বৃষ্টির রাতে পর্ব-৪+৫

0
321

#বৃষ্টির_রাতে
#রূবাইবা_মেহউইশ
(৪)

সপ্তাহ খানেক এর ছুটিতে এসে এখন মনে হচ্ছে দুদিনই বেশি হয়ে গেছে। আসারও যে খুব একটা ইচ্ছে ছিলো তেমন নয়। শুধু বাবার বকাবকিতে আসতে হলো। বাবাকে কেউ একজন খুব পরামর্শ দিচ্ছে কিছু জমিজমা বিক্রি করে মাইশার নামে ব্যাংকে টাকা-পয়সা জমা রাখতে। এমনিতেও নগদ অর্থের চেয়ে জমিজিরাতের দিক থেকে তাসিনরা এলাকায় খুব বড়লোক৷ দাদার ভাগের সকল সম্পত্তি তার বাবা আর ফুপুর মধ্যে ভাগাভাগি আরো আগেই হয়ে গেছে। দাদীর বাপের বাড়ি থেকেও প্রচুর সম্পত্তির অংশ হাতে এসেছে। এই নিয়েই আফছার মীরের নাভিশ্বাস উঠে গেছে। আজ ধানি জমি, কাল নানার বাড়ির সবজি ক্ষেত, পরশু মাছ চাষের পুকুর এতসবে নজর দিতে গিয়ে নিজের সুতার ব্যবসাটায় হেলাফেলা হয়ে যাচ্ছে খুব৷ লোকের ওপর ছেড়ে দিলে লাভের চেয়ে লসের পরিমাণটাই গুণতে হবে এই ভেবে ছেলেকে খবর দিয়েছেন কিছু জমিই বিক্রি করবেন৷ কিন্তু তাসিন আর তার মায়ের এক কথা মাইশার জন্য টাকা ব্যাংকে রাখার জন্য জমি বিক্রি এটা কোন সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। বরং জমিগুলো বর্গা দিতে পারে কৃষকদের কাছে। এতে তাদেরও লাভ হলো সাথে একজন জমিহীন কৃষকেরও। প্রয়োজনের সময় না হয় বিক্রি করা যাবে এমনিতেও দিন দিন জমির দাম আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে। বাবাকে বুঝ মানানো গেলেও মা আবার বেঁকে বসেছে। এসেছে যখন তখন তাকে পুরো সময়টা থেকে তবেই যেতে হবে। কিন্তু আয়নার জন্য বাড়িতে টেকা মুশকিল। সকালেই হোটেল থেকে নাশতা সেরে বাড়ি এসেছিলো সে। গেইটে পা দিয়েই শুনতে পেল আয়নার গলা সেই সাথে চুড়ির রিনিঝিনি ছন্দ৷ মেজাজ বিগড়ে গেল তখনই আর সেই বিগড়া মেজাজে আগুন ঢালল আয়না নিজে তার ঘরে প্রবেশ করে। মাইশা স্কুলে ছিলো মা আর নুড়ি খালাও আচারের জন্য আম কাটছিলেন উঠোনে বসে। এই ফাঁকে আয়না এসে ঢুকলো তাসিনের ঘরে। তাসিনের ঠিক মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, চোখে চোখ রেখে পাগলামির পারদ কয়েক ডিগ্রি বাড়িয়ে সে ভালোবাসি কথাটা বলেই ফেলল। এতেও সমস্যা হতো না যদি না মেয়েটা দুঃসাহসিক আচরণ করতো৷ অনেকটা জোর করেই জড়িয়ে ধরেছিলো আয়না তাকে। একটা মেয়ে এতখানি পাগলামি কেন করবে কোন পুরুষের জন্য! আয়না দেখতে যথেষ্ট সুন্দরী তার জন্যই তো কত ছেলে পাগল হয়ে পথে পথে ঘুরবে তা না সে নিজেই পাগল হয়ে আছে। আয়নার আজকের কাজে রাগের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে তাসিনের। তবুও কি করে যেন নিজেকে সামলে ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিয়েছে সে আয়নাকে। অন্যান্য সময় যেমন রাগে এলোপাতাড়ি চড় থাপ্পড় মারার ইচ্ছে জাগে আজ আর তেমনটা হয়নি। রাগ নিয়ন্ত্রণ করতেই হয়তো তখন তৎক্ষনাৎ বাড়ি থেকে আবারও বেরিয়ে গিয়েছিলো। আর সেই থেকেই শুধু বলছে চট্টগ্রাম চলে যাবে মাকে না বলেই৷ ভর দুপুরে মস্তিষ্ক গলা গরমে সে অনেকটা সময় বসেছিলো পুকুরপাড়ে তাল গাছের গুঁড়িতে৷ গ্রামে এলে নেটওয়ার্ক কাজ করে না খুব একটা তাই সোশ্যাল সাইটগুলোতে ঢোকা হয়নি দু’দিন। পুকুরপাড়ে বসে থাকতে থাকতে মনে পড়লো এখানে নেট ভালো কাজ করে। ভরদুপুরে তেজালো রোদ আর আম বাগানে বয়ে যাওয়া ঝিরিঝিরি হাওয়া দেওয়াল টপকে যেন পুকুরের পানিতে আছড়ে পড়ছে। শান্ত জলের মাঝে হালকা হালকা পানির কম্পন দৃষ্টি শীতল করে । তাসিনের মনে হলো এই বৈশাখী দুপুরে বসে ফোন টেপা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই। তাই নেট চালু করে প্রথমে ঢু মারলো ইন্সট্রাগ্রামে৷ মিনিট দুয়েক থেকে বিরক্ত হলো সে তাই আবার মেসেঞ্জারে একটু নজর দিলো৷ নাহ, জরুরি কোন বার্তা নেই কারো কাছ থেকে তাই আবার ফেসবুকে ঢুকলো৷ এখানেও মন বসলো না তাই কিছুক্ষণ নিউজফিড স্ক্রল করে বেরিয়ে এলো ৷ মনে হলো গ্রামে এসে এই প্রযুক্তিতে ডুবে থাকার চেয়ে এক ধ্যানে জলপুকুরে তাকিয়ে থাকাও উত্তম। নেটটা অফ করতে গিয়ে হঠাৎ মনে পড়লো অহনার কথা। ঝটপট ফেসবুক সার্চে সে অহনা ইয়াসমিন লিখে সার্চ করলো। সারির ঠিক প্রথমেই ভেসে উঠলো অহনার মুখটা। প্রোফাইলে তার নিজেরই ছবি আর তা দেখতেই চিনে ফেলল তাসিন। অহনার আইডিটাকে কয়েক সেকেন্ডেই খুঁটিয়ে দেখে নিলো৷ পাবলিক প্রোফাইল, বায়োতে রিলেশন স্ট্যাটাস সেই সাথে টাইমলাইনে তার প্রেগন্যান্সির পোস্ট। মুচকি একটু হাসলো তাসিন তারপর বন্ধুদের ফোন করলো দয়াগঞ্জ স্কুলে যাবে৷ মুরাদ বলল ট্রিট দিলে সে যাবে, রিমন বলল সে ফ্রীই আছে আসছে শুধু সুমন কোন কাজে ব্যস্ত তাই সে আসবে না। মিনিট দশেকের মধ্যে দুই বন্ধু এসে হাজির পুকুরঘাটে। রিমন বলল, “বন্ধু তোর গাড়ি কই?”

“গাড়ি নিবো না দোস্ত, অটোতে করে যাবো।”

তাসিনের কথা শুনে রিমন মুখে বিরক্তিসূচক এক শব্দ করে বলল, “এটা কোন কথা! স্কুলের দিকে যাবো গাড়ি নিয়ে গেলে ভাব ভালো থাকতো না!”

মুরাদ পাশ থেকে রিমনের মাথায় ঠোকা মেরে বলল, “শালা, নিব্বা নিব্বা বয়স নাকি তোর যে ভাব নিয়া স্কুলের সামনে যেতে হবে? এই বয়সে কি হাই স্কুলের মেয়ে পটাবি?”

তাসিন বসা থেকে উঠে বলল, “ওর তো এখনো দাঁড়ি গোফই ঠিকঠাক দেখা যায় না৷ হাইস্কুলের মেয়েও ওরে দিয়া পটানো সম্ভব কিনা সন্দেহ আছে।”

দুই বন্ধুর মশকরা খুব লাগলো রিমনের। তার জন্য এলাকার মৌলভীর মেয়ে পাগল হয়ে আছে আর বন্ধুরা এমন মশকরা করছে! আঁতে লাগলো খুব। একবার ইচ্ছে হলো বলেই ফ্যালে সেই মেয়ের কথা পরে মনে হলো আপাতত থাক, আগে স্কুলের দিক থেকে চক্কর লাগিয়ে আসুক। বলা যায় না যদিই সেখানে একটা পছন্দ হয়ে যায়! তিনবন্ধু পুকুর পাড় ছেড়ে ক্ষেতের আইল ধরে এগিয়ে গেল বাজারের দিকে। বাজার থেকে অটোতে করে চলে যাবে দয়াগঞ্জ। স্কুলে আর কলেজে পড়ার বয়সে সেই স্কুলে তারা বন্ধুরা মাঠ আর ক্ষেত পেরিয়ে হেঁটেই যেত সেই এলাকায়। এখন তো কত গুলো বছরে পা মাড়ায়নি সে এলাকায়। কথাটা ভাবতেই মনে পড়লো কাল রাতেই তো সে ওই মেয়ের জন্য গেল।

“দেখ সুপ্রভা এখন যাস না। তোর মা আর ভাই রাগ করে আমাকে বকবে। রোদ কমলে পরে বের হোস আর নয়তো টিয়াকে বল আসতে৷”

“ভাবীই,, টিয়ার বিয়ে সামনের সপ্তাহে। ওকে কেউ বাড়ি থেকে বের হতে দিবে না তো। আর মাকে আমি বলেই যাবো তুমি অযথাই ভাবছো।” সুপ্রভা খুব করে ধরলো ভাবীকে এখন তাকে যেতে দিতে। এমন দুপুরে বাড়ি থেকে বের হওয়াটা কারোই পছন্দ নয় তাই মিরা বারণ করলো সুপ্রভাকে। মেয়েটা শুনলো না উল্টো মায়ের সাথে একটু তর্ক চালিয়েই বের হলো। এতে অবশ্য তার মা মিরার ওপর ঝাল মেটালো। সুপ্রভা বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা টিয়াদের বাড়ি গেল। খাবারের পাট চলছিলো টিয়াদের বাড়িতে তাই সুপ্রভাকেও টেনে জোর করে খেতে বসালো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও টিয়ার জন্য সে খাবার খেলো। খাওয়া শেষে তাড়া দিয়ে বলল, “তাড়াতাড়ি চল স্কুলের মাঠে যাবো।”

সুপ্রভার কথা শুনে অবাক হয়ে টিয়া একবার দেয়ালে ঘড়িটা দেখলো৷ কড়া রোদের মধ্যে এই দুপুর আড়াইটায় স্কুলের মাঠে যাওয়ার কথা শুনে তার মনে হলো প্রভা পাগল হয়ে গেছে।

“তোর কি ঢাকায় থেকে মাথা খারাপ হয়ে গেছে?” চোখ মুখ কুঁচকে বলল টিয়া।

“আরেহ কি বলিস এসব! মাথা খারাপ হবে কেন?”

“নইলে কি! সময় দেখ এখন সেখানে গিয়ে কি করবো?”

“টনিক খাবো।”

“এ্যা!”

“হ্যাঁ, আম চুরি করবো, স্কুলের সামনে যে মুড়িওয়ালা টনিক বেঁচে সেটা খাবো তারপর ফিরে আসবো।”

উচ্ছাসে বিগলিত সুপ্রভার কণ্ঠস্বর। ঢাকায় সে টনিক পায়, মুড়িওয়ালাও পায় কিন্তু এখানকার মত রোদমাখা স্কুল মাঠ আর স্কুলের পেছনের আম বাগানটা পায় না। কত আম যে সে টিফিনের ফাঁকে চুরি করেছে টিয়া আর অন্য বান্ধবীদের নিয়ে তা বলে শেষ করা যাবে না। একবার তো টিফিন পালিয়ে বৃষ্টিতে ভিজে আম চুরি করে নদীর পাড় বসে খেয়েছিলো। আর তারপরই বড়দা ভাইয়ের সেই ভারী থাপ্পড় একদম কান বন্ধ ছিলো তার দুদিন পর্যন্ত। টিয়াকে জোরজবরদস্তি রাজী করিয়েছে প্রভা তারা যাবে। অথচ বাড়িতে ভাবীকে সুন্দর মিথ্যে বলল টিয়ার বিয়ে বলে সে বাড়ি থেকে বের হয় না। দুই বান্ধবী হাটতে হাটতে চলে গেল স্কুলের সামনে। হঠাৎ করেই রোদ পড়ে গেল , আকাশটা ছাইরঙা হচ্ছে। টিয়া বলল আকাশ মেঘলা হয়ে আসছে যদি বৃষ্টি হয়!

সুপ্রভা হাসলো, “ধুর বোকা এখন কি আষাঢ়, শ্রাবণ মাস নাকি! হুটহাট বৃষ্টি নামে না এ মাসে।”

“ইশ তুই কি ঋতুর অবস্থা বুঝিস? বৈশাখ মাসেই হয় হুটহাট বৃষ্টি।” টিয়া বোঝানোর ভঙ্গিতে বলল। সুপ্রভাও মানতে নারাজ। না বলে কয়ে বৃষ্টি একমাত্র বর্ষাকালেই আসে। দুই বান্ধবী ঋতু চক্র নিয়ে তর্ক করতে করতে এলো ঝালমুড়িওয়ালার কাছে। লোকটা তার জিনিসপত্র গুছিয়ে তৈরি হচ্ছে চলে যাওয়ার জন্য।

“মামা ঝালমুড়ি দিয়েন তো দশ টাকার।” সুপ্রভা ঝালমুড়িওয়ালার উদ্দেশ্যে কথাটা বলল। লোকটা একবার তাদের দিকে তাকিয়ে বলল মুড়ির মশলাপাতি শেষ। যা ছিলো টিফিনের সময়ই শেষ হয়ে গেছে। শুধু মুড়ি রয়ে গেছে কিছু। সুপ্রভার মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। এত কষ্ট করে এটার জন্যই তো এদিকে আসা। তবুও ভাবলো মুড়ি নেই তো টনিক খাবে। টনিক চাইলে লোকটা জানালো টনিক সে বিক্রি করে না। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল এবার। আগে যে লোকটা ঝালমুড়ি বেচতো তার কাছে টনিক, মুড়ি এমনকি চানাচুর মাখাও পাওয়া যেত। কলেজে পড়ার সময়ও সে এখানে এসে খেয়ে যেতো প্রায়ই। কিন্তু শহরে ভর্তি হওয়ার পর থেকে আর সুযোগই হয়নি তেমন। আকাশে মেঘ ডেকে উঠলো দুবার। টিয়া তাড়া দিলো, “চল না প্রভা, সত্যিই বৃষ্টি হবে বলে মনে হচ্ছে।”

“হলে হোক ভিজতে ভিজতে বাড়ি যাবো।”

সুপ্রভা শুনলো না উল্টো টিয়াকে টেনে ধরে আম বাগানের দিকে এগোতে থাকলো। বাগানের সামনে আসতেই বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে লাগলো। টিয়া সত্যিই চাচ্ছে না বৃষ্টিতে ভিজতে। এমনিতেই জোর করে মা-বাবা তাকে বিয়ে দিচ্ছে। এখন যদি দেখে সে কোনভাবে অসুস্থ হয়েছে তো রক্ষা নেই। সবাই বলবে সে বিয়ে ভেস্তে দিতেই নিজেকে অসুস্থ করছে। বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পড়তেই সে বড় দেখে একটা আম গাছের তলায় দাঁড়িয়ে গেল। খেয়াল করেনি সে গাছের পেছন দিকটাতে আরো কেউ আছে। কানের মধ্যে এলো ফিসফিসানি আওয়াজ আর সিগারেট এর গন্ধ৷ সুপ্রভাই প্রথমে ধোঁয়া দেখলো সে চেঁচিয়ে বলল, “টিয়া, তোর পেছনে ধোঁয়া কেন?”

সুপ্রভার চিৎকার শেষ হতেই গাছের পেছন থেকে বেরিয়ে এলো তিনটি ছেলে। আমগাছটা খুব বেশিই মোটা হওয়ায় প্রথমে তারা খেয়াল করতে পারেনি৷ তিনজনের হাতেই সিগারেট আর তিনজনই যেন তাদের দেখে ভূত দেখার মত চমকে গেল। কিছুটা সময় লাগলো সুপ্রভার তারপরই সে আগের মতোই চেঁচানো সুরে বলল, “আপনি! আবারও আমাদের এলাকায়? সাহস তো কম না। দাঁড়ান আজকে আর সুযোগ মিস করবো না৷ একদম হাত পা ভেঙে প্যাকেট করে পাঠাবো আপনাকে।”

সুপ্রভার মুখের কথা শেষ হতেই রিমন আর মুরাদ তাকালো তাসিনের দিকে। কি হচ্ছে এসব বোঝার উপায় নেই তাসিনের মুখ দেখে। সে বিষ্ময়ে হা! কি বলছে এই মেয়ে কাল রাতেই তো কত বড় একটা উপকার করলো৷

“তোমার কি মাথা ঠিক আছে?” খুব স্বাভাবিক স্বরে বলল তাসিন। সুপ্রভা এতে আরো ফুঁসে উঠলো।

“তুমি করে বলা হচ্ছে ! অসভ্য লোক রাত বিরাতে মেয়েদের হাত ধরতে বলে। আবার বলে কিনা ধর্মের বোন ভেবে ধর পটল! ধরাচ্ছি আপনাকে হাত। এ্যাই টিয়া চল তো আজ জাম্বুকে ডেকে এই লোকের অস্থিমজ্জা ভেঙে দেই।”

কি থেকে কি হচ্ছে তাসিনের বন্ধুরা আর টিয়া কিছুই বুঝলো না। এরই মাঝে রিমন বলল, “এটা তো সকালের মেয়েটা না? ওই যে হোটেলে নাশতা করতে গেল!”

বৃষ্টি বাড়ছে ; টিয়া আর দাঁড়াতে চাচ্ছে না মোটেই কিন্তু সুপ্রভাও ঠ্যাডা সে আজ তাসিনকে মার খাইয়ে তবেই যাবে। কাল রাতে মা তাকে কত বকাবকি করলো তার মধ্যে এই লোকের প্রশংসাও ছিলো অনেক। কিন্তু আশেপাশে কাউকে চোখে পড়ছে না আর না তারা দু বান্ধবী মিলে পারবে এই তিন ছেলেকে শায়েস্তা করতে। অগ্যতা না মেরেই চলে যেতে হলো দু বান্ধবীর। তারা যেতেই দুই বন্ধু তাসিনকে জিজ্ঞেস করলো ঘটনা কি! তাসিনও একের পর এক বলল রাতের ঘটনা। সব শুনে বন্ধু দুজন হো হো করে হেসে উঠলো।

“তুই এমন কেন করলি?” তাসিনকে প্রশ্ন করলো মুরাদ।

“ধুর আমি ভাবছি এই মেয়ে বাড়িতে বিয়ে ঠিক করছে বলে পালিয়ে যাচ্ছিলো। তাছাড়া একে জোর করে নিয়ে কিছু করবো এমন মনমানসিকতা আমার অন্তত নাই। যা বাজখাই স্বভাবের মেয়ে! দেখলি না হুদ্দাই বকবক করে কিসব বলে গেল?”

ভাবান্তর নেই তাসিনের কথায়। সে বৃষ্টির ফোঁটায় সিক্ত হয়ে স্কুলের দিকে তাকিয়ে আছে। এভাবেই তো বৃষ্টিস্নাত এক বিকেলে প্রথম দেখেছিলো অহনাকে। ছাতা হাতে থাকতেও অহনা ভিজে বাড়ি ফিরছিলো আর তাসিন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটাকে দেখলো যতদূর দেখা গেল৷ মেয়েটার খোঁজ খবর নিয়ে জানলো এদিকে কোন আত্মীয়ের বাসায় থেকে পড়াশোনা করছে মেয়েটা৷ কৈশোরের সেই ভালোলাগা মনে হতেই আবার মনে পড়লো একটু আগে দেখা সুপ্রভাকে। কাল রাতে অন্ধকারে তেমন একটা চেহারা ভালো দেখেনি। কিন্তু আজ খেয়াল হলো মেয়েটার কথা বলার সময় ডান ঠোঁটের কোণাকুণি নিচে ছোট্ট একটা গর্ত স্পষ্ট হয়। অহনারও হুবহু এমনই একটা গর্ত হয়। এটা বোধহয় টোল নয় অন্যকোন কারণে এমন দেবে যায়। কিছুসময় পর বৃষ্টিবিলাস করতে করতে তিন বন্ধু হেঁটে বাড়ি ফিরলো। মুরাদের আর খাওয়া হলো না কিছুই বাইরে। একেবারে বাড়ি ফিরেই ভাত খেল সে আর মনে মনে গালি দিলো তাসিনকে। বলে তো নিয়ে গিয়েছিলো অনেক কিছু খাওয়াবে কিন্তু ফিরলো খালি পেটে। সেদিন বাড়ি ফিরে তাসিন মাকে রাজি করিয়ে পরের দিন ভোরেই আবার চট্টগ্রাম ফিরে গেল। চট্টগ্রামে গিয়ে দুদিন তার ব্যস্ততার মাঝেই কাটলো খুব৷ সপ্তাহের শেষ দিনে সে তার সদ্য পাওয়া চাকরিটায় কোন এক অকেশনাল ডিনারের দাওয়াত পেল। তাই বাড়িতে বড় মামীকে বলো গেল তার আজ ফিরতে দেরি হবে। যাওয়ার সময় আজ স্যুট, টাই, শো পরে খুব পরিপাটি হয়ে বের হলো৷ খুব নামী এক হোটেলে অফিশিয়াল এই ডিনার হওয়ায় তাসিনের মুডটা খুব ভালো ছিলো। মনে মনে বলল, “বহুদিন পর সুযোগ মিলল কন্টিনেন্টাল ডিশ খাওয়ার। অফিসের বায়ার টায়ার সব উপস্থিত থাকবে তাই খাবারের আন্দাজটাও করা গেল দারুণ এবং প্রথমেই তার মনে হলো ইশ, মুরাদ থাকলে আজ খাবারে হামলে পড়তো একদম।” তার মনের কথা মনে উচ্চারিত হওয়ার আগেই ফোন বাজলো। হাতেই ছিলো ফোনটা সে চোখের সামনে ধরতেই দেখলো সুমন কল দিচ্ছে।

“হ্যা সুমন বল!” তাসিন কথাটা শেষ করার আগেই ওপাশ থেকে মুরাদ বলল, “তুই কোথায় এখন?”

অবাক হলেও তাসিন হোটেলের নাম বলল। এরপর আর কোন সাড়া পেলে না তাসিন। এদিকে রাত বাজে দশটা খাবার এখনো শুরু করা যাচ্ছে না। বিরক্ত লাগলো তাসিনের কোন না কোন বস এখনো আসেনি তাই বলে তারা কেন না খেয়ে অপেক্ষা করবে! কয়েক মিনিট পর আবারও ফোন বাজলো তাসিনের এবং এবার নাম্বারটা অচেনা। হ্যালো বলতেই মুরাদ বলল, “তুই কয় তালায় আছিস দোস্ত?”

“তিনতলার লেফ্ট সাইড পায়রা কনভেনশন হলে।”

তারপর আবারও কল ডিসকানেক্ট। মেজাজে এবার গরম পানি পড়ার মত ঝলসে গেল। কি এক অবস্থা এক তো পেটে খিদে দ্বিতীয় তো সুমন, মুরাদের এমন ফোন কল! তাসিন হাতের ঘড়িতে সময় দেখে একটু রিসেপশনের দিকে এগেচ্ছিলো আর তখনি সুপ্রভা এসে সামনে দাঁড়ালো।

“এখানে আর কতক্ষণ থাকবেন?”

“মানে! আর তুমি এখানে কেন?”

“অসভ্য লোক কতবার বোঝাতে হবে অচেনা মেয়েকে আপনি বলতে হয়! যাই হোক, আর কতক্ষণ লাগবে আপনার?”

সুপ্রভা কথা বলতে বলতে চোখ রাঙালো। তাসিন এবার বিভ্রান্ত হলো মেয়েটির আচরণে। সে এখানে কতক্ষণ থাকবে সেটা তার ব্যাপার সুপ্রভা কেন জানতে চাইবে! সে তৎক্ষনাৎ কোন জবাব দিলো না। সুপ্রভা এবার চেঁচিয়ে উঠলো, “কথা কি শুনতে পান না জবাব দেন?” রিসেপশন থেকে তাসিনের বস আর রিসেপশনেরই একজন আসছিলো। তারা বোধহয় আগে থেকেই কিছু বলাবলি করছিলো। সামনে এসে বলল, “মাহতাব সাহেব মিসেসকে রাগানো মন্দ কাজ। এতে ঘরের ঠাঁই নষ্ট হবে। যান বাইরে গিয়ে প্রবলেম সলভ করে আসুন একটু পরই বড় স্যার আসবেন।”

বসের কথা শুনে হতবিহ্বল তাসিন বোকার মত চাইলো সুপ্রভার দিকে। আর সুপ্রভা হঠাৎ দৃষ্টি নামিয়ে বলল, “বাইরে আসুন একটু কথা আছে জরুরি।”

চলবে

#বৃষ্টির_রাতে
রূবাইবা মেহউইশ
(৫)

চট্রগ্রামে আসবে আর কক্সবাজারে যাবে না তা কি করে হয়! তাও যদি হয় বাড়ি থেকে পালিয়ে আসা! মুরাদের ক্ষেত্রেও তাই হলো কিন্তু তার একা নয় বাকি বন্ধুরাও এর ফায়দা লুটছে। রাত বাজে এগারোটা তাসিনের গাড়ি চলছে কক্সবাজারের পথে। পেটের ভেতর খিদেটা বাঁদর নাচ নাচছে তার তবুও মুখ চেপে ড্রাইভিং করতে হচ্ছে। পাশে বসা রিমনের দিকে বার বার ক্রোধ মিশ্রিত চোখে তাকিয়ে ফোঁস ফোঁসও করছে বটে! এছাড়া উপায় কি তার। মুরাদের মত খাদক, পেটুক যে মেয়ে নিয়ে কখনো পালাতে পারে কথাটা কল্পনার বাইরে সব বন্ধুরই। তাসিন যখন অফিস পার্টিতে সুপ্রভাকে দেখেছিলো তখনই তার মনে ভয় জেগেছিলো। অশনিসংকেত ছিলো সুপ্রভার আগমন আর যখন সুপ্রভা তার বসের সামনেই ধমকে বলল, “রাখুন আপনার পার্টি৷ এক বেলা না খেয়ে থাকলে কিছু হবে না আর না পার্টি করলে। বেরিয়ে আসুন এক্ষুনি। স্যার আপনার কোন সমস্যা হবে তাসিন আজ পার্টিতে না থাকলে?” শেষের কথাটা তাসিনের বসের দিকে তাকিয়ে বলতেই লোকটা ভ্রু উঁচিয়ে নিজেই ভয় পেয়েছে এমন ভাব করে বলল, “না না মিসেস তাসিন ওকে এখন বিশেষ কোন প্রয়োজন নেই। নিয়ে যান আপনি৷ মিস্টার তাসিন এখনো দাঁড়িয়ে কি দেখছেন যান।” তাসিন বেকুব বনে গেছে বস আর সুপ্রভার আচরণে। কোন কিছু না বুঝেই বেরিয়ে এলো সুপ্রভার পেছন পেছন৷ সে শুনতে পেয়েছিলো বস হাসতে হাসতে তাঁর পাশের জনকে বলছে, “এরা নিশ্চিত প্রেম করে বিয়ে করেছে তাই বউ এমন ঝাড়ির ওপর রাখে। স্থান কালও খেয়াল করে না মেয়েগুলো!”

কথাটা তো সুপ্রভার কানেও গেছে কিন্তু মেয়েটা তাতে নির্বিকার। হলের গেইট পেরুতেই তাসিনের আক্কেলগুড়ুম হলো তিন বন্ধুর পাশে টিয়াকেও দেখে। তাসিনের বোঝা হয়ে গেল বন্ধুরা কোন ঝামেলা পাকিয়েছে এই মেয়েদের নিয়েই। বন্ধুরা কথা শুরু করার আগেই সে বলল, ” নিচে চল এখানে কোন কথা না।”

হোটেল থেকে বেরিয়ে গাড়ির কাছে গিয়ে তাসিন বন্ধুদের দিকে তাকালো। শুরু থেকে খেয়াল করছে টিয়া মেয়েটা মুরাদের গা ঘেঁষেই হাটছে এখনো দুজন পাশাপাশি৷

“এত রাতে তোরা এখানে কেন। আর এই ঝড়বৃষ্টি সাথে কেন?”

ঝড়বৃষ্টি বলার সময় তাসিন সুপ্রভা আর টিয়াকেই ইশারা করেছিলো। সুপ্রভা উত্তেজিত হতে গিয়েও হলো না। এখন কোন প্রকার ঝামেলা করা বিপদজনক বিশেষ করে ছেলের সংখ্যা যেখানে তিন আর তারা মাত্র দুজন মেয়ে। এমনিতেও তার তাসিনকে সেই রাত থেকেই অসভ্য মনে হচ্ছিলো। সে দাঁতে দাঁত চেপে শুনে গেল কথাটা।

তাসিন আবার কিছু বলতে চাইলে রিমন তাকে বলল, “রাগিস না এখন একটা বিপদ হয়ে গেছে।”

সুমন বলল, “হয়নি ঘটিয়েছে, এই যে দুই মানব-মানবী।” টিয়া আর মুরাদকে ইশারাকে।

“এরা দুটো বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছে ভোরে। আর বিয়ে করেছে।”
সুমনের কথা শেষ হতেই বড় বড় চোখে তাকালো তাসিন। তার চোখে অবিশ্বাসের ছায়া। মুরাদ এসেছে মেয়ে নিয়ে পালিয়ে। অসম্ভব!

“মাথা ঠিক আছে তোদের? রিমন মেয়ে ভাগিয়েছে শুনলে মানা যায় কিন্তু এই খাদক খাবার ছেড়ে মেয়ে খাবে ইম্পসিবল!”

তাসিনের মুখের কথা শেষ হতেই সুপ্রভা আর টিয়া এমন করে তাকালো তার দিকে যে, শুকনো গলায় ঢোক গিলতে হলো। সে কিছুটা ভয়ই পেল বুঝি নারী দৃষ্টির ক্রোধানলে। মুরাদ অস্থির হয়ে বলল, “ভাই এখন ক্ষেপাস না। বিপদে পড়ার আগেই কিছু কর?”

“হয়েছেটা কি তা আগে বল।”

রিমন বলা শুরু করলো, “এই শালা নাকি ওই মেয়ে মানে ভাবীরে আগে থেকেই পছন্দ করতো। কোনদিন প্রপোজ করে নাই কিন্তু চোখাচোখি কারবার চলছিলো। তারপর হঠাৎ ভাবীর বিয়ে ঠিক হওয়ায় আর দেখাসাক্ষাৎ এর চেষ্টা করেনি। সেদিন ওই যে আম বাগানে দেখলো আবার নাকি পুরানা প্রেম জাগলো তাই কালকে লুকাইয়া দেখা করতে গেল। এদিকে ভাবীজিও নাকি এই বিয়েতে রাজী ছিলো না। ব্যস দুজনে কথা বলল তারপর মনের বিরহ যাতনা স্বীকার করলো দুইজনের দিকের। এরপরই পালানোর সিদ্ধান্ত৷ গবেট ব্যাটা তার মায়রে সব জানাইছে কিন্তু কাকী নাকি সম্মতি দেয়নি। এদিকে ভাবীর আজকে গায়ে হলুদ কালকে বিয়ে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছেন ভোরেই কিছু না ভেবে আর এই যে মহান নারী তিনিও কি সুন্দর বান্ধবীকে নিয়ে এসে আমাদের এলাকায় হাজির। মুরাদকে ফোন দিছে সেও মুখ হাত না ধুয়ে দেখা করলো। হঠাৎ প্ল্যান করে আমাকে আর সুমনকে খবর দিলো। ভাই বন্ধু বলে কথা টেনে বিপদ মাথায় নিয়ে দুটোর বিয়ে করিয়ে পালিয়েছি আমরাও।”

“খুবই উত্তম করেছো ভাইয়েরা আমার। নিজেরা তো বাঁশ খাবে সাথে আমাকেও শামিল করতে এসে হাজির হয়েছো। অতি উত্তম।”

ভর্ৎসনার গলায় বলল তাসিন৷ এতেই যেন ফোস্কা পড়লো সুপ্রভার গায়ে। সে চেঁচিয়ে উঠলো, “সেদিন তো একলা মেয়ে পেয়ে জোরজবরদস্তি সাহায্য দেখাতে এসেছিলেন। আজ কি হলো! ঝামেলার ভয়ে সাহায্য করার সাহস ফুরিয়ে গেল।”

সুপ্রভার কথাটায় কি যেন একটা সুক্ষ্ম খোঁচা ছিলো। খুব লাগলো তাসিনের৷ এই খোঁচা ছাড়াও সে তার বন্ধুর হেল্প করতোই। তাই এই মুহূর্তে সুপ্রভার সাথে ঝগড়া করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই। সে বন্ধুদের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, “কি করতে হবে বল?”

“একটা থাকার জায়গা বের করে দে এখন৷ কাল সকালে বুদ্ধি বের করতে হবে বাড়িতে যাওয়ার।” মুরাদ বলল কথাটা।

তাসিন হতাশ দৃষ্টিতে তাকালো সবার দিকে। সে নিজে থাকে নানার বাড়িতে। বড় মামিদের সাথে দোতলায় তার ঘর৷ সে তার নিজস্ব ঘরটাতে তিন বন্ধুকে অনায়েসেই থাকতে দিতে পারে কিন্তু মেয়ে দুটোর কি হবে!

“আমার পক্ষে বাড়িতে মেয়েদের নেওয়া সম্ভব না।”

“তো কি আমরা মেয়েরা রাস্তায় থাকবো?”

সুপ্রভার গলার স্বর উঁচু হলো।

“আমি সেটা বলছি না। এই হোটেলেই তৃতীয়, চতুর্থ তলায় হোটেল, রুম পাওয়া যাবে। তোমরা না হয় সেখানেই থাকো।”

সুমন বরাবরই চুপচাপ স্বভাবের তবুও সেই এখন মুখ খুলল, ” বুদ্ধি ভালো দোস্ত কিন্তু মেয়ে মানুষ দুটো রেখে যাওয়া সেফ নয়। আর বিয়েটা যেমনেই হোক মুরাদের বাসরটা হয়েই যাক আজ।” সুমনের কথায় যে হালকা একটু খোঁচা ছিলো তা বুঝতে পেরে ঘুষি মারলো মুরাদ। তাসিনেরও মনে হলো ভুল তো যা করার করেই ফেলেছে এখন না হয় বাসরটাও হোক। সে এবার সবার চেয়ে দু কাঠি ওপরে ভেবে বলল, “গাড়িতে বস সবাই।”

“কোথায় যাবো?”৷ সুপ্রভা প্রশ্ন করলো।

” বাড়িতে থেকে বের হওয়ার সময় ভেবেছিলে কোথায় যাবে?”

“তখন কি আর এতকিছু ভাবার সময় ছিল?”

“এখনও ভাবতে হবে না গাড়িতে উঠো।” তাসিন বলেই গাড়িতে উঠলো। তার পরপরই সুমন উঠে বসলো ড্রাইভিং সিটের পাশে তা দেখে রিমন চালাকি করে পেছনের সিটে তড়িঘড়ি উঠে বসলো। সুপ্রভা, মুরাদ আর টিয়া হা করে তাকিয়ে আছে রিমনের দিকে। এতে অবশ্য তার তেমন কোন হেলদোল নেই। তাসিন সিট বেল্ট বাঁধতে বাঁধতে ঘাড় ফিরিয়ে দেখলো।

“বাহ্, এককাজ কর রিমন তুই একাই যা আমরা সবাই নেমে পড়ি!” ব্যঙ্গ করে বলল তাসিন

“আমি কি করলাম! পেছনে সিট দুইটা অথচ মানুষ চারজন৷” কাচুমাচু করে বলল রিমন।

“শালা নাম গাড়ি থেকে।সামনে আয় সুমনের পাশে।”

“নাহ, দোস্ত ওই সিটে তিনজন মুশকিল।”

“বেশি কথা বললে গাড়ির উপরে বেঁধে নিয়ে যাব তোকে।” গলা চড়ল তাসিনের। রিমন নেমে গেল। পেছনের সিটে প্রথমে সুপ্রভা তারপর টিয়া তারপর মুরাদ বসলো। মেয়ে দুটোই মোটামুটি হ্যাংলা পাতলা বলে সমস্যা হচ্ছে না বসতে। যত সমস্যা বাঁধলো সামনে। এক সিটে সুমন আর রিমন৷ তারমধ্যে রিমন আর তাসিন দুজনেই ফিটনেসের দিক থেকে চওড়া, লম্বা। গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার কিছুক্ষণ পরপরই গাঁইগুঁই করছে রিমন৷ বসতে তার অবস্থা কাহিল। এক ঘন্টার রাস্তা শেষে কক্সবাজারের পৌঁছুতেই সবার অবস্থা শীতল হলো। মোটামুটি সমুদ্রের হাওয়া আর শো শো গর্জন কানে আসতেই প্রত্যেকের মন চঞ্চল হলো। সারাদিনের ভয়ানক মুহূর্ত আর পালিয়ে আসাটা মনে করে আর ভয় লাগছে না বরং অজাগতিক এক নিস্তব্ধতা মনকে প্রলুব্ধ করছে সবার। গন্তব্যে পৌঁছুতেই তাসিন জিজ্ঞেস করলো কোন হোটেলে উঠবে? আর রুম তো তিনটা লাগবে!”

এবারও রিমনই মুখ খুলল আগে, “হোটেল সিগ্যালে যাবো।”

“পকেটে কয় লাখ নিয়ে এসেছিস?” মুরাদ বলল কথাটা। রিমন বলল, “বিয়ে করলি আর বন্ধুদের ট্রিট দিবি না?”

“ওহ আচ্ছা, বিয়ের ট্রিট তোদের ফেমাস হোটেলে এনে দিতে হবে। তা বন্ধু বিয়ে করছে সে হিসেবে একটা ট্রিট তো তুইও দিবি। হানিমুন প্যাকেজটা তুই দে।”

“উফ, কি শুরু করলেন আপনারা? রাত বাজে একটা এখন একটা হোটেলেও জায়গা পাবেন কিনা দেখেন দামী জমদামী লাগবে না।”

সমুদ্রের গর্জন এত বেশি শোনা যাচ্ছে সেই সাথে বাতাসের নিশ্ছিদ্র আকুলতা কানে তালা লেগে যাওয়ার মত। তাসিনের পেটের খিদে আর ক্লান্তি সবটা আপনাআপনি এই বাতাসে মিশে যাচ্ছিলো। সে বন্ধুদের তর্কে কান না দিয়ে বলল, ” ছোট মামা কদিন আগে একটা হোটেলের রিভিউ দিয়েছিল। বলেছিলো সেখানে তিন রকম এমাউন্টে ঘর আছে আর তাদের হসপিটালিটি মনোমুগ্ধকর। নামটা হোটেল নির্ঝর না নির্জন কি যেন বলেছিলো। আর হোটেলের ওনার আবার ছোট মামার কেমন আত্মীয়ের যেন!”

তাসিন যখন হোটেল সম্পর্কে বলছিলো তখনি সুপ্রভা নাম খেয়াল করলো। নিজের ফোন বের করে প্রথমে হোটেল নির্ঝর পরে হোটেল নির্জন নামে সার্চ করলো গুগলে। লোকেশন পেতেই চেক করলো তারা হোটেলের আশেপাশেই আছে সুপ্রভা বলতেই তাসিন নামলো। সে এক দোকানদারকে জিজ্ঞেস করতেই দেখিয়ে দিলো হোটেলটা একটু সামনের দিকে। বিচ থেকে কাছাকাছি জায়গাটা। তাসিন সর্বশেষ কক্সবাজার এসেছে আরো পাঁচ বছর আগে। এতদিনে আরো কতশত নতুন হোটেল তৈরি হয়ে গেছে, পথঘাটে পরিবর্তন এসেছে৷ তবুও দু মিনিটের মধ্যেই তারা পৌঁছে গেল কাঙ্খিত হোটেলের সামনে। ভেতরে গাড়ি পার্কিং এর সুন্দর জায়গা থাকায় গেইটেই সবাইকে নামিয়ে তাসিন গাড়ি পার্ক করলো। এরপর সবাই একসাথে নিয়ে নিচতলায় রিসেপশনে কথা বলে জানতে পারলো দোতলায় একটি আর তিনতলায় একটি রুম খালি আছে। তাদের তিনটি রুম লাগবে কিন্তু সমস্যা আরো আছে। একটি রুমে মুরাদ টিয়া থাকবে। অন্যটিতে হয় তারা তিন বন্ধু নয় সুপ্রভা। তারা তিনজন নিচে দেখলো বিশাল জায়গা সময় কাটানোর মত আছে আবার চাইলে বিচে ঘুরেও রাতটুকু পার করতে পারবে কিন্তু সুপ্রভাকে একা রেখে যাওয়াটা কতোটা নিরাপদ! না চাইতেও তাসিনের চিন্তা হলো সুপ্রভাকে নিয়ে৷ তাসিন আবারও রিসেপশনিস্টকে বলল, “প্লিজ আমাদের আর একটা রুমের ব্যবস্থা করে দিন৷ দেখতেই পাচ্ছেন সাথে মেয়ে মানুষ আছে।” তাসিনের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই কেউ একজন তার পাশাপাশি এসে দাঁড়ালো। রিসেপশনিস্টকে উদ্দেশ্য করে বলল, “শায়খ, সন্ধ্যায় নাকি হাসপাতাল থেকে মেডিসিন বক্স দিয়ে গেছে একটা?”

“জ্বী স্যার।”

“আমার রুমে পাঠাওনি কেন? মেডিসিনগুলো নির্জনের প্রয়োজনীয় ছিল৷ আমি ভাবলাম তারা বুঝি এখনো পাঠায়নি।” খুবই শীতল কণ্ঠে বলল লোকটা তা শুনে তাসিনরা সবাই বেশ অবাক হলো। লোকটাকে দেখেই কেমন দাপুটে মনে হচ্ছিলো সবার। রিসেপশনিস্ট ছেলেটা একটা প্যাকেট এগিয়ে দিতেই লোকটা তা হাতে নিলো। ফিরে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সে আবার থেমে গেল।

“আপনারা কি কোন প্রয়োজনে এখানে দাঁড়িয়ে আছেন?”

প্রশ্নটা করতেই সুপ্রভা বলল, “জ্বী আমরা আসলে কক্সবাজার ঘুরতে এসেছি৷ এই হোটেলে রুম পাওয়া গেল দুটো আমাদের দরকার তিনটে।”

“ওহ আচ্ছা, আমি রিশাদ রায়হান, এটা আমারই হোটেল। আপনারা তো দেখছি ছয়জন।” কথাটা বলে কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে রিশাদ বলল, “আপনাদের তো ছয়জন তার মধ্যে মেয়ে দুজন। দু রুমেই একটু ম্যানেজ করতে পারেন আপনারা।”

“হ্যাঁ আসলে আমাদের একজন কাপল আছে সাথে না মানে আজই বিয়ে করে এসেছে।” সুপ্রভার এ কথার পর রিশাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। কপালের মধ্যখানে সুক্ষ্ম এক রেখা স্পষ্ট তা দেখে কিছুটা আতংক বোধ করলো। তাদের ভয় কাটিয়ে রিশাদ বলল, “পালিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে তাইতো!”

উপস্থিত একজনও আর হ্যাঁ না কিছু বলল না রিশাদের কথার জবাবে। সবারই মাথাটা কেমন নুয়ে গেল। রিশাদ আর কিছু না বলে হাতে থাকা ফোনটাতে কাউকে কল দিলো। কয়েক সেকেন্ড বাদেই উচ্চারণ করলো, “মেবিশ, একটু নিচে আসতে পারবে?”

ওপাশ থেকে কিছু বলতেই রিশাদ বলল, “আচ্ছা তুমি থাকো আমি কয়েকজনকে নিয়ে রুমে আসছি।”

চলবে