বিস্বাদপূর্ণ জীবনে তুমি পর্ব-১০

0
507

#বিস্বাদপূর্ণ জীবনে তুমি
#পর্বঃ১০
#শুভ্রতা_শুভ্রা

রিয়া অনেক বার শাশুড়ির কাছে রেহানের কথা জিঙ্গাসা করতে গিয়েও ফিরে এসেছে। ওর কেমন যেন অস্থির অস্থির লাগছে। বারান্দায় একবার আসছে আর একবার রুমে যাচ্ছে। ফোন হাতে নিলো বারান্দায় বসে পরলো ধপ করে। কিছু ভালো লাগছে না তার। সে ফেসবুকে ডুকে নিউজফিড ঘুরতে লাগলো। হঠাৎ একটা লাইভে তার চোখ আটকে গেলো। একটা ছেলে গিটার হাতে গান গাইছে। ছেলেটার মুখ হাইড করা। ছেলেটার গান শুনে আবেশে চোখ বুজে নিলো রিয়া। গানটা কেন যেন মন ছুয়ে গেলো তার। অন‍্য আরেকটি ছেলের কন্ঠ শুনে ও চোখ খুলে ফেলল। তার কথা মতো গান গাওয়া ছেলেটির নাম স্পর্শ।

হঠাৎ সে খেয়াল করলো রেহান বাইকে করে বাড়ির মেইন দরজা দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করছে। রিয়া আর বসে না থেকে দৌড়ে গেল। সে রেহানের সামনে গিয়ে দাড়াল। কিন্তু রেহান ওকে দেখেও না দেখার ভাব করে ওর পাশ কাটিয়ে চলে গেল।

ও কয়েকবার ডাকলেও রেহান তাকে পাত্তা দিলো না। রেহানের এমন ব‍্যবহারে রিয়ার অনেক খারাপ লাগলো। সে মুখ নিচু করে রুমে যেতে নিবে তখন রেহানের মাকে দেখে থেমে গেলো। মুখে জোর করে একটা হাসি টেনে বলল

“কিছু কি বলবেন মামুনি”

রেহানের মা রিয়ার কাধে হাত রেখে মায়া ভরা কন্ঠে বলতে লাগল

“মন খারাপ করেছো রেহানের ব‍্যবহারে। করো না। সকালের আগেই দেখো ঠিক হয়ে যাবে। ও বেশিক্ষণ এমন করে থাকতে পারে না। তুমি যাও ঘুমিয়ে পড়ো মামুনি আর তোমাদের মধ্যে যা নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে তা মিটিয়ে নেও। আমার ছেলেটা যে তোমাকে বড্ড ভালোবেসে ফেলেছে। ওকে তুমি একা করে রেখে যেও না কখনো। তাহলে হয় তো ওকে আর বাঁচানো যাবেনা। হৃদমী ওকে ছেড়ে যাওয়ার পর অনেক কষ্টে ছেলেটিকে স্বাভাবিক করেছি।” বলেই কিছুটা ফুপিয়ে উঠলেন রেহানের মা।

রিয়া রেহানের মায়ের হাতটা ধরে বলতে লাগল “আমি তোমাকে প্রমিস করছি মামুনি আমি কখনো ওনাকে ছেড়ে যাবো না। আর আমি ওনার সঙ্গে সব কিছু ঠিক করে নিবো।”

রেহানের মা রেহানকে খাবার দিতে চাইলে রিয়া নিজের হাতে রেহানকে খেতে দিবে বলে। রেহানের মাও হাসিমুখে চলে গেলো।

রিয়া গুটিগুটি পায়ে রেহানের বন্ধ দরজার কাছে এগিয়ে যায়। কয়েকবার ডাকলেও রেহান দরজা খুলে না। রিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলতে লাগল

“আপনি যদি এখন দরজা না খুলেন তাহলে আমি ছুরি দিয়ে হাত কেটে ফেলবো বলে দিলাম। আমি তিন পযর্ন্ত বলার আগে যদি আপনি দরজা” বলার আগেই রেহান দরজা খুলে দিলো। রিয়া রুমে ঢুকে দেখলো রেহান মাথা নিচু করে সোফায় বসে আছে। রিয়া রেহানকে খাওয়ার কথা বললেও রেহান না করে দেয়।

রিয়া রুম থেকে বেরিয়ে যায়। কিছুক্ষণ পর রিয়া খাবার নিয়ে রেহানের কাছে এসে বসে। রেহান একবার রিয়ার দিকে তাকিয়ে আবার মেঝের দিকে চোখ রেখে বলল

“খাবো না নিয়ে যাও এখান থেকে এগুলো।”

রিয়া টিটেবিলে খাবারের প্লেটটা রেখে রেহানকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বলল

“খেয়ে নেন তাছাড়া আমি কিন্তু আমি কিন্তু”

রেহান প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে রিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল “কি”

রিয়া বলল “নিজেকে শেষ করে দিবো।” রেহান আবার মাথা নিচু করে রইল। রিয়া খাবার নিয়ে রেহানের মুখে ধরে রেহান ও বাধ‍্য ছেলের মতো খাবার খেতে লাগল। রিয়া সুন্দর করে রেহানকে খাইয়ে দিতে লাগল। খাওয়া প্রায় শেষের দিকে তখন রিয়া বলল

“আমি আপনাকে আজকে কিছু কথা বলবো। জানিনা এগুলো শোনার পর আপনার কেমন লাগতে পারে তবে আমাকে এগুলো বলতেই হবে আপনাকে।”

রেহান প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালো রিয়ার দিকে। রিয়া একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্লেট নিয়ে উঠতে উঠতে বলল

“আপনি রুমের বারান্দায় গিয়ে বসুন আমি কফি নিয়ে আসছি।” বলেই চলে গেলো রিয়া।

রিয়া কিছুক্ষণ পর দুই হাতে দুটো কফির মগ নিয়ে হাজির হলো বারান্দায়। রিয়া দেখলো রেহান আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। রিয়া মৃদু কন্ঠে রেহানকে ডাক দিতেই রেহান আকাশের দিক থেকে চোখ সরিয়ে রিয়ার রাখলো। রিয়া একটা মলিন হাসি দিয়ে রেহানের পাশে গিয়ে বসলো। রেহানের দিকে কপির মগ এগিয়ে দিলো সে। একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বলতে লাগলো।

—————————

আমি তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। একদিন স্কুল থেকে আসার সময় প্রচণ্ড বর্ষণ শুরু হয়। বর্ষণ দেখে আমার চোখমুখ চকচক করে উঠে। কারণ আম্মু কখনই আমাকে বৃষ্টিতে ভিজতে দিতো না। একটু বৃষ্টিতেই আমার জ্বর আসে তাই। ওইদিন আমার খুব আনন্দ হয়। রাস্তা দিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে বাসায় আসছিলাম। পথের মাঝে পথিক বাচ্চাদের সঙ্গে অনেক আনন্দ করি। আমি তখন ভুলেই গিয়েছিলাম যে আমি বড় হয়েছি। পুরো ড্রেস কাদায় মাখামাখি করে ফেলি। লাফালাফি করতে করতে কাদায় পরে যাই। ওখানে কান্না করা বাদ দিয়ে খিলখিল করতে হাসতে থাকি। হঠাৎ একটা বলিষ্ট হাতের থাপ্পড় পরে আমার গালে। থাপ্পড়টা এতো জোরে লেগেছিলো যে আমার চোখ বেয়ে নোনা জল পরতে থাকে। আমি মাথা উচু করে সেই ব‍্যক্তির দিকে তাকায়। তখনই আমার চোখ আটকে যায় ছেলেটির উপর। সাদা শার্ট বৃষ্টির পানি দিয়ে শরীরের সঙ্গে লেগে আছে একদম। চুল বেয়ে টুপটুপ করে পানি পরছে। চোখের পাঁপড়িগুলো সুদীর্ঘ একদম মেয়েদের মতো। ঠোঁটগুলো যেন চকলেটের মতো লাগছিল আমার।

ছেলেটির কর্কশ কন্ঠে আমার ভাবনায় ছেদ ঘটে। ছেলেটি কটমট কন্ঠে বলতে থাকে

“এই মেয়ে এতো বড় হয়েছো এখনো আক্কেল হয়নি তোমার। তুমি কি ছোট বাচ্চা। এমন করে ছোট বাচ্চাদের মতো ভিজতেছো। একবার নিজের দিকে খেয়াল করেছো।”

ছেলেটির কথা আমি নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার গায়ের জামাটা লেপটে আছে আমার শরীরের সঙ্গে। এমন অবস্থা দেখে আমি অনেক লজ্জায় পরে যাই। ছেলেটি তার হাতে থাকা কোর্টটি আমার হাতে দিয়ে পরে নিতে বলে। আমিও বাধ‍্য মেয়ের মতো গায়ে জরিয়ে নেই। এইদিন ছেলেটি তার গাড়ি করে আমার কাছ থেকে বাড়ির ঠিকানা নিয়ে আমাকে বাড়ি রেখে যায়। বাসায় আসার পর আমার খুব জ্বর আসে। প্রচণ্ড জ্বর আসে। দীর্ঘ তিনদিন আমি স্কুল যেতে পারিনি। কোর্টটা আমার কাছেই রয়ে গিয়েছিল। আমি ওটা আমার কাছ ছাড়া করতাম না এক মুহুর্তের জন‍্যেও।

প্রায় দুইদিন পর আমি ছেলেটিকে আবার দেখতে পাই। বাসার বারান্দা দিয়ে দেখতে পাই তাকে। আমি পলকহীনভাবে তাকিয়ে ছিলাম তার দিকে। হঠাৎ ছোট বোন হিয়ার কন্ঠ শুনে আমি চমকে উঠি। ওর দিকে তাকাতেই ও শয়তানী হাসি দিয়ে বলল

“আপুই এটা তিয়াস ভাই পাশের বিল্ডিংএ নতুন এসেছেন। ভাইয়াটা অনেক ভালো জানিস।”

আমি শুনছিলাম হিয়ার কথা আর দৃষ্টি ছিলো তিয়াসের দিকে। আমার ক্রাশটা কি সুন্দর খেলছে বাচ্চাদের সাথে। কি সুন্দর হাসি। হঠাৎ করেই ওনি উপরে তাকাতেই আমি ঘাবড়ে যাই। ওনি আমাদের দিকে তাকিয়ে বলে

“ওই পিচ্চি কি অবস্থা?”

আমি মুচকি হাসি দিয়ে বলি “ভালো আপনার” ওনিও মুচকি হাসি দিয়ে বললেন “ভালো”

এরপর থেকেই একটু একটু করে কথা শুরু হয় আমার সঙ্গে ওনার। আমি দিন দিন পছন্দের সঙ্গে সঙ্গে ভালোবেসে ফেলি। ওনিও হয় তো পছন্দ করতেন আমাকে। আমাদের দুইজনকে সবসময় একসঙ্গে দেখা যেতো। আমি ছোট ছিলাম তাই তখন ওনি আমার থেকে দূরে চলে যায়। ওনার ধারনা ছিলো ওনি এখানে থাকলে আমার পড়াশোনার ক্ষতি হবে। ওনি ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে শিফট করেন। ওখান থেকে আমার সঙ্গে হালকা যোগাযোগ রাখতেন। আমি এসএসসি এর পরীক্ষাটা ভালোমতো দিয়ে ফেলি। এরপর ইন্টারে উঠার পর আমি প্রায় পাগল হয়ে গেছিলাম তিয়াসের জন‍্য। ওনিও আমার আঠারো তম জন্মদিনে ভালোবাসি কথাটা বলেন। তারপরে ওইদিনই ওনি আমার বাবা মাকে রাজি করায় আমাকে বিয়ে করার জন‍্য। ওনি ওনার বাবা মাকে ও রাজি করায়। কিন্তু তিয়াসের মা আমাকে একটুও পছন্দ করতো না। কেন করতেন না জানিনা। তবে তিয়াসের জেদের কাছে হার মেনে ওনিও রাজি হয়ে যান।

সবকিছু ভালো চলছিলো। আমার খুব আনন্দ লাগছিলো। আমি আমার ভালোবাসাকে পাচ্ছি। কিন্তু ওই তো বলে না সবকিছু এতো সহজে পাওয়া যায় না। ভালোবাসা এতো সহজে পূর্ণতা পায় না।

বিয়ের দিনে ঘটে সব বিপত্তি আমার মামাতো ভাই নূর ভাইয়া আমাকে পছন্দ করতেন। ওনি যে আমার সঙ্গে এমন করবেন আমি কল্পনা অতীত ছিলো। বিয়ের সাজ সাজিয়ে সবাই আমাকে ঘরে রেখে চলে যায়। আমি আয়নার সামনে দাড়িয়ে নিজেকে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দেখছিলাম। নিজে নিজেই হাসছিলাম।

#চলবে