলত্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।]
চলবে…