বিষ করেছি পান পর্ব-৪১+৪২+৪৩

0
319

#বিষ_করেছি_পান(৪১)

(কপি করা নিষেধ)
রিতী ঘরে ঢুকতেই মুখটা আপনাআপনি হা হয়ে গেলো। পুরো রুমে বেলুনের ছড়াছড়ি। তাজা গোলাপের ডেকারেশন। ফ্লোরের মাঝবরাবর সেন্টার টেবিলে সুন্দর করে সাজানো গোছানো থ্রী লেয়ার কেক। তার পাশেই দাঁড়ানো শুভ্র পাঞ্জাবী গায়ে দাড়ানো সোহাগ। জীবনের এতো জটিলতার মাঝে রিতী এসব দেখে একটু যেনো ধাক্কাই খেলো। রিতীর পেছন দিয়ে বাড়ি শুদ্ধ লোক হর হর করে ভেতরে ঢুকে গেলো। সবাই এক সাথে বলে উঠলো,
— হ্যাপি বার্থডে সোহাগের পিরিতি!
শুনা মাত্রই সোহাগ হো হো করে হেসে ফেললো। বোনদের মাথায় চাটি দিলো। মাথা ঘসতে ঘসতে বোনরা রাগী লুক দিয়ে আবার রিতীর দিকে ফোকাস করলো। সোহাগ রিতীর দিকে এগিয়ে গেলো। দু হাত মুঠোয় নিয়ে মৃদু আওয়াজ করলো,
— হ্যাপি বার্থডে আমার বউ পিরিতি ♥️
রিতী মনে করার চেষ্টা করলো। আজ কত তারিখ। মনে পড়তেই লাফ দিয়ে উঠলো। সোহাগের মুঠো থেকে হাত টেনে নিলো।
— আমার নাম রিতী।
বলেই সবার দিকে দৌড় দিলো। রমিজউদ্দিন ছেলের বউকে সুন্দর একজোড়া ঝুমকা গিফট করলো। সোহাগী একজোড়া বালা পড়িয়ে দিলো। শ্বশুড়কে খুশি করার জন্য রিতী কানের দুল জোড়া খুলে রেখে শ্বশুড়ের দেওয়া ঝুমকা পড়ে দিলো। তাঁদের থেকে দোয়া নিয়ে ননদদের কাছে গেলো। তারাও রিতীকে ছোট ছোট গিফট বক্স দিলো। রিতী এসব এখন আনবক্স করলো না। পরে রয়ে সয়ে আনবক্সিং করবে ভেবে রেখে দিলো। সোহাগ এসে পাশে দাঁড়াতেই রিতী তার দিকে তাকালো। হাসি খুশি মুখটা যেনো আরো উজ্জল হয়ে গেলো।বাবা মা ছুটি তমালের কথা মনে পড়ে গেলো। জীবনে এই প্রথম জম্মদিন তাঁদের ছাড়া সেলিব্রেট হচ্ছে। ছুটির একটু খারাপ লাগলেও এতো খুশির মাঝে চাপা পড়ে গেলো। বিছানার উপর থেকে ফোনটা নিতেই কয়েকটা মেসেজে চোখ আটকালো। বাবা মা ছুটি তমাল সবাই উইশ করেছে তাকে। রিতী ঠোঁট বাঁকা লো। একটু কল দিয়ে উইশ করলে কি এমন হতো?

রিতীকে টেনে টেবিলের সামনে নিয়ে আসা হলো।
— ফোনটা এবার রাখো। এমনিতেই দশমিনিট লেট করে ফেলেছি এবার কেকটা কাটো।
রিতী চমৎকার হাসলো। সবার দিকে তাকিয়ে বললো
— সবাইকে ধন্যবাদ। আমাকে এতো সুন্দর একটা মুহূর্ত উপহার দেবার জন্য।
— লাভ ইউ ভাবী।
— লাভ ইউ টু..
সবাইকে একসাথে জড়িয়ে ধরলো। সোহাগী তাড়া দিলো। রিতী কেকের সামনে এসে দাড়াতেই মোমবাতি গুলো জ্বালানো হলো। মোম নিভিয়ে হাতে হাতে রেখে সবাই একসাথে কেক কাটলো। একজন আরেকজনকে খাইয়ে আর কেউ দাঁড়ালো না। রিতী সোহাগকে ছেড়ে সবাই ঘর খালি করে দিলো।

রিতী সোহাগ একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে কি মনে করে যেনো দুজনেই হেসে দিলো। সোহাগ দরজা বন্ধ করে রিতীর দিকে এগিয়ে আসলো। বাহু টেনে পাঁজাকোলা করে তুলে নিলো। রিতী সোহাগের কলার টেনে ধরে মুখোমুখি হলো। নাকের সাথে নিজের নাক ঘষে দিলো।
— আমার গিফট কোথায় মি.?
— তোমার কাছেই আছে।
— কোথায়?
— খেয়াল করে দেখো, তোমার গিফটাও তোমার কাছে আবার আমার গিফট টাও তোমার কাছে।
— কিভাবে?
— সর্বাঙ্গে জড়িয়ে আছি যে।
রিতী চট করে সোহাগের গলা জড়িয়ে ধরলো।
— এগুলো তুমি অর্ডার করেছিলে?
— তবে কি তোমার কিপ্টুস ননদরা অর্ডার করবে?
— ওরা কিপ্টুস না। দেখো কতগুলো গিফট বক্স ওখানে।
— সব গুলোর বিল আমার ক্রেডিট কার্ড থেকেই গেছে ওকে?
সোহাগের চুপসানো মুখ দেখে রিতী খিলখিল করে হেসে উঠে।
— ও তার মানে ওরা সেদিন ই মেহেদী সহ এই গিফট গুলো নিয়ে এসছে? আগে থেকেই প্ল্যান তাইনা? বাট কিভাবে জানলে?
— কাবিননামা দেখে। বসোতো এখানে।
— কোলে রাখতে বুঝি কষ্ট হচ্ছে?
— আরে না। কাজ আছে।
— কি কাজ?
— মেহেদী দেখবো। দু হাত ভরে মেহেদী পড়েছো আমার এখনো দেখাই হয়নি।
রিতী গলা ছেড়ে দু হাত সামনে এনে তুলে ধরে। এপাশ ওপাশ নাড়িয়ে নাড়িয়ে দেখায়। এবার সোজা করে ধরে রাখে। দুই হাতের তালুতেই সোহাগের নামটা শো করছে। সহজেই চোখে পড়বে। এবং নজর ও কেড়ে নিবে। সোহাগ বাঁকা হাসে। রিতীর কপালে চুমু দিয়ে বলে,
— পাজি মেয়ে! তবুও কোল থেকে নামবে না তাইনা?
— নামিয়ে দাও।
বিছানার এক কোনে বসিয়ে দেয় রিতীকে। রিতী মুখে মুখে হাত চেপে অবাক হবার ভান করে,
— আআ! নামিয়েই দিলে।
সোহাগ অপলক তাকিয়ে থাকে। রিতী কি আজ একটু বেশি হাসছে না? কি অমাইক সেই হাসি! এতো দিন রিতীর কান্নামুখ দেখে তৃষ্ণা মিটিয়েছে আজ রিতীর হাসি মুখ দেখে তৃষ্ণা মেটানোর পালা। একটু ভালোবাসলেই বুঝি এতোটা ফ্রি ভাবে দুজন পাশাপাশি থাকা যায়?
সোহাগ ঝুকে রিতীর কপালে ফের ঠোঁট চেপে ধরে। রিতী আবেশে চোখ বন্ধ করে সোহাগের গলা জড়িয়ে ধরে। সোহাগ ঠোঁট সরিয়ে মুখোমুখি হয়ে ভ্রু কুঁচকে বলে,
— আজ হঠাৎ বেশী বেশী গলা জড়িয়ে ধরা হচ্ছে না? হাসির দৌলতে ঠোঁট জোড়া তো এক হবার নাম ই নিচ্ছে না। আমি তো জল্লাদিনীকে ভীষণ মিস করছি। কতক্ষন এতো হাসিখুশি থাকবেন মেডাম?
— যতক্ষন আপনি এরকম সুন্দর ভাবে পারফরম্যান্স চালিয়ে যাবেন।
সোহাগ মুচকি হাসে। রিতীও হাসছে। সোহাগ সামনে হাঁটু গেড়ে বসে রিতীর কোমড় জড়িয়ে ধরে। রিতী হাসি থামিয়ে বলে,
— আমি কি সত্যিই বেশী হাসছি?
সোহাগ উত্তর দেয়না। মেহেদী পড়া হাত দুটোয় গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে। দুটো হাত চুমু একে বুকে চেপে ধরে। রিতীর চোখে চোখ রেখে প্রশ্ন করে,
— আমায় ছেড়ে যাবে নাতো বউ ?
— সেচ্ছায় তো আসিনি।
— জোর করে রেখে দিবো।
— তাতেই কি আমি থাকবো?
— থাকবে। বাইরের দুনিয়া থেকে লুফে নেবো তোমাকে। আবরণ হয়ে জড়িয়ে নেবো তোমায় আষ্টেপৃষ্ঠে। গেঁথে যাবো তোমার মাঝে। তুমি চাইলেও আর আলাদা হতে পারবেনা। নতুন করে শুরু হবে তোমার হাত ধরে পথযাত্রা। প্রয়োজন হলে দূরে চলে যাবো তোমায় নিয়ে। যেখানে পুরো রাজ্য জুড়ে আমার আয়ত্ত্বে থাকবে। আর সেই রাজ্যে হবে তোমার বিচরণ। পুরোনো সব ভূলে যেতে চাই পিরিতি। কলুষিত অতীতকে ছেড়ে আমার এই পবিত্র বর্তমানে ঢুব দিতে চাই। যেখানে থাকবেনা কোনো পাপালেশ থাকবেনা কোন আপত্তি। থাকবে রিতী নামক একরাশ মুগ্ধতা। আমি আর তোমাকে হারাতে চাইনা বউ। প্লিজ আমার বুকে থেকে যাও। নিজের সবটা দিয়ে তোমাকে আগলে রাখবো। তোমার খুশিতেই আমি হাসবো। প্রমিজ! আই প্রমিজ ইউ।
বলতে বলতেই রিতীর মুখখানা আঁজলা ভরে মূহুর্তে ই ঠোঁটে ঠোঁট মিলিয়ে দেয় সোহাগ। শুষে নিতে থাকে সবটুকু মিষ্টতা। আপনা আপনিই রিতীর হাত উপরে উঠে আসে। পরম আবেশে জড়িয়ে ধরে সোহাগের গলা। গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো বিছানায় মিশে একাকার হয়ে যায় দুটো তৃষ্ণার্ত প্রাণ ।রিতীকে নিয়ে পৃথিবীর সর্বোচ্চ সুখের রাজ্যে পাড়ি জমায় সোহাগ। রিতী আঁকড়ে ধরে সোহাগকে।‌‌ অভিভূত হয়।অবুঝের মতো প্রশ্ন করে নিজেকে।
— স্বামী সুখ বুঝি একেই বলে?

______________________
দরজায় বার বার কে যেনো কলিং বেল টিপছে। রান্নাঘর থেকে বীনা ডাকছে,
— কতক্ষন থেকে বেল বাজছে! কেউ দরজাটা খুলে দিচ্ছো না কেনো? কেউ নেই ড্রয়িংরুমে? বাঁধন? ঝিমা? কোথায় সব? আটা মেখেছি আমি। এই হাতে দরজা খুলবো কিভাবে?
মায়ের ডাকে বাঁধন আসে দরজা খুলে দিতে। বীনা রান্নাঘরের দরজায় এসে সোহাগকে দেখে। দাঁত মুখ খিচে বলে,
— ছেলে মেয়েকে দিয়ে একটা কাজ ও যদি হয় আমার। কখন থেকে ডাকছি তোমায়?
— মা আমি তোমার ডাক শুনেই আসছি।
বাঁধনের আগে কোথা থেকে চিলের বেগে ঝিমা দৌড়ে আসে। বাঁধনকে পেছনে ফেলে দেয়।
— মা আমি দেখছি। ছুটি আর কাকা এসেছে।
বাঁধন ঝিমাকে দরজা খুলতে যেতে দেখে সিড়ি বেয়ে উপরে চলে যাচ্ছিলো। ঝিমার মুখে ছুটির কথা শুনে সেখানেই থেমে যায়। পেছন ফিরে তাকায়। ঝিমা দরজা খুলে দিতেই ছুটির হাসিমাখা মুখটা দেখা যায়। এতো দিন পর দুই বান্ধবী দুজনকে দেখে আর দূরে থাকতে পারে না। ঝাঁপিয়ে পড়ে একজন আরেকজনের বুকে। খুশিতে কান্না চলে আসছে। একজন আরেকজনের ঘাড়ে মাথা রেখে চুপ করে থাকে। বাঁধন সিঁড়ি থেকে নেমে আসতেই চোখে পড়ে ছুটির। ছুটির চোখ দুটো আরো খুলে যায়। নিবদ্ধ হয় চারচোখ একসাথে। কেউ উদ্বিগ্ন হয়না। চোখ বুজে না। চোখ ফেরায় না। শুধু তাকিয়ে থাকে পলকহীন চোখে।

ছানোয়ারকে বীনা সোফায় বসতে বলে। বাড়ির হাল চাল রুম্পা তমালের কি খবর যাবতীয় সব জিজ্ঞেস করছে। এতো দিন পর দেখা হওয়ায় কথার তালে তালে সেও সোফায় বসে পড়ে। হাত ভর্তি যে তার মাখা ময়দা সেকথা বেমালুম ভুলে যায়। ঝিমা পরেছে ছুটিকে নিয়ে।
বাঁধন ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছুটি-ঝিমা, বীনা-ছানোয়ারের কথা শুনছে। ঝিমা ছুটিতো প্রায় নাচছে। আজ যে রিতীর জম্মদিন! রিতীকে সারপ্রাইজ দিবে আজ। ছানোয়ার গিয়ে রিতীকে নিয়ে আসবে আর সন্ধ্যার পর রেস্টুরেন্টে গিয়ে সবাই মিলে সেলিব্রেট করবে। ছানোয়ার বলে,
— পরিক্ষাটা আপনাদের কাছে রেখে দেওয়াতে খুব স্বস্তি পাচ্ছি ভাবী। আমরা তো রায়পুরেই চলে গেছি। সেখান থেকে এখানে পরিক্ষাটা দেওয়ানো অসম্ভব। আমি আর চাইছিনা এই বাড়িতে ফিরে আসতে। আমার ছোট মেয়েটার ও সমস্যা করতে পারে। বলে না জেদের ভাত কুত্তারে দিয়ে খাওয়ায়? আর ছুটিটাও বড় হয়ে গেছে। এই পরিক্ষাটা দিলে মেয়ে আমার কলেজে পড়বে। এখানে ঝিমার সাথে থাকবে সব সময় তাছাড়া আপনারা তো ঘরে বাইরে সব সময় আছেন ই। তাই স্বস্তি পাচ্ছি। মেয়েটাকে দেখে রাখবেন ভাবী।

বাঁধনের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙ্গে পড়ে। নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে ব্যাকুব মনে হয়। এদের কথা ধরনেই বুঝে গেছে আগে থেকেই যে এদের যোগাযোগ ছিলো। বাঁধন কে কেউ কিচ্ছুটি বললো না? ঝিমাও না? শুধু শুধু বাঁধন কত না জায়গায় কত ভাবে হন্যে হয়ে ছুটিকে খুঁজে বেড়ালো।ঝিমা ছুটি একপ্রাণ! তারা আলাদা থাকতেই পারেনা। এটা বাঁধনের বোঝা উচিত ছিলো। এতোটা বোকা নিজেকে বাঁধন কখনোই বোধ করে নি।
বাঁধন আরেকটা ব্যাপার খেয়াল করলো ছুটিকে সে খুঁজে বেড়িয়েছে। কেনো? চলে গেলো যেতো। ছুটি ঝিমার বেস্ট ফ্রেন্ড। বাঁধনের কি? না আছে কোন সম্পর্ক না আছে কোন বন্ধন! আর সেই চিঠি? চিঠিতে ছুটি বাঁধনের নামটা বার বার উল্লেখ করেছে। ঝিমাকে খেয়াল রাখতে বলেছে। চলে যাবার সময় অনেকেই আবেগে আপ্লুত হয়ে প্রিয় মানুষ গুলোর দায়িত্ব নিতে বার বার দায়িত্ত্ববান কাউকে বলে যায়।ছুটিকে এমন কিছু ভাবা যায়না যে তার আবেগ, আচরণ, কথা তুচ্ছ বলে ফেলে রাখবে। ছুটি এখন পূর্ণ একজন কিশোরী হয়ে উঠেছে। ছয়মাস আগে যে ছুটিকে দেখেছে সেই ছুটি আর নেই। হাতে পায়ে শরীরে সংকুচিত কলি প্রায় ফুটন্ত গোলাপে পরিণত হয়ে গেছে। রুপ লাবণ্যতা বেড়েছে কয়েকগুণ। ছোট থেকেই যেমন দুষ্টুমিতে ভরপুর তেমনি ম্যাচুরিটিতে বয়সের তুলনায় সবার থেকেই এগিয়ে। তাহলে কি বাঁধন ছুটির প্রিয় মানুষ? কি হিসেবে প্রিয়? বন্ধু? ভাই? নাকি অন্য কিছু?

ছানোয়ার রিতীর হলের সামনে দাঁড়িয়ে। বারবার মেয়েটাকে কল দিচ্ছে কিন্তু সুইচ স্টপ বলছে। অসময়ে ফোন কেনো বন্ধ থাকবে? তবে কি মেয়েটা ক্লাসে? ছানোয়ার অনেক ক্ষন অপেক্ষা করলো। এরিমধ্যে হলে একজন কে ঢুকতে দেখলো। মেয়েটাকে ছানোয়ার চিনে। রিতী আগে যে রুমে ছিলো সেই রুমে মেয়েটাও ছিলো। রুমমেট দের সাথে কি জানি সমস্যা হয়েছে রিতী বলেছিলো। তবে কার সাথে হয়েছে তা জানা নেই। ছানোয়ার প্রসস্ত হেসে মেয়েটির দিকে এগিয়ে গেলো। মেয়েটি ছানোয়ার কে দেখেই চিনে ফেললো। হাসি খুশি মুখে সালাম দিলো।
— আসসালামুয়ালাইকুম আঙ্কেল। কেমন আছেন? রিতীকে রেখে যেতে এসেছেন বুঝি?
— ওয়ালাইকুমুস সালাম মা। রেখে যেতে মানে? রিতী হলে নেই? ক্লাসে গিয়েছে বুঝি?
— কি বলেছেন আঙ্কেল? রিতীর না বিয়ে হলো? তিন দিন আগেই তো জানতে পারলাম। এসবের মানে কি? তার মানে আপনাকে না জানিয়েই রিতী বিয়ে করেছে? পালিয়ে গিয়েছে নাকি আঙ্কেল? ছি ছি?
— বিয়ে? মানে? আমার মেয়ের কোন বিয়ে টিয়ে হয়নি? কোথায় ও ডাকো ওকে।
— ফোন করুন না। তার মুখ থেকেই শুনুন।
— ফোন তো বন্ধ বলছে।
— বন্ধ তো বলবেই। মেয়ে আপনার ধোঁকা দিয়েছে। পালিয়ে কাকে না কাকে বিয়ে করেছে। এখন ফোন বন্ধ রেখেছে। সেবার না এসে কত গুন কির্তী করে গেলেন সুপারভাইজার এর সাথে? এখন দেখুন কেমন মেয়ে আপনার। ছি ছি। কি বলবো!
মেয়েটা ফোন বের করে এক নাম্বারে কল দেয়। হাসতে হাসতে বলে,
— এই কোথায় তোরা? নাম নাম নিচে নাম। দেখ রিতীর বাবা এসেছে। রিতী যে বিয়ে টিয়ে করে সংসার করছে তা ওর বাবা নিজেই জানে না। কিহ? হ্যা হ্যা। বলছিলাম না সুন্দর মেয়ে আবার সিঙ্গেল! এসব ফাপর বাজি ভাই আমি ভালোই ধরতে পারি। সাধু গিরী দেখাতে আসে। কোন নাগর জুটিয়ে এখন বিয়ে করেছে…

মেয়েটার কথা ছানোয়ার আর শুনতে পেলো না। বুকে চিন চিন করা ব্যথা অনুভব করলো। মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগলো। মেয়ের হাব ভাব তার এজন্য ভালো ঠেকছিলো না। বাপ সে সব বুঝে যায়। যে মেয়ের সাথে দিনে তিনবার নিয়ম করে কথা হতো গত তিনদিন থেকে সে মেয়ের সাথে একবার কথা হয়েছে। তাও অন্যরকম লাগছিলো মেয়েটাকে। পুতুলের মতো করে গড়া মেয়েকে ছেড়ে দিতে না দিতেই সর্বনাশ ঘটিয়ে ফেললো? এই শিক্ষা দিয়ে এতো দিন যাবৎ বড় করলো? ছানোয়ারের প্রচন্ড শরীর খারাপ লাগলো। গুটিসুটি হয়ে ধপ করে বসার জায়গায় গিয়ে বসে পড়লো। চোখে মুখে নিমেষেই আধার ঘনিয়ে এলো।

চলবে,
লাবিবা তানহা এলিজা ~

#বিষ_করেছি_পান(৪২)

(কপি করা নিষেধ)
হসপিটালে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসেছে রিতী। বাবার কেবিনে গিয়ে ‘ বাবা….’ বলে হাওমাও করে কেঁদে উঠে। ছানোয়ার পিঠের পেছনে বালিশ দিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে। একপাশে বাহু বন্ধনে ছুটি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে বাবার বুকে। আরেকপাশের বুকটা খালি। রিতী পড়ে আছে ছানোয়ারের পায়ের কাছে। শক্ত হয়ে বসে আছে। রিতীকে অপলক চোখে চেয়ে দেখছে। আর একটু একটু করে বুকের ব্যথাটা বাড়ছে। রিতী আকাশী রংয়ের কাতান শাড়ি পড়ে আছে। গলায় সোনার ন্যাকলেস। পিঠে ছাড়া সিল্কি চুল। হালকা মেকাপ। গাঢ় লিপস্টিক। ঘরের বউ দেখাচ্ছে। মেয়েদের শাড়ীতে বউ বউ লাগে। ছানোয়ারের চোখ ভিজে উঠলো। একপাশের খালি বুকটা খা খা করে উঠলো। তবু মেয়েকে ডাকলো না। নিলোনা বুকে টেনে। গম্ভীর গলায় জানতে চাইলো,
— কোথায় ছিলে?
রিতী ঝটপট উত্তর কাটলো,
— ভার্সিটিতে।
— এভাবে?
রিতী নিজের দিকে তাকালো। ঢুক গিলে বললো,
— ফাংশন ছিলো বাবা। দু তিন থেকে সেটা নিয়েই বিজি ছিলাম তাই তোমার সাথে ভালো ভাবে কথা বলতে পারিনি। আর তার মধ্যেই তুমি নিজের এই হাল করে ফেলেছো?
রিতী বোকা নয়। হসপিটালে ঢুকতেই হলের মেয়েটাকে দেখেই বুঝে ফেলেছে কাহিনী গভীরে চলে গেছে। নয়তো তার সুস্থ সবল বাবা এভাবে অসুস্থ হবে না। ভালোভাবেই ম্যানেজ করতে লেগে পড়েছে রিতী। কাঁদতে কাঁদতেই বললো,
— তুমি আসবে আমাকে জানালে না কেনো? কখন থেকে খাওনা? রোদে দাঁড়িয়ে ছিলে তাইনা? এরজন্য এমন হয়েছে! আজ ফাল্গুনেই চৈত্র মাসের রোদ উঠেছে।
রিতীকে দেখে বুঝার উপায় নেই সে এক বিন্দু মিথ্যে বলছে। ছানোয়ার জানে তার মেয়েটা মিথ্যা বলে না । রিতীর অস্থিরতা দেখে ছানোয়ার আর শক্ত থাকতে পারে না। হাত বাড়িয়ে মেয়েকে বুকে টেনে নেয়। এখন তার শান্তি লাগছে। তার বুক জুড়ে তার দুই কলিজা ভরে আছে।
— তোমাকে কে নিয়ে এসেছে এখানে বাবা?
— বাইরে আছে মেয়েটা। আগে তুমি যে রুমে ছিলে সে রুমেই ছিলো। তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে দিও।
— ওহ। আচ্ছা দিবো। তোমাকে বলেছিলাম না বাবা ঝামেলা হয়েছিলো… এই সেই মেয়েটা।
— ওহ। তারজন্য কি আমাকে উল্টোপাল্টা কথা বললো?
— কি বললো?
— তুমি নাকি পালিয়ে বিয়ে করেছো? সংসার করছো?
— আমি তো তোমার সামনেই আছি বাবা।
— শাড়ি কোথায় পেলে?
— এক বড় আপুর।
— গহনা তো সোনার।
— এগুলো গোল্ড প্লেট বাবা। আসল নকল চেনা যায়না।
— হুম। আমি একটু ঘুমাবো। তোমরা কোথায় যেও না।
ছুটি রিতী উঠলোনা। সেভাবেই বাবার বুকে পড়ে রইলো।ছানোয়ার লম্বা শ্বাস টানলো। এতোক্ষনের এলোমেলো চিন্তার সাথে অশান্ত মনটাও এবার শান্ত হলো। কিন্তু ঘুমোতে পারলো না। ফের চোখ দুটো ভিজে উঠলো। দুই মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
— আমার বড্ড আদরের দুটো পুতুল। তোমরা দুজনেই বড় হচ্ছো। কতো যত্নে তোমাদের মানুষ করছি সেটা আমিই ভালো জানি। শরীরের রক্ত পানি করে হলেও তোমাদের ভালো রাখছি । সাধ্য মতো কখনোই কোন খামতি রাখছি না। বাবার কষ্ট তোমরা এখন বুঝবেনা। যখন নিজেরা সেই পজিশনে যাবে তখন বুঝতে পারবে। আমি কখনোই এমন কারো হাতে আমার যত্নে গড়া পুতুলদেরকে তুলে দিতে পারবোনা যারা আমার পুতুলদের আমার থেকে ভালো রাখার সামর্থ্য থাকবেনা। আমার মেয়েদের যোগ্য কারো হাতেই আমি তাদের তুলে দিবো। বাবা আছেন। বাবা সবটা দেখবেন। ভূল করেও কখনো অপাত্রে নিজেকে দান করতে যেও না। ভূল করেও এমন ভূল বাবা কখনোই ক্ষমা করবে না।
রিতী ছুটি দু বোন ই হালকা কেঁপে উঠে। বাবার কথার গভীরতা দু বোন ই উপলব্ধি করতে পেরেছে। ছুটি বুঝতে পেরেছে এখন থেকে তার ও আর ছাড় নেই। আপুর সাথে বাবা তাকে একচোখেই দেখা শুরু করেছে। ভূল করেও যদি ভূল না ক্ষমা করে তাহলে তাদের দু বোনের কেউ ই ক্ষমা পাবেনা। বাবার এ মতবাক্য শোনার আগেই যে যার ভূল করে ফেলেছে। ছুটি কি কখনো বাবার সামনে স্বীকার করতে পারবে এই ভূলের কথা? বলতে পারবে তার মন প্রাণ সব একজনকেই উজাড় করে ভালোবেসে আসছে? আর সেই ব্যক্তি একজন একত্রিশ বছরের যুবক সাথে বিবাহিত? বাবা কি কখনো করবে ক্ষমা? রিতী এখনো লুকিয়ে যাচ্ছে সবটা। এতটুকু শুনেই যে বাবা অসুস্থ হয়ে যায় সেই বাবা কি মেনে নিতে পারবে যখন শুনবে পুরোটা? দুই বোন দুইদিকে অস্থিরতায় হাঁসফাঁস করছে।আর দরজায় হাজারটা ভাবনা ভাবতে ভাবতেই মাথা নত করে দাঁড়িয়ে আছে বাঁধন,সোহাগ আর হলের মেয়েটা। মেয়েটা অনুতপ্ত তার করা ব্যবহারে। এরকম কিছু কথা আছে একটা বাবা কখনোই মেনে নিতে পারেনা। আজ যদি রিতীর বাবার জায়গায় তার বাবাকে কেউ এমন ভাবে বলতো? কি হতো? সেও তো দুধে ধোওয়া তুলসী পাতা না। ছানোয়ার রিতীর কপালে চুমু দিয়ে বলে, — হ্যাপি বার্থডে আমার মা।

ছুটি ঝিমার রুমে নিজের বইপত্র রাখছে। এখানেই থাকবে প্রায় একমাস। পরিক্ষা শেষে আবার চলে যাবে। ছানোয়ার চলে গেছে বাসায়। ছুটি গোছানো শেষ করে একবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। নিজেদের বাড়িটা দেখে। বাড়ির নিচে সাইনবোর্ড লাগানো। সেখানে লেখা টু লেট। তার নিচে ছানোয়ারের নাম্বার দেওয়া। যাওয়ার আগে ছানোয়ার এই সাইনবোর্ড টি লাগিয়ে দিয়ে গিয়েছে। ছুটির একদম সেই মফস্বলের বাড়িটি ভালো লাগেনা। কিন্তু কোন এক জনাবের দ্বারা ছানোয়ার বুঝমান হয়েছে ছুটির ক্ষতি হবার সম্ভাবনা আছে। রিতীর মুখ থেকে শুনেছে সোহাগ নাকি রিতীকেও একথা বলেছে। কিন্তু ছুটি তো জানে… বিশ্বাস করে সোহাগ তার ছুটিরাণীর কোন ক্ষতি হতে দিবেনা। দুলাভাই হয় তার! ছোট বোনের মতো দেখে। ছুটি মনে প্রশ্ন যা শুনেছে তা কি ঠিক? রিতীর সাথেও কথা বলতে পারলো না। অবশ্য রিতী কাল আসবে বলেছে। রিতীর সাথে কথা বলে তারপর সোহাগের সাথে দেখা করবে। একমাত্র শালী হবার পরেও এমন ফিলিংস দিচ্ছে যেনো উড়ে এসে জুড়ে বসেছে। ভাবনায় মত্ত ছুটির ধ্যান ভাঙ্গে সুমধুর কবিতার আবৃতিতে।
” আমি, জেনে শুনে বিষ করেছি পান।
প্রাণের আশা ছেড়ে সঁপেছি প্রাণ।
যতই দেখি তারে ততই দহি,
আপন মনোজ্বালা নীরবে সহি,
তবু পারি নে দূরে যেতে, মরিতে আসি। ”
— এই কবিতাটি ই না বলেছিলি যখন আমি হসপিটালে?
ধরতে পারিনি ঠিক।আবছা ছিলো। মেলাতে মেলাতে ক্লিয়ার হলাম।

অপর পাশেই যে বাঁধনের বারান্দা ছুটি ভূলেই বসেছিলো। বাঁধনকে দেখে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মিথ্যা হাসি দিলো। বাঁধনের জন্য সত্য হাসি আসেনা ছুটির। আসে শুধু তৃষ্ণার্ত বুকের দীর্ঘশ্বাস। মুখে আওড়ালো
— বাঁধন ভাই!
— রুমে আয়।
— হ্যা?
— আমার রুমে আয়। কথা আছে তোর সাথে।
— কি কথা?
বাঁধন ঘরে চলে যায়। ছুটিও বারান্দা ছাড়ে। বাঁধনের ঘরে যেতেই বাঁধন অমাইক হাসি দেয়। বাঁধন ইশারায় বসতে বলে। ছুটি বসতে বসতে বাঁধনের হাসি মাখা মুখটা দেখতে থাকে। বাঁধন ও সামনে এসে বসে।
— কেমন আছিস?
— ভালো।
— পরিক্ষার প্রস্তুতি কেমন? এবারো ফেল মারবি?
— সারা জীবন ই মারবো। আমার জম্ম ই ফেল খাওয়ার জন্য।
— আমি আছি না? অংকে তোর বাপে তোকে জাহাজ না বানাতে পারলেও আমি তোকে লঞ্চ বানাবো। চলবেনা?
— সাঁতার কাটবে।
— তুই যে চলে গেলি আমাকে তো জানিয়ে গেলি না। পেলে নেলে তোকে এতো বড় করলাম আর তুই ফুরুৎ করে হুটহাট উড়াল দিলি! এটা কি ঠিক করেছিস ছুটি?
— তুমিতো ধরে রাখলে না।
— বড় হয়ে গেছিস। তুমি ডাকছিস।
— ঝিমাও যা আমিও তো তা।
— হ্যা। এবার আর ছুটবিনা। তোদের বড় ভাই আছেনা? দুইটাকে ভালো ছেলে ধরে এনে একসাথে বিয়ে দেবো আমি। তারপর যত ইচ্ছে ছুটিস।
— কতদিন পাবে? একমাস? বেশী তো না।
বাঁধন উত্তর দিলো না। ছুটিকে বাজিয়ে দেখতে মন চায়। কিন্তু ছুটি ছুটির মতোই ত্যাড়া। কিন্তু চোখ যে অন্য কিছু বলে? বাঁধনের উপর থেকে চোখ তো সরেই না। তাই বাধ্য হয় বাঁধন ঐ চোখে চোখ রাখতে।
— সুমি আপু কেমন আছে?
— হু?
— সুমি আপু।
— বেটার।
— ওহ।
— দেখতে যাবি? তোকে নিয়ে যাবো একদিন।
ছুটি হাসে। এখনো যাওয়া বাদ দিলো না। বীনা কত কি করলো তাতেও কাজ হলো না। বিয়ে করা বউ যে.. তাকে সুস্থ করেই তুলে ঘরে তুলবে। বাঁধন ভাই কি এই প্রতিজ্ঞা করেছে? খুব জানতে ইচ্ছে হলো ছুটির। তবে ইচ্ছেটা দমালো। আজ উঠি পড়তে বসবো বলেই বাঁধনের ঘর ত্যাগ করলো। কিন্তু পড়তে বসলো না। মন কি শরীর কোনটাই শায় দিলোনা। তাই চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়লো।

রিতীর আশেপাশে ঘুর ঘুর করছে ছুটি। একবার এপাশে যাচ্ছে তো আরেকবার ওপাশে। মাঝে মাঝে আবার নাক লাগিয়ে শুকছে। কি শুকছে? ক্রমাগত চালিয়েই যাচ্ছে। বীনা আদর করে রিতীকে বসিয়ে খাওয়াচ্ছে। এটা সেটা জিজ্ঞেস করছে। রিতী উত্তর দিচ্ছে। মাঝে মাঝে ছুটিকে চোখ রাঙাচ্ছে। আবার বকাও দিচ্ছে,
— ছুটি শান্ত হয়ে বস। কি শুরু করেছিস?
ছুটি থামছে না। রিতী ঝিমাকে বলে,
— ধরতো একে। রুমে নিয়ে যা। আমি আসছি। ওর বেয়াড়া পনা বের করছি।
রিতী রুমে আসতেই ছুটি ঝিমা একসাথে রিতীর শরীর শুকতে থাকে। দুজনেই একসাথে নিশ্বাস টেনে বলে উঠে, — খুশবু…..উউউউ।
রিতী পারেনা দুইটার গালে সপাত সপাত থাপ্পড় লাগিয়ে দেয়। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে বিছানায় গিয়ে বসে।
— এই সরতো তোরা। যতসব আজাইরা কাজকাম!
— হায় হায় আপু! সোহাগ ভাইকে পেয়ে আমাদের ভুলে গেলে!
— এবার কিন্তু বেশী বেশী হচ্ছে।
— আমাদের দাবী মানতে হবে। মানতে হবে।
— আমার কাছে কি? যা তোদের দুলাভাইয়ের কাছে যা।
ছুটি এসে রিতীর কোলে লাভ দিয়ে উঠে বসে।
— আপু! তুমি এতোদূর! বাবা যদি জানতো! সেখানেই অক্কা পেতো।
— ছিহ! ছুটি,এসব বলতে নেই।
— আপু তুমি কিভাবে এতো স্ট্রং থাকো সব সিচুয়েশনে?
ঝিমার করা প্রশ্নে রিতী শুকনো হাসে।
— তোরা যদি চুপ থাকিস আমি আরো স্ট্রং থাকতে পারি।
— আমি কিন্তু দুলাভাই কে ছাড়বোনা।
— ছাড়িস না।
— আপু তুমি কি আর তোমার সংসারে ফিরবে না?
— আপাতত না।
— কেনো? বাবাতো কিছু জানবেনা।
— সেখানে অনেক মায়া। অনেক সুখ! আমি যদি লোভী হয়ে পড়ি তাহলে আমার পরিবার জীবিত ভোগ করবে মৃত্যু যন্ত্রনা। তুইও বাচবিনা।

ছুটি এভাবে ভেবে দেখেনি ব্যাপারটা। তার বাবা তো সাফ সাফ জানিয়েই দিয়েছে তাদের দু বোনকে সবটা। তাহলে তার মতো তার বোন ও কি বয়ে যাবে এই না পাওয়ার কষ্ট টা? এটা ছুটি কিভাবে হতে দিতে পারে? চলুক এভাবে। পরিক্ষার কথা ভাবা যাক। পরে না হয় দেখে নিবে সুযোগ বুঝে ছুটি সবটা।

বাড়ি থেকে বেরিয়েছে ছুটি ঝিমা। দুদিন পর পরিক্ষা। এবার পরিক্ষা হচ্ছে মার্চ মাসে। সরকারের নানান ঝামেলায় সময়টা মাস খানেক পিছিয়ে গেছে।বীনা দেখলে আর র মানবে না। লুকিয়ে চুরিয়ে বেরিয়েছে ছুটি ঝিমা। ছুটি হাতে ফোন পেয়েছে। ছানোয়ার যাবার সময় দিয়ে গেছে। ছুটি কল দেয় সোহাগকে। সোহাগ জানায় আশে পাশেই নাকি আছে। ছুটি সেখানে গিয়ে উপস্থিত। ছুটিকে দেখে প্রশস্ত হাসে সোহাগ। টানিয়ে টানিয়ে মজা করে,
— ও হে.. আমার ছুট্টিরাণী।
ছুটির ঝাঁঝালো উত্তর।
— আমি কিন্তু ভীষণ রাগ করেছি।
ছুটির অবস্থা ভালো না। যে কোন সময় মাটিতে শুয়ে পড়তে পারে। ঠোঁট উল্টে বসতে যাবে তখনি এই এই এই করে সোহাগ হাত টেনে ধরে। ঝিমাও এসে বগলের নিচে হাত ঢুকিয়ে দিয়ে টেনে ধরেছে। এখন ছুটি ঝিমা আর সোহাগের মাঝে ঢুলছে। সোহাগের ঠোঁটে খই ফুটে,
— আপু আপু আপু…. আপুটা আমার এরকম করেনা। দেখো লোকে দেখে কি বলছে! এতো বড় মেয়ে এভাবে ঢোল খেলে! ঝিমা টেনে ধরো একে।
ছুটি ত্যাড়ামি শুরু করে। উঠবে না সে। ঠোঁট উল্টে কান্না শুরু করে..
— আমার ভালো ছুটি রাণী! কান্না অফ করো মা! চলো আমরা কোথাও বসি। কি চাই? কি চাই বলো?
— আমি বিয়ে খাবো….!
বলেই আরো কান্না জুড়ে দেয়। সোহাগ বুঝতে পারে একে থামাতে হবে। রাস্তায় লোকজন দেখছে। বার বার তাকাচ্ছে। যে কোন মুহুর্তে গোল চত্ত্বর সৃষ্টি হতে পারে। সোহাগ টেনে টুনে ছুটিকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ঢুকে। ওয়েটারকে ডেকে বলে,
— অর্ডার নাও। আমার ছুটি রাণী যা খেতে চাইবে তাই আনবে।
— আমি কিছু খাবোনা। বার বার আমাকে এভাবে হাত করা যাবেনা।
ছুটির চিৎকার এ সোহাগ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। হাত জোড় করে বলে,
— দুলাভাই সরি তো! কান্না অফ কর না….!
— তুমি কি ভেবেছো এসব ভূরি মোটা খাবার আমাকে খাইয়ে চুরি করে আমাদের ঘরের অমৃত খাবা! আমি সেটা মেনে নিবো?
— আমি কোথায় অমৃত খেলাম?
— একদম গলাবাজি করবেনা। আপুর গায়ে এখনো তোমার গন্ধ লেগে আছে। মিথ্যা কথায় চিড়ে ভিজবেনা।
ছুটির কথায় সোহাগের কাশি উঠে যায়। বিচ্চু টাযে বিচ্চু! তাই বলে এমন কথা বলবে সোহাগ ভাবতে পারেনি।তার সাথে জোড় হয় আরেকজন। স্বয়ং ঝিমা!
— আমি কিন্তু আংকেল কে বলে দেবো।
— তোরা দুজন মাফ কর মা। এমনেই বউ আমার পাচ দিন থেকে যোগাযোগ করেনা। তার উপর তোদের প্যারা।
— আমরা দুই মাত্র শালিকা। পর পর দুবার বিয়ে হলো তাও আমাদের ছাড়া। প্রথম বার ছেড়ে দিলাম। কিন্তু এবার? এবার কিছুতেই ছাড়ছিনা।
— কত চাই বল। দিয়ে দিচ্ছি।
— সামনে আমাদের পরিক্ষা।
— ভালোভাবে দিও।
— ডাবল দিয়ে দোয়া করে দাও দুলাভাই। মধু কিন্তু খেয়োছো। চুরির দায়ে এখনো কিন্তু লকাপে তুলছিনা।
অগত্যা সোহাগের মানিব্যাগের সব মানি হারালো। কতগুলো নোট ছিলো ছুটি ঝিমা সোহাগ কে গুনেও দিতে দিলো না। বিনিময়ে কথা দিলো,
— অমৃত চুরির ব্যাপারটা মালিকের কান অব্দি পৌঁছাবে না।

চলবে,
লাবিবা তানহা এলিজা ~

#বিষ_করেছি_পান(৪৩)

(কপি করা নিষেধ)
ছুটির পরিক্ষা শুরু। মাঝখানে একদিন কি দুই দিন গেপ। বাঁধন প্রতিরাত করে ঝিমা আর ছুটিকে পড়াচ্ছে। কোথায় কোন সমস্যা? ইমপর্টেন্ট কোয়াশ্চন গুলো কতটুকু ক্লিয়ার হলো সবটাই দেখছে। ঝিমা খুব ভালোভাবেই পড়া দিতে পারছে। ঝামেলা হচ্ছে ছুটিকে নিয়ে। এই বান্দি যে দাদু বাড়িতে যাবার পর পড়েইনি সেটা খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। বাঁধনের দশটা প্রশ্নের মধ্যে একটা প্রশ্নের উত্তর টেনে টুনে কোনরকম দিতে পারে। একে পড়াতে গিয়ে বাঁধনের মাথা ব্যথা হচ্ছে প্রতি রাতে। তবুও বাঁধন ছেড়ে দেবার পাত্রী নয়। জিদ করে বসেছে। যেভাবেই হোক এই আলু খাওয়া ছাত্রীকে মেয়োনিজের মুখ দেখিয়েই ছাড়বে। ছুটিও পড়েছে মহা ফ্যাসাদে। ঝিমা ঝিমার মতে মতে পড়ে চলে যায় ঘুমোতে। ছুটি যেতে পারেনা। গভীর রাত অব্দি বাঁধন বসিয়ে বসিয়ে পড়ায়। চা গরমের ইলেকট্রিকেল জগটা এখন ঘরেই আনা হয়েছে। ঘুম নেই বাঁধনের ঘুম নেই ছুটির। ঢুকে ঢুকে চা গেলা ই তাঁদের কাজ। ছুটি বিরক্ত হয়ে যায়। বাঁধনের বিছানায় রাগ করে টান টান হয়ৈ শুয়ে পড়ে। ঝনঝনিয়ে বলে,
— মাস্টার আমাকে দশ মিনিট পর ডেকে দিবেন। আমি ঘুমাবো।
ছুটি দশমিনিটের কথা বলে ঘন্টা ঘুমোবে সেটা বাঁধন ভালোভাবেই জানে। খ্যাক খ্যাক করে উঠে।
— মাস্টার তোর বাপ। ছানোয়ার মাস্টার। আমি তর যম। উঠ। উঠ বলছি।
ছুটি ত্যাড়ামি করে শুয়ে থাকে।পিঠে দু চার ঘা স্কেলের বাড়ি পরলে আবার উঠে বসে। ঠোঁট উল্টে আবার পড়তে থাকে।মুখ গুঁজে ঢুকে পড়ে বইয়ের মধ্যে। বাঁধন পলকহীন ভাবে ছুটির মতি গতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে খেয়াল করে।
পরিক্ষা গুলো হচ্ছে মোটামুটি। ছুটিতো তাই বলে। কিন্তু বাঁধনের মনে খচ খচ করে। কমন পড়া প্রশ্ন গুলো আদৌ ভালোভাবে লিখেছে তো? নাকি দুই চার লাইন লিখেই খাতা জমা দিয়ে দিয়েছে? বাঁধন এখন আফসোস করে। কেনো একে আগে থেকেই পড়ালো না? বাড়ির সাথে বাড়ি। পড়ানোতে কোন অসুবিধা ই ছিলো না।ছুটি যে ত্যাগদার ত্যাগদা ! একে এতো দিন না পড়িয়ে অন্যায় হয়েছে বাঁধনের। বাইরে হাজারটা টিচার রাখুক। যেই ছুটি সেই থাকবে। একে পাস করাতে পারবেনা। নিজের বাবাই ম্যাথ পড়িয়ে পাশ করাতে পারলো না! আর তো বাইরের শিক্ষক। বাঁধন আলতো হেসে জিজ্ঞেস করে,
— ছুটি! আমি যে তোকে এতো কষ্ট করে পড়াচ্ছি। আমাকে কি তোর বাবা স্যালারি দিবে না? ঠকাস না বুঝছিস? খুব খাটুনি যাচ্ছে আমার।
ছুটি হা করে বাঁধনের দিকে তাকিয়ে থাকে। যেই না পড়াচ্ছে তাতেই টাকা চেয়ে বসেছে। এতো ভালো কথা নয়। ছুটি পড়বেই না আর। এক টাকাও দেবে না। বই খাতা নিয়ে সুরসুর করে বেরিয়ে যাচ্ছে। বাঁধন ডেকে উঠে,
— এই! কোথায় যাচ্ছিস? পড়বিনা
— এই ছুটি কখনো টাকা দিয়ে পড়ে না। কি আমার সাবজেক্ট ছিলো! সব তো বাবাই পড়াতো। আমি এক টাকাও দিতাম না। আজ বাবা নেই বলে তুমি পড়াচ্ছো। টাকাও চেয়ে বসেছো। সুযোগে স্বদ্যবহার!
— কিপ্টা কথাকার!
— কিপ্টা বলবেনা। আমার দয়ার শরীর।
— তাহলে কে কিপ্টা? তোর বাবা?
— কখনোই না। আমার বাবা আমার থেকে দয়ালু। চাওয়ার মতো চাইলে কবেই আমাকে দিয়ে দিতো!
— তোকে নিয়ে আমি কি করবো?
— কাজ করাতে। এই তোমার সকল ধরনের কাজ। ঘর সামলানো, কাপড় কাঁচা, আইরণ করা, খাবার দাবার এগিয়ে দেওয়া, মাঝে মাঝে অফিসের প্রোজেক্টে হেল্প করা… সবই ।
— তোকে এসব কেনো করতে হবে?
— কাউকে না কাউকে তো করতেই হবে। আমি ছাড়া কে এতো বড় মনের হবে?
— এগুলো আমার বউয়ের কাজ। তোর না।
মুখটা থমথমে হয়ে যায় ছুটির। বউ ? সুমি?সে কি আর এসব কাজ করতে পারবে? আহারে! বেচারী, কতশত আনন্দ উল্লাসের মাঝ দিয়ে সংসারে পা রাখতে চেয়েছিলো,শেষমেষ তীরে এসে তরী ঢুবলো। সুমির জন্য মন খারাপ করলো ছুটির। বাঁধনের কাছে আবদার করে বসলো।
— শুক্রবারে নিয়ে যাবে আমাকে সুমি আপুর কাছে?
বাঁধন খোশ মেজাজেই ছিলো। সুমির কথা বলতেই তার হাসিতে যেনো তার টেনে গেলো। কিছু বললো না।নিশ্চুপ রইলো। ছুটি নিস্পলক তাকিয়ে রইলো। শুকনো মুখটার কারণ খুঁজতে লাগলো।
— সুমি আপুর অবস্থা কি আরো খারাপ?
— নাহ। বেটার। ঠিক হয়ে উঠবে আস্তে আস্তে।
— পুরোটাই?
বাঁধন শুকনো হাসলো।‌ ছুটিকে চলে যেতে বললো। বারান্দায় গিয়ে বসে উদাস হয়ে তাকিয়ে রইলো।

শুক্রবারে ছুটি বাঁধন কে অনেক রিকোয়েস্ট করলো। বাঁধন কানে তুললো না। ছুটিকে সুন্দর করে এড়িয়ে গেলো। ছুটি গেলো ঝিমার কাছে। ঝিমাকে জিজ্ঞেস করলে ঝিমা কোনো উত্তর দিতে পারলো না। পরিক্ষার জন্য সে সংসারের কোন কথাই কানে তুলে না। উল্টো ধমকে বসলো ছুটিকে।
— ভাইয়ার ব্যাপারে নাক গলানো বাদ দিয়ে একটু লেখা পড়া নিয়ে ভাব। ভালো একটা কলেজে উঠলে দেখবি ভাইয়ার মতো কতোজন তোর পিছু পিছু ঘুরছে! চুজ করতে না পারলে আমাকে বলিস। ট্রাস্ট করতে না পারলে দুলাভাই তো আছেই।ছেলেরা আবার ছেলেদের চেনে বেশী।
ঝিমার ধমক খেয়ে ছুটি গাল ফুলালো। পরমূহুর্তেই মনে পড়লো সুমির অবস্থা বেটার। আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যাবে। তাহলে কিসের আশায় বাঁধনের পেছনে পড়ে থাকবে? নিজের ভাবনায় নিজেই একটু অবাক হলো। সেকি আশায় ছিলো? কী ছেলেমানুষী! বাঁধনের জীবনে যদি দ্বিতীয় কোন নারী পদার্পন করে তাহলে তিনি লেখা পড়া শেষ অথবা কোন চাকুরীজিবী। নিশ্চয় তার বয়স হবে আটাশ কি উনত্রিশ। ছুটির মতো ষোড়শী নয়। ছুটি বাস্তবতা বোঝে। লাফ দিয়ে কখনো গাছে উঠা যায়না যদিনা গাছ নিজেই নুয়ে পড়ে। সুমি কতটুকু সুস্থ হয়েছে? কথা বলতে পারে? দেখলে চিনবে ছুটিকে?
শুক্রবার আসতে না আসতেই ছুটি চেপে ধরলো বাঁধন কে। সুমিকে দেখতে যাবে। বাঁধন বললো,
পরিক্ষা শেষ হোক তারপর নিয়ে যাবো। ছুটি মানলো না। জেদ ধরলো। বাঁধন কে মানাতে না পেরে ছুটলো বীণার ঘরের দিকে। বাঁধন পিছু ডাকলো,
— কোথায় যাস?
— কাকীর ঘরে বিচার দিতে।
— এই না না..দারা ছুটি দারা। মাকে কিছু বলিস না।
ছুটি শুনলো না। বাঁধন ও ছুটলো ছুটির পিছু পিছু। আটকাতে হবে ছুটিকে। বীণার ঘরের সামনে যাবার আগেই পেছন থেকে চেপে ধরলো ছুটিকে। পেটের উপরে হাতের বাঁধন শক্ত করে তুলে ধরলো ফ্লোর থেকে। ছুটি হাত পা ছুড়লো।
— আআআ নামাও।নামাও না আমাকে।
— চল এখান থেকে।
— নামাও না আগে।
— হ্যা তোকে নামাই আর তুই আবার ছুটা দে।
ভেতর থেকে বীণার গলার আওয়াজ এলো।
— কি হয়েছে রে?
— কিছুনা মা। এমনি।
জবাব দিয়েই ছুটিকে সেভাবেই তুলে ফের নিয়ে আসে নিজের রুমে। ছেড়ে দিতেই ছুটি পেটে হাত বুলাতে থাকে। বাঁধন জিজ্ঞেস করে,
— লাগলো?
— এভাবে বুঝি কেউ ধরে?
— সরি রে। মাকে বলতে গিয়েছিলিস কেনো?
— না বললে কি নিয়ে যাবে?
— মাকে কিছু বলিস না। কাউকেই কিছু বলিস না।
— কেনো?
— সবাই জানে সুমির সাথে আমার কোন যোগাযোগ ই হচ্ছে না। ডিভোর্সের জন্য কোর্টে মামলা দায়ের করা হয়ে গেছে। এখন যদি জানতে পারে আমি এখনো সুমির কাছে যাই তাহলে আবার অশান্তি শুরু হবে।
বাঁধনের কথা শুনে ছুটি অবাক হয়। এরা সত্যি সত্যি ডিভোর্স টা দিইয়ে ছাড়বে? একটা অসুস্থ মানুষ সে এসে তো ঘরে বসে খাচ্ছে না। কিসের এতো তাড়া এদের? বাঁধন ভাই কে কি আবার বিয়ে করাবে? সেজন্য ই এতো তাড়া? বুকটা ধক করে উঠে ছুটির। আবার! আবার! সেই পুরোনো ক্ষত নতুন হয়ে পীড়া দেবার যন্ত্রনা! বাঁধন ছুটির খোলা মুখটা দেখে এগিয়ে আসে। ছুটির পাশে বসে বলে,
— তোকে যে বললাম এটা আবার ঝিমার সাথে বলতে যাস না। সুমির এক্সিডেন্ট টা হবার পর থেকে কেউ চায়না আমি সুমির জন্য অপেক্ষা করি। সুমির বাবা মাও ও এখন চায়না আমি আর সুমির সাথে সম্পর্ক রাখি। সুমির নামটা এ বাড়িতে তুলাই যায়না। সবাই বিরোধীতা করে। সবার অলক্ষ্যে আমি বাধ্য হয়েই এখন সুমির সাথে যোগাযোগ রাখি। গোপনে তাকে দেখতে যাই। তার চিকিৎসার জন্য সমস্ত টাকা দিই। আমার যতটুকু দায়িত্ব আমি পালন করার চেষ্টা করি। সুমি এখনো আমার স্ত্রী। পরিবারের জন্য সমাজের জন্য আমি আমার দায়িত্ব থেকে তো আর পিছপা হতে পারিনা। এরজন্য তো একদিন না একদিন আমাকে হিসাব ঠিকই দিতে হবে। তখন কোন এক্সকিউজ সৃষ্টিকর্তা মেনে নিবে না। কারণ আমার কাছে বিকল্প হিসেবে সুযোগ ঠিকই আছে। সবাই যখন আমার বিপরীতে তখন তুই একমাত্র আমাকে সাপোর্ট করেছিস। তোর ছোট্ট মাথা কি ভেবে সাপোর্ট দিয়েছিলো আমি জানিনা। কিন্তু আমি চাইতাম এতো বড় একটা ট্রেস যাবার পর আবার যেনো সুমি ছাড়াছাড়ির কথা শুনে অসুস্থ না হয়ে পড়ে। মামলা দায়ের করার পরেও আমি সময় নিচ্ছিলাম সুমিকে জানানোর। কিন্তু তার আগেই সুমির পরিবার ই সুমিকে জানিয়ে দিয়েছে। সুমি এখন টুকটাক কথা বলতে পারে। প্রথমে ও চাইতো আমার সাথে কথা বলতে। কিন্তু যখন কথা বলতে পারলো তখন আমি হাজার চাইলেও আমার সাথে কথা বলেনা। আমি যতক্ষন ওর সামনে থাকি ততক্ষন চুপচাপ হয়ে থাকে। মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখে। চোখের জলে নাকের জলে একাকার করে দেয়। আমি বুঝতে পারি তার ভিতরে একটা চাপা অভিমান কাজ করে। কিন্তু আমিযে নিরুপায়! ডিভোর্স টা এবার হবেই।
— তুমি কি আবার বিয়ে করবে বাঁধন ভাই?
প্রশ্ন শুনা মাত্রই তাকায় বাঁধন।ছুটির উৎসুক চাহনী। ছলছল করছে চোখ দুটো। শক্ত মনের ছুটি সুমি বাঁধনের পরিস্থিতির কথা শুনে কাঁদতে পারে না। এ কান্না অন্য কোনো কারণ বহন করে। যা বাঁধনের আন্দাজে কিছুটা হলেও জানা। কিন্তু বাঁধন চায়না এই আন্দাজটুকু সঠিক হোক। তার জন্য ছুটির সাথে মিশতে হবে। সময় দিতে হবে। দূরে সরিয়ে রাখলে মনে যদি কিছু থেকে থাকে তা মনেই থাকবে প্রকাশ পাবেনা। প্রকাশ না পেলে বুঝানো যাবেনা। না বোঝাতে পারলে ভূল পথ থেকে ফিরিয়ে আনা যাবেনা। হিতের বিপরীত ও হতে পারে।

ছুটিকে নিয়ে বিকালে বেরোলো বাঁধন। মাকে বললো রিতীর সাথে দেখা করাতে নিয়ে যাচ্ছে। ঝিমা ছুটির সাথে যাবার আগ্ৰহ দেখালোনা। এ প্লাস কোনভাবেই মিস করা যাবেনা। ছুটিরা বেরোতেই টেবিলে বই নিয়ে বসে পড়লো। ঘড়িতে চারটা বিশ। বাইকে যেতে সময় লেগেছে মাত্র চৌত্রিশ মিনিট। সুমির কেবিনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বাঁধন। ছুটিকে ইশারায় ভেতরে যেতে বললো।ছুটি বাঁধন কে ছাড়া যাচ্ছেনা দেখে বাঁধন বললো,
— যা।
— তুমি যাবেনা?
— যাচ্ছি।
ছুটি আগে ঢুকলো বাঁধন তার পিছু পিছু। সুমি শুয়ে আছে মরার মতো। চোখ দুটো বন্ধ। ছুটি গিয়ে পাশে দাঁড়ালো। ফিসফিসিয়ে বললো,
— ঘুমিয়ে আছে মনে হয়।
তখনি সুমি চোখ মেললো। প্রথমেই দেখতে পেলো ছুটিকে। তার পাশেই বাঁধনকে। বাঁধনকে সুমি পুরোপুরি ইগনোর করলো। ছুটিকে দেখেই চিনতে পেরেছে। আলতো সুরে ডাকলো।
— ছুটি!
— হ্যা। সুমি আপু। ভালো আছো?
সুমি উত্তর দিলোনা। নড়েচড়ে উঠলো। ছুটি খেয়াল করলো সুমি অনেকটাই সেরে উঠেছে। নড়তে পারছে কথাও বলতে পারছে। চেহারাও অনেক টা সুস্থ লাগছে। মুখ বলেই উঠলো,
— সুমি আপু! তুমি তো প্রায় সুস্থ ই হয়ে গেছো। বাসায় যাচ্ছো না কেনো? এতো দিন থেকে এক হসপিটালে পড়ে আছো। তোমার কষ্ট হচ্ছে না? মন টিকে এখানে? ট্রিটমেন্ট তো বাড়িতে গিয়েও নেয়া যায়। আমার মনে হয় একা একা না থেকে পরিবারের সাথে থাকলেই তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে।
সুমি আগ্ৰহ দেখালোনা। ইশারা করলো।
— ছুটি বসো। কেমন আছো? আমাকে দেখতে ভালো লাগলো।
— আমি ভালো। তুমি তো ভালোই সুস্থ। বাড়ির লোক আসে দেখতে তোমায় নিয়মিত?
–হ্যা।আমি ভালোই আছি এখন।
— বাসায় থেকে ট্রিটমেন্ট করছোনা কেনো? মাইন্ড ডেবেলপ হবে তোমার বাসায় থাকলে। তোমাকে হসপিটালে দেখে সত্যিই ভালো লাগছেনা। বাঁধন ভাই ব্যবস্থা করে দিবে।
— উনাকে বলে দিবে আমার জন্য যেনো আর টাকা খরচ না করে। আমি ভালো হয়ে গেছি। এখন আর মাসে মাসে বিল পে করতে হবেনা।
কথাটা সুমি আড়চোখে বাঁধনের দিকে তাকায়েই বললো। বাঁধন উত্তর করলো না। ছুটি ব্যাপারটা বুঝলো। সেও সে সম্পর্কে কিছু বললোনা। ছুটিকে ভেতরে রেখেই বাঁধন বেরিয়ে এলো। ছুটি সুমির পাশে বসে জিজ্ঞেস করলো,
— বাঁধন ভাইয়ের উপর অভিমান করেছো? অভিমান করোনা। রাগ ও করোনা। বাঁধন ভাই ভালোমানুষ। ভালো মানুষদের উপর মনক্ষুণ্ণ হতে নেই। উনি তোমার ভালো চান। তুমি তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে।
— আমি ঠিক হলেও যা। না হলেও তা। তোমার বাঁধন ভাইয়ের সাথে আমার কখনোই আর একসাথে থাকা হবেনা। আঠারো দিন পরে ডিভোর্সের কেসটা ডিশমিশ হবে কোর্টে। এবার হবেই হবে। তোমার বাঁধন ভাইকে বলে দিবে আমার উপর মানবতার দৃষ্টান্ত যেনো আর না স্থাপন করে। আমি এডাল্ট। নিজের টা নিজে ভালোই বুঝি। সামলানোর ক্ষমতা রাখি।
— কোই রাখো? ঝাঁঝ তো ঠিকই দেখাচ্ছো।
— না দেখতে চাইলে চলে যাও। এখানে থেকো না।
— সুমি আপু! এখনো ডিভোর্স হয়নি। তোমরা তো পছন্দ করে বিয়েটা করেছিলে। এতো তাড়াতাড়ি হাল ছেড়ে দিলে?
— তো কি করবো?জেগে জেগে সপ্ন দেখবো? এই পা ছাড়া হয়ে?
কাঁপা হাতে কোমড়ের উপর অব্দি দেওয়া কাথা সরিয়ে দেয় সুমি। ছুটির একবার চোখ পড়তেই সাথে সাথে সরিয়ে নেয়। দ্বিতীয় বার ভুল করেও তাকায় না। সুমির মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে। তির তির করে ঠোঁট দুটো কেঁপে কেঁপে উঠছে। কতটুকু কষ্ট করেই না কান্না লুকিয়ে রাখতে চাইছে। ছুটি মুখ ঘুরিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

একটু আগে মাগরিবের আজান দিয়েছে। মুসুল্লিরা মসজিদে যাচ্ছে। বাঁধন ছুটিকে একটা চায়ের দোকানে এনে বসিয়ে দেয়। দোকানের ভেতরে গিয়ে মিনিটের মধ্যেই আবার ফিরে আসে। হাতে দুটো চিপস ধরিয়ে দিয়ে বলে,
— এখানে বস। কোথাও যাবিনা। আমি নামাজটা পড়ে আসছি।
বাঁধন চলে গেলে ছুটি আনমনে চিপস মুখে পুড়তে থাকে। এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে জনজীবন আয়ত্ত্ব করতে থাকে। মানুষ ছুটছে। এদিক থেকে ওদিকে। কেউ বসে নেই।
— মা! কয়ডা টাহা দেন।
সাইডে তাকাতেই দেখে একটা লোক হাত পেতে আছে ছুটির সামনে। লোকটার দুটো পা নেই। উরুর নিচে চাকা লাগানো হয়েছে। সেই চাকায় এদিক ওদিক ঘুরে ভিক্ষা বৃত্তি করে। সুমি আপুর ও পা নেই। তাকে যদি কখনো তার পরিবার বোঝা মনে করে ছেড়ে দেয় সেও কি এভাবেই জীবনধারণ করবে? ভাবতেই গা শিউরে উঠে ছুটির। এইযে হাতের লোমগুলো বড় বড় হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে।

চলবে,
লাবিবা তানহা এলিজা