বিরোধীদলীয় প্রেম পর্ব-০৯

0
119

বিরোধীদলীয় প্রেম
পর্ব – ৯
আফরোজা আক্তার
[দয়া করে কেউ কপি করবেন না]

গতকাল রাতের পর থেকে আজ তিনদিন হতে চলল সা’দ মাহার সঙ্গে কথা বলেনি। দু’দিন হতে চলল মাহা তার বাবার বাড়িতে। নিজের বাবা মায়ের কথার মান রাখতেই সা’দ মাহাকে বাবার বাড়ি নিয়ে যায়। সেখানে কিছুক্ষণ থেকে কাজের বাহানায় বের হয়ে যাওয়ার পর আর আসেনি সে এই বাসায়। সা’দের ব্যবহারে মাহার পরিবারের সবাই অবাক হয়। বিশেষ করে মাহার বাবা। তিনি নিজে কিছু না বললেও স্ত্রীকে দিয়ে জিজ্ঞেস করিয়েছেন।
শেষ বিকেলে ছাদের এক কোণে মাহাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমিনা মেয়ের কাছে যান। মা’কে দেখে কান্না লুকায় মাহা। কিন্তু মায়ের চোখকে কি এত সহজে ফাঁকি দেওয়া যায়? আমিনা ঠিকই ধরেছনে, মেয়ে ছাদে একা একা কাঁদছে। ভয়ার্ত চোখে তিনি মাহার দিকে তাকান।
‘তুই যে কিছু একটা লুকাইতেছিলি তা প্রথম থেকেই জানতাম। তুই আসার পর থেকেই দেখতেছিলাম। সত্যি করে বল তো, কী হয়েছে? জামাই আসল, তোকে রেখে চলে গেল। আর আসার খবর নাই। কী হয়েছে?’
‘কিছু হয়নি মা। কিচ্ছু হয়নি।’
‘স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে তুই লুকাইতেছস। আমাকে বলবি না? তুই তোর মা’কে বলবি না?’
মাহার নীরবতায় আমিনা আরও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েন। বার দুয়েক ঢোক গিলে বলেন, ‘জামাইর আচার আচরণ ভালো না? তোকে কি মারধর করেছে? নাকি জামাইয়ের অন্য কোনো সমস্যা আছে?’
‘অন্য কোনো সমস্যা মানে?’
‘এই যেমন ধর অন্য কারো সঙ্গে প্রেম টেম আছে কি-না অথবা শারীরিক কোনো সমস্যা।’
‘নাহ। এমন কিছুই না।’
‘তাহলে কেমন কিছু তুই বল।’
মাহা মায়ের দিকে তাকায়। এরপর আবার চারপাশে তাকায়। তারপর ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। আমিনা বেগম মেয়ের এমন আচরণে ভড়কে যান। মাহা ততক্ষণে মায়ের বুকে। মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে কাঁদছে।
‘মায়ের কাছে কিছু গোপন করিস না মা। তোর মনে যা আছে। সব বল আমাকে। মা শুনব। সব শুনব। তুই বল আমাকে।’
মাহা কাঁদতে কাঁদতে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মা’কে বলতে থাকে। সা’দের সঙ্গে তার প্রথম দেখে, সেই দেখা থেকেই এই বিয়ে পর্যন্ত সবকিছু বলে মাহা। আমিনা চুপচাপ মেয়ের সব কথা শুনল। তিনি চাপা নিঃশ্বাস ফেললেন।
‘আমাদের আগে কিছু বললি না। আগে যদি বলতি তাহলে এতটা গড়াতো না।’
‘ভেবেছিলাম বিয়েটা হয়ে গেলে আমি মুক্ত। কিন্তু এখন দেখছি উল্টো হয়ে গেল মা। আমি আরও আঁটকে গেছি।’
‘সা’দ ভালো ছেলে মাহা। এটা তোর বাবাও মানে। আর আমিও। হ্যাঁ, ওর ভুলও আছে। এটাও আমি মানি। তোকে পেতে ও যেই রাস্তাটা বেছে নিয়েছে সেটাও ভুল, এটাও মানছি। তবে ও তোকে সত্যিকার অর্থে ভালোবাসে। ভালো না বাসলে কেউ কখনও এমন করে না। আর তোরও নিজেকে সংযত করা উচিত ছিল। ওকে নিয়ে এক জায়গায় বসে কথা বলতে পারতি। সবার সামনে চড় মারাটা নিতান্তই বাচ্চামো ছাড়া কিছুই না। এই ঘটনাও জানাসনি আমাদের। এমনকি তোর বান্ধবীরাও বলে নাই। তোর মনে হচ্ছে সা’দ প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তোকে বিয়ে করেছে। এমনও তো হতে পারে যে, সা’দ তোকে হারাতে চায়নি বলেই বিয়েটা করেছে। মাহা, যা হবার তা হয়ে গেছে। নিজেকে আরেকটু সময় দে। সা’দকে বোঝার চেষ্টা কর। দেখবি সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে। তোর উপর এখন অনেক দায়িত্ব। সব কিছু বাদ দিয়ে মন দিয়ে সংসার কর মাহা।’
মায়ের কথা শুনে যেন পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল মাহার। সে ভেবেছিল হয়তো সবটা শুনে তার মা নিজেই এই বিয়েটা ভেঙে দিবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে তিনি মন দিয়ে সংসার করার কথা বলছেন। মাহা চোখের পানি মুছতে মুছতে বলল, ‘মা! তুমি এইসব কী বলতেছ? আমি মন দিয়ে সংসার করব? আমার পড়াশোনার কী হবে মা?’
‘তোকে তো পড়ালেখা বন্ধ করার কথা একবারের জন্যেও কেউ বলেনি। আমরাও চাই তুই পড়াশোনা কর। আর উনারাও চায় তুই পড়াশোনা শেষ কর। পড়াশোনার পাশাপাশি সংসার ধর্মও তো পালন করতে হবে মা।’
‘আমি যদি সংসার না করি। আমি যদি সা’দকে ডিভোর্স দিয়ে দিই। তাহলে?’
মেয়ের মুখে এমন কথা শুনে আমিনা রেগে যান।
‘চড়িয়ে তোমাকে সিধে করে দিব। পন্ডিতি করে আগে সব কিছু লুকিয়েছ কেন? আমাদের জানাওনি কেন? আর এখন ডিভোর্সের কথা বলতেছ। কী ভাবো তুমি? বিয়েটা ছেলেখেলা? দুইদিনের জন্য কারো ঘরে গেলাম। রান্না বাটি খেললাম। এরপর চলে আসলাম। খবরদার মাহা, ভুলেও এইসব ভাববা না তুমি। তোমার বাবার একটা মান সম্মান আছে। সেই সম্মানে কেউ আঘাত করবে, এইটা তো আমি বরদাস্ত করব না। এবার সে যে-ই হোক না কেন, এমনকি তুমিই হও না কেন। সা’দকে ফোন করো। আসতে বলো বাসায়। আমি ওর জন্য রান্নাবান্না করব।’
আমিনা চলে যেতে নিলে মাহা অত্যন্ত রূঢ়ভাবে বলল, ‘ও আসবে না।’
‘কেন আসবে না। কী করেছ তুমি?’
মাহা আর কিছু বলতে পারেনি। সামান্য ডিভোর্সের কথা শুনে মায়ের এমন রিয়েকশন দেখে মাহার রীতিমতো ভয় হচ্ছিল। বাসরের রাতে যা হয়েছিল তা শুনলে যে তিনি কী করবেন তার আইডিয়া মাহা করতে পারছে। পরবর্তীতে আমিনা নিজেই বললেন, ‘তোমাকে ফোন করতে হবে না। আমিই কথা বলব ওর সঙ্গে।’

★★

সা’দের সামনে কয়েক পদের খাবার। পাশেই বসে আছেন শ্বশুর। এক পাশে দাঁড়িয়ে আছেন শাশুড়ি। মাহা নিজের ঘরেই আছে। মোশাররফ হোসেন এমন সোনার টুকরো জামাই পেয়ে ভীষণ খুশি। তবে রেগেও আছেন বটে। গম্ভীর গলায় জামাইকে বললেন, ‘তোমার উপরে ভীষণ রেগে আছি বাবা।’
এই বাসায় সা’দের ভালো লাগছে না। নিজের কাছে নিজেকে ছোটো ছোটো লাগছে। বিগত তিন ধরে সেই রাতের কথা লাগাতার মনে পড়ছে সা’দের। সম্ভব হলে ঢাকার বাইরে চলে যেত কয়েক মাসের জন্য, কিন্তু সেটা হবে না। অপমানে লজ্জায় আয়নায় তাকাতেও ভুলে যাচ্ছে সে। মাথা তুলে শ্বশুরকে বললেন, ‘হঠাৎ রেগে যাবার কারণ?’
‘মাহাকে দিয়ে চলে গেলা। তারপর আর আসলা না।’
‘আসলে আমি ব্যস্ত ছিলাম। কিছু কাজের প্রেশার ছিল।’
আমিনা বুঝতে পারছিলেন মেয়ে জামাই সম্পূর্ণ বানোয়াট কথা বলছে। আপাতত তিনি চুপচাপ সব হজম করছেন। খাবার এগিয়ে দিতে দিতে বললেন, ‘খাওয়া শুরু করো বাবা।’
‘এতকিছু রান্না করেছেন, আমি কোনটা রেখে কোনটা খাব।’
‘তোমার যেটা খেতে ইচ্ছে করে খাও। আমি মাহাকে ডেকে নিয়ে আসছি।’
মাহার কথা শুনে সা’দের অস্বস্তি বেড়ে যায়। এক টেবিলে পাশাপাশি বসে মাহার সঙ্গে খাবার খাওয়াটাও তার কাছে বেমানান লাগছে। কিন্তু উপায় নেই। সে চাইলেও এ বাড়িতে মাহাকে এভয়েড করতে পারবেন না।
মায়ের সঙ্গে ডাইনিং পর্যন্ত আসে মাহা। মায়ের চোখ রাঙানোতে খেতে বসে মাহা। আমিনা বেগমের ভেতরে ঝড় বইছে। যেভাবেই হোক মেয়ের সংসার টিকিয়ে রাখতেই হবে। মেয়ের মাথায় সংসার ভাঙার আগাম চিন্তা দূর করতে হবে। করতেই হবে।

★★

শ্বশুর শাশুড়ির অনুরোধে রাতটা এই বাড়িতেই রয়ে যায় সা’দ। মাহার ঘরে সা’দকে থাকতে হবে এটা ভেবেই সা’দের অশান্তি লাগছিল। সে কোনোভাবেই মাহাকে ফেস করতে চাচ্ছে না। একটা মেয়ে কতটা নির্দয়ভাবে তার ভালোবাসায় মোড়ানো সকল আকুতি অগ্রাহ্য করে তাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিল। আর সেই মেয়েটাকে ঘিরেই তার পুরোটা জীবন। এসব ভাবতেই তার ক্রোধ হাজারগুন বেড়ে যায়। তার ইচ্ছা করে সে দূরে কোথাও চলে যেতে নয়তো মাহার অধ্যায় জীবন থেকে মুছে ফেলতে। কিন্তু পরবর্তীতে ভাবে, মাহাকে এত সহজে মুক্তি দেওয়া যাবে না৷ মাহাকে বুঝতে হবে। মাহাকে বুঝতে হবে কারো ভালোবাসাকে এইভাবে নষ্ট করলে তার খেসারত দিতে হয়।
মাহা সা’দের আগেই ঘরে চলে আসে। খাওয়া দাওয়ার পর্ব মিটিয়ে ড্রইংরুমে শ্বশুরের সঙ্গে গল্পের আসর জমায় সা’দ। মানুষগুলোকে তার ভালো লেগেছে। আমিনা এসে মোশাররফ সাহেবকে ধমকান। স্ত্রীর ধমক খেয়ে মেয়ে জামাইকে ছাড়েন তিনি। মাহার ঘরে এসে দরজায় খিল দেয় সা’দ। মাহা তখন বিছানাতেই বসে। বইপত্র নিয়ে ঘাটাঘাটি করছিল। ঘরে ঢুকে সোজা বারান্দায় চলে যায় সা’দ। বারান্দার একপাশে রাখা চেয়ারটায় বসে সে। সিগারেট জ্বালায়। সিগারেটের গন্ধ ততক্ষণে ঘরেও পৌঁছে গেছে। বিরক্তিকর চেহারা নিয়ে মাহা বারান্দায় আসে। সা’দের সামনে দাঁড়ায়। সা’দ একবারের জন্যেও মাহার দিকে তাকায়নি।
‘সিগারেট অফ করো সা’দ। তুমি এখানে স্মোকিং করতেছ। আর ঘরে স্মেল যাচ্ছে।’
সা’দ মাহার কথায় পাত্তা না দিয়ে আনমনে সিগারেট টেনেই যাচ্ছে। মাহা আবারও বলে, ‘একটা মানুষ কত সিগারেট টানতে পারে। আশ্চর্য! সা’দ সিগারেট অফ করো।’
সা’দ তবুও মাহার কথায় কোনো কান দিল না৷ মাহা আচমকাই সা’দের হাত থেকে সিগারেটটা নিয়ে নিচে ফেলে দেয়। মাহা এই জিনিসটাই ভুল করে ফেলেছে। সা’দ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। মাহার বাম হাতটা শক্ত করে ধরে। হেঁচকা টানে মাহাকে সোজা নিয়ে বিছানায় ফেলে। সা’দের এই ব্যবহারটা রীতিমতো অসভ্যতার পরিচয় দিচ্ছিল মাহার কাছে। আগুন চোখে সা’দ মাহার সামনে ঝুঁকে পড়ে।
‘ডোন্ট ইউ ডেয়ার ডু দিস টু মি। আমি খুব কষ্টে নিজেকে সংযত করে রেখেছি। আমাকে পশু হতে সাহায্য কোরো না। নয়তো ছিড়েখুঁড়ে খেয়ে ফেলতে দুইবার ভাবব না আমি।’
মাহা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে সা’দের দিকে। এই মুহুর্তে সা’দকে হিংস্র পশুর চাইতেও ভয়ংকর মনে হচ্ছে। ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে। ঠোঁট কাঁপছে। চোখ বন্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে চোখের কোণ বেয়ে দু’ফোটা পানি বেয়ে পড়ে। সা’দ সরে যায়। পুনরায় বারান্দায় যায়। আবারও সিগারেট ধরায়।

চলমান…………………..