বিরোধীদলীয় প্রেম
পর্ব – ১০
আফরোজা আক্তার
[দয়া করে কেউ কপি করবেন না]
ভার্সিটিতে সবার নজর মাহার দিকে। বিশ দিন পর ভার্সিটি আসে মাহা। সবার দৃষ্টি তাকে এমন ভাবে গিলছিল যেন সে চিড়িয়াখানা থেকে আসা অদ্ভুত এক প্রাণী। প্রেজেন্ট স্টুডেন্ট না ভার্সিটির সিনিয়রের বউ হিসেবেই দেখছে সবাই তাকে। ব্যাপারটা অনেকের কাছে দৃষ্টিকটু লাগলেও অনেকের কাছে আনন্দের। মাহাকে নিয়ে সা’দের ভয়ংকর পাগলামির কথা ভার্সিটির সবাই-ই জানে। সে হিসেবে দেখতে গেলে হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া সবাই অনেক খুশি।
মিমি আর মাহা পাশাপাশি বসে আছে। মাহার বিষন্ন মুখটা মিমিকে আহত করছিল। সে জিজ্ঞেস করল, ‘মন খারাপ?’
মাহা উত্তর দেয়, ‘কেমন জানি ছন্নছাড়া লাগতেছে নিজেকে।’
‘সা’দ ভাইয়ার বাড়ির লোকজন কেমন রে?’
‘এখন পর্যন্ত যা দেখলাম, সবাই ভীষণ ভালো।’
‘কাজ টাজ করতে হয় নাকি?’
‘বুয়া আছে দুইজন। তাছাড়া বাকি কাজ সা’দে মা আর ভাবীই দেখেন। আমাকে তেমন হাত লাগাতে হয় না। তারাও বলে না। তবে বাসা থেকে মা অনেক বলে সব কাজ না পারলেও একটু একটু হাত লাগাতে।’
‘সা’দ ভাইয়ার আচার আচরণ কেমন?’
‘সা’দের আচার আচরণ সম্পর্কে এতদিনেও অবগত হোস নাই তুই? এইসব কী প্রশ্ন করিস?’
‘রাগ করতেছিস কেন? উনার আচার আচরণ অন্যদের সাথে এক আর তোর সাথেই আরেক। সেইক্ষেত্রে তোর সঙ্গে কেমন করে সেটাই জানতে চাচ্ছি।’
‘কথা হয় না আমাদের। আমিও বলি না। সে-ও বলে না।’
‘তুই যে বলবি না তা আমি জানি কিন্তু সে তো কথা না বলার মানুষ না। কথা কেন বলে না?’
মিমির প্রশ্নে আশেপাশে তাকায় মাহা। তারপর খানিকটা ঝুঁকে বাসরের রাতের ঘটনা বলে সাথে এটাও বলে যে, ‘বিশ্বাস কর, আমি চাইনি ও পড়ে যাক। কিংবা ওকে ফেলে দেওয়ার জন্য আমি এমন করিনি। আমার অস্বস্তি লাগছিল। আর ওর শেষ কথাটা আমি নিতে পারিনি তাই এক্সাটেট হয়ে,, ’
‘তাই বলে ধাক্কা! ওই লোক নিজেকে কন্ট্রোল করে রাখল কীভাবে? উনার জায়গায় অন্য কেউ হলে তো তুই শেষ। যেই মাইন্ডের পুরুষ উনি। এটা শুনে আমি সত্যিই অবাক।’
‘টিজ করতেছিস?’
‘একেবারেই না। সত্যি করে একটা কথা বলবি?’
‘কী?’
‘তোদের মধ্যে কি এখনও কিছু হয়নি?’
‘কি কিছু হবে?’
‘আর ইউ ভা*র্জিন?’
মাহা চমকে যায়। বলে, ‘অফ কোর্স আই এম।’
‘স্যালুট জানাতে হয় তাহলে সা’দ ভাইকে। যে নিজেকে এতটা কন্ট্রোল করে রাখতে পারে।’
মিমির কথা শুনে রাগ হয় মাহার।
‘চুপ কর। প্লিজ চুপ কর। এইসব শুনতে সত্যিই ভালো লাগে না।’
‘মাহা, অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই। বিয়েটা হয়ে গেছে তোদের। আর সা’দ ভাইয়া এতটাও খারাপ না। ঠান্ডা মাথায় ভাব। আর তাছাড়া এখন তো দু’জন একসঙ্গেই আছিস। কিছুদিন দেখ। দেখবি তোর মনটাও চেঞ্জ হবে।’
‘আল্লাহ করু, আমার মনটা কখনও চেঞ্জ না হয়।’
‘মাহা!’
‘আমি ওর সঙ্গে থাকতে চাই না। আমি আজ হলেও ওকে ছাড়ব। কাল হলেও ওকে ছাড়ব। দেখে নিস।’
মাহার কথা শুনে মিমি আশ্চর্য হয়। সংসার করার বদলে মাহার মাথায় সা’দকে ছেড়ে দেওয়ার পোকা উথাল-পাতাল করছে তা সে খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছে।
★★
রাস্তায় দাঁড়াতেই কালো রঙের একটা প্রাইভেট কার এসে মাহার সামনে দাঁড়ায়। আচমকা গাড়িটা ব্রেক করায় মাহা ভয় পায়। গাড়ির গ্লাস নামতেই সা’দকে দেখতে পায় মাহা। সা’দের পাশে ড্রাইভার বসে আছে। ড্রাইভার মাহাকে উদ্দেশ্য করে বলে, ‘ভাবী, গাড়িতে উঠে বসেন।’
মাহা তেমন কিছু না বলে গাড়িতে উঠে বসে। লুকিং গ্লাসে পেছনে বসা মাহাকে দেখছে সা’দ। ড্রাইভারকে আগেই বলে দিয়েছিল সে যেন মাহাকে গাড়িতে উঠতে বলে। ধূসর রঙের থ্রি পিসে মাহাকে সুন্দর লাগছে। মাথায় ঘোমটা। সাদা চাদরে পুরো শরীর আবৃত। এক কথায় অপূর্ব। সা’দ মনে মনে ভাবে, এই মেয়েটা প্রতিটা মুহুর্তে আমার বুকে ছুরি চালাচ্ছে। সেই ছুরির আঘাত কেউ দেখছে না একমাত্র আমি ছাড়া। তার শান্ত চেহারার অন্তরালে লুকিয়ে আছে একটা বাঘিনী চরিত্র যা কেবল আমিই জানি। সব থেকে ভালো হতো মেয়েটা আমার জীবনে না আসলে। সব থেকে ভালো হতো মেয়েটাকে আমি ভালো না বাসলে। তাহলে হয়তো এতটাও অপমানিত, এতটাও লজ্জিত আমি আমার কাছে হতাম না।
রাস্তাটা মোড় পেরুতেই সা’দ গাড়ি থামাতে বলে। চোখে সানগ্লাস পরে গাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। যাওয়ার সময় ড্রাইভারকে বলে দেয়, ‘ম্যাডামকে বাড়ি পৌঁছে দিবে। রাস্তায় কোথাও দাঁড়াবে না। ওকে?’
ড্রাইভারও হ্যাঁসূচক মাথা নাড়াল। সা’দ একবারও পেছনে মাহার দিকে তাকায়নি। সে তার গন্তব্যে চলে যায়। জানালা দিয়ে সবই দেখেছে মাহা। সা’দের বড়ো ভাইয়ের বউয়ের কাছে শুনেছিল, ফয়সাল ছেলেটার অনেক ভালো। সা’দদের গ্রামের বাড়ির ছেলে। এস এস সি পাশ করার পর ওর বাবা সা’দের বাবার হাতে পায়ে ধরেছেন তার ছেলেকে কোনো কাজ দেওয়ার জন্য। পরবর্তীতে সা’দের বাবা ফয়সালকে ঢাকায় নিয়ে আসেন আর ড্রাইভিং কোর্স করান। সেই সাথে ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তি করিয়ে দেন। এই বাড়িতে থেকেই ফয়সাল ইন্টার পাশ করে এখন ডিগ্রীতে ভর্তি হয়েছে। তার পাশাপাশি এই বাড়ির একটা গাড়ি সে চালায়। থাকা খাওয়া বাদে ফয়সালকে প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকা দেওয়া হয়। এই টাকার অর্ধেকাংশই গ্রামে ফয়সালের বাবা-মাকে পাঠানো হয় যা সা’দের বাবা নিজে পর্যবেক্ষণ করে। মাহা একটু নড়ে বসে। এরপর খানিকটা সামনে ঝুঁকে। নিচুস্বরে গলাটা ঠিক করে ফয়সালকে বলল, ‘ফয়সাল, একটা কথা জিজ্ঞেস করলে, বলবা?’
‘কী কথা ভাবী, বলেন।’
‘ও কোথায় গেল?’
‘ছোট ভাই তো মিটিংয়ে গেছে।’
‘কীসের মিটিং?’
‘ইলেকশনের মিটিং।’
‘কীসের ইলেকশন?’
‘ভার্সিটির ইলেকশন। আপনি জানেন না?’
মাহা সত্যিই জানত না যে সা’দ ইলেকশনে দাঁড়িয়েছে। ক্লাসে দুই-একজনকে বলাবলি করতে শুনেছিল দুই-একবার কিন্তু সেখানে সা’দের নাম শোনেনি সে। ফয়সাল নিজ থেকেই বলতে থাকে, ‘ভাইসহ আরও দুইজন দাঁড়াবে।’
‘ওহ।’
‘ভাইয়ের বিপরীতে যারা আছে তারা সবাই ভাইয়ের ক্ষতি করতে চায় ভাবী। চাচীআম্মা তো এইজন্যই ভাইকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকে।’
‘ক্ষতি করবে কেন? ক্ষতি করার মতো কোনো কাজ নিশ্চয়ই তোমার ভাই করেছে তাই ক্ষতি করতে চাইছে।’
ফয়সাল মুখটা কালো করে লুকিং গ্লাসে মাহাকে দেখল।
‘ভাই কারো ক্ষতি করে না ভাবী। ভাই খুব ভালো মানুষ। যেমন চাচা তেমনই চাচার দুই ছেলে। বড় ভাইও ভালো আর ছোট ভাই তো আরও ভালো।’
মাহা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মনে মনে বলে, কতটা ভালো তা তো আমি আমার জীবন দিয়েই বুঝতেছি। কারো ক্ষতি করে না, অথচ সব থেকে বড় ক্ষতি সে আমার করলো।
★★
নিচ থেকে উপরে আসতে আজকে বেশ দেরি হয়ে গেছে মাহার। নিচে ড্রইংরুমে শাশুড়ি আর জা’য়ের সাথে কথা বলছিল সে। কথা বলছিল বলতে বেশির ভাগ সময় সে চুপ-ই ছিল। নওমি তাকে যা জিজ্ঞেস করেছে তার উত্তরে শুধু হ্যাঁ বা না বলেছে। তাদের সঙ্গে কথা বলে মাহা যা বুঝল, তার শাশুড়ি বড় বউয়ের প্রতি অনেকটাই দুর্বল। আর হবে না-ই বা কেন? বড় বউ বলে কথা। এই বাড়িতে প্রথম সে এসেছে। এত বছর ধরে এই বাড়িতে আছে। সবার সঙ্গে নিজেকে মানিয়েও নিয়েছে। সব কাজ একা হাতে সামাল দিচ্ছেন কোনো রকম বিরক্তি ছাড়াই। সেইজন্যই শ্বশুর শাশুড়ির মন তার প্রতি বেশিই নরম। বাচ্চা দুটো যেন তাদের সকলের চোখের মনি। মাহার খুব ভালো লাগে বাচ্চা দুটোকে। সারাক্ষণ ছোট মা ছোট মা করতে থাকে। সা’দের সঙ্গে তার বসবাসের সময় ঠিক কতটা সে জানে না। তবে সে যেই কয়দিন এই বাড়িতে থাকবে সকলকে আপন মনে করেই থাকবে। কাল থেকে বাড়ির কাজে সে-ও সাহায্য করবে।
ঘরে ঢুকতেই সিগারেটের গন্ধ নাকে আসে মাহার। বুঝতে পারে সা’দ সিগারেট টানছে। দরজায় খিল দিতে দিতে সা’দের কন্ঠস্বর কানে লাগে মাহার। সা’দ কাউকে বলছিল, ওয় বেশি বাড়ছে। আমি কিছু বলতেছি না তার মানে এই না যে আমি কিছু বলব না বা কিছু করব না। আমি যখন ধরব, ধরার মতো ধরব। সাড়ে তিন হাত না পুরা সাত হাত মাটির নিচে পুঁতে ফেলব একেকটাকে। বলে দিস। কথা শেষ করে সা’দ ভেতরে এসে দেখে মাহা দাঁড়িয়ে আছে ড্রেসিং টেবিলের সামনে। সে চোখ নামিয়ে সোফায় শুয়ে পড়ে। সেদিন রাতের পর থেকে সা’দ সোফাতেই ঘুমায়। বাইরে শুতে পারে না কারো চোখে পড়লে নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে তাই এখানেই বাধ্য হয়ে থাকতে হয় তাকে৷ সা’দকে আয়নায় দেখছিল মাহা। তারপর সা’দকে বাজিয়ে দেখার জন্য তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে ওড়নাটা খুলে পাশে রাখল। চুলে হাত দিতেই সা’দ বলল, ‘তুমি খুব কাঁচা খেলোয়াড় মাহা। আমি এক ভুল বার বার করি না। তুমি যদি ভেবে থাকো তোমার খোলা বুক আমাকে মাতাল করবে তাহলে ভুল ভাবছ। আমাকে মাতাল করার জন্য শরীর প্রয়োজন হয় না। তেমনটা হলে আমি সা’দ এতদিনে কমছে কম পঞ্চাশটা মেয়ের সঙ্গে শুয়ে পড়তাম। মেয়েরাও জানে আমাকে শরীর দেখিয়ে লাভ হয় না। তাই বলতেছি, এইধরনের চিপ খেলা আমার সাথে খেল না। সেদিন রাতের ধাক্কাটা সারাজীবন মনে রাখব আমি। সারাজীবন। যেভাবে চলতেছে, চলতে থাকুক।’
মাহা কিছু বলতে পারল না। কারণ সে যে কাজটা করতে চেয়েছিল সেটা করার আগেই সা’দ সেই না হওয়া কাজে পানি ঢেলে দিল।
চলমান………………