বৃষ্টিশেষে প্রেমছন্দ পর্ব-২৪+২৫

0
696

#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

২৪.
রাত তখন একটা বেজে পাঁচ মিনিট। ফোনের ওপাশে প্রগাঢ় নিস্তব্ধতা। কারোর ভারী নিঃশ্বাসের স্পন্দনে উত্তাল ঢেউয়ের গভীর নিরবতা। আদর কথা বলল প্রথম,

‘বাহ! এতো তাড়াতাড়ি ফোনকল? আমি তো ভেবেছি আরো দু-চারদিন লাগবে।’

টিকলি জোরালো শ্বাস ফেলল। যাক, শেষ পর্যন্ত ঠিক ঠাক নাম্বারে কল করতে পেরেছে। ক্লান্ত গলা ঠেলে দিয়ে বলে উঠলো,

‘আপনি এমন কেনো ডাক্তার?’

আদরকে জড়ীভূত ধরলো। মিনিট খানিক নিরব থেকে বিরবির করলো, ‘আহ! ডাক্তার! কি মধুর!’

‘কিছু বললেন?’
‘নাহ।’
‘এতো রাতে ফোন করলাম বিরক্ত হননি?’
‘আমি এখনো হসপিটালে।’
‘এতো রাতেও?’
‘হুম।’
‘বাড়ি ফিরবেন কখন?’
‘এইতো দেখি। কখন ফেরা যায়।’

এরপর ওপাশে পিনপিনে নিরবতা। আদর চেয়ারে হেলান দিয়ে মুচকি হেসে প্রশ্ন করলো, ‘তো নাম্বার পেলেন কীভাবে?’

টিকলি ভ্রু কুচকে বলল,

‘ঢং করেন? আপনি নিজেই তো লিখে দিয়েছেন।’

‘হ্যাঁ দিয়েছি। কিন্তু সেটা অতিমাত্রায় বুদ্ধিমান ব্যক্তি ছাড়া তো কারোর বুঝার কথা না।’

‘আপনার কি আমাকে বোকা মনে হয় ডাক্তার?’

টিকলি গলায় তেজের রেশ টেনে বলল। আদর হেসে বলল, ‘নাহ। আপনি তো ভীষণ বুদ্ধিমতী। এবার বলুন তো দেখি কীভাবে কীভাবে পেলেন?’

‘আপনি আর কথা বলবেন না তো।’
‘ওমা, কেনো?’
‘আপনি জানেন আমি সাড়ে দশটায় প্রেসক্রিপশন টা খুলেছিলাম। আর এখন একটা পনেরো বাজে। এ পর্যন্ত আমি একেকজনকে ফোন ই দিয়েছি। যাকেই বলি আদর সাহেব বলছেন সেই বলে এতো রাতে মশকরা করছেন। পাগল ফাগল উপাধিও পেয়েছি। কোন কোন নাম্বারে ফোন দেইনি বলুন, ০১৭৬১২১৩৫৩০, ০১৭৬১২১৩৫৩১, ০১৭৬১২১৩৫২৮,০১৭৬১২১৩৫২৯, ০১৭৬১২১৩৫২৪। একটা নাম্বারও কাজে লাগেনি।’

আদর মনোযোগ দিয়ে শুনলো টিকলির সব কথা। খানিক বাদে বলল, ‘কিছু পেতে হলে তো কিছু হারাতেই হবে টিকলি। সব কিছু কি এতো সহজেই হাতের মুঠোয় পাওয়া যায়? আপনার কি মনে হয় আমি এতো সহজে আপনাকে ধরা দিবো?’

‘কিন্তু আমি তো ধরে ফেলেছি ডাক্তার।’ টিকলির গলা নরম হলো। আদর চেয়ারে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করলো। কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে বলল, ‘এক্সপ্লেইন করুন তো দেখি কীভাবে নাম্বারটা বুঝলেন?’

‘আপনি যে প্যাচানো লোক সেটা তো ভালো করেই জানি। যখন দেখলাম কোনো নাম্বার ই কাজে লাগলো না। তখন খাতা নিয়ে বসে বিভিন্ন ভাবে মিলানো চেষ্টা করলাম এরপর আবার ফোন লাগাতে শুরু করলাম। এরপর মাত্র কাঙ্ক্ষিত মানুষটিকে পেলাম। শূন্য জীবনে ভাসে এক আকাশের সাত রং, ০১৭। ছয় ঋতুতে আসছে বারো মাস আর এক ফাল্গুন, ৬১২১।
হঠাৎ জীবন পথ খুঁজে তিন গলির মুখে, পাঁচ রাস্তার মোড়ে। দুটোই রাস্তার সাথে সংযোগ। আর পাঁচ রাস্তার মোড়ে তিন গলি আছে। এটুকু মিলে হবে আট। তাই না ডাক্তার?’

আদর হাসলো, ‘হুম। তারপর?’

‘সারা মাসে অক্লান্ত পরিশ্রমে ফুরোয় দিন তোমার কফি মগে। এখানে ৩০ এর সাথে ২৪ গুন করে হবে ৭২০। ০১৭৬১২১৮৭২০ এই হলো আপনার নাম্বার।’

আদর বাহ্বা দিয়ে বলল, ‘বাহ! ইম্প্রেসিভ! আপনার আই-কিউ তো দারুন টিকলি। বোকা ভাবতাম কিন্তু প্রচুর বুদ্ধিমতী আপনি। দু দিনে বের করে ফেলেছেন।’

আনমনে টিকলি ধীর গলায় বলল, ‘ভালোবাসলে এসব একটু আকটু আই-কিউ বের করা যায় বাদর সাহেব।’

আদর পুরো কথা শুনেনি তবে শেষে বাদর কথাটা ঠিক শুনেছে। রাগী কণ্ঠে বলল, ‘এই কি বললেন আপনি?’

থতমত খেয়ে টিকলি জবাব দিলো, ‘বলছিলাম যে আমি দুদিনে বের করিনি। আজকেই প্রেসক্রিপশন টা খুলেছি।’

‘তাহলে তো আরো দারুন। ব্রিলিয়ান্ট এর উপর ব্রিলিয়ান্ট। তবে নিশ্চয়ই এখনো ওষুধ গুলো কিনেন নি? তাড়াতাড়ি কিনে ফেলবেন। মাথা ব্যথা বাড়বে নাহয়। এই দুদিনে আরো মাথা ব্যথা করেছিলো কি?’

‘আপনাকে দেখে সব দৌড়ে পালিয়েছে ডাক্তার।’

‘আহা! কি বিরবির করছেন মিস. টিকটিকি? জোরে বলুন না।’

টিকলি চোখ রাঙিয়ে বলল, ‘এই…’

আদর হাসলো। হঠাৎ কিছু মনে পরেছে এমনভাবে বলল, ‘আচ্ছা আপনার যে ঠান্ডার সমস্যা বলেননি তো। যে দুই তিনদিন নিঝুম দ্বীপে একসাথে থাকলাম সে কয়দিন তো তেমন….’

আদরের কথা সমাপ্ত করতে না দিয়েই টিকলি বলল,

‘আপনি বোধ হয় ভুলে গেছেন। যেদিন আমরা নিঝুম দ্বীপে গেলাম সেদিন আমার ডাস্ট অ্যালার্জির কারণে সকালে ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়েছিলো বলে আপনি কি বকাটাই না দিলেন। ধুলোবালিতে ছিলাম এবং রাতে আরেকবার গোসল করেছিলাম বলে ঠান্ডা লেগে গিয়েছিলো।’

‘ওহ হ্যাঁ মনে পরেছে।’

‘আচ্ছা ডাক্তার, আপনি আমাকে আপনার ফোন নাম্বার কেনো দিলেন? তাও এভাবে?’

টিকলি ভ্রু কুচকে ঠোঁট টিপে প্রশ্ন করলো। আদর বিহ্বল হয়ে গেলো। চেহারা হয়ে উঠলো বিবর্ণ। এই প্রশ্নের কি জবাব দিবে? সে নিজেও তো জানে না কেনো সে নাম্বার দিয়েছে। আদর কথা ঘুরাতে বলল,

‘আপনি এতো কার সাথে কথা বলেন টিকলি? আপনি এতো ফোন কলে বিজি থাকেন কেনো?’

আদরের কণ্ঠ কেমন জানি একটু অভিমানের ছোঁয়া। টিকলি বলতে চাইলো আমার ফোন কল বিজি থাকলেই আপনার কি ডাক্তার? কিন্তু আদরের ওই কোমল ললিত নরম কণ্ঠে সে অভিভূত হয়ে গেলো। বলল,

‘কোথায়? আমার ফোন কল তো বিজি থাকেনা ডাক্তার। আপনাকে এ কথা কে বলেছে?’

‘আপনার মামা। চেম্বারে ঢোকার আগে আপনি কারোর সাথে কথা বলছিলেন যার কারণে আপনার দেরি হয়েছে।’

টিকলি হেসে দিলো। বলল, ‘আমার এক ফ্রেন্ডের সাথে কথা বলছিলাম।’

আদরের ভ্রু কুচকে প্রশ্ন করলো, ‘ফ্রেন্ড?’

‘জি বান্ধবী।’

আদরের বুক কেনো যেনো স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। বড্ড ক্লান্ত গলায় বলল, ‘ঘুমোবেন না?’

‘হুম। আপনি বাড়ি যাবেন কখন?’
‘দেখি। বাড়ি যাওয়া খুব প্রয়োজন। ওদিকে আর্দ্র এক্সিডেন্ট করেছে।’
‘আল্লাহ! কীভাবে?’
‘বাইক এক্সিডেন্ট। দেখেন না কেমন তিড়িং বিড়িং করে সবসময়। পায়ে অনেকটা ইনজুরি হয়েছে। হাটতে পারছে না।’
‘ইশশ…একটু দেখে চলবে না? আজকে টায়রাও অসুস্থ হয়ে পরেছে।’
‘কীভাবে?’
‘ওর তো হেমোফোবিয়া আছে। রাস্তায় কে যেনো এক্সিডেন্ট করেছিলো। রক্ত দেখে বাসায় এসে বমি করেছে।’

আদর ভ্রু কুচকে কিছুক্ষণ ভাবলো। ছোট করে বলল, ‘ওহ। খেয়াল রাখবেন। কি করছে টায়রা এখন?’

‘ঘুমোচ্ছে। আচ্ছা ডাক্তার হেমোফোবিয়াকে ডাক্তারি ভাষায় কি বলে?’

‘ভ্যাসোভ্যাগাল সিনকোপ বা নিউরোকার্ডিও জেনিক সিনকোপ।’

‘উফফ..কত্ত কঠিন নাম। এতোকিছু মনে রাখেন কীভাবে?’

‘ডাক্তারদের মনে রাখতে হয়। এর জন্যই তো আমরা ডাক্তার।’

টিকলি চোখ সরু করে বলল, ‘ভাব ধরছেন?’

আয়েশী ভঙ্গিতে আদরের জবাব, ‘হুম।’

টিকলি আর কথার উত্তর দিলোনা। বারান্দা গলিয়ে আসমানে তাকালো। আকাশে অনেক তাঁরার মেলা। তাঁরাদের মিলনায়তনে যোগ দিয়েছে চাঁদ। রুপালি আলো। চারিপাশে চমক আর চমক। শুধু ভালোলাগা। টিকলি চোখ বন্ধ করে বলল,

‘আপনার কাছ থেকে আকাশ দেখা শিখেছি। আকাশ দেখা যে এতো সুন্দর হতে পারে জানা ছিলোনা।’

আদর ঠোঁটের কোণায় সন্তুষ্টির হাসি ঝুলিয়ে বলল,

‘তবে এবার ঘুমিয়ে পড়ুন। অনেক রাত হলো।’

‘আচ্ছা। শুভ রাত্রি।’

টিকলি ফোন রেখে দিতেই আদরের মনে পরলো তার সরি বলা হয়নি। তড়িঘড়ি করে সে বলল, ‘হ্যালো হ্যালো কেটে দিয়েছেন? ‘

‘নাহ বলুন শুনছি।’

আদর বড় করে শ্বাস নিলো। হঠাৎ কি যেনো হলো বুকের ভেতর তবলা বাজলো। ধামাধাম। আদর এলোমেলো হলো। সেই এলোমেলো থেকে অগোছালো কণ্ঠে বলল,

‘চিরকুট টাতে কিন্তু শুধু আমার নাম্বার লিখা ছিলোনা কিছু অজানা অনুভূতিকে প্রহরী হিসেবে সাজিয়ে নিয়োজিত রেখেছিলাম।’

টিকলির ঠোঁট প্রসারিত হলো। কান থেকে আস্তে করে ফোন রেখে বুকের মাঝে চেপে ধরলো। দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে নিঃশব্দে হেসে দিলো। ভালোবাসার একেকটা ছন্দ, স্বপ্ন, দৃশ্যকাব্য মনের ক্যানভাসে রঙিন হয়ে ধরা দিলো। টিকলি স্বপ্ন বুনলো। কল্পনা করলো আগামী দিনের তার ভালোবাসার দিনগুলি।

চোখের সামনে ফোন ধরে আদর কিছুক্ষন থ হয়ে বসে থাকলো। বলতে চাইলো কি? আর বলে ফেলল কি? নিজের এই অকর্মায় নিজেই লজ্জিত হয়ে পরলো। এই সরি টাই শনি। যতবার সরি বলতে গেছে কিছু না কিছু ভুল হয়ে যায়। আদর ভেবে পায়না, সে কেনো টিকলিকে সরি বলতে পারেনা? শুধুমাত্র টিকলিকেই কেনো?

_________________________________

ভোরের সূর্যের কোমল আলো ঘর ছুতেই আর্দ্রর বুঝে আসলো সকাল হয়ে গেছে এবং সারারাত তার ঘুম হয়নি অজানা কোনো বুককাঁপা উত্তেজনার কারণে। নরম কমলা সূর্যের আলোতে আর্দ্র নিজের বাম হাতের দিকে তাকালো। কেনো তাকালো কে জানে। কাল বিকালের পর থেকে এই হাত দিয়ে সে কিছুই ধরেনি। এমন কি বাথরুমের চাপ এলেও বাথরুমে যায়নি। কি যন্ত্রণা! শেষমেষ পায়ের সাথে সাথে কি মাথাটাও গেলো?

হাতের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই আর্দ্রর চোখে খেলে গেলো উড়নচণ্ডী, চাপাবাজ, পকপক করা টায়রার মুখচ্ছবি। এই হাতটাই টায়রার কোমড়ে রাখা হয়েছিলো। সেকেন্ড মিনিট গড়িয়ে অনেক্ষণ ওই কোমড়ের অধিকার পেয়েছিল। আর্দ্রর দিশেহারা লাগলো। অগোছালো জীবনটা আরো বেশি অগোছালো হয়ে উঠলো।

তখন বাজে সাড়ে পাঁচটা। আদর ঘুমু ঘুমু ক্লান্ত চোখে ঘরে ঢুকতেই দেখলো বিছানা জুড়ে অন্য কারোর বিচরণ। আর্দ্রকে দেখে আজ কোনো কড়া কথা কিংবা বকা দিলো না। নিঃশব্দে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে আর্দ্রর সামনে বসলো। আর্দ্র একাচ্ছন্ন নয়নে তখনো তাকিয়ে দেখছিলো বাম হাত। আদর বলল,

‘এখন পায়ের অবস্থা কি?’

আর্দ্রের দিক থেকে কোনো ফিরতি উত্তর এলো না। আদর ভ্রু কুচকে তাকিয়ে নাক ছিটকে বলল,

‘কিরে? বামহাতের রেখা গুনছিস নাকি? ছি ছি ছি! শেষমেষ বাম হাত? এমন ভাবে দেখছিস মনে হচ্ছে এখনি খেয়ে ফেলবি। ইয়াক! এক কাজ কর এভাবে দেখা বাদ দিয়ে একটু চেটে টেস্ট নিয়ে নে।’

আর্দ্র হুশে ফিরে তাড়াতাড়ি হাত নিচে নামিয়ে উঠে বসতে গেলেই পায়ে চাপ পরলো। সাথে সাথে কুকরিয়ে উঠলো। আদর বিরক্ত দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফার্স্ট-এইড বক্স নিয়ে আসলো। ড্রেসিং করতে করতে বলল,

‘অসুস্থ বলে আজকে কিছু বললাম না। যে কয়দিন অসুস্থ আছিস সে কয়দিন আমার সাথে থাক। কিন্তু এরপর থেকে নিজের রুমে যাবি।’

আর্দ্র খুশি হয়ে বলল, ‘হোয়াট আ বড় অফার….’

,

সকাল দশটা বাজতেই বাড়িতে আগমন ঘটলো নিভার। আদর সকালে নাস্তা করছিলো। আর্দ্র রিমোট চেপে চ্যানেল পাল্টাচ্ছিলো এবং মনোয়ারা বেগম ছোট ছেলেকে পরম যত্নে খাইয়ে দিচ্ছিলেন। নিভা ডুকতেই মনোয়ারা বেগম চিল্লানো সুরে বললেন,

‘নিভা…তুই?’

নিভা আস্তে করে ভেতরে ডুকে আর্দ্রের পাশে সোফায় বসলো।

চলবে❤️

#বৃষ্টিশেষে_প্রেমছন্দ
#মুমুর্ষিরা_শাহরীন

২৫.
নিভা গিয়ে আর্দ্রর পাশে সোফায় বসে বলল, ‘তুমি অসুস্থ খালামনি কাল আম্মুকে ফোন দিয়ে বলল তাই আসলাম।’

মনোয়ারা খান খুশিতে গদগদ হয়ে বললেন, ‘বাহ! বেশ ভালো করেছিস। আয় দেখি খেতে বস তোর আদর ভাইয়ার সাথে।’

সোফা ছেড়ে উঠে গিয়ে টেবিলে বসতে বসতে আদরের দিকে প্রশ্ন ছুড়লো নিভা, ‘কেমন আছো বস?’

হালকা হেসে আদর উত্তর দিলো, ‘এইতো যাচ্ছে। তোমার কি খবর? পড়াশোনা কেমন চলছে?’

‘বেদনাদায়ক!’

‘ফাঁকিবাজ।’

নিভা হেসে দিলো। আদর টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

‘তবে থাকো। আমি যাই। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। মা গেলাম। খোদা হাফেজ। ‘

রান্নাঘর থেকে মনোয়ারা খান জবাব দিলেন, ‘সাবধানে যাস বাবা। গিয়ে মাকে ফোন করতে ভুলিস না।’

খাবারের প্লেট নিয়ে নিভা আর্দ্রর পাশে এসে আবার বসলো। টিভি দেখতে দেখতে একসময় খাওয়া শেষ হলো। নিভা বলল, ‘ছাদে যাই ভাইয়া?’

‘একা?’ আর্দ্র প্রশ্ন করলো ভ্রু কুচকে।

‘হুম। তা নয়তো কে যাবে? তুমি তো পা ভেঙে বসে আছো।’

‘দরকার নেই। তিনতলায় ব্যাচেলর ভাড়া দেওয়া হয়েছে।’

‘এমা! কবে?’

‘এইতো তিনমাস আগে। তুই তো প্রায় ছয় মাস থেকে আমাদের বাসায় আসিস না।’

‘তোমরা যাও?’

সোফায় হেলান দিয়ে বসে আর্দ্র হাই তুলে বলল, ‘না। আলসেমি লাগে।’

মুখ ভেঙিয়ে নিভা জবাব দিলো, ‘হুম সেটাই। গেলাম আমি। ব্যাচেলররা এতো সকালে ঘুম থেকে উঠে না। আর উঠলেও কি? একটু চান্স ফান্স পাওয়া যাবে। সিংগেল থেকে মিংগেল হওয়ার একটা সুযোগ অন্তত পাবো।’

অবহেলার গলায় আর্দ্র বলল,

‘লাভ নেই। দুজন বিবাহিত। একজন গেছে ফুফুর বাসায় আরেকজন বোধ হয় এখন টিউশনিতে আছে।’

‘ওহ….মাই বেড লাক।’

হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে নিভা ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। সেন্টার টেবিলে নিভার ফোন পরে থাকতে দেখে আর্দ্র গলা উঁচিয়ে চিৎকার করে বলল,

‘এই ফোন নিয়ে গেলি না?’

‘রেখে দেও ভাইয়া। ফোন দেওয়ার মতো কেউ নেই। কষ্টে জীবন ত্যানাত্যানা।’

‘মেয়েটা ভারী দুষ্টু হয়ে গেছে।’

বিড়বিড় করে আর্দ্র ফোনটা যথাস্থানে রাখলো। রাখার খানিক বাদেই বাজঁখাই গলায় ফোন চিল্লিয়ে উঠলো। আর্দ্র ভ্রু কুচকে তাকাতেই অবাক হয়ে গেলো। বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মুখের কথা হারিয়ে ফেলল। কপালে কিছু সূক্ষ্ম ভাঁজ, মুখে অপ্রত্যাশিত ছায়া, চোখ জোড়া কুচকিত। আর্দ্র ফোন হাতে তুলে নিলো। ফোনের পুরো স্ক্রিন জুড়ে ভেসে উঠেছে টায়রার ঠোঁট চেপে অল্প জিব বের করা বাম চোখ টিপা দুষ্ট মুখচ্ছবি। নাম্বার সেভ করা ‘ময়নাপাখি ২’ দিয়ে। পাজি সেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ফোন কেটে গেলো। আর্দ্র হুশে ফিরে নিজের বাম হাতটার দিকে তাকালো। এইতো…কাল এই মেয়েটার সাথে দেখা হয়েছিলো। বেশি বুঝা মস্তিষ্ক ভেবেছিলো আর কোনোদিন হয়তো দেখা হবে না। ভাগ্যের ফেরে আজ আবার….?

বোকা মস্তিষ্কের কথা ভাবতে ভাবতেই ফোন তার নিজস্ব ক্ষমতায় আবারো আন্দোলন করে উঠলো। এবারো ফোন কেটে গেলো। আকস্মিক এই ব্যক্তির ফোনকলে বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়েছে আর্দ্র। তৃতীয় বার ফোন বাজতে বাজতে কেটে যাওয়ার আগ মুহুর্তে আর্দ্র রিসিভ করলে ও পাশ থেকে কেউ চড়া গলায় বলল,

‘ওই শালী, ফোন দিয়ে আমি শহিদ হয়ে যাইতাছি আর তুই কি করতাছোস হ্যাঁ? ঘুম পারতাছোস এখনো? এদিকে আমি তোমারে ফোন দিয়ে মরি ওদিকে তুমি অবলীলায় ঘুমাও?’

টায়রার ভাষা দেখে আবেগে আপ্লুত হয়ে পরলো আর্দ্র। ভীষণমাত্রায় অবাক হয়ে মাত্রাতিরিক্ত গম্ভীর গলায় বলে উঠলো,

‘হ্যালো।’

টায়রার ভ্রু জোড়া কুচকে গেলো। এক মুহুর্ত চুপ থেকে আবারো তার ডাইনির ন্যায় গলায় চিল্লিয়ে বলে উঠলো,

‘এই… আপনি কে? আমার বান্ধবীর ফোন আপনার কাছে কেনো? কি করছেন আমার বান্ধবীর সাথে? আমি যতদূর জানি ওর তো কোনো বয়ফ্রেন্ড নেই। অবিয়াত্তা। তাহলে আপনি কে? কিডনাপ করছেন….? আমি তাহলে এই মুহুর্তে একজন কিডনাপার এর সাথে কথা বলছি?’

শেষের লাইন টায়রা বিস্ফোরিত গলায় বলল। আর্দ্র হতবিহ্বল, হতবাক চোখে শূন্যে চেয়ে রইল। এই মেয়েটা এতো বেশি বুঝে যে কিডনাপার এর উপাধিটাও লাভ করে ফেলল আর্দ্র। এই মুহুর্তে তার কেদে বুক ভাসাতে ইচ্ছে করলো হঠাৎ। ভাঙাচোরা হৃদয় নিয়ে বলে উঠলো,

‘টায়রা….’

আর্দ্রের কথার মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে টায়রা টেনে টেনে বলল,

‘ওহ…মাই…গড, আমার নামও জানেন? কে আপনি তাড়াতাড়ি বলুন। তা নাহলে পিছে এমন ডান্ডা দেবোনা দাড়ালে বসতে পারবেন না আর বসলে শুতে পারবেন না।’

আর্দ্র ধমকে বলল এবার,

‘কি আবোলতাবোল বকছেন? বলছি তো আমি…’

টায়রা বিরবির করে বলল, ‘কণ্ঠটা কেমন চেনা চেনা লাগলো।’ পরমুহূর্তেই আবারো গগনবিদারী গলায় বলল,

‘কে আপনি? পরিচিত? পরিচিত হয়ে এভাবে বাঁশ দিলেন? আমার বান্ধবীকে কিডনাপ করলেন? এখন নিশ্চয়ই মুক্তিপণ চাইবেন। দেখুন ভাই, ওতোসব টাকা-পয়সার মালিক আমি না। আর আমার বান্ধবীর বাবা হার্টের পেসেন্ট মা হাই-প্রেসার এর পেসেন্ট। তাই ওদের তো কোনোমতেই বলা যাবে না। যদি বাই চান্স মেয়ের শোকে মরে টরে যায় তাহলে ফোন দেওয়ার অপরাধে আমার দোষ হবে। তার চেয়ে এক কাজ করুন, আমার বান্ধবীকে বিয়ে করে ফেলুন। এখন যা টাকা মুক্তিপণ হিসেবে চাইতেন বিয়ের যৌতুক হিসেবে তা সুদে-আসলে তুলে নিবেন। যদিও যৌতুক হারাম। তবুও কিডনাপার রা তো মায়া-দয়াহীন হয়। খুন টুন ও করে ফেলে নাকি। থাক ভাই আমার বান্ধবীকে বাচিঁয়ে রেখে বিয়ে করে ফেলেন। আমাকে দাওয়াত দিয়েন। এত্তোবড় গিফট নিয়ে যাবোনি। আইডিয়া টা কেমন দিলাম বলুন…? রাজ্যের মহর সাথে রাজকন্যা ফ্রি। ভাবতেই ভিষণ অবাক লাগছে জানেন, যে আমি একজন কিডনাপারের সাথে কথা বলছি। হাউ ব্রেভ আই এম! আই এম প্রাউড অফ মি।’

টায়রার অনবরত বিরামহীন কথা শুনতে শুনতেই যেনো আর্দ্রর পায়ে ব্যথা বেড়ে গেলো। টায়রার কথার ইতি ঘটতেই ক্লান্ত গলা ঠেসে দিয়ে আর্দ্র বলল,

‘শেষ মিস. ফুটা টায়ার? মানে সিরিয়াসলি? একটা মানুষ এতোটা বিরক্তিকর বাঁচাল কীভাবে হতে পারে? বুদ্ধিহীনতারও তো একটা সীমা আছে নাকি?’

‘আপনি আমাকে ইনসাল্ট করছেন? কে আপনি? নাম বলুন। থানায় ফোন দিবো। কেস করবো। মামলা ঠুকবো। আপনাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবো। জেলে ডুকাবো। আপনাকে ফাসিতে…’

টায়রার কথা শেষ করতে না দিয়েই আর্দ্র উচ্চস্বরে চিল্লিয়ে উঠলো,

‘সাট আপ। আমি আর্দ্র। ‘

আর্দ্রের উচ্চবাক্যে কেঁপে গেলো ফোন, ফোনের ওপাশের টায়রা। কান থেকে ফোন সরিয়ে চোখের সামনে ধরে নাম্বার দেখে ভ্রু কুচকে সচেতন দৃষ্টিতে তাকালো। এরপর বিস্ময়তা নিয়ে বলল,

‘আপনি কেনো? আমার বান্ধবীর ফোনে আপনি কি করছেন? ও কোথায়…’

‘চুপ করবেন?’ আর্দ্র ধমকে উঠলো আবারো।

টায়রা ঠোঁট উল্টে বলল, ‘আপনি আমাকে ধমক দিলেন?’

আর্দ্র চোখ বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। এই মেয়ের পকপকানিতে রীতিমতো মাথা ব্যথা ধরে গেছে। শান্ত গলায় আর্দ্র জবাব দিলো,

‘আমি ওর খালাতো ভাই। ও আমার খালাতো বোন।’

টায়রা একদম কিছুই হয়নি এমন স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘ওহ। নিভা কই?’

‘ছাদে গেছে। বাই দা ওয়ে আপনি ওর কি হন? ফ্রেন্ড?’

‘নট জাস্ট আ ফ্রেন্ড উই আর বেস্ট ফ্রেন্ড।’

‘মাশাল্লাহ! আমার বোন ভাগ্য করে একটা বেস্ট ফ্রেন্ড জুটাইছিলো। এমন বাঁশমার্কা বান্ধবী পাওয়ার সৌভাগ্য আর কতজনের হতে পারে?’

‘কি বললেন আপনি?’

ছোট করে আর্দ্র বলল, ‘কিছুনা। টিকলি কেমন আছে?’

‘আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছে।’

এরপর কিছুক্ষণ নিরবতা। কথা আদান-প্রদান করার জড়তা, এতোক্ষন আজেবাজে কথা বলার জন্য লজ্জা, এই প্রথম ফোনে কথা বলায় অস্বস্থি। নিরব থাকতে থাকতে প্রথম প্রশ্ন টায়রা করলো,

‘পায়ের অবস্থা কেমন এখন?’

‘যেমন দেখেছিলেন তেমনি।’

‘যত্ন নিবেন। হেলাফেলা করবেন না। রাখছি। নিভা এলে ফোন দিতে বলবেন।’

‘আচ্ছা।’

‘আল্লাহ হাফেজ।’

‘আল্লাহ হাফেজ।’

,

ফুফু বাড়ির আমেজ শেষ করে নিজের ব্যাচেলর বাসাটায় ফিরে আসলো রাহুল। তখন শেষ অপরাহ্ন। রোদ মাথায় নিয়ে বাসায় ঢুকতে গেলেই পাশাপাশি পার হলো আরেক রমণী অথচ কেউ কাউকে তাকিয়ে দেখলো না। চিনলো না। যার যার নিজস্ব গতিতে নিজ নিজ জায়গার উদ্দেশ্যে ছুটলো। রাহুল ছুটলো গরম থেকে একটু রেহাই পেতে ঘরের ফ্যানের উদ্দেশ্যে। নিভা ছুটলো তাড়াতাড়ি বান্ধবী নামক শাকচুন্নির সাথে দেখা করতে। এতোটাই ব্যস্ত পথ পার হলো যে আড়াআড়ি চলে গেলো দুজন অথচ কেউ কাউকে বুঝলো না, খুঁজলো না, অনুভব করলো না, চোখের চাহনিতে আবদ্ধ করলো না। দুটো পরিচিত ব্যক্তি একই সময় একই কালে একই স্থান পার করলো অথচ কেউ কাউকে দেখেও দেখলো না। নিজস্ব উল্লাসের তল্লাসে চলে গেলো ফুরুৎ করে।

______________________________

সেদিনের পর আজ কেটে গেছে তিন দিন। এর মাঝে আদরের কোনো ফোন বা মেসেজ আসেনি। অভিমানে টিকলিও আর ফোন দেইনি। ফোন হাতে নিয়ে কৃত্রিম সবুজ গাসের বারান্দাটাতে বসে টিকলি উদাস চোখে বাইরে তাকিয়ে ছিলো। সন্ধ্যা হওয়ার পূর্বসূচি। পাখিদের নীড়ে ফিরে যাওয়ার তাড়না। দিনের আলো মিলে গিয়ে রাতের অন্ধকারে রূপান্তরিত হওয়ার সূচনা। আদরের নাম্বারটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই অবচেতন মনে ফোন লাগালো। এক দুবার রিং হওয়ার পরই ওপাশে ফোন ধরে গম্ভীর গলায় বলা হলো, ‘হ্যালো।’

টিকলি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইল ফোনের পানে। মিনিট দুয়েক গড়ালো। আদর বার দশের মতো হ্যালো হ্যালো করে চুপ করে গেলো। টিকলি ফোন কানে ধরলো। বুকের মাঝে উথলে উঠা কান্নারা ঘাপটি মেরে বসে থাকলো সময়ের অপেক্ষায়। ভারী নিঃশ্বাসের সুগভীর কষ্ট প্রকাশযোগ্য হলেই আদর ছন্নছাড়া গলায় বলল,

‘এতো দেরি করে ফেললেন টিকলি? তিনটে দিন..।’

টিকলি তখন ভাবছিলো সে বুঝি বেশি দুর্বল। আদর বোধ হয় এমনি কথা বলে তার সাথে। আদর বোধহয় বিরক্ত। আদরের থেকে তো কোনো রেসপন্স আসেনি এখনো। তারপরও কেনো এই লোকের মুখের বুলিগুলো এতোটা গভীর? টিকলির ভাবনার সুতো ছিড়লো আদরের বাণীতে। সব ভুলে গিয়ে মেয়েলী অহং, দর্প, দম্ভ, বড়াই সব একপাশে ফেলে রেখে সে মোহবিষ্ট গলায় বলল,

‘আপনিও তো ফোন দেননি ডাক্তার। প্রতিবার কেনো আমিই প্রথম?’

আদর চুপ থাকলো। ক্ষণসময় চুপ থেকে বলল, ‘যদি বিরক্ত হন।’

‘তার মানে আমি যে ফোন দিলাম আপনি বিরক্তবোধ করছেন?’

আদর তড়িঘড়ি করে ব্যস্ত কণ্ঠে বলল, ‘না না না টিকলি৷ একদমি না। আপনি ভুল ভাবছেন।’

‘তাহলে সঠিকটা কি ডাক্তার?’

‘সঠিকটা এই যে অসীম ব্যস্ততার মাঝেও বারংবার ফোন হাতে নিয়ে আপনার নাম্বার ডায়াল করেও ফিরে আসা।’

টিকলি চোখ বন্ধ করলো। বন্ধ চোখের কোলে খুশির জোয়ার চিকচিক করলো। টিকলি প্রফুল্লতার হাসি হাসলো। কিছুক্ষণ দু’পক্ষের মাঝে নিবিড় নিস্তব্ধতা চলার পর আদর বলল প্রথম হঠাৎ,

‘দেখা করবেন টিকলি?’

টিকলি চমকে উঠলো। এতোটাই চমকালো যে আকস্মিক কোনো কথা খুঁজে পেলো না। আদর আবার বলল, ‘আপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে।’

মন্ত্রমুগ্ধ গলায় টিকলি বলল, ‘কবে?’

‘ইদানীং তো ব্যস্ত থাকি। সময় হবেনা। ব্যস্ততা কাটুক তারপর সময় নিয়ে নাহয়….।’

আদরের কথার মাঝেই প্রফুল্লচিত্তে টিকলি বলল,

‘সত্যি?’

‘তিন সত্যি।’

চলবে❤️